Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাঘববাবুর বাড়ি || Shirshendu Mukhopadhyay

রাঘববাবুর বাড়ি || Shirshendu Mukhopadhyay

পুরুতমশাই নন্দলাল ভটচার্য

সকালবেলায় পুরুতমশাই নন্দলাল ভটচার্য রাঘব চৌধুরীর বাড়ির নিত্যপূজা সেরে বেরোচ্ছেন। হঠাৎ নজরে পড়ল বাইরের দিককার বাগানে একটা মুশকো চেহারার লোক উবু হয়ে বসে বাগানের কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে। মুখটা ভারী চেনা-চেনা ঠেকল। এ গাঁয়ের লোক নয়, তবে কোথাও একে দেখেছেন।

নন্দলালের টিকিতে একটা কলকে ফুল বাঁধা, গায়ে নামাবলী, বাঁ বগলে ছাতা, ডান হাতে সিধের পুঁটুলি, পরনে হেঁটো ধুতি, পায়ে খড়ম। দেখলেই মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা হওয়ার কথা। হয়ও। নন্দলালকে দেখলেই লোকে একটু তটস্থ হয়ে পড়ে।

নন্দলাল দু পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে বাপু, মুখোনা বড্ড চেনা-চেনা ঠেকছে যে!”

অন্য কেউ হলে তাড়াতাড়ি উঠে হাতজোড় করে বলত, “পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই” কিংবা, “পাতঃ পেন্নাম বাবাঠাকুর”, বা যা হোক ওরকম কিছু। এ লোকটা সেই ধার দিয়েই গেল না। দু’খানা জ্বলজ্বলে চোখে একবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিক্ষেপ করে বলল, ‘চেনা-চেনা ঠেকলেই যে চিনতে হবে তেমন কোনও কথা আছে?

লোকটা যে ঠ্যাটা এবং তিরিক্ষে, তা বুঝে নন্দলাল একটু দমে গেলেন। চেহারাখানা দেখে ষণ্ডাগুণ্ডা বলেই মনে হয়। ডাকাত বা খুন খারাপির আসামি হওয়াও বিচিত্র নয়। কথা হল, রাঘব চৌধুরীর বাড়িতে এসে জুটলই বা কী করে! আর এক কথা, লোকটাকে তিনি কোথাও দেখেছেন, কিন্তু কোথায় তা মনে পড়ছে না।

রাঘব চৌধুরী বড়লোক হলে কী হয়, ভারী খামখেয়ালি মানুষ। পাট আর গুণচটের পৈতৃক কারবারে লাখো-লাখো টাকা কামান বটে, কিন্তু লোকটার বাস্তববুদ্ধির একটু অভাব আছে। নইলে এ বাড়িতে যেসব লোক এসে জোটে, দূরদর্শী হলে কদাচ তাদের আশ্রয় দিতেন না।

পালোয়ান হাবু দাসের কথাই ধরা যাক। একসময়ে নাকি কুস্তি টুস্তি করত। রাঘববাবুর কাছে একদিন এসে ধরে পড়ল, “হুঁজুর, গতরখানা তো দেখেছেন। এই দেহের খোরাকটা একটু বেশিই। কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে তাতে দু’বেলা ভরপেট জোটানোই মুশকিল, যদি একটু আশ্রয় দেন তা হলে যা করতে বলবেন, করব।”

রাঘববাবু বললেন, “আহা, কুস্তিগির তো একজন আমিও খুঁজছি, তা ভালই হল। আমার ছেলেপুলেগুলোকে শেখাও, আমিও মাঝেমধ্যে একটু-আধটু তালিম নেব’খন।”

তা হাবু দাস থেকে গেল। তার জন্য একটা আখড়াও তৈরি করে দিলেন রাঘববাবু। তাঁর দুই ছেলে প্রথম প্রথম উৎসাহের চোটে কুস্তি শিখতে লেগে পড়ল। কিন্তু দিনদুয়েক বাদেই গায়ের ব্যথায় দুইজনকে শয্যা নিতে হল। রাঘববাবুর গিন্নি বললেন, “ওদের হল নরম শরীর, দুধননী খেয়ে মানুষ, ওদের কি ওসব আসুরিক কাণ্ড সহ্য হয়! কবে কোনটার ঘাড় মটকে যায়, হাত বা পা ভাঙে, দরকার নেই বাবা কুস্তি শিখে। বাছারা আমার ননীর পুতুল হয়েই থাকুক।”

তা তাই হল। রাঘববাবুও একদিন কি দু’দিন ল্যাঙট এঁটে নেমেছিলেন বটে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি। কয়েকদিন বাদেই হাবুর আখড়া ফাঁকা হয়ে গেল। তা হাবু তখন একা-একাই মুগুর ভাঁজত, ডন বৈঠক করত। কিন্তু কিছুদিন পরে তারও উৎসাহে ভাঁটা পড়ে গেল। এখন হাবু দাসের মাত্র দুটো কর্ম, খাওয়া আর ঘুমনো। অ্যাই বিরাট চেহারা হয়েছে, মস্ত ভূঁড়ি, শরীরে চর্বি থলথল করছে। দিনরাত ঘুমোলে আর রাশি রাশি খেলে যা হয়। কুস্তি দূরস্থান, এখন দশ পা হাঁটতেও তার হাঁফ ধরে।

ওই যে কালোয়াত গুণেন সাঁতরা, মস্ত নাকি গাইয়ে, কিন্তু গাঁ-গঞ্জে সমঝদার না পেয়ে একদিন সভাগায়ক হবে বলে রাঘববাবুর কাছে এসে হাজির।

রাঘববাবু সব শুনে তটস্থ হয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আমি তো রাজা জমিদার নই, আমার সভা-টভাও নেই, কাজেই সভাগায়ক রাখার কথাই ওঠে না। আমি নিকষ্যি ব্যবসাদার।”

গুণেন ভারী মুষড়ে পড়ে বলল, “তবে যে সবাই বলছিল আপনার কাছে এলেই নাকি একটা হিল্লে হবে?”

রাঘববাবু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “আজ্ঞে, কালোয়াতি গানও আমি বুঝি না। বড়জোর কেত্তন বা শ্যামাসঙ্গীত অবধি আমার দৌড়, তবে গুণী মানুষের কদর আমি বুঝি। এসে যখন পড়েছেন তখন তো আর ফেলতে পারি না।”

তা গুণেনও থেকে গেল। প্রথম প্রথম ভোররাতে উঠে খুব রেওয়াজ-টেওয়াজ করত। সেই আওয়াজে গঞ্জের যত কুকুর এসে রাঘববাবুর সদরে জুটে সে কী ঘেউ-ঘেউ! তার মানে এ নয় যে গুণেন কিছু খারাপ গাইত, কিন্তু এলাকায় কুকুরগুলোেই বজ্জাত বেরসিক। বিরক্ত হয়ে গুণেন রেওয়াজ প্রায় ছেড়েই দিল। এখন তাস-পাশা খেলে সময় কাটায়। মাঝে-মাঝে একটু-আধটু গুনগুন করে।

ওই যে লম্বা, সুড়ঙ্গে, সুটকো চেহারার ভূতনাথ হালদার, সে নাকি একজন ভূত-বিশারদ। যত বুজরুক সব এসে এই রাঘবের ঘাড়ে ভর করে। ভূতনাথ নাকি ভূতবিদ্যা গুলে খেয়েছে। তার চারদিকে সর্বদাই ভূতের ভিড়! বছরটাক আগে এসে সেও জুটে গেল এ বাড়িতে। রাঘবকে বলল, “বাবুমশাই, ভূত বড় ত্যাঁদড় জিনিস, এমনিতে টেরটি পাবেন না। কিন্তু ধরুন চিতল মাছের পেটি দিয়ে পরিপাটি ভাত খাবেন বলে মনস্থ করলেন, একটা দুষ্টু ভূত এক খাবলা নুন দিয়ে গেল ঝোলে।”

রাঘব সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম তো হয়ই।”

“তারপর ধরুন শুভকার্যে বেরোচ্ছেন, দুর্গা দুর্গা বলে বেরোতে পা বাড়িয়েছেন, একটা বদমাশ ভূত টক করে খুতির খুঁটটা দিল পায়ে জড়িয়ে। দড়াম করে পড়লেন আর কী। ভূতের কাজ বলে টেরটিও পেলেন না।”

রাঘব সোৎসাহে বললেন, “ঠিক বলেছেন তো! গত বছর আমার তো একবার এরকম হয়েছিল।”

“শুধু কি তাই বাবুমশাই! ধরুন, আপনার শুদ্ধাচারী বিধবা শাশুড়ি একাদশীর পরদিন চারটি ভাত পাথরের থালায় বেড়ে নিয়ে খেতে বসেছেন, একটা শয়তান ভূত টুক করে একখানা মাছের কাঁটা তার পাতে ফেলে গেল। কী সর্বনাশ বলুন তো!”

রাঘব মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, এরকম তো হতেই পারে। হয়ও।”

“আর চিন্তা নেই মশাই। আজ থেকে এই শৰ্মা গ্যাঁট হয়ে বসল এই বাড়িতে। ত্রিসীমানায় আর ভূতের উপদ্রব থাকবে না।”

রাঘববাবু তাঁর পুরনো কাজের লোক নবকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন, “কী রে নবু, এরকম একজন তোক বাড়িতে থাকা তো ভালই, কী বলিস?”

নবকৃষ্ণ রাঘববাবুর তামাক সেজে কলকেতে ফুঁ দিতে দিতে গড়গড়ার মাথায় বসাচ্ছিল। খুব নির্বিকার গলায় বলল, “ওঝা-বদ্যি রাখুন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তা হলে পীতাম্বরমশাই, হরুখুড়ো, পঞ্চা বিশ্বেস, আন্নাকালী দেব্যা এদের কী ব্যবস্থা হবে? তেজালো ওঝা দেখলে তাঁরা কি ভড়কে যাবেন না?”

রাঘব খুবই চিন্তিত হয়ে তামাক টানতে টানতে বললেন, “হ্যাঁ, সেটাও তো একটা কথা! ওঝা ঢুকলে তাঁরা যদি যাতায়াত বন্ধ করে দেন তা হলে তো সর্বনাশ!”

ভূতনাথ হাঁ করে দু’জনের কথা শুনছিল। বড় বড় চোখ করে বলল, “আপনারা কাদের কথা কইছেন? এরা সব কারা?”

রাঘব তামাক টানতে টানতে নিমীলিত চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে বললেন, “এঁরা এ বাড়ির পুরনো আমলের মানুষ সব। পীতাম্বরমশাই আর হরুখুড়ো আমারই ঊর্ধ্বতন পঞ্চম আর সপ্তম পুরুষ। পঞ্চা বিশ্বেস এ বাড়িতে দেড়শো বছর আগে কাজ করত, এইনবকৃষ্ণেরই ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ, আন্নাকালী দেব্যা ছিলেন আমার ঠাকুর্দার বিধবা পিসি। আনাচে কানাচে থাকেন, সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করেন।”

নবকৃষ্ণ বলল, “এঁরা তো আছেই, তা ছাড়া পালে পার্বণে আরও অনেকে এসে জুটে যান। তাই বলছিলাম, ওঝাবদ্যি বসান দিলে এঁরা কুপিত হয়ে যদি তফাত হন তা হলে কি বাড়ির মঙ্গল হবে?”

ভূতনাথ ভারী ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বলল, “ওরে বাবা! তাঁরা কি দেখাটেখাও দেন নাকি গো নবুদাদা?”

“তা দেবেন না কেন? নিত্যিই দেখছি। একটু আগেই তো গোয়ালে সাঁজাল দিতে গিয়ে পীতাম্বরমশাইকে দেখলুম, কেলে গোরুটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন?”

ভূতনাথ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “বাপ রে! এ বাড়িতে তো তা হলে ভূতের মচ্ছব।”

নবকৃষ্ণ বলল, “উঁহু, উই, ভূত বললে এঁদের ভারী অপমান হয়। হেঁদো ভূত তো নন। দেয়াল করতেও আসেন না। বাড়ির মঙ্গলামঙ্গলের কথা চিন্তা করেই চারদিকে নজর রাখেন আর কী!”

শুনে ভূতনাথ ভিরমি খায় আর কী! মাথায় জলটল দিয়ে তাকে সুস্থ করার পর রাঘববাবু বললেন, “তোমার ভয় নেই হে, আমার বাড়িতে যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই নিপাট ভাল লোক। শুধু ওই আন্নাঠাকুমাই যা একটু খাণ্ডার। তাকে না ঘাঁটালেই হল। যা রে নবু, ওকে ব্যারাকবাড়ির পুবদিকের ঘরখানায় বন্দোবস্ত করে দে।”

তা ভূতনাথও রয়ে গেল। এভাবেই এক-একজন এসে ঢুকে পড়ে এ বাড়িতে। তারপর আর নড়তে চায় না। বৈজ্ঞানিক হলধর হালদার একসময়ে কালিকাপুর ইস্কুলে বিজ্ঞানের মাস্টার ছিলেন। মাথাপাগলা মানুষ। ইস্কুল কামাই করে বাড়িতে বসে নানারকম উদ্ভট বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতেন। শেষে ইস্কুলের কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে তাঁকে চাকরি থেকে ছাড়িয়েই দিল। বিপাকে পড়ে তিনিও এসে একদিন জুটে গেলেন রাঘবের বাড়িতে। এদের জন্যই বাড়ির লাগোয়া একটা ব্যারাকবাড়ি করে রেখেছেন রাঘববাবু, কম করেও পঁচিশ-ত্রিশখানা ঘরে নানারকম লোক থাকে। বেশিরভাগই নিষ্কর্মা, কারও কারও নানা বাই-বাতিক, কেউ কেউ ভণ্ডুলকর্মা, অর্থাৎ বৃথা কাজে সময় কাটান।

রাঘববাবুর এই যে অজ্ঞাতকুলশীল উটকো লোকদের আশ্রয় দেওয়া, এটা বাড়ির লোকেরা মোটেই ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু তাঁকে বলে বিশেষ লাভ হয় না। বড়ই দয়ার শরীর। লোকে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসেন। কিছুদিন আগে পিছনের বাগানের আগাছার জঙ্গলে একজন লোককে পড়ে থাকতে দেখে বাগানের মালি চেঁচামেচি শুরু করে। লোকটাকে তুলে এনে মুখেচোখে জল থাবড়ানোর পর সে জ্ঞান ফিরে পেয়ে যা বলল তা আষাঢ়ে গল্প। সে নাকি এই পৃথিবীর লোক নয়। অনেক দূরে অন্য এক নীহারিকায় এক গ্রহে তার বাস। মহাকাশযানে তারা ভুল পথে এদিকে এসে পড়ে। তার সঙ্গীরা নাকি ষড়যন্ত্র করে তাকে এখানে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। গ্রহান্তরের লোকের বাংলা ভাষা জানার কথা নয়, পরনে ধুতি আর জামা থাকারও কথা নয়। ভেতো বাঙালির মতো চেহারাই বা তার হবে কেন? কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না বটে কিন্তু রাঘববাবু খুঁতখুঁত করতে লাগলেন, আহা, হতেও তো পারে। দুনিয়ায় কত কী-ই না ঘটে, কেষ্টর জীব, ফেলতে তো পারি না।

তা সেই গুলবাজ গোলাপ রায়ও দিব্যি বহাল তবিয়তে ব্যারাকবাড়িতে গদিয়ান হয়ে বসেছে।

কিন্তু এই নতুন অভদ্র লোকটা নন্দলালকে খুব ভাবিয়ে তুলল। তিনি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে ভিতরবাড়িতে গিয়ে নবকৃষ্ণের ঘরে হাজির হলেন। নবকৃষ্ণ এ-বাড়ির ম্যানেজার। এ-বাড়ির সবকিছু দেখভাল করার ভার তার ওপর। দশ-বারোজন চাকর আর গুটি আট-দশ ঝি তারই অধীনে দিনরাত খাটে। বছর চল্লিশেক বয়সের নবকৃষ্ণকে বিবেচক মানুষ বলেই মনে হয় নন্দলালের।

নন্দলালকে দেখে নবকৃষ্ণ শশব্যস্তে উঠে বলল, “ঠাকুরমশাই যে! পেনাম হই, পেন্নাম হই।”

“ওহে নবকৃষ্ণ, আমি তো পরিস্থিতি ভাল বুঝছি না। ওই ডাকাতের মতো চেহারার লোকটা কোথা থেকে উদয় হল বল দেখি! ও তো খুনিয়া লোক। এসব লোককে কি বাড়িতে ঠাঁই দিতে আছে? এ তো বিছানায় কেউটে সাপ নিয়ে ঘুমনো!”

নবকৃষ্ণ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কর্তা কি কারও বুদ্ধি বা পরামর্শ নেন? বলে বলে তো মুখ পচে গেল মশাই। গতকাল সন্ধেবেলায় ওই ঘটোৎকচটি এসে উদয় হলেন। গুলবাজের মতো চেহারা, ভাঁটার মতো চোখ, কথা কয় না গর্জন করে বুঝে ওঠা মুশকিল। মস্ত নাকি লেঠেল। হাতে দু’খানা তেলচুকচুকে লাঠিও ছিল। তা আমি বললুম, কামশাই, আমদের কি লেঠেলের অভাব? কাহারপাড়ায় একশ’ লেঠেল মজুত, এক ডাকে এসে হাজির হবে। কর্তামশাই খুঁতখুঁত করতে লাগলেন, ওরে, হাতের কাছে একজন লেঠেল থাকাও ভাল। এ লোকটাকে দেখে গুণী মানুষই তো মনে হচ্ছে। একে রাখলে বাড়ির ছেলেপিলেগুলোও একটু লাঠি খেলাটেলা শিখতে পারে, আমাদেরও একটু বলভরসা হয়। আমি আর বেশি কিছু বলতে ভরসা পেলুম না, লোকটা মানুষখেকো চোখে এমনভাবে আমার দিকে চাইছিল যে, গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল বড্ড।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দলাল বললেন, “কর্তাবাবু আর যেগুলোকে জুটিয়েছেন সেগুলো অকালকুণ্ড বটে, কিন্তু ভয়ঙ্কর নয়। কিন্তু এটি তো সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না হে। যেমন চেহারা তেমনই ব্যবহার। একটু নজর রাখিস বাবা, যন্তরটিকে কোথায় যেন দেখেছি, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। নামটাম কিছু বলেছে?”

“যে আজ্ঞে। কদম দাস। চক হরিপুরে বাড়ি।”

নামটা চেনা ঠেকল না নন্দলালের। চক হরিপুর কোথায় তাও জানেন না, তবে এসব পাজি লোকের মুখের কথায় বিশ্বাস কী!

“দুর্গা দুর্গতিনাশিনী” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দলাল খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। সামনে দিয়ে যেতে কেমন যেন সাহস হল না।

খিড়কির দিকে পুকুর। পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিল গোলাপ রায়।

তাঁকে দেখে বিগলিত হাসি হেসে বলল, “ঠাকুরমশাই যে! তা পুজো সেরে এলেন বুঝি?”

নন্দলাল রোষকরিত লোচনে গুলবাজটার দিকে চেয়ে বললেন, “চ্ছ।”

গোলাপ রায় হাসতে হাসতে বলল, “ওঃ, আমাদের মকরধ্বজ গ্রহে যদি একবার যেতেন ঠাকুরমশাই, তা হলে আপনার পুজোপাঠের খুব সুবিধে হয়ে যেত।”

নন্দলাল গম্ভীর গলায় বললেন, “কীরকম?”

“আরে মকরধ্বজের কাছেই তো ইন্দ্রলোক কিনা। আমরা তো মাঝে-মাঝেই দেখতে পাই সাঁ করে একটা পুষ্পকরথ বেরিয়ে গেল, কিংবা বাঁই করে নারদের টেকি চলে গেল। নিশুত রাতে কান পাতলে তো ইন্দ্রের সভার নাচগানের শব্দও পাওয়া যায়। নূপুরের শব্দ, তবলার বোল, সুরেলা গলার গান, এমনকী কী বলব মশাই, কতদিন ইন্দ্রলোক থেকে ফেলা তরকারি আর ফলের খোসা আমাদের উঠোনে এসে পড়েছে।”

নন্দলাল কটমট করে তাকিয়ে গোলাপ রায়কে ভস্ম করে দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, “বটে?”

“তবে আর বলছি কী মশাই! তারপর ধরুন পুজোপার্বণে আপনারা মাটির মূর্তি গড়ে পুজোটুজো করেন। সেদিক দিয়ে আমাদের ভারী সুবিধে। মূর্তিটুর্তির বালাই নেই। যার পুজো হয় তিনিই টুক করে নেমে এসে পুজো নিয়ে চলে যান। গণেশবাবাকে ডাকলেন তোত উনি ধেড়ে ইঁদুরটাকে নিয়ে হেলতে দুলতে এসে হাজির। দিব্যি শুড় দিয়ে চালকলা সাপটে খেয়ে ঢেকুর তুলে উঠে পড়লেন। আমি একবার গণেশবাবার ইঁদুরের লেজ ধরে টেনেছিলাম বলে ইঁদুরটা এমন কামড় দিল, এই দেখুন ডান হাতে এখনও সেই কামড়ের দাগ। তারপর ধরুন মা-সরস্বতী, দিব্যি বীণা বাজাতে বাজাতে হাঁসের পিঠে চড়ে নেমে এলেন। পুজো নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ইংরিজি, বাংলা, অঙ্কও কখনওসখনও দেখিয়ে দেন। তবে আমাদের আসল সমস্যা হয় দুর্গাপূজার সময়। ছেলে, মেয়ে, সিংহ, সাপ, অসুর নিয়ে মা যখন নামেন তখন একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা, তার ওপর সিংহটা গাঁক গাঁক করে ডাক ছেড়ে এর ঘাড়ে ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে চায়। অসুরটা ফাঁক বুঝে পালানোর চেষ্টা করে। সাপটা তেড়েফুড়ে কাকে কামড়ায় তার ঠিক নেই। তার ওপর হাঁস প্যাঁচা ইঁদুর ময়ূর সকলে মিলে এক ঝটাপটি অবস্থা। মা দুর্গার দশটা হাত কেন তা আমাদের মকরধ্বজ গ্রহে গেলে বুঝবেন ঠাকুরমশাই। মনে হবে দশটা হাতেও কুলোচ্ছে না। গোলমালে চণ্ডীমণ্ডপ ভেঙে পড়ে আর কী! চারদিন আমাদের নাওয়া খাওয়া ভুলে সামাল দিতে হয়।”

গুরুগম্ভীর মুখ করে নন্দলাল বললেন, “তা হলে তো তোমাদের গ্রহেই যেতে হয় হে।”

একগাল হেসে হাতজোড় করে গোলাপ রায় বলল, “যে আজ্ঞে। বেড়াতে বেড়াতে চলে আসুন একবার। বেশি দূরও নয়, মাত্র আড়াই লক্ষ লাইট ইয়ার। খুব সুবিধে হবে আপনার। মকরধ্বজে আবার অমাবস্যা পুন্নিমে নেই বলে আরও সুবিধে।”

“কেন হে বাপু, সেখানে অমাবস্যা পুন্নিমে নেই কেন?” গোলাপ চোখ গোল করে অবাক হয়ে বলে, “অমাবস্যা পুন্নিমে হওয়ার কি জো আছে মশাই? আমাদের আকাশে একুনে একুশখানা চাঁদ। তা ধরুন কম করেও রোজ রাতে দশ থেকে বারোখানা চাঁদ থাকে মাথার ওপর। অমাবস্যাটা হবে কী করে বলুন? জ্যোৎস্নার ঠেলায় পাগল হওয়ার জোগাড়। দিনে রাতে তফাত করাই মুশকিল। আমার মেজোমামার কথাই ধরুন। ভুলোমনের মানুষ। রাত দেড়টায় দুপুর মনে করে পুকুরে নেয়ে এসে পাতপিড়ি করে বসে হাঁক দিলেন, কই গো, ভাত বেড়ে আনো। মামি তখন ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে এসে বললেন, আ মরণ! মিনসের ভীমরতি হল নাকি? বলে নড়া ধরে তুলে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।”

নন্দলাল হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু। তোমার সঙ্গে এঁটে ওঠাই মুশকিল। গল্প উপন্যাস লিখলে তো শরৎবাবুর মতো নাম করতে পারতে হে। এমন প্রতিভা নষ্ট করছ?”

হঠাৎ গোলাপ রায় চোর-চোখে চারদিকটা একটু দেখে নিয়ে গলাটা খাটো করে বলল, “একখানা কথা ছিল ঠাকুরমশাই।”

“বলে ফেলল।”

“সকাল থেকেই বড্ড আপনার কথাই মনে হচ্ছে, ভাবছিলাম, ঠাকুরমশাইয়ের মতো এমন বিজ্ঞ বিচক্ষণ লোক এই অজ পাড়াগাঁয়ে আর কেই বা আছে। কপালের ফেরে পড়ে আছেন বই তো নয়। শহর গঞ্জে গিয়ে পড়লে আপনার সত্যিকারের কদর হত।”

“সে না হয় বুঝলুম, কিন্তু কথাটা কী?”

“একটু গুহ্য কথা মশাই, পাঁচকান করবেন না।”

“সে ভয় নেই। পাঁচকান করা আমার স্বভাব নয়।”

গলাটা আরও খাটো করে গোলাপ রায় বলল, “তা বলছিলাম কী, কর্তাবাবু যে একজন সাঙ্ঘাতিক গুণ্ডাকে ভাড়া করে এনেছেন সে খবর রাখেন কী? সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা আর এই আলিসান তাগড়াই চেহারা। কপাল খারাপ বলে ভাগ্যের দোষে না হয় এসেই পড়েছি মশাই, তা বলে গুণ্ডা দিয়ে পেটাই করা কি ভাল? শত হলেও অতিথি নারায়ণ বলে কথা! ভালয় ভালয় বললে কি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেয় হতুম না!”

নন্দলাল গম্ভীর হয়ে বললেন, “গুণ্ডাটা তোমাকে কিছু বলেছে বুঝি?”

মাথা নেড়ে গোলাপ রায় বলল, “আজ্ঞে না। বলা কওয়ার লোকও নয়। এ হল কাজের লোক। শুধু দু’খানা চোখ দিয়ে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিচ্ছে, সে কী রক্তজলকরা চাউনি মশাই! পাঁচু বলছিল কর্তাবাবু নাকি মেলা খরচাপাতি করে গুণ্ডাটাকে ভাড়া করে এনেছেন। শুনে তো কাল রাতে মুখে ভাতই রুচল না। সোনামুগের ডাল আর বেগুন ভাজা ছিল মশাই, সবই প্রায় ফেলে উঠে পড়লুম। গুণ্ডাটা আমার মুখোমুখি বসে মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে, পেটভরে খেতে সাহসই হল না। তাই বলছিলুম ঠাকুরমশাই, গুণ্ডাটা কি আমার জন্যই আনা করালেন কর্তাবাবু?”

নন্দলাল গম্ভীর হয়ে বললেন, “কিছুই বলা যায় না হে, দিনকাল যা পড়েছে।”

‘বড় ভয়ের কথা হল মশাই, মকরধ্বজের গাড়িরও তো এসে পড়ার কথা ছিল। তা সেও এল না। বেঘোরে প্রাণটা গেলে বাড়ির লোক যে খবরটাও পাবে না। শ্রাদ্ধশান্তিরই বা কী ব্যবস্থা হবে কে জানে! উইল টুইলও করে রাখিনি মশাই। তারপর ধরুন, অপঘাতে মৃত্যু। এখানে তো এমন কেউ নেই যে, গরজ করে গিয়ে গয়ায় পিণ্ডটা দিয়ে আসবে।”

একটু ভেবে নন্দলাল বললেন, “অত আগ বাড়িয়ে ভাবা কেন হে? মারলে থানা-পুলিশ হবে, একটু-আধটু কিল, চড়চাপড় বা রদ্দাটদ্দা দিতে পারে বড়জোর। তা ওসব তেমন গায়ে না মাখলেই হল। একটু নজর রেখে চলো, আমি দেখছি।”

“ভরসা দিচ্ছেন ঠাকুরমশাই?”

“দিচ্ছি। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।”

“আপনিই বল-ভরসা,” বলে গোলাপ রায় নন্দলালের পায়ের ধুলো নিয়ে ফেলল।

চিন্তিত মুখে নন্দলাল পুকুরধারের রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছেন, হঠাৎ পিপুল গাছের আড়াল থেকে রোগামতো দাড়িগোঁফওলা, লম্বা চুলের একজন লোক বেরিয়ে এসে পথ জুড়ে দাঁড়াল।

“ঠাকুরমশাই যে!”

লোকটাকে দেখে নন্দলাল বিশেষ খুশি হলেন না। লোকটা ঘোর নাস্তিক, বৈজ্ঞানিক হলধর হালদার।

নন্দলাল কঠিন গলায় বললেন, “তোমার আবার কী চাই?”

হলধর চাপা গলায় বলল, “ওই গুলবাজটা কী বলছিল বলুন তো আপনাকে! ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। ব্যাটা নাকি গ্রহান্তরের মানুষ, ওদের বিজ্ঞান নাকি পঞ্চাশ হাজার বছর এগিয়ে আছে! বলেনি আপনাকে?”

“তা বলেছে বটে।”

“বিশ্বাস করেছেন নাকি ওর কথা?”

“দ্যাখো বাপু, আমি পুজোআচ্চা নিয়ে থাকি, বিজ্ঞান-টিজ্ঞানের আমি কীই বা বুঝি! তবে যা-ই বলো, গুল মারলেও লোকটা তোমার মতো নাস্তিক নয়, ঠাকুর-দেবতাকে মান্যি-গণ্যি করে। ধর্মে মতি আছে।”

“খুব চিনেছেন তা হলে! ধর্মে মতি না হাতি, ও আসলে একটা স্পাই।”

নন্দলাল অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী হে? এই অজ পাড়াগাঁয়ে স্পাই ঘোরাঘুরি করবে কেন? এখানে সুলুকসন্ধান করার মতো আছেটাই বা কী?”

হলধর বিরস মুখে বলল, “আছে মশাই, আছে, আর সেইটেই তো দুশ্চিন্তার কারণ। আমার অমন আবিষ্কারটা যদি শত্রুপক্ষের হাতে চলে যায় তা হলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে, পনেরো বছরের সাধনা। এ দেখছি তীরে এসে তরী ডোবার আয়োজন।”

নন্দলাল নাক সিটকে বললেন, “তা কী এমন হাতি-ঘোড়া আবিষ্কার করলে হে? শুনতে তো পাই সারাদিন ঘর বন্ধ করে শিশিবোতল কৌটো বাউটো দিয়ে কীসব খুটুর-মুটুর করো, তা শিশিবোতল থেকে কি বেহ্মদত্তি বেরোল নাকি?”

হলধর ভ্রু কুঁচকে নন্দলালের দিকে চেয়ে বলল, “ও বিদ্যে বোঝার মতো ক্ষমতা আপনার ঘটে নেই, স্পাই কি এই ধ্যাধেরে গোবিন্দপুরে এমনি আসে মশাই? কাঁঠাল পাকলেই ভোমা মাছি এসে জোটে, দেখেননি? এও হচ্ছে সেই ব্যাপার।”

নন্দলাল মাথা নেড়ে ভালমানুষের মতো বললেন, “শুনেছি বটে এক যোজন দূরে গোরু মরলেও নাকি গৃধিনীর ঝুঁটি নড়ে, তা তোমার থলি থেকে কী ম্যাও বেরোল?”

রোষকষায়িত লোচনে নন্দলালের দিকে চেয়ে হলধর বলল, “শুনতে চান? শুনলে মুখের হাসি কিন্তু শুকিয়ে যাবে। এসব তো ঠাট্টা মশকরার জিনিস নয়, অং বং দুটো মন্তর বলে দুটো ফুল ফেলে দিয়ে চাল কলা আর দক্ষিণা আদায়ের ফাঁকিবাজি কারবারও নয়, বিজ্ঞান হল সাধনা আর হাড়ভাঙা খাটুনি।”

নন্দলাল মিষ্টি করে হেসে বললেন, “খাটুনির কথা বলছ বাপু?” তা আমাদের ওই ন্যালা পাগলাকে দ্যাখো না, সারাদিন কী খাটুনি না খাটছে। এই সারা গায়ে হরিবোল হরিবোল বলে দৌড়ে বেড়ালোলা, এই তালগাছে উঠে গেল, এই কাকবকের সঙ্গে ঝগড়া করতে লাগল, এই ছেলেপুলেদের তাড়া করল, এই আকাশে ঢিল ছুঁড়তে লাগল, এই ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে এল, তারও কি খাটুনির শেষ আছে?”

‘অ! আপনারও তা হলে ধারণা যে, আমি পাগল? তবে জেনে রাখুন, আর্কিমিডিস, গালিলেওকেও লোকে পাগল বলেই মনে করেছিল একদিন। প্রতিভা আর পাগলামির তফাত বুঝতে এলেম চাই, বুঝলেন মশাই? এই আপনাদের মতো লোকেরা অন্ধ বিশ্বাসে আর কুসংস্কারে দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন বলেই এদেশে বিজ্ঞানের উন্নতি হল না।”

নন্দলাল চটলেন না। মোলায়েম গলাতেই বললেন, “ওরে বাবা, আমাদের ন্যালা পাগলাও কি যে-সে লোক নাকি? তাকেও তো অনেকে ছদ্মবেশী সাধক, অনেকে শিবের অবতার বলে মনে করে। খামোখা চটে যাও কেন বলো তো? ইতিবৃত্তান্তটা একটু খুলে বলো দেখি শুনি।”

হলধর একটা শ্বাস ফেলে বলল, “যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে আমি তাদের পছন্দ করি না বটে, কিন্তু আপনাকে আমার একজন বিবেচক মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। লোকে বলে আপনি নাকি বেশ বুদ্ধিমান লোক, বিপদে পড়লে লোকে আপনার কাছে বুদ্ধি-পরামর্শ নিতে আসে।”

“তা বাপু, তোমার কি বিপদ যাচ্ছে?”

হলধর অবাক হয়ে বলে, “তবে আর বলছি কী? বিপদ বলে বিপদ! বিপদের ওপর বিপদ। স্পাই তো লেগেইছে, এখন ভাড়াটে খুনিও এসে গেছে। সাধে কি আর মাঝরাতে উঠে বাঁশবনে এসে লুকিয়ে আছি! মশার কামড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত মশাই, তার ওপর পোকামাকড়েরও তো অভাব নেই।”

নন্দলাল চিন্তিতভাবে বললেন, “একটু খুলে বললে হয় না?”

“সেটাই তো বলার চেষ্টা করছি, আপনিই বাগড়া দিলেন।”

“আচ্ছা আর বাগড়া দেব না, বলে ফেলো।”

“ইংরিজি বইটই কি পড়া আছে ঠাকুরমশাই?”

“না হে বাপু, আমার বংশেই ও চর্চা ছিল না। আমার ঠাকুর্দা বলতেন, ও হল ম্লেচ্ছ ভাষা, শুনলে কানে গঙ্গাজল দিতে হয়।”

“ইংরিজি রূপকথায় ডাইনির গল্প আছে। ডাইনিরা নাকি ঝাটায় চড়ে উড়ে বেড়ায়, জানেন কি?”

“আমার নাতির বইতে ওরকম একটা ছবি দেখেছি বটে!”

“কথাটা হল আমি ছেলেবেলা থেকেই ওই উড়ুক্কু ঝটা নিয়ে খুব ভাবতাম। আমার মনে হল সেই আমলের ডাইনিরা ছিল আসলে বৈজ্ঞানিক, কিন্তু সাধারণ মানুষেরা বিজ্ঞানের কাণ্ড দেখে ভয় পেত বলে বৈজ্ঞানিকদের ডাইনি বলে এড়িয়ে চলত। উড়ুক্কু ঝাটার ছবি তো দেখেছেন তো ঠাকুরমশাই, আমাদের বঁটার মতো নয়। লম্বা একটা লাঠির ডগায় ঝাটাটা লাগানো থাকে।”

“তা দেখেছি বটে।”

“আসলে জিনিসটা হল একটা হালকা পোর্টেবল রকেট, লম্বা ডাণ্ডাটা হল রকেটের বডি আর তলার ঝাটাটা হল আসলে ফুয়েল ডিসচার্জ। রকেট যখন আকাশে ওঠে তখন তলার দিকটায় দেখবেন আগুনের যে হলকা বেরোয় তা অনেকটা বঁটার মতোই দেখায়। আইডিয়াটা মাথায় আসতেই আমার মনে হল, এরকম একটা জিনিস তৈরি করতে পারলে চারদিকে হইচই পড়ে যাবে। এখনকার গাবদা গোবদা রকেটের তো অনেক বায়নাক্কা, যখন-তখন যেখানে-সেখানে ব্যবহার করার জো নেই। কিন্তু উড়ুক্কু ঝাটার মতো হালকা রকেট যেখানে-সেখানে যখন-তখন ব্যবহার করা যাবে। ধরুন বর্ষার জলকাদা ভাঙতে হবে না, খালের ওপর সাঁকোটা ভেঙে পড়লেও চিন্তা নেই, হুড়ুম করে ওপর দিয়ে চলে গেলেন। তারপর ধরুন গিন্নি পুঁইডাঁটা কুটে দেখেন মিষ্টি কুমড়োর জোগাড় নেই। তো চট করে দশ মাইল দূরের ময়নাগড়ের হাট থেকে একফালি কুমড়ো কিনে দশ মিনিটের মধ্যে হাসতে হাসতে চলে এলেন। কিংবা ধরুন আপনার শ্বশুরবাড়ির গাছে খাজা কাঁঠাল পেকেছে, শাশুড়ি খবর পাঠাচ্ছেন, কোনও সমস্যা নেই। উড়ুক্কু ঝাটায় চেপে গিয়ে পেটভরে কাঁঠাল সাঁটিয়ে এলেন।”

নন্দলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কাঠালের কথা বলে আর দুঃখ দিও না ভাই। আগে আস্ত একটা কাঁঠাল একাই সাবাড় করতুম। আজকাল আর পেটে সয় না। খেলেই আইঢাই, চোঁয়া ঢেকুর, আমাশা। জিনিসখানা যদি বানাতে পারো তবে যজমানবাড়ি ঘুরে বেড়াতে বড় সুবিধে হয়। এখন চার-পাঁচখানার বেশি লক্ষ্মীপুজো করতে পারি না। ঝটাগাছ হলে দশ বারোখানা হেসে-খেলে পারা যাবে।”

কাঁচুমাচু মুখ করে হলধর বলল, “কাজ তো পনেরো আনা হয়েই গেছে ঠাকুরমশাই, সমস্যা ছিল জ্বালানি নিয়ে। এ রকেট তো হালকা পলকা জিনিস, তেল কয়লা তো আর ভরা যাবে না। তাই বহু খেটেখুটে, মাথা ঘামিয়ে পাঁচ বছরের চেষ্টায় একটা জ্বালানি বানিয়ে ফেলেছি। দিনসাতেক আগেই সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি উড়ুক্কু ঝটায় প্রথমে গোঁ গোঁ শব্দ হতে লাগল। তারপর হঠাৎ নড়েচড়েও উঠল। একটু উড়ু উড়ু ভাবও যেন হতে লাগল।”

চোখ বড় বড় করে শুনছিলেন নন্দলাল। সাগ্রহে বললেন, “তারপর? উড়ল নাকি?”

“এই হাতখানেক উঠেছিল, বুঝলুম কাজ প্রায় সেরে এনেছি। জ্বালানিতে আর একটা জিনিস মেশালেই ‘জয় মা দুর্গা’ বলে ঝাটা উড়তে লাগবে।”

“তুমি না নাস্তিক?”

“বটেই তো?”

“এই যে বললে জয় মা দুর্গা?”

“বলেছি নাকি?”

“নির্যস বলেছ!”

“ওটা ধরবেন না, কথার কথা।”

“তুমি পাষণ্ড বটে হে! তারপর ঝাটার কথাটা শেষ করো।”

“আজ্ঞে, পরশুদিনই জ্বালানির কাজও শেষ হয়েছে।” চোখ বড় করে নন্দলাল বললেন, “হয়েছে?”

“হ্যাঁ, তবে প্রয়োগ এবং পরীক্ষা হয়নি। তার আগেই গতকাল সন্ধেবেলা ওই কালান্তক যম এসে হাজির। ঠাকুরমশাই, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে আমার আয়ু শেষ। কে বা কারা ওই যমদূতকে পাঠিয়েছে তা জানি না। কাল সন্ধেবেলা যখন একমনে কাজ করছি তখন একটা ফোঁস শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি, জানালা দিয়ে ওই দানবটা আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে রয়েছে। তখনই আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নড়ে উঠল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। শেষরক্ষা হয় কিনা সেটাই চিন্তার কথা। আমার এতকালের পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সাধনা সবই বুঝি বৃথা গেল।”

নন্দলাল একটু চিন্তা করে বললেন, “লোকটাকে দেখে ভয় লাগারই কথা বটে। কিন্তু সে যে তোমাকেই মারতে এসেছে সেটা

তো এখনও সাব্যস্ত হয়নি।”

“তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কথা বলছি কেন?”

“বাপু, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কথা শুনেছি বটে, কিন্তু সেটা কী বস্তু তা জানি না। বলি ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয়টা কী জিনিস বুঝিয়ে বলল তো।”

“সে কি ছাই আমিই জানি। তবে মনে হয় সেটা টিকটিকির মতো একটা কিছু হবে। বিপদ ঘনীভূত দেখলেই সেটা টিক টিক করে ডাকতে থাকে।”

“শোনা যায়?”

“আজ্ঞে না, ঠিক শোনা যায় না। তবে টের পাওয়া যায়।”

“তবে আমার টিকটিকিটা ডাকে না কেন? সেটা কি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?”

“বিপদে পড়লে ঠিকই ডাকবে, কিন্তু ঠাকুরমশাই, আমার এত সাধের আবিষ্কারটার কী হবে? নিশুত রাতে প্রাণের ভয়ে উড়ুক্কু ঝাঁটা আর তার ফর্মুলা নিয়ে পালিয়ে এসে বাঁশবনে গা-ঢাকা দিয়ে আছি। কিন্তু এভাবে তো থাকা যাবে না মশাই।”

“দাঁড়াও বাপু, একটু ভাবতে দাও। বলি পেটে দানাপানি কিছু পড়েছে?”

“আজ্ঞে না। দুশ্চিন্তায় ওসব খেয়ালও করিনি।”

“তবে এই দুটো কলা আর খানকয় বাতাসা রাখো। ঠাকুরের প্রসাদ, ভক্তিতে হোক আর অভক্তিতে তোক একটু কপালে ঠেকিয়ে খেও। এ-বেলাটা বাঁশবনেই ঘাপটি মেরে থাকো, আমি ওবেলা আসবখন।”

নন্দদুলাল খুবই দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়িমুখো হাঁটতে লাগলেন। বিশ কদম যেতে না যেতেই বাধা পড়ল।

“পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই।”

“কে রে?”

“এই যে আমি!” নন্দলাল চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বললেন, “কই হে, কাউকেই যে দেখতে পাচ্ছি না।”

“আজ্ঞে, দয়া করে একটু ঘাড় তুলে ওপরের দিকে তাকাতে হবে যে!”

নন্দলাল ওপরের দিকে চেয়ে দেখলেন, পুরনো আমগাছটার প্রায় মগডালে ভূতনাথ ঘোড়সওয়ার হয়ে বসা।

“বাপু ভূতনাথ!”

“যে আজ্ঞে।”

“এটা কোন ঋতু, তা খেয়াল আছে?”

“ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে এটা তো শরৎকাল বলেই মনে হচ্ছে।”

“তা হলে বাপু, এই শরৎকালে আমগাছে উঠেছ যে বড়? এ তো আমের সময় নয় হে।”

“আজ্ঞে আম নয় ঠাকুরমশাই, খুড়োমশাইয়ের খোঁজে এসেছি।”

“খুড়োমশাই! বলি তোমার খুড়োমশাইয়ের আবার এ-গাঁয়ে কবে আগমন হল? আর এত জায়গা থাকতে বুড়োমানুষ আমগাছেই বা উঠতে গেলেন কেন? পড়ে হাত-পা ভাঙবে যে!”

ভূতনাথ হেসে বলল, “আজ্ঞে সে ভয় নেই। খুড়োমশাইয়ের গাছপালা খুব পছন্দ। হাত-পা ভাঙার উপায় নেই, বায়ভুত জিনিস কি না।”

“হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথায় এসো তো হে।”

“আজ্ঞে। ঠাকুরমশাই, আসল কথাটা বলার জন্যই তো গলা খুসখুস করছে। কিন্তু কাকে বলি বলুন! ভূতনাথের কথা যে কেউ মোটে বিশ্বাসই করতে চায় না। অভয় দেন তো শ্রীচরণে নিবেদন করে ফেলি।”

“তা করে ফেলো বাপু।”

ভূতনাথ গাছ থেকে নেমে এসে ভারী ভক্তিভরে নন্দলালের পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে আর মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “আজ্ঞে, কথা তো অনেক। কোনটা আগে বলি, কোনটা পরে সেইটেই সমস্যা। কথার সঙ্গে কথার বড় ঠেলাঠেলি হচ্ছে মশাই, ভেতরে।”

“যেটা আগে বেরোতে চাইছে সেটাকেই বের করে দাও।”

“যে আজ্ঞে। গুরুতর কথাটাই বলি তা হলে। আমাদের হাবু দাসের শরীরে যে আর একটাও হাড়গোড় আস্ত নেই সে-খবর কি শুনেছেন?”

নন্দলাল অবাক হয়ে বললেন, “বলো কী হে? হাবু দাস পালোয়ান মানুষ, তার হাড়গোড় তো সহজে ভাঙার কথা নয়। খাট থেকে ঘুমের ঘোরে পড়েটড়ে গিয়েছিল নাকি?”

ভূতনাথ টপ করে আর একবার খাবলা দিয়ে নন্দলালের পায়ের ধুলো নিয়ে গদগদ হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আপনি সিদ্ধপুরুষ, অন্তর্যামী। সবই আগেভাগে জেনে যান। বৃত্তান্তটা অনেকটা তাই বটে। তবে তফাত হল, হাবু পড়ে যায়নি, তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।”

“অ্যাঁ! কার ঘাড়ে দুটো মাথা?”

“আজ্ঞে, উনি বোধ হয় কল্কি অবতারই হবেন। সেইরকমই চেহারাখানা, দেখলে ভক্তিও হয়, ভয়ও হয়।”

“তা হাবুর দোষটা কী?”

ঘাড়টাড় চুলকে ভূতনাথ বলল, “আজ্ঞে, হাবুদাদার মতো মানুষ হয় না, কারও সাতেপাঁচে নেই। চারটি খাওয়া আর ঘুম। কোথা দিয়ে সূর্যোদয় হয়, কোথা দিয়ে অস্ত যায়, তা উনি টেরও পান না। কানে খড়কে দিন, কালীপটকা ফাটান বা কামান দাগুন, হাবুদাদার ঘুম ভাঙার নয়, ওই ঘুমই তো প্রায় কালঘুম হয়ে যাচ্ছিল আর কী!”

“ভণিতা ছেড়ে আসল কথাটায় এলেই তো হয়।”

“আজ্ঞে, পিছনের কথাটা না বললে সামনের কথাটা তেমন পরিষ্কার হয় না কিনা, তা দোষটা ধরুন হাবুদাদারও নয়, দোষ পাঁচুর। কল্কি অবতারটিকে নাকি কর্তাবাবুই এনেছেন। তা পাঁচু বলল, পালোয়ানের ঘরেই পালোয়ন থাকা ভাল। দু’জনে বেশ মানানসই হবে। এই বলে কল্কি অবতারকে তো পাঁচু হাবু দাসের ঘরেই ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু কাঁচাখেগো দেবতাটি বলে বসল, ওই মোটা লোকটা জানালার ধারে ভাল জায়গাটা দখল করে থাকলে তো চলবে না। ওই জায়গাটা আমার চাই। তা পাঁচু মিনমিন করে কী একটু আপত্তি করেছিল যেন। কিন্তু অবতারটি সে-কথায় কান না দিয়ে সোজা হাবু দাসকে নাড়া দিয়ে বলল, ওহে, তোমার বিছানাটা ওই কোণের দিকে নিয়ে যাও, আমি আলো-বাতাস ছাড়া থাকতে পারি না। কিন্তু হাবু দাসের ঘুম ভাঙায় তার সাধ্যি কী! অবতার মানুষ তো, বেশি কথাটথা কইতে জানেন না। এঁরা কাজ ভালবাসেন। বললে বিশ্বাসই করবেন না, তোশকটা ধরে স্রেফ একটা ঝাড়া দিলেন। হাবু দাসের ওই দশাসই বিশমনি শরীরখানা যেন চড়াই পাখিটির মতো উড়ে গিয়ে গদাম করে দশ হাত দূরে পড়ল। কল্কি দেবতার এলেম দেখে আমাদের শরীর হিম হয়ে গেল। পাঁচুর সে কী ঠকঠক করে কাঁপুনি।”

“আ মোলো যা। বলি তাতেও কি হাবুর ঘুম ভাঙেনি! উঠে তো দু-চারটে রদ্দা মারতে পারত।”

“আজ্ঞে। তা হয়তো মারতেনও। কাঁচা ঘুমটা ভেঙেও গিয়েছিল। কিন্তু চোখ মেলেই নিজের হাত-পা খুঁজতে লাগলেন যে! ভারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কেবল বলছিলেন, ওরে আমার হাত কই? পা কই? এই যে বাঁ হাতটা পেয়েছি, কিন্তু ডান হাতটা কোথায় গেল বল তো! ওরে, আমার মুণ্ডুটা! সেটা তো দেখতে পাচ্ছি না! তা আমরাই সব খুঁজে পেতে দিলাম। হাবুদাদা খুশি হয়ে বললেন, যাক বাবা, সব ঠিকঠাক আছে তা হলে! বেশ, তবে আমি এবার ঘুমোই?”

“এই যে বললে বাপু, হাড়গোড় আর আস্ত নেই?”

“আজ্ঞে, বলেছি। আস্ত নেইও। তবে হাবুদাদার শরীর তো পেল্লায়। অত বড় শরীরের খবর মগজে পৌঁছতে তো একটু সময় লাগবে। না কি? তা ধরুন, দশ মিনিট পরে হাবুদাদা বাপ রে, মা রে’ বলে চেঁচামেচি শুরু করলেন। কোবরেজমশাই এসে বললেন, মোটে সাতখানা হাড় ভেঙেছে।”

“বলো কী হে? এ তো রীতিমত খুনখারাপি!”

“আজ্ঞে। সেই কথাটা বলতে গিয়েই তো গুণেনবাবু কল্কি অবতারের ঠোকাটা খেলেন।”

“এর পর ঠোকনাও আছে নাকি?”

“যে আজ্ঞে। কাল জ্যোৎস্নারাত্তিরে গুণেনবাবুর একটু ভাব এসেছিল। ছাদে উঠে গান গাইছিলেন। গণ্ডগোল শুনে নীচে এসে কাণ্ড দেখে কল্কি অবতারকে গিয়ে একটু তড়পেছিলেন। কী বলব ঠাকুরমশাই, কল্কি অবতার স্রেফ হাই তুলতে তুলতে ছোট্ট করে পিঁপড়ে তাড়ানোর মতো একটা ঠোকনা দিয়েছে কি দেয়নি, অমনি গুণেনবাবু ছিটকে পড়ে চোখ উলটে গোঁ গোঁ করতে লাগলেন।”

নন্দলাল ভারী চটে উঠে বললেন, “গুণ্ডাটা এত কাণ্ড করল আর তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে? কিছু করলে না?”

“আজ্ঞে, করলুম বইকী!”

“কী করলে শুনি?”

“আমরা ওঁর প্রতি ভারী ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করলুম। পাঁচু তো গড় হয়ে পেন্নামই করে ফেললে। ফটিক দু’ টাকা নজরানা অবধি দিয়েছে। আমি যে কী করেছিলুম তা ঠিক স্মরণে নেই বটে, কিন্তু ওরকম ধারাই কিছু একটা হবে।”

“কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার!”

ভূতনাথ খুব আহ্লাদের গলায় বলল, “এখন আপনি কুলাঙ্গার বলায় একটু লজ্জা-লজ্জা করছে বটে, কিন্তু গতকাল কুলাঙ্গার হতে পেরে কিন্তু ভারী আনন্দ হয়েছিল ঠাকুরমশাই।”

“বটে!”

“যে আজ্ঞে। তবে কল্কি অবতার আমাকেও ভারী বিপদে ফেলেছেন ঠাকুরমশাই। কালকের ওই হুলুস্থুলু দেখে খুড়োমশাই ভড়কে গিয়ে তফাত হয়েছেন। তাঁর আর টিকির নাগালটিও পাচ্ছি না। একটা গুপ্তধনের হদিস দেবেন বলে ক’দিন হল ঝুলিয়ে রেখেছেন। এখন তাঁর সন্ধান না পেলে যে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে আমার।”

“খুড়োমশাইটি কে বলো তো!”

“আজ্ঞে, তিনি হলেন কর্তাবাবুর ঊর্ধ্বতন তৃতীয় পুরুষের খাজাঞ্চি। পঞ্চাশ বছর হল গত হয়েছেন। আমাকে বড্ড স্নেহ করেন।”

“অ। তোমার যে আবার ভূতের কারবার তা তো ভুলেই গিয়েছিলুম বাপু।”

ভারী বিনয়ের সঙ্গে ভূতনাথ বলল, “আমার আর কী কারবার দেখছেন ঠাকুরমশাই। মাঠ গোবিন্দপুরের নিবারণ গড়াইয়ের কারবার তো দেখেননি! অশৈলী কাণ্ডকারখানা।”

“সে কি ভূতের পাইকার নাকি?”

“তা বলতে পারেন। তার ভূতের আড়ত দেখলে ভিরমি খাবেন। বিশ-পঁচিশজন কর্মচারী কারবার সামলায়।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress