Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রমণীখোশ তৈল || Musharraf Khan

রমণীখোশ তৈল || Musharraf Khan

কিগো পুষ্পরাণী! বইসা আছো ক্যান? ভাইসাবগো তোমার নৃত্য দেখাবানা?
বিশ্রামরত নর্তকী পুষ্পবালা শঙ্খরানীকে সস্নেহে তাগিদ দেয় নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানির স্বত্বাধিকারী পূর্ণচন্দ্র রাজবংশী। তো অমনি পুষ্পরানী তার যাবতীয় নৃত্যকলা প্রদর্শনে চাতাল পরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নুপুরের এলোপাথারি ঝম ঝম নিক্কণ আর কতিপয় পোষা মুদ্রার বেপরোয়া পরিবেশন চলতে থাকে ঘুরে ফিরে একই তালে লয়ে ভঙ্গীমায়। শীর্ণদেহী কিশোরী পুষ্পরানী চপল চোখের বর্শা হানে নিজেরই অপুষ্ট অঙ্গ পানে। শশী খুড়োর গলায় গামছায় ঝুলানো হারমোনিয়ামের রীডের সড়কে ধেয়ে যায় লিকলিকে আঙ্গুলের বল্গাহীন ঘোড় দৌড়। তার দন্তবিহীন তুবড়ানো গালে ঝুলে থাকে দুর্বিনীত দুষ্ট ছেলের ঝিলিক দেওয়া মিস্কি হাসি।
– নজর দিয়োনা নাগর শরম লাগে গ অ অ অ।
উদাস উপাষ অঙ্গে আমার গরম লাগে গ অ অ অ।
শশী খুড়োর রচিত এবং সুরারোপিত বিপণন সঙ্গীত। পুষ্পরানীর মিহি কণ্ঠের গীত লহরীর চটুল রসে চনমনে হয়ে ওঠে সমবেত দর্শক শ্রোতা। তার নাকি সুরের প্রলম্বিত শরম লাগে গঅঅঅ’র সাথে শশী খুড়োর মরমী হারমোনিয়ামের অনুপম সিংক্রোনাইজেশনে মুগ্ধ শ্রোতার মুহুর্মুহু করতালি আর তীব্র শীস ধ্বনির মুর্ছনায় জমে যায় আসর।
টুগা টুগ্ টুগা টুগ্ । পূর্ণচন্দ্র রাজবংশীর কুশলী হাতের ডুগডুগির নেশা ধরানো ছন্দের আবেশে শিবরামপুর হাটের দক্ষিণ কোণের বটতলায় মোহন মোল্লার ধানকলের লাগোয়া চাতালে জমে উঠে নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানির সিংহ মার্কা রমনীখোশ তৈলের রমরমা পশার। তুখোড় ক্যানভাসার পূর্ণচন্দ্র রাজবংশীর বাচাল মুখে ফুটতে থাকে বিপণনের বিচিত্র ভাষার খই পটকা।
– তবে কিনা ভাইসব! টাকা পয়সা হাতের ময়লা এই আসে এই যায়। শরীলের সুখ দেহের কামনা বিদায় নিলে আর ফিরে না। শরীলের তাগত্ আর যৌবনের বলই অইল মানবদেহের অমূল্য সম্পদ। এই ধন ফুরাই গেলে পাথরে মাথা কুইট্টাও ফিরত পাইতেন না!
তারপর কথার গতিতে ঢিলেমী এনে পাশে দাঁড়ানো এক শীর্ণ পাণ্ডুর হাটুরের কাঁধে হাত রেখে একটা বিটকেলে হাসি দিয়ে পূর্ণচন্দ্র বলে,
– কি বাই সাব! বাড়ি ঘরের খবর কী? আমাগো ভাবী সাবের মন দিল বালা আছে নি?
পুলকিত হাটুরে বেকুবি হাসি উপহার দিয়ে ঘন ঘন ঘাড় চুলকায়। সমবেত জনতা সমস্বরে হেসে ওঠে। পূর্ণচন্দ্র ফিরে যায় মূল সুরে।
– তবে কিনা ভাইসব! এখানে এমন অনেক ভাই আছেন যাগোর বেগম সাবগো মন দিল বালা থাকে না গো! যে সকল ভাইয়েরা যৌবনের আরম্ভে অনাচারে কুঅভ্যাসে মূল্যবান যৌবন শক্তি নষ্ট করেছেন। অকালে অসময়ে অঙ্গবৈকল্যে আক্রান্ত হইয়া বিবাহে বিমুখ। বিবাহিত অথচ নিশি রাইতে পরাজয়ের ডরে স্ত্রী মিলনে অনীহা। বিশেষ মুহূর্তে শৈথিল্যের ভয়ে নারী গমনে অনিচ্ছুক। যৌবন বয়সেই সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। অনেকে আবার সিফিলিস্ গনোরিয়া এইডস্ নামক দুরারোগ্য মরণ ব্যাধির শিকার অইয়া নীরবে করিতেছেন অশ্রু বিসর্জন। যাদু টোনা তাবিজ কবজ পানি পড়ায় কাজ হয় নাই। দ্যাশ বিদ্যাশের নামকরা বড় বড় ডাক্তার কবিরাজ এম বি বি এস এফ আর সি এস এর চিকিৎসায় কোনো ফল না পাইয়া বছরের পর বছর ভুগিতেছেন চরম হতাশায়। ঘরে ঘরে অশান্তি। স্বামী-স্ত্রীতে অমিল। রাগ ঝাল মান অভিমান ঝগড়া বিবাদ কলহ। এই সকল মুশকিল আসানের জন্য পাহাড় জঙ্গল হইতে সংগৃহীত দুষ্প্রাপ্য গাছগাছড়ার রস, মূল্যবান ধাতু, এবং মৃগনাভী কস্তুরীর নির্ঝাস হইতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি দ্বারা প্রস্তুত স্বাস্থ্য দফতরের সনদ প্রাপ্ত নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানির জনপ্রিয় সিংহ মার্কা অলৌকিক কেরামতির রমনীখোশ তৈল বাজারে আসিয়াছে। তবে কিনা ভাইসব! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। একশ’ পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়া কইতাছি। নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানির সিংহ মার্কা রমনীখোশ তৈলের তিনটি ফাইল ব্যবহারে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এইসব রোগব্যাধি হতাশা হইতে নিশ্চিত মুক্তি। এই তৈল প্রয়োগে যত আরাম সেবনে তার ততই সুখ। এই তৈলের ব্যবহার নরের দেহে আনে সিংহের বল আর নারীকে দেয় মিলনের তৃপ্তি। স্বপ্নাদিষ্ট এই অলৌকিক তৈল হাজার হাজার নর-নারীর মধুর মিলনের গোপন সাথী।
বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়। আমার কথা বিশ্বাস না অইলে নিজেরাই তয় সরেজমিনে পরখ কইরা দ্যাখেন নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানির সিংহ মার্কা রমনীখোশ তৈলের ব্যবহারে উপকৃত শত শত কাস্টমারের অকৃপণ প্রশংসার কথা।
বলেই পূর্ণচন্দ্র একটি কাপরের থলির মুখ খুলে চাতালের উপর ঢেলে দেয় শতেক চিঠির স্তূপ। নানা ধরনের নতুন পুরাতন দেশী বিদেশী পোস্টকার্ড খাম আর এ্যারোগ্রামে বাংলা হির্ন্দি ইংরেজি নানা ভাষায় ঠিকানা লেখা শত চিঠির প্রদর্শনী। সেখান থেকে একটি চিঠি তুলে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে থাকে পূর্ণচন্দ্র,
– শ্রদ্ধেয় মহাশয়। অনুগ্রহ পূর্বক এই চিঠির গোপনীয়তা রক্ষা করিবেন। শরীরের কিছু অসুবিধার কারণে আমার বহু বছরের বিবাহিত নিঃসন্তান স্ত্রী আমাকে লাগাতার তালাকের হুমকি দিয়া আসিতেছিল। এক বন্ধুর পরামর্শে নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানির সিংহ মার্কা রমনীখোশ তৈলের তিনটি ফাইল ক্রয় করি। নিয়মিত সেবনে ও প্রয়োগে অচিরেই বিশেষ উপকার পাই। আমার স্ত্রীর দেহের সুখ আর মনের শান্তি ফিরিয়া আসে। বছর না ঘুরিতেই সে আমাকে জমজ পুত্র সন্তান উপহার দেয়। কিছুদিন পর স্ত্রীর একান্ত অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে বাধ্য হইয়া দ্বিতীয়বার বিবাহ করি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী ও আপনাদের অলৌকিক তৈলের কেরামতিতে এখন দুই স্ত্রীকেই তৃপ্ত রাখিয়া পরম সুখে জীবন যাপন করিতেছি।
সমবেত দর্শক শ্রোতাদের মাঝে একটা হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ে। করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে বিকিকিনির আসর। অতঃপর পূর্ণচন্দ্র রমনীখোশ তৈলের এমনি অজস্র গুণ কীর্তনে গুঞ্জরিত আরও কিছু চিঠি পাঠ করে শোনায় সমবেত শ্রোতাদের।
– তবে কিনা ভাই সব! নিখিল বঙ্গ নিরাময় কোম্পানি জনপ্রিয় রমনীখোশ তৈল ক্রয়ের আজকার এই মওকা হেলায় নষ্ট করবেন না। আমাগো মালের স্টক সীমিত। আগে চাইলে আগে পাইবেন। ফুরাইয়া গেলে পাইবেন না। কোম্পানির নির্ধারিত দাম প্রতি ফাইল বিশ টাকা। তয় শুধু আইজকার জন্য ইস্পিশাল ডিসকাউন্ট প্রতি ফাইল মাত্র দশ টাকা দশ টাকা দশ টাকা। একসাথে তিন ফাইল নিলে মাত্র বিশ টাকা বিশ টাকা বিশ টাকা। বিফলে মূল্য ফেরত। কোম্পানির গ্যারান্টি। ভাগ্যবান ভাইয়েরা আমার! পয়সা সহ হাত বাড়াইলে তেল। না বাড়াইলে ফেল।
টুগা টুগ। টুগা টুগ্। পূর্ণচন্দ্রের কুশলী হাতে দ্রুত বেজে চলে বিপণনী ডুগডুগি। ভিড়ের মধ্য থেকে কয়েকজন সাগ্রহে হাত বাড়ায়,
– আমারে দ্যান এক ফাইল।
– আমারে তিন ফাইল।
– আমারে দুইটা।
এই আপাত উদগ্রীবরা কিন্তু আসল ক্রেতা নয়। এরা পূর্ণচন্দ্রের চুক্তিবদ্ধ দালাল। আগে থেকেই বুঝাপড়া করা থাকে। ভিড়ের আনাচে কানাচে ঘাপটি মেরে বসে থাকে তারা। সঠিক সময়ে পূর্ণচন্দের গোপন ইশারায় তাদের আবির্ভাব হয় ক্রেতার বেশে। বেচাকেনার হুজুগের খেইটা এরাই ধরিয়ে দ্যায়। দেখাদেখি এবার অন্যেরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফাইলের পর ফাইল বিলি হয় উৎসাহী ক্রেতাদের হাতে হাতে। নর্তকী পুস্পরানী এখন অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখন সে ক্যাশ কালেকটর। হেসে হেসে হেলে দুলে সে পয়সা তোলে ক্রেতার কাছে। আঙ্গুলে আঙ্গুলে এক আধটু ছোঁয়াছোঁয়ি। পুষ্পরানীর মোহন হাসির যাদু টোনায় আটকা পড়ে শতেক দর্শকের মন। রমনীখোশ তৈলের একটি দুটি ফাইল ক্রয়ই যেন এই বন্দী দশার মুক্তিপণ।
অথচ এমন রমরমা অর্থায়নের দিনকাল চিরদিন ছিল না পূর্ণচন্দ্রের। অসময়ে পিতৃবিয়োগের জেরে অনভিজ্ঞ অপটু হাতে এসেছিল সংসারের ভার। সংসারে মা আর পিতৃদেবের সখ ক’রে ঘরে আনা পুত্রবধূ গিরিবালা। তখন পূর্ণচন্দ্রদের বড় দুর্দিন। পিতা বিমানচন্দ্র রাজবংশী এক মাঘী অমাবস্যার ভোরে চাইরার খালের ঘেরে ডুব দিয়ে মাছ তুলতে গিয়ে আর উপরে উঠে আসেনি। বিশাল মাছের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে ঘেরের নিচে পুঁতে রাখা গাছের ডালপালায় তার বিশাল শরীর আটকে যায়। পরের দিন সকালে জেলেরা যখন ধরাধরি করে বিমানচন্দ্রের নিথর দেহখানি ডাঙ্গার উপরে নিয়ে এলো এক অতিকায় আইর মাছ তখনও তার বুকের সাথে সাপটে রাখা। আইর মাছের তীক্ষ্ণ কাঁটা বিমানচন্দ্রের বক্ষদেশ এফোর ওফোর করে রেখেছে।
বাড়ৈখালীর বাজারে জেলেদের লাইনে ধসে মাছ বিক্রি করছিল পূর্ণচন্দ্র। হঠাৎ দেখে খগেন কাকু খালই হাতে সামনে দাঁড়িয়ে।
– কিরে ভাতিজা! বেচাকেনা কেমুন? মাছের খারি দেহি খালি খালি?
– মাছ থাকলে তো বেচা কেনা কাকু? খাল বিল শুকাই গেছে । কোথাও মাছ পাওয়া যায় না গো। সকাল সন্ধ্যা ভেশাল পাইতা বইসা থাকি। সারাদিনেও খারির কোণা ভরে না। বড় নদীর ঘের ইজারা সব নেতাদের দখলে চইলা গেছে। আমারার জাউলাগো অহন না খাইয়া মরণ!
– খাল বিলের মাছ বেইচা পেট চালানোর জামানা আর নাইরে ভাতিজা। অহন মাছের যোগান আহে শহর বন্দরের বড় লোকের ফিশারীজ থনে। তোমার বাবার আমলে জাউলারা রুই কাতলা বোয়াল উঠাইছে নদী হাওরের ঘেরে থনে। অহন কাওরান বাজার সোয়ারীঘাট পাগলার মাছের আড়তে রুই কাতলা চিতল আহে বার্মা মুলুক থেইকা। রাজবংশীগো দিন শ্যাষ। বাঁচতে অইলে অন্য লাইন ধর ভাতিজা!
– কি করুম কাকু! আর কোনো কামতো জানি না। বাপ দাদার পেশা জাউলাগিরি থুইয়া কি করণ কন দেহি?
– রাস্তা আছে ভাতিজা। একদিন বাড়িতে আইস। বুদ্ধি দিমুনে।
তো সেই খগেন কাকুর পরামর্শে আর বুদ্ধির জোরেই পূর্ণচন্দ্র রাজবংশীর রমনীখোশ তৈলের এই ব্যবসার পত্তন। টার্গেট মার্কেট গ্রাম গঞ্জের দাম্পত্য মিলন সুখ বঞ্চিত অতৃপ্ত নারী পুরুষ। খগেন কাকু বলেন, এই দ্যাশের ঘরে ঘরে অপুষ্ট অক্ষম আর অতৃপ্ত নর নারী। এই বাজারটা ঠিক মত ধরতে পারলে লালে লাল হয়ে যাবা ভাতিজা। বাদাম তেলে, সেন্ট, আর রং মিশাইয়া খালি শিশিতে ভরবা, লেবেল লাগাইবা আর বেচবা। নাম দিবা রমনীখোশ তৈল। পাবলিকে খাইবো এই জিনিস। এই দ্যাশে অহন জিনিসের ভিতরের গুণাগুন কোনো মুখ্য ব্যাপার নয়। অখনকার পাবলিকে বাইরের চমকটাই বেশি দ্যাখে। দ্রব্যের মোড়কটা যত চকচকা তত তার কদর। এইডা অইলো ঢোল পিটানোর যুগ। ব্যবসা বাণিজ্যে খালি গলাবাজীর ঢোল ডগর। চোপার জোরে বাজার মাত। যত বড় ঢোল তত বড় আওয়াজ। যত জোরে ঢোলের বাড়ি তত দূরে প্রচারের বিস্তার। খগেন কাকু বলেন এই মৌসুমডারে কামে লাগাও ভাতিজা। ভাদ্র আশ্বিনের বর্ষা বাদলের দিনে মানুষ জনের কাম কাইজ কম। গরু বাছুর ঘোয়াইলে বান্দা। কিষাণগো রবি শস্যের ক্ষেতে কাজ শুরু অইতে অইতে অঘ্রাণ পৌষ। অহন কিষাণ মজুররা বাড়ি ঘরেই থাকে। স্বামী স্ত্রীতে দেখা সাক্ষাৎ মেলামেশাটা অহন একটু বেশি বেশি হয়। এই মৌসুমে মন দিল দিয়া হাট-ঘাট কর। দেখবা তোমার তেলের চাহিদার কেমন বাড় বাড়ন্ত বাজার । খগেন কাকুর কথাটা ঠিক। এই কয় মাস প্রতিটি হাট বাজারে রমনীখোশ তৈলের অতিরিক্ত বিক্রি। কোমরের সাথে বেঁধে রাখা টাকার থলিটি হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে পূর্ণচন্দ্র। হাতের ডালা উপুর করে উপার্জন দিছেন মা লক্ষী।
আকাশের আলো আঁধারি ছাদের নিচে গড়িয়ে গড়িয়ে বয়ে চলেছে ভরা যৌবনের ইছামতি। নবমী চাঁদের জোসনায় ঝিকঝিক করছে রূপালী জলের প্রশস্ত চাতাল। দু’পাশের গ্রাম, ঘর-বাড়ি, গাছপালা, ধানক্ষেত, খালের বাঁক অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই ভর রাত্রিতেও। স্রোতের টানে আপন বেগে বয়ে চলেছে যাত্রী বোঝাই হাট ফেরত গয়নার নাউ। পেছনে শুধু মাঝি ভাই বসে আছে নৌকার হাল ধরে। ক্ষীপ্র হাতের নিপুণ ইশারায় ইচ্ছামতির প্রখর স্রোত আর ঢেউয়ের দোলায় কেঁপে কেঁপে নদীর এ বাঁক সে বাঁক হয়ে এগিয়ে চলেছে তার কত কালের পোষ মানা গয়না। হাটুরেরা কেউ কেউ চাদর মুড়ি দিয়ে যুত করে শুয়ে পড়েছে নৌকার পাটাতনে। ছইয়ে ঝুলানো হারিকেনের মৃদু আলোর নীচে এখানে সেখানে বসেছে কিছু তাসের আসর। বাকীরা চড়ে বসেছে নৌকার প্রশস্ত ছইয়ের উপরে।
ছইয়ের উপরে এক নিভৃত কোণে বসে পূর্ণচন্দ্র রাজবংশী সন্তর্পণে স্পর্শ করে কোলের কাছে যতনে রাখা গামছার পুটুলিটি। আশেপাশের মানুষদের নজর এড়িয়ে পুটুলি খুলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করে গিরিবালার জন্যে কিনে আনা উপহার সামগ্রী। লাল পেড়ে ডোরা কাটা তাঁতের শাড়ি। রঙিন পেটিকোট। ডানাকাটা লাল ব্লাউজ। গিরিবালার প্রিয় প্রসাধনী স্নো পাউডার লিপষ্টিক আর পায়ে মাখার আলতার কৌটা। পুটুলির একেবারে ভেতরের দিকে গোছানো আছে তার নিজস্ব পছন্দের লাল সাদা খয়েরী রঙের তিনটা গোপন জিনিস। কেনার সময় লজ্জায় সঠিক মাপটি বলা যায়নি দোকানীকে। হাট-বাজার মাত করা রমণীখোশ তৈলের তুখোড় ক্যানভাসারও নিজের বৌয়ের এই জিনিসটি কিনতে গিয়ে আরেক দোকানীর কাছে দারুণ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। বুঝে নিয়েছিল অভিজ্ঞ দোকানী। এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করেছিল বয়স কত? এই ধরেন কুড়ি বাইশ। তয় দাদা এইটা নিয়া যান। মাপটা এখন বার বার মনে আসছে। তার রূপসী তন্বী বউ গিরিবালার শরীরের মাপ। এও কি ভুলবার জিনিস? পূর্ণচন্দ্রের দেহের কোষে কোষে তির তির করে বয়ে যায় এক সুতীব্র অনুরণন। গিরিবালার জন্য হৃদয় মন তার ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কতদিন দেখা হয়নি গিরিবালার সাথে? রমনীখোশ তৈলের বিকিকিনির এই মুখর মৌসুমে এ হাট থেকে সে হাটে এ গঞ্জ থেকে সে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে কেটেছে কতগুলি দিন মাস? কতদিন গিরিবালার খবর নেয়া হয়নি? রাজবংশী পাড়ায় কখন পৌঁছুবে গয়নার নৌকা? গিরিবালা যা ঘুম কাতুরে! এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেগে নেই। মনে মনে মতলব ভাজে পূর্ণচন্দ্র। বাড়ী ফিরেই টেনে তুলবে ঘুম থেকে। বাকী রাত একটি মুহূর্তও আজ আর ছুটি নেই গিরিবালার।
গয়নার নৌকার ছইয়ের উপরে শীতল হাওয়ার আদুরে পরশে ঝিমুনি ধরে গিয়েছিল। হঠাৎ মাঝি মাল্লাদের হাঁক ডাকে ধরফর করে উঠে বসে পূর্ণচন্দ্র। রাজবংশী পাড়ার ঘাটে এসে ভিড়ে হাট ফেরত গয়নার নাউ। মাঝি মাল্লারা সমস্বরে হাঁক ছাড়ে,
– রাজবংশী পাড়া, রাজবংশী পাড়া। নামেন গো ভাই সাহেবেরা।
শেষ রাতের নির্জনতায় এখনো কিছু ভিড় আছে ঘাটে। হাট ফেরত স্বজনের প্রতীক্ষায় এখানে ওখানে জটলা করে বসে আছে তারা। এখন তারা দৌড়ে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় ঘাটের পাড় ঘেঁষে। হাটুরেরা যার যার মাল সামান নিয়ে নেমে যায় নৌকা থেকে।
এই সময় কোথা থেকে পূর্ণচন্দ্রের বৃদ্ধা মাতা পাগলের মত ছুটে এসে আছাড় খেয়ে পড়ে গয়নার নৌকার গলুইয়ের উপর।
– ওরে পূর্ণ! এতদিন কোথায় ছিলিরে বাপ? তোর গিরিবালা!.. তোর গিরিবালা.. বলতে বলতে কান্নার তোড়ে কথা আটকে যায় শোকার্ত বৃদ্ধার কণ্ঠে। পূর্ণচন্দ্র উদ্ভ্রান্তের মত সমবেত প্রতিবেশীদের দিকে ফিরে বলে,
– কী হয়েছে গিরিবালার আ ?
– মুখপোড়া এক প্রতিবেশীনি খ্যারখ্যারে গলায় খেঁকিয়ে উঠে,
– কি হবেরে পোড়াকপাইলে? পালিয়েছে তোর সাধের বৌ। পিরিতের মানুষের সাথে লাপাত্তা হয়েছে গো তোমার গিরিবালা।
পূর্ণচন্দ্রের মা বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে প্রতিবেশীনির কোলে। পূর্ণচন্দ্র সেদিকে একটুও ভ্রূক্ষেপ না করে পাশ কাটিয়ে উঠোন পেরিয়ে দৌড়ে চলে যায় ঘরের ভেতর। দ্রুত হাত গলিয়ে দেয় শিকেয় ঝুলানো মাটির শানকিতে। শিকেয় ঝুলানো এই মাটির শানকিটি পূর্ণচন্দ্র গিরিবালার মান অভিমান বিনিময়ের গোপন ডাকবাক্স। মধুর দাম্পত্যের দিন রাত্তিরে কলহ অভিমানের দুর্বহ মৌসুমে দু’জনের তাবৎ সালিস অভিযোগ অনুনয় বিনয় সন্ধি প্রস্তাব আদান প্রদান হয় এই গোপান ডাকবাক্সে। পূর্ণচন্দ্র জানে গিরিবালার ইনিয়ে বিনিয়ে লেখা একটি অভিমানী চিঠি থাকবেই শানকিতে। উদগ্রীব হাতের সঞ্চালনে বেরিয়ে আসে দু’ভাজ করা এক টুকরা কাগজ।
আহঃ! গিরিবালার চিঠি! খুলে পড়তে শুরু করে প্রবল ত্রস্ততায়। গিরিবালার চিঠিতে অন্য দিনের মত প্রাণাধিক আমার, কিংবা ওগো মোর জীবনের সাথী জাতীয় কোন সোহাগের সম্বোধন নেই। চিঠিটা শুরু এইভাবে,
– শোন পূর্ণচন্দ্র রাজবংশী! তোমারতো ঘরে মন নাই। বাইরে বাইরে কায়-কারবার তোমার। তোমার আশায় বইসা থাইকা জীবনডারে নষ্ট কইরা কী লাভ অইব আমার? এখন আমার যৌবন কাল। এই নতুন শরীরে কত আগুন! কত তার চাওয়া পাওয়া! হেই খবর কি তুমি রাখ? ঘরের মানুষডারে উপোষ রাইখা তোমার রমণীখোশ তেলে কোন্ রমণীরে খুশী কর পূর্ণচন্দ্র? তোমার ঐ তেলে কিসসু নাই! তুমি শঠ্ । তুমি মানুষ ঠকাও। কেমন মরদ তুমি? চাইর বছর তোমার ঘর করছি। কোলে আমার একটাও সন্তান দিতে পার নাই! তুমি অক্ষম। তুমি হিজড়াগো নাহাল পঙ্গু! তোমারে আমার আর দরকার নাই। চইলা গেলাম আমি।
ইতি-
গিরিবালা।
পূর্ণচন্দ্র রুদ্ধবাক। বিধ্বস্ত বিচূর্ণ। গিরিবালার চিঠিটি হাতে নিয়ে বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে সে ঘরের মেঝেতে। তুখোড় বিকিকিনির প্রবল অশ্বারোহী বণিক বাজার মাত করা রমণীখোশ তৈলের বাচাল বিপণক পূর্ণচন্দ্র রাজবংশী এখন বাকহীন, স্থবির। উদ্ভ্রান্ত অগোছালো পায়ে ঘর থেকে সে নেমে আসে দাওয়ায়।
বাইরে তখন জাঁকিয়ে বসেছে ভোরের আলোর প্রথম জলসা। ঘাটে ঘাটে যাত্রী নামিয়ে কখন চলে গেছে হাটুরেদের গয়নার নাউ। প্রতিবেশীরা সবাই ফিরে গেছে নিজ নিজ গৃহে। সরব হয়ে উঠছে গ্রামীণ সংসারের দিবস শুরুর প্রথম শব্দ ছন্দ। গিরিবালার কল কাকলিতে মুখরিত পূর্ণচন্দ্রের প্রতিদিনের প্রত্যুষের সংসার আজ শব্দহীন। উঠোনের এক কোণে সজনে গাছের গুঁড়িতে মাথা এলিয়ে পড়ে আছে মা। এলোমেলো পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় পূর্ণচন্দ্র। ধীরে ধীরে সে বসে পড়ে মায়ের পাশটিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress