Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রবীন্দ্ররচনার বানান || Rajshekhar Basu

রবীন্দ্ররচনার বানান || Rajshekhar Basu

বাংলা ভাষার এক বিশেষ সমস্যা অগণিত শব্দের ব্যাকরণ সম্মত একাধিক বিকল্প বানান–যা এই ভাষা শিক্ষা, রচনার শুদ্ধি রক্ষা ও মুদ্রণ পদ্ধতিকে জটিল ও বিশৃঙ্খল করে তুলছিল। এর সমাধান ও নিয়মাবলী সুনির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে বানান-সংস্কার সমিতি গঠন করেন, যার যোগ্যতম সভাপতিরূপে নির্বাচিত হন রাজশেখর বসু। সাধারণের প্রবল বিরোধ বিতর্ক ও মতানৈক্য পার হয়ে সমিতি-নির্দিষ্ট নিয়মাবলী প্রকাশিত হয়–এর বিশদ বিবরণ বানানের নিয়ম প্রবন্ধে আছে।

রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের সময় বিশ্বভারতী এই বানানের সমতা ও সরলতা সম্বন্ধে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন অনুভব করেন, কারণ বহু বৎসরব্যাপী রচিত এই বিপুল সম্ভারে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিস্তর বানান-পার্থক্য দেখা দিয়েছে কবি স্বয়ং তা স্বীকার করে কারণস্বরূপ ভাবনা ও অভ্যাসএর মধ্যে বৈষম্য নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছেন। এই সমস্যা অতিক্রম করে সমতা ও সরলতা আনার প্রায় শেষকথা রাজশেখরকে তাই চিঠি দিয়ে মতামত চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে শ্রীকানাই সামন্ত। চিঠিটা পাই নি, তাই প্রশ্ন অনুপস্থিত। কিন্তু প্রায় সব উত্তরই স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং প্রায় এই নির্দেশ মেনেই আজও মুদ্রিত হয়ে চলেছে রবীন্দ্র রচনাবলী।

এই উত্তরমালাও এক সুরচিত প্রবন্ধ। –স:।

শ্ৰীযুক্ত কানাই সামন্তর প্রশ্নের উত্তর

১। কবির সকল বই-এর বানান ইত্যাদি সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তিনি নিজে একই পদ্ধতিতে চলেন নি, সর্বমান্য কোনও পদ্ধতি নেই। ভাষায় খুঁটিনাটি এত বেশী যে কবির গ্রন্থাবলীর জন্য একটা সম্পূর্ণ পদ্ধতি খাড়া করাও বৃহৎ ব্যাপার। সুতরাং যথাসম্ভব সংগতিরক্ষার চেষ্টা করা ভিন্ন উপায়ান্তর দেখি না।

কবি ইলেক পছন্দ করতেন না। ৫/৬ বৎসর আগে আমি একবার তাকে বলি-ও-কার লেখার চেয়ে ইলেক দেওয়া ঢের সোজা, আর তাতে শুধু দরকার মতন উচ্চারণ বোঝানো যায়, শব্দের পূর্বরূপ বিকৃত হয় না। কবি এই যুক্তি মেনেছিলেন। কিন্তু তখন হক হন ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা হয় নি। আমার ধারণা–ক্রিয়াপদের একটি বড় ফর্দ কবির সামনে ধরলে তিনি সংগতিরক্ষার উপায়স্বরূপ এই বানান মেনে নিতেন।

করি না, করি নে। গরু গোরু দুইই ঠিক মনে করি।

২। কি, কী।–কবির অভিপ্রায় মোটামুটি এই বুঝেছি।–অব্যয় কি (তাই কি? তাই নাকি, হাঁ কি না)। সর্বনাম কী (কী চাই, বল কী!)। বিশেষ ক্রিয়াবিশেষণ কী (কী জিনিস, কী করিয়া, কী বুদ্ধি!)। বোধ হয় সর্বত্র এই নিয়ম মানেন নি।

৩। দুই শব্দের মাঝে হাইফেন থাকবে, কি ফাঁক হবে, কিংবা জুড়ে দেওয়া হবে তার নিয়ম বাঁধা বোধ হয় অসম্ভব। ইংরেজীতেও সংগতি নেই। কবির কোনও নির্দিষ্ট মত ছিল বোধ হয় না। সংগতির আশা ত্যাগ করে আপনাদের পছন্দমত ছাপবেন। আমার পছন্দ-পরে বহুবচনবাচক শব্দ থাকলে জোড়া হবে (লোকগুলো, যেসকল)। দ্বিরুক্ত শব্দে ফাঁক (বার বার, ধীরে ধীরে)। কিন্তু দ্বিতীয় শব্দটি অর্থহীন বা ইত্যাদিসূচক হলে জোড়া (কাপড়চোপড়, গাছপালা)। অনুকার শব্দে জোড়া (চকচক, ঝনঝন)। ক্রিয়াবিশেষণ বা বিশেষণ বাচক হলে অনেক স্থলে জুড়লে ভাল হয়। (এজন্য, যেহেতু, যেরকম, সবচেয়ে, সবসুদ্ধ, হয়তো)। জোড়া বা না জোড়া অনেকটা উচ্চারণের উপর নির্ভর করে–যেকেউ, যে মানুষ (বা যে-মানুষ)। হাইফেন যথাসম্ভব কম হলে ভাল।

৪। কবি অসংস্কৃত শব্দে ঈ-কারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তার আগেকার লেখায় ব্যতিক্রম আছে (চয়নিকা ৩০ সং।)–কাঙালিনী, বিজুলী, বিজুলি, পাখী, পশ্চিমী, বাঙালী, চখা চখীরে, চাহনী, ময়ূরকণ্ঠী, মাসী, বাঁশরী, হিন্দুস্থানী, গয়লানী)।

৫। কবির পুরনো বইএ ইংরাজি ইংরেজি দুইই। কিম্বা প্রভৃতি শব্দে করির যেখানে ং স্থানে ম লিখেছেন সেখানে বদলাবার দরকার নেই।

৬। কবি আমাকে বলেছিলেন বাংলা প্রয়োগে শব্দের শেষের বিসর্গ অনাবশ্যক (সংস্কৃতে মনঃ, দুর্বাসা, স্বতঃ, বাংলায় মন, দুর্বাসা, স্বত)।

৭। হস্-চিহ্ন সম্বন্ধে কবির মত জানি না। বোধ হয় সংস্কৃত শব্দে অধিকাংশ স্থলে হচিহ্ন বজায় রাখা ভাল (ব্যতিক্রম–ভগবান, বলবান, (বুদ্ধিমান, বিপদ, দিক ইত্যাদি বহু শব্দ)। অসংস্কৃত শব্দে নিতান্ত দরকার না হলে হচিহ্ন বর্জনীয় (পটকা, বালতি, আচমকা, চটকানো)। খণ্ড-ত আমার পছন্দ নয়, বাংলা ছাড়া কোনও ভাষায় নেই। কিন্তু জগৎ স্থানে জগত লিখলে লোকে খেপে উঠবে। চলন্তিকা ৪র্থ সংস্করণে অনেক অসংস্কৃত শব্দে ৎ স্থানে ত দিয়েছি (ওত, তফাত, মেরামত, শরবত)। বুদবুদ, প্রগম্ভ–হচিহ্ন আবশ্যক। সংস্কৃতে ষড়দর্শন, ষড়যন্ত্র; বাংলায় সাধারণে হচিহ্ন দেয় না।

৮। কার্তিক, বর্তিকা শুদ্ধ, পাণিনিসম্মত। বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ঢাকার গোবর্ধন শাস্ত্রী প্রমাণ দিয়েছেন। পাশ্চাত্য অনেকে লেখেন। সামান্য একটু পরিবর্তনে যদি শব্দটিকে শুদ্ধ করা যায় তবে ত্ত্য লিখতে দোষ কি? (বাংলায় ও হরফ আছে বলেই ত্ত লিখতে হবে কেন?)

৯। যদি দৃষ্টিকটু না হয় তবে যুক্তাক্ষর কিছু কমানো ভাল (উদ্গত, উদ্ঘাটন, ধিক্কার)। তন্ময় দৃষ্টিকটু। বাংলায় দ-এর পর ব-ফলা বা য-ফলার দুরকম উচ্চারণ। যেখানে স্পষ্ট উচ্চারণ (চ বা তুল্য) সেখানে হস্ চিহ্ন দিতে চাই, অন্যত্র যুক্তাক্ষর রাখতে চাই (উন্ধন, উদাহু, তবিধ, উদ্যোগ, উদ্যাপন, বিদ্বান, অদ্বৈত, উদ্যত, উদ্যান)। রচনাবলীতে অবশ্য এরকম করা হয় নি।

কবি আমাকে বলেছিলেন–বাংলায় ঐ ঔ তুলে দেওয়া উচিত (পইতা, বউ, মউমাছি)। আমি বলেছিলাম–সর্বত্র তা হবে কি? উত্তরকেন হবে না। পৌষ সংস্কৃত শব্দ, বাংলাতে উচ্চারণ বদলায় নি, সুতরাং পউষ বর্জনীয়। ঔষধ ঔউষধ হয় নি।

আমার মতে ঐ (that) স্থানে সর্বত্র ওই লিখলে দৃষ্টিকটু হবে।

১০। বানানসমিতি কেবল কয়েকটি শব্দে য-এর বদলে জ-এর ব্যবস্থা করেছেন (কাজ, জাউ, জাঁতা, জাতি, জুই, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল)। অন্য শব্দে জ কিংবা য আপনারা স্থির করবেন। খৃষ্ট স্থানে খ্রীষ্ট বা খ্রীস্ট লেখা ভাল। নবাগত অসংস্কৃত শব্দে রি বা রী স্থানে ঋ লেখা অনুচিত, কারণ ঋকারের মূল উচ্চারণ তা নয়। আমরা যা ভুল করে আসছি তা আর বাড়াবার দরকার কি। বাংলা উচ্চারণে শ ষ স সমান, কিন্তু নবাগত notice লিখতে নোটিশ বানান করা ঠিক নয়। নোটিস, বার্নিশ ঠিক।

১১। মর্ত, মর্ত; অর্ঘ, অর্ঘ্য–সবই শুদ্ধ। বাংলায় মর্ত্য বেশী চলে। অর্ঘ, অর্ঘ্য–কিছু অর্থভেদ আছে।

১২। ১নং উত্তর দ্রষ্টব্য।

১৩। ইলেক দেওয়া না দেওয়া ইচ্ছাধীন।

১৪। অর্থবোধে বাধা হলে হাইফেন দেওয়া ভাল। উদাহরণগুলিতে হাইফেন না দিলেও চলে।

১৫। বাংলায় যেসকল শব্দে অ্যা উচ্চারণ আছে অথচ বানানে এ-কার বহুপ্রচলিত, সেখানে কবির রীতি অনুসারে দেওয়া উচিত।

১৬। কবির লেখায় আগে? এবং! চিহ্ন খুব থাকত, শেষে প্রায় বাদ দিয়েছিলেন। বোধ হয় সর্বত্র বাদ দিলে মানে বোঝা শক্ত হবে। কমা-চিহ্ন সম্বন্ধেও ঐ কথা। বাক্যের প্রথমে এমন কি, অর্থাৎ, আর, কিন্তু থাকলে হলবিশেষে কমা দিলে ভাল হয়।

—-রাজশেখর বসু
৩০/৪/৪৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *