Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

চারি বৎসর অতীত হইয়াছে। এই চারি বৎসরে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহা এই কাহিনীর অন্তর্গত না হইলেও সংক্ষেপে বৰ্ণিত হইল। ভাস্কো-ডা-গামা কালিকট ত্যাগ করিবার দুই বৎসর পরে আবার পোর্তুগীজ জাহাজ ভারতবর্ষে আসিল। এবার পোর্তুগীজদের অধিনায়ক আলভারেজ কেবলার নামক একজন পাদ্রী এবং তাঁহার অধীনে নয়খনি জাহাজ। পাদ্রী আলভারেজ কালিকট বন্দরে প্রবেশ করিয়াই জাহাজ হইতে নগরের উপর গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। ফলে বহু নাগরিকের প্রাণনাশ হইল, অনেকে আহত হইল এবং কয়েকটি অট্টালিকা চূৰ্ণ হইয়া গেল। এইরূপে রাজা-প্রজার মনে ভীতি ও কর্তব্যজ্ঞান সঞ্চারিত করিয়া পোর্তুগীজরা আবার ভারতভূমিতে পদার্পণ করিল। রাজা সামরী আগস্তুকদিগকে সম্মান দেখাইলেন ও তাহাদের বাসের জন্য নগরের বাহিরে ভূমিদান করিয়া কুঠি-নিমাণের অনুমতি দিলেন। কিন্তু পোর্তুগীজদিগের এই অহেতুক জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতায় কালিকটের জনসাধারণের মন তাহাদের বিরুদ্ধে ঘূণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ হইয়া উঠিল।

তারপর কলহ বাধিতে বিলম্ব হইল না। দাম্ভিক বিদেশীদের প্রতি যাহাঁদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ জন্মিয়ছিল, তাহারা ঝগড়া বাধাইয়া রক্তপাত করিতে লাগিল। পোর্তুগীজরাও জবাব দিল। ক্ৰমে ভিতরে বাহিরে আগুন জুলিয়া উঠিল। একদিন নাগরিকগণ পোর্তুগীজদের কুঠিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া সত্তর জন্য ফিরিঙ্গীকে হত্যা করিল। অবশিষ্ট পলাইয়া জাহাজে উঠিল এবং হাজ হইতে গোলা মারিয়া নগরের এক অংশে আগুন লাগাইয়া দিল। তারপর সেই যে হারা কালিকট ছাড়িয়া গেল, দুই বৎসরের মধ্যে আর ফিরিয়া আসিল না।

কালিকটের রাজা-প্রজা নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল—আপদ দূর হইয়াছে, আর ফিরিবে না।

শেষোক্ত ঘটনার বৎসরেক পরে মির্জা দাউদ স্ত্রী-কন্যা লইয়া তাঁহার জন্মভূমি মরক্কো দেশে গেলেন। সেখানে কিছু দিন অবস্থানের পর বৃদ্ধ পিতাকে সঙ্গে লইয়া মক্কাশরীফ দর্শন করিলেন। তারপর তীর্থ-দৰ্শন শেষ করিয়া সকলে মিলিয়া কালিকটে প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন।

কথা ছিল, মক্কাশরীফ হইতে মির্জা দাউদ কালিকটে আসিবেন, তাঁহার পিতা মরক্কো দেশে ফিরিয়া যাইবেন। কিন্তু পিতা স্থবির ও জরাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন—অধিক দিন পরমায়ু নাই। পুনরায় মরক্কো যাইবার সুযোগ হয়তো শীঘ্ৰ হইবে না, ততদিন পিতা বাঁচবেন কি না, এই সকল বিবেচনা করিয়া মির্জা দাউদ তাঁহাকে ছাড়িলেন না, নিজের সঙ্গে কালিকাটে লইয়া চলিলেন। বৃদ্ধও ঈদের চাঁদের মতো সুন্দর ক্ষুদ্র নাতিনীটিকে দেখিয়া ভুলিয়াছিলেন——তিনিও বিশেষ আপত্তি করিলেন না।

মক্কাশরীফ দর্শনের সময় কালিকাটের কয়েকজন সম্রান্ত ব্যক্তির সহিত মির্জা দাউদের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তিনি তাঁহাদের বলিলেন, ‘আপনারাও কালিকটে ফিরিতেছেন—আমার জাহাজেই চলুন।’ তাঁহারা আনন্দিত হইয়া সপরিবারে মির্জা দাউদের জাহাজে আশ্রয় লইলেন।

মক্কা হইতে কালিকট তিন মাসের পথ। জাহাজ যথাসময়ে আরব উপকূল ছাড়িয়া লোহিত সাগর পার হইল। ক্রমে পারস্য উপসাগর উত্তীর্ণ হইয়া ভারত সমুদ্রে আসিয়া পড়িল।

মহাসাগরের বুকের উপর বায়ু-বর্তুলিত পালের ভরে মির্জা দাউদের তরণী দক্ষিণাভিমুখে চলিয়াছে। চারিদিকে অতল জল দুলিতেছে, ফুলিতেছে—লক্ষকোটিখণ্ডে বিচূৰ্ণিত দর্পণের মতো রবিকরে প্রতিফলিত হইতেছে। পূর্ণ দিগন্তরেখা অখণ্ডভাবে তরুণীকে চারিদিকে বেষ্টন করিয়া আছে। কেবল বহুদূরে পূর্বচক্রবালে মেঘের মতো কচ্ছভূমির তাঁটবনানী ঈষন্মাত্র দেখা যাইতেছে।

জাহাজে যে অভিজ্ঞ আড়কাঠি আছে, সে বলিয়াছে যে বায়ুর দিক এবং গতি পরিবর্তিত না হইলে অষ্টহমধ্যে কালিকটে পৌঁছানো যাইবে। আশু যাত্রাশেষ কল্পনা করিয়া আরোহীরা সকলেই হৃষ্ট হইয়া উঠিয়াছেন।

সেদিন শুক্রবার, সূর্য ক্রমে মধ্যগগন অতিক্রম করিয়া পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িল। জাহাজের বিস্তৃত ছাদের উপর মির্জা দাউদ, তাঁহার পিতা ও আর আর পুরুষগণ দ্বিপ্রাহরিক নমাজ প্রায় শেষ করিয়াছেন। জাহাদের নিয়ামক সম্মুখে স্থিরদৃষ্টি করিয়া হালের নিকট নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া আছে। চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু তরণীর বেগবিদীর্ণ জলরাশি ফেন-হাস্যে কলকল করিতেছে।

এমন সময় আকাশ-বাতাস প্ৰকম্পিত করিয়া মেঘগর্জনের ন্যায় ভীষণ শব্দে সকলে চমকিত হইয়া দেখিলেন, পশ্চাৎ হইতে পাঁচখানা ফিরিঙ্গী জাহাজ সমস্ত পাল তুলিয়া দিয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে অগণ্য দাঁড় বাহিয়া যেন বহুপদবিশিষ্ট অতিকায় জলজন্তুর মতো ছুটিয়া আসিতেছে। অতর্কিতে এত নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে যে, জাহাজের মানুষগুলাকে পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। এই আকস্মিক দৃশ্য দেখিয়া সকলেই বুদ্ধি-ভ্ৰষ্টের মতো সেই দিকে নিষ্পলকভাবে তাকাইয়া রহিলেন।

বিস্মিত হইবার মতো দৃশ্য বটে! দুই দণ্ড পূর্বেও চতুর্দিকে কোথাও একটা ভেলা পর্যন্ত ছিল না। সহসা সমুদ্রের কোন অতল গুহা হইতে এই পাঁচটা ভীষণ দৈত্য বাহির হইয়া আসিল? মির্জা দাউদের মন বলিল, আজ আর রক্ষা নাই। কামান দাগিয়া ইহারা নিজ আগমনবাতর্গ ঘোষণা করিয়াছে—আজ তাহারা দয়ামায়া দেখাইবে না। মুরের রক্তে হিংসা চরিতার্থ করিবার আজ তাঁহাদের সুযোগ মিলিয়াছে।

এরূপ ঘটনা প্রতীচ্যখণ্ডের সমুদ্রবক্ষে পূর্বে কখনও ঘটে নাই। স্মরণাতীত কাল হইতে এইপথে শত শত তরণী অবাধে যাতায়াত করিয়াছে। চীন হইতে কাষ্পীয় হ্রদ পর্যন্ত কেহ। কখনও হিংস্ত্ৰিক বা বোম্বেটের নাম পর্যন্ত শুনে নাই। স্থলপথ অপেক্ষা জলপথ অধিক নিরাপদ ছিল বলিয়াই জলবাণিজ্য এত প্রসার লাভ করিয়াছিল। কিন্তু আজ যুগযুগান্তরের বাহিতপণ্য অব্যাহত পথে স্বার্থান্ধ ফিরিঙ্গী তাহার অগ্নি-অস্ত্ৰ লইয়া পাথরুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইল।

কিন্তু যুদ্ধদান করা মির্জা দাউদের পক্ষে অসম্ভব। তাঁহার জাহাজ তীর্থযাত্রীর জাহাজ, তাহাতে বারুদ-গোলা কিছুই নাই। আছে কেবল কতকগুলি অসহায় যুদ্ধানভিজ্ঞ ধর্মপরায়ণ তীর্থযাত্রী এবং তদপেক্ষাও অসহায় কতকগুলি নারী ও শিশু। এরূপ অবস্থায় পাঁচখানা রণপোতের সঙ্গে যুদ্ধ করা বাতুলতা ভিন্ন আর কিছুই নহে। এক উপায় পলায়ন; কিন্তু মির্জা দাউদের জাহাজ কেবল পালের ভরে চলে—বিপক্ষের পাল দাঁড় দুই আছে; এ ক্ষেত্রে পলায়নও সাধ্যাতীত।

মির্জা দাউদ ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে চিন্তা করিলেন। একবার আকাশের দিকে দৃষ্টি করিলেন। আকাশ নির্মেঘ–বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর। রাত্ৰি হইতে বিলম্ব আছে। তিনি নাবিককে ডাকিয়া সমস্ত পাল তুলিয়া প্ৰাণপণে জাহাজ ছুটাইতে আজ্ঞা দিলেন।

কিন্তু এ আজ্ঞা পালিত হইতে না হইতে জলদস্যুদিগের পাঁচখানা জাহাজ হইতে একসঙ্গে কামান ডাকিল। একটা গোলা বড় পালের ভিতর ছিদ্র করিয়া জাহাজের পরপারে গিয়া সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিল, অন্যগুলা জাহাজের চারিদিকে জলের উপর পড়িল। কোনটাই কিন্তু জাহাজকে গুরুতর জখম করিতে পারিল না।

জাহাজের পুরুষযাত্রীদের মুখ শুকাইল। নিম্ন হইতে ভীত শিশু ও নারীগণের আর্তস্বর ও ক্ৰন্দন উঠিল। দন্তে দন্ত চাপিয়া মির্জা দাউদ নাবিকদের হুকুম দিলেন, “যতক্ষণ পারি, জাহাজ চালাও, ফিরিঙ্গ দস্যুর হাতে ধরা দিব না।’

এমন সময় মির্জা দাউদের চারি বৎসরের কন্যা হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপরে উঠিয়া আসিয়া পিতার জানু জড়াইয়া ধরিল। বলিল, “বাবা, মা তোমাকে ডাকছেন।”—বলিয়া পিতার মুখের দিকে চোখ তুলিয়াই উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, “বাবা, আমার বড় ভয় করছে।”

মির্জা দাউদ কন্যাকে দুই হাতে তুলিয়া বুকে চাপিয়া ধরিলেন। তাহার কানে কানে বলিলেন, হরুণা, কাঁদিস না। তুই মুরের কন্যা—তোর কিসের ভয়? আজ আমরা সকলে একসঙ্গে বেহেস্তে যাইব।”

কন্যাকে পিতার ক্ৰোড়ে দিয়া মির্জা দাউদ নীচে নামিয়া গেলেন। সম্মুখেই আকুলনায়না স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ হইল।

নিজ কাটি হইতে ক্ষুদ্র মাণিক্যখচিত ছুরিকা পত্নীর হস্তে দিয়া সংযত কণ্ঠে কহিলেন, “শালেহা বোধ হয় আজ অন্তিমকাল উপস্থিত হইয়াছে। বোম্বেটে জাহাজ পিছু লইয়াছে। যদি উহারা এ জাহাজে পদার্পণ করে, এ ছুরি নিজের উপর ব্যবহার করিও। তার পূর্বে কিছু করিও না। আর অন্যান্য স্ত্রীলোকদের আশ্বাস দিও, অকারণে ভয় না পায়। চলিলাম।”—এই বলিয়া মুহুর্তকালের জন্য পত্নীর মস্তক বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া মির্জা দাউদ উপরে ফিরিয়া গেলেন।

উপরে উঠিয়া দেখিলেন, এই অল্পকাল মধ্যে দসুজাহাজগুলি অর্ধচন্দ্ৰাকারে তাঁহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। এত নিকটে আসিয়া পডিয়াছে যে, তাহদের কণ্ঠস্বর পর্যন্ত স্পষ্ট শুনা যাইতেছে। মির্জা দাউদ দেখিলেন, প্রত্যেক জাহাজ হইতে কামানের মুখ তাঁহাদের প্রতি লক্ষ্য করিয়া আছে। এত নিকট হইতে এবার আর লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হইবে না।

মির্জা দাউদের পিতা আসিয়া বলিলেন, “দাউদ, আর উপায় নাই। ধরা না দিলে জাহাজ ডুবি হইয়া মরিতে হইবে।”

মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘ধরা দিলেও নিশ্চয় মরিতে হইবে, তাহার অপেক্ষা ডুবিয়া মরাই শ্ৰেয়ঃ।’

পিতা বলিলেন, “সে কথা ঠিক। কিন্তু সঙ্গে শিশু ও স্ত্রীলোক রহিয়াছে। তাহদের রক্ষা করিবার চেষ্টা করা উচিত নহে কি?’

মির্জা দাউদ কিয়াৎকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “কিন্তু দসু্যরা শিশু ও নারীদের দয়া করিবে: কি? বরঞ্চ—’

পিতা কহিলেন, “ফিরিঙ্গী অর্থলোভী, অর্থের বিনিময়ে তাহদের ছাড়িয়া দিতে পারে।”

অন্যান্য পুরুষগণও বৃদ্ধের বাক্য সমর্থন করিলেন। মির্জা দাউদ তখন কহিলেন, “ভালো, চেষ্টা করিয়া দেখা যাক।”

ঠিক এই সময় একখানা জাহাজ হইতে আবার কামান দাগিল। এবার গোলার আঘাতে প্রকাণ্ড মাস্তুল পালসুদ্ধ মড়মড় শব্দে ভাঙিয়া পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে স্তুপীকৃত পালের কাপড়ে আগুন লাগিয়া গেল।

রমণীরা এতক্ষণ পর্যন্ত আবরু রক্ষা করিয়া জাহাজের খোলের মধ্যেই ছিল, কিন্তু এবার আর লজ্জার বাধা মানিল না। সন্তানবতীরা সন্তান কোলে লইয়া, যাহাদের সন্তান নাই—তাহারা যে যেমনভাবে ছিল, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে উপরে উঠিয়া আসিল। সকলেই ভয়বিহুলা। কেহ উৰ্ধৰ্বমুখী নতজানু হইয়া ঈশ্বরের নিকট প্ৰাণের আকুল আবেদন জানাইতে লাগিল, কেহ। শিশু-সন্তানকে দুই হাতে উচ্চে তুলিয়া ধরিয়া জলদসু্যাদিগকে দেখাইয়া তাহাদের কৃপা আকর্ষণের চেষ্টা করিতে লাগিল।

এদিকে পালের আগুন ক্ৰমে বাড়িয়া উঠিয়া জাহাজময় ব্যাপ্ত হইবার উপক্ৰম করিল। পুরুষগণ তখন সমুদ্র হইতে জল তুলিয়া অগ্নিনিবাপণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বহু কষ্টে অনেক জল ঢালিবার পর অগ্নি নির্বাপিত হইল। তখনকার মতো জাহাজ রক্ষা পাইল।

একখানা ফিরিঙ্গী জাহাজ মির্জা দাউদের জাহাজের একেবারে পাশে আসিয়া পড়িয়াছিল। মধ্যে মাত্র একশত গজের ব্যবধান। কামান ঘুরাইয়া তাহারা আবার গোলা ছুড়িবার উদ্যোগ করিতেছিল। তখন মির্জা দাউদ উচ্চকণ্ঠে তাহাদিগকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘গোলা ছুড়িও না—আমরা আত্মসমৰ্পণ করিতেছি।”

কামান ছাড়িয়া তাহারা উল্লাসধ্বনি করিয়া উঠিল। তাহাদের মধ্যে একজন—বোধ হয়, সেই প্রধান নাবিক-কহিল, “তোমাদের জাহাজে যত অস্ত্ৰ আছে, জলে ফেলিয়া দাও—নহিলে কামান ছুঁড়িব।”

মির্জা দাউদ কহিলেন, “আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্ৰ নাই। ইহা তীর্থযাত্রীর জাহাজ। যাহা কিছু ধনরত্ন সঙ্গে আছে, দিতেছি—আমাদের ছাড়িয়া দাও।”

এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় আক্রমণকারী জাহাজের ভিতর হইতে একজন পুরুষ উপরে উঠিয়া আসিল। অতি মহার্ঘ বেশভূষায় সজ্জিত বিশালদেহ এক পুরুষ। তাহাকে দেখিয়া মির্জা দাউদের বুকের রক্ত সহসা যেন স্তব্ধ হইয়া গেল। চিনিলেন—ভাস্কো-ডা-গামা। তাহার মুখের উপর কৃষ্ণ কাল-সৰ্পের মতো হিংসা যেন কুণ্ডলিত হইয়া আছে। মির্জা দাউদকে দেখিয়া ভাস্কো-ডা-গামা হাসিল। মাথার কঙ্কপত্রযুক্ত টুপি খুলিয়া তাহা আভুমি সঞ্চারিত করিয়া বলিল, ‘মির্জা দাউদ, আজ সুপ্ৰভাত! স্মরণ আছে, বলিয়াছিলাম আবার দেখা হইবে?’

মির্জা দাউদের মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না। ভাস্কো-ডা-গামা তখন পূর্বোক্তি প্রধান নাবিকের দিকে ফিরিয়া কঠোর কণ্ঠে কহিল, “কাপ্তেন, কামান নীরব কেন? আমার হুকুম কি ভুলিয়া গিয়াছ?’

ভীত কাপ্তেন বলিল, “প্ৰভু, উহারা ধনরত্ন দিয়া পরিত্রাণের আর্জি করিতেছে।”

দুই জাহাজ ক্রমে আরও নিকটবতী হইতেছিল। ডা-গামা আবার মির্জা দাউদের দিকে ফিরিয়া শ্লেষতীক্ষ্ণ কণ্ঠে কহিল, “মূর, ধনরত্ন দিয়া প্ৰাণভিক্ষা চাও?’

মির্জা দাউদ কহিলেন, “নিজের প্রাণভিক্ষা চাহি না। আমাদের সর্বস্ব লইয়া বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের ছাড়িয়া দাও।”

ডা-গামা শত্রুর লাঞ্ছনার রস অল্প অল্প করিয়া পান করিতে লাগিল, কহিল, “বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের ছাড়িয়া দিব? কিন্তু তাহাতে আমাদের লাভ? বরঞ্চ তোমরা যুবতী নারীদের আমাদের নিকট পঠাইয়া দিয়া পুরুষগণ প্ৰাণ বাঁচাইতে পার। আমাদের জাহাজে স্ত্রীলোকের কিছু প্রয়োজন হইয়াছে। আমার নিজের জন্য নয়–খালাসীদের জন্য। আমার নারীতে রুচি নাই।”

ক্ৰোধে অপমানে মির্জা দাউদের মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল। বুঝিলেন, ডা-গামা তাঁহাকে লইয়া খেলা করিতেছে। অতি কষ্টে আত্মদমন করিয়া কহিলেন, “ডা-গামা, তোমার প্রস্তাবের উত্তর দিতে ঘৃণা হইতেছে। যদি অভিরুচি হয়, আমাদের সহিত যাহা মূল্যবান সামগ্ৰী ও স্বর্ণ রৌপ্য আছে, তাহা লইয়া আমাদের নিষ্কৃতি দাও। নতুবা কিছুই পাইবে না।’

ডা-গামা ভ্রূকুটি করিয়া কহিল, “কিছুই পাইব না, তার অর্থ? মির্জা দাউদ কহিলেন, “তার অর্থ—জোর করিলে আমাদের মারিয়া ফেলিতে পরিবে, কিন্তু কিছু লাভ করিতে পরিবে না। যদি আমার জাহাজে চড়াও করিবার চেষ্টা কর, তক্তা খুলিয়া জাহাজ ডুবাইয়া দিব।”

মির্জা দাউদের কথা শুনিয়া ডা-গামার ভ্রূকুটি গভীরতর হইল, সে নতমুখে চিন্তা করিতে লাগিল।

এদিকে জাহাজের মাস্তুল ভাঙিয়া যাওয়ায় মির্জা দাউদ পঙ্কে নিবদ্ধ হস্তীর মতো চলচ্ছক্তিহীন। ফিরিঙ্গীর পাঁচখানা জাহাজ ধীরে ধীরে তিন দিক হইতে ঘিরিয়া আরও নিকটবর্তী হইতে লাগিল।

মির্জা দাউদ অধীর হইয়া কহিলেন, “ডা-গামা, যাহা করিবে, শীঘ্ৰ করি। আমাদের সহিত বারশত তোলা সোনা আছে—আরও অন্যান্য মহাৰ্য বস্তু আছে; যদি পাইতে ইচ্ছা কর, শীঘ্ৰ বল। অধিক বিলম্ব করিলে সব হারাইবে।”

ডা-গামা বলিল, “রমণীদের দিবে না?”

মির্জা দাউদ গর্জিয়া উঠিলেন, “না, দিব না। আমরা স্ত্রী-কন্যার ব্যবসা করি না।”

ডা-গামা কহিল, “মূর, এখনও তোর স্পধর্ণ কমিল না!—ভালো, অর্থই লাইব। তোমার জাহাজে যাহা কিছু আছে, ভেলায় করিয়া আমার জাহাজে পাঠাও।”

‘যাহা কিছু আছে পাইলে ছাড়িয়া দিবে।’

‘দিব।’

“তোমাকে বিশ্বাস কি?”

‘আমি মিথ্যা কথা বলি না।’

“মিথ্যাচারি, শপথ করিয়াছিলে কখনও হিন্দে পদার্পণ করিবে না, তাহার কি হইল?’

ডা-গামা হাসিয়া বলিল, “এখনও হিন্দে পদার্পণ করি নাই।”

মির্জা দাউদ তখন অন্যান্য সকলের সহিত পরামর্শ করিলেন। সকলেই কহিলেন, উহাদের কবলে যখন পড়িয়াছি, তখন উহাদের কথায় বিশ্বাস করা ভিন্ন উপায় নাই। অগত্যা মির্জা দাউদ সম্মত হইলেন।

তখন এক ভেলা প্রস্তুত করিয়া তাহারই উপর যাহা কিছু ছিল, এমন কি, নারীগণের অলংকার পর্যন্ত তুলিয়া ডা-গামার জাহাজে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল।

ডা-গামা জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমাদের আর কিছু নাই?’

‘না।’

‘আবার জিজ্ঞাসা করিতেছি—নারীদের দিবে না?’

অসহ্য ক্ৰোধে মির্জা দাউদের বাকুরুদ্ধ হইয়া গেল। শুধু তাঁহার চক্ষুদ্বয় অগ্নিশিখার মতো জ্বলিতে লাগিল।

ভাস্কো-ডা-গামা কালকূটের মতো হাসিল। বলিল, “ভালো, তোমাদের যেরূপ অভিরুচি।” তারপর কাপ্তেনের দিকে ফিরিয়া বলিল, “কাপ্তেন, গোলা মারিয়া উহাদের জাহাজে আগুন লাগাইয়া দাও। আজ মুসলমান কুকুরগুলাকে পুড়াইয়া মারিব।”

মির্জা দাউদ চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “শঠ। বিশ্বাসঘাতক! মিথ্যাবাদী শয়তান!”

ডা-গামা কহিল, “মির্জা দাউদ, তোর প্রাণরক্ষা করিতে পারে, এত অর্থ পৃথিবীতে নাই। তবে তুই তোর স্ত্রীর বিনিময়ে এখনও প্রাণরক্ষা করিতে পারিস। তোর স্ত্রীকে আমি বাদী করিয়া রাখিব!’

মির্জা দাউদ উন্মত্তের মতো গর্জন করিতে লাগিলেন, “শয়তান! শয়তান।”

জাহাজে ভীষণ কোলাহল উঠিল। নর-নারী সকলে পাগলের মতো চারিদিকে ছাটাছুটি করিতে লাগিল। সকলেই যেন এই অভিশপ্ত জাহাজ হইতে পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। চতুর্দিক হইতে আর্তরব উঠিল, “রক্ষা করা! দয়া করা! প্ৰাণ বাঁচাও!”

এই আকুল প্রার্থনার জবাব আসিল। সহসা শিলাবৃষ্টির মতো জাহাজের উপর বন্দুকের গুলি পড়িতে লাগিল। কেহ হত, কেহ আহত হইয়া পড়িতে লাগিল। মৃত্যুর বিভীষিকা যেন ভীষণতর রূপ ধরিয়া দেখা দিল।

মির্জা দাউদের পিতা ক্ষুদ্র হারুণাকে বক্ষে লইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে পুত্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। স্খলিত কণ্ঠে একবার শুধু ডাকিলেন, ‘দাউদ!’

দুৰ্দম আবেগে মির্জা দাউদ একসঙ্গে পিতা ও কন্যাকে জড়াইয়া ধরিলেন, এমন সময় লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়া শালেহা আসিয়া স্বামীর হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইলেন।

মির্জা দাউদ বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে একবার তিন জনের মুখের দিকে চাহিলেন। তারপর অবরুদ্ধ স্বরে কহিলেন, ‘পিতা, ঈশ্বর কি নাই?’

সহসা হারুণা ক্ষুদ্র একটি কাতরোক্তি করিয়া এলাইয়া পড়িল। দ্রুত কন্যাকে নিজের ক্রোড়ে লইয়া মির্জা দাউদ দেখিলেন, তাহার দেহে প্ৰাণ নাই। নিষ্ঠুর গুলি তাহার বক্ষে প্রবেশ করিয়াছে।

তারপর দ্রুত অনুক্ৰমে স্ত্রী ও পিতা গুলির আঘাতে মাটিতে পড়িয়া গিয়া মরণ-যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতে লাগিলেন। ভাস্কো-ডা-গামা তখন স্বয়ং ধূমায়িত বন্দুক হাতে করিয়া পিশাচের মতো উচ্চ হাসি হাসিতেছে।

সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তরেখা স্পর্শ করিয়াছে। আকাশ এবং সমুদ্র তপ্ত রক্তের মতো রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। সাগরবক্ষে সূৰ্য্যস্ত হইতেছে।

এইবার পাঁচখানা জাহাজ হইতে এককালে কামান ডাকিল। গোলার সংঘাতে শীতার্ত বৃদ্ধের মতো মির্জা দাউদের জাহাজখানা কাঁপিয়া উঠিল। পালের কামড়ে দপ করিয়া আবার আগুন জ্বলিয়া উঠিল। ধীরে ধীরে টলিতে টলিতে জাহাজ নিমজ্জিত হইতে লাগিল। আবার কামান গৰ্জিল। এবার জাহাজের সম্মুখ দিকটা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। কলকল শব্দে জল ঢুকিতে লাগিল।

তারপর নিমেষের মধ্যে সমস্ত শেষ হইয়া গেল। আরোহীদের মিলিত কণ্ঠ হইতে এক মহা হাহাকার-ধ্বনি উঠিল। জ্বলন্ত জাহাজ অকস্মাৎ জীবিতবৎ সোজা দাঁড়াইয়া উঠিল; তারপর সবেগে সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিল। যাত্রীদের ঊর্ধ্বোত্থিত কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হইয়া গেল। মুহূর্তপূর্বে যেখানে জাহাজ ছিল, সেখানে আবর্তিত তরঙ্গশীর্ষ জলরাশি ক্রীড়া করিতে লাগিল।

ফিরিঙ্গী জাহাজগুলি চিত্ৰাপিতবৎ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। প্রায়ান্ধকারে তাহাদিগকে যেন অনা জগতের কোনও ভৌতিক তরণীর মতো দেখাইতে লাগিল।

ক্ষণকাল পরে সান্ধ্য নীরবতা বিদীর্ণ করিয়া ভাস্কো-ডা-গামার জাহাজ হইতে দামামা ও তুর্য বাজিয়া উঠিল।

সূর্য তখন সমুদ্রপারে আস্তমিত হইয়া অন্য কোন নূতন গগনে উদিত হইয়াছে।

১৯৩০

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress