যার যেমন
আমি একটা মানুষ! আমার কোনও ইয়ে আছে? এই ‘ইয়ে’ শব্দটার কোনও তুলনা নেই। ‘ইয়ে’ টা যে ‘কিয়ে’ তা ব্যাখ্যা করা যায় না। ভেতরে অনেক না-বলা বাণী ঢুকে আছে। আমার কোনও ‘ইয়ে’ নেই। আমাতে আর মৃগাঙ্কতে অনেক তফাত। আমাতে আর অভিজিতে অনেক তফাত। মৃগাঙ্গ, অভিজিৎ, গজেন আলাদা আলাদা নাম হলেও একই ধরনের মানুষকে বোঝাচ্ছে। সফল মানুষ। জীবনে সফল। জীবিকায় সফল। ফুচকার মতো ভোগের জলে টইটুম্বুর হয়ে ভাসছে।
রোজ সন্ধেবেলা আমিও বাড়ি ফিরি। মৃগাঙ্গ কি গজেনও বাড়ি ফেরে। কত পার্থক্য। আকাশ পাতাল ব্যবধান। মৃগাঙ্কর গাড়ি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সিলভার গ্রে রঙের দোতলা বাড়ি। চারপাশে বাগান। বারান্দায় আইভি-লতা, উঁই। গেটের মাথায় লোহার অর্ধচন্দ্র। তার ওপর বোগেন হতে ভ্যালিয়ার আসর। যেন সানাই বাজাতে বসেছে, আলি আহমেদ খান। সামনে। বাগানে নানা রঙের গোলাপ, হাসনুহানা। যত রাত বাড়ে, রোমান্টিক ছোকরা থাকে, ততই গন্ধ বাড়তে থাকে। মৃগাঙ্কের লিপস্টিক-লাল গাড়ি বাড়ির সামনে থামামাত্রই চারজন ছুটে আসে— মৃগাঙ্কের মা, মৃগাঙ্কের বউ, মৃগাঙ্কের চাকর, মৃগাঙ্কর ধেড়ে ‘অ্যালসেশিয়ান’। ড্রাইভার দরজা। খোলামাত্রই পা বেরিয়ে আসবে, ঝকঝকে জুতো, কুচকুচে কালো মোজা, ধবধবে সাদা ডান পা কে অনুসরণ করবে বাঁ-পা। মৃগাঙ্ক নামক বিশেষ্যটি স্প্রিং-এর মতো নেমে আসবে। বেলুন। আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলে যেরকম হালকা নাচে, মৃগাঙ্ক ঠিক সেইরকম অল্প একটু নেচে নেবে। পরিধানে রুলটানা সুট। বুকের ওপর টাই। চোখে বিলিতি ফ্রেমের চশমায় অভিমানী কাচ। পোলারাইজাড় গ্লাসের বাংলা অনুবাদ। কাচে রোদ লাগালে অভিমানে কালো হয়ে ওঠে।
মৃগাঙ্ক যখন প্রিং-এর মতো নাচছে তখন ড্রাইভার আর ছোকরা দুজন মিলে গাড়ির পেছন। হাতড়ে মালমশলা নামাতে ব্যস্ত। প্রচুর প্রচুর মশলানামে। রোজই নামে। প্রথমে নামবে একটা বাস্কেট। বেতের তৈরি সুদৃশ্য একটি ব্যাপার। মনে হয় ত্রিপুরা থেকে স্পেশ্যাল আমদানি। সাধারণ মানুষের হাতে অমন বস্তু সহসা দেখা যায় না। লন্ডন থেকেও আসতে পারে! কারণ। মৃগাঙ্কর সবই ফরেন। দিশি মালে অসম্ভব ঘৃণা। পারলে দিশি দেহটাকেও বিলিতি করে ফেলত। উপায় নেই। সে করতে হলে মরতে হবে। মরে টেমসের ধারে পিটার বা রবিনসের ঘরে জন্মাতে হবে। আবার নব ধারাপাত, প্রথম ভাগ দিয়ে জীবন শুরু করতে হবে। বাস্কেটে কী থাকে আমি জানি। থাকে লাঞ্চ বক্স, এক বোতল বিশুদ্ধ জল গরম করে, ঢাল-ওপর করে, হাওয়া খাইয়ে ক্লোরিন দিয়ে বোতল ভরা। এ দেশে জল নিয়ে নাকি ইয়ার্কি চলে না। জল এ দেশে জীবন নয়, মরণ। পাট করা একটা নরম তোয়ালে থাকে। থাকে সিজন্যাল ফ্রটস, দু-একটা ওষুধ। কথায়। বলে, প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর। দামি শরীর। কত কিছুর আক্রমণ থেকে সামলে। রাখতে হয়! একজিকিউটিভ ব্যামো কী একটা! হার্টে জমাট রক্ত ধাক্কা মারতে পারে। লিভারে কি লাংসে ক্যানসার ঢুকতে পারে। মৃগাঙ্ক আসে যখন এতটা দামি ছিল না, তখন একের পর একটা খুব সিগারেট খেত। এখন ভীষণ টেনশানের সময় একটা কি দুটো—তাও দামি, বিলিতি।
বাস্কেটের পর নামবে ব্রিফকেস। নামবে একটা সুদৃশ্য ফ্লাস্ক। সারা দিনের মতো কয়েক গ্যালন দুধ ছাড়া, চিনি ছাড়া কালো কফি থাকে। আর নামে পার্ক স্ট্রিটের দামি দোকানের কেক আর পেস্ট্রির বাক্স। এ এক এলাহি ব্যাপার! রোজ সকালে লোডিং, রোজ বিকেলে আনলোডিং। শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে একটা লেভেলে এনে মৃগাঙ্ক প্রথমেই যা করবে তা হল, ওই বাঘের মতো কুকুরটার সঙ্গে একটু আদিখ্যেতা। কুকুরের সায়েবি নাম রেখেছে, রাখুক, আমার কিছু। বলার নেই। অ্যালসেশিয়ান। তার নাম ভোলা কি গজা রাখলে মানাত না। মৃগাঙ্ক কুকুরের মাথা চাপড়াবে আর বলবে, ডিক, আমার ডিক, তোমার সব ঠিক?
ডিক, আধ হাত জিভ বের করে হ্যাঃ হ্যাঃ করবে।
মৃগাঙ্ক আদুরে গলায় বলবে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বন্দো গলম, গলম’। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে বলবে, ‘ওঃ হোয়াট এ সালটি ওয়েদার! অফুল।’
কুকুর ছেড়ে মৃগাঙ্ক সামনে এগোতে থাকবে আর তার বুকের কাছে টাইয়ের নট খুলতে খুলতে পেছনে থাকবে মৃগাঙ্কর মেয়ে। মৃগাঙ্কর সময় খুব কম। বাড়িতে ঢুকে টাইয়ের ফাঁস খোলার। সময়টুকুও সে দিতে চায় না। বাপির যে সময়ের অভাব মৃগাঙ্কর মেয়ে তা জানে। মেয়ে কেন, বাড়ির সবাই জানে। মৃগাঙ্ক কথায় কথায় বলে ‘সিসটেম’, ‘প্ল্যান’, ‘ইউটিলাইজেশান’।
বাড়িতে ঢোকামাত্রই মৃগাঙ্কর বউ একটা হ্যাঙ্গার হাতে পাশে এসে দাঁড়াবে। মৃগাঙ্ক হাত দুটো পেছনে ছেতরে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে তার ছোকরা চাকর কোটটা সুড়ুত করে খুলে নিয়ে মেমসায়েবের হাতে দিয়ে দেবে। মৃগাঙ্ক চেয়ারে বসবে। নিমেষে খুলে ফেলবে জুতো, মোজা।
মৃগাঙ্কর মেয়ে বিলিতি স্টিরিও সিসটেমে সেতার চড়াবে। মৃগাঙ্ক বলে, মিউজিকের একটা সুদিং এফেক্ট আছে। সেতার শুনতে শুনতে জামা আর ট্রাউজার খোলা হয়ে যাবে। হাতে এসে যাবে নরম তোয়ালে। মৃগাঙ্ক ধীর পায়ে এগিয়ে যাবে বাথরুমের দিকে। ফাইভস্টার বাথরুম। এই সময় লোডশেডিং হতে পারে। হলেও ক্ষতি নেই। নিজস্ব জেনারেটার আছে। ফ্যাট-ফ্যাট চলবে। ফটাফট আলো জ্বলে উঠবে। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মৃগাঙ্কর মুখ আয়নায় হেসে উঠবে। ছোট্ট করে মুখ ভ্যাংচাবে নিজেকে। মৃগাঙ্ক পড়েছে, মনটাকে শিশুর মতো করে রাখতে পারলে শরীর ফিট থাকে। যৌবন আটকে থাকে। স্মৃতি ভোঁতা হয় না। মৃগাঙ্ক কোমর দুলিয়ে খানিক নেচে নেয়। নিজের সঙ্গে আবোল-তাবোল কথা বলে। শিশুর মতো বলতে থাকে, বিশ্বকর্মা। পুজোয় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি ওড়াব। ঘুড়ি কিনব, একতে, আন্দে। কাল সকালে পড়া হয়ে গেলে গুলি খেলব। খোকন আমার সঙ্গে পারবে?
খোকন ছিল মৃগাঙ্কের বাল্যবন্ধু। এখন কোথায় আছে, কে জানে!
মৃগাঙ্ক বলবে, বড়দিদুটো টাকা দিলে দু-টাকারই লেবু লজেন্স কিনব। যত সব ছেলেবেলার পরিকল্পনার কথা বলতে থাকে একে একে। বলতে বলতে একেবারে শিশুর মতো হয়ে যাবে। ঘুরে ঘুরে বারকতক নাচবে। তারপর বাথটাবের কলদুটো খুলে দেবে। তখন সে গণিতজ্ঞ। গরম। জলের ট্যাপ দু-প্যাঁচ মেরে, ঠান্ডা জলেরটায় মারবে ছ’-প্যাঁচ। তবেই সে ‘টেপিড ওয়ার্ম’ জল পাবে। বার্থটা ভরে গেলে জলে এক খাবলা নুন ফেলে দেবে। এই নুন তাঁকে গেঁটে বাত থেকে বাঁচাবে।
নুনটা গলতে মৃগাঙ্ক জোরে জোরে দম নিতে নিতে চেস্ট এক্সপানশান করবে। তারপর দেহটাকে সমর্পণ করবে বাথটবের জলে। ডান হাতের নাগালের মধ্যে দেওয়ালদানিতে বিলিতি সাবানের দুধসাদা কেক। মৃগাঙ্ক জল নিয়ে খুঁড়িতে থ্যামাক থ্যামাক করবে। ছোট ছেলের মতো নানা রকম শব্দ করতে থাকবে মুখে। তখন সে আর শিশু নয়। একেবারে সদ্যোজাত। ওঁয়া ওঁয়া করলেই হয়।
এই সময়টাকে মৃগাঙ্ক বলে, ‘মোমেন্টস অফ পিস অ্যান্ড হ্যাপিনেস’।
এইবার আমার কথায় আসি। আমি আর মৃগাঙ্ক সমবয়সি। কপালগুণে মৃগাঙ্ক গোপাল আর আমি কপালদোষে গরু। আমার গাড়ি নেই। আমার বাহন মিনি। আমি মিনিতে ধারের আসনে। আধঝোলা হয়ে বসব। দেখতে দেখতে খুদে যানের কুঁচকি, কণ্ঠা ঠেসে যাবে যাত্রীতে। আমাকে। উঁড়ি দিয়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরবে। ব্রহ্মতালুতে কনুই মারবে। মেয়েরা মাথার ওপর ভ্যানিটি ব্যাগ রাখবে। মাঝে মাঝে আঁচলে মুখ ঢেকে যাবে। একবার এক ভদ্রলোক আমার মাথায় নস্যির ডিবে রেখে নস্যি নিয়েছিলেন।
আমি ওইরকম আড়কাত হয়ে ঘণ্টাখানেক থাকব। জ্যাম থাকলে দেড় দু-ঘণ্টা। তারপর ধুপুস করে স্টপেজে নামব। কন্ডাকটার মাথায় চাটি মেরে টিকিট দেখতে চাইবে। আমার আকৃতিটাই এইরকম যে যে-ই দেখে সে-ই ভাবে, ব্যাটা একটা ছিচকে চোর। মেরে পালোনোর পার্টি।
চেহারায় কোনও আভিজাত্য নেই। বড় দোকান থেকে জিনিস কিনে বেরোবার সময় দরজার ধারে টুলে বসে থাকা দরোয়ান বিশ্রী গলায় বলবেই বলবে, ‘ক্যাশমেমো’। এহেন প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা আমি কোনওদিন ভুলব না। একদিন গ্র্যান্ড হোটেলের তলা দিয়ে লিন্ডসের দিকে হেঁটে চলেছি। আমার সামনে হাঁটছেন লম্বা চওড়া-সুটেড-বুটেড এক ভদ্রলোক। তাঁর ঠোঁটে বাঁকা করে ধরা একটি পাইপ। পাইপ থেকে ফিকে ধোঁয়া উঠছে। তিনি চলেছেন, আমি চলেছি। তিনি গ্যাট-ম্যাট করে, আমি খুড়স-খুডুস—যেন ঘোড়ার পেছনে গাধা। লিন্ডসেতে পড়ে তিনি বাঁয়ে বেঁকলেন। আমিও। তারপর আবিষ্কার করলাম দুজনেরই গন্তব্যস্থল এক। একই দোকানে। দোকানের কাচের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দ্বাররক্ষক টুল থেকে তড়াক করে উঠল, সেলাম বাজাল, দরজা টেনে ধরল, পাইপ ঢুকে গেলেন। আর আমি যেই ঢুকতে গেলুম, দরজাটা সে ছেড়ে দিল, খাঁই করে আমার নাকের ওপরে। আমার শরীরের একমাত্র শোভা আমার পিচবোর্ডকাট নাকটি। আমার লম্বাটে মুখের ওপর খাড়া হয়ে আছে। যেন ওটা আমার নাক নয়, প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতে গীতা যেমন প্রক্ষিপ্ত। ও নাক এ মুখের নয়। অন্য কোনও মুখের। অনেকটা নাকুমামার মতো। আমার স্ত্রী যখন আমাকে ন্যাকা বলে, তখন মনে হয় এই নাক দেখেই বলে। আমারও কিছু কিছু শুভার্থী বন্ধু আছেন, সবাই আমার শত্রু নন। সেইরকম এক বন্ধু বলেছিলেন, তোমার গাল দুটো দেবে যাওয়ায় নাকের স্ট্রাকচারটা অত ঠেলে উঠেছে। গাল দুটো সামহাউ একটু ভরাট করার চেষ্টা করো, তাহলে তোমার ওইমুখ যা দাঁড়াবে না! জেম অফ এ পিস। ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গলের মতো হয়ে যাবে।
তারপরে আবিষ্কার করলাম, গাল ভরাট করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। অনেকটা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মতো। পুকুর ভরাট করা যায়, চোয়াড়ে গাল ভরাট করা যায় না। ধার করে, দেনা করে ফ্যাট খাও, প্রোটিন খাও, খুঁড়িটাই বেড়ে গেল, খাবলা গাল, খাবলা গাল-ই থেকে গেল।
দোকানের দরজাটা ধাঁই করে নাকে লাগতেই সর্দি হয়ে গেল। আমি তো আর মুষ্টিযোদ্ধা নই। নাকে ঘুষি হজম করার শক্তি কোথায়? দ্বারপালকের ওপর রাগ হল। তার বয়েই গেল। আমার। মতো ফেকলুকে সে পাত্তা দেবে? ঠান্ডা, সুন্দর দোকানের ভেতর সেই সবাদৃত পাইপ। ঘুরে ঘুরে শাড়ি দেখছেন, কার্পেট দেখছেন, বিছানার চাদর দেখছেন। কী আগ্রহ নিয়ে দোকান-বালিকারা। তাঁকে দেখাচ্ছেন। তিনি মাঝে মাঝে পাইপচ্যুত হয়ে অল্প-স্বল্প মন্তব্য করছেন। আমাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। বলছি, চাদর, বলছে ওই তো চাদর, দেখুন না। বলছি শাড়ি, বলছে এখানে। শাড়ির অনেক দাম। পাইপ সারা দোকান ওলটপালট করে দিয়ে শুধু হাতে প্রস্থান করলেন। মাঝে মাঝেই তাঁকে বলতে শুনলুম, দ্যাট মাই চয়েস, দ্যাটিস নট ফাইন, বেটার সামথিং। ভেবেছিলুম বড় খদ্দের যাবার পর ছোটটার দিকে নজর পড়বে। কোথায় কী! সুন্দরীরা নিজেদের মধ্যে গল্প শুরু করলেন। আমি তাঁদের সামনে কাউন্টারের উলটোদিকে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলুম। মোটা সুন্দরী, ছিপছিপে সুন্দরী, রোগা সুন্দরী, ভুরুওলা সুন্দরী, ভুরু আঁকা সুন্দরী, খোঁপা সুন্দরী, এলো সুন্দরী। কত কী যে তাঁদের বলার আছে। মাধুরীদি স্বপ্নাকে কী বলেছে? সান্যালদাটা ভীষণ অসভ্য! ওরই মধ্যে একজন বলে ফেললে,…লাগে, একদিন ঝাড় খাবে। আমার রুচিশীল কান বললে, পালাও। পালাব মানে! সোজা ম্যানেজার। তিনি ছুটে এলেন…’তোমরা ভদ্রলোককে শাড়ি দেখাচ্ছ না কেন?’ স্লিম সুন্দরী আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বললে, ‘আহা, বোবা না কি? না বললে দেখাব কী?’
আমার প্রায় প্রেমে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। ভবা পাগলার নাম শুনেছ? আমি এক প্রেম পাগলা, এই করেই আমার বউয়ের প্রেমে পড়ে জীবনটা নষ্ট করেছি। মৃগাঙ্ক হতে হতেও হওয়া হল না। সংসারের ম্যাঁও সামলাতে সামলাতেই ঘাটে যাবার সময় হয়ে গেল। প্রবীণা এক মহিলা বললেন, ‘সীমা, ভদ্রলোককে ওই ওপরের থাকের শাড়িগুলো দেখাও।’ চালাকিটা পরে বুঝলুম। আমাকে অপদস্থকরার জন্যে সবচেয়ে দামি শাড়ি একের পর এক নেমে এল। সাড়ে চারশো, সাতশো, সাড়েনশো।
আমি বললুম, ‘আর একটু কম দাম?’
‘এ দোকানে কম দামের শাড়ি রাখা হয় না।’
আমি সেই ক্ষয়া চাঁদের চোখের বাণে কাবু হলে কী হবে, তিনি আমার খাড়া নাকের আভিজাত্যকে মোটেই সমীহ করলেন না। আমি প্রায় মরিয়া হয়েই, সাড়ে চারশো দামের একটা শাড়ি কিনে ফেললুম। তখনও আর একজনের ওপর বদলা নেওয়া বাকি ছিল। ওই সেই দ্বারপাল। শাড়ির প্যাকেট বগলে নিয়ে আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। আমি আগেই দেখে রেখেছিলুম, সে পাইপকে উঠে দাঁড়িয়ে, দরজা খুলে সেলাম করেছিল।
বললুম, ‘গেট আপ।’
লোকটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। ধমকের সুরে বললুম, ‘গেট আপ।’
তখন আমার সংহার মূর্তি। উর্দি উঠে দাঁড়াল।
‘দরওয়াজা খোলো।’
দরজা খুলে ধরল। তখনও তার আর একটা কাজ বাকি।
‘স্যালুট। সেলাম বাজাও।’
সেলাম করল। আমি সেই পাইপ দাদার মতো গ্যাটম্যাট করে বেরিয়ে এলুম। লোকটা মহা শয়তান। আমার শরীরটা পুরো বেরোবার আগে, দরজাটা ছেড়ে দিল। কড়া প্রিং। দুম করে দরজাটা আমার পায়ের গোড়ালিতে ধাক্কা মারল। মারুক। আমি আমার পাওনা আদায় করে নিয়েছি।
এত এত বড় একটা ভণিতার কারণ, আমার দুঃখ। লোকটাকে কেউ সামান্যতম পাত্তা দেয় না। না বাড়ির লোক, না বাইরের লোক। কেন? কারণটা কী? এক জ্যোতিষীকে বলেছিলুম, ‘একবার দেখুন তো মশাই, হরোস্কোপটা। কোথায় কোন গ্রহ এঁকে-বেঁকে আছে।’
অনেক অঙ্কটঙ্ক কষে তিনি বললেন, ‘আপনার রবিটা খুব ড্যামেজ হয়ে আছে, যে কারণে চামচিকিতেও আপনাকে লাথি মারবে। মটরদানার মতো একটা হিরে পরুন।’ হিরে পরব আমি! আমি কি মৃগাঙ্ক? দশ, বারো, চোদ্দো, কত হাজার পড়বে কে জানে! মারুক চামচিকিতে লাথি। যাক, যে কথা বলছিলুম, মিনি থেকে নেমে আমাকে এ-দোকান, সে-দোকান ঘুরে ঘুরে জিনিস কিনতে হবে। কেরোসিন কুকারের পলতে, চিড়ে, ছোলা, বাতাসা, বাদাম, মাথাধরার ওষুধ, সেজের চিমনি, মুরগির ডিম, পুজোর ফুল। কেনাকাটার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। নিতান্তই। মধ্যবিত্তের জিনিস। মৃগাঙ্কর প্যাটিস-পেস্ট্রি নয়। আর সবই বিপরীতধর্মী জিনিস। ফুলের সঙ্গে ডিম ঠেকবে না। বাসায় চাপ পড়বে না। চিমনি চাপ সইবে না। এ সবই আমার প্রেমের। বউয়ের কারসাজি। রোজই এমন সব জিনিস আনতে বলবে, মানুষের দু-হাতে ম্যানেজ করা অসম্ভব। দশটা হাত, দশটা মুণ্ডু হলে যদি কিছু করা যায়। এ সংসারে রাম হলে কপালে বনবাস। রাবণ হতে হবে। রাজ্যপাট, লোভনীয় পরস্ত্রী সবই তখন সম্ভব। রাম হলে ভোগান্তি। রাবণ হলে ভোগের চূড়ান্ত। দু-হাতে বুকের কাছে সব পাকড়ে ধরে বাড়িমুখো হাঁটতে হাঁটতে বলি, ‘আই অ্যাম এ ডিগনিফায়েড ডঙ্কি।’ ফাইনাল খেলা শুরু হয় বাড়ির সামনে এসে। রবি নীচস্থ হলেও মঙ্গল আজ মনে হয় তুঙ্গী। বরাতে বাড়ি মোটামুটি ভালোই জুটেছে। সামনে একটু বাগান মতো আছে। গেট। গেট থেকে সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা সোজা সদরে। আমার বউয়ের এদিক নেই ওদিক আছে। নিজে পায় না খেতে, শঙ্করাকে ডাকে। লোমলা ফুটফুটে কুকুর কিনে এনেছে। তিনি যেন গৃহদেবতা। তাঁর সেবার শেষ নেই। তিনি সকালে চুকচুক করে আধবাটি দুধ খাবেন। নিজে খাই, না খাই ডেলি একশো গ্রাম ক্রিম ক্রাকারবাঁধা। ঝড় হোক, জল হোক, রাষ্ট্রবিপ্লব হোক, এমনকী অ্যাটম বোমা পড়লেও ডেলি দুশোগ্রাম কিমা। মাসে ডাক্তার, বদ্যি, ওষুধ-বিষুধের পেছনে অ্যাভারেজ—পঞ্চাশ টাকা। নিজে অসুস্থ হলে পড়ে থাকা যায়। কেউ গ্রাহ্যই করবে না। তুমি ব্যাটা মরে ভূত হয়ে যাও, কিছু যায়-আসে না। ঘটা করে শ্রাদ্ধ করে, পাসবই নিয়ে ব্যাংকে ছুটবে। আকাউন্ট ট্রান্সফার করবার জন্যে। তুমি তো আমার লোমওয়ালা বিলিতি কুকুর নও। হিন্দি ছায়াছবিতে যেমন গেস্ট আর্টিস্ট থাকে, আমাদের সেইরকম গেস্ট কুকুর আছে। সে আবার আর এক ইতিহাস। কে বলে ইতিহাসে ইতিহাসে কেবল রাজারাজড়া? সাধারণ মানুষের জীবনে কম ইতিহাস? বছর দশেক আগে এক বর্ষার রাতে রাস্তার লালু এসেছিল বারান্দায় আশ্রয় নিতে। সেই লালু হয়ে গেল গেস্ট। লালুর চারটে বাচ্চা হল। কান্নু আর গুগলু বড় হল। তাদের হল চারটে চারটে আটটা। তিনটে গেল, রইল পাঁচটা। সে এক জটিল হিসেব। তবে এখন যা অবস্থা, পিলপিল করছে কুকুরে। রাতে কানে তুলো খুঁজে দরজা-জানলা বন্ধ করে শুতে হয়। মিনিটে মিনিটে ডাক। প্রথমে একটা ডাক, তারপর আর ক’টা কোরাসে। শুরু হলে আর থামতে চায় না, সভাপতির ভাষণের মতো। আমার বউ বলবে, ‘কী আশ্চর্য! কুকুর ডাকবে না? ডাকবে বলেই তো দেড় কেজি চালের ভাত খাওয়াই।’
‘বাঙালির বাত, কুকুরের ডাক।’ বেশ বাবা। তাই তোক। তা কিন্তু হল না। মালকিন নিজেই এবার কুকুরের ওপর খাপ্পা। কুকুরেরা খেলা পায়। খেলার আনন্দে তারে ঝোলা শাড়ি ছিঁড়ে ফালা-ফালা করেছে। দরজার পাপোশ আঁচড়ের-মেটেরিলাল করে দিয়েছে। এই সব অপকর্ম যদিও বা সহ্য। হল, হল না সেই মারাত্মক অপরাধ। গেস্ট আর্টিস্টরা একদিন বাড়ির লোমওয়ালা হিরোকে বাগে পেয়ে খাবলে দিল। এখন নিয়ম হয়েছে, যে-ই আসুক আর যে-ই যাক গেট বন্ধ করতে হবে। সে ও আবার এক ইতিহাস। লোয়েস্ট কোটেশানের লোহার গেট। লোহা নামে সরু কতকগুলো সিক সরু পার্টির ফ্রেমে ঢালাই করা। বাতাসে ম্যালেরিয়া রুগির মতো কাঁপে।
ফুঁ দিলে খুলে যায়। ফলে ব্যবস্থা যা হয়েছে, তা অভিনব। অষ্টগন্ডা গাঁটওয়ালা, একটা দড়ি দিয়ে গেটটা বাঁধা হয়। বাঁধা সহজ। যে বাঁধে, সে বাঁধে। শ্যামল মিত্রের সেই গান, ‘ফুলের বনে মধু। নিতে অনেক কাঁটার মালা, যে জানে সে জানে, ভ্রমরা যাস নে সেখানে।’ খুলতে পিতার নাম ভুলিয়ে দেয়। গেঁটে বাতের মতো।
মৃগাঙ্ক যখন ফেরে তাকে রিসিভ করার জন্যে একটা ব্যাটেলিয়ান খাড়া থাকে গার্ড অফ অনার দেবার জন্যে। আমি তো আর মৃগাঙ্ক নই।
ছেলেবেলায় একটা ছবি দেখেছিলুম কোনও এক বইয়ে—দ্রোপদীর বস্ত্রহরণ। বুকের কাছে দু হাত দিয়ে দলা পাকানো কাপড় ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, আর রাজার পোশাক পরা গুঁপো একটা গুন্ডা, হয় দুঃশাসন না হয় দুর্যোধন আঁচল ধরে টানছে। আমাদের বাড়ির গেটের সামনে আমারও সেই অবস্থা। বুকের কাছে দু-হাতে জাপটে ধরা প্যাকেট-ম্যাকেট। কাঁধে সাইড ব্যাগ, সামনে গেঁটে বাত। গেটে দড়ি বাঁধা ম্যালেরিয়া গেট। আবার একটা গানের কলি, কেউ দেয়নি তো উলু, কেউ বাজায়নি শাঁখ। দু-হাতে যে বাঁধন খোলা যায় না, সেই বাঁধন খুলবে এক হাতে? আলিবাবা, চিচিংফাঁক মন্ত্র দাও। বলে না, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। কে বলে বাঙালির ফেলো ফিলিংস নেই! খুব আছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কেউ না কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে। আমি ভাবি কত ভাবেই না মানুষ রোজগার করতে পারে! আমার ফেরার সময় খোকন জেগে আছে। সেও এক ইতিহাস। খোকন খাঁড়ার বাবার ছিল সাবেক কালের বিশাল গোলদারী দোকান। প্রভূত পয়সার মালিক। পয়সা হল ভূত। ভূতে ধরলে মানুষের মতিভ্রম হয়। বড় খাঁড়া পর পর তিনটে বিয়ে করে ফেললেন। লোকে একটা বউয়ের হ্যাপা সামলাতেই হিমসিম খেয়ে যায়। সব হ্যাপিনেস, গাং গঙ্গায়ৈ নমঃ। বড় খাঁড়ার চুল উঠে গেল। মুখ ফুলে গেল। উঁড়ি বেড়ে গেল। আমরা ভাবতুম সুখে বড় খাঁড়া মোটা হচ্ছে। তা নয়, খাঁড়ার উদুরি হয়ে গেল। খাঁড়া মরে গেল। লোকে মরলে একটা বউ বিধবা হয়। খাঁড়া তিন-তিনটেকে বিধবা করে পগার পার। তারপর যা হয়, বিষয় বিষ। মামলা, মকদ্দমা, মারদাঙ্গা। গোলদারী ভুস। বড়পক্ষের ছেলে খোকন খাঁড়া। খাঁড়া হলে কী হবে, ধার নেই। পথে পড়ে গেল। কল্কে ধরলে। অন্যের কল্কে। ধরলে লোকের আখের ফেরে। নিজে কল্কে ধরলে সর্বনাশ হয়। খোকন এখন আধপাগলা। শুধু ধান্দা, কীভাবে গাঁজার পয়সা জোগাড় করা যায়। ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়।
সে আবার কী কথা! বলি সে কথা। ভগবান আমার জন্ম দিলেন। বয়েসকালে বাবরি চুল রেখে প্রেম করলুম। হ্যা হ্যা করে বিয়ে করলুম। ধারদেনা করে বাড়ি করলুম। পয়সার অভাবে লগবগে গেট করলুম। বিজ্ঞান হাতে তুলে দিল টিভি। প্রবাদ—যত হাসি তত কান্না, বলে গেছে রাম শর্মা। যত প্রেম তত ঘণা। আমার বউ টিভি দেখবে। আমি গরু খেটে ফিরব। দু-হাতে ফলটা মুলোটা। খোকন খাঁড়া সামনের বাড়ির রকে। সে নেমে আসবে মেসোমশাইকে সাহায্য করতে। বিনিময়ে পঁচিশ পয়সা। এক পুরিয়া গঞ্জিকার দাম।
একেই বলে কুকুর। আমার বউ আমার এই বেড়া টপকানোর খবর কিছুই জানতে পারবে না। পারবে লোমওয়ালা কুকুর। সে ঘেউ ঘেউ করবে। তাতেও আমার বউ উঠবে না। ভাগ্যিস ছেলেবেলায় ব্যাকে ফুটবল খেলেছিলুম। ডানপায়ে সদর দরজায় দমাদম লাথি। তখন দরজা খুলে যাবে। কুকুর ছুটে আসবে। দু-হাত তুলে নাচবে। চাটার চেষ্টা করবে। আর আমার বউ। হাসিমুখে অভ্যর্থনার বদলে, কি জিনিসপত্তর ধরে আমাকে খালাস করার বদলে একটি কথাই রুক্ষ গলায় বলবে, ‘গেটে দড়ি বেঁধেছ? যাও বেঁধে এসো।
মালপত্তর কোনওরকমে নামিয়ে, আমি গান গাইব। মনে মনে। বাঁধ না তরীখানি আমার এই নদীকূলে। একা দাঁড়িয়ে আছি লহনা কোলে তুলে। তারপর ছুটব। তলতা গেটে দড়ি বাঁধতে। ওই কাজটি করার কালে আমি দার্শনিক হয়ে যাব। মাথার ওপর মরুর আকাশ। মিটিমিটি তারা। আমার বাগানের কৃষ্ণচূড়ার ঝিরিঝিরি পাতা। অসংখ্য গাঁটওয়ালা একটা দড়ি, যেন হাতে ধরা। জপের মালা। এক-একটা গাঁট এক-একটা রুদ্রাক্ষ। আমি তখন সত্যি-সত্যিই তিন গাঁটে ওংকার জপ করব। পা বাড়ালেই পথ। আমি তখন গাইব প্রশ্নের মতো করে, ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?’ আমি কোনও উত্তর খুঁজে পাব না। মাথা নীচু করে ফিরে আসব। আমার কুকুর গাল চাটবে। মৃগাঙ্কর বিলিতি আফটার-শেভ লোশান আছে। সেটা থাকে শিশিতে। আমারও রয়েছে, একটু অন্যভাবে। বিলিতি কুকুরের জিভে। ভাবামাত্রই আমার মন মসৃণ। মধ্যবিত্ত মলিন বাথরুমে ঢুকে কল ছাড়ব, আর ছাড়ব আমার গলা—হারে রে রে রে তোরা দেরে আমায় ছেড়ে।