Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যোগাযোগ || Mallik Kumar Saha

যোগাযোগ || Mallik Kumar Saha

যোগাযোগ

এই সংসারে দুই প্রকৃতির লোক বিরাজমান— এক হইল, যাহারা না বুঝিয়াই অন্যকে পরামর্শ দিতে চেষ্টা করে; আর একদল হইল, যাহারা অনেক কিছু জানিয়া বুঝিয়াও সৎপাত্রের অন্বেষণে স্থির হইয়া থাকে। দুই বিপরীতমুখী বিষয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য হইল সঠিক যোগাযোগ স্থাপন করা। নিজে না বুঝিয়া অপরকে বুঝাইতে গেলে যেমন বিপদ, আবার অন্যদিকে সুপরিপক্ক ভাবে বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করিয়া সৎপাত্রে দান না করিতে পারার সমস্যা। এই সমস্যাকেই আমরা ‘যোগাযোগ বিভ্রাট’ নামে অভিহিত করি।

এই যোগাযোগ বিভ্রাটের ফলে বন্ধু বন্ধুতে, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে এমনকি আত্মীয়-আত্মীয়তে যে মহাভারত সৃষ্টি হইয়া পরে তাহা প্রধান বিচারপতিরও বোধগম্যের বাহিরে চলিয়া যায়। উল্লিখিত সমস্ত কলহের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীতে যেসব বাদানুবাদ হইয়া থাকে গবেষকদের মতে তাহাই সর্বোপরী আসন লাভ করে বলিয়া মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকেন। কারণ এই কলহে কোন তৃতীয় পক্ষ সম্মুখে আসিলে তাহার সুনামটুকু তৎক্ষণাৎ গোধূলির ন্যায় উড়িয়া যায়।

মাত্র সাতদিন আগের কথা। এক ছুটির দিনে ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকায় কিছু অস্পষ্ট শব্দ কানে আসিলে সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া জানিলাম ইহার উৎপত্তি স্থান কোথায়। ঘরের বাহিরে আসিতেই জোড়াল ধ্বনি প্রখরতর হইয়া অনায়াসে কানে ঢুকিল। মাত্র দুইঘর দূরে প্রতিবেশী বৈদ্যবাড়ীর ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীতে কোন এক ব্যাপার লইয়া বাক্ দ্বন্দ্ব বাঁধিয়া গিয়াছে। বিষয়বস্তু বুঝিবার দরুণ সামান্য খোলা দরজার ফাক দিয়া দৃষ্টি রাখিবামাত্র বৈদ্য দাদার বৌরাণী ঝপাট করিয়া কপাট বন্ধ করায় সেই শব্দ আসিয়া আমার হৃদয়ে ঠেকিল। ভাগ্যিস হৃদয়ের দরজায় শক্ত অর্গল ছিল। তাহা না হইলে স্বামী-স্ত্রীর কহল দেখিবার সাধ চিরতরে ঘুচিয়া যাইত। ডাক্তার কবিরাজ ডাকিবার সময়টুকু পর্যন্ত পাওয়া যাইত না। সেই হইতে ভাল মানুষী দেখাইয়া যোগাযোগ করিবার সাধ মিটিয়া গেল।

একবার শ্যামনগর গ্রামের ধরবাবুকে অসময়ে অসুখ আসিয়া ধরিল। তিনি তখন যুবক। যদিও আমাদের সবার জানা যে অসুখ কখনও কাহারো সহিত বন্ধুত্ব করিবার জন্য আসে না। আর যখন আসে তখন তাহা রোগীর বুকের পাজরে বসিয়া গালা টিপিয়া ধরে। অসময় এই জন্য বলা হইল যে পিতৃমাতৃহীন যুবক বিবাহ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কোন ভ্রমর আসিয়া ফুলে বসে নাই। পরিবর্তে অনিমন্ত্রিত অসুখ আসিয়া বসিল। কিন্তু তাই বলিয়া এই মিতভাষী, প্রখর জ্ঞান সম্পন্ন যুবককে একা ভাবিলে ভুল করা হইবে। তাহার সেবায় হাজির হইল নিকটবর্তী এক স্বল্পজ্ঞান সম্পন্না যুবতী। কয়েকদিনের মধ্যেই অসুখ লেংটি গুটাইয়া পালাইয়া গেল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে স্বল্পজ্ঞানীর সংস্পর্শে মহাজ্ঞানীর হৃদয়ে প্রেমের ঢেউ খেলা করিয়া বসিল। ভাষা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হইলেও ভাব ভাষাকে পরাস্থ করিয়া যুবকের হৃদয়ে স্থান পাইল।

একদিন একান্তে উনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম :

” আচ্ছা ধরবাবু, শুনতে পেলাম আপনি আপনার এক ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। বয়সে অনেকটা ছোট হওয়া সত্ত্বেও এই গুরুগম্ভীর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় প্রথমে একটু চমকিয়া উঠিলেন। পরমুহূর্তে একগাল হাসিয়া উত্তর দিলেন: “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।”

কিভাবে এই বিয়ে হয়ে গেল ?

একটু থামিয়া মনে মনে কিছু চিন্তা করিলেন। মনের গোপন কোণে যাহা এতদিন সুপ্ত ছিল তাহা প্রকাশ করিতে উদ্যোগী হইলেন :
“আমার অসুখের সময় কমলা আমাকে সেবা করেছিল। তার পরে কিভাবে যে কি হয়ে গেল তা বুঝতে পারলাম না। সেই থেকেই সে আমার গৃহিনী।”

ধরবাবু বড়ই বিচিত্র স্বভাবের লোক। নদীর ভাঙ্গনে জায়গাজমির অধিকাংশই নষ্ট হওয়ায় স্ত্রীপুত্র ঘরে রাখিয়া অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত সদরে আসিয়া শিক্ষকতা আরম্ভ করিলেন। পোশাকের চাকচিক্য বলিতে কিছুই নাই। সাদামাটা একদুই খানা শার্ট-প্যান্ট। কোমরের উপর শার্টটি ছাড়িয়া দিতেন। মাঝে মাঝে তাহার মুখ হইতে হিন্দী গানের ছন্দ ভাসিয়া আসিয়া আমাদের চমকাইয়া দিত। ডট্‌ কলমের নগ্ন রিফিল ছাড়া অন্য কোন লিখিবার বস্তু তাহার হাতে দেখি নাই। ইংরেজী শব্দকোষ সমস্তই তাহার মুখস্থ। মাঝে মাঝে আমরা খুব শক্ত ধরনের ইংরেজী শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করায় তিনি অবিলম্বে সেই শব্দের সমস্ত ইতিহাস বলিয়া দিতেন। বৃদ্ধহস্তে রান্নাবান্না করিয়া স্কুলে আসেন।

কর্মকারবাবু তাহাকে একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন: “ধরবাবু, আজ আপনি কি কি রান্না করেছেন?”

আমরা সকলে খুব মনযোগ দিয়া তাহার কথা শুনিতে চেষ্টা করিলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। বুঝিলাম, তিনি এই প্রশ্নে ভীষণ লজ্জা বোধ করিলেন। তাহার পর তিনি চারিদিকে তাকাইয়া নিজেকে নিরাপদ মনে করিয়া ধীরে ধীরে উত্তর করিলেন: “আজ বাড়ীতে বিশেষ কিছু ছিল না। থাকার মধ্যে ঐ কয়েকটি উস্তে আর এক টুকরো কচু। উস্তে গুলো ভাতে সিদ্ধ দিয়ে দিলাম। কচুটি কুচি কুচি করে কেটে হালকা তেলে ভেজে ভাত খেয়ে এলাম।”

আমরা বুঝিলাম আজ তাহার আহার ভাল হয় নাই। যে ব্যক্তি দরিদ্রতার লাঞ্ছনা স্বীকার করিয়া বড় হইয়াছেন তাহার নিকট ইহা বড়ই স্বাভাবিক। দুঃখ-কষ্টকে জয় করিতে পারিয়াছেন বলিয়াই নম্রতার ছাপ মুখমণ্ডলে বিদ্যমান। তাহা ছাড়া সরলতা মানুষের অন্তরিকতার পরিচয় বয়ে নিয়ে চলে। বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের একাত্মবোধকে পরিমার্জিত করে।

প্রতিদিনের মতো সেইদিনও ধরবাবু সকলের সঙ্গে বসিয়া আছেন। এমনসময় শ্যামনগর হইতে এক অল্প বয়সের যুবক আসিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনি একটু চিন্তিত হইলেন। ধরবাবু যুবকের সঙ্গে দেখা করায় সে বলিল : “কাকাবাবু, আমি আপনার গ্রামের বাড়ী থেকে এসেছি। আপনার ছোটছেলের অসুখ করেছে। কাকীমা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। উপায় না দেখে আপনার ছেলেকে চিকিৎসার জন্য সদরের হাসপাতালে ভর্তি করেছি। আপনি আমার সঙ্গে হাসপাতালে চলুন। যে সামান্য টাকাকড়ি ছিল তা খরচ হয়ে গেছে। ঔষধপত্র কিনতে হবে।”

ছেলের অসুস্থতার খবর শুনিয়া ধরবাবু মানসিকভাবে নিস্তেজ হইয়া পড়িলেন। বৃদ্ধ শরীরের সঞ্চিত শক্তিটুকুও লোপ পাইতে বসিল। শেষে মুখে জড়তা আসিয়া বাসা বাঁধে, তিনি অস্ফুট স্বরে বলিয়া বসিলেন :

” মাসের শেষে কিসের অসুখ?”

অসুখ কখনও ধনী-গরীবের ভেদাভেদ বোঝে না। মাসের শেষে ন্যূনতম সঞ্চয়টুকুও যে শেষ হইয়া যায় তাহাও বোঝে না। গরীবের পেটের আহার যোগাড় করাটাই যেখানে কষ্টকর, অসুখ সেখানে বিভীষিকা।

সকলের অনুরোধে ও সহায়তায় তিনি হাসপাতালে পৌঁছাইয়া গেলেন। কিন্তু ক্ষণকালের মধ্যেই ছেলের নিঃশ্বাসের স্বাভাবিকতা নিস্তেজ হইয়া পড়িল। পিতৃস্নেহ পাইবার যে আশাটুকু অবশিষ্ট ছিল তাহাও শেষ বিকেলে অস্তমিত হইল !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *