নবম পরিচ্ছেদ – অনুসরণের ফল
এইরূপে রাজারাম ও প্রতাপ ওরফে রায়মল্ল গোয়েন্দা উভয়ের বিস্তর কথাবার্ত্তা চলিল। রাজারাম কোথায় কি ভাবে ডাকাতি করিয়াছে, তাহা সমস্তই তাঁহার নিকটে বর্ণন করিল। প্রতাপ কথায় কথায় তাহার নিকট হইতে অনেক সন্ধান জানিয়া লইলেন। রাজারাম প্রতাপের সহিত খুব বিশ্বাসী বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করিল। এরূপভাবে দস্যুদলের মধ্যে রায়মল্ল গোয়েন্দা নিঃসহায় অবস্থায় আসিতে সাহস করিবেন, ইহা কি রাজারামের কল্পনাতে আসা সম্ভব।
ক্রমে সন্ধ্যা অতীত হইল। রজনীর গাঢ়তা হইল। দস্যুগণের আহারাদি প্রস্তুত হইলে সকলেই আহার করিল। রায়মল্ল সাহেবও তাহাতে যোগ দিলেন। একে একে সকলে শিবির মধ্যে শয়ন করিল, রাজারাম ও রায়মল্ল সেই সঙ্গে শয়ন করিয়া নিদ্রিত হইলেন।
প্রকৃতপক্ষে প্রতাপবেশী রায়মল্ল সাহেব নিদ্রিত হন্ নাই। তিনি দেখিয়াছিলেন, রাজারাম চুপি চুপি একজনকে কি আজ্ঞা করিল। সেই আজ্ঞামতে সে আহারীয় দ্রব্য-সামগ্রী লইয়া একদিকে চলিয়া গেল। তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন, সে আহারীয় দ্রব্য তারার জন্য প্রেরিত হইল। তারাকে কোথায় বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছে, তাহা তিনি যদিও জানিতেন না, কিন্তু এ পর্যন্ত জানা থাকাতে সে স্থান- নির্ণয়ে আর বিশেষ কোন কষ্ট হইবে না ভাবিয়া তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন। তাঁহার নাসিকাধ্বনি শুনিতে শুনিতে রাজারাম নিদ্রিত হইল।
রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় যে দুইজন লোক শিবিরের অনতিদূরে পাহারা দিতেছিল, তাহাদের মধ্যে একজন আসিয়া রাজারাম ও অন্যান্য দস্যুকে উঠাইল।
রাজারাম জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে?”
প্রহরী দস্যু বলিল, “জগৎসিংহ নামে একটা লোক এখনই দেখা করতে চায়। তাকে আমরা আর একটু হলেই গুলি করে ফেলেছিলেম; কিন্তু সে আমাদের সাঙ্কেতিক বাঁশী বাজিয়ে হঠাৎ রক্ষা পেয়ে গেছে।”
রাজারাম। তাকে নিয়ে এস—সে আমার জানা লোক। তার সঙ্গে একটা কাজ চলছে।
ক্ষণপরে প্রহরী জগৎসিংহকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল।
জগৎসিংহ আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল “সে বালিকা হাতছাড়া হয় নি ত?”
রাজারাম। না।
জগৎ। তোমার পিছু পিছু একজন লোক তাড়া করেছিল, তা’ জান?
রাজারাম। জানি।
জগৎ। সে লোক কে, তা’ জান?
রাজারাম। কে?
জগৎ। রায়মল্ল গোয়েন্দা।
রাজারাম বিস্মিত হইয়া বলিল, “বল কি! তা’ ভালই হয়েছে, এবার তাকে আমি ফাঁকি দিয়েছি।”
জগৎ। কিছু বলা যায় না। আমি একবার সেই মেয়েটাকে দেখতে চাই। নইলে আমার মনের সন্দেহ ঘুচবে না।
রাজারাম। কেন? তোমার কি বিশ্বাস হয় না?
জগৎ। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়, চল দেখি।
এই সময়ে রাজারাম একবার প্রতাপের জন্য চারিদিকে চাহিল;কিন্তু তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। জগৎসিংহকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি প্রতাপকে জান?‘
জগৎ। কে প্রতাপ?
রাজারাম। কেন, যাকে তুমি প্রথমে এই কাজে হাত দিতে বলেছিলে?
জগৎ। কৈ, আমি ত আর কাউকে কখন বলি নি।
রাজারাম। কাউকে বল নি? সে কি রকম! সে গেল কোথায়?
রাজারাম ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া চারিদিকে প্রতাপের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। জগৎসিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “কি, ব্যপার কি বল?”
রাজারাম। একটা লোক এসে সব ঠিকঠাক বলে, তোমার সঙ্গে তার পরিচয় আছে—তুমি তাকে ঠকিয়েছ—টাকা দাও নি, তাও বললে, রঘুনাথের কথা বলে, আমাদের সঙ্কেত, ইঙ্গিত, ইসারা, ধরন-ধারণ সব জানে, দেখলেম; সে লোকটা গেল কোথায়?
আবার রাজারাম নিতান্ত অস্থির হইয়া চারিদিকে ছুটোছুটি করিয়া প্রতাপের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। অবশেষে কোন স্থানে তাহাকে দেখিতে না পাইয়া নিরাশ হইয়া কহিল, “পালিয়েছে— লোকটা নিশ্চয়ই প্রবঞ্চক! তোমার নাম ধ’রে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল, তোমাকে আসতে দেখেই বেমালুম স’রে পড়েছে।”
জগৎসিংহ মাথায় হাত দিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িল। ভগ্নকণ্ঠে কহিল, “এ সব কথা যদি ঠিক হয়, তা’হ’লে সে বালিকাও নাই। আমি দশ হাজার টাকা বাজী রাখতে পারি; সে যদি পালিয়ে থাকে, তবে সে বালিকাও সঙ্গে সঙ্গে হাত-ছাড়া হয়েছে।”
রাজারাম। ওঃ! আমি এতক্ষণে সব বুঝতে পেরেছি। এ-ও সেই রায়মল্ল গোয়েন্দার ছল! উঃ! লোকটা কি ভয়ানক জাঁহাবাজ! কি ভয়ানক সাহসী! অকুতোভয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলে। একসঙ্গে আহারাদি হ’ল, এক সঙ্গে নিদ্রা গেল! উঃ, আচ্ছা ঠকানটা ঠকিয়েছে!
রাজারাম প্রতাপের সঙ্গে তাহার সে রাত্রির কথা সংক্ষেপে সমস্ত বলিলে তারাকে যে স্থানে রাখা হইয়াছিল, জগৎসিংহ সেই স্থান দেখিতে চাহিল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দস্যুগণ অনতিদূরে একটা পুরাতন অট্টালিকার সম্মুখবর্তী হইল। রাজারাম প্রথমে সেই ভগ্ন অট্টালিকার মধ্যে একটি কক্ষে প্রবেশ করিয়াই বলিল, “নাই—নাই—নিয়ে পালিয়েছে, সর্ব্বনাশ করেছে!”
ক্রোধে, ক্ষোভে রাজারাম দন্তে দত্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিল, “আমি ভূত বিশ্বাস করি না; কিন্তু এ রায়মল্ল গোয়েন্দা মানুষ না ভূত? দেখছি যে, এ লোকটা ভূতের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান্! এর কাজ সব ছায়াবাজীর মত! বলিহারি সাহস!!”
উত্তমরূপে সন্দেহ বিমোচনের জন্য জগৎসিংহ আলো ধরিয়া সেই কক্ষের অন্তরালে ও নিভৃত স্থান সকল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল। একজন দস্যু একখানি টুক্রা কাগজ কুড়াইয়া পাইল। রাজারাম তাহা লইয়া জগৎসিংহকে পাঠ করিয়া শুনাইল, —
“অভাগিনী তারার ভাল-মন্দের ভার আমি গ্রহণ করিয়াছি। এখন আমি তাহার রক্ষক। যে তাহার প্রতি কোন অত্যাচার করিবে, সে আমার পরম শত্রু। শমনের ন্যায় আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ারূপে ভ্রমণ করিব। সাবধান! কেউ তারার অনিষ্ট চেষ্টা করিয়া নিজের মৃত্যুপথ পরিষ্কার করিও না।
সরকারী গোয়েন্দা—
শ্রীরায়মল্ল সাহেব।”
এই পত্র শ্রবণ করিয়া জগৎসিংহের মুখ ম্লান হইয়া গেল। বক্ষঃস্থল কম্পিত হইল—ঘন ঘন নিঃশ্বাস বহিতে লাগিল। সে ভাবিতে লাগিল, তারার বিষয় রায়মল্ল গোয়েন্দা কতদূর জানে? তারা কে, কার কন্যা, কে তার বিষয় ফাঁকি দিয়া ভোগ করিতেছে, এ সব কথা কি সে জানে? সে কি তারার বিষয় বাস্তবিকই পুনরুদ্ধার করিয়া দিবার ভার লইয়াছে? যদি তা হয়, তা’ হ’লে আমার ঐশ্বর্য্য সম্ভোগের দিন বুঝি বা চিরস্থায়ী হ’ল না।
যদিও আদালতের মোকদ্দমায় বার বার তাহার জয় হইয়াছে, যদিও বর্ত্তমান তারা, প্রকৃত তারা বলিয়া প্রমাণীকৃত হয় নাই, তথাপি রায়মল্ল গোয়েন্দা তারার ভাল-মন্দের ভার গ্রহণ করিয়াছে শুনিয়া জগৎসিংহের অন্তরাত্মা স্তম্ভিত হইল। জগৎসিংহ মোকদ্দমা শেষ হইবার পর হইতেই যে কোন প্রকারে হউক, তারাকে হস্তগত করিবার চেষ্টা করিতেছিল। যতদিন অজয় সিংহ পীড়িত হন নাই, ততদিন সে অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছু করিতে পারে নাই।
এতদিনে জগৎসিংহ বুঝিতে পারিল, বার বার রেহাই হইয়াছে, কিন্তু এবার উদ্ধারপ্রাপ্ত হওয়া আর বড় সহজ কাজ নয়। রায়মল্ল গোয়েন্দা এ পর্য্যন্ত কোন কার্য্যে বিফল হন নাই। তারার বিষয় পুনরুদ্ধারে যে তিনি সমার্থকমনোরথ হইবেন তাতেই বা বিচিত্রতা কি? রায়মল্ল সাহেব যদি রীতিমত উদ্যোগ করেন, তাহা হইলে তিনি যেমন করিয়া হউক, প্রমাণাদি সংগ্রহ করিয়া তবে আদালতে উপস্থিত হইবেন। জগৎসিংহ এতদিন পরে প্রমাদ গণিল। সে উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “চল, আমরা এখনই রায়মল্লের পশ্চাদ্ধাবন করব। সে এতক্ষণে কতদূর গিয়াছে। যে রায়মল্ল গোয়েন্দাকে খুন ক’রে তারাকে আমার হাতে সমর্পণ করতে পারবে তাকে আমি দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবো। আমরা এত লোক এক সঙ্গে মিলে একটা লোককে আর খুন করতে পারব না?”
দস্যুগণ সকলেই লাফাইয়া উঠিল। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সকলেই ঘোড়ায় চড়িয়া তীরবেগে রাজেশ্বরী উপত্যকা হইতে বাহির হইয়া পড়িল।