রঘুর গুমটি
রঘুর গুমটি,,,, খড়্গপুর_ঝাড়গ্রাম রুটের একটি অখ্যাতবাস স্টপেজ!খড়্গপুর শিল্পতালুকের মধ্যে6নংজাতীয় সড়ক(বম্বেরোড) এ অবস্থিত॥এখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের গ্রামে আমার
স্কুল!প্রায় 15 বছর একটানা যাতায়াত! কোনো
দিনই এই স্টপেজের কোন বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়েনি!সেদিন ছুটি হয়েগিয়েছিল তাড়াতাড়ি! স্থানীয় কটি ছাত্রীর সাথে হঁাটতে হঁাটতে
বাস ধরতে আসছি!মেয়েরা জিজ্ঞেস করলো,,,”দিদিমনি রঘুর গুমটিতে বাস ধরবেন?”
আমিওদের প্রশ্ন করলাম,,”হঁ্যারে এই রঘুর গুমটি নাম কেন হয়েছে জানিস?”মেয়েরা উত্তর দিল
”জানি নাতো!”
বাস স্ট্যান্ডে এসে চারপাশে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম!ভারী সুন্দর জায়গাটা॥শিল্পতালুকের যান্ত্রিকতার মাঝে একটুকরো সবুজ স্বপ্ন!রাস্তার অপর পারে একটা সিমেন্ট বঁাধানো চাতাল!তাকে ঘিরে বেশ কয়েকটা কলকে,টগর ,জবা,রঙ্গন,কাঠ টগর গাছ!গাছগুলো ফুলে ফূলে ছেয়ে আছে!ঐ চাতাল টাতে একটা পানগুমটি দেখে ছিলাম কবছর আগে!ঐগুমটির পেছনে একটা মাটির বাড়িছিল॥ছবির মত সুন্দর ফুল গাছে ছাওয়া বাড়িটা ভেঙে গেছে কয়েক বছর আগে!পোড়ো বাড়িটার চারপাশের সেই সাজানো বাগান আজ জঙ্গলের চেহারা নিয়েছে॥এই বসন্তে কাঠটগরগাছ গুলো থরে থরে ফুলে ছেয়ে আছে!ঝরা ফুলে তলাটা ঢেকে গেছে॥খুব ভাল লাগছেদেখতে॥বসেবসে বাসের প্রতিক্ষা
করছি॥বেশ কয়েকজন আদিবাসী বৃদ্ধাএসে বসলো গাছ তলাতে!তাদের একজন আমাকে প্রশ্ন করলো,,,’কুথা যাবি মা?”উত্তর দিলাম,,,”খড়্গপুর,মাসী! তোমরা কোথায় যাবে?”আমরা ঝাড়গ্রাম যাব॥ আস্তে আস্তে আলাপচারিতাবাড়তে থাকলো॥কথায় কথায় জানতে চাইলাম,,,’তোমাদের বাড়ি এই গ্রামে?”সম্মতির মাথা নাড়লো বৃদ্ধা॥এবার জিজ্ঞাসা করেই বসলাম,,,”আচ্ছা মাসী এই রঘুর গুমটি নাম টাই বা কেন হয়েছে? আর রঘুই বা কে?”বুড়ী বলে,,’সে এক ব্যথার কাহিনী!আজ থেকে বছর দশেক আগেএখানেএক তেলেগুছেলেও মাহাতো মেয়ের ভালবাসার বাড়ি ছিল! তেলেঙ্গনারপ্রত্যন্তগ্রাম থেকে রঘুএই শিল্পশহরে এসেছিলো পেটের ধান্দায়॥দিন মজুরের কা জকরতো ছেলেটা॥খুব হাসিখুশি মিশুকে ছিল ছেলেটা!কারখানার বাবুরা তাকে খুব ভালবাসতো॥আর সে বঁাধা পড়েছিলো এই গ্রামের মাহাতো মেয়ে রেনুর প্রেমে॥এই অসবর্নপ্রেম মাহাতো সমাজ মেনেনেয়নি!ভালবাসার অমোঘটানে ও কারখানার বাবুদের সহায়তায় ঘর বঁাধে দুজনে॥এই বাস রাস্তার পাশে একটা পান গুমটি দেয় রঘু!চা,পান,সিগারেট ছাড়াও টিফিনওপাওয়া যেত এখানে॥ দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায় বেশ ভালোই চলতো দোকানটা॥দোকানের পেছনেই ছিল ফুল গাছে ছাওয়ামাটির ছোট্ট বাড়িটা॥কিন্তুএই সুখমেয়েটারকপালে বেশিদিন সইলো না॥শিল্পনগরীর বিষ,,,,মদ আর জুয়া!এর কবলে পড়লো রঘু!খুব ঝগড়া হতো দুজনে!রেনু রাগ করে ছেড়ে চলে যাব বলতো!কারখানার বাবুরা আবার মিটমাট করে দিতো!এই ভাবেই সুখে দুঃখে কেটে যাচ্ছিলো বছর গুলো॥কিন্তু নেশার বিষ রঘুকে আষ্টেপৃষ্ঠেজড়িয়ে ধরেছিলো॥রেনুর ভালোবাসা, সেবা,যত্ন আর তাকে বঁেধে রাখতে পারলো না!সিরোসিস অফ লিভারে রঘু মারা গেল॥সেই শুভার্থী দাদারা যারা ওদের বিয়ে দিয়েছিলো তারাই রঘুরশেষকৃত্য করেছিলো॥রেনুকে তার বাড়ির লোক আবার গ্রামে ফিরিয়ে নিতে চেয়ে ছিলো!অভিমানী রেনু আর ফিরে যায়নি॥এই রঘুর গুমটি আঁকড়েপড়ে ছিলো!রঘুর বিরহ সে একেবারে সহ্য করতে পারেনি! ছয় মাসের মধ্যেই সামান্য জ্বরে রেনু মারা যায়॥রেনুর আত্মীয় রা গুমটিটা গ্রামে নিয়েচলে যায়॥ পড়ে থাকে রেনুরঘুর ভালোবাসার বাড়ি ও রঘুরগুমটি নামটা॥আস্তেআস্তেকালেরঅমোঘ নিয়মেজঙ্গল,ঝোপঝাড়ঐ বাড়ির চারপাশগ্রাস করে॥মাটির পরিত্যক্ত কুটির মাটিতেই মিশে যায়!কিন্তু রেনুর ভালবাসার গাছগুলো সতেজই থাকে॥প্রতি বসন্তে ফুলের ডালি সাজিয়ে রঘুর গুমটিকে সাজিয়ে রাখে॥
বৃদ্ধার গল্পশুনতে শুনতেকখন যেন এই কাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম॥চমক ভাঙলো বাসের হেল্পারের,,,রঘুরগমটি,রঘুর গুমটি’ চিৎকারে॥বাস্তবে ফিরে এলাম!ভালোবাসার কি অমোঘ টান॥এখনও কোনো বসন্ত সন্ধ্যায়টগর,বকুল,মাধবীলতার গন্ধ বিধুর আধো অন্ধকারে রেনু রঘু যেন তাদের পৃথিবীর ভালোবাসাকে দেখতে নেমে আসে এখানে॥তাদের ভালবাসার ছোট্ট জগতের দেখাশোনার শেষে আবার ফিরে যায় তাদের ঊধ্বর্লোকের স্বগ্॥
সকালে ফুল গাছ গুলোর তলায়ঝরে পড়া ফুলের রাশি তাদের মাটির স্বর্গকে অভিনন্দিত করে॥