রাঢ়বঙ্গের লোক উৎসব – ভাদু পরব
ভরা ভাদরের আকাশে কৃষ্ণ মেঘ দোলে। রাঢ় বঙ্গের কৃষিজীবীদের অন্তরে জাগে উৎসবের— পরবের আনন্দ। শস্য উৎপাদনের আকাঙ্ক্ষা ও আশায় শুরু হয় ভাদু পরবের। যদিও তা স্মরণ উৎসব তবুও আন্তরিক কামনায় এই মাটির মানুষদের পরান কথা ফুটে ওঠে ভাদু গানে গানে।
রাঢ়বঙ্গের অন্যতম লোকউৎসব ভাদু পরব। সারা ভাদ্র মাস জুড়েই চলে এই লোক উৎসব।
ভাদু উৎসব উৎসব কিভাবে শুরু হয়েছে সে নিয়ে অনেক জনশ্রুতি আছে। শোনা যায় যে পুরুলিয়ার লারা গ্রামের মোড়ল ভাদ্র মাসে ধান ক্ষেতের আলে এক কন্যা সন্তানকে কুড়িয়ে পান। সেই অনাবৃষ্টির বছরে ওই “মাটির কন্যাকে “ঘরে আনা মাত্রই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে! কন্যার নাম রাখা হয় ভদ্রাবতী! এই রূপে গুণে অতুলনীয় কন্যার কথা রাজা নীলমনি সিং দেও র কানে পৌঁছালে তিনি একে দত্তক নিতে চান। ষোডশী ভদ্রাবতী ভালোবেসেছিল গ্রামের কবিরাজের ছেলে অঞ্জনকে। রাজা সব জানতে পেরে অঞ্জনকে বন্দি করে। ভদ্রাবতী ওই কয়েদখানার চারপাশে করুণ সুরে গান গেয়ে ঘুরতে থাকে। সেই গানে রাজার মন গলে ।অঞ্জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ভদ্রাবতীর আর কোনো খোঁজ মেলেনি। কেউ বলে নদীতে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন কেউবা বলে মাটির কন্যা মিশে গেছে মাটিতে। সেই শোক স্মরণেই শুরু হয় ভাদু পরবের।
আবার অনেকে বলেন প্রায় 200 বছর আগের কথা। পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংদেও। তার কন্যা ভদ্রাবতী। রাজকন্যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিবাহ করতে আসার পথে ডাকাতদল বরসহ বরযাত্রীদের হত্যা করে। এই আঘাতে ভদ্রাবতী আত্মঘাতী হন। রাজা নীলমণি সিং দেও মেয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় রাখতে ভাদু গানের প্রচলন করেন। কিছু সরকারি নথিতে ঘটনাটির উল্লেখ মেলে।
বীরভূম বাসীরা মনে করেন ভদ্রাবতী আসলে হেতমপুরের রাজকন্যা। তাঁর সাথে বর্ধমানের রাজপুত্রের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতের আক্রমণে মৃত্যু হয় রাজপুত্রের। ভদ্রাবতী সহমরণে যান রাজপুত্রের সাথে। সেই থেকেই মানভূম অঞ্চলে শুরু হয় ভাদু পরবের।
পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা বাড়ির কুলুঙ্গিতে একটি মাটির পাত্রে ফুল রেখে অথবা পাত্রের ওপরে গোবর দিয়ে তার মধ্যে ধান ছড়িয়ে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। সেদিন থেকেই শুরু হয় সমবেত ভাদু গান। এই গান রাঢ়বঙ্গের কৃষিজীবী মানুষের মুখের কথা। তাই লৌকিকতা ও সামাজিকতায় আচ্ছন্ন থাকে পদগুলি। মহিলাদের সুখ-দুঃখের বর্ণনা উঠে আসে গানগুলিতে। পাঁচালী সুরে গাওয়া গানগুলি গ্রামীণ মানুষের সমাজচেতনা প্রতিবাদ বর্ণিত হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির 7 দিন আগে ঘরে আনা হয় ভাদুর মূর্তি। পদ্মাসনা বা ময়ূর বা হাঁস বাহনা
মূর্তির গায়ের রং হলুদ হাতে আলপনা। ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে হয় ভাদু জাগরণ। রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘরে মূর্তি স্থাপন করা হয়। নানা উপাচার সাজিয়ে চলে পুজোর আয়োজন। মূর্তির সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানীয় মিষ্টি। তার সাথে চলতে থাকে ভাদু গান। এই ভোগের বিশেষ মিষ্টি হলে জিলিপি। ভাদু বরণের অঙ্গ এই জিলিপি। ভাদ্রসংক্রান্তির সকাল বা-বিকেলে মহিলারা দলবদ্ধভাবে ভাদু মনি কে মাথায় নিয়ে সারা গ্রাম পরিক্রমা করেন। তারপর বরণ করে নদীতে বা পুকুরে বিসর্জন দেন। এই ভাদু বরণ কে স্থানীয় ভাষায়” ভাদু চুমানো “বলে! এই পরবে নেই কোন পুরোহিত মন্ত্র উপবাস আচার বা প্রাতিষ্ঠানিকতা। আছে শুধু গান যা কৃষিজীবী সমাজের অন্তরের কথা–
” ভাদু কে আস্যেছে লিতে মহুলবনীর চিনিবাস
যদি ভাদু যাব বল আমরা লিব বনবাস ।”
কিংবা—” যাচ্ছ ভাদু যাওগো
পিছন ফিরে চাও গো
সখীরা সব দাঁডায় আছে
পদধূলি দাও গো।”
ভাদু বিসর্জনের ঘাটে চলে গানের প্রতিযোগিতা।
ভাদু গানে সমসাময়িক বিষয় রাজনীতি সামাজিক ঘটনা বর্ণিত হয়। প্রান্তিক কৃষিজীবী সমাজের আকাঙ্ক্ষা খুবই সামান্য—-
” ভাদুর লাচে ঘুঙ্গুর দে মা
মাচান ভরে ডিংলাঝিঙা
নিমক মরিচ মাডে ভাতে
মাদলে বোল ঘিজাং ঘিনা।”
বিশ্বকর্মা পূজার আগের দিন হয় ভাদুবরণ।
থালা ভরা মিষ্টি র বিকল্প হিসাবে বিরাট বড় জাম্বো জিলিপি সাজিয়ে দেওয়া হয় ভাদুর সামনে।
প্রান্তিক কৃষিজীবী সমাজের আর্থিক দৈন্য কে সুন্দর ভাবে বিকল্প জিলিপির মিষ্টতায় ঢেকে দেওয়া হয়। এই জিলিপি ভোগ দেওয়ার সামর্থ্য সব কৃষিজীবীর আছে।
এই নিয়ে সুন্দর লোক সাহিত্য আছে।
বাঁকুড়ার ছাতনার কেঞ্জাকুডায় শুরু হয় বিরাট জিলিপি বানানো।—-
” অবাক দেখেশুনে
” কেঞ্জাকুডায় অশোক দত্তের দোকানে
বড় বড় জিলিপি গুলা সওয়া কেজি ওজনে
আবার খাজা গুলা এক ফুট করে দেখে এলাম নয়নে—“!
একইভাবে পুরুলিয়ায় বানানো হয় জাম্বো জিলিপি। এছাড়াও গজা খাজা লবঙ্গ লতিকা— যা এই সীমান্ত বাংলার খুবই আদরের মিষ্টান্ন!
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী ভাদুর জন্ম ও মৃত্যু ভাদ্র মাসে। তাই এ মাসে হিন্দু মেয়ের বিয়ে দিতে নেই।
ভাদ্র সংক্রান্তির বিকেল— আকাশে কালো মেঘ– রাঢ় বঙ্গের কৃষিজীবীদের মনের আকাশে ও মেঘের ছায়া— ভাদু মনিকে যে বিসর্জন দিতে হবে
–” আমার বড় মনের বাসনা
ভাদুধনকে জলে দিব না।”
গানে গানে ভাদু মনি কে বিদায় জানায় প্রান্তিক বাংলার কৃষিজীবীরা! সমাপ্তি ঘটে একমাস ব্যাপী ভাদু পরবের।
তথ্যসূত্র- লোকভাষ, বর্তমান পত্রিকা, গুগোল