রাধানগর (Radhanagar) : 13
—কী হয়েছিল আমার? — এক ঢোঁক ফলের রস ফীডিং কাপে করে আমার মুখে ঢেলে দিয়েছে মন্দাকিনী। ও কোনও জবাব দিচ্ছে না।
—ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া? আমি প্রশ্ন করি।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে চায় ও। কী করে জানলে?
—স্বপ্নে কেউ আমায় বলল। বলে গেল।
—ও, স্বপ্নে? তবে ওটা তোমার বাইরের রোগ মন্দার, আসল রোগটা অন্য।
—কী?
—আসল রোগটার নাম হল — মান। মান হয়েছিল তোমার। এখনও সেটা সেরেছে কি না জানি না। ওর মুখে মৃদু হাসি।
—মান সারে না, ভাঙে। — আমি বললাম।
—তাও তো বটে। শেয়ালদায় সেই চাতালটাতে বসে বসে সারারাত মশার কামড় খেয়েছিলে, মনে আছে?
আমি মাথা নাড়ি।
—তখনই ওই মশাগুলো তোমাকে কামড়েছিল। রাত দশটার পর ওগুলো বেরোয় তো! যাক ঠাট্টা-টাট্টার মুডে আছ। — ও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ঘরটার চারদিকে চেয়ে দেখি। এটাই আপাতত আমার ভবিতব্য। নিয়তি আমাকে বারবার এখানে এনে ফেলছে। আমি তো এখানে আসতে চাইনি! এদের কাছে আশ্রয় চাইনি। — বরং পালাতে চেয়েছি। তবু আমার দু’ দুটো মারাত্মক বিপদের সময়ে এই মন্দাকিনী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরাই আমাকে উদ্ধার করেছে। এই মিসেস এলা আইলিন চৌধুরীই আমায় আশ্রয় দিয়েছেন। ইরাবতীর ওপর আমার রাগ হতে পারে। কিন্তু সে রাগ এঁদের ওপর ফলানো বোধহয় ঠিক হয়নি। আমার কাছে এঁদের কিছু পূর্বজন্মের ঋণ রয়ে গেছে, আর এঁদের কাছে আমার ঋণ এই জন্মেরই। ঋণ অনেক।
খুব ক্ষীণ হয়ে গেছে স্বর আমার, জিজ্ঞেস করলাম — কী করে আমার খোঁজ পেলে? — মন্দাকিনীকে একটু রোগা লাগল। চোখগুলো কেমন ক্লান্ত।
—স্টিফেন তো সারাক্ষণ তোমার পেছন-পেছন ছিল। তুমি টের পাওনি? —ও বলল।
—না তো। কেন?
—কোথায় যাও দেখতে, বাড়িটা চিনে আসতে। আমি মাইকেল রুডি তিনজনে গিয়ে চিনে এলাম আবার। রুডি তো সারারাত পাহারা দিয়েছে।
—কেন?
—তুমি জিজ্ঞেস করছ মন্দার? এ কথা জিজ্ঞেস করছ? কী অবস্থা আমাদের! দিয়া তো পাগলের মতো করছিল, তা জানো? আমাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছে। তুমি একটা বোকা ছেলে, কলকাতায় নতুন, রাত্তির দশটার সময়ে হোটেলে থাকবে বলে বেরিয়ে যাচ্ছ। রাখালবাবু তো কিছুই নয়। যদি গুণ্ডা বদমাসদের হাতে পড়তে? ভোরবেলা রথীদের বাড়িতে ডাক্তার ঢুকতে দেখে রুডিরা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছো। তখন আমি আর দিয়া গেলাম রথীদের বাড়ি।
—দিদিমা গেলেন?
—যাবেন না? কী যে বলো! গেলেন, ওঁরা তো একেবারে অবাক। তবে সবকিছু ওদের কাছে প্রমাণ করা খুব মুশকিল হল।
—কী প্রমাণ? কীসের?
—এই আমাদের আইডেনটিটি। তোমার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।
—আমি কি হাসপাতালে ছিলাম?
—এটাও কি তোমাকে কেউ স্বপ্নে বলে গেল?
—ধরো তাই।
—ছিলে। তুমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছ মন্দার।
আমি দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে রইলাম। এত দুর্বল, যে কথা বলা তো দূরের কথা, কিছুক্ষণ অন্যের কথা শুনলেও আমার ক্লান্তিতে ঘুম এসে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারি দিদিমা, দিয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আহ্, এইভাবেই যদি ভেসে চলে যেতে পারতাম।
ভোরবেলা একবার ঘুম ভাঙে আমার। ঠিক ভোরও নয়। শেষ রাত। ঘরে একটা নীলচে আলো জ্বলে। সেই আলোতে ঘরের আসবাবপত্রগুলো কেমন অলৌকিক মনে হয়। কেমন একটা বিভ্রম হয় আমার। যেন কোনও অন্য জন্মে চলে গেছি। স্মৃতির জলের তলায় ভেসে আছে এই সব দেরাজ, আলমারি, টেবিল। দেয়ালে ঠিক আমার সামনে একটা ফটো। পাশাপাশি বসে আছেন আইলিন আর তাঁর স্বামী, আমার দাদামশাই। কৌচের হাতলের ওপর আইলিন, একটা নীল সিল্কের শাড়ি পরে, চুলটা ফাঁপানো, প্রচুর গয়না পরে আছেন, মাথার চুলগুলো খোঁপা করে বাঁধা, মুখটা সামান্য একদিকে কাত করা, তাই খোঁপা, খোঁপায় রুপোর কাঁটা দেখা যাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা নেই আইলিনের। পাতলা মুখ, নীল চোখ, দুধেআলতা রং,—ঠিক যেন আমাদের ঠাকুরবাড়ির রাধারানি। —কৌচে বসে বিনয়ভূষণ। উনি পরেছেন হালকা হলুদ রঙের যোধপুরী, সেই রঙেরই, বোধহয় একটু গাঢ় শেডের শেরওয়ানি, তাতে বোতামপটির পাশে জরির কাজ। দিদিমা যদি রাধারানি হন তো ইনি হলেন কৃষ্ণ কালো, তমাল কালো। যে চিত্রকর এই ফটোতে রং লাগিয়েছেন, তিনি যেন রাধামাধবকে মনে করেই রং ব্যবহার করেছেন। এই শেষরাতে সবই কেমন অর্থময়, মনে হয় রাধানগরেই আছি। একটু ঘুরলেই দেখতে পাব রাধামাধবের মন্দির। ঠাকুরমশাই ঠাকুর সাজাচ্ছেন। প্রভাতী গাইছেন ছোট চক্কোত্তি। ছোটবেলাকার অভ্যস্ত আবহাওয়াটা সম্ভবত মানুষের চেতনার মধ্যে একেবারে ঢুকে থাকে। কোথাও একটা ছোট্ট মিল পেলেই একেবারে অন্যরকম, বিপরীত বা বিদেশি আবহাওয়াতেও টুক করে ঢুকে পড়ে। ক্রমশ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। এই যে ভোরবেলাটায় আমার এলিয়ট রোডের বাড়ির এই দক্ষিণের ঘরখানাকে রাধানগর-রাধানগর লাগে, কী মিল আছে দুটোতে? মিল তো নেই-ই, বরং চূড়ান্ত অমিল। চমৎকার চমৎকার আসবাবপত্রে সাজানো এই ঘরের সঙ্গে আমার সেই পশ্চিমের ঘরের সামান্যতম সম্পর্কও নেই। তবু পুরো রাধানগরীয় আলো-হাওয়া ঢুকে পড়ল এখানে এই ভোরবেলা আর ওই ফটোগ্রাফটাকে কেন্দ্র করে।
দক্ষিণের জানলার পর্দা একটু সরিয়ে দিই। ভোরবেলার ধারহীন রোদের একটা ভোঁতা-ভোঁতা ফলা বেঁকে পড়ে ওই ফটোগ্রাফটার ওপর। মেমসাহেব বলে মনে হয় না ওঁকে, মনে হয় একজন অসামান্য সুন্দরী, এমন সুন্দরী যাঁকে ঠিক আমাদের পরিচিত দেশজ মুখশ্রীতে কখনও দেখা যাবে না। এই সুন্দরী একজন বিস্ময়, সবসময়ে একটা চমক দেন ইনি। সেইজন্য যেন একটু বিদেশি-বিদেশি মুখে রাধার আদল আরও খুলেছে।
‘কাঞ্চন বরণী কে বটে সে ধনী
ধীরে ধীরে চলি যায়
হাসির ঠমকে চপলা চমকে
নীল শাড়ি শোভে গায়,’
‘গোরোচনা-গোরী-নবীন কিশোরী’ নয় এই আইলিন? এঁর রঙে লালচে ভাব। তবু এঁকে দেখলেই মনে হয় ‘যঁহা যঁহা ঝলকত অঙ্গ তঁহি-তঁহি বিজুরী-তরঙ্গ।’ একটু যে মুখ কাত করে তাকিয়ে রয়েছেন বিনয়ভূষণের দিকে তাতেই যেন বিজুরি-তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। আবার যে মুগ্ধতা, সজীবতা আইলিনের হাবে-ভাবে, — বিনয়ভূষণের মধ্যে তার কিছুই নেই। তিনি সত্যিই একটা তমালগাছের মতো, কালো, স্তব্ধ, মগ্ন। কেমন একটা বিষণ্ণতা ওঁর মুখে। আমাদের রাধামাধবের পেতলের মূর্তিতে খুব গতানুগতিক ভঙ্গিতে আয়ত চোখ, টানা ভুরু আর হাসিমুখ আঁকা, মাধবের মূর্তিটা কালো রং করা। হাতে বাঁশি, কিন্তু সে মূর্তিও আমার কেমন বিষণ্ণ-বিষণ্ণ লাগত। পুরো রাধানগরটাকেই উঠিয়ে নিয়ে এল এই ঘরে ওই ফটোগ্রাফ। ছোট্ট ছোট্ট কাশ্মীরি শাল দিয়ে মূর্তি দুটির অঙ্গ ঢেকে দেন ঠাকুরমশাই এমনই শীতে। রাত্তিরবেলায় হালকা নীল সার্টিনের লেপ ঢাকা দিয়ে শোন রাধামাধব। পৌষসংক্রান্তির দিনে কনকনে হাওয়া বইলে ঠাকুরমশাই বলেন ‘আজ আর স্নান দিয়া কাজ নাই।’ তুলসীপাতা বুলিয়ে ঠাকুরের শুদ্ধিকৰ্ম সারেন তিনি।
শুনেছি এ ঘরটা আমার মাসির। মাসি মিলির একটা সাদা কালো ফটোগ্রাফ আছে ঘরে। ঠিক আমার পড়ার টেবিলের পেছনের দেয়ালে। গালে হাত দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে মাসি। চোখগুলোর দৃষ্টি একটু নীচের দিকে, একটু দূরের দিকে। ছায়াময় এই ছবির মানুষটি একেবারেই অল্পবয়সী। হয়তো আমাদের মতোই হবে। এক আধ বছরের ছোটও হতে পারে। গাল গলার গোল-গোল ভাবে —অল্পবয়সটা বোঝা যায়। কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা খুব পরিণত। যেন অনেক জেনেছে, অনেক বুঝেছে, তারপরে চুপচাপ শুধু তাকিয়ে আছে। কিছু বলা বৃথা, শুধু দেখে যাও —এই রকমই যেন বাণী ছবিটার। এ হল আরেক রাধিকা। না আমার দিদিমার মতো, না আমার মায়ের মতো। সাদা-কালো ফটোতে তো রং বোঝা যায় না। তবু মনে হয় ইনি শ্যামলী। দিদিমার মতো কমলিনী গোরীও নয়, আর আমার মায়ের মতো জ্বলজ্বলে বিজলী-গোরীও নন। মায়ের মুখটা যেমন ঈষৎ লম্বাটে, এর মুখটা একটু চৌকো ধাঁচের। চিবুকে একটা সুন্দর ভাঁজ, মায়ের চোখ চেরা চেরা, মাসির চোখ বড়বড়, পালক ছাওয়া, যেন আমাদের রাধানগরের পশ্চিমপুকুর, পাড়ে ভর্তি কলাগাছ, বেশি কেউ যায় না। নির্জন, পাখির ডাকে ভরা।
আমি চোখ বুজিয়ে ফেলি। এতক্ষণ চেয়ে থেকে থেকে আমার আবার ঘুম এসে গেছে।
এই ঘুম ভাঙাবে খালেদা-দিদি চমৎকার এক কাপ চা দিয়ে। এই সময়ের ঘুমটা কখনও খুব গভীর হয় না। হঠাৎ নিজেরই খেয়াল হয় আমি আসলে ভাবছি। ভাবছি দুটো মুখ। দেখছি। —মন্দাকিনী আর ইরাবতী। ইরাবতীর ওপর থেকে সেই বিধ্বংসী ক্রোধ বা তিক্ততা এখন আমার চলে গেছে। ওটা যেন একটা ঘুমিয়ে-থাকা ব্যথার জায়গা। — টিপলে বোঝা যায় আছে, কিন্তু সব সময়ে অনুভব করা যায় না। দিদিমা বলেন ‘ডলি’। দিদিমার এই ডলিকে আমি ভাল করে চিনতে পারি না। আমার মা সোজা হয়ে হেঁটে যেত রাধানগরের মেঠো-মেঠো রাস্তা দিয়ে। মাথায় ছোট চুল, সাধারণের চেয়ে একটু বেশি লম্বা, জ্বলজ্বলে চেহারা, জোরালো ধরন ধারণ, আমাদের দুর্গা কিম্বা জগদ্ধাত্রী-ঠাকুরের মতো। মা আমার মুখে চকলেট পুরে দিত, আমরা একসঙ্গে বসে চাইনিজ-চেকার খেলতাম, সাপলুডো খেলতাম, মা আমাকে অ্যাণ্ডারসেনের ফেয়ারি টেইলস-এর বই ধরে ধরে ইংরেজি শেখাত, টুনটুনির বই, ছোটদের রামায়ণ, ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী মা আমাকে কিনে দিয়েছিল। আজ পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ‘রাজকাহিনী।’ কিন্তু মন্দাকিনী বলেছে মা কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য রাধানগরে যেত। আমার জন্যে নয়। তা হলে ওই ‘ক্ষীরের পুতুল’ ‘রাজকাহিনী’ বা বিস্কুট-চকলেটের প্যাকেটের মানে কী? মানে কী সেই মেরুন সোয়েটারের যার ওপরে মিকি মাউস আর ডোনাল্ড ডাক বোনা ছিল?
মন্দাকিনীকে আমি ভাল বুঝতে পারি না। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় মন্দাকিনীকে আমার কেমন লাগে, তারও কোনও সোজা জবাব আমি দিতে পারব না। ডলি বলে যে মানুষটির উল্লেখ করেন দিদিমা, মন্দাকিনীর মধ্যে তাকেই যেন দেখা যায়। — বেপরোয়া, ডানপিটে, দলের পাণ্ডাগিরিতে পটু, একটু খেয়ালি, একটু কি নিষ্ঠুরও? ওকে বোন বলেও ভাবতে পারি না আমি কিছুতেই। আঠারো বছর বয়সে কি আর নতুন করে কাউকে বোন ভাবা যায়? আর, আমি যেহেতু এতকাল একা একা কাটিয়েছি, ভাই, বোন এ সব সংস্কার আমার ভেতরেই নেই। মন্দাকিনী বড় জোর একজন আত্মীয়, যে অনেকটা বন্ধু হয়ে গেছে। তবে প্রথম প্রথম মন্দাকিনীর রূপ, তার সপ্রতিভতা যেমন আমার চোখ ঝলসে দিত, আমাকে কুঁকড়ে দিত, এখন আর সেটা হয় না। খুব তাড়াতাড়ি আমি সাবালক হয়ে উঠেছি। কেউ আর আমাকে দমাতে পারবে না।
চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়েছিলাম।
—মন্দার! জেগে আছ! খুব সন্তর্পণে নরম গলায় ডাকলেন দিয়া।
চোখ মেলে দেখি ওঁর হাতে চা।
—আপনি?
উনি হাসলেন— নাও, চা নাও। আজকে আমার পূজা হয়ে গেছে।
দেখি উনি একটা ঈষৎ হলুদ আভার শাড়ি পরেছেন। চুলগুলো পিঠের ওপর মেলা। কপালে একটা চন্দনের টিপ।
কী পুজো ইনি করেন রোজ রোজ জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ হয়। মন্দাকিনীর কাছে আমি যতটা স্বচ্ছন্দ, এঁর কাছে ঠিক ততটাই আড়ষ্ট।
—কেমন বোধ করছ আজ?
—ভাল। আর কয়েকদিনের মধ্যেই কলেজ যেতে পারব।
উনি একেক সময়ে কেমন নির্নিমেষে চেয়ে থাকেন আমার দিকে। আমার ভীষণ অস্বস্তি হয়।
বললেন— তা বোধ হয় পারবে না। বাসের ভিড় আছে। সে সব কাটিয়ে যাওয়া তো! যদি একটা গাড়ি থাকত। অবশ্য খুব দরকার হলে তুমি ট্যাক্সি করে যেতে পারো। তা সে-ও এখনও দেরি আছে।
এটা অবশ্য আমি মনে মনে জানিই। আমি পারব না। উঠে যখনই বাথরুমে যাই, আমার মাথা ঘুরতে থাকে। এই দুর্বলতা কাটানোর জন্যে আমাকে রোজ ডিম খেতে হচ্ছে। ডাক্তার বলছিলেন মুরগির জুস খেলে তাড়াতাড়ি বল পাব, কিন্তু সে আমি খেতে পারব না। একদিন মন্দাকিনী খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল। তাতে আমার এমন বিধ্বংসী বমি হয় যে দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করা হয় নি।
—কী ভাবছিলে শুয়ে শুয়ে? কী ভাবো? —উনি জিজ্ঞাসা করলেন।
—ভাবিনি, দেখছিলাম।
—কী?
—আমি ফটোগ্রাফটা আঙুল দিয়ে দেখাই।
উনি কি একটু লাল হলেন? ওঁর মতো প্রৌঢ়া আমি দেখিনি। ওঁর হাবভাব এখনও কিশোরীর মতো। চলাফেরা করেন নিঃশব্দে, হালকা পায়ে। যখন চলে যান, মুখ তুলে না দেখলে মনে হবে কোনও অল্পবয়স্ক মেয়ে চলে গেল বুঝি বা। হাত দুটো, বিশেষ করে হাতের পাতায় একটা শুকনো ভাব। মুখে কয়েকটা খয়েরি খয়েরি তিলের মতো। কিন্তু চোখ মুখের একটা ক্লান্ত ভাব, লাল চুলের মধ্যে একটা বিবর্ণতা, কপালের ওপরে কয়েকটা হালকা দাগ আর কয়েকটা রুপোলি চুল এ ছাড়া ওঁকে ঠিক প্রৌঢ়াও যেন বলা যায় না। দুঃখের আঁচে উনি যেন শুকিয়ে গেছেন, এমনটা মনে হয়। ওই ফটোগ্রাফের ফুটন্ত ফুলের মতো আইলিন আর নেই। ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে উঠেছে। কিন্তু ফুলই। হঠাৎ আমার মনে হল ‘বিরতি আহারে। রাঙা বাস পরে। যেমতি যোগিনী পারা।’
এই সব পদ আমাদের ঠাকুরবাড়ির হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়, ঝুলন, রাস, দোল, জন্মাষ্টমী উপলক্ষে যে সমস্ত কীর্তনিয়া, কথকঠাকুর, নানা দেশের বৈষ্ণব জড়ো হন তাঁদের কথাবার্তায় গানে এই সমস্ত পদ ঘুরে ফিরে আসে, আমার স্মৃতিতে এগুলো গেঁথে আছে। আমি জানি না এ সব কার পদ, কিন্তু ওই বুলি ওই গান আমার হাত পা যেমন নিজস্ব তেমনই নিজস্ব হয়ে গেছে। কলকাতায় এসে যেটা আমার সবচেয়ে অসুবিধের ব্যাপার হয়ে গেছে সেটা হল ভাষা। এরা, কলকাতার ছেলেরা কেমন ভাঙা-ভাঙা ভাষায় কথা বলে। শব্দগুলো উচ্চারণ করে খুব অবহেলার সঙ্গে। যেন উচ্চারণের যোগ্যই নয় সেগুলো। আমি গোটা গোটা করে কথা বলতে অভ্যস্ত। আমি যদি এই সব পদ উদ্ধৃত করি ওরা আমার পেছনে লাগবে। এমনিতেই ওরা বলে ‘এই যে মন্দার মহারাজ কেমন আছেন?’ আমি অবশ্য বলি, ‘কেমন আছেন’-টা চলবে না—বলতে হবে ‘কুশল তো?’ তখন ওরা খুব হাসে। কিন্তু আমি কী করে আঠারো বছর ধরে শেখা আমার ভাষা, আমার চিন্তাধারা সব পাল্টে ফেলি?
আজ সকালবেলা দিদিমাকে দেখে ওই চরণগুলো মনে এল—
বিরতি আহারে/ রাঙা বাস পরে/ যেমতি যোগিনী পারা।
উনি বললেন— কবেকার ফটো! তখন সবে মাস ছয়েক আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম উনি, দাদামশাই অত বিষণ্ণ কেন?
দিদিমা চমকে উঠলেন, বললেন— বিষণ্ণ, না? আমি তখন বুঝতে পারিনি, পরে মনে হয়েছিল। তোমারও মনে হচ্ছে?
আমি মাথা নাড়ি।
উনি বললেন— তোমার দাদাকে তাঁর বাবা তো আর বাড়ি ঢুকতেই দিলেন না। হি ওয়জ ডিজওন্ড্। তাই-ই হয়তো! ফটোটা দেখে তোমার আর কী মনে হচ্ছে?
আমি বললাম— রাধাকৃষ্ণ।
উনি আবারও চমকে উঠলেন। আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। মন্দাকিনী ঢুকল। রাত পোশাকের ওপর একটা আলগা লাল কার্ডিগ্যান পরেছে ও। চুলগুলো রুক্ষ এলোমেলো হয়ে বেরিয়েছে। মুখে চোখে খুব কষে জল দিয়েছে বোধহয়, লাল হয়ে আছে মুখটা। সামনের চুলে কয়েক ফোঁটা জলও লেগে রয়েছে। হেসে বলল—
‘আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর?’
আমি বললাম— গুড মর্নিং।