Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কিছু পেলে না তোমরা খুঁজে

কি হল, কিছু পেলে না তোমরা খুঁজে?

কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে দুজনেই আমরা তাকাই।

আশ্চর্য! চোখে পড়ল না কিছু এখনো তোমাদের কারো?

আমি তখনো সরমা ও শকুন্তলার ফটো দুটি পাশাপাশি রেখে দেখছিলাম, হঠাৎ কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে উঠি। সত্যিই তো, অদ্ভুত একটা সৌসাদৃশ্য আছে তো ফটো দুটির মধ্যে! কপাল, নাক ও চোখের অদ্ভুত মিল!

চট করে অবিশ্যি প্রথমে কারো নজর না পড়বারই কথা। কিন্তু ভাল করে দেখলে চোখে পড়বেই।

বললাম, হ্যাঁ, যদিও বয়সের তফাৎ রয়েছে তবু দেয়ার আর সিমিলারিটিজ—দুটো মুখের মধ্যে সৌসাদৃশ্য রয়েছে!

হ্যাঁ রয়েছে, কিরীটী বললে, এবং সব চাইতে বড় সৌসাদৃশ্য হচ্ছে ডান দিককার চিবুকের কাছে কালো তিলটি দুজনেরই মুখে। তবে সরমার তিলটা ছোট্ট, কিন্তু শকুন্তলারটা বড়। হ্যাঁ, ঐ তিলটিই আমার মনে গতকাল খটকা বাধিয়েছিল—যে মুহূর্তে ওটা সরমার মুখে দেখি শকুন্তলার মুখে দেখবার পর!

বাবাঃ, কি শকুনের মত নজর তোমার গো! কৃষ্ণা বলে ওঠে ঈষৎ যেন ব্যঙ্গের সুরে।

কাজটাই যে শকুনের কাজ প্রিয়ে! কিরীটী মৃদু হাসির সঙ্গে বলে ওঠে, বলছিলাম না কৃষ্ণা তোমাকে সেদিন, মেয়েদের মত অভিনেত্রী হয় না—প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতেই!

আবার আমি চমকে উঠি, কি বলতে চাস তুই কিরীটী?

কি আবার বলতে চাই, যা বলতে চাইছিলাম সে তো নিজেরাই বুঝতে পেরেছিস—

না, না–ও কথা নয়—

তবে আবার কি?

তুই কি বলতে চাস তাহলে—

হ্যাঁ–সরমা সাধারণ ঝি নয়—সরমা হচ্ছে ঐ শকুন্তলার জননী। আর তাইতেই তার স্থান হয়েছিল অধ্যাপকের গৃহে অমনি সুদৃঢ়।

তবে—তবে কি–

না। যতদূর আমার মনে হচ্ছে অধ্যাপকের রক্ত শকুন্তলার দেহে নেই—

হঠাৎ ঐ সময় দ্বারপ্রান্তে শিবেন সোমের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি?

আরে শিবেনবাবু, আসুন, আসুন—আপনার কথাই ভাবছিলাম।

শিবেন সোম ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, রিপোর্ট দেখলেন?

হুঁ।

কিন্তু এ যে তাজ্জব ব্যাপার, ডিজিট্যালিন শেষ পর্যন্ত–

হ্যাঁ, বেচারী একে হাইপারটেনসনে ভুগছিলেন—তাই অধিক মাত্রা ডিজিট্যালিনের দ্রুতক্রিয়া মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। যদিও অত্যন্ত ক্রুড হয়ে—তবু বলব হত্যাকারী সুনিশ্চিত পন্থাটাই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সে তো পরের কথা ইতিমধ্যে সুব্রত যে আরো একটি মারাত্মক আবিষ্কার করে বসে আছে!

সে আবার কি? শিবেন সোম আমার দিকে তাকালেন।

আমি লজ্জিত হয়ে বলি, না-না—আমি নয়, কিরীটীই। ইট ওয়াজ হিজ ডিসকভারি! ওরই আবিষ্কার—

কিন্তু ব্যাপারটা কি সুব্রতবাবু?

জবাব দিল এরপর কিরীটীই। সে বললে, শকুন্তলা চৌধুরী অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর ভাইঝি নন—

সে কি!

হ্যাঁ, সরমার ইতিহাস যদি সত্যিই হয়—অর্থাৎ সে যদি সত্যিই কৈবর্তকন্যাই হয়ে থাকে তো শকুন্তলা অধ্যাপকের কেউ নয়—কোনো রক্তের সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে ওদের নেই।

মানে—কি বলছেন?

ঐ ফটো দুটো দেখলেই বুঝতে পারবেন। দেখুন না ফটো দুটো একটু চোখ মেলে পরীক্ষা করে!

সরমা ও শকুন্তলার ফটো দুটো শিবেনের দিকে এগিয়ে দিল কিরীটী।

ফটো দুটো দেখতে দেখতে শিবেন সোম বলেন, আশ্চর্য! ব্যাপারটা তো আগে আমার নজরে পড়ে নি? কিন্তু–

বুঝতে পারছি শিবেনবাবু, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে—এই তো?

না, তা নয়—

তবে? ভাবছেন তাহলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, এই তো?

হ্যাঁ, মানে—

ব্যাপারটার একটা মীমাংসার প্রয়োজন বৈকি। আর সেই জন্যেই আজ আবার আপনাকে কষ্ট করে রাত এগারোটার পর এখানে আসতে হবে—

রাত এগারোটার পর?

হ্যাঁ, রাত এগারোটার পর।

.

বলা বাহুল্য, ঐদিনই রাত্রে কিরীটীর দোতলার বসবার ঘরেই আমরা বসেছিলাম। আমি, কিরীটী, শিবেন সোম ও কৃষ্ণা।

দেওয়াল-ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট হয়ে গিয়েছে। শিবেন সোম যে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন বুঝতে পারছিলাম। কিরীটীর কথামত বেচারী সেই রাত সাড়ে দশটা থেকে এখানে এসে বসে আছেন।

কিরীটী দ্বিপ্রহরে যতটুকু বলেছিল তার বেশী আর একটি কথাও বলে নি। একেবারে যেন চুপ।

ঘন ঘন শিবেন সোম একবার ঘড়ির অগ্রসরমান কাটার দিকে এবং পরক্ষণেই আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

কিরীটী কিন্তু নির্বিকার। পাইপটা ওষ্ঠপ্রান্তে চেপে ধরে একান্ত নির্বিকার চিত্তেই যেন ধূমপান করছে।

রাত যখন সাড়ে এগারোটা, একটা রিকশার ঠুং ঠুং শব্দ আমাদের সকলের কানে এসে প্রবেশ করল।

কিরীটী যে অন্যমনস্কতার ভান করলেও ভিতরে ভিতরে বিশেষ কারো আগমন প্রতীক্ষ্ণয় কতখানি উগ্রীব হয়েছিল বুঝতে পারলাম ঐ রিকশার ঠুং ঠুং শব্দটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহূর্তে কিরীটী উঠে সোজা গিয়ে পথের দিককার খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিল।

কৌতূহল যে আমারও হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম।

নীচে জানালাপথে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল, একটি রিকশা এসে কিরীটীর ঠিক দোরগোড়ায় থামল।

জায়গাটায় ঠিক আলো না থাকার দরুন এবং রাস্তার লাইট হাতকয়েক দূরে থাকার দরুন একটু যেন আলোছায়ায় অস্পষ্ট। তাই পরিষ্কার বা স্পষ্ট দেখা যায় না।

কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কেউ এল রিকশা করে মনে হচ্ছে তোরই বাড়িতে! কে রে?

যার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম–

অপেক্ষা করছিলি!

হ্যাঁ। অবিশ্যি মনে একটু সন্দেহ যে ছিল না তা নয়—আসবে কি আসবে না শেষ পর্যন্ত, কিন্তু যাক, শেষ পর্যন্ত এসেছে!

কথা বলছিলাম আমরা নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়েই। দেখলাম আপাদমস্তক চাদরে আবৃত এবং গুণ্ঠনবতী এক নারীমূর্তি রিকশা থেকে নামল।

একজন ভদ্রমহিলা দেখছি!

হ্যাঁ।

ঐ সময় নীচের সদর দরজাটা খুলে গেল এবং জংলীকে দেখা গেল।

বুঝলাম কিরীটী জংলীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল পূর্ব থেকেই।

কে এলেন? শিবেন সোম এতক্ষণে পিছন দিক থেকে প্রশ্ন করেন।

এলেই দেখতে পাবে–আসছেনই তো এই ঘরেই! কিন্তু একটা কাজ করতে হবে তোমাকে আর সুব্রতকে

কি?

তোমাদের সামনে অর্থাৎ তৃতীয় ব্যক্তি এখানে কেউ ওঁর সামনে থাকলে উনি মুখ খুলতে ইতস্তত করবেন, কাজেই তোমরা ঐ পাশের ঘরে যাও। দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে। রেখো–তাহলেই ওঁকে তোমরা দেখতেও পাবে, ওঁর কথাও শুনতে পাবে।

চলুন তাহলে শিবেনবাবু।

আমার কথায় শিবেনবাবু এবং কৃষ্ণা দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। আমরা পাশের ঘরে গিয়ে অতঃপর প্রবেশ করি।

.

দরজার ফাঁক দিয়ে আমরা দেখতে লাগলাম।

অবগুণ্ঠনবতী সেই নারী সামনের কক্ষে এসে প্রবেশ করল।

আসুন, আসুন—কিরীটী আগন্তুক অবগুণ্ঠনবতী ভদ্রমহিলাকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সাদর আহ্বান জানাল।

ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একটা শূন্য সোফায় উপবেশন করলেন।

সরমা দেবী!

কিরীটীর সম্বোধনে যেন রীতিমত আমি চমকেই উঠি। আগন্তুক মহিলা তবে অন্য কেউ নয়-সরমা!

কিরীটীর কথায় সরমা দেবীও যেন একটু চমকেই উঠল মনে হল।

কিরীটী আবার বলে, আমি জানতাম যে সরমা দেবী আপনি আসবেন—আর আজই।

সরমা মাথার গুণ্ঠন সরিয়ে এবারে কিরীটীর দিকে তাকালেন।

তার দুচোখের দৃষ্টিতে বুঝি সীমাহীন বিস্ময়।

আপনি—

হ্যাঁ, জানতাম আপনি আসবেন আর কেন যে আসবেন তাও জানতাম।

আপনি—আপনি জানতেন?

জানতাম।

মনে হল অতঃপর কিরীটীর ঐ কথায় সরমা যেন নিজেকে নিজে একটু সামলে নিলেন। তারপর বললেন, কিরীটীবাবু, আপনি কি জানেন আমি জানি না, তবে একটা কথা শুধু বলতে এসেছিলাম

মৃদু হেসে কিরীটী কতকটা যেন বাধা দিয়েই বললে, শকুন্তলা বিমলবাবুকে হত্যা করে নি। এই কথাটাই তো বলতে এসেছেন?

হ্যাঁ, আপনারা মিথ্যে তার ওপরে সন্দেহ করে আজ তাকে ধরে এনেছেন সন্ধ্যার দিকে।

শকুন্তলা দেবীকে তাহলে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?

হ্যাঁ, সন্ধ্যার পরই তাকে গ্রেপ্তার করে এনেছে।

সবিস্ময়ে এবং নিঃশব্দেই আমি পার্শ্বে দণ্ডায়মান শিবেন সোমের দিকে তাকালাম। শিবেন সোম নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালেন।

বুঝলাম কিরীটীর নির্দেশে শিবেন সোম শকুন্তলাকে আজ সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করেছেন বটে, কিন্তু ব্যাপারটা তিনি না বুঝেই নির্দেশ পালনের জন্য করেছেন মাত্র।

.

১৭.

ঘরের মধ্যে আবার দৃষ্টিপাত করলাম দরজার ফাঁক দিয়ে। মুখোমুখি বসে কিরীটী ও সরমা।

ঘরের উজ্জ্বল আলোয় দুজনের মুখ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

কিন্তু কিরীটী বলছিল, শকুন্তলার গ্রেপ্তারের জন্য কিছুটা আপনিই দায়ী সরমা দেবী—

আমি দায়ী?

দায়ী বৈকি। কারণ সেদিন সব কথা গোপন না করে যদি অন্ততঃ আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়েও সত্যটা বলতেন তাহলে হয়তো এই দুর্ঘটনা ঘটত না।

সত্য আমি গোপন করেছি!

করেছেন। প্রথমতঃ আপনি আপনার সত্যকারের পরিচয় দেন নি—

আমার পরিচয়!

হ্যাঁ, আপনি যে ঐ বাড়িতে সাধারণ একজন দাসী হিসাবে স্থান পান নি, সে কথা আর কেউ না জানলেও প্রথম রাত্রেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম—

না কিরীটীবাবু—আমি—

আপনি দাসী নন। এবং শকুন্তলার জন্যেই ঐ গৃহে আপনার স্থান কায়েমী হয়েছিল।

কি বলছেন আপনি? শকুন্তলা–

হ্যাঁ-বলুন শকুন্তলা আপনার কে?

শকুন্তলা—না, না—শকুন্তলা আমার কে কেউ না, কেউ না! আর্তকণ্ঠে যেন প্রতিবাদ জানাল সরমা।

এখনো আপনি স্বীকার করবেন না! কিন্তু আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সে আপনার নিকট হতেও নিকটতম, আপন থেকেও আপন–

না, না, না—

বলুন—বলুন কে সে আপনার?

হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সরমা, কেউ না, কেউ না—সে আমার কেউ না—বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, আপনি বিশ্বাস করুন—

মর্মান্তিক এক বেদনায় যেন দুহাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলেন সরমা।

ক্ষণকাল কিরীটী সেই করুণ দৃশ্যের দিকে চেয়ে থেকে আবার এক সময় শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, সরমা দেবী, এখন বুঝতে পারছি অনুমান আমার মিথ্যা নয় এবং নিষ্ঠুর সত্য আজ দিনের আলোর মতই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। হয়তো চিরদিনের মত আজও গোপনই থাকত, কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা হয়তো তা নয়, তাই আজ এতদিন পরে সব কিছু প্রকাশ হয়ে পড়ল। দুঃখ করবেন না, কে বলতে পারে হয়তো বিধাতার ইচ্ছায় সব প্রকাশ হয়ে পড়ল—ঐ শকুন্তলার ভালর জন্যই!

কিন্তু কি লাভ হবে—কি লাভ হবে, কি মঙ্গল হবে তার এ কথাটা আজ সে জানতে পারলে? অরুদ্ধ কণ্ঠে মুখটা তুলে আবার সরমা কথা বললেন।

হবে, আপনি বিশ্বাস করুন—

না, না—সে হয়তো ঘৃণায় আর কোনদিন আমার মুখের দিকে তাকাবেই না। সে যখন জানবে যে সে এক বিধবার সন্তান–

সে যদি আজ তার জন্মের জন্য নিজের মায়ের বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেয় তাহলে বুঝব যে সত্যিই সে হতভাগিনী! কিন্তু ভয় নেই আপনার আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, যদি সত্যিই তাই আপনার অভিপ্রায় হয় তো একথা এতদিন যেমন গোপন ছিল তেমনি গোপনই থাকবে আজও। কিরীটী রায়ের মুখ দিয়ে এ কথা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারিত তো হবেই না, এমন কি তার পরিচিত শিবেন সোম বা সুব্রতর মুখ দিয়েও নয়—

কিরীটীবাবু! একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে সরমা।

হ্যাঁ সরমা দেবী, তারাও জানে এ কথা।

তারাও জানেন?

জানে। তবে তাদের আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। কিন্তু এবারে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, বিমলবাবু ছাড়া এ কথা কি আর কেউ জানত?

জানি না। তবে–

বুঝতে পেরেছি, আপনার অনুমান আরো কেউ জানত। হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা—আরো একজন জানত। তিনি বোধ হয় বিমলবাবুর বন্ধু ঐ রাঘব সরকার—তাই নয় কি?

মাথাটা নীচু করে সরমা।

ঠিক আছে। আপনি এবার ফিরে যেতে পারেন। যদি বলেন তো আমি নিজে গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। রাত অনেক হয়েছে–

না, না—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না! আমি একাই ফিরে যেতে পারব। কিন্তু–

কি বলুন?

শকুন্তলা–শকুন্তলার কি হবে?

সত্যি যদি তার এ ব্যাপারে কোন দোষ না থেকে থাকে তো আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, সে আবার রাহুমুক্ত হয়ে সসম্মানে আপনার কাছে ফিরে আসবেই। ভয় নেই, সত্যিকারের মিথ্যা চিরদিন টিকে থাকতে পারে না। মিথ্যার ভিতটা হুড়মুড় করে একদিন-বা-একদিন ভেঙে পড়েই।

ঢং করে ঐ সময় দেওয়াল-ঘড়িতে সাড়ে বারোটা রাত্রি ঘোষণা করল।

না, সত্যি রাত অনেক হয়ে গেল—কিরীটী একটু যেন ব্যস্ত হয়েই ওঠে সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে, চলুন, আমিই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি—

আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না কিরীটীবাবু। তাছাড়া কোথায় আপনি আমাকে পৌঁছে দেবেন? হ্যাঁ, আমি তো সেখানে আর ফিরে যাচ্ছি না—

ফিরে যাচ্ছেন না।

না, সেখানে আর নয়। আজকের মতই একদিন অসহায় আমার হাত ধরে সেখানে নিয়ে গিয়ে তার আশ্রয়ে আমাকে যে আশ্রয় দিয়েছিল, আজ সে-ই যখন নেই তখন আর কোন্ ভরসায় সেখানে থাকব বলতে পারেন! আর কোন্ দুঃসাহসেই বা থাকব! না কিরীটীবাবু, পৃথিবীতে বিশ্বাস বস্তুটা এমনই জিনিস যে একবার তার মূলে ভাঙন ধরলে আব কোন কিছুতেই তাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। হুড়মুড় করে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘাড়ের ওপরেই ভেঙে পড়ে। না কিরীটীবাবু, আর সেখানে কোনদিন ফিরব না বলে স্থির করেই এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছি–

কিন্তু কোথায় যাবেন?

কোথায় যাব জানি না, কিন্তু সেদিন যে দুশ্চিন্তাটা নবজাত এক শিশুর মা হয়ে সরমার বুকের মধ্যে ছিল আজ তো সে দুশ্চিন্তাটা আর তার বুকের মধ্যে নেই। আজ আর ভয় কি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।

অকস্মাৎ যেন সরমার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। হঠাৎ একটা পাথর যেন ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে। এক নিমেষে সমস্ত কুণ্ঠা সমস্ত দ্বিধার অবসান ঘটেছে।

বিস্মিত দৃষ্টিতে দরজার মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

কিন্তু সরমা দেবী, আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত আপনি ও-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না! কিরীটী এবারে বললে।

হ্যাঁ দিয়েছিলাম, মনে আছে। আর সেটাই তো এখানে এত রাত্রে আসবার আমার দ্বিতীয় কারণ কিরীটীবাবু!

শান্ত মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সরমা দেবী এবং যাবার জন্যই বোধ করি অতঃপর উঠে দাঁড়ালেন, আমি তা হলে এবারে যাই!

না সরমা দেবী, তা হয় না। আমাকে কথা দিয়ে আপনি কথা রেখেছেন বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কিন্তু আজ আর একজনকে না জানিয়েও তো কোথাও এভাবে চলে যাবার আপনার অধিকার নেই।

কিরীটীবাবু!

আপনার মেয়ে শকুন্তলা—তার প্রতি কি আর আপনার কোন কর্তব্যই অবশিষ্ট নেই? তাকে আপনি কার কাছে রেখে যাচ্ছেন?

আমি জানি কিরীটীবাবু, সে দুষ্মন্তকে ভালবাসে আর দুষ্মন্তও তাকে ভালবাসে—দুষ্মন্তই তাকে আশ্রয় দেবে। বরং আমি থাকলেই তার সেই নিশ্চিন্ত আশ্ৰয়টা ভেঙে যাবার সম্ভাবনা আছে–

তা আছে কিনা জানি না, তবে রাঘব সরকারের কথাটাই বা ভুলে যাচ্ছেন কেন?

রাঘব।

হ্যাঁ–

মৃদু অথচ অতিশয় করুণ হাসির একটা আভাস যেন সরমার ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে। এবং হাসিটা মিলিয়ে যাবার পরক্ষণেই সমস্ত মুখখানি যেন কঠিন হয়ে ওঠে।

সরমা দেবী!

নিশ্চিন্ত থাকুন, সে এখনো জানে না যে তার মৃত্যুবাণ আমারই হাতে রয়েছে!

মৃত্যুবাণ?

হ্যাঁ। আমি এবারে যাই—

কিন্তু সরমা দেবী, একটা কথা—আপনাকে হয়তো আমার প্রয়োজন হবে এবং অন্য কোন কারণে নয়—আপনার মেয়ে শকুন্তলাকে বাঁচানোর জন্যই, তখন কোথায় আমি আপনাকে পাব?

আমি রামচরণের সঙ্গেই থাকব।

রামচরণ!

হ্যাঁ, আমার ধর্ম-ছেলে। আমি তার ধর্ম-মা।

আপনি তা হলে এখন তার দেশের বাড়িতেই যাচ্ছেন?

, বসিরহাটে তার ছেলে, ছেলের বৌ আছে—সেখানেই আপাততঃ কিছুদিন থাকব আমি। তা হলে চলি—

চলুন, আপনাকে নীচে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।

সরমা আগে ও পিছনে কিরীটী বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

আমরাও পুনরায় ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।

একটু আগে ঘরের মধ্যে যেন একটা নাটক অভিনীত হয়ে গিয়েছে এবং তার সুরটা ঘরের বাতাসে যেন এখনো ছড়িয়ে রয়েছে।

.

১৮.

সরমাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী পুনরায় ঘরে ফিরে এল।

ক্ষণপূর্বে নাটকের দর্শক ও শ্রোতা আমরা তখন যেন বিমূঢ় নির্বাক হয়ে ঘরের মধ্যে বসে। আছি।

কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, কিন্তু বসল না—পূর্বেরই সেই খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরও কিছুক্ষণ একটা যেন জমাট স্তব্ধতার মধ্যেই আমাদের কেটে গেল।

মনে হচ্ছিল কারোর যেন কিছু আর বলবার নেই। সবারই কথা যেন শেষ হয়ে গিয়েছে। নাটক শেষ হয়ে গিয়েছে, যবনিকা নেমে এসেছে, শূন্য প্রেক্ষাগৃহে যেন কজন আমরা বসে আছি।

প্রথমে সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কৃষ্ণাই কথা বললে, সরমা চলে গেল?

কৃষ্ণার ডাকে কিরীটী ওর দিকে ফিরে তাকাল, হ্যাঁ, চলে গেল।

আচ্ছা একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না এখনো—

কি?

শকুন্তলার বাপ তা হলে কে?

জন্ম যখন তার হয়েছে—সরমা যখন তার মা-বাপও তার একজন আছে বৈকি কৃষ্ণা।

কিন্তু কথাটা ওকে তুমি জিজ্ঞাসা করলে না কেন?

ছিঃ কৃষ্ণা! তাই কি পারি? মেয়েমানুষ হয়েও কি বুঝতে পারো না, মেয়েমানুষের জীবনে এ কত বড় লজ্জা! তাছাড়া হৃদয়হীনতার কি একটা সীমা নেই!

কিন্তু–

না। তাছাড়া তোমাদের চোখ আর মন থাকলে শকুন্তলার বাপের সংবাদটা পেতে তোমাদেরও দেরি হত না। যাক সে কথা। তার জন্ম-বৃত্তান্তটা যখন প্রকাশ হয়েছে, সে কথাটাও অপ্রকাশ থাকবে না। কিন্তু শিবেনবাবু—

সহসা শিবেনের দিকে ফিরে তাকিয়ে এবার কিরীটী বললে, দ্বিতীয় ফঁাকটাও আমার ভরাট হয়ে গিয়েছে। তাই বলছিলাম কাল প্রত্যুষে সরমার গৃহত্যাগের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পূর্বেই আমাদের যা করবার করতে হবে

কি?

দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল কিরীটী, রাত পৌনে দুটো এখন, ঠিক পৌনে পাঁচটায় মানে আর তিন ঘণ্টা পরেই আমরা বের হয়ে পড়ব। আপনাকে কালকের জন্য যেমন যেমন বলেছিলাম ফোনে তেমন তেমন ব্যবস্থা সব করে রেখে দিয়েছেন তো?

হ্যাঁ, কিন্তু শকুন্তলা—তাকে কি ছেড়ে দেব?

পাগল হয়েছেন! এখন তাকে ছেড়ে দিলে তাকে বাঁচাতে পারবেন না—

বাঁচাতে পারব না?

না। কারণ সে-ই যে একমাত্র সাক্ষী সেদিন রাত্রের নৃশংস সেই হত্যার ব্যাপারের!

বলেন কি? সে তা হলে সব জানে?

জানে। তবে—

তবে? এইটুকুই কেবল জানে না—লোকটা কে—আসলে কে সে, কারণ ঘর অন্ধকার ছিল—

শকুন্তলা তা হলে জানে!

জানবেই তো, সে যে তখন রঞ্জনের ঘরে ছিল—

রঞ্জনের ঘরে!

হ্যাঁ। অথচ রঞ্জন সেটা ঘুণাক্ষরেও সেদিন যেমন জানতে পারেনি, তেমনি আজও জানে না।

তবে কি—সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিবেন তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

কিন্তু কিরীটী যেন পরমুহূর্তেই শিবেনের সমস্ত উৎসাহ করে একটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, এখনো হাতে প্রায় ঘণ্টা-তিনেক সময় আছে বড্ড ঘুম পেয়েছে—আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।

কথাটা বলে এবং কাউকে কথা বলার দ্বিতীয় অবকাশমাত্রও না দিয়ে সোজা ঐ ঘর থেকে বের হয়ে কিরীটী নিজের শয়নঘরের দিকে পা বাড়াল।

আমরা তিনটি প্রাণী যেন একটা দুর্বোধ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিমূঢ় বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। বিশেষ করে শিবেন সোম।

প্রথমে কথা বললেন শিবেন সোমই, সুব্রতবাবু, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না!

আমার মনের অন্ধকারটা ততক্ষণে কাটতে শুরু হয়েছে, অন্ধকারে বেশ আলো দেখতে পাচ্ছি।

আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, কিছু বলছিলেন মিঃ সোম?

বলছিলাম, তা হলে কি হল? কিছু বুঝতে পারছেন আপনি?

আমার কাছ থেকে আর কেন শুনবেন—হয়তো বলতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলব, ও তো বলেই গেল ঘণ্টা-তিনেক বাদেই বোধ হয় সব জানতে পারবেন কিন্তু কৃষ্ণা, এবারে একটু চা হলে মন্দ হত না বোধ হয়!

কৃষ্ণা ঘর থেকে উঠে গেল নিঃশব্দে।

.

পৌনে পাঁচটা নয়, বেরুতে আমাদের প্রায় পাঁচটা হয়ে গেল।

কিরীটীর গাড়িতে চেপেই আমরা চলেছিলাম আমাদের গন্তব্যস্থলে। হীরা সিং গাড়ি চালাচ্ছিল।

শিবেন সোম আর নিজেকে চেপে রাখতে পারেন না, প্রশ্ন করেন, কিন্তু কোথায় আমরা যাচ্ছি কিরীটীবাবু? বেলগাছিয়ায় কি?

না। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।

তবে কোথায়?

বিনায়ক সেনের ওখানে, শ্যামবাজারে।

সেখানে-সেখানে কেন?

গেলেই জানতে পারবেন।

.

যাই হোক, বিনায়ক সেনের গৃহে, রামধন মিত্র লেনে, যখন গিয়ে আমরা পৌঁছলাম সকাল সাড়ে পাঁচটা। সবে ভোর হয়েছে বলা চলে।

সুন্দর তিনতলা সাদা রঙের বাড়িটি। দারোয়ান সবে তখন গেট খুলেছে। গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দারোয়ানকে দিয়েই ভিতরে সংবাদ পাঠানো হল।

একজন ভৃত্য এসে আমাদের বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিল। শুনলাম বিনায়ক সেন তখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। একটু বেলা করেই নাকি ওঠেন।

ভৃত্যকে বলা হল বাবুকে তুলে দেবার জন্য। কথাটা কিরীটীই বললে।

ভৃত্য প্রথমে বোধ হয় একটু আপত্তি জানাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে শেষ পর্যন্ত কি জানি কেন সে আর না করতে পারল না। ভিতরে চলে গেল।

এবং মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা স্লিপিং গাউন গায়ে চাপিয়ে ঘাসের চটি পায়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন বিনায়ক সেন।

ঘরে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়ালেন। কয়েকটা মুহূর্ত যেন বোবা। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন কেবল, আপনারা!

হা মিঃ সেন, বসুন। বলা বাহুল্য কিরীটীই কথা বললে, এবং কেন যে এ সময় এসেছি তাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন–

একটা সোফায় মুখোমুখি বসতে বসতে বিনায়ক সেন বললেন, না। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?

কিন্তু বোঝা উচিত ছিল আপনার অন্তত মিঃ সেন!

বোঝা উচিত ছিল?

হ্যাঁ। শুনুন মিঃ সেন, আপনি বোধ হয় শুনেছেন—

কি?

শকুন্তলা অ্যারেস্টেড!

সে কি! চমকে ওঠেন বিনায়ক সেন।

হ্যাঁ, তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে—অথচ সে নির্দোষ—

আমি–আমি কি করে তা জানব?

সে কি কথা, নিজের সন্তানকে আপনি জানেন না—

কি বললেন? অকস্মাৎ যেন চমকে উঠলাম কিরীটীর কথায়।

হ্যাঁ মিঃ সেন, সুনন্দা আমাদের সব বলেছে—

সুনন্দা!

হ্যাঁ সুনন্দা। যে আজো জীবিত আছে জানতে পেরে সেদিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে বিমলবাবুর গৃহে আপনি গোপনে দেখা করতে গিয়েছিলেন–

কি বলছেন আবোল-তাবোল সব আপনি কিরীটীবাবু?

সত্যকে আর গোপন করবার চেষ্টা বৃথা বিনায়কবাবু। সত্য সব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আপনার দুষ্কৃতি আর গোপন নেই। শান্ত মৃদু কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বললে।

আমি—

কিন্তু আপনার নিজের আত্মজা শকুন্তলা জেনেও কি করে এত বড় অন্যায়টা করতে গিয়েছিলেন মিঃ সেন?

অন্যায়!

নিশ্চয়ই। আপনার মেয়ে শকুন্তলা দুষ্মন্তকে ভালবাসে জেনেও রাঘবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তারই হাতে শকুন্তলাকে তুলে দেবার চেষ্টা করতে আপনার এতটুকু দ্বিধা হল না?

না না—

হ্যাঁ। আর কেন যে আপনি ঐ ঘৃণ্য কাজ করতে দ্বিধা করেননি তাও আমি জানি। ফিল্ম বিজনেস-এ আপনার গত কয় বছর ধরেই শোচনীয় অবস্থা চলেছে, তাই রাঘব সরকার জোচ্চুরি করে সিনথেটিক হীরা আসল হীরা বলে চালাচ্ছে জেনেও, সে আপনাকে ফাইনানসিয়ালি সাহায্য করছিল বলে তার বদলে শকুন্তলাকে সেই শয়তানটার হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্রে আপনি লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ আপনি জানতেন আপনার বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবু গোপনে বিধবা কুলতাগিনী সুনন্দা অর্থাৎ সরমাকে বিবাহ করেছিল সেই কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়লে বিমলবাবু সমাজে আর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। তাই তার পক্ষে বাধা দেওয়াও সম্ভব নয়—

না না —

হ্যাঁ, তাই। বলুন যা বলছি তা মিথ্যা?

হ্যাঁ মিথ্যা, মিথ্যা—কোথায়–কোথায় সুনন্দা? এক্ষুনি তার কাছে আমি যাব—

সে এখন আপনার নাগালের বাইরে—

নাগালের বাইরে!

হ্যাঁ, আমিই তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিয়েছি। ছি ছি বিনায়কবাবু, আপনি এত নীচ–এত ছোট মন আপনার! নিজের ঔরসজাত সন্তানের এত বড় সর্বনাশ করতে আপনি উদ্যত হয়েছিলেন? টাকাটাই কি দুনিয়ায় সব? কিন্তু কার জন্য বলুন তো আপনার এই সম্পত্তি–এই অন্ধ অর্থের নেশা? সংসারে তো আপনার নিজের বলতে আর কেউ নেই

কোথায় কোথায় সুনন্দা? নিয়ে চলুন আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন, আমি তাকে খুঁজেছি—

তার কাছে গিয়ে আজ আর আপনার কোন লাভ নেই মিঃ সেন!

মিঃ রায়?

হ্যাঁ, তার কাছে আজ আপনি মৃত। ডেড়। যে ভালবাসার ওপরে বিশ্বাস রেখে একদিন সে আপনারই হাত ধরে নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে ভালবাসা তো আপনি একদিন গলা টিপে শেষ করে দিয়েছেন–

বিনায়ক সেন আর একটি কথাও বলতে পারলেন না। যেন পাথরের মত বসে রইলেন। এবং অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললেন, শকুন্তলার কাছে আমি যাব।

না, সে-চেষ্টাও আর করবেন না মিঃ সেন। সে যে পরিচয় তার জানে সেই পরিচয় নিয়েই সে থাক। কোন ক্ষতি হবে না তার ঐ কুৎসিত সত্যটা আজ আর না জানলেও।

বিনায়ক সেন চুপ করে রইলেন।

হ্যাঁ, যে পাপের জন্য সে দায়ী নয়—সে পাপ-স্পর্শ তার জীবন থেকে দূরেই থাক। কোন ক্ষতি হবে না তাতে করে তার। জীবনে যে প্রতিষ্ঠা আর পরিচয় সে আজ পেয়েছে সেটাই থাক তার জীবনের সত্য হয়ে।

বিনায়ক সেন বসে রইলেন। একটি শব্দও আর মুখ থেকে তার বেরুল না।

কিরীটীই আমাদের চোখের ইঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য বলে নিজে দরজার দিকে অগ্রসর হল।

আমরা তাকে অনুসরণ করলাম।

.

১৯.

আবার সকলে এসে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম।

ঘণ্টা-দুয়েক আগেকার অভিযানের সমস্ত উত্তেজনা তখন যেন একেবারে ম্লান হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মন জুড়ে যেন কেমন একটা বেদনাতুর অবসন্নতা। কারো কোন কথা বলবার আর যেন উৎসাহমাত্রও তখন আর আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

কিরীটীর নির্দেশমত তখন আবার তার বাড়ির দিকেই গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

ভেবেছিলাম অতঃপর কিরীটী বুঝি আর কোন কথাই বলবে না। কিন্তু কিরীটীই কথা বললে।

শিবেনবাবু, আমার কাজ ভাই শেষ হয়েছে। এবারে যা করবার আপনিই করুন।

কিন্তু কিরীটীবাবু, আমি তো এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না—

কি বুঝতে পারছেন না?

কে তা হলে অধ্যাপককে হত্যা করল আর কেনই বা হত্যা করল?

এখনো বুঝতে পারেননি?

না।

কিন্তু কেন বলুন তো? সব কিছু কি এখনো আপনার কাছে প্রাঞ্জল হয়ে যায়নি?

ভাই। সত্যি কথা বলতে কি, আরো যেন সব জট পাকিয়ে গেল!

জট পাকালো নয় বরং জট সব খুলে গেল!

খুলে গেল?

তাই নয় কি?

কিন্তু–

শুনুন শিবেনবাবু, অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত একটা পুরোপুরি ট্র্যাজেডি অফ এররস যাকে বলে তাতেই পর্যবসিত হয়েছে—

ট্র্যাজেডি অফ এররস!

হ্যাঁ। আর এও বলে দিচ্ছি—বিনায়ক সেন, রঞ্জন বোস, সরমা ও শকুন্তলার মধ্যেই একজন হত্যাকারী।

বলেন কি—এদের চারজনের মধ্যে একজন?

হ্যাঁ, ওয়ান অফ দেম! কিন্তু আর একটি কথাও বেশী বলব না। হত্যার কারণটাও আপনারা ইতিপূর্বেই জেনেছেন, অতএব সে-সম্পর্কেও আর আলোচনা নিরর্থক।

কিন্তু কিরীটীবাবু–

না, আপনারা না পারেন যারা এই কাহিনী শুনবে বা পড়বে তাদেরই ওপর না হয় ছেড়ে দিন-তারাই খুঁজে বের করুক কে হত্যাকারী!

কিরীটীবাবু!

ভয় নেই, হত্যাকারী পালাবে না। কারণ তার পালাবার পথ নেই—অতএব সেদিক দিয়ে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি।

পরিশিষ্ট

২০.

সত্যিই সেদিন বিনায়ক সেনের গৃহ থেকে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে, পরে সমস্ত দিন কিরীটী তার বসবার ঘরে এক প্যাকেট তাস নিয়ে সর্বক্ষণ একা একা আপন মনে নিঃশব্দে পেসেন্স খেলেই কাটিয়ে দিল।

কেবল মধ্যে মধ্যে জংলীকে চায়ের আদেশ দেওয়া ব্যতীত একটি কথাও বললে না।

সন্ধ্যার দিকে এসে কৃষ্ণার কাছ থেকেই ব্যাপারটা অবগত হলাম।

আমি গৃহে পা দিতেই কৃষ্ণা এসে শুধাল, কি ব্যাপার ঠাকুরপো, ভদ্রলোক হঠাৎ এত চুপচাপ কেন? ফেরা অবধি কারো সঙ্গে একটা কথা পর্যন্ত বলছে না!

মৃদু হেসে সকালবেলাকার নাটকীয় ব্যাপারটা খুলে বললাম।

সব শুনে কৃষ্ণা বললে, হুঁ, এই ব্যাপার তা হলে? এদিকে বেচারী শিবেনবাবু ফোনের। পর ফোন করছেন।

ব্যাপারটা একটা লঘু রহস্য। ভদ্রলোক ধরতে পারেননি। হেসে বললাম।

যাই হোক ঘরে এসে প্রবেশ করলাম। কিন্তু কিরীটী আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। যেমন আপন মনে পেসেন্স খেলছিল তেমনি খেলতেই লাগল।

আমিও তাকে কোনরূপ সম্বোধন করে বিরক্ত না করে একটা সোফায় বসে একটি রহস্যকাহিনীতে মনোনিবেশ করলাম।

আরো ঘণ্টা দুই অতিবাহিত হয়ে গেল। এবং রাত আটটা নাগাদ শিবেন সোম আবার এসে হাজির।

আমার পাশে বসে ফিস ফিস করে শুধালেন, কি হল সুব্রতবাবু?

কিসের কি?

কিছু জানতে পারলেন?

জানবার কথা তো ওর নয়, জানবার কথা যে আপনার শিবেনবাবু! হঠাৎ কিরীটী মুখ তুলেই তাস সাজাতে সাজাতে কথাটা বললে।

কিন্তু এদিকে যে আর এক জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে আজই দ্বিপ্রহরে কিরীটীবাবু! তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন শিবেন সোম।

মুখ না তুলেই প্রশ্ন করে কিরীটী, জটিল সমস্যা!

তাছাড়া আর কি? শকুন্তলাকে সকালবেলা থানাতে গিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলাম—

ও, তা হলে আপনার ধারণা শকুন্তলা হত্যা করেননি? কিরীটী শুধায়।

না, অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি।

কেন বলুন তো সে হত্যাকারী নয়?

দুটো কারণে সে হত্যা করেনি বা করতে পারে না বলেই আমার মনে হয় কিরীটীবাবু।

যথা!

হয়তো আমার ভুল হতে পারে

না, না,–ভুল হয়েছেই যে ভাবছেন কেন? বলুন না?

প্রথমতঃ যাকে নিজের কাকা বলে এতকাল পর্যন্ত জেনে এসেছে—তা সে মিথ্যা জানাই হোক বা সত্য জানাই হোক এবং যার কাছ থেকে এমন অকুণ্ঠ স্নেহ ও ভালবাসা পেয়ে এসেছে। তাকে সে হত্যা করবে এ যেন ভাবাই যায় না!

আর দ্বিতীয় কারণ?

অধ্যাপককে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে ক্লোরোফরম দিয়ে প্রথমে অজ্ঞান করে, তারপর ডিজিট্যালিন প্রয়োগে—সে কাজ তার মত এক নারীর পক্ষে শুধু অসম্ভব নয়, অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয় না কি?

ঠিক।

সেই কারণেই তাকে আমি আজ সকালেই মুক্তি দিয়েছিলাম।

কিন্তু তবু–

জানি মিঃ রায়, সে কথাটাও যে আমি ভাবিনি তা নয়। আপনি হয়তো বলবেন রাঘব সরকারের সঙ্গে বিবাহের ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায়—মুক্তির কোন পথ না দেখতে পেয়ে সে অন্য কারো সাহায্যে বা প্ররোচনায় নিজে হয়তো অধ্যাপককে হত্যা না করলেও হত্যার ব্যাপারে সাহায্যকারিণী হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না তার এবং এমন যে আগে কখনো ঘটেনি তাও নয়। নারী জাতি কোন কারণে হিংস্র হয়ে উঠলে তারা যে কি না করতে পারে সেটাও চিন্তার বিষয় ছিল, কিন্তু–

চমৎকার—চমৎকার অ্যানালিসিস আপনার হয়েছে শিবেনবাবু! আমার মনে হয় শকুন্তলার ব্যাপারে অন্তত আপনি সেন্ট পারসেন্ট কারেক্টরাইট! কিন্তু হোয়াট অ্যাবাউট আদার্স?

তারপর ধরুন সুনন্দা বা সরমা দেবী!

বলুন?

তাকেও আমি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি।

কেন?

প্রথমতঃ সুনন্দার প্রতি অধ্যাপকের গভীর ভালবাসা বা প্রেম যা তাকে শুধু তার চরম দুর্দিনে আশ্রয়ই কেবল দেয়নি, দিয়েছিল পরিচয় সম্মান ও নিশ্চিন্ত আশ্বাস এবং যে তার আত্মজাকে নিজের ভাইঝি বলে সকলের কাছে পরিচয় দিয়েছে, তাকেই সুনন্দা হত্যা করবে ব্যাপারটা চিন্তা করাও বাতুলতা ছাড়া আর কি বলুন!

হু, তা বটে। কিন্তু–

শুনুন, শেষ হয়নি বক্তব্য আমার সুনন্দাও নারী শকুন্তলার মত তার পক্ষেও ঐভাবে অধ্যাপককে হত্যা করা একপ্রকার অসম্ভব নয় কি!

তা বটে! তবু–

জানি তবু হয়তো আপনি বলবেন, দুষ্মন্তের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে রাঘব সরকারের সঙ্গে শকুন্তলার বিয়ের জেদাজেদির জন্য সরমা হয়তো নিষ্ফল হয়ে শেষ পর্যন্ত ঐভাবে অধ্যাপককে হত্যা করতে পারত। কিন্তু যার কাছে সে এতখানি কৃতজ্ঞ তাকে সে মেয়েমানুষ হয়ে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে আর যে-ই ভাবুক আমি কিন্তু ভাবতে পারলাম না।

উঁহু, আইনের প্রতিভূ হয়ে আপনার ঐ দুর্বলতা তো শোভা পায় না শিবেনবাবু! কিরীটী বলে ওঠে।

কিন্তু আইন যারা গড়েছে একদিন তারা শুধু মানুষই নয়, মানুষের দিকে তাকিয়েই তাদের আইন গড়তে হয়েছিল। আইন স্বেচ্ছাচারিতাও নয়—অবিশ্বাস্যও কিছু নয়।

কিরীটী এবারে মৃদু হেসে বললে, বেশ, মেনে নিলাম সুনন্দার নির্দোষিতার কথাও—তা হলে বাকি থাকছেন দুজন!

হ্যাঁ, বিনায়ক সেন ও রঞ্জন বোস। এদের মধ্যে হত্যা করা কারো পক্ষেই অসাধ্য কিছু নয়। এদের দিক থেকে হত্যার কারণও যথেষ্ট আছে বা ছিল। এবং এদের মধ্যে একজনের পরিচয় আমরা যতটা সংগ্রহ করতে পেরেছি অন্যজনের বেলায় ততটা পারিনি। আমি বলতে চাই রঞ্জনবাবুর কথা।

সে কি, রঞ্জনবাবুর যথেষ্ট পরিচয়ও তো আমরা পেয়েছি!

কেমন করে? তার অতীত সম্পর্কে তো এখনো কিছুই আমরা জানি না।

জানি বৈকি। হেড কোয়ার্টারে খোঁজ নিলেই আপনি জানতে পারতেন।

মানে?

আপনি হেড কোয়ার্টারের থু দিয়ে যে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন মালয়ে, পরশু রাত্রেই তার কি জবাব এসেছে তা জানেন না?

কই না! আমি তো কিছু শুনিনি!

ডি. সি.-ই আমাকে ফোনে জানিয়েছেন আজ সকালে। মালয় সম্পর্কে সে যা বলেছিল মোটামুটি তা ঠিকই।

তা হলে—

কি, তা হলে?

রঞ্জনবাবুই সত্যি সত্যি তা হলে বিমলবাবুর যাবতীয় সম্পত্তির বর্তমানে সত্যিকারের একমাত্র উত্তরাধিকারী!

আইন তাই বলে।

তবে তো পেয়ে গিয়েছি! উল্লাসে বলে ওঠেন হঠাৎ শিবেন সোম।

পেয়েছেন? হ্যাঁ, হাসে তা হলে সে-ই হত্যা করেছে সেরাত্রে অধ্যাপককে!

অসম্ভব নয় কিছু। কিন্তু প্রমাণ কি তার?

প্রমাণ?

হ্যাঁ, হাউ উড ইউ প্রভ দ্যাট? ভুলবেন না শিবেনবাবু, তিনটি মারাত্মক ব্যাপারের এখনো কোন মীমাংসাই করতে পারেননি বন্ধু!

তিনটি মারাত্মক ব্যাপার?

হ্যাঁ। প্রথমতঃ অধ্যাপকের ঘরের ভাঙা আরামকেদারাটা কি করে ভাঙল, কে ভাঙল এবং কেন ভাঙল?

কি বলছেন কিরীটীবাবু।

ঠিকই বলছি। সেটা বর্তমান হত্যা-রহস্য মীমাংসার মূলে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপার এবং দ্বিতীয়তঃ—

বলুন?

শকুন্তলার হাতের অভিজ্ঞানটি—

মানে আংটিটা!

আংটি?

হ্যাঁ, ভুলবেন না আংটি স্বেচ্ছায় হাতে না পরলে কেউ কারো হাতে জোর করে যেমন পরাতে পারে না, তেমনি মনের মধ্যে স্বীকৃতি না থাকলে কারো অনুরোধেই বিবাহের প্রাক্‌অভিজ্ঞান হিসাবে কেউ নিজের হাতে আংটি পরে না! এবং তৃতীয় হচ্ছে—

কি?

হত্যার আসল কারণটা কি ছিল? অথ বিবাহঘটিত না অর্থম অনর্থম? শেষ মাইলস্টোনএ পৌঁছবার পূর্বে ঐ তিনটি পয়েন্ট নিজের কাছে নিজে ক্লিয়ার করে নিতে হবে।

শিবেন সোম একেবারে চুপ।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *