রাধানগর (Radhanagar) : 03
চাঁদের আলোয় চারদিক থই থই করছে। আমি রায় বাড়ির চত্বর ছেড়ে মাঠের পথ ধরি।
রাসের মেলা চলছে এখন। শুক্লা একাদশী থেকে শুরু হয় এই মেলা। পূর্ণিমা পার করে তবে শেষ হয়।
‘ভাবিয়াছিলাম এ তিন ভুবনে
আর মোর কেহ আছে।
রাধা বলি কেহ শুধাইতে নাই
দাঁড়াব কাহার কাছে।’
দূর থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে। মূল গায়েন একজন মহিলা। তিন-চার জন সঙ্গী, সবাই পুরুষ। খুব সুন্দর গান ইনি। আজ বোধহয় সারা রাত কীর্তন হবে। ইনি ছাড়াও একটা দল এসে বসে আছে।
মন্দির ঘিরে আরও নানান উৎসব হয় সারা বছর। আষাঢ়ে রথযাত্রা দিয়ে শুরু হয়, ফাল্গুনে দোল দিয়ে মোটামুটি শেষ হয়। মাঝে আছে জন্মাষ্টমী, ঝুলন, আর কার্তিকী পূর্ণিমায় এই রাস। বহু দূর থেকে দর্শনার্থীরা আসতে থাকেন কদিন। অন্ধকার হলেই ডায়নামো চলতে থাকে, মন্দিরের সারা অঙ্গে টুনি বালব থাকে। উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক করতে থাকে রাধারানির জরি বসানো লাল বেনারসী, মাধবের নীল বসন। পীত উত্তরীয় আজ রাধারানির গলায়। বসন বদলাবদলি হয় এ সময়ে ঠাকুরের। বাগানে ছোট ছোট খোপ করে কৃষ্ণলীলার নানান দৃশ্য পুতুল দিয়ে প্রদর্শনী করা হয়েছে। ছোটবেলায় এই পুতুল সজ্জার আকর্ষণ ছিল খুব। সারা বছর এইসব পুতুল মন্দিরের পাশের ঘরে, জড়ো করা থাকে, সেটা আবিষ্কার করার পর থেকেই আকর্ষণটা কমে যেতে থাকে। কিন্তু কথকতা আর কীর্তন শোনবার আগ্রহ আমার এখনও যায়নি। কতবার তো শুনেছি ধ্রুব, প্রহ্লাদ, বলিরাজা, অজামিল, জড়ভরতের কাহিনী। পুরনো হয় না। আর কীর্তন? কীর্তন শোনবার আমার একটা বিশেষ প্রণালী আছে। আসরে বসে শুনি না আমি। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াই। ঝলকে ঝলকে গান ভেসে আসে দূর থেকে। ‘রাধে’ বলে টান দিলে, কি ‘কৃষ্ণ’ বলে হাহাকার করে উঠলে চড়াসুরের সেই টান আমার ভেতর থেকে কী সব টেনে বার করে আনে। একমাত্র তখনই আমি বুঝি, ব্যথা-বেদনা আমারও আছে। একটা নি-মানুষের মতো বাঁচলেও, মানুষেরই কষ্ট আমার ভেতরে বাসা বেঁধে রয়েছে।
মাঠের মধ্যে প্রচুর গাছ। জায়গায় জায়গায় জঙ্গল মতো। একটু ছোট্ট টিপি মতন দেখে বসি।
‘বঁধু হে’ বলে একটা চড়া সুরে টান দিয়ে সুরের জাল ছড়িয়ে দেন গায়িকা। হঠাৎ ভেতর থেকে গরম জল উঠে আসে দুই চোখে। আমি হাঁটুর ওপর মুখ রেখে বয়ে যেতে দিই নুনের নদী।
ঘুরে ফিরে গাইতে থাকেন বৈষ্ণবী—
‘এ কূলে ও কূলে দুকূলে গোকুলে
আপনা বলিব কায়।
শীতল বলিয়া শরণ লইনু
ও দুটি কমল পায়।।’
আমি কার পায়ে শরণ নেব? জীবন্ত পা চাই যে আমার। এমন পেতলের রাধামাধবের আমার হবে না, হবে না।
কে যেন আমার মাথায় হাত রাখল। চমকে মুখ তুলে দেখি চেনা-চেনা চেহারা। শিশিরদা না? আমি আর মুখ তুলতেই পারছি না। উনি বোধহয় আমাকে কাঁদতে দেখেই এসে দাঁড়িয়েছেন।
চলো, একটু বেড়ানো যাক— শিশিরদা বললেন।
—তোমাদের এই পুজো কতদিনের, মন্দার! বেড়াতে বেড়াতে উনি জিজ্ঞেস করলেন, অন্য প্রসঙ্গে যেতে পেরে আমি বাঁচি।
—১২৭৩ বঙ্গাব্দে এই সম্পত্তি দেবত্র করা হয়েছিল। ঠাকুরদাদের বাবা পেয়েছিলেন। মন্দির বোধহয় তার আগে থেকেই ছিল।
—উনি কার কাছ থেকে পেয়েছিলেন?
—বোধহয় ওঁর মামার কাছ থেকে।
—আমি কিন্তু অন্য একটা গল্প শুনেছি। শিশিরদা বললেন, মামা নয়, মাতামহ, তোমার প্রপিতামহর মায়ের কাকা না কি নিজের ছেলের ওপর বিরক্ত হয়ে এই নাতিকে সম্পত্তি দেন, কিন্তু মন্দির তৈরি করে সম্পত্তিটা দেবত্র করে দেন। যাতে সম্পত্তিটা নয়ছয় না হয়, আর যাতে ফ্যামিলি একত্র থাকে। তার মানে দেখো মন্দার, সম্পত্তি রক্ষার জন্য নেহাত বৈষয়িক একটা চাল হিসেবে এই মন্দিরের উৎপত্তি। অথচ এখন দেখো জিনিসটা সম্পূর্ণ অন্যরকম দাঁড়িয়েছে।
—অন্যরকম আর কী?
—অন্যরকম নয়? কত লোক আসছে ভক্তি নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে, কত উৎসব। গ্রামাঞ্চলে একটা এ ধরণের উৎসবের কিন্তু ভীষণ মূল্য। দেখো শহরে কতরকম আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা রয়েছে। ইচ্ছে হলেই সিনেমা, পয়সা খরচ করলেই ভাল হলে গান শুনতে পাবে, এগজিবিশনে যেতে তো বেশির ভাগ সময়েই খরচ লাগে নামমাত্র। কিন্তু এসব জায়গায়? তোমাদের রায়েদের এ বাবদে প্রচুর ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আমি বললাম— ওঁরাও তো পাচ্ছেন অনেক।
—ওঁরাও পাচ্ছেন? মানে? —শিশিরদা কেন অবাক হলেন আমি জানি না।
আমি বললাম— প্রণামী পাচ্ছেন, টাকা ছাড়াও কাপড়, গয়না, মেলার দোকানগুলোর সঙ্গে ব্যবস্থার কথা তো সবাই-ই জানে। সম্পত্তি-রক্ষা তো হচ্ছেই। বৃদ্ধিও হচ্ছে নিশ্চয়ই।
শিশিরদা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপরে আস্তে বললেন— তুমি কি এসব নিয়ে ভেবেছ? আলাদা করে?
—না। ভাবলে অন্যায় হবে?
—তা ঠিক নয়। তবে ধরো এতজন মানুষ, তোমাদের ফ্যামিলির কথা বলছি, দেবপূজা নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন তো? বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে হয়তো কিছু উপার্জন হচ্ছে!
আমার মেজঠাকুরদার সেই মন্তব্য—‘ম্যাম বিয়ে করেছে’ মনে পড়ে গেল চকিতে। এঁদের সবার অনুদারতা, স্বভাবের উদাসীনতা, কাঠিন্য এ সবের কথা মনে পড়ে গেল। আমি চুপ করে রইলাম। কী হবে মন্দির করে, নিত্যপূজা করে যদি একজন মাকে এঁরা পথে ঠেলে দিয়ে থাকেন? একজন শিশুকে যদি আপন করতে না পেরে থাকেন? আরও খানিকটা হাঁটবার পর শিশিরদা বললেন— অনেকটা এসে গেছি কিন্তু মন্দার। চলো এবার ফিরি। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি৷
—আমাকে?—আমি অন্ধকারে হাসি।
—কী হল? তোমাকে পৌঁছনোর কথায় হাসলে কেন?
—আমি তো এখানকারই ছেলে। বড়ও তো হয়ে গেছি। যাই … বরং আপনাকেই আমি এগিয়ে দিই।
শিশিরদা থাকেন স্কুলবাড়ির কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। শহর থেকে আসা তিনজন মাস্টারমশাই থাকেন—ঘরটায়। ওখানে আমি পড়াশোনা বুঝে নিতে কি খেলা সংক্রান্ত দরকারে বহুবার গেছি। শিশিরদা আমাদের সঙ্গে খুব খোলাখুলি মেশেনও। তবু আজকের মতো কাছাকাছি ওঁকে কখনও পাইনি।
জিজ্ঞেস করলাম—এখানে থাকতে আপনার কেমন লাগে শিশিরদা?
—রাধানগর আমার খুব ভাল লাগে। এত শান্ত। এত পরিষ্কার হাওয়া! দামোদরের তীরটা এত সুন্দর। তবে কলকাতা ছেড়ে থাকতেও খুব কষ্ট হয় মন্দার।
কলকাতায় থাকতে আমার কেমন লাগবে শিশিরদা! ‘আমার’ কথাটার ওপর আমি জোর দিই। শিশিরদা হাসলেন, বললেন—তুমি যে রকম ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠছ তাতে করে কলকাতা তোমাকে কাবু করতে পারবে বলে মনে হয় না, তবে ভাল লাগা শক্ত। নোংরা আর আওয়াজ এই দুটো জিনিসই তোমাকে সবচেয়ে পীড়া দেবে।
আমি মনে মনে বলি—নোংরা, আওয়াজ এ সব তো বাইরের ব্যাপার। কিন্তু ওই শহর থেকেই উঠে আসত আমার একমাত্র আপনজন। ওই শহরেই সে হারিয়ে আছে। উপরন্তু শিশিরদা আপনি, অপর হলেও আপনি এত আপন আমার, আপনিও এসেছেন ওই শহর থেকেই, কিছু না কিছু গুণ তো ও শহরের আছেই!
—তোমার কি রাধানগর ভাল লাগে না? অনেকক্ষণ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শিশিরদা বললেন।
আমি বললাম—কী জানি?
—সে কী? ভাল লাগে কি লাগে না জানো না? অবশ্য তোমার বয়সে জন্মভূমি খুব একঘেঁয়ে লাগবারই কথা। নিস্তরঙ্গ জীবন, বৈচিত্র্য নেই…তোমাদের এখন রক্ত টগবগ করে ফুটছে, অ্যাকশন…অ্যাকশনের জন্যে এখন তোমরা ছটফট করছ, তাই না?
—কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া করতে কি আমার খুব অসুবিধে হবে? —আমি জিজ্ঞেস করি।
—না, অসুবিধে কেন? ওখানে প্রতিযোগিতাটা বেশি। সংখ্যাও বেশি। এত মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার, দিশেহারা হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থাকেই।
—শিশিরদা, আমার পক্ষে কতটা ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব? এই ফাইন্যাল পরীক্ষায়?
—আরে, সেটা তো আমিই তোমায় জিজ্ঞেস করব!
—কলকাতায় পড়বার জন্যে আমি আমার পক্ষে যতটা পড়াশোনা করা সম্ভব করছি। আমি একটুও ফাঁকি দেব না। কিন্তু কতটা ভাল করতে পারব সেটা তো আমি জানি না, তাই জিজ্ঞেস করছি।
—তুমি ভাল ছেলে মন্দার, ভাষাগুলো ভাল শিখেছ, অঙ্কের মাথা তোমার পরিষ্কার। বিজ্ঞান আমরা যতটা শেখাতে পেরেছি শিখেছ। ভাল করারই তো কথা।
—শিশিরদা, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?
—কী ব্যাপারে? কলকাতায় যাওয়ার ব্যাপারে?
—হ্যাঁ।
—তোমার বাড়ি থেকে যদি যেতে দিতে না চান…..ওঁরা কী বলবেন…
—ওঁরা কিছু বলবেন না, সেটা কোনও কথা না। আসলে শিশিরদা আমার তো টাকাপয়সা নেই।
—মানে? কী বলছ মন্দার? শিশিরদা অবাক হয়ে গেছেন। রায়বাড়ির ছেলে তুমি…তোমার? নাঃ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
—যতদিন এখানে আছি , ঠিক আছে। কিন্তু দূরে চলে গেলে এঁরা আমার খরচ দেবেন কেন? দেবেন না…। আমার তো কেউ নেই এখানে…।
—কেন? তোমার বাবা? জ্যাঠা-কাকারা, এত আত্মীয়স্বজন অথচ…
আমি কী বলব! চুপ করেই রইলাম।
—কলকাতায় ধরুন, বাচ্চাদের পড়াতে পারি। দিনের বেলায় কলেজ করলাম। সন্ধেবেলায়… এ ভাবে তো অনেকেই চালায়, এরকম কিছু যদি আপনি জোগাড় করে দেন…
শিশিরদা খাপছাড়াভাবে বলে উঠলেন—এই মন্দির, পুজো, এত উৎসব, এত মানুষের সমাগম…এগুলো দেখতে দেখতেই তো তুমি বেড়ে উঠেছ মন্দার, সবাইকেই নিশ্চয় কোনও না কোনওভাবে এ সবের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়, এক জেনারেশন চলে গেলে আরেক জেনারেশনকে এ সব ভার নিতে হয়। তুমি…তুমি…তোমাকেও নিশ্চয় নিতে হবে… সে জন্যেই কি তোমার এ সব ভাল লাগে না, না?
তার মানে উনি ভেবে নিয়েছেন আমি বিদ্রোহী, পারিবারিক পূজা অর্চনা এগুলো আমাকে টানে না, বরং এগুলোর আওতা ছেড়ে আমি বেরোতে চাই।
—ইয়াং ম্যান…তোমার অবশ্য ভাল না লাগতেই পারে…কিন্তু তার জন্য ওঁরা তোমাকে একেবারে ত্যাগ করবেন এ কথা ভাবছ কেন? কোনও নিয়ম আছে না কি এ ব্যাপারে?
কোনও নিয়মের কথা আমি জানি না। এ বাড়ির ছেলেরা বাইরে পড়তে যায়নি এমনও নয়। তবে কম। বাইরে পড়তে গেলেও এঁরা শেষ পর্যন্ত এখানেই ফিরে আসেন। সেটা কোনও নিয়মের জন্যে কি না কী করে জানব? কিন্তু আমি যে এঁদের কেউ না, রায়বাড়ির অবহেলার দানে এত বড়টা হয়েছি তা কী করে শিশিরদাকে বোঝাব। মোটের ওপর আমি এঁদের ওপর নির্ভর করে আর থাকতে চাই না। কারও ওপরেই না।
শিশিরদা বললেন—তোমাকে আমি যতদূর পারি সাহায্য করব মন্দার। কিন্তু বাস্তব তো অত সহজ নয়! ট্যুইশনি করলে আর সেই উপার্জনে পড়লে শহরে থাকলে এতটা সম্ভব না-ও হতে পারে। তোমার অল্পবয়স, চট করে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে কাজ করারই বয়স। কিন্তু একটু ভাবনা-চিন্তা করে না চললে বিপদে পড়ে যাবে মন্দার। যাক গে তুমি এ সব না ভেবে মন দিয়ে পড়াশোনাটা করো।
শিশিরদা কি ভয় পেলেন? বড়লোকের ছেলেকে পড়াশোনা খেলাধুলায় সাহায্য করা এক জিনিস আর আমার মতো হতভাগার দায়িত্ব নেওয়া আরেক। না শিশিরদা, সামান্যতম সাহায্যের চেয়ে বেশি কিছু আপনার কাছ থেকে চাইব না আমি। চাওয়ার মনটাই আমার তৈরি হয়ে ওঠেনি। আপনাকে আমি বোঝাতে পারিনি এ বাড়ির আমি কেউ নয়। কারও সঙ্গে আমার কোনও মিল নেই। আত্মীয়তা নেই, বন্ধুত্ব নেই। কিন্তু বোঝাতে তো আমাকে হবেই, যদি আপনার সাহায্য চাই!
হঠাৎ বললাম—শিশিরদা, আপনি ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলেছেন? হেসে ফেললেন উনি—এখন কি তোমার লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছে করছে না কি মন্দার?
—না, আমি একবার ছোটবেলায় এই রায়বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছিলাম, সেটা মনে পড়ল।
—রায়বাড়ির ছেলেমেয়ে মানে? তোমার জাড়তুতো খুড়তুতো ভাইবোনেরা?
—হ্যাঁ
—তো একবার বলছ কেন? মাত্র একবারই খেলেছ?
—খুব বেশি খেলিনি, তবে একবারের চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই। শেষবারের কথাটাই খুব ভাল করে মনে আছে। সত্য, নিতাই এদের তো চেনেন? পঞ্চানন, গায়ত্রী…?
—হ্যাঁ, চিনি…
—ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিলাম। খুব জমেছিল খেলাটা। এক এক জন চোর হচ্ছিল, আর তাকে চোখ বন্ধ করে উল্টো মুখে বসিয়ে দিয়ে আমরা অন্যরা লুকোচ্ছিলাম। আমাদের উঠোনের চার পাশে কত গাছপালা দেখেছেন তো? ওইসব ঝোপঝাড় গাছপালাতেই লুকোচ্ছিলাম। তারপর শিশিরদা, একবার আমি চোর হলাম। আমাকেও চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে হল। চোখ বুজিয়ে বসে আছি আর ছড়া কাটছি।
আমপাতা জোড়া জোড়া
মারবো চাবুক চলবে ঘোড়া
ওরে সেপাই সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া…।
সাধারণত এই ছড়াটা বলতে বলতেই ওদের লুকোনো হয়ে যায়। হয়ে গেলেই ‘কু’ বলে ডাক দেবে একজন। আমার খোঁজা তখন শুরু হবে। তো আমি বসেই আছি, ‘কু’আওয়াজ আর শুনতেই পাইনা। শেষে ধৈর্য হারিয়ে উঠে পড়ি। কী দেখি জানেন?
—কী?
—দেখি ওরা লুকোয়ইনি। গায়ত্রী আর সাবিত্রী রান্নাবাড়ির রোয়াকে বসে বাঘবন্দি খেলছে। সত্য আর নিতাই দুজনে দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাকিরা সব বাড়ি চলে গেছে।
—ওইভাবে বসিয়ে? ঠকাচ্ছিল না কি!
—না তো!
—তবে কি সন্ধে হয়ে গিয়েছিল?
—তাও তো না।
—তুমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করনি?
—নাঃ
—তোমাকে উঠে আসতে দেখেও কেউ কিছু বলল না?
—না।
—আশ্চর্য তো। এলেবেলে না কি?
—তা-ই বোধহয়। তবে সে কথাও কেউ তো আমাকে মুখ ফুটে বলেনি।
—আমি এখানে এইচ. জি ওয়েলস-এর সেই ‘ইনভিজিবল ম্যান’-এর মতো, আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। আমায় কেউ দেখতে পায় না। এক হিসেবে তাই আমি নেই। এক একসময়ে সন্দেহ হয় আমি কারও কল্পনা। সত্যি কোনও অস্তিত্ব নয়।
—কী বললে? তুমি কারও কল্পনা?
—হ্যাঁ ধরুন—কেউ আমাকে ভেবেছে। আমি একটা সত্যি মানুষ নয়। লেখকরা চরিত্র ভাবেন না? ধরুন বেকার স্ট্রিটের যে ঠিকানায় শার্লক হোমস-এর আস্তানা, সেখানে গিয়ে যদি আমরা হোমস-এর খোঁজ করি। পাব? পাব না। কনান ডয়েল বানিয়েছেন ওটা। আমার রাধানগরের ঠিকানাটাও কারও বানানো। আমিও বানানো। অবাস্তব। না হলে এমন হবে কেন?
শিশিরদা আমার কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন—তুমি বড্ড একা মন্দার, তোমার কোনও বন্ধু নেই? তারক? তারক পাল তো তোমার বন্ধু। খেলাধুলো করছ এত। বন্ধু হয় না কেন তোমার? ব্রুড করবে না একদম, ওটা খুব অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। …আর মন্দার, সে ভাবে দেখতে গেলে তো আমরা সকলেই বানানো …ঈশ্বরের। ফিরে আবার আমরাও ঈশ্বরকে বানাই, এই রাধামাধবের মধ্যে যেমন বানিয়ে তুলেছি।
আমি কিছু বলি না। শিশিরদা বোধহয় ভাবছেন, আমার মাথার গোলমাল হয়েছে। তবে, আমার অবস্থাটা মনে হয় উনি ঠিক না বুঝলেও, খানিকটা অনুভব করতে পেরেছেন।
একটা বাঁকের মুখে এসে উনি নিজের পথে চলে যান। আমিও আমার পথ ধরি।
আগের গানটা শেষ হয়ে গেছে, এখন পুরুষ গায়কের গলা শুনতে পাচ্ছি—
এখন তখন করি দিবস গমাওল,
দিবস দিবস করি মাসা,
মাস মাস করি বরষ গমাওল,
ছোড়লুঁ জীবন আশা॥
আ-হ্! আমি যদি গান গাইতে পারতাম!
একমাত্র গানের মধ্যে দিয়েই, মানে এই কীর্তন গানের মধ্যে দিয়েই আমি স্নেহ-ভালবাসা-আবেগ-অনুভূতির জীবন্ত জগৎটার খোঁজ পাই। আমি নিজেও তখন জীবন্ত হয়ে উঠি। শরীরে, মনে। মাথা টিপটিপ করে, বুক হু হু করে, আমার পেটে, তলপেটে একটা আলাদা জীবনস্পন্দন আছে বুঝতে পারি। আপনজনের জন্য কান্না আমার শিরায় শিরায় চারিয়ে যায়। রাধার গান, কৃষ্ণের গানে ওই যে বিরহ, সে তো নারীপুরুষের প্রেম-বিরহের কথা বলছে! আমার কিন্তু মনে হত একজন বা একাধিক অনির্দিষ্ট প্রিয়জনের কথা। এখন-তখন করে দিবস চলে যাচ্ছে, দিবস দিবস করে মাস, মাস মাস করে বছর … এ যেন আমারই কথা। এতদিন চলে যায় আমার মা আসে না। মা হচ্ছে সমস্ত প্রিয় সম্পর্কের প্রতিনিধি আমার কাছে। একটা স্তর টপকে তো আরেকটা স্তরে যাওয়া কঠিন! তাই হয়তো শৈশবের আকাঙ্ক্ষা টপকে আমি যৌবনের আকাঙক্ষাতেও পৌঁছতে পারি না।
গান ছাড়া অন্য সময়ে আমি যে চেতনায় বাস করি, সেটা প্রায় অনুভূতিহীন। সম্পূর্ণ ব্যবহারিক কিছু কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাথরের মতো নিরেট একটা অস্তিত্ব। খাচ্ছে, দাচ্ছে, খেলাধুলো করছে, পড়াশোনা করছে একটা যন্ত্র, একটা যন্ত্রমানুষ, দম দিয়ে তাকে চালু করে দিয়েছে কেউ।