Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রজনী (২০০৩) || Humayun Ahmed » Page 3

রজনী (২০০৩) || Humayun Ahmed

ডাক্তারের সন্ধানে বের হলাম

ডাক্তার হচ্ছেন আমাদের ধীরেন কাকু। দীর্ঘদিন এই পাড়ায় আছেন। উনিশ শ পয়ষট্টি সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দলবল নিয়ে কোলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুবিধা করতে না পেরে আবার ফিরে এসেছেন। এখানেও সুবিধা করতে পারেন নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের সমস্ত দুর্বলতা ধীরেন কাকুর আছে। তিনি আশেপাশের সবাইকে খুশি রাখতে চান। বেশিরভাগ সময়ই ভিজিট নেন না। ভিজিট দিতে গেলে তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বলেন, আরে, আপনার কাছে ভিজিট কি নেব? ভাই। ভাই হিসেবে বাস করছি, কী বলেন? ঠিক না? আপনার বিপদে আমি আপনাকে দেখব, আমার বিপদে আপনি দেখবেন আমাকে। হা হা হা।

উনিশ শ একাত্তুরে ধীরেন কাকুকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। তখন আমাদের পাড়ার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজি আবদুল কাদের তাঁকে অনেক ঝামেলা করে ছুটিয়ে নিয়ে এলেন, এবং এক শুক্রবারে হাজি আবদুল কাদের ধীরেন কাকুকে মুসলমান বানিয়ে ফেললেন। নতুন মুসলমান ধীরেন কাকুর নাম হল মোহাম্মদ সুলায়মান। তিনি দাড়ি রাখলেন। চোখে সুরমা দেওয়া শিখলেন। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে লাগলেন। একদিন বেশ ঘটা করে বাজার থেকে গরুর গোশত কিনে আনলেন। শান্তি কমিটির একটা মিছিল বের হল। সেখানেও টুপি মাথায় তাঁকে দেখা গেল। দেশ স্বাধীন হবার পর ধীরেন কাকু আবার হিন্দু হয়ে গেলেন। তবে দাড়ি ফেললেন না। দাড়িতে তাকে বেশ ভালো মানায়, কেমন ঋষি-ঋষি লাগে।

ধীরেন কাকুকে বাসায় পেলাম না। কলে গেছেন। তাঁর বড় মেয়ে অতসীদি বললেন, তুই বোস বীরু, বাবা এসে পড়বে। কার অসুখ?

পিতৃদেবের।

কী হয়েছে?

বক্কর-বক্কর করে কাশছে। মনে হচ্ছে লাংস ফুটো।

ছিঃ বীরু, বাবাকে নিয়ে কেউ এভাবে কথা বলে?

অতসীদি এত কোমলভাবে কথাগুলো বললেন যে, সত্যি-সত্যি আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। তিনি হয়তো খুব সাধারণভাবেই কথাগুলো বলেছেন। তাঁর চেহারা এবং গলার স্বরের জন্যেই সাধারণ কথাও অন্যরকম মনে হয়েছে। একজন স্নিগ্ধ চেহারার মেয়ের কর্কশ কথাও স্নিগ্ধ মনে হয়। অতসীদি এই ভোরেই গোসল সেরেছেন। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল বাঁধা। চোখের দিকে তাকালে মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই গাঢ় করে কাজল দেওয়া হয়েছে। ঈশ্বর কোনো কোনো মেয়েকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত করুণা করেন। চোখে জন্ম-কাজল পরিয়ে দেন।

বীরু চা খাবি?

খাব।

চিনি নেই কিন্তু। বিনা চিনিতে।

বিনা চিনিতেই খাব।

নিয়ে আসছি, তুই বসে থাক। এরকম করে পা নাচাবি না তো, দেখতে বিশ্রী লাগে।

আমি বসে থাকি। অনেক দিন পর আসছি ধীরেন কাকুর বাড়িতে। ছোটবেলায় খুব আসা হত। আমার মূল আকর্ষণ ছিল মিষ্টি। এই বাড়িতে এলেই অতসীদি বলতেন, হাতটা ধুয়ে আয়, সন্দেশ দেব। সাবান দিয়ে ভালো করে ধুবি, নয়তো দেব না।

অতসীদির ছোট আরো তিন বোন ছিল। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ধীরেন কাকু একেকজনকে কলকাতায় নিয়ে ঝামেলা পার করে এসেছেন। শুধু বড়জনকে পারেন নি। অথচ বড়জনই বোনদের মধ্যে সবচে সুন্দর। আমার মতে পৃথিবীর সবচে সুন্দর মেয়ে। শৈশবে প্রায়ই ভাবতাম, বড় হয়ে অতসীদিকে বিয়ে করব।

কে জানে মনে মনে হয়তো এখনো ভাবি, নয়তো তাঁকে দেখে এমন অস্থির লাগবে কেন?

চায়ের কাপ এবং একটা পিরিচে কী যেন একটা খাবার নিয়ে অতসীদি ঢুকলেন। রেশমের মতো কোমল গলায় বললেন, একটু মোহনভোগ এনেছি, খেয়ে দেখ তো। মিষ্টি বেশি হয়ে গেছে, তবে খেতে খারাপ না।

মোহনভোগ লাগবে না, তুমি চা দাও।

তোর চোখ এমন লাল হয়ে আছে কেন রে?

চোখে আলতা দিয়েছি, এর জন্য লাল হয়েছে।

দিনদিন তোর কথাবার্তা খুব খারাপ হচ্ছে। গুণ্ডাপাণ্ডা হয়ে গেছিস। তোর সঙ্গে একটা ছেলে আসত নাটুকু নাম। ওদেখি খুব বদমাশ হয়েছে। মদদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ঐ দিন রিকশা করে আসছি। আমাকে পেছন থেকে দেখেছে, চিনতে পারে নি। খুব খারাপ একটা কথা বলেছে। আমি রিকশা থেকে নেমে বললাম, কী হচ্ছে রে টুকু? ওমি পালিয়ে গেল। ও করে কী এখন?

মেয়েদের হাত থেকে গলার হার, হ্যান্ডব্যাগ এইসব ছিনিয়ে নেয়।

তুই সবসময় এ রকম ঠাট্টা করিস কেন?

ঠাট্টা না। সত্যি কথা বলছি। ওর পেশা হচ্ছে ছিনতাই।

আমি অতসীদির হাতে হাত রাখলাম। কী রকম ঠাণ্ডা একটা হাত। ধবধবে ফর্সা। তাকালেই পবিত্র একটা ভাব হয়।

অতসীদি হাত সরিয়ে নিলেন না। অন্য কোনো মেয়ে হলে নিত। অতসীদি অন্য কোনো মেয়ে নয় বলেই সহজ গলায় বললেন, তোর হাত এরকম হয়েছে কেন? রগ-ওঠা হাত। বানরের থাবার মতো লাগছে।

মনে হয় বানর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা বানর থেকে মানুষ হয়েছিল, আমরা মানুষ থেকে বানর হয়ে ঋণ শোধ করছি।

সব সময় উল্টাপাল্টা কথা বলিস কেন? আচ্ছা শোন, টুকুর সঙ্গে তোর দেখা হয়?

হয় মাঝে-মাঝে।

একবার বলিস তো আমার কাছে আসতে। কী রকম ছোট্ট ছিল। সব সময় নাক দিয়ে সর্দি পড়ত।

আমি চায়ের কাপ নামিয়ে হঠাৎ করে বললাম, একটা মজার কথা শুনবে অতসীদি?

তোর তো সব কথাই মজার, নতুন করে আর মজার কথা কি শোনাবি? সব মজার কথাই তো কয়েকবার করে শোনা।

এটা বিশেষ মজার।

বল শুনি।

আমি এবং টুকু—আমরা দুজন ছোটবেলায় ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে তোমাকে বিয়ে করব।

অতসীদি খিলখিল করে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে তাঁর চোখে পানি এসে। গেল। তিনি সেই পানি মুছলেন না। কী অদ্ভুত দৃশ্য! অতসীদি হাসছে। আর টপটপ করে। তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

আমাকে বিয়ে করতে চাইতি কেন? মিষ্টি খাওয়ার লোভে?

জানি না। হয়তো।

আগে কোনোদিন আমাকে বলিস নি কেন?

বললে কী হত?

অতসীদি জবাব দিলেন না। আবার হাসতে শুরু করলেন। তাঁর হাসির মাঝখানেই আমি বললাম, আমার কিন্তু এখনো তোমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা করে।

অতসীদির হাসি থেমে গেল। তিনি অবাক হয়ে তাকালেন। তাঁর চোখ দুটি কী যে অদ্ভুত। মনে হয় জল থৈথৈ করছে। যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবেন। কেঁদে ফেলবার মতো আমি কি কিছু বলেছি? অতসীদিকে এমন কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না।

অতসীদি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, সব সময় ঠাট্টা করা ভালো না বীরু। বলেই তিনি মাথায় আঁচল তুলে দিলেন। হিন্দু মেয়েরা মাথায় আঁচল দিলে কেমন যেন লাগে।

তুই চলে যা বীরু। বাবা এলে পাঠিয়ে দেব।

অতসীদি ছোট-ঘোট পা ফেলে চলে গেলেন। রান্নাঘর থেকে খুটট শব্দ হতে লাগল। এ ছাড়া চারপাশ কি নীরব! আমি চলে গেলাম না। বসে বসে ধীরেন কাকুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ধীরেন কাকু এলেন অনেকক্ষণ পরে। তাঁকে যতবারই দেখি, ততবারই মনে হয় আগের চেয়ে বুড়ো হয়ে গেছেন। ক্লান্ত জরাগ্রস্ত মানুষের মতো চলাফেরা। কথাবার্তায়ও প্ৰাণের স্পর্শ বলে কিছু নেই। যেন একটা রোবট যার ব্যাটারি ডাউন হয়ে যাওয়ায় কাজকর্ম শ্লথ হয়ে গেছে। তিনি আমাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তবু বললেন, কে?

আমি। আমি বীরু।

ও, আচ্ছা। ঠিক আছে। কার অসুখ?

বাবার।

ও, আচ্ছা আচ্ছা। চল যাই। চল।

ধীরেন কাকু ডাঙায় ভোলা মাছের মতো ঘন-ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি না থাকলে হয়তো অতসীদি বাবাকে পাখা দিয়ে হাওয়া করতেন। ঠাণ্ডা পানির গ্লাস এনে সামনে রাখতেন। ধীরেন কাকু রাস্তায় নেমেই নিচু গলায় বললেন, আমার নিজেরও শরীরটা খারাপ।

ডাক্তাররা যখন বলেন, শরীরটা খারাপ তখন গোটা চিকিৎসা-শাস্ত্রটার উপর কেমন যেন সন্দেহের ভাব এসে পড়ে।

বাসায় ফিরে দেখি অল কোয়ায়েট ইন দা ইস্টার্ন ফ্রন্ট। পূর্ব দিগন্ত নিশ্রুপ। বাবার বিখ্যাত কামান-দাগানো কাশি বন্ধ হয়েছে। তিনি বারান্দার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন—চোখে-মুখে প্রশান্ত ভাব। শেভ করেছেন। চুল আঁচড়ানো হয়েছে। চায়ের কাপে টোস্ট ড়ুবিয়ে মুখে দিচ্ছেন। সামনে আজকের খবরের কাগজ। যে-রকম মনযোগের সঙ্গে কাগজ দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে আজও সম্ভবত তাঁর কোনো চিঠি ছাপা হয়েছে। নাগরিক কোনো সমস্যা নিয়ে জ্বালাময়ী কোনো চিঠি ঝিকাতলা অঞ্চলে বখাটেদের যন্ত্রণা বিষয়ে কঠিন বক্তব্যের চিঠি।

ধীরেন কাকু বললেন, আবার কী হল?

ঐ কাশি। বড় বেড়েছিল। রাতে ঘুম হয় নি।

এখন কী অবস্থা?

এখন ভালোই। বয়স হয়েছে তো। বয়সের অসুখ।

ডায়াবেটিস আছে কি না দেখান। ইউরিনটা টেষ্ট করেন।

হয়েছে কাশি, ইউরিন টেস্ট করার কেন?

চেকআপের জন্য আর কী। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একটার সঙ্গে একটার যোগ আছে।

কাশিটার কী করবেন?

ক্রনিক অসুখে কবিরাজী খুব কাজ করে। পুরোনো ঘি বুকে মালিশ করে দেখতে পারেন। আমার কাছে এক শ বছরের পুরোনো ঘি আছে। পাঠিয়ে দেব।

ওষুধপত্র কিছু দেবেন না?

উঁহুঁ। ঘিটা মালিশ করে দেখেন। ওতেই আরাম হবে। উঠি তাহলে।

আরে না, উঠবেন কী? বসেন, চা খান। কথাটথা বলি। মেয়ের বিয়ের কিছু হল?

নাহ্। দেখি, পূজার সময় কোলকাতায় যাব। আমার এক শ্যালক আছে ধর্মতলায়, তাকে চিঠি দিয়েছি। খোঁজখবর করছে।

দেশে কিছু হচ্ছে না?

ধীরেন কাকু জবাব না-দিয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। আমি চলে গেলাম নিজের ঘরে। আপাতত কিছু করার নেই। এক শ বছরের পুরোনো ঘি আনবার জন্যে আরেকবার যেতে হবে। সেটা এখনই না আনলেও হবে। যে ঘি এক শ বছর অপেক্ষা করতে পেরেছে, সে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারবে।

টেবিলের উপর একটা চিঠি পাওয়া গেল। পারুল চিঠিটা এমনভাবে রেখেছে যেন চট করে চোখে না পড়ে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে চিঠি খুলে সে পড়েছে। খামের মুখ দ্বিতীয় বার বন্ধ করা। আমি বিরক্ত মুখে খাম খুললাম।

চিঠি পড়বার সঙ্গে-সঙ্গে বিরক্তি কেটে গেল। গোপনে আমার চিঠি পড়ার জন্যে পারুলকে ক্ষমা করে দিলাম। খকখক কেশে আমার ঘুম ভাঙানোর জন্য ক্ষমা করলাম বাবাকে। জোর করে আমাকে ধীরেন কাকুর বাসায় পাঠাবার যে অপরাধ মা করেছেন, তার জন্য মাকেও ক্ষমা করা গেল।

তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। খুবই জরুরি। তুমি সোমবার সকাল দশটা পাঁচ মিনিটে সায়েন্স ল্যাববারেটোরির পুলিশ বক্সের সামনে অপেক্ষা করবে। আবার ভুলে যে না। ইতি তোমার—এ।

তোমার—এ মানে তোমার এশা। এখা চিঠিপত্রে কখনো তার পুরো নাম লেখে না। যার কাছে চিঠি যাচ্ছে তার নামও থাকে না। এ ছাড়াও আরো কিছু ব্যাপার থাকে। যেমন, এই চিঠিতে সময় দিয়েছে দশটা পাঁচ মিনিট। দশটা লিখলেই হত, তা লিখবে না। গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য সঙ্গে পাঁচ মিনিট লাগিয়ে দিয়েছে। অপেক্ষা করবার জায়গাটাও চমৎকারপুলিশ বক্সের সামনে। পুলিশ বক্সের সামনে কেউ অপেক্ষা করে?

কেউ করে না। কিন্তু এশা করে। তার স্বভাবই হচ্ছে অদ্ভুত কিছু করা। একবার সে বলল, বুড়িগঙ্গায় নৌকায় কিছু ভাতের হোটল আছে, তুমি জান? খুবই নাকি ভালো রান্না। চল না, দুজন মিলে খেয়ে আসি।

যেতে হল। বুড়িগঙ্গায় নৌকার হোটেলে এশা মহানন্দে ভাত খেল। মোটা মোটা ভাত। টকটকে রঙের কী একটা মাছের ঝোল। ঝাল এমন দিয়েছে যে, চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু এশার ধারণা, এমন চমৎকার রান্না সে জীবনে খায় নি। প্রতি সপ্তাহে একবার এসে খেয়ে যাওয়া উচিত।

ভাগ্যিস দ্বিতীয় বার তার এই শখ হয় নি। নৌকার খাবার খেয়ে আমার নিজের পেট নেমে গেল। ডায়ারিয়ার মতো হল।

আজ এশার কী পরিকল্পনা, কে জানে। আজই সোমবার। ভাগ্যিস চিঠিটা খুলেছিলাম। চিঠি পড়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ একটু কম। একবার একটা চিঠি এক সপ্তাহ পর খুলেছিলাম। খামের উপরের লেখাটা পছন্দ ছিল না বলে ভোলা হয় নি।

দশটা বাজতে এখনো অনেক দেরি তবু আমার মনে হল, প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে দেওয়া দরকার। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে একটির পর একটি ঝামেলা লাগে। আজ বিশেষ দিন। ঝামেলা লাগবেই। দাড়ি কমাতে গিয়ে দেখব ব্লেডে ধার নেই। শার্ট গায়ে দেবার পর দেখা যাবে পেটের কাছের বোতাম নেই। সমস্ত বাড়ি খুঁজেও রুমাল পাওয়া যাবে না। কিংবা এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটবে মার কলিক পেন উঠবে এবং তাঁকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতেই মার কলিক পেন ওঠে। বাঁধা নিয়ম।

অনার্স সেকেন্ড পেপারের দিন এই অবস্থা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে চোখ-টোখ উল্টে মা এমন এক নাটক শুরু করলেন, পরীক্ষা মাথায় উঠল। বাবা চি-চি করে বলতে লাগলেন, হাঁ করে দেখছিস কি? তোর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যা।

আমি বিড়বিড় করে বললাম, আমার পরীক্ষা।

বাবা চোখ লাল করে বললেন, চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব হারামজাদা। মানুষ মারা যাচ্ছে, আর বলে কী!!

প্রয়োজনের সময় কিছুই পাওয়া যায় না। একটা বেবি ট্যাক্সি জোগাড় করতে লাগল আধঘন্টা। সেই বেবি ট্যাক্সিও এমন যে, দুমিনিট পরপর স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভারকে কার্বুরেটার খুলে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। মেডিক্যাল কলেজের গেটে এসে মার কলিক পেন কমে গেল। তিনি বোকার মত হাসতে লাগলেন।

আজও নিশ্চয়ই এরকম কিছু হবে। ঘর থেকে পা বাইরে ফেলবার সময় মা চিকন গলায় ডাকবেন, ওরে বীরু রে! গেলাম রে।

আর আমার স্ত্রী-ভক্ত বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠবেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নীকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্যে। তিনি নিজে কিন্তু যাবেন না। এর আগের বারও যান নি। হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধ তাঁর সহ্য হয় না। ডাক্তারদের দুর্ব্যবহার সহ্য হয় না। টেনশান সহ্য হয় না। কিছুই সহ্য হয় না।

ইদানীং হয়তো জীবনটাও অসহনীয় হয়েছে। সকাল এবং সন্ধ্যায় প্রবলবেগে খকখক করে তাই জানান দিচ্ছেন। আমি গুনগুন করে বললাম, আমরা কাশির শব্দে ঘুমিয়ে পড়ি, কাশির শব্দে জাগি। পারুল আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে কঠিন চোখে তাকাল। আগেকার আমলের মুনি-ঋষিরা হয়তো ঠিক এরকম চোখের দৃষ্টি দিয়ে মানুষকে ভস্ম করে দিতেন।

আশ্চর্য কাণ্ড, দাড়ি কাটার পর্ব বিনা ঝামেলায় পার হল! থুতনির কাছের ভয়াবহ ব্ৰনটাকে আহত না-করে চমৎকার একটা শেষ করে ফেললাম। ইস্ত্রি করা একটা চেক শার্ট পাওয়া গেল যার সব কটি বোম অক্ষত। তোষক উল্টে একটা রুমাল পাওয়া গেল। মোটামুটি পরিষ্কার। ভদ্রসমাজে বের করলে কেউ সরু চোখে তাকাবে না।

মার কলিক পেন এখনো শুরু হয় নি। তিনি একতলার বারান্দায় চালের গুড়ো নিয়ে বসেছেন। মনে হচ্ছে ভাপা পিঠা হবে। কদিন আগে বাবা ভাপা পিঠার কথা কী যেন বলেছিলেন। এটা হচ্ছে তারই ফলোআপ। আমরা ভাপা পিঠা, ভাপা পিঠা বলে লক্ষবার চেঁচালেও কিছু হবে না, কিন্তু বাবা মুখ দিয়ে একবার উচ্চারণ করলেই অন্য ব্যাপার। টনা-টুনীর গল্প আর কি। টুনা কহিল টুনী পিঠা তৈরি কর…।

আমি দোতলা থেকে খুব সাবধানে পা ফেলে নিচে নামলাম। সিঁড়িতে কে যেন দুধ ফেলে দিয়েছে, যে-কোনো মুহূর্তে রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম হবার সম্ভাবনা।

বাবা বারান্দায়। গলায় মাফলার। কোলে খবরের কাগজ। হাতে লাল নীল পেনসিল। ইদানীং তিনি খবর আন্ডার লাইন করা শুরু করেছেন। হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ এইসব লাল রঙে দাগাচ্ছেন, পলিটিক্যাল খবরগুলো নীল রঙে। আমার জন্যে বেশ সুবিধা হয়েছে। আমি দাগ দেয়া খবর বাদ দিয়ে কাগজ পড়ি। পলিটিক্স-ফলিটিক্স আমার ভালো লাগে না।

বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। এমনভাবে তাকালেন যেন আমাকে চিনতে পারছেন না, তবে চেনা-চেনা লাগছে। তিনি গলা পরিষ্কার করলেন। ঠিকমতো পরিষ্কার হল না। কফ-জমা ভারি স্বরে বললেন, আমার জিনিসটা নিয়েছি?

আপনার কোন জিনিস?

ইউরিন স্যাম্পল। সুগার আছে কি না দেখবে। বাথরুমের কে আছে। একটা পলিথিন পেপার দিয়ে মুড়ে নিয়ে যা।

আমি স্তম্ভিত। যাচ্ছি এশার কাছে পকেটে থাকবে পলিথিনে মোড়া ইউরিন। স্যাম্পল। পিতৃদেবের মূত্ৰ।

অন্য কাউকে দিয়ে পাঠান বাবা, আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি। খুবই জরুরি।

আমার কাজটা তাহলে তোমার কাছে তেমন জরুরি মনে হচ্ছে না? ভালো, ভালো, খুবই ভালো।

বাবার মুখ অন্ধকার। চশমা আরো খানিকটা স্কুলে পড়েছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে জ্যেষ্ঠ পুত্রের হৃদয়হীনতায় তিনি মর্মাহত। আমি ইতস্তত করে বললাম, বাবলুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিন বাবা, ও ছাদে ক্যারাম খেলছে।

বাবা খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাকে পাঠাব তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার অত্যন্ত জরুরি কাজটি সেরে আস।

আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।

তোমাকে নিতে হবে না।

আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন কেন?

তোমার সঙ্গে আমি এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও বলতে চাই না।

আমি খুব আহত হবার ভান করে বললাম, যাচ্ছি একটা চাকরির ব্যাপারে। পকেটে ইউরিন-ফিউরিন এই জন্যেই নিতে চাচ্ছিলাম না। না বুঝেই রাগ করেন।

লক্ষ করছি, বাবা অপ্রস্তুত বোধ করতে শুরু করেছেন। মুখ কেমন লম্বা ধরনের হয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে বোকাটে। তিনি নিচু গলায় বললেন, কিসের ইন্টারভ্য?

বেক্সিমকো বলে একটা কোম্পানি।

তোর তো এমএ-র রেজাল্টই এখনো হয় নি!

রেজাল্টের আশায় বসে থাকলে আরো তিন বছর লাগবে। এখনো ভাই হয় নি। ভাইভা হবে, তারপর টিচাররা দয়া করে খাতা দেখবেন, আবার এক মাস ঘুম। তারপর চলে যাবেন বিদেশ। আর তাঁর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাবে না। আমাদের রেজাল্টও বন্ধ।

বাবা তাঁর মুখ করুণ করে ফেললেন। বেচারাকে দেখে এখন মায়াই লাগছে। পুত্রের প্রতি সহানুভূতিতে তাঁর হৃদয় আর্দ্র।

ইউরিন স্যাম্পলটা কোথায় রেখেছেন বাবা? বাথরুমের তাকে?

থাক থাক। তোকে নিতে হবে না।

কোনো অসুবিধা নেই।

আহা, বললাম তো নিতে হবে না! যাচ্ছিস একটা শুভ কাজে।

আমি প্রায় জোর করেই ইউরিন স্যাম্পল নিয়ে নিলাম। অপরাধবোধে বাবা এখন জর্জরিত। সারাক্ষণ অস্বস্তিতে ভুগবেন। দুপুর বেলা ভালো করে খেতেও পারবেন না। অথচ আর একটু হলেই উল্টো ব্যাপার ঘটত। আমি যদি বোতলটা না নিয়ে আসতাম, তাহলে অপরাধবোধ আমাকে কাবু করে ফেলত। বারবার মনে হত, বুড়ো বাবার সামান্য একটা কাজ।

ঘর থেকে পা ফেলবার ঠিক আগমুহূর্তে মা বললেন, ধীরেন বাবুর কাছ থেকে পুরোনো ঘিটা দিয়ে যাস তো বাবা।

এক্ষুনি লাগবে?

হুঁ। বুক ঘড়ঘড় করছে। মালিশ করে দেব।

আমি তো তেমন কোনো ঘড়ঘড় শুনতে পেলাম না।

যা বাবা নিয়ে আয়, কতক্ষণ আর লাগবে?

মার চোখ এখন দেখাচ্ছে অবিকল গরুর মতো। ছলছল করছে, যেন এক্ষুনি পানি উপচে পড়বে। চোখের এই আবেগ অগ্রাহ্য করা অত্যন্ত কঠিন। তবে ইদানীং অনেক কঠিন কাজ বেশ সহজ ভঙ্গিতে করতে পারছি। আমি মার দিকে না তাকিয়ে বললাম, বিকেলে ফেরার পথে নিয়ে আসব। তুমি কোনো চিন্তা করবে না। বাবার কামান দাগা সন্ধ্যার আগে শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে না।

মা আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসছেন। তার মানে মার পেটে আরো কিছু কথা রয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরুবার পর তিনি তা উগরে দেবেন। কী বলবেন তাও আঁচ করতে পারছি। নাখালপাড়া যেতে বলবেন। আজ মাসের চব্বিশ। এই সময়ে আমাকে নাখালপাড়া যেতে হয়। আমার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি। তার কাছ থেকে কিছু। টাকাপয়সা আনতে হয়। পরের মাসের তিন-চার তারিখে আমাকেই সেটা ফেরত নিয়ে যেতে হয়। গত মাসে টাকা ফেরত দেওয়া হয় নি, আবার এ মাসে যাওয়া!

বাবা বীরু।

বলে ফেল।

অনুর কাছে আজ একবার যেতেই হবে। তিন শ টাকা নিয়ে আসবি। বাবা, মানিক।

পাগল হয়েছ মা! আগামী এক সপ্তাহ নাখালপাড়ার দিকে যেতে পারব না।

একটা পয়সা ঘরে নেই।

বাবাকে বল–বাবার দায়িত্ব। সংসার চালানোর দায়িত্ব তোমাকে মাথায় নিতে কে বলেছে?

মাকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। চমৎকার একটা দিন। ঝকঝকে রোদ। বাতাস মধুর এবং শীতল। এই বাতাস আজ সারাদিনেও হয়তো তেতে উঠবে না। তবে একে না পাওয়া গেলে ভিন্ন কথা। তখন সবই অসহ্য বোধ হবে।

এই বীরু, যাচ্ছিস কোথায়?

আমি কয়েক মিনিট চিন্তা করলাম, জবাব দেব কী দেব না। টুকু নৰ্দমার পাশে পেচ্ছাব করতে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সেখান থেকেই কথা বলছে। তার ছোটখাটো মুখে বিশাল এক গোঁফ। কুৎসিত দেখাচ্ছে।

ব্যাপার কী, সাউন্ড দিচ্ছি না কেন? যাচ্ছিস কোথায়?

ঠিক নেই কিছু।

তোর কাছে দশটা টাকা হবে নাকি?

না।

পাঁচটা হবে কি না দেখু। শালা পকেট একেবারে ইয়ে।

হবে না।

তাহলে একটা সিগারেট খাওয়া দোস্ত। রিকোয়েস্ট।

আমি দুটো সিগারেট কিনলাম। সিগারেট দিয়ে যদি সহজে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই আশাতেই কেনা। টুকু ছোঁ মেরে সিগারেট নিয়ে হাসিমুখে বলল,

একটা চায়ের পয়সা দিয়ে যা দোস্ত। তোর পায়ে ধরি।

টুকু সত্যি-সত্যি পা ধরতে এল। গুণ্ডামি করলেও টুকু জাতে ওঠে নি। কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। বিনা পয়সায় চা-সিগারেট খাওয়ায় না। নগদ পয়সা দিতে হয়।

দোস্ত, আমার রিকোয়েস্টটা রাখ। একটা পাত্তি ছেড়ে দে।

তুই অতসীদিকে কী বলেছিলি?

টুকু দপ করে নিভে গেল। মুখ আমশি করে বলল, মিসটেক হয়ে গেছে, বুঝতে পারি নি। আমি ভাবলাম নতুন কেউ। এমন লজ্জা পেয়েছি! আর বলিস না। রাতে ঘুম হয় নি।

অতসীদি তোকে যেতে বলেছে।

সত্যি?

হুঁ।

যাব কী করে, বল?

হেঁটে হেঁটে যাবি। আর কীভাবে যাবি? তোর জন্যে পালকি লাগবে?

অতসীদি আর কী বলল?

উনি আর কিছু বলেন নি–আমি বললাম।

কী বললি?

বললাম, তুই ঠিক করে রেখেছিলি বড় হয়ে অতসীদিকে বিয়ে করবি।

টুকু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে।

আর কী বললি?

জিজ্ঞেস করল, তুই আজকাল কী করি। আমি বললাম, ছিনতাইয়ের কাজ। করে। পার্ট-টাইম কাজ। ফুল-টাইম কাজ হচ্ছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা, পরিচিত। কাউকে পেলে ভিক্ষা চাওয়া।

ব্লাফ দিচ্ছিস, ঠিক না?

ব্লাফ দেব কেন, ব্লাফ দেবার আমার দরকারটা কি? হাত ছাড়, আমার জরুরি। কাজ আছে।

টুকু আমার হাত ছাড়ল না সঙ্গে-সঙ্গে আসতে থাকল। তার গা থেকে বিকট গন্ধ আসছে। আমি বললাম, আজকাল গাঁজা খাচ্ছিস নাকি? গন্ধে নাড়িভূড়ি উলটে আসছে।

টুকু বিড়বিড় করে বলল, কী যে বলিস দোস্ত। ভদ্রলোকের ছেলে না আমি। সস্তার সিগারেট, এই জন্যেই গায়ে গন্ধ হয়ে গেছে। আচ্ছা দোস্ত, সত্যি কথাটা ব, অতসীদি কি যেতে বলেছে?

হুঁ।

ঐদিনের ব্যাপারটায় মাইভ করেছে, তাই না?

হুঁ। এখন হাত ছাড়ু। তুই আমার হাত গান্ধা বানিয়ে ফেলেছিস। অতসীদির কাছে যাবার আগে গরম পানি দিয়ে গোসল করিস।

টুকু হাত ছেড়ে দিয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। চায়ের পয়সা চাইল না। তার মুখের সিগারেটও নিভে গেছে। সে তা বুঝতে পারছে না। নেভানো সিগারেট প্রাণপণে টানছে। আমি বললাম, কী যন্ত্রণা, এখনো সঙ্গে-সঙ্গে আসছিস কেন? টুকু ফিসফিস করে বলল, হাজার পাঁচেক টাকা জোগাড় করে এনে দিতে পারবি? এক মাসে ডাবল করে রিটার্ন দেব। আপ অন গড়।

করবি কী টাকা দিয়ে?

কাউকে বলিস না দোস্ত। একটা পিস্তল কিব। জার্মান জিনিস।

তোর দৌড় ব্লেড পর্যন্ত। পিস্তল দিয়ে করবি কী? হাত ছাড়্‌।

টুকু হাত ছেড়ে দিয়ে আবার রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ব্যাটার বহুমূত্র হয়েছে। কি না কে জানে। সব সময় দেখি রাস্তার পাশে প্যান্টের জিপার খুলে দাঁড়িয়ে আছে।

পুলিশ বক্সের সামনে এশা নেই।

মৈনাক পর্বতের সাইজের এক পুলিশ অফিসার পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন। সে চাচ্ছে, এ-শহরের সবাই তার দু পায়ের ফাঁক দিয়ে হামাগুড়ি দিক। সার্জেন্টের হাতে ওয়াকি টকি। কার সঙ্গে যেন খোশগল্প করছে। ঘন-ঘন বলছে, আরে ব্যাটা বুদ্ধ, সহজ কথা বুঝলি না? আমার জায়গায় মাসুম হলে পুলিশ সার্জেন্টকে দুম করে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসত। হয়তো বলত, এই যে ব্রাদার, আপনি এত মোটা কী করে হলেন, কাইন্ডলি আমাকে বলবেন? অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্টে প্রশ্নটা করছি। আমি ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনের ছাত্র। প্রশ্ন শুনে সার্জেন্টের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। জবাব দেবার আগেই মাসুম দ্বিতীয় প্রশ্ন করত। সেটি হত প্রথমটির চেয়েও ভয়াবহ।

পাবলিক লাইব্রেরিতে মাসুমের সঙ্গে গিয়েছি। মাসুমের কাজে। লাইব্রেরির সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কী একটা বই সে ঘন্টা খানিক ধরে খুঁজল। না পেয়ে মহা বিরক্ত। বিরক্তি কাটাবার জন্যেই বোধহয় আমাকে বলল, চল লাইব্রেরিয়ান ব্যাটাকে ভড়কে দিই। গেলাম তার সঙ্গে। লাইব্রেরিয়ান বেচারা বুড়ো মানুষ। কেমন ভালোমানুষ তালোমানুষ চেহারা। মাসুম তাঁর কাছে গিয়ে নিচু গলায় বলল, স্যার, মানুষ খুন করার সহজ পদ্ধতি, এই জাতীয় কোনো বইপত্র আছে? আমাদের বিশেষ দরকার।

লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। মাসুম গলার স্বর আরো খানিকটা নামিয়ে বলল, ছুরি, বোমা দিয়ে মানুষ মেরে তোতা স্যার কোনো থ্রিল নেই। আমরা চাচ্ছি নতুন ধরনের কিছু। হাইলি সাইন্টিফিক ধরনের। মডার্ন।

মাসুমের মতো কিছু একটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমি পুলিশ অফিসারটিকে চমকে দিয়ে বললাম, আচ্ছা ভাই, এখানে কি একটি মেয়েকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন?

পুলিশ সার্জেন্ট সত্যি-সত্যি চমকাল। অবাক হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, আপনাকে। লম্বা একটা মেয়ে কোঁকড়ানো চুল। সাধারণত তার কাঁধে চটের একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকে। পুলিশ-বক্সের সামনে তার অপেক্ষা করার কথা।

এত জায়গা থাকতে পুলিশ-বক্সের সামনে কেন?

পুলিশদের আশেপাশে ঝামেলা কম থাকে, এই জন্যেই বোধহয়। আপনি তাহলে দেখেন নি?

লোকটি হেসে ফেলল। বেশ অন্তরঙ্গ হাসি। হাসতে-হাসতেই বলল, চা খাবেন?

এবার আমার চমকাবার পালা। এ আমাকে চা খেতে বলছে কেন? যেভাবে বলছে, তাতে মনে হচ্ছে না ঠাট্টা করছে।

আমি আপনাকে চিনি, আপনার নাম বীরু। শহীদুল্লাহ হলে আপনি রুম নাম্বার দুই হাজার তিরিশে মাঝে-মাঝে ঘুমাতেন।

এখনো ঘুমাই।

পাস করেন নি?

পরীক্ষাই হয় নি, পাস করব কীভাবে? ইউনিভার্সিটি থেকে বেরুতে আগে চার বছর লাগত, এখন দশ-বার বছর লাগে। আপনি কি শহীদুল্লাহ হলে ছিলেন নাকি?

জ্বি। দুই হাজার তেইশ। অনার্স কমপ্লিট করে ঢুকে গেলাম পুলিশে। সারদায় দুবছর ট্রেনিং নিয়ে এখন সার্জেন্ট।

ভালো করেছেন।

একটু দাঁড়ান, চা নিয়ে আসছি। বাসা থেকে ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে অপেক্ষা করুন, এর মধ্যে হয়তো আপনার রোগা লম্বা, চটের ব্যাগ কাঁধের মেয়ে চলে আসবে।

বাসায় তৈরি চা, কিন্তু দোকানের চায়ের চেয়েও বিস্বাদ। তার উপর ঠাণ্ডা মেরে আছে। এরকম একজন জবরদস্ত পুলিশ সার্জেন্টের চোখের সামনে চা ঢেলে রাস্তায় ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না। আমি বিরক্ত মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, যদি এশার দেখা পাওয়া যায়।

বীর সাহেব।

জ্বি, বলুন।

আপনারা এখনো এম.এ. পাশ করতে পারেন নি, ভাবাই যায় না। আমি চাকরিতে জয়েন করে ভালোই করেছি, কী বলেন?

খুব ভালো করেছেন। মিলিটারিতে ঢুকতে পারলে আরো ভালো করতেন।

ঠাট্টা করছেন?

হ্যাঁ ভাই, করছি। পুলিশের সঙ্গে ঠাট্টা করে দেখলাম কেমন লাগে।

সে হেসে ফেলল। তাকে এখন আর আগের মতো ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। তার দাঁড়িয়ে থাকার যে-ভঙ্গিটি এতক্ষণ অসহ্য মনে হচ্ছিল, এখন সেটাকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পুলিশদের এভাবেই দাঁড়াতে হয়।

বীরু সাহেব।

জ্বি, বলুন।

খুব টেনশনের চাকরি। টেনশনে শরীর ফুলে এরকম হয়েছে।

বলেন কী। আমার তো ধারণা ছিল উল্টোটা হয়।

একেক জনের বেলায় একেক রকম হয়। টেনশনে হরমোন ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়, তার থেকে এই হয়। কেউ শুকিয়ে যায়, কেউ আমার মতো হয়।

বাহ্ ইন্টারেস্টিং তো!

আমি যদি কিছু নাও খাই, ফুলতে থাকব। এই যে এত বেলা হয়েছে, আমি কিন্তু চার কাপ চা ছাড়া কিছু খাই নি। ভাত খেতে খেতে দুটা বেজে যাবে।

খিদে লাগে না?

লাগে না আবার! এখন মনে হচ্ছে একটা বেবি ট্যাক্সি খেয়ে ফেলি। হা হা হা।

আমি হাসিতে যোগ দিলাম না। এশার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এরকম করার মানে কি? কতক্ষণ আমি অপেক্ষা করব? শহীদুল্লাহ হলের এই প্রাক্তন ছাত্র মনে হচ্ছে অতিরিক্ত রকমের মাইডিয়ার। তার তেলতেলে ধরনের ব্যবহার এখন আর ভালো লাগছে না। ভাড়া ঠিক না-করেই আমি একটা খালি রিকশায় উঠে বললাম, চলি, কেমন?

আবার আসবেন। সকালবেলায় আমি এইখানেই থাকি। আর যদি আমাকে না। দেখেন, তাহলে জিজ্ঞেস করবেন—সার্জেন্ট শামসুদ্দিন কোথায়? ওরা ওয়াকি টকিতে ইনফরমেশন দিয়ে দেবে।

আমি হেসে ফেললাম। সার্জেন্ট শামসুদ্দিন এমনভাবে কথা বলছে, যে শিগগিরই আমি তার বিরহে ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসব পুলিশ-বক্সে। ওয়াকি টকির চল্লিশ মাইল ব্যাসার্ধে বারবার বলা হবে, সার্জেন্ট শামসুদ্দিন, আপনার বন্ধু আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন, চলে আসুন। হ্যালো, হ্যালো, সার্জেন্ট শামসুদ্দিন…।

বীর সাহেব।

জ্বি বলুন।

আবার দেখা হবে, কেমন?

তা তো হবেই। মিছিল নিয়ে যখন আসব তখন দেখা হবে। পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেব।

সার্জেন্ট শামসুদ্দিনের মুখ কেমন হয়ে গেল। সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বিড়বিড় করে বলল, এসব কী বলছেন ভাই!

সত্যি কথাই বলছি। দি টুথ। আমরা আপনাদের পেটাব, আপনারা আমাদের। আমরা ঢিল ছুঁড়বো। আপনারা আমাদের উপর ট্রাক তুলে দেবেন। টিয়ার গ্যাস, গুলি এইসব চলবে।

আমাদের এসব বলছেন কেন? আমাদের দোষটা কোথায়?

ঠাট্টা করছি রে ভাই, ঠাট্টা। পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে রসিকতা।

ও তাই বলুন।

সার্জেন্ট শামসুদ্দিন হেসে ফেলল। তার দাঁতগুলো চমৎকার। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন হয়। নতুন ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন কি দেয়া যায় না? একজন পুলিশ সার্জেন্ট টুথব্রাশ হাতে নিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে লেখা—শান্তির এই প্রহরীর হাসিটিও প্রশান্তির। কারণ ইনি ব্যবহার করেন পিয়া টুথপেস্ট। পিয়া টুথপেস্ট এখন নতুন মোড়কে পাওয়া যাচ্ছে।

বাতাস আর মধুর মনে হচ্ছে না। রোদ ঝাঁঝাঁ করছে। আকাশ ধূসর বর্ণ। কড়া রোদে আকাশ ধূসর হয়ে যায়। তাকালেই বমি-বমি ভাব হয়। এ সঙ্গে থাকলে এই ধূসর আকাশই হয়তো অন্যরকম লাগত। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম—এশার সঙ্গে অনেক দিন পরপর আমার দেখা হয়।

রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার আমাকে দেখছে। সার্জেন্টের সঙ্গে আমার খাতির দেখে সম্ভবত আক্কেল গুড়ুম হয়েছে। ভাড়া নিয়ে কোনো ঝামেলা করবে না। যা দেব তাই সোনা মুখ করে নেবে। অনেক দিন ধরেই পকেটে একটা তাপ্পি মারা পাঁচ টাকার নোট পড়ে আছে। চালানো যাচ্ছে না! এই রিকশাওয়ালার উপর একটা অ্যাটেস্পট নেয়া যেতে পারে।

স্যার, কই যাইবেন?

তাই তো, কোথায় যাওয়া যায়। রিকশায় উঠলেই আমার একটা সমস্যা হয়। হঠাৎ মনে হয় আমার যেন কোথাও যাবার জায়গা নেই। বাসে এই সমস্যা নেই। বাসের একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে। রিকশার নেই। রিকশায় উঠে গন্তব্যের কথা বলে দিতে হয়।

স্যার, কোন দিকে যাইবেন?

আরে বাবা, তুমি চালাও না! এত অস্থির হয়ে গেলে কেন?

রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে কুৎসিত চোখে আমাকে দেখল, যেন আমরা একে অন্যের শত্ৰু। তারপর প্যাডেল চাপতে লাগল নিতান্ত অনিচ্ছায়। এক শত্ৰু অন্য শত্রুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা মন্দ নয়। আমি সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগলাম, কোথায় যাওয়া যায়। যাত্রাবাড়ির দিকে গেলে কেমন হয়? যাত্রাবাড়ি হচ্ছে এশাদের বাড়ি। এশার বাবা অন্য এক জনের জমি জবরদখল করে দুতিনটা ঘর তুলে দিব্যি আছেন। হাফ বিল্ডিং। পাকা দেয়াল। উপরে টিন।

যাত্রাবাড়িতে গেলে এশাকে অবশ্যি পাওয়া যাবে না। এশা এমন মেয়ে, যাকে কোথাও পাওয়া যায় না। ওদের নিজের বাড়িতে তো নয়ই। আমি কখনো গিয়ে পাই। নি।

রাত দশটায় একবার ওদের বাড়িতে গিয়ে শুনি, এশা এখনো ফেরে নি। কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারে না। একটি মেয়ে যে এত রাত পর্যন্ত বাইরে, তা নিয়েও কাউকে চিন্তিত মনে হল না। এশার বাবা বিকট একটা হাই তুলে বললেন, তোমার খুব দরকার থাকলে অপেক্ষা কর, চলে আসবে।

কোথায় গেছে সে?

বলে যায় নি তো!

এত রাতে একা-একা ফিরবে?

তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, কেউ দিয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

বিন্দুমাত্র উদ্বেগ আমি লোকটার মধ্যে দেখলাম না, যেন এশা রাতে বাড়ি না-ফিরলেও তাঁর ঘুমের তেমন অসুবিধা হবে না।

কি, তুমি চলে যাবে, না থাকবে?

বসি কিছুক্ষণ।

তুমি কি ওর সঙ্গে পড়?

জ্বি।

ভালো খুব ভালো।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ-বাড়িতে অপেক্ষা করাও যন্ত্ৰণা। বসার ঘরটা খুপরির মতো ছোট। ভাদ্র মাসের অসহ্য গরম। ঘরের আধখানা জুড়ে এক চৌকি। সেই চৌকিতে আশ্রয় নিয়েছেন লোমশ শরীরের এক ভদ্রলোক। ঘুমিয়ে পড়েছেন কি না। বোঝা যাচ্ছে না। নাকের ডাক শোনা যাচ্ছে। আবার এদিকে দেখি হাত পাখাও চলছে। ভদ্রলোকের পাশে এশার সবচে ছোট বোনটি। তার মাথার নিচে বালিশ নেই। কাঁথা খুঁজে বালিশের মতো করে দেওয়া। মেয়েটি গরমে ঘুমুতে পারছে না। মাঝে-মাঝে উঠে বসছে।

রাত এগারটায় এশার বাবা একটা ভেজা গামছা গায়ে জড়িয়ে বসার ঘরে ঢুকে বললেন, তুমি চলে যাও, আজ বোধহয় ও আসবে না।

আসবে না তো যাবে কোথায়?

মীরপুরে ওর খালার বাড়ি। মনে হচ্ছে, ওখানেই থেকে যাবে। মাঝে-মাঝে রাত বেশি হলে থেকে যায়।

খবর দেয় না?

কীভাবে দেবে, ও বাড়িতে কি টেলিফোন আছে?

আপনার চিন্তা হচ্ছে না?

ভদ্রলোক এমনভাবে তাকালেন যেন আমার বেয়াদবিতে স্তম্ভিত হয়েছেন। তিনি কী বলবেন মনে-মনে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খুব রেগে গেলে মানুষ মজার-মজার সব কথা বলে। অবশ্যি ভদ্রলোক মজার কিছু বললেন না। বড় রকমের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাড়ি চলে যাও, নয়ত বাস পাবে না। লাস্ট বাস সাড়ে এগারটায়।

বাস সত্যি-সত্যি পেলাম না। তিন মাইলের মতো হেঁটে একটা রিকশা জোগাড় করতে হল। রিকশায় ওঠামাত্র রিকশাওয়ালা যে কথা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছেকলেজ গার্ল লাগবে কি না। তার সন্ধানে প্রচুর কলেজ গার্ল আছে। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। অভাবে পড়ে এই লাইনে এসেছে।

আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। রিকশাওয়ালা আমার জন্যে কলেজ গার্ল জোগাড় করে ফেলেছে এই জন্যে নয়। এরা একটা চক্রের সঙ্গে আছে। এদের হাতে যেমন কলেজ গার্ল আছে, তেমনি গুণ্ডাপাণ্ডাও আছে। পেটে ছুরি বসিয়ে আমাকে নর্দমায় ফেলে দেওয়া এদের কাছে ছেলেখেলা। আমি রিকশাওয়ালাকে খুশি রাখবার জন্যেই সরাসরি না বললাম না। বললাম, খরচপাতি কীরকম লাগবে?

রেইট হইল গিয়া আফনের ঘন্টা হিসাবে। পঞ্চাশ আছে, যাইট আছে, আবার ধরেন গিয়া এক শ আছে। যেমুন জিনিস তেমুন দাম।

আরে সর্বনাশ, আমার কাছে আছেই মাত্র দশ টাকা। আরেক দিন আসা যাবে।

বাস স্ট্যান্ডের বগলে দোকানে আমার নাম কইয়েন, তাইলে খবর পাইবেন।

কি নাম তোমার?

বদিউল।

ঠিক আছে বদিউল, তোমাকে খুঁজে বের করব। দুএকদিনের মধ্যেই আসব। তবে খরচপাতি অনেক বেশি।

সেইটা আমি দেখমু। খরচপাতির জইন্যে চিন্তা করবেন না।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যাত্রাবাড়ির দিকে আর আসছি না।

বদিউল নামের রিকশাওয়ালা আমাকে চিনে ফেলতে পারে। চিনে ফেললে হয়তো চেপে ধরবে। ঘন্টা হিসেবে এক জন কলেজ গার্ল জুটিয়ে দেবে। সেই কলেজ গার্ল নিয়ে আমি করব কী? যাব কোথায়? ঢাকা শহর গিজগিজ করছে মানুষে। একটা গর্ত খুড়লে সেই গর্ত দেখার জন্যে হাজার-হাজার মানুষ জমে যায়। একটা মাইক ফিট করে হ্যালো ওয়ান টু থ্রি বললে চার-পাঁচ হাজার লোক দাঁড়িয়ে যায়। এখানে নিরিবিলি কোথায় যে কলেজ গার্লের সঙ্গে দুএকটা মিষ্টি কথা বলব? এশার সঙ্গে তিন বছর ধরে আমার পরিচয়, এখনো একটু নিরিবিলি পাই নি যে, হাত ধরে গাঢ়স্বরে দুএকটা কথা বলব কিংবা ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে যাব। ভালবাসার মেয়েকে চুমু খেতে কেমন লাগে কে জানে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress