Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যুযুধান || Buddhadeb Guha

যুযুধান || Buddhadeb Guha

এখন রাত সাতটা। যুযুধান মিনিবাসের সামনের দিকের জানালার পাশে বসেছিল। বাসটা এসে সুরেন বাঁড়ুয্যে রোড আর চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়াল। অন্যদিনের তুলনাতে আজ তাড়াতাড়িই বেরিয়েছিল কিন্তু কলেজস্ট্রিটে যাওয়াতেই দেরি হয়ে গেল।

বাসটা প্রায় ভরতিই বলতে গেলে! তবুও দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে ভ্যাপসা গরম। প্রচন্ড মিশ্র আওয়াজ উঠছে চারদিক থেকে। সে আওয়াজের ডেসিবেলে-এর হিসেব কষা মুশকিল। মাথার মধ্যে ঝমঝম করে। মনে হয়, বদ্ধ কালা হয়ে যেতে আর বেশিদিন নেই। ভাবনা চিন্তার ক্ষমতাও বোধ হয় চিরদিনের মতোই নষ্ট হয়ে যাবে। কোনো ব্যাপারেই কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারে না আজকাল। ফড়িং-এর মতো হয়ে গেছে মন।

এই যে যুযু! কেমন আচিস?

যুযু চমকে উঠে প্রচন্ড শোর-এর মধ্যে সেই বিশেষ বাক্যটি যেদিক থেকে উৎসারিত হল মনঃসংযোগ করে সেদিকে তাকাল। তাকিয়েও মানুষটিকে চিনতে পারল না। অথচ ওর নাম ধরেই ডাকলেন ভদ্রলোক।

কী রে শালা! চিনতেই যে পাচছিস না! তুই অবশ্য একাই নোস। কোনো শালাই আমাকে আর চিনতে পারে না আজকাল।

চিনতে পারল এবারে যুযুধান। তার স্কুলের বন্ধু সোম ব্যানার্জি। অবিকল একইরকম চেহারা আছে সোম-এর। লম্বা, ছিপছিপে। কণ্ঠার হাড়টা উঁচু। কাটা কাটা নাক চিবুক। বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখ। ঠিক সেইরকমই দুটি হাত দু-দিকে নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলার ভঙ্গিটিও অবিকল আছে। বদলের মধ্যে শুধু গায়ের রংটাই কালো হয়ে গেছে। আর রোগাও হয়েছে একটু। কতদিন পরে দেখা।

সোম না?

অ্যাই তো! হেসে বলল সোম। চিনেছিস তাহলে! বা:! ওল্ড ইজ গোল্ড। কী করিস এখন? শুনেছিলাম, ওয়েস্টবেঙ্গল গভর্নমেন্টে ছিলি?

শুনেছিলি ঠিকই। এখনও সেখানেই আছি।

বেড়ে আছিস।

তুই? তুই কোথায় আছিস এখন?

কোথায় আছি মানে? কোন এলাকাতে থাকি? না, কাজের থাকা-না-থাকার কথা বলছিস?

দুই-ই।

ইনকামট্যাক্সে ছিলাম। ভারত সরকারের আপিসে।

ছিলি মানে?

ছিলাম মানে, চাকরি চলে গেছে। মাস ছয়েক হল। এখন জব-লেস।

কেন? কী হল? হঠাৎ?

ফিফটি-সিক্স জে। হি: হি:। গিলোটিন।

সেটা আবার কী?

সে অনেক কথা। তোর মিনি ছেড়ে দিচ্ছে।

সোম, তুই কোথায় থাকিস?

কথাটা জিজ্ঞেস করেই যুযুর মনে হল ওকে ওর সহযাত্রীরা খারাপ ভাবতে পারেন। সরকারি চাকরি যার চলে যায় তার সঙ্গে হৃদ্যতা রাখাটা কি ভালো চোখে দেখেন কেউই? কিন্তু ততক্ষণে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। তা ছাড়া চুরি করে বা ঘুস খেয়ে চাকরি গেলে কেউ চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়ে চাকরি চলে-যাওয়া নিয়ে ইয়ার্কি করতে পারে না। পালিয়েই বেড়ায়। যুযু ওকে যতটুকু জানে তাতে মনে হয় চাকরি গিয়ে থাকলে ফাঁকি মারা বা ইনএফিশিয়েন্সির জন্যে যেতে পারে, ঘুস খাওয়ার জন্যে নয়। ঘুস হজম করতে হলে মদ হজম করার চেয়েও শক্তপোক্ত লিভারের দরকার। ভন্ডামিরও।

কুঁদঘাট।

আগে যতীন দাস রোডে থাকতিস না?

সে তো কবে। মামাবাড়ি ছিল। তারপর গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার। এখন কুঁদঘাট। আর তুই?

সেখানেই।

কোনখানে?

ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়িতেই।

গদাধর বোস লেন না কী যেন নাম ছিল গলিটার নারে?

যুযু হেসে বলল, তোর দেখছি মনে আছে এখনও?

থাকবে না? মাসিমা কত আদর করতেন। পুলি-পিঠে, মোচার চপ। ভুলে যাব? এমন নিমকহারাম নই। মাসিমা কেমন আছেন? সোম শুধোল।

নেই।

নেই? সে কী রে! ভারি দুঃখ হল রে শুনে। লাস্ট অফ দ্যা মোহিকানস। ওই জেনারেশনের মা-মাসিরা আর হবে না, বুয়েচিস। তা, কতদিন গত হলেন?

পাঁচ বছর।

রিয়্যালি? ভেরি ব্যাড…

যুযু, আমার মাও লং এগো গান। তবে আমার এই বেইজ্জতির আগেই টেসেছেন এই যা। নইলে মায়ের জন্যে বড়ো দুঃখ পেতাম।

যুযু কী যেন আরও বলতে গেল তারপর; কিন্তু মিনির ডিজেলের এঞ্জিন ঘড়ঘড় করে উঠল।

যুযু হাত তুলে বলল, আসিস একদিন। বলেই বাড়ির নম্বরটা মনে করিয়ে দিল।

সোম বলল, সে কী রে? তুই তো আজিব আদমি হচ্ছিস শালা। ফিফটি-সিক্স জে-কে কেউ বাড়িতে ডাকে? যখন চাকরি ছিল সারাপৃথিবীই তেলাত। এর শালার কেস করে দাও, তার ভায়রাভাইয়ের, কার পিসতুতো ভাইয়ের চাকরি, ছেলের আর্টিকেল্ড ক্লার্কশিপ, কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে বলে। সবসময়ই জি জি! স্যার! স্যার। আর আজকে হঠাৎ পথে দেখলে আঁতকে ওঠে। এমনই ব্যবহার করে যেন আমি কোনো মার্ডারার, রেপি…

.

বাসটা ছেড়ে দিল।

বাসটা ছেড়ে দিতেই হাওয়া লাগল যুযুর গায়ে। ওই দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেল। শোর এর তারায়-চড়ানো জটবাঁধা শব্দগুলো জমাট বেঁধে ছিল আধো-আধো হয়ে ধুলোতে বালিতে কালিতে ডিজেল পেট্রোলের ধুয়োতে, এখন হঠাৎ হাওয়া পাওয়াতে আলতো হয়ে উড়ে যেতে লাগল সেগুলো।সরে সরে গা ছাড়তে লাগল।

যুযুর পাশে-বসা অপরিচিত ভদ্রলোক বললেন, ভারি মজার লোক কিন্তু আপনার বন্ধু।

মজার? যুযু বলল। তা ছাড়া বন্ধুই যে, তা জানলেন কী করে? যুযু অস্বস্তিতে পড়ে বলল।

এই ভয়ই তো করছিল!

কথাবার্তা শুনেই বুঝলাম। তা ছাড়া আমি তো ওঁকে চিনি। আমিও ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টেই আছি।

তাই?

আপনি কি সোম-এর কলিগ ছিলেন?

ভদ্রলোক হেসে বললেন, না, ঠিক কলিগ নই! ওঁর এক ধাপ নীচে কাজ করতাম। ওঁর চাকরি থাকলে উনি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হয়ে যেতেন এতদিনে।

অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার মানে?

ওই যাঁরা ক্লাস ওয়ান অফিসার তাঁদের এখন নতুন নাম হল অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার।

ফিফটি-সিক্স জে-টি কী জিনিস মশাই?

সে আর বলবেন না। মি. ব্যানার্জির কাছ থেকেই শুনবেন। আপনার বন্ধুকে আমি ভালো করেই চিনি। ওঁর প্রতি সত্যিই খুব অবিচার করা হয়েছে। তারপর থেকেই কেমন যেন পাগলাটেই হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আয়কর ভবনেও আসেন। ইংরিজি-বাংলাতে খুবই ভালো ছিলেন। কিন্তু অ্যাকাউন্টস, ট্যাক্স এসব বুঝতেন না মোটেই। আদৌ পছন্দও করতেন না। অ্যানথ্রোপলজিতে ফার্স্ট ক্লাস এম এ। পেটের দায়ে ট্যাক্সো করতে এসেছিলেন। আমাদের দেশেই এ সম্ভব।

সেটা ঠিক। স্কুলেও সোম ইংরিজিতে, শুধু ইংরেজিই বা বলব কেন, বাংলাতেও খুবই ভালো ছিল। স্কুলের পরে তো যোগাযোগই ছিন্ন হয়ে গেছিল। ও সম্ভবত সুরেন্দ্রনাথ বা ওইদিকের কোনো কলেজে ভরতি হয়।

আর আপনি?

আশুতোষ। আমাদের পাড়ার মধ্যেই তো প্রায়।

যুযু বলল, সোম অনেস্ট ছিল?

প্রশ্নটা করেই বুঝল যে, এমন প্রশ্ন করাটা উচিত হল না আদৌ।

কিন্তু একটুও এমবারাসড না হয়ে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ যুযুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, হান্ড্রেড পারসেন্ট। ওঁর সঙ্গে আবারও দেখা হলে বলবেন আমার কথা।

কী বলব?

বলবেন যে ওঁর ডিপার্টমেন্টেরই একজন এই কথা বলেছেন।

কোন কথা?

ওই তো! যে, উনি নির্দোষ। উনি হান্ড্রেড-পারসেন্ট অনেস্ট। ওঁর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে।

বলব। কিন্তু আপনার নাম কী বলব? যদি অবশ্য আদৌ ওর সঙ্গে আবারও দেখা হয়।

আমার নাম? বলবেন, অনাথ। আমি ওঁর পেশকার ছিলাম উনি যখন প্রথম চাকরিতে ঢোকেন। বলবেন, ক্যালকুলেটর অনাথ বা অনাথ ক্যালকুলেটর।

ক্যালকুলেটর কেন? যুযু হেসে শুধোল।

আমি খুব তাড়াতাড়ি যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে পারতাম আর ট্যাক্স ক্যালকুলেশনও ঝড়ের মতো করতে পারতাম। আগে ট্যাক্স ক্যালকুলেশানে অনেক ঝকমারিও তো ছিল। আনৰ্ড-ইনকাম, আন-আর্নড-ইনকাম। এই সারচার্জ, সেই সারচার্জ। কত্ত ফ্যাকড়া। তাই উনি আমাকে নাম দিয়েছিলেন ক্যালকুলেটর অনাথ। আসল পদবি ঘোষ।

আর আপনাকে চিনতেই পারল না আজ?

আমিই তো মাথা নীচু করে ছিলাম। দেখতে পেলে তো চিনবেন।

আপনার মাথা নীচু করার কী ছিল অনাথবাবু?

এই নাথহীন দেশে চতুর্দিকে অহরহই যে অন্যায় ঘটছে তার প্রতিকারের ক্ষমতা তো দাদা আপনার আমার নেই। আমার মতো অনাথের তো নেই-ই। প্রতিবিধানের ক্ষমতা নেই অবশ্যই কিন্তু লজ্জাবোধ তো এখনও মরেনি। বিপদ তো সেখানেই। ব্যক্তিগত লজ্জার কথা বলছি না। সমষ্টিগত, সামাজিক; রাষ্ট্রিক সব কাঁড়ি কাঁড়ি লজ্জা।

বাঃ। আপনি তো খুব ভালো কথা বলেন।

অনাথবাবু হেসে ফেললেন। বললেন, আমি পার্টি করি। মানে, করতাম। আবৃত্তির ক্লাস এবং বাংলা বক্তৃতার ক্লাসও করতে হয়েছে একসময় রীতিমতো। তাই …। আসলে কী আর ভালো জানি। কিছু কিছু শব্দ ….. ওই … হয়ে যায় আর কী!

জগুবাবুর বাজার! জগুবাবুর বাজার!

কনডাক্টর হাঁকল।

আমি এবার নামব। যুযু বলল।

আচ্ছা দাদা। নমস্কার। আপনার নাম তো যুযু রায়। তাই বললেন না?

যুযুধান রায়।

এরকম অদ্ভুত নাম?

ছেলেবেলায় আমার পিঠোপিঠি এক ভাই ও এক বোনের সঙ্গে বালিশ পেটাপেটি করতাম সব সময়, তাই মা নাম দিয়েছিলেন যুযুধান।

অনাথ ক্যালকুলেটর হেসে ফেললেন। ভারি রসিক ছিলেন তো আপনার মা! তবু ছেলেবেলা বলে আমাদের কিছু একটা ছিল। কী বলেন? আমাদের ছেলে-মেয়েরা তো ছেলেবেলা কাকে বলে তা জানলই না।

তা ঠিক। মিনি থেকে নামতে নামতে যুযু বলল।

মিনি থেকে নেমে নিজের মনেই বলল, সত্যিই ছেলেবেলা বলে আমাদের মস্ত একটা প্রাপ্তি ছিল। সে নিজে অবশ্য অবিবাহিত বলে নিজের ছেলে-মেয়েদের এ বাবদের তফাতটা বোঝবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের ছেলে-মেয়েদের দিয়ে বিলক্ষণই বুঝেছে।

গলিতে ঢুকে বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল যুযুধান। সারারাত সাইক্লোনিক ঝড়ের পরও বিকেলে এদিকে জোর একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এমনিতে অপরিচ্ছন্ন মলিন গলিটাকে ধোয়ামোছা তকতকে বলে মনে হচ্ছে আজকে। তারই মধ্যে পড়ে আছে দেওয়াল ঘেঁষে একটি বেড়ালের মরা বাচ্চা। সাদা কালো। আর একটি শালিখ। হলুদ-সিঁটিয়ে যাওয়া পা দুটি তার। কালকের সাইক্লোনের বলি এরা। এক নিথর সমর্পণের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে বেড়াল-বাচ্চাটি। আর বুড়ো শালিখটা এমনই করে পা মুড়ে ঘাড় গুঁজে আছে যেন উড়ে যাবে এখুনি।

কড়া নাড়ল যুযু।

এই ছোট্ট পাড়াতে, এই গলিতে এখনও আধুনিকতা পুরোপুরি আসেনি। অবশ্য আজকালকার আধুনিকতা আসে অর্থর হাত ধরে। অর্থ না থাকাও একটা বড়ো কারণ। সব প্রতিবেশী মিলেই উগ্র আধুনিকতাকে ঠেকিয়ে রেখেছেন তাঁদের দুর্বল হাতে। এ পাড়ায় এখনও প্রতি বৃহস্পতিবারে শির-বের-করা হাতে শাঁখ বাজিয়ে লক্ষ্মী পুজো হয়। লক্ষ্মীর কৃপা কেউই পাননি এখনও প্রতিবেশীরা। পাবার আশু সম্ভাবনাও নেই কোনো। সকলের অবস্থাই দিনে দিনে দরিদ্রতর হচ্ছে এই গগন-ছোঁয়া বাজার দর-এ। গুজরাটি, মাড়োয়ারি আর সর্দারজিদের দালালেরা প্রায়ই গলির প্রায় সব কটা বাড়িতে এসেই খুবই লোভনীয় দর দিয়ে যাচ্ছে। এত টাকা একসঙ্গে এঁরা কেউই চোখে দেখেননি। সব বাড়ি ভেঙে মাল্টি স্টোরিড বাড়ি হবে। এই প্রস্তাব।

কোনো প্রতিবেশীর মায়ের ক্যানসার। কারও অরক্ষণীয়া কন্যার বিয়ে দিতে হবে। কারও ছেলে সর্বসুখের দেশ আমেরিকাতে গিয়ে এম বি এ করে আসবে বলে ঝুঁকে পড়েছে। কারও বা বড়ো আদরের একমাত্র বিবাহিত মেয়ে বিয়ের তিনমাস পরে শিক্ষিত স্বামীর বিকৃত ব্যবহারে বাড়ি ফিরে এসেছে। তাই প্রত্যেকেরই টাকার খুব দরকার।

মরণোন্মুখ সার সার মানুষের মৃত্যুর অপেক্ষায় এই শহরেরই অলিতে-গলিতে একদিন শকুনেরা যেমন সার দিয়ে বসে থাকত আজও তেমনি পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীরা গরিব বাঙালিদের শহর থেকে উৎখাত করবে বলে ওঁত পেতে আছে। প্রত্যেকের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখছে। দেখছে, নাড়ির গতি। টাকা নাও মুঠো মুঠো। আর সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে বেচে দিয়ে চলে যাও।

কিন্তু তবুও মাল্টিস্টোরি-ওয়ালাদের হাত থেকে এখনও এই জরাজীর্ণ বাড়ির ঐতিহ্যময় গলি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে কোনোক্রমে। লক্ষ্মীর কৃপা ক্কচিৎ যে দু-একজন পেয়েছেন শর্টকাট পথে, তাঁরা এপাড়া ছেড়ে তাঁদের ভি সি আর আর মারুতি গাড়ি কিনে চলে গেছেন অন্যত্র।

এ গলিতে বড়োলোকি ঢোকা এখনও বড়ো কঠিন। কারণ, টানা রিকশা, দ্বিচক্রযান এবং অটো ছাড়া আর কোনো যানবাহনই এতে ঢুকতেই পারে না। এমনই সরু গলি এ। গলির প্রতিবারান্দাতে এখনও কাঁচা শাড়ি, শায়া এবং লুঙ্গি-গামছা ঝুলোনোকে অসভ্যতা বলে কেউই মনে করেন না।

বুড়োরা রকে বসে সকাল-সন্ধেতে এখনও রাজা-উজির মারেন। চলে যাওয়া সোনার দিনগুলির স্মৃতিচারণ করেন। বাধা কেউই দেন না। এপাড়া পুরোনো দিনের কলকাতার স্মৃতি বহন করে চলেছে। মেয়েরা পূর্ণ বা বিজলি বা ইন্দিরাতে এখনও ভালো বাংলা ছবি এলে ম্যাটিনি শো-তে সে ছবি পাছা-পেড়ে শাড়ি পরে গিয়ে দেখে আসেন। এ পাড়ার মেয়েরা রোজ চুলে তেল দেন। বিবাহিতারা সিঁথিতে সিঁদুর। শোয়ার আগে চুল আঁচড়িয়ে শুতে যান তাঁরা। ছেলেরা এবং বুড়োরা এখনও কেউ কেউ গড়গড়া খান। প্রায় সকলেই ধুতি পরেন ক্রিয়া-কৰ্মর দিনে। বাংলা বই ও বাঙালি সাহিত্যিকের মর্যাদা এখনও আছে এখানে। এবং কী আশ্চর্য! বাংলাতে চিঠি লিখতেও পারেন এঁরা সকলেই। বিজয়ায় ও নববর্ষে দূর-প্রবাসের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়মিত চিঠি লেখেন সবাই। ছেলে-মেয়েরাও কথা বলে বাংলাতেই।

কীর্তন, পুরাতনি, রবীন্দ্রসংগীতই এখনও এখানে একমাত্র গান। দিশি উচ্চাঙ্গ সংগীতও। ভজন। অনুপ জালোটা আর পঙ্কজ উধাস এখানের সকলকে উদাসী করেননি এখনও।

প্রায় শুকিয়ে-যাওয়া বাঙালি জাতের একটি সরু সোঁতা, সরু ঘোলাজলের টালির-নালার পাশে এখানে এখনও বয়ে যাচ্ছে। তেলাপোকার মতো শক্ত প্রাণ এই গলির মানুষদের। বাসে-ট্রামে, ঘামে-লোডশেডিং-এ, প্রোটিন-ডেফিশিয়েন্সিতে মরতে মরতেও না মরে এবং কিছুতেই মরব না এমন পণ করেই এখনও বেঁচে আছেন এঁরা।

পচার মা দরজা খুলল। ছোটোভাই অমলের আড়াই বছরের ছেলে শাশা জেতু জেতু করে দৌড়ে এল টালমাটাল পায়ে। যুযু পকেট থেকে দুটি লজেন্স বের করে দিল তাকে। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে ছোটোভাই অমলের বউ শ্ৰীলা, ঘোমটা মাথায় কাছে দাঁড়িয়ে বলল, দাদা, আপনার চিঠি।

হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পারল যুযু কার লেখা চিঠি এ। শ্ৰীলাও জানে কার চিঠি। শ্ৰীলার দূরসম্পর্কের দিদি হয় যূনী। দিল্লি থেকে লিখেছে। শ্ৰীলার সঙ্গে অমলের বিয়ের সম্বন্ধ যূনীই করেছিল।

গা ধোয়ার পর লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে নিজের ইজিচেয়ারে এসে বলল যুযু। পচার মা চা আর হাতে-গড়া দুটি রুটি আর আলুর তরকারি নিয়ে এল।

যুযু বলল, ওগুলো নিয়ে যাও। শুধু চা-টা রেখে যাও পচার মা। একেবারেই খেয়ে নেব রাতে। অমল কি ফিরেছে অফিস থেকে?

ছোড়দা তো ফিরেই ক্লাবে গেছে। ফিরতে দেরি হবে। তুমি খেয়ে নিলে বলো। তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব। বউদিও তোমার সঙ্গে খেয়ে নেবে বলেছে। বউদি বলেই রেখেছে আমাকে।

চা খাওয়া হয়ে গেলে, চায়ের কাপটা শেষ করে এবারে শ্রীলার দেওয়া চিঠিটা খুলল যুযু।

দরিয়াগঞ্জ
পুরোনো দিল্লি
৯/৬/৮৯

যুযুদা,
কাগজে দেখলাম তোমাদের কলকাতায় সাইক্লোন আসছে। সত্যিই এলে কী হবে জানি না। তোমাদের ও তোমাদের পাড়ার বাড়িগুলো যেমন পুরোনো, তাতে বাড়িঘর সব উড়ে না যায়। তেমন সাইক্লোন তো কলকাতায় কখনোই আসেনি। তাই ভয় করে।

আগামী শনিবার তোমার জন্মদিন। তোমার জন্যে পার্সেল করে একটি কলম পাঠিয়েছি। পোস্ট অফিসে খোঁজ কোনো। যবন কাস্টমস-এর দোকান থেকে আমার কথামতো নিয়ে এসেছিল। ছাই-রঙা একটি জার্মান কলম। খুব সরু নিব। তোমার পছন্দ হবে হয়তো।

তোমার চল্লিশ হবে। তোমার একটি করে বছর বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে আমারও মনে পড়ে যায় যে আমারও বাড়ল একটি। জন্ম তো একই মাসে। মাত্র ক-দিনের তো ব্যবধান। আমরা দুজনেই কর্কট রাশির। তাই কি এত ভাব আমাদের? আমার পঁয়ত্রিশ হবে তিরিশে জুন। কী করে যে দিনগুলো চলে গেল ভাবতে বসলে অবাক হয়ে যাই। দাদা এবং মাসিমার চলে যাওয়ারও পাঁচ বছর হয়ে গেল।

জন্মদিনে কি আমার কথা মনে করো যুযুদা একটিবারও? তোমার নিজের বাড়িতেও তোমার জন্মদিনের খোঁজ কেউই রাখে না। শ্রীলাকে আমি বলেছিলাম যে, তোমাকে পায়েস যেন বেঁধে দেয় একটু। তা তুমিই তো তাকে ভুজুং দিলে, বললে, যূনী জানে না কবে জন্মদিন। তোমার জন্মদিন সাতাশে জুন নয়। কবে যে, সেকথাও তাকে বললে না। সে বেচারিই বা কী করে এল।

কেমন আছ? তোমার সঙ্গে চার বছর দেখা হয় না। চার বছর। একথা বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হয় না। দেখা কি মরার আগে আবার হবে? তুমিও আসো না দিল্লিতে, আমিও যাই না কলকাতাতে। একটি ফোটো পাঠাতেও কি পারো না? সম্প্রতি ভোলা? অমলের আর শ্রীলার বিয়েতে যখন গেছিলাম তখন ওদের বিয়ের ছবির মধ্যে (অমলের পাড়ার বন্ধু গেনু তুলেছিল) আমার আর তোমার কটি ছবি উঠেছিল। লজ্জায় অমল অথবা গেনুকেও বলতে পারিনি এনলার্জ করিয়ে দেওয়ার কথা। পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোগুলি আলমারিতে আমার ড্রয়ারে রাখা আছে। বাড়ি যখন একেবারে খালি থাকে তখন বিছানার ওপরে খুলে মেলে দেখি। তুমি তো দিনে দিনে আরও ছেলেমানুষ হচ্ছ আর আয়নার সামনে আমার দাঁড়াতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। এমনই বুড়ি-বুড়ি হয়ে যাচ্ছে চেহারাটা।

জানো আমার চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে? এই জীবনটা এমনি করেই কি শেষ হয়ে যাবে? কিছু কি করা যায় না এখনও? তুমি তো ক্লাস-ওয়ান অফিসার। বলেছিলে, এবার বদলি করলে তোমাকে অ্যাকসেপ্ট করতেই হবে। বদলি নিয়ে চলে এসো না দিল্লি। বেশ আমার সঙ্গেই থাকবে। যবন কিছু মনে করবে না। যবন একটি পাঞ্জাবি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটির নাম অনুরাধা। যমন ডাকে তাকে আনু বলে। ভারি মিষ্টি মেয়ে। লম্বা, শালীন, ভদ্র। যখন আমার দেওয়া তাঁতের শাড়ি পরে অনুরাধা রবিবার দুপুরে আসে আমাদের বাড়িতে খেতে, তখন মনেই হয় না যে, ও বাঙালি নয়। তবে ওদেরও বিয়ে করা এক্ষুনি হবে না। আনুর বাবা পাঞ্জাবে কাজে গেছিলেন, রোপার-এ বা মোগাতে নয়। এখন ওইসব অঞ্চলে গেলে নিরপরাধ লোকেও টেররিস্টদের গুলিতে মরে কিন্তু উনি মারা গেলেন সাদামাটা হার্ট-অ্যাটাকে। আমার, তোমার বা আনুর বাবার মতো সাধারণ মানুষেরা মৃত্যুর সময়টাতেও হঠাৎ খবর হয়ে যে যাব তেমন কপালও করে আসিনি। আনুর একটি ছোটোবোন আছে। সে স্কুলে পড়ে। আনুর মা জাকির হুসেন কলেজে আমাদেরই কলিগ। উনি ইতিহাসের অধ্যাপিকা। রিটায়ার করার মাত্র একবছর বাকি।

আনু কাজ করে একটি কমার্শিয়াল ফার্মে। জনপথে অফিস ওদের। ছোটবোনকে মানুষ করে তোলার আগে ও বিয়ে করতে চায় না। আমি অনেক বুঝিয়েছিলাম। বিয়েটা বিয়ের সময়ে না করে ফেলতে পারলে পরে অনেক সময়েই আর করা হয়ে ওঠে না। সাহসের বড়োই অভাব হয়। তা ছাড়া যৌবনের শুরুতেই বিয়ে না করলে দাম্পত্যর মজাও বোধ হয় অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়। তুমি ও আমি তো এ জীবনে দম্পতি আর হতে পারলাম না। পারবও না। কিন্তু শুধু মনের ভালোবাসা নিয়ে এত বছর আমরা কাটিয়ে দিলাম বলে (প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার! যাই এল আর তাই এল!) যে, আনু-যবনও পারবে তার ভরসা কী? তা ছাড়া সব পুরুষ তো তোমার মতো অন্তর্মুখী নয়; লেখক নয়। পুরুষদের ভালোবাসা ফড়িং-এর মতো। আজ এখানে; কাল সেখানে। পুরুষরা অধিকাংশই শরীর-সর্বস্বও। তোমার মতো তো সবাই নয়। আনুর জন্যে চিন্তা হয় খুবই। ওদের সম্পর্কটাও শুধুমাত্র প্লেটোনিক পর্যায়ে যাতে থেমে না থাকে (ক্কচিৎ-কদাচিৎ দু-একটি চুমুকে শারীরিক সম্পর্ক বলা যায় না) তাই প্রতি রবিবার দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নানা অছিলাতে আমি বাড়ির বাইরে চলে যাই যাতে ওরা একলা হবার সুযোগ পায়। চা খাওয়ার সময়ের আগে আবার ফিরে আসি। ওরাও জানে যে, আমি ফিরে আসব ওই সময়ে। আনুই চায়ের জল চড়িয়ে রাখে। এই গরমে দুপুরে বাইরে যাওয়া যে কী কষ্টকর তা দিল্লিতে থাকলে বুঝতে। অনেকদিন আমাদেরই ভাড়া বাড়ির একতলায় থিংগু সাহেবদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। তাতে তাঁদেরও বিরক্ত করা হয়। রবিবারের দুপুর বলে কথা।

কোনোদিন বাসে চেপে লালকেল্লাতে চলে যাই। কোনো বড়ো গাছের ছায়ায় বসে থাকি নানাদেশি টুরিস্টদের ভিড় দেখি। সাধ হয় ওদের সঙ্গে, ওদের দেশে চলে যাই! কানাড়া, ইউ এস এ, জাপান, ইউনাইটেড কিংডম, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ঘানা, জাম্বিয়া, তানজানিয়া কত দেশ থেকেই না মানুষে দিল্লি দেখতে আসে। বাচ্চারা চিৎকার করে ছুটোছুটি করে। চার থেকে সাত বছরের ফুলের মতো বাচ্চাদের দেখে কখনো কখনো যে, বুকের মধ্যেটা কুরে কুরে যায় না এমনও নয়। আমারও তো অমন একটি শিশু থাকতে পারত। চার থেকে সাত বছরের মধ্যে যার বয়স। কি যুযুবাবু? পারত নাকি?

কোনোদিন বা কোনো এয়ার-কণ্ডিশানড রেস্তরাঁতে এককাপ কোল্ড কফি নিয়ে বসে থাকি। খরচটা অপচয় বলে মনে হয়। পরক্ষণেই ওদের কথা ভাবি। তবে যেখানে বাচ্চারা যায়, চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, সেসব জায়গাতেই বেশি যাই।

তুমি তো মেয়ে হয়ে জন্মাওনি। তুমি বুঝবে না যে, মেয়ে হয়েও মা না-হওয়াটা কত কষ্টের।

যবন আর আনুর জন্যে বাড়ির বাইরে গরমে সেদ্ধ হয়েও এক ধরনের গভীর আনন্দ পাই। এক গভীর আনন্দ। জানো যুযুদা। তুমি বোধ হয় ঠিকই এল। অন্যকে আনন্দিত দেখে মানুষ যতখানি আনন্দিত হতে পারে তেমন আনন্দিত সে নিজের আনন্দে কখনোই হতে পারে না।

তোমার মতো মানসিকতার পুরুষ এবং হয়তো আমার মতো মেয়েও আজকাল বড়ো কমে আসছে একথা জেনে এক ধরনের গর্ব যে বোধ করি না তাও নয়। কিন্তু ভয়ও করে। তুমি ও আমি যাদের সুখের জন্যে, যাদের মুখ চেয়ে নিজেদের সুখকে কোনোদিন ছুঁতে পর্যন্ত পারলাম না তারা যদি বুড়ো বয়সে আমাদের ফেলে দেয়? আমাদের সম্মানের আসনে না বসিয়ে রাখে? তবে?

তোমার ভয় করে না কখনো?

জন্মদিনের অনেক অনেক অগ্রিম শুভেচ্ছা ও আদর জেনো।
–ইতি তোমারই, যূনী।

.

০২.

আজকে দিল্লি থেকে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেসের চেয়ারম্যান আসছেন। সঙ্গে ইস্টার্ন রিজিয়নের মেম্বার এবং মেম্বার ইনভেস্টিগেশন। পুরো দেশের ট্যাক্স রেইডের কর্তা।

কালকে চিফ কমিশনার সাকুলার দিয়েছিলেন যেন অনাথরা সবাই সময়মতো অফিসে আসে। অবশ্য ওরা আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবরে কীই বা দরকার ওদের। কিন্তু চুল টানলেই মাথাও নড়ে। কখন কোনো ইনফরমেশনের দরকার হয়, কোন ফাইলে রিফাণ্ড পড়ে আছে, কোন ফাইলে ডিম্যাণ্ড তা আগে থেকে জানা যাবেও বা কী করে?

চেয়ারম্যান সাহেব আর মেম্বার সাহেবরা পকেট থেকে এক-একটি চিরকুট বের করে চিফকে বা রেসপকটিভ কমিশনারকে একবার বলে দিলেই তো কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর একেবারে গোড়াতেই টান পড়বে। আর গোড়া মানেই অনাথরা।

রাজনৈতিক নেতাদের ভাষাতে গ্রাসরুট লেভেলের মানুষ। শিরদাঁড়া বেয়ে যেমন ঘাম নেমে গড়াতে গড়াতে পেছনে গিয়ে মিলিয়ে যায় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেও ঠিক তেমনিই হয়। ঘাসেরই মতো চেয়ারম্যান থেকে সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বয়ে এসে গড়িয়ে গিয়ে থামে ইনকামট্যাক্স অফিসারদেরই পেছনে।

এখন অবশ্য ডি সি অ্যাসেসমেন্টদের পেছনেও। তবে এখন যাঁরা চিফ বা মেম্বার বা চেয়ারম্যান তাঁরাও একদিন এই গ্রাস-রুট-লেভেল থেকেই শুরু করেছিলেন তাই তাঁরা নিজেরাও এই হরকত-এর রকমটা বোঝেন ভাগ্যিস। তবে কেউ কেউ আবার কনভিনিয়েন্টলি ভুলেও যান। সেটা চেয়ারেরই দোষে। চেয়ারের মতো অসুখ আর বড়ো নেই।

ক্যানসারের চেয়েও বেশি দুরারোগ্য এই অসুখ। কোনো আমলার পেছনে চেয়ার যদি সেঁটেই থাকে তাহলেই মুশকিল হয়। অনাথদের মতো গ্রাস-রুট লেভেলের মানুষদের। তবে এই রোগও সেরে যায় যখন পেছন থেকে চেয়ারটাই সরে যায়। সব লেভেলই যতদিন চেয়ারে আছেন ততদিন চেয়ার যে একদিন-না-একদিন সরবেই এই কথাটি কিছু কিছু আমলা বেমালুমই ভুলে যান। চেয়ার ছাড়ার পরে তাঁদের যা অবস্থা হয় তা আর কহতব্য নয়। সে অনাথদের চেয়ারই হোক; কি ওপর মহলের চেয়ারই হোক।

এসেছিলেন সকলেই। অনাথ, রায়, রথীন, সুপ্রভাত, বিজয়, অনিমেষ, অনিরুদ্ধ সবাই মিলে অনাথের ঘরে চা খাচ্ছিলেন। সবাই অফিসার। প্রত্যেকের অফিসেই বলা ছিল কমিশনারের ফোন এলে যেন সঙ্গে সঙ্গেই খবর দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, সাহেব টয়লেটে গেছেন।

রায় বললেন, কাল তাহলে সোম বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে দেখা হল?

অনাথ বললেন, হ্যাঁ। তা না হলে আর বলছি কী!

তোর নামটা কিন্তু বাঁড়ুজ্যে সাহেব ভালোই দিয়েছিলেন। ক্যালকুলেটর!

সুপ্রভাত বললেন, এখন আর ক্যালকুলেশানের আছেটা কী?

ওঁর এক বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হল, মিনিতে যাচ্ছিলেন আমার সঙ্গে। কী অদ্ভুত নাম রে ভদ্রলোকের, যুযুধান। মানেই জানি না।

অনাথ বললেন, যুযুধান মানে জানিস না? এ কোন যুযুধান রে? লেখক যুযুধান রায় নয় তো?

অনাথ বললেন, না না। উনি ওয়েস্টবেঙ্গল গভর্নমেন্টে কাজ করেন।

আরে! সে তো কবি যুযুধান রায়ও করেন।

রথীন বললেন। তাই?

না তো কী?

তা না হয় খোঁজ করা যাবে কিন্তু নামের মানেটা কী?

রথীন বাংলা সাহিত্যের খুব ভক্ত। বিজয়কে বললেন, মানে বলিস না বিজয়। অনাথ একটি বাংলা অভিধান কিনে নিয়ে বাড়ি গিয়ে দেখবে, মানেটা কী?

অভিধান কিনে কী হবে? বাড়ি গিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।

সুপ্রভাত বললেন, ছেলে তো সাহিত্য-অনুরাগী একজন।

ভালোই বলেছিস! ছেলে তো ইংলিশ-মিডিয়ামে পড়ে। বাংলার পন্ডিতই বটে। নিজের বাবার নামের মানেই জানে না তার আবার যুযুধানের মানে! পারলে আমার বউই পারবে।

অনাথ বললেন।

তা বটে। বউরাই তো বাংলা সাহিত্য আর বাঙালি সাহিত্যিকদের বাঁচিয়ে রেখেছে, যাই বলিস আর তাই বলিস। আমাদের এসব পড়ার সময়ই বা কোথায়? ম্যানুয়াল পড়ব, না বোর্ডের আর কমিশনারের সাকুলার পড়ব, না ওইসব। তাছাড়া আইনও তো রোজই পালটেচ্ছে। মাথামুন্ডু বোঝার আগেই ল্যাজ পালটে যাচ্ছে।

বর্ষার আকাশের মতো। যা বলেছিস।

রায় বললেন।

এবার সময় হবে সকলেরই। অগাস্ট মাসের মধ্যেই যদি নাইনটিন এইট্টি এইট এইট্টিনাইনের সব অ্যাসেসমেন্টস শেষ করে দিতে হয়, তাহলে তারপরে তো একেবারে যাকে বলে অখন্ড অবসর। তখন আমরাও বাংলা সাহিত্যের প্রাণ-সঞ্চারক হব।

হাসতে হাসতে অনিমেষ বললেন।

শুধু আমরাই নয়, অ্যাডভোকেট আর অ্যাকাউন্ট্যান্টসরাও হবেন। তাঁদেরও তো রিটার্ন ফিলিং আর স্ক্রটিনি-কেস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।

না। কিছু আপিল ট্রাইব্যুনাল তো থাকবে।

তাও বা সংখ্যাতে কত? আর সকলেই তো ট্রাইব্যুনালে যান না।

তা যা বলেছিস। অনিমেষ বললেন।

এমন সময় অনাথের ঘরের ফোনটা বাজল। অনাথ বললেন, একটু চুপ কর, চুপ কর। কমিশনাররাও তো টেন্সড হয়ে আছেন সবাই আজ। কার কখন ডাক পড়ে চিফ-এর বা মেম্বারের বা চেয়ারম্যানের ঘরে। আমার কমিশনারের ফোন হলে গালাগালি খেতে হবে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলবেন: আপনার ঘরে কীসের কনফারেন্স চলছে এখন ঘোষ?

রায় বললেন, বলবি, আপনার কনডোলেন্স মিটিং হচ্ছে স্যার।

এই কী হচ্ছে। চুপ কর। চুপ কর।

সবাই চুপ করে গেলে অনাথ ফোনটা তুললেন।

হ্যালো!

ঘরের সকলেই চা খেতে খেতে অনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ও-ও। আপনি? যুযুধান বাবু? স্বস্তির গলায় অনাথ বললেন, বলুন! বলুন! অনেক দিন বাঁচবেন। একটু আগেই আপনার কথা হচ্ছিল। তা, আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?

ও আচ্ছা। আচ্ছা। বেশ করেছেন। আপনার অফিস কোথায়? রাইটার্স বিল্ডিং-এ? ও তাহলে তো কাছেই। ও। না। ব্যানার্জি সাহেবের ঠিকানাটা তো আমার কাছে নেই। তবে উনি আসেন মাঝে মাঝে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! তা পারব না কেন? বলুন, আপনার ঠিকানা। লিখে নিচ্ছি। হ্যাঁ। ফোন নাম্বারও দিন। উনি যখন আসবেন তখন যাতে পান তার বন্দোবস্ত করব। না, না। আমি বেশ কয়েক কপি টাইপ করিয়ে যাঁদের কাছে উনি আসেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই এককপি করে দিয়ে রাখবৃখন যাতে উনি অবশ্যই পান। কোনো চিন্তা নেই আপনার। আমি মুখেও বলব আপনার কথা দেখা হলে। হ্যাঁ। হ্যাঁ। ও। এখন আপনার বাড়ির ফোনটা খারাপ? বলে দেব। বলে দেব। নিশ্চয়ই বলে দেব। হ্যাঁ আসবেন একবার। না, না। কাজ তো আছেই, থাকবেই।

রথীন বললেন, কবি কি না জিজ্ঞেস করবি তো?

ও। হ্যাঁ। আচ্ছা যুযুধানবাবু, আপনি কি লেখক? অ্যাঁ? তাই বলুন। আমার বন্ধুরা।

রথীন টিপ্পনী কাটলেন, অনাথ তুই সত্যিই একটা পাঁঠা। তাড়াতাড়ি একদিন আসতে বল ভদ্রলোককে। আলাপ হবে।

তা একদিন চলে আসুন তাড়াতাড়ি। আমার বন্ধুরা আলাপ করতে চান।

আচ্ছা। আচ্ছা। আসবেন তাহলে।

উনিই লেখক যুযুধান রায়?

ইয়েস স্যার। এবারে একদিন আলাপ করিয়ে দেব।

তোর কাছে ইটও যা যুযুধান রায়ও তাই। সুপ্রভাত বললেন।

তারপর কিছুক্ষণ যুযুধানকে নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা হল। কে কী বই পড়েছেন তা নিয়েও আলোচনা শেষ হলে অনিরুদ্ধ বললেন, ভেবো না, অ্যাসেসমেট থাকবে না বলে অন্য কাজও থাকবে না। রোজই রেইড করতে যেতে হবে গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে। এতদিনে ডিপার্টমেন্টের টনক নড়েছে। জেনে গেছে যে, কাঁচা-টাকা, সোনা এসব কলকাতার চেয়ে মফসসলের শহরে এবং গ্রামেই অনেক বেশি আছে। মধু যখন একবার পাওয়া গেছে তখন লাগাতার রেইড হবে। এতদিন যে কেন এটা ডিপার্টমেন্টের মাথায় খোলেনি, তা কে জানে।

অনাথ বেল টিপে, তদারকির লোককে ডেকে, কাগজটা দিয়ে অফিসে নিয়ে গিয়ে যুযুধান রায়ের অফিস ও বাড়ির ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব দশ কপি করে টাইপ করাতে বললেন। অনিমেষকে বললেন, তোকেও এককপি দেব অনিমেষ। তোর কাছেও তো আসেন সোম বাঁড়ুজ্যে সাহেব।

দিস। তবে কবে যে আসবেন তা উনিই জানেন।

সুপ্রভাত আর রথীন বললেন, বাঁড়ুজ্যে সাহেব আসার আগেই আমরা নিজেরাই যুযুধান রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করব।

.

ফোনটা আবারও বাজল।

হ্যালো। অনাথ চায়ের কাপটার তলানিটুকু গিলে বললেন।

ইয়েস স্যার। যাচ্ছি স্যার। এখুনি যাচ্ছি। হ্যাঁ ফাইলটা নিয়েই যাচ্ছি।

টেলিফোন নামাতেই সকলেই সমস্বরে বললেন, কে? কে রে?

আর কে? চিফ-কমিশনার স্বয়ং। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। চেয়ারম্যান ফাইল চেয়েছেন। উকিল অবশ্য বলেই গেছিলেন যে, চেয়ারম্যান অবধি তাঁর জানাশোনা আছে।

কে উকিল?

আরে ন্যালাখ্যাপার মতো দেখতে একটা লোক। আগে কোনোদিন অ্যাপিয়ারই করেনি। তোরাও চিনিস না।

ফাইলটা কার?

একজন নেতার ছেলের।

উকিলের নাম কী বল না? বাঙালি?

বড়ো কেস আর বাঙালি উকিলদের কাছে কোথায়? নাম পরে বলব-খন। প্রাণটা বাঁচিয়ে ফিরে তো আসি আগে।

ছাড় তো। উলটে তোর আরও ভালো হল। যা গোলমাল আছে, তা সব দেখিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ইনস্ট্রাকশানস চাইবি। তারপর বেঁধে যোগ করবি। কাজই যদি না জানে তো শুধু জানাশোনা দিয়ে কী হবে? ঘোড়ার ডিম! সত্যিকারের ভালো উকিল, তাঁর যতই জানাশোনা থাক, কখনো কমপ্লেন করবেন না। নিজের গুণে উইনওভার করবেন। এ উকিল যে ন্যালাখ্যাপা তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

অনাথ লোহার আলমারি খুলে ফাইলটা বের করেই আলমারিটা শব্দ করে বন্ধ করলেন। তারপর ফাইল হাতে দরজার দিকে এগোলেন।

ওঁরা সকলেই উঠে পড়লেন।

অনিমেষ বললেন, ফিরে এসেই ফোন করিস আমাকে একটা। কী হল তা জানতে ইচ্ছে করবে।

আমাদেরও।

সেই উকিলকে একটু চিনিয়ে দিস তো।

রায় বললেন।

দেব।

অনাথ বললেন।

ন্যালাখ্যাপাকে একটু টাইট দিতে হবে সকলে মিলে।

.

০৩.

রাত প্রায় এগারোটা হল। যূনীকে চিঠিটা লেখা শেষ করে একটা হাই তুলল যুযুধান। হাইটা, চিঠি লেখার ক্লান্তিজনিত নয়। অন্য অবসাদজনিত। কলমটা যূনী পাঠিয়েছে আজ প্রায় দিন পনেরো কুড়ি হয়ে গেল। গত সাতদিন হল পোস্টঅফিসে রোজই খোঁজ করে করে হয়রান হয়ে গেছে ও। ওঁরা বললেন জি পি ও-তে খোঁজ করুন। আজ তাই গেছিল অফিস যাওয়ার পথে। সেখানেও কোনো হদিশ মিলল না।

বড়োই অসহায় অবস্থা। চুরি না করেও এমন চোর হয়ে থাকা প্রতিমুহূর্ত, এ আর ভালো লাগে না। কিছু একটা করা দরকার। কিছু একটা ঘটা দরকার। কোনো বিস্ফোরণ। এই তো গেল। পোস্ট অফিসের কথা। এদিকে বাড়ির ফোনটাও আজ প্রায় দুমাস হল খারাপ হয়ে আছে। মাঝে দু-দিনের জন্যে ঠিক হয়েছিল। জেনারেল ম্যানেজারকে ফোন করেছিল একটা। ভেবেছিল, সামান্য হলেও ওর লেখক পরিচয়টা ভাঙিয়ে যদি এই দয়াটুকু পাওয়া যায়। উঁচুমহলের আমলারা তো সাধারণত সংস্কৃতিসম্পন্ন হন।

যুযুধানের প্রত্যেক জন্মদিনেই যূনী দিল্লি থেকে একটা ফোন করেই সকালবেলাতে। কিন্তু ফোনটা এখনও ঠিক হল না। যতই যুযুধানের জন্মদিনটা এগিয়ে আসছে, ততই উত্তেজনা বাড়তে থাকছে।

অথচ পার্সেল বাড়িতে বা পোস্ট অফিসে পৌঁছোনো বা ফোন সারানোটা পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট আর টেলিফোন ডিপার্টমেন্টেরই দায়িত্ব। কর্তব্য। এতে কোনো দয়ার ব্যাপারই নেই। অন্য দেশ হলে এতদিনে ক্ষমা চেয়ে চিঠি আসার কথা ছিল। প্রতিযোগিতা থাকলে এমনটি হবার উপায়ই ছিল না আদৌ। তবু অনেক দ্বিধার পরই নিজেকে ছোছাটো করেছিল যূনীর কথা ভেবেই।

অফিসের অপারেটরের কাছ থেকে নাম জেনেছিল নতুন জেনারেল ম্যানেজারের। আগের জি এম তাঁকে চিনতেন। এঁর নাম শ্রীহিরালাল মুখার্জি। তাঁর নাম্বার ডায়াল করাতে একজন মহিলা ফোন ধরলেন। হয়তো ওঁর পি এ-ই হবেন। তা হওয়াই স্বাভাবিক। বললেন, জি এম তো মিটিঙে ব্যস্ত আছেন। বলুন আপনি কী বলবেন?

অত্যন্ত ঠাণ্ডা নিরুত্তাপ স্বর মহিলার। তবে বেশ ব্যক্তিত্বময়।

যুযুধান বলল, নিরুপায় হয়েই জি এম কে কষ্ট দিচ্ছি। আপনাকেও।

মহিলা তেমনই ঠাণ্ডাগলায় বললেন, না কষ্টর কী? বলুন। আপনার ফোন নাম্বার বলুন, মানে, যে নাম্বার খারাপ।

ফোন নাম্বার দিয়ে যুযুধান বলে দিল, দয়া করে যদি এই উপকারটা করেন বড়ো কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার নামটি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? ফিউচারে যদি আবারও বিরক্ত করার দরকার হয়।

আমার নাম? বলে একটু চুপ করে থেকে ভদ্রমহিলা বললেন, ইলা বোস।

যুযুধান বলল, অনেক ধন্যবাদ।

ভাবল ফোনটা যদি আরও তিন চার দিনের মধ্যে ঠিক না হয় তবে জি এম শ্রীহিরালাল মুখার্জির পি এ ইলা বোসকে আবারও ফোন করবে ও। এখানে ক্ষমা চাওয়া তো চিন্তারও বাইরে। এঁরা দয়া করেই কারও কারও ফোন ঠিক করে দেন।

চিঠিটা লেখা শেষ হয়েছিল অনেকক্ষণই। খামে বন্ধ করার আগে একবার পড়ে দেখল যুযুধান।

কলমটা যে পায়নি সেকথা জানিয়ে দুঃখ দেয়নি ও যূনীকে।

কলকাতা
২৬.৬.৮৯

যূনী কল্যাণীয়াসু,
তুমি এমন চিঠি লেখো যে, মন ভারি খারাপ হয়ে যায়। তোমার চিঠি পেয়েছি প্রায় দশ দিন হল। ভেবেছিলাম, যে তোমার কলমটি হাতে পেয়ে তোমার কলম দিয়েই এই চিঠিটা লিখব। তাই এতখানি দেরি হল।

চমৎকার কলম। এত দামি কলম কেন পাঠালে? ভালো ও দামি কলম ব্যবহারের যোগ্যতা কি সকলের থাকে? আমার কাছে তুমি এমনিতেই এত দামি যে, আমাকে দেয় তোমার আর কিছুমাত্রই নেই। তোমাকেও আমার অদেয় কিছুই যে নেই সেকথা তুমিও জানো। অবশ্য এই দেয়া আর কলম দেয়া সমার্থক নয়। শুধু কবে এবং কখন যে শেষ দেয়া নেয়া সম্পূর্ণ হবে সেই অপেক্ষাতেই আমাদের দুজনেরই দিন গোনা। কিন্তু এই দেয়া-নেয়ার স্বপ্ন কোনোদিনও কি সত্য হবে? আজকাল কেবলই মনে হয় যে, বেলা পড়ে আসছে; সময় আর বেশি নেই।

চমৎকার লিখছে তোমার কলম তরতর করে। যেমন সুন্দর রং তেমনি সুন্দর নিব। কিন্তু এমন কলম যদি প্রথম যৌবনে পেতাম তবে তার দাম উসুল করে নিতাম। এখন তরতর করে লেখার মতোই যে কিছু নেই। বৃষ্টির পরে বিকেল বেলার আলো যখন পড়ে আসে, ধোয়া-মোছা চিকন ডানা মেলে যখন ক্কচিৎ পাখি ডেকে ওঠে, ফড়িং ওড়ে ঝাঁক বেঁধে, আর মন ভারি খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, বেলা হল। এবারে যেতে হবে।

যাই হোক, কলমের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোটো করব না।

কত স্বামী-স্ত্রীও তো ভিন্ন জায়গাতে থাকেন। যবনকে ঠিকমতো সেটল করে দিয়ে তারপর তোমার ছুটি এই কথা তুমি সবসময়ই এল। পৃথিবীর হাজারও মানুষের প্রতি তোমার হাজারও কর্তব্য। শুধু আমার প্রতিই বুঝি তোমার কোনো কর্তব্য নেই? আমার বেলাও অবশ্য সেকথা খাটে। আমারও হাজার মানুষের প্রতি হাজার কর্তব্য। শুধু তোমার প্রতিই কোনো কর্তব্য নেই।

তোমার এই যে ভাবনা, জীবনের সব কাজ শেষ করে তারপরই ছুটি নেবে এ বোধ হয় ঠিক নয়। জীবনের পথে চলতে চলতেই যারা আনন্দ ও শান্তি গুছিয়ে নিতে না পারে, তাদের জীবনে আনন্দ ও প্রাপ্তির যোগ কখনোই ঘটে না। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি আছে না? কেতকীতে? নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি, নে রে ও মন নে রে, আপন পানে টানি। ওই গানেরই সঞ্চারী অথবা আভোগে আছে, (ঠিক মনে নেই কোথায়)

এমনি করে চলতে পথে ভবের কূলে
দুই ধারে যা ফুল ফুটে সব নিস রে তুলে।
সে ফুলগুলি চেতনাতে গেঁথে তুলিস দিবস রাতে
দিনে দিনে আলোর মালা ভাগ্য মানি
নে রে, ও মন নে রে, আপন পানে টানি।

দোষ অবশ্য আমারই। আমি হয়তো যথার্থ পুরুষমানুষ নই। তোমার জন্যে কলকাতা বা কলকাতার উপকণ্ঠে কোথাওই বাংলার একটি লেকচারারশিপ জোগাড়ই করে দিতে পারলাম না। এত বছরেও। আমি কোনোই কাজের নই।

আমার কত সহকর্মী আছেন যাঁদের কর্মতৎপরতায় আমি বিস্মিত হয়ে যাই। তাঁরা কেউ হলে একাজ কবেই তাঁরা সমাধা করতেন। লোকে কী করে যে ফটাফট নিজেদের নামে জমি অ্যালট করিয়ে বাড়ি করে ফেলে, কী অবলীলায় বউ এবং একাধিক বাচ্চাদের নিয়ে ট্রেনের যাওয়া-আসার রিজার্ভেশন কনফার্ম করিয়ে প্রতিবছর পুজো বা শীতে কাশ্মীর অথবা কন্যাকুমারী ঘুরে বেড়ায় এবং ফিরেও আসে একটিও হাত-পা বা বাচ্চা না-হারিয়ে।

আমি দূর থেকে ওদের প্রণাম করি। এ জগতে কাজের লোকের যে যে গুণ থাকা উচিত আমার সেসবের একটিও নেই।

গ্যাস জোগাড় করা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি চকিতে ডেকে আনা, একদৌড়ে সামান্য টাকাতে গুছিয়ে গাছিয়ে বাজার করে আনা, বাচ্চাকে গান গেয়ে পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়ানো, এসব যে একজন পুরুষের কত বড়ো গুণ তা আমার একেবারেই নেই বলেই আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি।

কাজের মধ্যে একমাত্র বাহাদুরির কাজ যেটি করেছি তা তোমাকে আবিষ্কার করা। সেটা অবশ্য আমার কাছে তাজমহল বানানোর চেয়েও বড়ো কীর্তি। আমার মতো পরনির্ভর অথচ অগণ্য দাবিসম্পন্ন মানুষের পৃথিবীতে আদৌ আসা উচিত ছিল না। আমার সমস্ত পরনির্ভরতা জ্যোতির্ময় স্বয়ম্ভরতায় জ্বলজ্বল করত শুধু যদি তুমি কাছে থাকতে। আমি স্বর্ণলতারই মতো তোমাকে আশ্রয় করে পরমসুখে এ জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিতাম। স্বভাবে আমিই নারী। তুমি নারীর সব নম্রতা ও কোমলতা সত্ত্বেও পুরুষের মতো কাজের। আমার তোমাকে সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল এ জন্মে।

তুমি সবসময়ই এল যে, স্বনির্ভর না হয়ে নিজের বুড়ো বয়সের আখের নিজে না গুছিয়ে নিয়ে তোমার পক্ষে কেবল আমারই ভরসায় দিল্লির চাকরি ছেড়ে এখানে চলে এসে আমার স্কন্ধারূঢ় হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না?

জীবনময়ই তো বুদ্ধিমানের মতো কাজই করলে। একবার না হয় নির্বুদ্ধির ক-টা কাজই করে ফেলতে! চোখ-কান বুজে! সামান্য হলেও আমার তো কিছু প্রভিডেন্ট ফাণ্ড গ্র্যাচুইটির টাকা প্রাপ্য হবে। তার ওপর আমি যতদিনে রিটায়ার করব ততদিনে রাজ্য সরকারও পেনশান-এর বন্দোবস্ত করে ফেলবেন মনে হয়। রিটায়ার করতে তো অনেকই দেরি। তোমারও তো যতটুকুই হোক পুঁজি কিছু থাকবেই। দুজনের সঞ্চয় এবং আয় মিলিয়ে কি চলে যেত না আমাদের। তুমি কাছে থাকলে আমি পেটে না-খেয়েও থাকতে পারতাম। পেটের খিদে ছাড়াও তো মানুষের অন্যরকম খিদে থাকে। সময়ে খিদে না মিটোতে পারলে শেষবেলায় পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে খেতে দিলেও তখন আর খাওয়া যায় না। খিদে মরে যায়। অম্বলের ব্যথা ওঠে। এত বোঝো, আর এটুকু বোঝো না তুমি?

আমার এক সহকর্মী প্রণবেশ বলছিল শান্তিনিকেতনে এইবেলা সস্তায় কিছু জমি কিনে রাখতে। যাতায়াতের এখন খুবই সুবিধে। সেকেণ্ড ক্লাসের ভাড়া এখন বেড়ে বেড়েই চব্বিশ টাকা হয়েছে। আগে আরও কম ছিল। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গায়ক অর্ঘ্য সেন, নাট্যজগতের কুমার রায়, টপ্পাগায়ক চন্ডীদাস মাল মশায় এবং আরও অগণ্য নামি ও অনামি মানুষ জমি কিনে বাড়ি করেছেন এবং করছেন ওখানে। ওখানের সব নামিদামিরা তো আছেনই! অবশ্য এখন আর ভালো জায়গাতে জমি কেনার সামর্থ্য আর আমাদের হবে না। প্রান্তিক স্টেশানের কাছাকাছি যদি দু-তিন কাঠা জমিও সস্তাতে পেতাম তাহলে নিয়ে রাখতাম। পরে, ছোট্ট একটা বাড়ি করে নিতাম। নিজে হাতে বাগান করতে তুমি। আমি বসে বসে ফুলের শোভা দেখতাম। আর তোমার শোভা। ওদিকে দাম নাকি এখনও ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে আছে।

আমার মতো প্রচন্ড নিষ্কর্মা লোকের পরকর্মজনিত আনন্দ যে ঠিক কী প্রকার তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। দিল্লি থেকে আসার সময় তুমি বেশ তোমার গাড়োয়ালি খিদমদগার কেশর সিংকে সঙ্গে নিয়ে আসতে। শান্তিনিকেতনের জব্বর শীতে যখন অগণ্য মানুষ পৌষমেলা বা মাঘোৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে আনন্দর খোঁজে ছুটত তখন আমি শুধু আরামে তোমার নিয়ে-আসা হিমাচলপ্রদেশের কম্বল গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতাম। তুমি নিজে হাতে চা করে আনতে আমার জন্যে। আঃ। ভাবতেই কী যে ভালো লাগে কী বলব।

এক একজনের আনন্দর রকমটা এক একরকম। কুঁড়েমি করে অথবা কিছুমাত্রই না করে আমি যে কী গভীর আনন্দ পাই তা তোমাকে ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। তা ছাড়া দৌড়োদৌড়ি করে আনন্দ করার বয়েস এখন আর নেই। এখন ইজিচেয়ারে শুয়ে ভাবতে কি কোনো ভালো বই পড়তে যা আনন্দ পাই কাশ্মীর কন্যাকুমারী দেখে তা পাব বলে মনে হয় না।

বাট্রাণ্ড রাসেল-এর একটি বই আছে না? পড়েছ কি সে বই? In Praise of idleness. মহৎ মানুষ তিনি। তাই কুঁড়েমির মূল্য বুঝেছিলেন।

এ চিঠি পেয়েই আমাকে লিখো। তোমার সাড়া পাওয়ামাত্রই প্রণবেশের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এক শনিবার চলে যাব জমি দেখতে। বাড়ি হোক কি নাই হোক, আমাদের। মতো মধ্য এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের বাড়ির জন্যে জমি দেখার মধ্যেও যে কী প্রকার এক ধরনের বড়োলোকি-ভাব সুপ্ত থাকে তা তুমি কি অনুমান করতে পারো?

শান্তিনিকেতনে শেষ গেছিলাম কলেজে পড়ার সময়ে। একবারই গেছিলাম। তাও, যাহা শেষ তাহাই প্রথম। গেছিলাম বসন্তোৎসবে। কলেজের চার বন্ধু মিলে গেছিলাম। একজন বন্ধুর অধ্যাপক কাকার বাড়ি দুপুরের খাওয়া, অন্যর লেখিকা দিদার বাড়ি রাতের খাওয়া এবং অন্যতর বন্ধুর আর্টিস্ট ব্যাচেলার মামার বাড়ি, নীচুবাংলার কোয়ার্টারের মেঝেতে শুয়ে রাতটা কাটানো হয়েছিল। শাল ফুলের গন্ধ, পূর্ণিমার চাঁদ, আর আমাদের কচিচোখে নৃত্য গীতরতা আমবাগানে আর শালবীথিতে ঘুরে বেড়ানো কচি-মেয়েদের মুখের ছায়া বুকে করে বাদুড়-ঝোলা ঝুলতে ঝুলতে পরদিনই ফিরে এসেছিলাম অসহ্য ট্রেনে চেপে। সেই শান্তিনিকেতনেই সেই যুযুধান রায়ই যে, তার নিজের এবং নিজস্ব হবু-স্ত্রী যূনীর জন্য বাড়ি করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জমি দেখতে যাবে এই ভাবনাতেই যুযুধানের চিত্ত বড় অস্থির হয়ে রয়েছে। কী যে উত্তেজনা! তা বুঝিয়ে বলতেও পারব না।

যূনী, তুমি কি একবার শান্তিনিকেতনে জমি দেখার জন্যও আসতে পারো না? রাজধানী এক্সপ্রেসে এসে রাজধানী এক্সপ্রেসেই না হয় ফিরে যাবে? সব খরচা আমার। এতটুকু করার ন্যূনতম স্পর্ধাও তো আমার থাকা উচিত তোমার ভাবী জীবনসাথি হিসেবে।

না কি?

ভালো থেকো। আমার জন্মদিনে অনেক আদর ও ভালোবাসা জেনো।
ইতি তোমার যুযুদা

.

০৪.

যুযুধান রবিবারের সকালে রসিয়ে রসিয়ে দু-কাপ চা খায়। দুটি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে। শ্ৰীলা মেয়েটি বড়ো ভালো। সে যে যূনীর আত্মীয়া বলেই যুযুধানকে এক বিশেষ চোখে দেখে তা নয়, যুযুধানের ছোটোভাই অমলের ওপরেও যেন ঠিক নির্ভর করতে পারে না।

খোকা আসার পর শ্রীলার দায়িত্ব, চিন্তা, ভাবনা ঠিক যে হারে বেড়েছে, অমলের দায়িত্ব কর্তব্যও যেন ঠিক সেই হারেই কমেছে। এই অসহায়তার মধ্যে যুযুধান বুঝতে পারে যে, শ্রীলা ক্রমশই যুযুধানের ওপরে বেশি নির্ভর করতে শুরু করেছে। একথাটা বুঝতে পেরে যুযুধান যেমন খুশি হয়, তেমন অখুশিও হয়।

অমল পড়াশোনাতে কোনোদিনও ভালো ছিল না। টুকে-টাকে পাস করেছে চিরদিনই। তারপর বি কমটা যে কী করে পা করল তা সে-ই জানে। চাকরি একটা যুযুধানই গলবস্ত্র হয়ে অনেককে অনুরোধ করে জুটিয়ে দিয়েছিল। এক বাঙালি ব্যাবসাদারের ফার্মে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টের। হলে কী হয়, অর্ধেক দিনই অফিসে যায় না। নিজের খাটনির হিসেব না রাখলেও মালিকের আয়ের হিসেবটা ঠিকই রাখে এবং সবসময়ই বলে, ও শালা আমাকে যা মাইনে দেয় তার চেয়ে বেশি কাজ করে দিই।

কিন্তু যে মাইনে ও পায় সেই মাইনেতেই যে, ওর চেয়ে অনেক ভালো এবং খাঁটিয়ে ছেলে চাকরিটা পেলে বর্তে যায় চাকরিটা পাবার পর সেকথাটাই আর একবারও মনে রাখে না। ফাঁকি মারা, দেরিতে অফিস যাওয়া এবং কামাই করাটাকেই চালাকির পরাকাষ্ঠা বলে মনে করে।

এই করেই চোখের সামনে একটা পুরো জাত নষ্ট হয়ে গেল। অনেকই কারণ হয়তো আছে তার পেছনে। সবচেয়ে বড়ো কারণ এই শ্রমবিমুখতা, ওপর-চালাকি।

যুযুধান নিজের ভাইয়ের ব্যাপারেই কিছু বলার অধিকার রাখে না, জাত-টাত তো অনেকই বড়ো ব্যাপার। একটা জিনিস লক্ষ করে এই দুঃখের মধ্যেও আনন্দিত হয় ও। সেকথাটা হল, বাঙালি ছেলেরা যে হারে ফাঁকিবাজ, অলস, নেশাগ্রস্ত, মদ্যপ, পরশ্রীকাতর হয়ে উঠছে, বাঙালি মেয়েরা যেন ঠিক সেই হারেই পরিশ্রমী, দায়িত্ববতী, কর্তব্যজ্ঞানসম্পন্না হয়ে উঠেছে। যে-কোনো জাতের যখন পতন ঘটে তখন এই সমস্ত লক্ষণ সব জাতের মধ্যেই পরিস্ফুট হয় বোধ হয়। বাঙালি পুরুষ হিসেবে এ কারণে বড় লজ্জাবোধ করে যুযুধান।

ইদানীং অমল কিছু ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করছে যাদের যুযুধান ভালো বলে মানতে পারে না। তারা যে ঠিক কী করে জীবিকা হিসেবে, যুযুধানের আদৌ জানা নেই। তবে, তারা প্রায়ই ফ্যান্সি-মার্কেটে যায়। খিদিরপুরের মুসলমান স্মাগলারদের কাছে যায়। হাতে প্রচুর কাঁচা পয়সা। শ্ৰীলার জন্যে বিদেশি সাবান, পারফিউম, ব্রেসিয়ার, প্যান্টি, জর্জেট শাড়ি এসব নিয়ে আসে। ও নাকি একটি মোটর সাইকেলও বুক করেছে। কোত্থেকে টাকা পায় তা অমলই জানে।

বাড়িতে ও সবসুদ্ধ তিনশো টাকা দেয়। বাকি সব খরচ যুযুধানের। অথচ অমলরাই তিনজন লোক! যুযুধান তো একা।

কিছুই বলে না যুযুধান। ভাবে, একটাই তো ভাই! তা ছাড়া নিজের বিয়ে কখনো হবেই যে, এমন স্থিরতাও নেই। ছোটোভাই আর তার পরিবারকেই তাই আপন করে নিয়েছে।

খোকাটা জেতু জেতু করে টালমাটাল পায়ে ওর কাছে যখন আসে তখন ওর মুখের দুধের গন্ধ, স্বর্গীয় হাসি, যুযুধানের মনের কোণের সব বিরক্তিই উড়িয়ে দেয়। সব শিশুরাই স্বর্গের বাগানের শিশু। এ পৃথিবীর কোনো মালিন্য কোনো কুটিলতা বা চক্রান্তের মধ্যেই ওরা নেই। কিছুক্ষণ ওদের কাছে থাকলে নিজের মনই পবিত্র হয়ে যায়। ওরা সব দৈবী-রাজা।

এখন সকাল আটটা বাজে। শ্রীলা এসে বলল, খোকা! জেতুকে বিরক্ত কোরো না। তারপর বলল, দাদা আজ রামের সুমতি হয়েছে। আপনার ভাই বলেছে, বাজারে যাবে। আপনি কী ভালো মাছ খাবেন জিজ্ঞেস করে পাঠাল। ইলিশ? না বড়ো কই? না চেতলের পেটি?

মাছ? ভালো? অবাক হয়ে যুযুধান বলল, আজকাল ভালো মাছের দাম তো আশি টাকা কেজি।

ও তা জানে। তবু বলেছে দাদা কী মাছ খাবে জিজ্ঞেস করে এসো। একদিন খাওয়াবে।

মাছ-টাছ আনতে হবে না। এল কাতলা মাছের মাথা নিয়ে আসুক। মুড়িঘণ্ট করো। মাছও হবে, সস্তাও হবে।

ও কিন্তু মাছের দামের কথা জানে। একদিন শখ করে বলেছে, না করবেন না দাদা। মনে দুঃখ পাবে।

ঠিক আছে। চেতল মাছ আনতে এল। তেলওয়ালা-পেটি। কত্তবছর যে খাই না। আজ মাসের পঁচিশ তারিখ। চাকুরেদের বাড়িতে হঠাৎ কীসের মোচ্ছব লাগল? ওকি কোনো বোনাস-টোনাস পেয়েছে? অসময়ে?

তা আমি জানি না দাদা। শ্রীলা বলল, সেসব আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করবেন।

খবরের কাগজের পাতায় মনোনিবেশ করল যুযু, শ্রীলা চলে গেল।

শ্রীলা মলিন মুখে চলে গেল। ভাবল দাদার মন ভারি ছোটো। ছোটোভাই আদর করে মাছ খাওয়াবে বলল তাতে এত জেরা কীসের? অবশ্য মাসের শেষের রবিবারে হঠাৎ কীসের মোচ্ছব, কোন কামাই-এর জোরে? একথা যে শ্রীলারও একবার মনে হয়নি তা নয়। তবে শ্ৰীলাও অন্য যেকোনো গড়পড়তা মেয়েরই মতো। টাকা পেলেই ওরা খুশি। সে টাকা কোত্থেকে এল তা নিয়ে ওদের মাথাব্যথা নেই।

যুযুধানের কগিল শুভব্রতর যে কারণে চাকরিটাই গেল। ভালো ছেলে ছিল চিরদিনই। অভাব বলতেও তেমন কিছু ছিল না কিন্তু প্রতিবেশীদের যা আছে সবই আমার চাই এই মনোভাবের কারণেই ওর অবুঝ অশিক্ষিত বউ-এর জন্যেই শেষে চাকরিটাই চলে গেল বেচারির।

পিয়ারলেসের এজেন্ট হয়েছে এখন। মাঝে মাঝে আসে অফিসে। কিন্তু যারা ট্যাক্স দেয় তাদের পিয়ারলেসের পলিসি নিয়ে তো লাভ নেই। কোনো ছাড়ই পাওয়া যায় না। তাই যুযুধান শুভব্রতকে সাহায্য বিশেষ করতে পারে না।

.

ভারি ভয় করে যুযুধানের অমলের জন্যে। জীবনের যে সময়ে নিজের দিকে তাকাতে বড়ো ইচ্ছে করছে, যূনীকে ঘিরে যখন অনেকই কল্পনা, তখনই ওর মন অমলের কারণে বড়োই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। নানারকম অশুভ এবং ভয়ের ভাবনাতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ও জড়িয়ে ফেলছে নিজেকে। ভাইয়ের কর্মের ওপরে ওর তো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু কর্মফলের বোঝা তাকে বিলক্ষণই বইতে হবে যে, সেকথা ও জানে।

মনে মনে বলল, একদিন অমলের সঙ্গে বসতে হবে। কিন্তু তার তো চেহারাই দেখতে পায় না। কবে বসবে? কখন?

এমন সময় কে যেন খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ল। এই গলিতে মাত্র একটি বাড়ি ছাড়া কোনো বাড়িতেই কলিংবেল নেই। দেওয়ালের পুরোনো ঘড়িটা সময় দেখাচ্ছিল সাড়ে আটটা। রবিবারের এই সময়টুকুতে তাকে কেউ বিরক্ত করুক এটা চায় না যুযুধান। কিন্তু কে আসতে পারে এই অসময়ে?

নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে বিরক্তমুখে দরজা খুলল।

কী রে? তুই?

এলাম। তুই এতজনকে পেয়াদা লাগিয়েছিলি যে, না এসে কী করি। পরশু ইনকামট্যাক্সে যেতেই প্রায় পাঁচজন তোর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিল। সরি যুযু। ফোনে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসা সম্ভব হল না। তা ছাড়া আমার নিজের তো ফোন নেইও।

ফোনের কথা আর বলিস না। গত ছ-মাস ধরেই খারাপ। মাঝে একদিনের জন্যে ভালো হয়েছিল। জাস্ট কুডনট কেয়ারলেস অ্যাটিচ্যুড। আমাদের আত্মসম্মান, লজ্জা, এসব ব্যাপার সত্যিই লোপ পেয়ে গেছে। জেনারেল ম্যানেজারকে ফোন করে কখনো ফাঁকা পাওয়া যায় না। মিটিং-এ থাকেন নয়তো কনফারেন্সে। হতেই পারে। সব অর্গানাইজেশানের বড়োসাহেবরাই মিটিং আর কনফারেন্সেই থাকেন। কিন্তু তাঁর পি এ-ও যে মিথ্যা নাম বলে আমার মতো নির্বিরোধী লোককেও অপমান এবং বিভ্রান্ত করতে পারেন এটাও অভাবনীয়। এইরকম অভদ্র ও অন্যায্য রসিকতা সত্যিই অভাবনীয়।

তুই একটা ইডিয়টই আছিস মাইরি। ফোন খারাপ তো জেনারেল ম্যানেজার কী করবে? তাঁরা বড়ো আমলা। মিটিং, কনফারেন্স নিয়েই তো থাকেন। পরের প্রমোশান। ওদের কত কী করার আছে। তুই তোর পাড়ার টেলিফোনের অফিসে লোক ঠিক করিসনি?

সেটা আবার কী?

যাঃ বাবা! রামরাজত্বে বাস করিস তা বেঁচে থাকার ঘোঁৎঘাটুকুও শিখিসনি? তাদের যদি মাঝেমধ্যে কিছু না দিস তাহলে তোর ভালো টেলিফোনও খারাপ করে দিয়ে যাবে এসে। সব এক্সচেঞ্জেই এই ব্যাপার। মাইনেটা তো উপরি। এইসবই তো আসল রোজগার। কলকাতায় অগণ্য ব্যাবসাদার আছেন, যাঁরা এখন কলকাতার মালিক। তাঁরা ভারতবর্ষের সব জায়গাতেই দিনে রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছেন। মাসশেষে কিড়িং-কিড়িঙের লোক এসে মাইনে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের বিল চাপছে তোর আমার ঘাড়ে। ফাসকেলাস চলছে মাইরি দেশটা।

যুযু বলল, আমার এক কলিগ গ্রামাঞ্চলে এক ছোট্ট নতুন বাড়ি করেছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের আণ্ডারে সে জায়গা। প্রথম প্রথম বিল আসত মাসে পনেরো কুড়ি টাকা। তিন মাসের বিল আগাম। এবারে এসেছে প্রতিমাসে চারশো টাকা করে। তাও আগাম তিন মাসের। অথচ বাড়িতে মালি ছাড়া কেউই থাকে না। মিটার নাকি বাড়ি তৈরি হওয়ার পর থেকে একদিনও কেউ পড়তেই আসেনি গত দেড় বছরে সে কী করে হয়?

হয়। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে খবর নিয়ে দেখবি যে, ওঁরা তিন মাসের আগাম বিলই পাঠান। ওঁরা গন্ধ শুঁকেই বলতে পারেন কার কত বিল হতে পারে। বিশেষ করে ফাঁকা বাড়িতে। যে ম্যান-পাওয়ার মিটার-রিডিং করে নষ্ট হবে সেই ম্যান-পাওয়ার অন্য কনস্ট্রাকটিভ কাজে লাগানো হচ্ছে। স্টেট গভর্নমেন্টের কর্মচারীদের তো অসহ্য কাজের চাপ।

বলেই, সোম বলল, সরি। তুইও তো স্টেট গভর্নমেন্টের।

তাতে কিছু নয়। একথা আমি অস্বীকার করব না যে, আমাদের বড়ো বড়ো আমলা থেকে কেরানিরাও, কাজ অধিকাংশ মানুষই করেন না। কাজ করাটা পশ্চিমবঙ্গে এখন ফ্যাশানেবল নয়। তাইতো রাজ্যের এমন অগ্রগতি।

সোম বলল, তাই তো বলি, হয় চুপচাপ সব সহ্য করে যা, নয় প্র্যাকটিকাল হ। অন্য দশজন, যা করে, তাই কর। তালে তাল দে। মহৎ বুদ্ধিজীবী বলে সবরকম নীচতার বেসাতি কর।

প্রণব বলছিল, যুযুধান বলল।

প্রণবটা কে? সোম বলল।

আরে আমার কলিগ, যার গ্রামের বাড়ির কথা বলছিলাম।

ও। কী বলছিল?

বলছিল, ওর মালির কাছে নাকি পুজোর আগে চাঁদা চাইতে এসেছিল ইলেকট্রিক অফিসের মিস্তিরিরা। মালি বলেছিল, বাবু তো এখানে থাকেন না। এবারে পুজোর সময়েও আসবেন না। যখন আসবেন তখন আপনারাও আসবেন। বাবু লোক খারাপ নন। চাঁদা নিশ্চয়ই দেবেন আপনাদের। মালি বলছে, এই রাগেই মাসের বিল চারশো টাকা করে দিয়েছেন ওঁরা প্রতিমাসে। এই নইলে অ্যাডমিনিস্ট্রেশান। পৃথিবীর কোনো অসভ্য দেশেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। আমরা সবাই সহ্য করে যাই, তাই এই অবস্থা। এমন লজ্জাকর দৃষ্টান্ত বড়ো বেশি নেই। নিজেকে বাঙালি বলে ভাবতেও লজ্জা করে।

এর কারণ পোলিটিক্যাল…….

কারণ নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কেন? যেটা ঘটনা, সেটাই বলছি। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টও সেরকমই। টেলিফোন তো চিরদিনই এমন। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েই বসে আছেন তাঁরা। কাজ করত দুটি ডিপার্টমেন্ট। স্টেটের ফায়ার ব্রিগেড আর সেন্ট্রালের পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট। সেই পোস্টাল ডিপার্টমেন্টও গোল্লায় গেছে। তবে ওঁদের প্রতি খুব অন্যায়ও করা হয়েছে। ওঁদের দায়িত্ব কর্তব্য অনুযায়ী যা মাইনে পাওয়ার কথা তা কোনোদিনই পাননি। আর এদিকে ব্যাঙ্ককে দ্যাখ। সারাদিন প্রায় পিকনিক করেও শহরের ন্যাশানালাইজড ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের মাইনে কীরকম। কোনো প্যারিটি নেই, যোগ্যতার, শ্রমের অ্যাপ্রিসিয়েশান নেই। এমন করেই তো কাজের লোকও নিষ্কর্মার ধাড়ি হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে এই ক্যাওটিক সিচুয়েশানে পড়ে। কী খাবি সোম?

যা খাওয়াবি। তুই একা থাকিস? বিয়ে করিসনি?

না।

কেন? এত বয়েসেও? কোনো রহস্য?

না। ছোটোভাই আছে। বিয়েও করেছে। ছেলেও হয়েছে একটি।

বাঃ। তবে তো সংসার আছেই, স্ত্রী না থাকলেও।

তা আছে। আর তোর?

আমি? আমার সংসারী হতে হতেও হওয়া হল না।

কীরকম?

জানিস তো, বাবা রিফুজি হয়ে এসেছিলেন। একটি সলিসিটরস ফার্মে অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক ছিলেন। তাও মারা গেলেন যেদিন আমি চাকরিতে জয়েন করি তার তিনদিন পরেই! এক দিদির বিয়ে বাবাই দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিন বোন ছিল আমার ভাগে। তাদের সবাইকে এক এক করে গ্র্যাজুয়েট করিয়ে বিয়ে দিলাম।

ভগ্নীপতিরা কী করে?

প্রথমজন ওভারসিয়ার ছিল। কিন্তু হাতের রেখা খুব ভালো। মালটিস্টোরিড বিল্ডিং-এর ব্যাবসা করে সে এখন প্রায় কোটিপতি!

বাঃ।

দ্বিতীয়জন ন্যাশানালাইজড ব্যাঙ্কে আছে। এখন অফিসার। গাড়ি কিনেছে। নাটক করে বেড়ায়। ব্যাঙ্কে আড্ডা মারতে যায় রোজ কিছুক্ষণের জন্যে। সেও আছে ভালো। আমার ওই বোনও নাটক করে। ওদের জীবনযাত্রাও বেশ নাটুকে। নিয়মিত মদ্যপান করে। আস্তে আস্তে হাই-সোসাইটিতে উঠছে। জীবনের পরমলক্ষ্য তাই।

আর তৃতীয়জন?

সে ব্যাটা একটা ইডিয়ট। সি এম ডি এ-র ইঞ্জিনিয়র। কিন্তু এক পয়সাও বানায়নি। যখন ছোকরা ছোকরা ইঞ্জিনিয়াররা সব সল্টলেকে, বাঁশদ্ৰোণীতে বাড়ি করে ফেলেছে, রেস-এর মাঠ আর নানা নেশায় উড়ে বেড়াচ্ছে তখন সুবোধের আমার সংসারই চলে না। চুচুড়োতে বাড়ি। বিধবা মা এবং একটা ছোটো ভাই-বোন নিয়ে থাকে। কিন্তু তোকে কী বলব যুযু, সবচেয়ে শান্তিতে আছে আমার ওই ছোটোবোন, রমা। সতোর কোনো বিকল্প নেই, বুঝলি। চারদিকে যাই দেখি না কেন আমরা, শুনি না কেন, টাকাটা সকলেরই দরকার নিশ্চয়ই, কিন্তু টাকা শান্তি দিতে পারে না যুযু। আমি ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের লোক ছিলাম। টাকাওয়ালা লোকদের সঙ্গেই কারবার ছিল। অর্থই যে অনর্থের মূল এ সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্রই সংশয় নেই।

যুযু বলল, বড়ো বেশি কথা হচ্ছে। তোকে কিছু খেতে দিতে বলি। তারপর চা খা। দুপুরেও খেয়ে যা এখানে। আজ পশ্চিমদিকে সূর্য উঠেছে, আমার সহোদর অমলচন্দ্র বাজারে গেছেন। বলেই ডাকল, শ্রীলা।

দোতলা থেকে জবাব দিল শ্রীলা, আসছি দাদা।

পচার মাকে ডেকে যুযু বলল, আমাদের দুজনকেই জলখাবার দিয়ে।

শ্রীলা এলে বলল, এই যে আমার স্কুলের বন্ধু সোম। সোম ব্যানার্জি। আর এই আমার ভ্রাতৃবধূ শ্রীলা।

সোম দাঁড়িয়ে উঠে বলল, বাঃ বাঃ। তোমাকে যে-কেউ যখন তখন বিয়ে করতে পারে বোন। তুমিই হচ্ছ আইডিয়াল বাঙালি বউ। রাঁধতেও জানো, গানও গাও, স্বামীর কাছে কিছু দাবিও নেই। দুটি খেতে-পরতে দিলেই যথেষ্ট। এমন বউ বাংলার ঘরে ঘরে তোক।

শ্রীলা হাসবে কি না ভেবে বোকার মতো একটু হাসল।

যুযু বলল, সোমও আজ দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে শ্রীলা। এই বলার জন্যেই ডাকা তোমাকে।

.

শ্রীলা বলল, খুব ভালোকথা।

শ্রীলা চলে যেতেই যুযু বলল, তুই একটু বোস। আমি আসছি।

ভেতরে গিয়ে সিঁড়ির মুখে ধরল ও শ্রীলাকে। বলল, কিছু মনে কোরো না। ওর চাকরি চলে গেছে। তাই মাথায় একটু গোলমাল মতো হয়েছে। মনে করোনি তো কিছু? এরপরেও যদি কিছু বলে তো মনে কোরো না।

যুযু বসবার ঘরে ফিরে এলে সোম বলল, ভ্রাতৃবধূকে বলে এলি?

কী বলে আসব?

এই! আমার মাথার গোলমাল আছে। ঘুস খেয়ে চাকরি গেছে।

যুযুধান অবাক হয়ে গেল। বলল, কী যা-তা বলছিস।

ঠিকই বলছি। তবে বলে ভালোই করেছিস।

যুযু মাথা নামিয়ে নিল।

তারপর বলল, তোদের এই ফিফটিসিক্স-জেটা কী জিনিস?

ওরে বাবা। সে এক সাংঘাতিক জিনিস। সংবিধানের একটি ধারা এটি। এর বলে প্রেসিডেন্ট অফ ইণ্ডিয়া যেকোনো অসৎ, অক্ষম, অকার্যকর সরকারি চাকুরের চাকুরি যখন তখন খেয়ে নিতে পারেন। অনেক লোকেরই চাকরি গেছে এই ধারার গিলোটিনে। শুনেছি তাদের মধ্যে কারও কারও অসতোর বদনামও ছিল। আমারও ছিল বদনাম। তবে ঘুস খাবার নয়। অপ্রিয় সত্য কথনের। আমার ঘুসখোর ওপরওয়ালারা আমাকে কোনোদিনও দেখতে পারতেন না। পারতেন না বহু ইনফ্লুয়েনশিয়াল অ্যাসেসি। অনেক কলিগও। তবে চাকরিটা যে ঠিক কী করে গেল সেকথা তোকে বলব বলেই আসা। তুই তো সাহিত্যিক, ইচ্ছে করলে তুই আমাকে নিয়ে মস্ত বড়ো একটি উপন্যাস লিখতে পারবি। প্লট দেব তোকে।

যুযু বলল, আমার নিজের মাথাতেই যেসব প্লট জমে আছে তা লিখতে একটি জীবনের ওপর আর একটি জীবন দরকার। অন্যের প্লট নিয়ে কী করব বল? তবে তোর কথা শুনতে কোনো আপত্তি নেই। জীবনের মাপ বড়ো হবে তাতে।

বাঃ। বেশ বলেছিস। জীবনের মাপ!

পচার মা চিড়েভাজা আর ওমলেট নিয়ে এল।

যুযু বলল, নে সোম। শুরু কর।

হ্যাঁ। ভালোই হল। কাল রাতে খাওয়াই হয়নি। খিদেও পেয়েছিল খুবই।

কেন? খাওয়া হয়নি কেন?

ওই। ইচ্ছে করল না। কে আর রাঁধেবাড়ে বল? সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবার পর। আমার একটা কাজ দরকার। যে কাজে অনেক পরিশ্রম কিন্তু যে কাজে অন্যায় করে একজন মানুষের ঘাড়ে চুরির কলঙ্ক চাপানো হয় না।

চা কি আনব? পচার মা বলল।

হ্যাঁ নিয়ে এসো। যুযু বলল।

এটা খেয়ে নিয়েই কি তোকে বলব গল্পটা যুযু?

এত তাড়া কীসের? তুই তো সারাদুপুরই থাকবি আমার কাছে, নাকি?

বেশ কিছুক্ষণ সোম যুযুর চোখে চেয়ে রইল চিড়ে ভাজার বাটিটা নামিয়ে রেখে। তারপর বলল, আমার সঙ্গে কত বছর পরে তোর দেখা হল রে?

তা প্রায় তেইশ-চব্বিশ বছর হবে।

নো-ডাউট। দীর্ঘ সময়। আসলে যদি যোগাযোগ না থাকে তবে স্কুলের বন্ধুরা স্কুল থেকে বেরোবার পর এতখানিই বদলে যায়, মানে বদলে গেছে বলে মনে হয় যে, একে অন্যকে মেনে নিতে, বিশ্বাস করতে বেশ একটু সময় লাগে। তাই না? এটাই স্বাভাবিক। স্কুলে, যে মুখচোরা ছিল সে দুর্দান্ত মুখর উকিল হয়ে ওঠে। স্কুলে, যে পড়াশোনায় মেধাবী ছিল সে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে থার্ড ক্লাস পায়। যে গরিব পরিবারের ছিল সে এই ব্যবধানে প্রচন্ড বড়োলোকের পরিবারভুক্ত হয়ে যায়। যে সৎ, সে অসৎ; যে অসৎ, সে সৎ। তেইশ বছর। সময়টা মানুষের জীবনে বড়ো কম সময় নয়। কী বল?

হঠাৎ এসব কথা?

যুযু বলল।

হঠাৎ নয়। তোর ও আমার দুজনকে দুজনের আরও ভালো করে জানা উচিত। আমি চাই না যে, এই বয়েসে এসে, এত মার ও পোড় খাবার পরও তুই আমার কাছে বা আমি তোর কাছে কোনোরকম সন্দেহ দুজনের মধ্যে রেখেই পুরোনো সম্পর্ককে আবার জোড়া লাগাই।

কীসের সন্দেহ? তুই কী বলছিস?

আমি জানি যে, তুইও জানিস যে, আমি কী বলছি। আজ আমি উঠব।

সে কি রে? সোম। তুই কিন্তু …

চা নিয়ে এল পচার মা।

চা খাবি না?

কেন খাব না? চা খেয়েই যাচ্ছি। আমি তো ঝগড়া করে যাচ্ছি না, ভালোবেসেই যাচ্ছি। তুই একদিন আমার কুদঘাটের বাড়িতে আসিস। এই আমার কার্ড। দাঁড়া শালার ডেসিগনেশানটা কেটে দিই আগে। হ্যাঁ। তুই এলে, আমার পারিপার্শ্বিকে আমাকে দেখলে, তারপর আমাকে বুঝতে সুবিধে হবে। তোর স্কুলের বন্ধু সোমকে বিশ্বাস করতে সুবিধে হবে।

বলেই, চায়ের কাপটা ঠকাস করে তেপায়াতে নামিয়ে রেখেই বলল, চলি রে!

উঠে দাঁড়িয়েই কী যেন বলবে বলে তাকাল যুযুর দিকে। যুযুও দাঁড়িয়ে উঠেছিল।

সোম বলল, তোর ভ্রাতৃবধূ শ্রীলাকে বড়ো ভালো লাগল। ওকে কোথায় যেন দেখেছি আগে। কে জানে! স্বপ্নেও দেখে থাকতে পারি। তবে দেখেছি নিশ্চয়ই। যাক। ভাববার চেষ্টা করব কোথায় দেখেছি আগে। ভাবব। চলি রে।

দরজায় দাঁড়িয়ে সোম বলল, যদি আসিস তো সন্ধের দিকে আসিস। সারাটাদিন চরেবরেই বেড়াই। আর শোন শ্রীলাকেও বলিস কথাটা।

কী কথা?

যে, ওকে আগে আমি দেখেছি। কোথায় যে, তা মনে করতে পারছি না। ওকেও একটু ভাবতে বলিস। ওর বাঁদিকের বাহুতে তিনটি কালো তিল আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে পারবি? ওঃ সরি। তুই তো ভাসুরঠাকুর। তাহলে আমিই কোনোদিন। ধস। আমি তো ভাসুরঠাকুরের বন্ধু। তাহলে…দুস শালা। বড়ো কেচাইন হল দেখছি।

সোম যখন চলে যাচ্ছিল তখন তার সুদর্শন তরুণ চেহারা পেছন থেকে দেখতে দেখতে যুযুর মনে হল এ কোন নতুন বিপদে পড়ল ও আবার। প্রার্থনা করল যুযু, সোম যেন আর না আসে কখনো।

.

০৫.

গত পরশু অপরেশদা মারা গেলেন। হয়নি কিছুই। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে হরিশ মুখার্জি রোড পেরোবার সময় মিনিবাস চাপা দিয়ে যায়। মিনিবাস কলকাতাতে রোজই মানুষ চাপা দেয়। সেই পাড়ার মানুষ কয়েক ঘণ্টার জন্য বিক্ষুব্ধ থাকেন। পরদিন সকালে মিনিবাসে করেই অফিসে যান এবং ড্রাইভারকে একথাও বলেন : একটু চেপে চালান দাদা, অফিসে লেট হয়ে যাব। কিছুদিন বাদে অফিস যাওয়ার তাড়ায় অথবা বাড়ি ফেরার, আবার কেউ চাপা পড়ে। চলে এমনি করেই।

কেওড়াতলাতেও গেছিল যুযুধান। ইলেকট্রিক চুল্লিতে খুব ভিড়। বর্ষায় বুড়োবুড়িরা অনেকেই টেসে যান। ঘণ্টাচারেক পরে টার্ন এল। অপরেশদা যুযুধানের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো ছিলেন।

ডানলপে কাজ করতেন। ঢুকেছিলেন রাঘব বোসের আমলে, রাঘব বোস যখন চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট। পরে তো ফিন্যান্স ডায়রেক্টরও হয়েছিলেন। সায়েবরা তখনও ছিল। তারপর ঘন ঘন মালিকানার হাত বদল হওয়াতে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও একটু চিন্তিত ছিলেন। সেইসব কথা ভাবতে ভাবতেই বোধ হয় রাস্তা পেরোচ্ছিলেন। দেরি করে বিয়ে করেছিলেন। ছেলেটা এবার ক্লাস টেন-এ উঠেছে।

ইলেট্রিক চুল্লির লোহার পাল্লাটা তুলতেই লাল গরম আগুনের মধ্যে যখন বাঁশের চালির ওপরে শুইয়ে-রাখা অপরেশদাকে ঠেলে দেওয়া হল ছেলে মুখাগ্নি করার পর, তখন ঠিক পাশে দাঁড়ানো যুযুধানের অপরেশদার জন্য যতটা না কষ্ট হল তার চেয়ে অনেকই বেশি কষ্ট হল ওর নিজেরই জন্যে। হঠাৎই একথা মনে হল যে, এই ইলেকট্রিক চুল্লিই জীবনে সবচেয়ে বড়ো সত্য। ও-ও আর পাঁচটি বছরের মধ্যে অথবা তার আগেই এখানে ঢুকে যেতে পারে অবলীলায় অথচ এ জীবনে করার মতো কিছুই করা হল না। শুধু পাঁয়তাড়া করেই জীবন গেল। মহড়াই সার। নাটক আর মঞ্চস্থ হবে না।

ওর খুব খারাপও লাগতে লাগল এ কথা ভেবে যে, মৃতের প্রতি শোক না জানিয়ে ও নিজের কারণে শোকমগ্ন হয়ে উঠল নীচ স্বার্থপরের মতো। প্রতিবেশী এবং অপরেশদার আত্মীয়রাও কতক্ষণে কাজ শেষ হবে সেই অপেক্ষাতে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন। প্রত্যেকেরই কাজ আছে। অপরেশদা যখন চুল্লির ভেতরে যাবার জন্য লাইনে শুয়ে অপেক্ষা করছিলেন তখনও খুব কম মানুষই তাঁকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মানুষের মৃত্যুর এত অল্পক্ষণের মধ্যেই যদি অন্য মানুষ তাকে ভুলে যায় তবে জীবনে তো জীবনটুকুই পরমসত্য, মরণটুকুই মিথ্যা। এমনই একটি অনুভূতি হল যুযুধানের মধ্যে।

ইতিমধ্যে অপরেশদার একজন বড়োলোক আত্মীয় এলেন একটি কন্টেসা গাড়িতে করে। সাদা রং কন্টেসা। তাঁকে কখনো দেখেনি পাড়াতে, হয়তো গলিতে গাড়ি ঢোকে না বলেই। তিনি নাকি খুব বড়ো এক্সপোর্টার। তাঁকে দেখে সকেলই অপরেশদাকে ছেড়ে তাঁর কাছে চলে গেলেন। উর্দিপরা ড্রাইভার ফুল নামাল সেলোফেন কাগজে-মোড়া। তিনি বার চারেক নীরবে চাররকম মুখভঙ্গি করলেন। এমন ঘটনার জন্য অনুশোচনা, অনুতাপ, দেরি করে আসার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং অপরেশদা চলে গেলেন বলে দুঃখ। যেকোনো উঁচুদরের পেশাদার অভিনেতার চেয়েও ভালো অভিব্যক্তি ফোঁটালেন চোখে মুখে। তারপর পঞ্চমবার, হতাশার।

হতাশার অভিব্যক্তি ফুটিয়েই তিনি চলে গেলেন।

চলে যখন গেলেন, তখন তাঁর জন্যে যুযুধানের খুবই কষ্ট হল। কারণ আশপাশের অনেকেই বললেন, গাবুদা যেন আমাদের আর অপরেশদাকে ধন্য করে দিয়েই চলে গেলেন।

একজন বললেন, কন্টেসা গাড়ি ফুটোবার আর জায়গা পায় না।

আরজন বললেন, গত মাসে ছেলেটার একটা চাকরির জন্যে গেছিলুম। খালি বাতেল্লা। দুস শালা বড়োলোক আত্মীয় দিয়ে কী হয়!

যুযুধানের মনে হল, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সকলেই বড়োলোক না-হলে দু-একজনের বড়োলোক হবার মতো পাপ এবং ভাগ্য আর কিছুই বোধ হয় হয় না। সে-মানুষ যতই অন্যকে জড়াতে চাক, বুকে চেপে ধরতে চাক, অন্যরা সকলেই ঈর্ষায়, চাপা দুর্বোধ্য অভিযোগ অভিমানে দূরে সরে সরে যায়। মানুষে বড়োলোকের বাইরের সুখটাই দেখে। তার পরিশ্রম, জীবনযাত্রা এবং দুঃখ সম্বন্ধে কোনো খোঁজই রাখে না। বড়োলোক যে ও নিজে হয়নি, এই কথা মনে করে খুবই আশ্বস্ত হয় যুযুধান। গরিব থাকার তুলনায় বড়োলোক হওয়া অনেকই কঠিন তো বটেই; কষ্টেরও।

অপরেশদার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-বন্ধুরাও অপরেশদাকে নিয়ে কোনোরকম আলোচনা করছিল না। আসন্ন লিগের খেলা, টি ভি সিরিয়ালের ভালো-মন্দ, মাছের দর, রাজীব গান্ধির ভবিষ্যৎ, এইসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। গরমের সময়ে যে দুজন কাশ্মীর এবং আলমোড়া রানিখেত-নৈনিতাল বেড়াতে গেছিলেন সপরিবারে, তাঁরা সেই বেড়িয়ে আসার খরচ এবং ছিন-ছিনারির রোমহর্ষক ধারাবিবরণী দিয়ে শবযাত্রীদের মনে শিহরন এবং ঈর্ষা দুই-ই ক্ষণে ক্ষণে অলটারনেটলি জাগিয়ে দিচ্ছিলেন। ওঁদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে, ইচ্ছা করেই ওঁরা অমন করছিলেন। অন্যের মনে ঈর্ষা-উদ্রেক করার মতো গভীর আনন্দ, সর্বস্ব-হৃত বাঙালির আর বড়ো বেশি যে নেই।

যুযুধান অপরেশদার ছেলেকে বলে দাহ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই চলে এল। নিজের মধ্যে হঠাৎই এক ব্যস্ততা অনুভব করছিল। কিছু একটা করতে হবে। ওর নিজের জন্যে খারাপও লাগছিল, যূনীর জন্যেও খারাপ লাগছিল। সময় চলে যাচ্ছে বলে ভীষণভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করছিল।

যুযুধান ঠিক করল, যাওয়ার সময়েই রাজা বসন্ত রায় রোডে প্রণবেশের বাড়িতে একবার ঘুরে যাবে শান্তিনিকেতনের জমির ব্যাপারে ও যে প্রচন্ড সিরিয়াস, সেকথা জানাতে। তারপরই ভাবল, শ্মশান থেকে বেরিয়ে এই পোশাকেই যাওয়াটা ঠিক হবে না। কীসব আগুন-টাগুন ছুঁতে হয়, লোহা ছুঁতে হয়, মিষ্টি খেতে হয়। ওসব অবশ্য এখন কেউ মানেও না, জানেও না; তবে ওদের গলিতে এখনও ওসব রয়ে গেছে। পাড়াতুতো মাসিমা পিসিমারা, জেঠি-কাকিদের জন্যে।

কী মনে করে ঠিক করল, না, এখান থেকে প্রণবেশের বাড়িই যাবে। হেঁটেই এল রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে। কিন্তু প্রণবেশ বা প্রণবেশের স্ত্রী বাড়ি ছিল না। একলাইন চিঠি লিখে এল ওর মেয়ের কাছে আমি কিন্তু জমির ব্যাপারে প্রচন্ড সিরিয়াস। যেদিন বলবে, সেদিনই শান্তিনিকেতনে যাব। প্রয়োজন হলে ছুটি নিয়েও।

বাড়ি যখন ফিরল তখন শ্মশান-যাত্রীরা ফিরে এসেছেন। মাঝে মাঝে মৃদু কান্না শোনা যাচ্ছে। একতলার সিঁড়ির কাছে অনেক জুতো। যুযুধান ঢুকেও চলে এল।

বাড়িতে শ্রীলা ছিল না। ওখানেই গেছিল। যুযুধান চান করতে গেল। একটু গরম জল পেলে ভালো হত। আবহাওয়াটা ঠাণ্ডা এবং খুবই ম্যাজম্যাজে। রাতে ঠাণ্ডাজলে চান করলে জ্বর আসতে পারে। কিন্তু কাকেই বা বলবে এখন! পচার মা নিশ্চয়ই রুটি করছে। রুটি করা বন্ধ রেখে গরম জল করতে হবে, যদি বলে। তাই ঝামেলা বাড়াল না আর। চান সেরেই লুঙ্গি আর বাড়িতে কাঁচা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে যখন ইজিচেয়ারে এসে বসল তখন পচার মা চা নিয়ে এল এবং সঙ্গে তিনটি চিঠি।

বলল, ও মা! এই জোলো আবহাওয়াতে তুমি ঠাণ্ডাজলে চান করলে গো দাদাবাবু।

যাকগে। রান্না করছিলে তুমি। রুটি করছিলে তো! চা যে এনেছ, এই যথেষ্ট।

তার জন্যে কী? ছোটো বউদি-ছোড়দার বাথরুমে তো গিজার লেগে গেছে। বললে না কেন? আমি পেলাসটিকের বালতি করে একবালতি গরম জল এনে দিতাম আপনাকে।

গিজার?

হ্যাঁ! সাদা রঙা। গোল মতো। সুইচ-টিপলেই লাল আলো জ্বলে আর জল গরম হলেই নিভে যায়। এবার থেকে বলবে, যখনই গরম জলের দরকার হবে।

বলব।

পচার মা চলে গেলে চিঠিগুলো তুলে নিল। একটি ইউনিট ট্রাস্টের চিঠি। ডিভিডেণ্ডের সময় এখনও হয়নি। ঠিকানা সংক্রান্ত চিঠি। একটি ইনশিয়য়ারেন্সের প্রিমিয়াম। অন্যটি দিল্লির।

চা-টা খেয়েই যূনীর চিঠিটা খুলল।

দরিয়াগঞ্জ
নিউদিল্লি

যুযুদা,
সেদিন তোমার জন্মদিনে সারা সকাল, দুপুর এবং রাত সাতটা অবধি চেষ্টা করেও তোমার লাইন কিছুতেই পেলাম না। এত খারাপ লাগছে যে কী বলব।

তুমি আমার অনেক অনেক ভালোবাসা ও আদর জেনো। এতই খারাপ লাগছে যে, কিছুই লিখতে ইচ্ছা করছে না।

শান্তিনিকেতনের ব্যাপারে আমার পূর্ণ সায় আছে। তবে যত তাড়াতাড়ি পারো করো। আমার দেখার আদৌ দরকার নেই। তোমার রুচির ব্যাপারে আমার পূর্ণ আস্থা আছে। টাকা লাগলে, পত্রপাঠ জানাবে। তোমার নামেই কিনো। কিন্তু টাকা লাগলে জানাতে একটুও দ্বিধা কোরো না।

জমি কেনা হয়ে গেলে বাপ্পকে দিয়ে প্ল্যান করিয়ে নেব। ও আর্কিটেক্ট। দিল্লি থেকেই পাস করেছে। একটি অহমিয়া মেয়েকে ভালোবেসে বিয়েও করেছে। ভারি চমৎকার মেয়েটি। যেমন সুন্দরী, তেমন সভ্য। সেও আর্কিটেক্ট। অনেকবারই আমাকে ওদের এখনকার গৌহাটির বাড়িতে যেতে বলেছে। তুমি অহমিয়া সংস্কৃতির সঙ্গে কতখানি পরিচিত জানি না, হয়ত একটুও নও, কিন্তু আসল আসাম তো আপার-আসামই। সেখানকার মানুষদের বেশ-ভূষা, আচররণ, বিনয়, রীতি-নীতি এবং সংস্কৃতি আমার যে কী ভালো লাগে কী বলব!

তুমি যাই এল, আমরা বাঙালিরা যতখানি না সত্যিকারের শিক্ষিত এবং সংস্কৃত, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদের বড়াই। বাঙালির মধ্যে সত্যিই সাহিত্য পড়েন, গান শোনেন, পড়াশোনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এমন ক-জন আজকাল দেখো? সে বাঙালি আর নেই! অহম দেশের এবং কলিঙ্গ দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বাঙালিদের চেয়ে কোনো অংশে খাটো তো নয়ই; বরং বড়োই।

জোব-চার্নক সাহেব, সুতানুটি-গোবিন্দপুরে প্রথমেই নৌকো ভিড়িয়ে, বাঙালিদের প্রথমে ইংরিজি শিখিয়ে, জাতটির মাথায় ইংরিজি জ্ঞান আর শিক্ষা সমার্থক এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা যে তৈরি করে দিয়ে গেছেন কবে, সেই মিথ্যে সুপরিয়রিটি-কমপ্লেক্সে পুরো জাতটারই সর্বনাশ হল। এখন ক-জন বাঙালি দেখতে পাও যুযুদা যিনি ইংরিজি এবং বাংলা দুটিই ভালো করে জানেন? বাঙালি বাংলাও ভুলে গেছে; ইংরিজিও। নিজেদের কালচার গুলে খেয়ে, না সরস্বতী, না-লক্ষ্মীর সাধনাতে কৃতকার্য হয়ে এখন গণেশ-পূজারিদের দ্বারে দ্বারে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দেখো, কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এলাম! একেই কি বুড়ো হওয়া বলে?

যাই হোক জমি কিনে ফেলল। কেনা হলেই আমাকে জানাও। ভালো থেকো।

ভালো থেকো এই কথাটুকু বলা ছাড়া দুরে বসে তোমার জন্যে আর কিছুই তো করার নেই।
ইতি তোমারই যূনী।

চিঠিটা কোলের ওপর ফেলে যুযুধান অনেকক্ষণ বসে রইল।

বাড়িতে কেউ নেই। অমল এখনও ফেরেনি। শ্মশানেও যায়নি। পাড়ার ছেলেরা এখন যুযুধানকে দেখে, দূর থেকে বলে, অমুর দাদা যাচ্ছে। অমুর দাদা-হওয়াটা সম্মানের না অসম্মানের ঠিক বুঝতে পারে না যুযুধান।

ছেলেবেলায় অমল খুবই গুণ্ডামি করত। যখন ওর বছর দশেক বয়স তখন থেকেই সমবয়েসি ছেলেদের ধরে বেধড়ক পেটান পেটাত। তখন যুযুধান পথ দিয়ে গেলে পেছন থেকে বাচ্চা ছেলেরা বলত, দ্যাখ, অমল গুণ্ডার দাদা যাচ্ছে।

এখন নিজেদের মধ্যে ওরা কী বলাবলি করে কে জানে!

শ্রীলা না ফিরলে খাওয়া-দাওয়া হবে না। তা ছাড়া রোজ তো আর প্রতিবেশীর মৃত্যু হয় না। অপারেশদার মৃত্যুটা শুধুমাত্র মৃত্যু হয়েই আসেনি ওর কাছে, বাঁচার এক নতুন প্রেরণা, জীবনের এক দ্যোতক হয়েই এসেছে। তাই, ভারি বাঁচতে ইচ্ছে করছে যুযুধানের। বাঁচার মতো বাঁচা! এই দিনগত পাপক্ষয়, থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়ের বাঁচা নয়। অনেক জীবন্ত, উষ্ণ, অনুক্ষণ উৎসাহের মধ্যে বাঁচা।

যূনীকে চিঠি লিখতে বসল যুযুধান। আপাতত ওর জীবনটা যূনীকে চিঠি লেখার মধ্য দিয়েই সবচেয়ে বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। ওই চিঠির অক্ষরগুলির মধ্যে ও নিজেকে যতখানি প্রাণবন্ত ও জীবন্ত মনে করে তা অন্যসময়ে কখনোই করে না।

কলকাতা

যূনী কল্যাণীয়াসু,
তোমার টেলিফোন যে আসেনি তার দায় তোমার নয়। দোষও নয়। দিল্লি-বোম্বেতে বসে কলকাতার টেলিফোনের অবস্থার কথা তোমরা অনুমান করতে পারবে না। বাঙালি জাতটার আত্মসম্মানবস্তুটি চলে গেছে পুরোপুরি, যারা বাংলার De-facto মালিক তাদের তা অনেক আগেই গেছে। এই বাঙালিকে সবদিক দিয়ে নষ্ট করার পেছনে এই মালিকদের মদতও কম নেই। টাকাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো কামনা। টাকাই সম্মান, যশ, ক্ষমতা সবকিছুর উৎস। রেলের টিকিট থেকে শুরু করে সিনেমার টিকিট, এবং অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই এই মালিকরাই কালোবাজারের প্রথম সূত্রপাত করে। ঘুস-ঘাস এবং জান-চিন-এর সংস্কৃতিতে এঁরাই প্রথম এমন ব্যাপকভাবে একটি জাতির চরিত্র এবং সমৃদ্ধিকেও পুরোপুরি নষ্ট করতে কাজে লাগায়। আজকে অবশ্য এসব ব্যাপার আলোচনারও বাইরে চলে গেছে কারণ এটাই এখন সত্য, সরল সত্য যে, বাংলার মালিক আর বাঙালি নেই। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ পৃথিবীতে যেখানে বাংলা ভাষাভাষীরাই সব। তাদের কথাই শেষকথা। এটা ভাবলেও ভালো লাগে।

কী বলতে বসে কীসব বলছি। বুড়ো আমি তোমার চেয়েও বেশি হয়েছি। এখুনি একজনকে দাহ করে এলাম। আমাদের চারটে বাড়ি পরে থাকতেন অপরেশদারা।

আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো৷ মিনিতে চাপা পড়েছিলেন হরিশ মুখার্জি রোড পেরোতে গিয়ে। অফিসের পর। চাপা পড়েছিলেন পরশুদিন। পোস্ট মর্টেম করে কাটা-ছেঁড়া, ফোলা, বীভৎস মৃতদেহ আজ বিকেলে আত্মীয়-বন্ধুরা হাতে পেয়েছেন। পোস্টমর্টেম করতে এত সময় কেন যে লাগে, কে জানে? সবাই সব দেখে কিন্তু চুপচাপ মেনেও নেয়। কোনো অন্যায়েরই প্রতিবাদ হয় না এখানে। এখানে মূক, নির্বাক, আত্মসম্মানহীন, নিজস্বার্থপরায়ণ এক প্রজাতির বাস, তাদের নাম বাঙালি। যারা নিজের পায়ে অন্যের জুতোর চাপ না পড়লে বিচলিত হয় না, নিজের বোন শ্লীলতা-হৃত না হলে উত্তেজিত হয় না, নিজের দাদা বা বাবা অপমানিত না হলে অপমান বোধ যাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না, এই প্রজাতি সেই বাঙালিই। একতা বলতে যাদের মধ্যে কিছুমাত্র নেই। পরশ্রীকাতরতা এবং ঈর্ষাই যাদের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

এসব ভাবনা ভেবে বিচলিত, উত্তেজিত বা অপমানিত বোধ আমিও করি না কারণ সময় পেরিয়ে গেছে। আর সময় নেই। ভাগ্যকে বিনা-প্রতিবাদে মেনে নিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে একদল বাঙালি উদবাস্তু হয়ে এসেছিলেন কয়েক যুগ আগে আর আর-একদল পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদবাস্তু হয়ে চলে যাচ্ছেন। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত।

আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে পুরো কলকাতা শহরে–শ্যামবাজারের পাঁচমাথা বা চৌরঙ্গিতে, বা রাসবিহারীর মোড়ে তুমি কোনো বাংলা শব্দ উচ্চারিত হতে পর্যন্ত শুনবে না। বাঙালির উদবাসন সম্পূর্ণ হবে ততদিনে সমস্ত বাংলা থেকে। যাঁরা থাকবেন, তাঁরা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে ভোরবেলা কলকাতাতে জীবিকার কারণে আসবেন এবং ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, বিরক্ত হয়ে গভীররাতে ফিরে যাবেন। আমরা এই লজ্জাকর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থেকে যাব।

অপরেশদা চলে গিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন যে, থাকাটাই মিথ্যে আর যাওয়াটাই সত্যি। আমাকে না-বলেও বলে গেলেন যে, জীবনটাকে জিয়োনোকইমাছের মতো হাঁড়ির ছলকানো পিছল-জলের মধ্যে ঝপাং-খপাং করে বাঁচিয়ে রেখে ক্ষতবিক্ষত করে করে তাকেই বেঁচে থাকা বলে ভুল করার সময় আর নেই। এবারে যে কটি দিন আছে, সত্যি সত্যিই বাঁচতে হবে।

তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ না যূনী? এবারে আমাদের বাঁচতে হবেই। জীবন বড়ো পুলক ভরে ডাক দিয়েছে! আর নষ্ট করার সময় নেই।

আমার কলিগ প্রণবেশের বাড়ি গেছিলাম আজই শ্মশান থেকে। বাড়ি ছিল না ও। চিঠি দিয়ে এসেছি। যে-কোনোদিন শান্তিনিকেতন যেতে পারি। তুমি এবার চাকরি ছাড়ার কথা ভাবো। শান্তিনিকেতনেও চেষ্টা করে দেখব। তুমি বাংলা ভাষায় এম এ এবং ডক্টরেটও, তোমার কি একটা চাকরি জোটে না শান্তিনিকেতনে?

ভালো থেকো।
ইতি তোমার যুযুদা।

পুনশ্চ–অমলের চাল-চলন এবং জীবনযাত্রা রীতিমতো রহস্যময় হয়ে উঠছে দিনে দিনে। বিনা-পরিশ্রমের অঢেল পয়সাও দেখতে পাচ্ছি। তোমার দূরসম্পর্কের বোন শ্রীলা, যেহেতু টাকা পাচ্ছে সেইহেতু বোধ হয় টাকার উৎস সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করে না অমলকে। অবশ্য জানি না সে কীভাবে নিয়েছে ব্যাপারটা।

এই বাড়িতে থাকাই হয়তো মুশকিল হবে আমার পক্ষে বেশিদিন। সবসুদ্ধ পাঁচ কাঠা জমি। মালটিস্টোরিওয়ালাদের বিক্রি করা যেতে পারে যখন তখন। কিন্তু এত বছর যে প্রলোভন ঠেকিয়ে এসেছি, গলির প্রত্যেককে দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছি; তা আমি নিজে করি কী করে?

এ পাড়ায় যত বাড়ি হচ্ছে তাতে ফ্ল্যাট কেনার শর্ত হচ্ছে যে, নিরামিষাশী হতে হবে। লিখিত নিয়ম নয়, অলিখিত নিয়ম। তা ছাড়া আজকাল কলকাতার বুকে ফ্ল্যাট কেনার মতো বড়োলোক বাঙালি ক-জনই বা আছেন? তবে যাঁদের জমি, তাঁরা চাইলে অবশ্য একটি বা দুটি ফ্ল্যাট ওঁরা দিচ্ছেনও। কিন্তু জেনারেটর নিয়ে মেইনটেন্যান্স খরচ আর করপোরেশন ট্যাক্স দিতেই তো প্রাণান্ত হবে। তাই বাঙালিরা ফ্ল্যাট পেলেও ফ্ল্যাট রাখতে পারছে না।

আমাদের কলকাতা কর্পোরেশনের ভূমিকাও এই শহর থেকে বাঙালি উৎখাতের পেছনে আদৌ বড়ো কম নয়। তাঁদের এই পুণ্যকর্মর কথাও বাঙালির ইতিহাসে যোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই থাকবে।

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress