জলপাইগুড়ির সদর থানার দারোগা
জলপাইগুড়ির সদর থানার দারোগা অবনীবাবুর সঙ্গে গল্প করা অর্জুনের এখন অভ্যেসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। পুলিশের কিছু লোক এখনও বইপত্র পড়েন। অবনীবাবু তাঁদের একজন। কিন্তু তিনি প্রায়ই অর্জুনকে বলেন, দুর মশাই, আপনি নিজেকে নষ্ট করছেন। এই শহরে না থেকে কলকাতায় চলে যান। টাকা হবে, নামও হবে।
অর্জুন কখনওই জবাব দেয় না। মিটিমিটি হাসে।
আজ সন্ধেবেলায় চায়ের কাপে আড্ডা জমেছিল। অবনীবাবু বললেন, আজ একটা দারুণ দিন। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনও ক্রাইম হয়নি এ-শহরে।
অর্জুন বলল, এখন ছটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। রাত বারোটা পর্যন্ত তারিখ বদলাবে না।
জানি। কিন্তু আমার মন বলছে তেমন কিছু হবে না আজ। অবনীবাবু চোখ বন্ধ করলেন। এই সময় একটি ছেলে দরজায় এসে দাঁড়াল, আসতে পারি?
চোখ খুললেন অবনীবাবু, অবশ্যই।
ছেলেটি ঘরে ঢুকল। জিনসের ওপর হলুদ টিশার্ট। মাথার চুল প্রায় কাঁধ পর্যন্ত স্টাইল করে রাখা। ছেলেটি বলল, আমার নাম কাজল মুখার্জি। কদমতলায় আমাদের একটা দোকান আছে। এর আগে আপনার সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছিল। ছেলেটির মুখভর্তি সাজানো দাড়ি।।
আপনি একটা ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে জড়িত? অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। আমি কিছুদিন আগে পাশপোর্টের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। ওরা বলছে পুলিশের রিপোর্ট পেলেই পাশপোর্ট ইস্যু করবে। রিপোর্টটা যদি দয়া করে পাঠান। ছেলেটি চেষ্টা করছিল ভদ্র গলায় কথা বলতে। বলার সময় দাড়িতে হাত বোলাচ্ছিল।
আমার এখানে কোনও কাজ পেন্ডিং থাকে না কাজলবাবু। তবু আপনি যখন বলছেন তখন একটু অপেক্ষা করুন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। বেল বাজিয়ে সেপাইকে ডেকে অবনীবাবু হুকুম দিলেন পাশপোর্ট-সংক্রান্ত এনকুয়ারির ফাইল আনতে।।
অর্জুন লক্ষ করছিল কাজল মুখার্জিকে। নামটা তার খুব চেনা-চেনা লাগছিল। সে ফট করে জিজ্ঞেস করল, কদমতলায় আপনাদের কিসের দোকান?
কাজল জবাব দিল, সাইকেল রিপেয়ারিংয়ের।
এবং তখনই মনে পড়ল তার। বিজনবিহারীবাবু তা হলে এরই কথা বলেছিলেন। বিজনবিহারীর নাতনি টুকুকে বিয়ে করতে চায় এই ছেলেটি।
ইতিমধ্যে ফাইল এসে গেল। অবনীবাবু বিশেষ রিপোর্টটি খুঁটিয়ে দেখছিলেন। মুখ তুলে বললেন, কিন্তু কাজলবাবু, আপনি দরখাস্তে লিখেছেন স্কুল ফাইনাল পাশ করেছেন, কিন্তু লেখেননি হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেওয়ার সময় নকল করার অভিযোগে আপনাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। তাই না?
কাজল দাঁড়িয়ে ছিল! বলল, ফর্মে লেখা আছে এড়ুকেশন কোয়ালিফিকেশন কী? আমার যা, তাই লিখেছি। বাড়তি কিছু লিখিনি।
হুম। অবনীবাবু মাথা নাড়লেন, সাব ইনস্পেক্টর লিখছেন আপনি এর আগে দুটো মারামারিতে জড়িয়ে ছিলেন। তার একটাতে মাডার পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে আপনাকে ধরা হয়নি।
একদম বাজে কথা। একটা ফুটবল-সংক্রান্ত ব্যাপার এবং আমি তখন শহরে ছিলাম না। দ্বিতীয়টা ইলেকশনের সময়। আমার কোনও ভূমিকা ছিল না। কাজল বলল।
আপনি পাশপোর্টের জন্য চেষ্টা করছেন কেন?
প্রথম কথা, যে-কোনও নাগরিকের একটা পাশপোর্ট থাকা উচিত। দ্বিতীয়ত, আমি কয়েকদিনের জন্য বাংলাদেশে যেতে চাই।
বাংলাদেশে কেন? অবনীবাবু ফাইলে কিছু লিখছিলেন, সেখানে কি আপনার কোনও আত্মীয় আছেন? বাংলাদেশের কোথায় যাবেন?
ঢাকা এবং কালীগঞ্জে। ওখানে যাব বেড়াতে। আমার কোনও আত্মীয় ওখানে নেই। আমরা পশ্চিমবঙ্গের লোক। কাজল বলল।
অবনীবাবু বললেন, আপনার কপাল খুব ভাল।
কাজল বলল, আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
অবনীবাবু হাসলেন, আজ আমি কারও পেছনে শুধুই সন্দেহের বশে লাগব। আই ওয়ান্ট টু কিপ দি ডে ক্লিন। তবে দেখবেন এরপর যেন কোনও ঝামেলায় না জড়ান।
কাজল ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। চুপচাপ বসে এঁদের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিল অর্জুন। এবার বলল, অবনীবাবু, আপনার এলাকায় আজ কোনও অপরাধ হবে কিনা জানি না, তবে আমি কাজ পেয়ে গেলাম।
অবনীবাবু বললেন, তার মানে?
আমি একটা টেলিফোন করতে পারি?
অবশ্যই।
এখন জলপাইগুড়িতে অপারেটারের মাধ্যমে কানেকশন চাইতে হয় না। একবারেই অর্জুন লাইন পেয়ে গেল। বিজনবিহারীবাবু রিসিভার তুলে বললেন, কে বলছেন?
আমি অর্জুন।
হ্যাঁ। কিছু জানতে পারলে?
শুনুন। আমি আপনার কেসটা নেব বলে এখন ঠিক করলাম।
তার মানে? তুমি আমার ব্যাপারটা এতদিন ভাবনি?
না। কিন্তু এখন থেকে ভাবতে হবে।
আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
খুবই সরল ব্যাপার। আমি কেসটা নিচ্ছি। আপনি সমস্ত খরচ দেবেন তো?
দ্যাখো ভাই, কে চুরি করেছে তা যদি ধরতে পারো তার জন্য যা পাবে তা নিশ্চয়ই ওসব জিনিস ওখান থেকে তুলে আমার কাছে নিয়ে এলে যা দেওয়া
উচিত তার সমান হবে না। তুমি বুঝতেই পারছ।
আপনি কালই ভবাকে দিয়ে হাজার চারেক টাকা পাঠিয়ে দিন।
হাজার চারেক। সে কী!
এই টাকার হিসেব আপনাকে দেব।
এত টাকা! বিজনবিহারীবাবু বিড়বিড় করলেন। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে পকেটের টাকা খরচ করে তদন্ত করতে বলবেন।
তা তো নয়। বিজনবিহারীবাবু বললেন, বেশ। ভবা কাল যাবে।
রিসিভার নামিয়ে রাখল অর্জুন। অবনীবাবু হতভম্ব। জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো? কাকে ফোন করলেন?
বিজনবিহারী ঘোষ। এক্স টি-প্ল্যান্টার।
আচ্ছা। হঠাৎ কী কারণে তাঁর কেস নিলেন? মনে হচ্ছে আগে রাজি হননি। অবনীবাবু কৌতূহলে ফেটে পড়ছিলেন।
আগে ভেবেছিলাম কোনও রহস্য নেই। এখন মনে হচ্ছে আছে।
এই কাজল মুখার্জিকে দেখার পর মনে হচ্ছে রহস্য আছে?
এখন পর্যন্ত কোনও ক্রাইম হয়নি। কেন আর প্রশ্ন করছেন? অর্জুন উঠে দাঁড়াল।
অবনীবাবু বললেন, আপনার রিঅ্যাকশন ইন্টারেস্টিং।
অর্জুন বলল, আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা যদি সত্যি হয় তা হলে একটা ক্রাইমের সূত্রপাত হচ্ছে। একটু দেখা যাক, তারপর আপনাকে বলব।
অমল সোম বলতেন, হঠাৎ কোনও সূত্র পেয়ে সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পোডড়া। নানাভাবে সেটাকে বিশ্লেষণ করো, সুযোগ থাকলে অপেক্ষা করো। অর্জুন তাই করবে বলে ঠিক করল।
কাজলকে থানায় ভাল করে দেখে তার পছন্দ হয়নি। ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত একটা শীতলতা আছে যা অর্জুনকে বিচলিত করছিল। সে সময় পেলেই বাইক নিয়ে কদমতলায় যায়। কাজলের সাইকেল কারখানা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি। সকাল-বিকেলে সেখানে যে-ধরনের চেহারার ছেলেরা কাজলের সঙ্গে আড্ডা মারে, তাদের কোনও ভবিষ্যৎ ভাবনা নেই তা দেখেই বোঝা যায়। পোশাক দামি এবং যথেষ্ট উদ্ধত, সিনেমার আর্টিস্টের নকল করা চুল, হাতে বালা। এদের মধ্যে কাজল খুব স্বাভাবিক। অর্জুন ইচ্ছে করেই কাজলের দোকানে ঢোকেনি। সে ল্যাংড়া-পাঁচুকে ধরল। লোকটা এককালে এই শহরের বিখ্যাত তালা-খুলিয়ে ছিল। টাকা নিয়ে চোর-ডাকাতদের এব্যাপারে সাহায্য করত সে। অর্জুন তাকে একটা সময় বাঁচিয়ে দিয়েছিল। ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল আর ওইসব কাজ করবে না। এখন পর্যন্ত কথা রেখে চলেছে ল্যাংড়া-পাঁচু। কদমতলায় লটারির টিকিট বিক্রি করে সে।
কাজলের নাম শুনে পাঁচু একটু চুপসে গেল, কাজলদা হেভি মাস্তান।
তাতে কী হল?
যদি জানতে পারে আমি টিকটিকি হয়েছি, তা হলে মেরে হাড় ভেঙে দেবে।
যতক্ষণ তুমি অন্যায় না করছ ততক্ষণ তোমার কোনও ভয় নেই।
অবশ্য আপনার জন্য আমি সব করতে পারি।
সব করতে হবে না। শুধু লক্ষ রাখবে ও রোজ দোকানে আসে কি না! ব্যবসার বাইরে কারা কারা ওর দোকানে আসে। ও কোথাও যাচ্ছে কিনা।
অর্জুন বুঝিয়ে বলল।
বিজনবিহারী টাকাটা ভবাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই তাঁর তাগাদা শুরু হয়ে গেছে। দিনে অন্তত একবার টেলিফোন করে প্রোগ্রেস রিপোর্ট চান। অর্জুন শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি আপনার নাতনিকে কতখানি বিশ্বাস করেন?
নাতনি? সে এর মধ্যে আসছে কোত্থেকে? বিরক্ত হলেন বিজনবিহারী।
ওই বাড়িতে থাকে বলেই বলছি।
পৃথিবীতে যদি কাউকে বিশ্বাস করি, তবে সে টুকু। ওর সব কথা আমাকে বলে। মেয়েটা ওর মা বাবার ধরন পায়নি বলে রক্ষে।
কথা বাড়ায়নি অর্জুন। কাজলের ঢাকায় যাওয়াটা কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু সে থানায় গিয়ে অবনীবাবুকে পাশপোর্টের জন্য তদ্বিরের সময় কালীগঞ্জের নাম উল্লেখ করেছিল। কোনও আত্মীয়স্বজন যে-দেশে নেই, সেখানে বেড়াতে গেলে কালীগঞ্জের কথা আগে মাথায় আসতেই পারে না। যে ছেলে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মেরে কাটায়, সে হঠাৎ উদ্যোগী হয়ে একা বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে, এমনটা ভাবাও যায় না। কোনও বিশেষ মতলব ছাড়া ও ওদেশে যাচ্ছে না। আর এই মতলবটা ওকে জুগিয়েছে টুকু। অর্জুনের মনে হচ্ছিল টুকুই বিজনবিহারীবাবুর ব্যাগ থেকে খামটা সরিয়েছে। চিঠি পড়ার পর সে বুঝতে পেরেছে ওর গুরুত্ব। তারপর কাজলকে ব্যাপারটা বলেছে। কাজল ধান্দাবাজ ছেলে। সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়েছে। গোয়ালন্দে পোঁছতে গেলে পাশপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন হয় বলে অপেক্ষা করছে এখন।
দিন-পাঁচেক বাদে এক বিকেলে ল্যাংড়া-পাঁচু এসে হাজির, কাজলদা নেই।
নেই মানে? অর্জুন এইটেই আশা করছিল।
গতকাল পিওন একটা রেজিষ্ট্রি চিঠি নিয়ে এসেছিল। সেটা পেয়ে খুব খেপে গিয়েছিল কাজলদা। পুলিশকে গালাগাল করছিল। আমি পিওনকে পরে আলাদা পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কী চিঠি এসেছে। পিওন বলল, পাশপোর্ট অফিস থেকে এসেছে।
অর্জুন খুব নিরাশ হল, তার মানে পাশপোর্ট পায়নি?
না।
তা হলে গেল কোথায়?
তা তো বলতে পারব না। আজ বাড়ি থেকেই দোকানে আসেনি। এখানে আসার আগে আমি একবার ওর দোকানের কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, দাদা বেড়াতে গেছে বাইরে।
হুম। আর কোনও খবর আছে?
না। ও হ্যাঁ। আজ দুপুরে একটি অল্পবয়সী মেয়ে দোকানে এসেছিল রিকশায় চেপে।
কীরকম দেখতে?
খুব সুন্দরী। কর্মচারী হযতো একই কথা বলেছে। শোনার পর দেখলাম মুখ শুকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে পড়ল।
এই মেয়েটিকে তুমি আগে দেখেছ?
না। লক্ষ করিনি।
গতকাল কাজল দোকান থেকে কখন বেরিয়েছিল?
সন্ধের একটু আগে। ওর বন্ধুরা এসে ওকে পায়নি। আমাদের হরির রিকশায় চলে গিয়েছিল। দোকান বন্ধ করার সময়ও ফেরেনি।
হরিকে কোথায় পাওয়া যাবে?
কদমতলার স্ট্যান্ডে।
অর্জুন দশটা টাকা ল্যাংড়া-পাঁচুকে দিতে গেল, কিন্তু সে জিভ বের করে সরে দাঁড়াল, ছি ছি ছি। এত সামান্য কাজের জন্য পয়সা নেব, তা হয় না।
অর্জুন থানায় টেলিফোন করল। অবনীবাবু ছিলেন।
কাজল মুখার্জিকে পাশপোর্ট পেতে দিলেন না শেষপর্যন্ত?
ও, খবর পেয়ে গেছেন? আমি না দেওয়ার কে? পাশপোর্ট অফিসকে যা সত্যি তাই জানিয়ে দিয়েছিলাম। ওঁরা যদি না ইসু করেন, তা হলে—
আপনি ওকে বলেছিলেন ওর পাশপোর্ট যাতে হয় সেইভাবে রিপোর্ট দেবেন।
ভেবেছিলাম। কিন্তু ওকে দেখার পর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে দেখে বুঝলাম যা সত্যি তাই বিশদে লেখা ভাল।
অর্জুন টেলিফোন রেখে দিল। পাশপোর্ট না পেলে কাজল বাংলাদেশে যেতে পারছে না। তা হলে গেল কোথায়? সে সন্ধের পব কদমতলায় এসে হরিকে ধরল। অল্পবয়সী ছেলে। অর্জুনকে চিনতে পারল। বলল, পাঁচুদা আপনার কথা আমাকে বলেছে বাবু। কিন্তু আমি কখনও কোনও অন্যায় করিনি।
তুমি অন্যায় কবেছ কে বলল?
পাঁচুদা বলেছিল আপনার সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক আছে।
তা একটু আছে। তবে তোমার কাছে এসেছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। তোমার সাহায্য চাই আমি।
বলুন বাবু।
অর্জুন দেখল আশেপাশে দাঁড়ানো রিকশাওয়ালারা কানখাড়া করে তাদের কথাবার্তা শুনছে নেহাতই কৌতূহলী হয়ে। সে বলল, চলো, তোমার রিকশায় ওঠা যাক।
অর্জুন সিটে বসতেই হরি কয়েক পা প্যাডেল করে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে বাবু?
পাঁচু কিছু বলেনি ওব্যাপারে?
না।
গতকাল সন্ধের সময় তুমি সাইকেলকারখানার কাজলকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?
হরি আবার দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পেছনে রিকশাওয়ালা, সাইকেল-বেল বাজাচ্ছে। সে রাস্তার একপাশে সরে এসে বলল, কাজলবাবু কোনও অন্যায় করেছে, না?
অর্জুন হাসল, আরে, সে অন্যায় করতে যাবে কেন?
কাজলবাবু এমনিতেই …। তার ওপর যার কাছে গিয়েছিল সেই লোকটা সুবিধের নয়। আপনি তার কাছে একা যাবেন না। ধান্দা ছাড়া কেউ ওর কাছে যায় না।
আমি একা নই। তুমি লোকটার কাছে নিয়ে চলো। কোন পাড়ায় থাকে?
সেনপাড়ায়। বলে হরি রিকশা চালাতে লাগল।
ছেলেটা একটু বেশি কথা বলে কিন্তু অনেক খবর রাখে বলে মনে হল অর্জুনের।
লোকটার নাম জানো? চলন্ত রিকশায় বসে জিজ্ঞেস করল অর্জুন।
কাজলবাবু ওকে দাসবাবু বলে ডেকেছিল। রিকশাওয়ালা জবাব দিল।
তুমি কি কাজলকে ওখানে নামিয়ে দিয়েই চলে এসেছিলে?
না। বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে সাড়া পাওয়ার পর আমাকে দাঁড়াতে বলে কাজলবাবু ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন। কী কথা হল জানি না। সেই সময় আরও দুজন লোক ভটভটি নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। গুণ্ডা ধরনের লোক। এখানে কখনও দেখিনি।
তারপর?
আধঘণ্টা পরে কাজলবাবু হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন দাসবাবুর সঙ্গে। তিনি বললেন, আপনি এই শহরের ছেলে। পুরো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। তবে টাকাটা। সঙ্গে সঙ্গে কাজলবাবু বললেন, রাত্রে যখন আসব পুরো টাকাটাই পাবেন। আমি কাজলবাবুকে ওঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিলাম। রিকশা তখন করলা নদীর ব্রিজে।
এতে তোমার কি করে মনে হল লোকটা সুবিধের নয়?
বাবু, দেখলেই বোঝা যায়।
ঠিক আছে। তুমি আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করবে।
সেনপাড়ার একেবারে ভেতরে যে বাড়িটার সামনে রিকশা থামাল হরি, সেটার চেহারা নিতান্তই মধ্যবিত্ত। রাস্তায় আলো জ্বলছে না। অর্জুন বলল, একটু লক্ষ করা যাক।
হরি বলল, আজও ভটভটি ওখানে আছে বাবু।
মিনিট তিনেকের মধ্যে দৃশ্যের হেরফের না হওয়াতে অর্জুন নামল। বাড়ির সামনে কোনও গেট বা বেড়া নেই। মোটর বাইক রয়েছে দরজার গায়ে। সে ডাকল, দাসবাবু, দাসবাবু।
একটু বাদে দরজা খুলে গেল। সিল্কের লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা এক প্রৌঢ় দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি দাসবাবু?
হ্যাঁ।
একটু কথা আছে।
দাঁড়ান। ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়ালেন, তা হলে তুমি চলে যাও। ওদের বলল যা কথা ছিল তাই দেওয়া হচ্ছে। এরপর এরকম হলে আমরা অর্ডার বদলাব।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ামাত্র একটি চামড়ার জ্যাকেট পরা লোক মাথা নেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বাইকে উঠল। সে স্টার্ট নিয়ে চলে যাওয়ার পর দাসবাবু বললেন, আসুন।
বাইরের ঘরটি অতি সাধারণ। চারটে বেতের চেয়ার এবং টেবিল, যা জলপাইগুড়ির ফুটপাথে বিক্রি হয় শস্তায়, তাই পাতা। তারই একটাতে বসল অর্জুন। সামনে দাসবাবু।
দাসবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বলুন, কী করতে পারি?
অর্জুন বুঝতে পারছিল না সে ভুল করছে কি না। তার হাতে কোনও প্রমাণ নেই। শুধুই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সাহসী হওয়া। সে খুব সিরিয়াস গলায় বলল, বাংলাদেশে যেতে চাই।
যান না। আমি কী করতে পারি?
আমার পাশপোর্ট নেই। ভিসা পাব না। এত তাড়াতাড়ি পাশপোর্ট পাব বললেন, অরটি অতি পক্রি হয় শত না।
আমার কথা আপনাকে কে বলল?
আমার এক বন্ধু কাজল।
কাজলবাবু আপনার বন্ধু?
হ্যাঁ। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। অর্জুন বলল, ওরও বাংলাদেশে যাওয়ার কথা। আজ সকাল থেকে ব্যাটার দেখা পাচ্ছি না।
আপনি কোন পাড়ায় থাকেন?
কদমতলায়।
কী করেন?
একদম বেকার। সেইজন্য ওখানে যেতে চাই। যদি কিছু হয়।
আত্মীয়স্বজন আছে?
তা আছে।
কালীগঞ্জে?
কালীগঞ্জ মানে?
বাংলাদেশের একটা গ্রাম। কাজলবাবুর আত্মীয় থাকেন সেখানে। দেখুন মশাই, আমি আপনাকে চিনি না। এখনই কোনও কথা বলব না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন এভাবে বর্ডার পেরিয়ে যাওয়া বেআইনি। জেল হতে পারে ধরা পড়লে। ওখানেও পুলিশ জেরা করলে বিপদে পড়বেন।
আমি খরচ করতে রাজি আছি।
দেখুন, আমি এত খুচরো কাজ করি না। তার জন্য অন্য লোক আছে।
কাজল বলেছিল আপনি সব দায়িত্ব নেবেন।
কাজলের রেফারেন্স আলাদা। আপনি কাল আসবেন। এই সময়। কী। নাম যেন?
অর্জুন। সে উঠে দাঁড়াল। নমস্কার করল।
দাসবাবু বললেন, কদমতলায় নিশ্চয়ই অনেকে আপনাকে চিনবে? আসলে আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। দিনকাল খারাপ।
কত টাকা লাগবে ঢাকায় পৌঁছতে?
বললাম তো, আগামীকাল কথা হবে।
অর্জুন মাথা নেড়ে বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠে চাপা গলায় বলল, থানায় চলো।
হাসিমুখে অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, রাগ কমেছে?
অর্জুন সেটা এড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার কোনও আইডিয়া আছে, মাঝরাত্রে জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হয়ে বর্ডার পেরিয়ে গোয়ালন্দে পৌঁছাতে কীরকম সময় লাগে?
অ্যাঁ! না। কে যাবে?
গিয়েছে। যাকে আপনি পাশপোর্ট নিতে দেননি, সে চলে গেছে।
অবনীবাবু বললেন, সে কী! উইদাউট পাশপোর্ট?
হ্যাঁ।
এটা তো ক্রাইম।
ধরতে পারলে।
আপনি জানলেন কী করে?
যে লোকটি টাকা নিয়ে বর্ডার পারাপার করায়, তাকে মিট করে এলাম।
এই শহরে? চোয়াল শক্ত হল অবনীবাবুর।
আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে এটা তার খুচরো ব্যাপার, অন্য কিছু আছে, যা মনে হয় সলিড।
নামটা বলুন।
প্রমাণ ছাড়া ধরে কোনও লাভ নেই। অর্জুন বলল, সেনপাড়ায় দাসবাবু নামে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক থাকেন। বাড়ির সামনে সন্ধেবেলায় মোটরবাইক পার্ক করা থাকে। নজর রাখুন। সেইরকম সময়ে বাইকে যারা আসে তাদের সমেত ধরুন। অর্জুন উঠল।
উঠছেন কোথায়?
হাতে সময় নেই। গোছগাছ করতে হবে। একটা টেলিফোন করতে পারি?
নিশ্চয়ই।
অর্জুন ডায়াল করল। বিজনবিহারীবাবু ধরলেন।
অর্জুন বলছি। আমি কলকাতায় যাচ্ছি। ওখান থেকে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ। ফিরে এসে দেখা করব।
যাক। এতদিনে …। কিন্তু চিঠিটা?
আপনার ঠাকুর্দার চিঠি যার কাছে আছে, সে এখন বাংলাদেশের পথে।
তার মানে? কে সে? বিজনবিহারী উত্তেজিত।
অর্জুন জবাব না দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল।