রাধানগর (Radhanagar) : 11
দিয়ার নাতিকে দিয়ার কাছে এনে দিয়েছি। কী খুশি বুড়ি! পরদিন সকালে দেখি ভোর-ভোর উঠল। দুখানা শাল মুড়ি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেছে। খালেদাটাও বুড়ি হয়েছে। দেখি ঘুমোচ্ছে। নাতি এসেছে মিসেস এলা চৌধুরীর, খালেদা বিবির তো আর নয়! আমিই চা-টা করলাম। …পেছন থেকে কাপটা কোলের কাছে বাড়িয়ে ধরেছি। বুড়ি বলল— খালেদ, ছেলেটাকে ভাল করে দেখেছিস?
আমি বলি— হুঁ।
—কার মতো বল তো!
আমি সামনে দাঁড়িয়ে বললাম— কার মতো?
—ওমা তুই? —মুখটা সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
—কার মতো বলো? —আমি আবার জিজ্ঞেস করি।
—না, জিজ্ঞেস করছিলাম। তুই-ই বল না।
আমি বললাম— ঠিক একটা ছেলের মতো। একটা উজবুক, শহরের চাল-চলন জানে না, এসেই বিপদে পড়েছে এই রকম একটা গাঁইয়া হাঁদা ছেলে।
—আর দু-চার দিন পরে দেখবি এমন চালাক-চতুর হয়ে গেছে, যে তোরই কান কেটে নেবে।
—তা হতেই পারে, তুমি যদি ট্রেইনিং দাও আর তোমার মেয়ের এক কণাও যদি পেয়ে থাকে।
দিয়া চুপ করে রইল। সেদিন থেকে আমি একবারও জিজ্ঞেস করিনি দু’ভাই বোন কী করে একই মাসের মধ্যে পাঁচ দিনের তফাতে জন্মায়। দিয়া বারবার আমাকে বলতে গেছে। আমি হাত তুলে থামিয়ে দিয়েছি। এতদিন একটা আষাঢ়ে গল্প বলে রেখেছিল। আবার আর একটা আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে। এদের আমি আর বিশ্বাস করি না। এদের রক্তের মধ্যে বইছে ছলনা আর কপটাচার। এত মিথ্যার দরকারটা কী ছিল সেটাই শুধু বুঝতে পারি না। বুঝে অবশ্য আর কাজ নেই আমার। যেটুকু বুঝেছি তাই-ই যথেষ্ট।
মুখটা এমন চুন করে আছে যে মানুষটার ওপর দয়া হল। বললাম— তোমাকে আর তোমার মেয়েকে ছাড়া আর কাউকে তো দেখিনি। কী করে বলব, কার সঙ্গে ওর মিল?
একটু বোধহয় উৎসাহ পেল এলা চৌধুরী, বলল— তুই দেখেছিস, রোজ দেখেছিস, ফটোতে। তোর দাদার মতো। নয়?
—কী জানি!
—ঠিক অল্পবয়সের বিনু।
আমি হেসে বললাম— একেবারে এইটুকু ছেলের মুণ্ডু চিবিয়েছিলে? বাঃ, ব্রাভো দিয়া!
দিয়ার মুখটা একবার লাল, পরক্ষণেই সাদা হয়ে গেল। মুখ নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, হাতটা একটু একটু কাঁপছে। ঠিক বুড়োদের মতো। কত বয়স হল দিয়ার? ষাট হল? যাঃ দিয়া, তুমি ঢকঢকে বুড়ো হয়ে গেলে?
সকাল হয়ে গেছে। এক ফালি রোদ এসে ব্রাউন চন্দ্রমল্লিকাটার ওপর পড়েছে। ফুলটা হয়েছে যাকে বলে গর্জাস। একটা ছোটখাটো চুবড়ির মতো। টবগুলোর একটু জায়গা অদল-বদল করে দিই। হলুদগুলোই রাজত্ব করছে, ব্রাউনগুলো যে কত যত্নে ফুটিয়েছি! স্পঞ্জ দিয়ে পাতাগুলো পাপড়িগুলো মুছে দিই। ঝকঝক করতে থাকে ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা। এগজিবিশনে দিলেই হয়।
—পরের বছর, পার্প্ল আর লাল ডালিয়া করব, বুঝলে দিয়া?
মুখ ফিরিয়ে দেখি দিয়া চলে গেছে। বারান্দার দরজার কাছে মন্দার দাঁড়িয়ে আছে।
বলি— গুড মর্নিং।
ও বলে—আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান!
—বাঃ, এ তো আশাতীত উন্নতি! লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতি! সত্যিই ওর চোখগুলো দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। কোনও ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। অদ্ভুত তো?
—ডবল প্রমোশন? —ও বোকার মতো হেসে বলল। —যাক, হাসিটা এখনও বোকা-বোকা আছে।
—ভেতরে আসব?
—ভেতর কী? বাইরে বলো! এসোনা!
বলল— বড় ফুলগুলো, ওই যে হলদে আর বাদামি ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকাগুলো!
—হ্যাঁ, ওগুলো কী?
—তুমি যখন ওগুলোর পাতা মুছিয়ে দিচ্ছিলে, তখন মনে হচ্ছিল ওগুলোও তোমার বোন।
—বাপ রে! এই রেটে যদি উন্নতি হয় তা হলে তো চাঁদে-টাঁদে পৌঁছে যাবে। শিগগিরই।
খুব লজ্জা পেয়েছে। বলল— খারাপ কিছু বলেছি? কিছু মনে করলে মন্দাকিনী?
আমি বলি— আমার ডাকনাম বুলা। তোমার কোনও ডাকনাম নেই।
—সোনা। ছোটসোনা।
—গুড। মন্দার কি একটা নাম হল না কি? যেমন মন্দাকিনী, তেমনি মন্দার দুটোই বোগাস!
—হ্যাঁ ওগুলো স্বর্গের গাছ, স্বর্গের নদী।
—সোনা তো, ছোট কেন? —
বলল— বড় নয়, তাই। দুজনে খানিকটা হাসি। আমি বললাম— আজকের প্রোগ্রাম জানো?
—না তো!
—আজ একটা এক্সপিডিশন আছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
—এক্সপিডিশন? কোথায়?
—কোথায়, তুমিই বলো না।
ভেবে-চিন্তে বলল— শেয়ালদা থানায়?
মনে মনে বললাম— তোমার মাথা! মুখে বললাম— দেখা যাক।
কালকে ওর জন্যে দু’সেট পায়জামা-পাঞ্জাবি, আর একসেট ট্রাউজার্স-শার্ট কিনে এনেছি। ট্রাউজার্সের কোমরটা ফিট করলে হয়। একটু আলগা হলে বেল্ট দিয়ে ম্যানেজ করে নিতে বলব, কিন্তু ছোট হলে? দোকানে অবশ্য বলল— ছোট হওয়ার কোনও চান্স নেই।
জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে ওর ঘরে বিছানার ওপর রেখে দিই।
বলল— এ সব কিনেছ কেন?
—জাহাজডুবি হয়ে তো এসেছ, পরবেটা কী? আমার স্কার্ট না দিয়ার শাড়ি?
—আমি আমার জামাকাপড়গুলো কাল কেচে শুকোতে দিয়েছি।
—কোথায়?
—ওই বাথরুমেই,
ঢুকে দেখি র্যাকে জামা-টামা শুকোচ্ছে বটে, —আমি ঢুকতে যেতেই হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছিল।
—তোমাকে দেখতে হবে না, তোমাকে হাত দিতে হবে না, আমি ঠিক করে নিচ্ছি।
আমি বললাম— ওগুলো আয়রণ না করলে তো পরা যাবে না। আমি স্টিফেনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওকে দিয়ে দাও আর নতুন ড্রেসটাই পরো। পরে দেখে নাও ঠিক হয়েছে কিনা।
রাখাল সরকারের নাকের ওপর একটা আঁচিল আছে এইটাই ছিল আমাদের ট্রাম্প কার্ড। কর্পোরেশনে বেঁটে, ষণ্ডামার্কা নাকে আঁচিল রাখাল সরকারের খোঁজ পেতে মাইকেলের দেরি হয়নি। লোকটা অ্যাসেসমেন্ট সেকশনের ক্লার্ক।
বিকেলে লোকটা বেরোলে মাইকেল পেছু নিল। সুরেন ব্যানার্জি থেকে একটু পরে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে ঢুকতে যাবে, পেছন থেকে মাইকেল, সামনে থেকে রুডি গিয়ে ওর কাঁধে থাবড়া মারল।
—মিঃ সরকার, কেমন আছ?
—কে? কে? —ভড়কে রাখাল সরকার বলল, কে আপনারা?
—চিনতে পারছ না? সে কী?—অমায়িক হেসে রুডি বলল।
—না তো!
—এখখুনি চিনবে। একটা শিস দিল মাইকেল।
আমি আর মন্দার তখন এগিয়ে যাই।
—দেখো তো মন্দার এই তোমার লোক?
মন্দার মাথা নাড়ল।
লোকটা হাঁ করে মন্দারের দিকে একবার আমার দিকে একবার চাইছিল। মুখে কথা নেই।
ট্যাক্সির ভেতর ঢোকানো হয় লোকটাকে। ওর দুপাশে রুডি আর মাইকেল। সামনে আমি আর মন্দার। লোকটা কিছু বলছে না। ভয়ে চুপ করে আছে। আমার পাশে মন্দারও খুব শক্ত, ঠাণ্ডা মতো হয়ে রয়েছে। ঘাবড়েছে।
শেয়ালদার বাড়িটাতে পৌঁছে ট্যাকসি থেকে নামবার সময়ে রাখাল সরকারের বাকস্ফুর্তি হল। বলল, আমি কিন্তু এখুনি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারি।
মাইকেল বলল—ইউ ক্যান ট্রাই। তবে লোক জড়ো আমরা আরও ভাল করতে পারি।
রুডি বলল—হেই ম্যান, ভালয় ভালয় এর জিনিসগুলো দিয়ে দাও। বেশি ত্যাণ্ডাই ম্যাণ্ডাই করলে কপালে তোমার দুঃখু আছে।
বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাখাল বলল—আমার কাছে চাবি নেই।
—তো চাবিটা কোথায় আছে? রুডি জিজ্ঞেস করল—জুলির কাছে?
এমন চমকে উঠেছে রাখাল, যেন কেউ ওর পেটে কোঁৎকা মেরেছে।
—কী? রুডি বলল, জুলির কাছ থেকে নিয়ে আসব!
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো গুটিয়ে গিয়ে রাখাল বলল
—দেখি আমার ফোলিওটা, থাকলেও থাকতে পারে।
ব্যাগ থেকে চাবি বার করে দরজা খুলল লোকটা। আমরা সকলে ঢুকলাম। মন্দার তাড়াতাড়ি নিজের সুটকেসটার দিকে ছুটে গেল।
আমি বললাম—খুলে দেখে নাও সব আছে কি না।
মাইকেল বলল—এই মন্দার ছেলেটা তোমার জন্য বড্ড ভাবছিল, বুঝলে রাখালবাবু, কোথায় গেল রাখালবাবু, তার তো তিনকূলে কেউ নেই!
রুডি বলল— চ্ চ্, মন্দারবাবু, সত্যি নাকি?—রাখালবাবুর তিনকূলে কেউ না থাকলে কী হবে। আরেকটা কুল আছে—ফোর্থ কুল। জুলি। রাখাল সরকারের মেয়ে জুলি…
মন্দার অবাক চোখে তাকিয়ে বলল—রাখালবাবুর মেয়ে আছে? বলেন নি তো!—মন্দারের মতো আহাম্মক, ইডিয়ট আমি আগে দেখিনি।
—আহা হা হা। রুডি হেসে বলল—মেয়ে কেন হবে? মেয়েমানুষ, না রাখালবাবু? জুলির কাছে কদিন কাটিয়ে আসাও হল, এদিকে মন্দারকে কাটিয়ে দেওয়াও হল।
রাখালবাবু কম যায় না। শয়তানের মতো চোখ মটকে বলল—এই মন্দারও যেমন এই মেয়েটার কাছে কদিন কাটাচ্ছে। তা ভাল। ভাল জুটিয়েছিস মন্দার!
হঠাৎ আমার পাশ থেকে একটা গুলতির মতো কী একটা ছুটে বেরিয়ে গেল। দেখি মন্দার। লাফিয়ে রাখালবাবুর ঘাড়ে পড়েছে। তারপর ওরে বাবা, কী মার, কী মার! মুখে কথা নেই, লোকটাকে শুইয়ে ফেলে একেবারে চোরের ঠ্যাঙানি!—ওর যে অত রাগ, ওইরকম করে যে কাউকে ঠেঙাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
মাইকেল, রুডি অনেক কষ্টে ওকে তুলে নিয়ে আসে। ওর বইপত্র, সুটকেস, সব নিয়ে আমরা বেরিয়ে যাই। শুধু বিছানাটা মন্দার নেয় না। মুখের একটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গি করে বলে—ও শুয়েছিল। ওটা নোংরা হয়ে গেছে।
—আমি থানায় যাব—কোঁকাতে কোঁকাতে লোকটা বলল—এফ. আই. আর করব।
রুডি বলল—ট্রাই ইট। ইটস অলওয়েজ গুড টু ট্রাই। আমাদের এফ. আই. আর তো করাই আছে।
বাড়িতে ফিরে দেখি দিয়া একটা সাদা খোলের তাঁতের শাড়ি পরেছে। কপালে একটা কালো টিপ। আমাদের দেখে বলল—পেয়েছিস? সব কিছু?
আমি বললাম—হ্যাঁ।
—তোমার হার? মন্দার?
—হ্যাঁ।
—বইগুলো গুছিয়ে রাখো—দিয়া বলল।
বইয়ের থলেটা ও নিয়ে গেল ঘরে।
—বেশি গোলমাল কিছু করিসনি তো?—দিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
—না। আমরা অত বোকা না।
—ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে তো ওই রুডি।
বেশি কিছু করতে হয়নি। আমি বলি—রাখালবাবুর মার খাওয়াটা দেখবার মতো হয়েছিল। ক্যা সীন?
—সেই মারলে? এত করে যে বললাম ছেলেগুলোকে মারপিট করিস না।
—ওরা করেনি তো! মার দিল তোমার নাতি।
—কে মন্দার? মন্দার মারপিট করল?—দিয়ার গলায় অবিশ্বাস।
—মারপিট নয়। এক তরফা মার, বেধড়ক।
—বলিস কী রে? কেন? তোরা সামলাতে পারলি না?
—সামলাব কী? আমাকে লক্ষ্য করে একটা বেফাঁস কথা বলেছিল লোকটা…বাস—ঠাঁই ঠাঁই শুরু হয়ে গেল।
দিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপরে বলল—আশ্চর্য!
আমি বললাম—কোনটা আশ্চর্য?
দিয়া বলল—ঠিক বিনুর মতো।
সুটকেসটা তখনও দালানে পড়ে। নিয়ে ওর ঘরে ঢুকেছি, দেখি ও টেবিলের ওপরে মাথা রেখে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
বই-টই সব চারদিকে ছড়ানো।—কিচ্ছু গোছানো হয়নি। আমি নিঃশব্দে বইগুলো র্যাকে তুলছি। মুখ তুলে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
আমি চেঁচিয়ে বললাম—দিস ইজ ক্যালকাটা, এ মেট্রোপলিটান সিটি। কান্নাকাটি করে কিছু করতে পারবে না এখানে। লাইফ ইস টাফ হিয়ার। রিয়্যাল টাফ।
ও মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসছে। আমার দিকে তাকাতে পারছে না। বললে— বিশ্বাস করো, এই প্রথম, জীবনে এই প্রথম, না বোধহয় দ্বিতীয়বার।
—দ্বিতীয়বার? তা প্রথমবার কী কারণে কাঁদলে?
—বলব কেন তোমাকে? তুমি ঠাট্টা করবে।
—ঠাট্টা নিতে পারো না?
—ভেবে দেখতে হবে।
—ঠিক আছে বলো ঠাট্টা করব না।
ও বলল—গান, গান শুনে।
—গান শুনে? তা হলে তো তোমাকে এখানে দিবারাত্র কাঁদতে হবে।
—কেন?
—এখানে তো সব সময়ে গান বাজছে।
—ওহ্। ওই গান। পানের দোকানে টোকানে যেগুলো বাজে? ওগুলো আবার গান না কি?
পানের দোকানে বাজে বলে হয়তো তেমন মন দিয়ে শোননি। অন্য জায়গায় শুনলে কোনও কোনও গান খুবই ভাল লাগার কথা। বলে আমি একটা গান গেয়ে উঠলাম।—হিন্দি ফিলমি গান।
ও মন দিয়ে শুনল, বলল—তুমি গাইছ বলে ভাল লাগছে। কিন্তু এইসব গান, আর ওইসব গলা আমার … আমার ঠিক…। বলতে বলতে দু বার গলা ঝেড়ে নিয়ে ও-ও গেয়ে উঠল—
মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়
দেই তুলসী তিল এ দেহ সোঁপাল
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।
আমি তো অবাক! বললাম—তুমি তো বেশ গাও। ভয়েস তো চমৎকার।
—গানটা ভাল লাগল?—ও একটু লজ্জা পেয়ে গেছে।
আমি বললাম—তুমি গাইলে বলে ভাল লাগল। নইলে কীর্তন আমার ভাল লাগে না।
—আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছ? কিন্তু মন্দাকিনী, কার্তিক মাসের শুক্লা পূর্ণিমায় যখন চারদিক দুধসাদা হয়ে যায়, কোথাও কেউ থাকে না, দূর থেকে এই গান হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসে। তখন তোমার মন হু-হু করবে, মনে হবে কেউ নেই তোমার, হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে কেউ যে তোমার একমাত্র আপনজন। কিন্তু….
আমি বললাম—থামলে কেন, বলো আমি শুনছি।
—নাঃ, —ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকাল ও।
—দিয়া খুব ভাল কীর্তন গাইতে পারে। জানো তো?
—তাই বুঝি?—হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রথম যেদিন এ বাড়িতে আসি উনি গুনগুন করছিলেন। আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
—শিখেছে তো ভাল করে।
এই সময়ে পর্দা সরিয়ে দিয়া ঢুকল।—কে গান করল? মন্দার না কি?
—দুটো লাইন মন্দাকিনীকে শোনাচ্ছিলাম, দিদিমা,—খুব লাজুক মুখ করে ও বলল।
—ও তো আর জানত না, তুমি কীর্তনে এক্সপার্ট! আমি বলি।
—তুমি কীর্তন ভালবাসো?—দিয়া জিজ্ঞেস করল।
মন্দার বলল—আমাদের ওখানে তো যে কোনও উপলক্ষে কীর্তন হয়, বিশেষ করে ব্রজবুলির কীর্তন আমার খুবই ভাল লাগে।
—কী মনে হয় তোমার?
—কী মনে হবে?
—না ওই যে বুলাকে বলছিলে!
—কিছু না, পূর্ণিমার রাতে-টাতে খুব ভাল লাগে, তাই বলছিলাম মন্দার বেশ লজ্জা পেয়ে গেছে। কিছুতেই আর বলল না।
দিয়া বলল—তোমার দাদার ইচ্ছেতেই তো আমি কীর্তন শিখি। উনি বলতেন ভক্তি-সংগীত হিসেবে তোমায় কীর্তন গাইতে হবে না। গাও ল্যভ-সঙ হিসেবে। আমরা দুজন কেউই কিছু বললাম না।
দিয়া বলল—লাভ সঙ ঠিকই। কিন্তু পাওয়ার গান নয়, এগুলো না-পাওয়ার গান। একেবারেই না-পাওয়া, আভাসে-পাওয়া, পেয়েও-না-পাওয়া। যাঁর কাছে শিখেছি সেই যুগল কীর্তনিয়া বলতেন, কীর্তন অঙ্গে মিলনের গানও বিরহের গানের মতো করেই গাইতে হবে। মিলনই বলো আর পাওয়াই বলো, সেটা একটা আইল্যান্ড ডুবু-ডুবু জলের মধ্যে জেগে-থাকা দ্বীপ, যে কোনও সময়ে ডুবে যেতে পারে। তোমার মধ্যে যদি সীমাহীন অভিমান থাকে, যদি তোমার জীবনে রিফিউজ্যালের কষ্ট থাকে, বঞ্চনা থাকে, তা হলে কীর্তন হবে, দি মিউজিক ফর ইউ।
—ওহ্, আমি তোদের খুব বিরক্ত করলাম…দিয়া পর্দা ঠেলে চলে গেল। মাঝে মাঝে দিয়া যেন নিজের ভেতরের একটা ঘরের পর্দা সরিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য।
—সুটকেস থেকে জামাকাপড়গুলো বার করলাম। —আলমারির মধ্যে সাজিয়ে রাখছি, মন্দার বলল—আচ্ছা মন্দাকিনী, দিদিমা অত সুন্দর বাংলা বলেন কী করে?
—দিয়া তো শিখেছে! দাদার কাছে শিখেছে। টিউটর রেখে শিখেছে।
—কিন্তু একটু টান আছে, তাই না?
—হ্যাঁ, যেমন নয় কে বলে নোয়, হয় কে হোয়, ‘যুগোল’ ‘মিলোন’ যুক্তাক্ষরগুলো একটু ভেঙে বলে, কীরতন, বজ্রো…।
—কিন্তু আমার মায়ের বা তোমার তো এ রকম টান নেই?
—বাঃ দিয়ার বাবা-মারা ছিল ইংলিশ-স্পীকিং। কিন্তু আমার বাবা-মা তো দুজনেই বাংলা বলে, বাঙালি। ইরাবতীর মা মানে আমাদের দিয়া তো সে সময়ে ছিলেন পুরোপুরি বাঙালি। আমরা পড়েওছি নিভেদিতার স্কুলে। মা তো বটেই, আমিও।
—এ সব কি দাদামশাইয়ের আইডিয়া?
—হ্যাঁ, দাদা আসলে দিয়া সুদ্ধু পুরো নিজের ফ্যামিলিটাকে বাঙালি সমাজে রিহ্যাবিলিটেট করতে চেয়েছিল!
—রি-হ্যাবিলিটেট?
—হ্যাঁ! দিয়া তো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান! বাঙালি-সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণ, বাঙালি রীতিনীতি, অভ্যাস সব রপ্ত করতে হবে তো!
—তা সেই সমাজ, তোমার দাদার সমাজ কই? তাঁদের কেউ তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন?
—এই ব্যাপারগুলো আমি জানি না। তুমি দিয়াকে জিজ্ঞেস করো। তবে আমার জ্ঞানে আমি দাদার কোনও আত্মীয়কে এখানে আসতে দেখিনি।
—মা কোথায় চাকরি করে মন্দাকিনী? —মন্দার হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
—মা কি তোমায় তাই বলে গেছে?
—আর কী বলবে?
আমি বললাম—দেখো। আমাদের ছোটবেলায় মা একটা চাকরি করত। রিসেপশনিস্ট ছিল। কিন্তু সে চাকরি মা অনেকদিনই ছেড়ে দিয়েছে।
—তা হলে?
—তুমি একটা ফার্স্ট ক্লাস ইডিয়ট মন্দার, বুঝতে পারছ না, মা আবার বিয়ে করেছে?
দিয়া কথাটা বলতে আমাকে বারবার বারণ করেছিল, কিন্তু আমি বলে ফেললাম।