রসসিক্ত কাব্য কথা
অভিনয়াদির দ্বারা অন্তরহৃদয়গত রসকে যা প্রকাশ করে, তাকে ভাব বলে। রস উৎপন্ন না হলে ভাবেরও কোন পৃথকসত্তা নেই। ভাবের দ্বারা যেমন রস প্রকটিত হয়, তেমনি রসের দ্বারাও ভাব প্রকটিত হয়।
কোন কবি যখন তার কাব্যশিল্প রচনা করেন তখন তার লৌকিক যে সব ভাব বাস্তব ঘটনার সাথে জড়িত থাকে, তাকে অবলম্বন করে তিনি সেই কাব্যশিল্প রচনা করতে পারেন না। লৌকিকভাবে বাস্তব ঘটনার সাথে অনুভূত ভাবগুলো যখন হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বাসনারূপে অবস্থিত হয় এবং সেই বাসনাগুলি বাস্তবকে অবলম্বন না করে তার হৃদয়ের মধ্যে উদ্বুদ্ধ হয়, তখনই তিনি দেশকালাদি রহিত ভাবে সাধারণীকৃতরূপে কাব্যার্থের বিভাবণ করতে পারেন। এবং তাদৃশ বিভাবন ব্যাপারের ফলেই যে কাব্য রচিত হয় তা লোকের আস্বাদ যোগ্য হতে পারে। নিজের ব্যক্তিগত বাস্তব ঘটনার বা তৎসহ রচিত অনুভবের বর্ণনায় কখনও কাব্য হতে পারে না, তা জীবন চরিত হতে পারে; তা দিয়ে লোকের চিত্তে অনেক অনুভব উৎপন্ন হতে পারে কিন্তু তা কাব্যরসজণিত অনুভব নয়।
ভারত বলেন, চার প্রকার রস—মূল রস। শৃঙ্গার, রৌদ্র, বীর ও বীভৎস।
শৃঙ্গার থেকে হাস্য, রৌদ্র থেকে করুণ, বীর থেকে অদ্ভুত এবং বীভৎস থেকে ভয়ানক রস উৎপন্ন হয়।
অভিনব গুপ্ত , একমাত্র রসকেই কাব্যের তাৎপর্য বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু অনেকেই তা সমর্থন করেন নি।
ভামহ, শব্দার্থের সাহিত্যকে কাব্য বলেছেন। এ ছাড়া রুদ্রট, শব্দ ও অর্থকে।
মন্মট বলেছেন, সগুণ ও দোষ বর্জিত শব্দার্থই কাব্য।
বামন বলেন, রীতি কাব্যের আত্মা।
দন্ডী , কাব্যের শরীরভূত শব্দের উপরেই জোর দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বনাথ ও কেশব মিশ্র- অভিনবকেই অনুসরণ করেছেন। বিশ্বনাথ, ‘রসাত্মক বাক্যকেই কাব্য বলেছেন। আর কেশব মিশ্র বলেন, রসই কাব্যের আত্মা।
আগে ধ্বনিই কাব্যের আত্মা স্বরূপ—এমন একটা মতও প্রচলিত ছিলো, তবে অনেকেই তা স্বীকার করতেন না। ধ্বনিকার এই মতকে সুন্দররূপে সমর্থন করেন।
আনন্দবর্ধন তার বৃত্তিতে এবং অভিনব তার লোচনটীকায় এই মত এমনকরে সমর্থন করেছেন যে মন্মট প্রভৃতি পরবর্তী অনেক আলংকারিকই এর অনুসরণ করে গেছেন। কাব্যতত্ত্বজ্ঞেরা অনেকেই যারা ধ্বনি স্বীকার করেন না, তারা বলেন যে শব্দ, অর্থ এবং অলঙ্কার ছাড়া নিরতিশয় শোভাবর্ধনকারী কাব্যের অন্য কোন গুণ নাই, কাব্যের শোভাকারী বলে মনে হয়। তার যে নাম দেওয়াই হোক না কেন তা গুণ বা অলঙ্কারের মধ্যে পড়বে। শব্দার্থ কাব্যের শরীর কিন্তু এরা কেউই ধ্বনি নয়, শব্দার্থের চারুতাকে ধ্বনি বলা যায় না। কাব্যের আলোচনা করলে সহজেই ধ্বনি বলে এমন কিছু পাওয়া যায় না—শব্দার্থের গুণালঙ্কার ছাড়া যার অন্য কোন স্বাতন্ত্র্য আছে। গীত, নৃত্য হাস্যাদির সহৃদয় হৃদয়াহ্লাদী শব্দার্থময়ত্ত্বই কাব্যতত্ত্বের লক্ষণ।
ধ্বনিবাদীরা বলেন যে ধ্বনিই কাব্যের বিষয়ীভূত অথচ পূর্ববর্তী প্রসিদ্ধ আলঙ্কারিকেরা তার কোনও উল্লেখ করেন নি। যদি কাব্যের এতাদৃশ্য প্রাণস্বরূপ কিছু থাকতো তবে তারা তার উল্লেখ করতেন এবং এ সম্বন্ধে বিচারও চলতে পারতো।
কেউ কেউ বলেন,’ লক্ষণার দ্বারা যে অর্থ পাওয়া যায়, তাই ধ্বনি। উদ্ভট, বামন প্রভৃতিরা এই মত পোষণ করতেন। কেউ কেউ বলেন যে ধ্বনিবস্তুর কোন লক্ষণ দেওয়া যায় না, তা বাক্যের অগোচর। কেবল হৃদয় দিয়ে সহৃদয় ব্যক্তিরাই তার আস্বাদ পেয়ে থাকেন। শরীরের লাবণ্য যেমন শরীরের অবয়ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অথচ তা অবয়ব দ্বারাই প্রকাশিত হয় এবং কোন অলংকারাদির অপেক্ষা রাখে না, ধ্বনিও তেমনি কাব্যশরীরের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয় অথচ কাব্যশরীর থেকে একান্ত স্বতন্ত্র।এই ধ্বনিগম্য অর্থটি তিন প্রকার—বস্তুমাত্র, অলঙ্কার এবং রসাদি, যা কাব্যর্থ দ্বারা আক্ষিপ্ত হয় কিন্তু বাচ্যার্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অভিনব বলেছেন—এই তিন প্রকার ধ্বনির মধ্যে রসধ্বনিই সর্বশ্রেষ্ঠ!