Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যাকে ঘুষ দিতে হয় || Manik Bandopadhyay

যাকে ঘুষ দিতে হয় || Manik Bandopadhyay

মোটর চলে আস্তে। ড্রাইভার ঘনশ্যাম মনে মনে বিরক্ত হয়, স্পিড় দেবার জন্য অভ্যাস নিশপিশ করে ওঠে প্রত্যঙ্গে, কিন্তু উপায় নেই। বাবুর আস্তে চালাবার হুকুম। কাজে যাবার সময় গাড়ি জোরে চললে তার কোনো আপত্তি হয় না কিন্তু সস্ত্রীক হাওয়া খেতে বার হলে তারা দুজনেই কলকাতার পথে মোটর চড়ে–নিজেদের দামি মোটর চড়ে বেড়াবার অকথ্য আনন্দ রয়ে-সয়ে চেটেপুটে উপভোগ করতে ভালোবাসে।

এত বড়, এত দামি এমন চকচকে মোটর গড়িয়ে চলেছে শহরের পিচ-ঢালা। পথে, শুধু এই সত্যটাই যেন একটানা শিহরণ হয়ে থাকে সুশীলার। তারপর আছে পুরনো, সস্তা, বাজে মোটরগাড়ির চলা দেখে মুখ বাঁকানোর সুখ। আর আছে বোঝাই ট্রাম-বাসের দিকে তাকিয়ে তিন বছর আগেকার কল্পনাতীত স্বপ্নজগতে বাস্তব, প্রত্যক্ষ বিচরণের অনুভূতি। ট্রামের হাতল ধরে আর বাসের পিছনে মানুষকে ঝুলতে দেখে সুশীলার মায়া হয়, এক অদ্ভুত মায়া! যাতে গর্ব বেশি। তিন বছর আগে মাখনকেও তো এমনভাবে ঝুলতে ঝুলতে কাজে যেতে হত। স্বামীর অতীত সাধারণত্বের দুর্দশা আজ বড় বেশি মনে হওয়ায় ট্রাম-বাসের বাদুর-ঝোলা মানুষদের প্রতি উত্তপ্ত দরদ জাগে সুশীলার। মাখন সিগারেট ধরিয়ে এপাশে ধোয়া ছেড়ে ওপাশে সুশীলার দিকে আড়চোখে চেয়ে প্রায় সবিনয় নিবেদনের সুরে বলে, কে ভেবেছিল আমরা একদিন মোটর হাঁকাব?

সুশীলা বিবেচনা করে জবাব দেয়। সে মধ্যবিত্ত ভালো ঘরের মেয়ে, পরীক্ষায় ভালো পাস করা গরিবের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হল। ওমা, এত ভালো ছেলের চাকরি কিনা একশ টাকার! কত অবজ্ঞা, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা স্বামীকে দিয়েছে সুশীলার মনে পড়ে। চালাকও হয়েছে সে আজকাল একটু। ভেবেচিন্তে তাই সে বলে, আমি জানতাম।

মাখনের মনে পড়ে সুশীলার আগের ব্যবহার। একটু খাপছাড়া সুরে সে জিজ্ঞাসা করে, জানতে?

জানতাম বৈকি। বড় হবার, টাকা রোজগার করবার ক্ষমতা তোমার ছিল আমি জানতাম। তাই না অত খোঁচাতাম তোমাকে। টের পেয়েছিলাম, নিজেকে তুমি জান না। তাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমায় মরিয়া করে জিদ জাগালাম–

সত্যি! তোমার জন্যে ছাড়া এত টাকা–ড্রাইভার, আস্তে চালাও।

সুশীলা তখন বলে, কিন্তু যাই বল, দাস সাহেব না থাকলে তোমার কিছুই হত না।

মাখন হাসে, বলে, তা ঠিক, কিন্তু আমি না থাকলেও আর দাস সাহেব ফাঁপত না।

কী ঘুষটাই দিয়েছি শালাকে!

কত কন্ট্রাক্ট দিয়েছে তোমাকে!

এমনি দিয়েছে? এত ঘুষ কে দিত?

গাড়ি চলছে। আস্তে আস্তে গড়িয়ে চলছে। আর একখানা গাড়ি, দামি কিন্তু পুরনো, পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে খানিক এগিয়ে স্পিড কমিয়ে প্রায় থেমে গেল। মাখনের গাড়ি কাছে গেলে পাশাপাশি চলতে লাগল দাস সাহেবের গাড়িটা।

কোথায় চলেছেন?

একটু ঘুরতে বেরিয়েছি।

দাস সাহেবের দৃষ্টি তার মুখে-বুকে-কোমরে চলাফেরা করছে টের পায় সুশীলা। অন্দর থেকে উঁকি দিয়ে বৈঠকখানায় দাস সাহেবকে সে অনেকবার দেখেছে। লজ্জায় তার সর্বাঙ্গ কুঁচকে যায়। এই মহাপুরুষটি তার স্বামীর ট্রামে ঝোলার অবস্থা থেকে এই দামি মোটরে চড়ার অবস্থায় এনেছেন। শ্বশুর-ভাশুর ইত্যাদি গুরুজনের চেয়েও ইনি গুরুজন। ইনি দেবতার শামিল।

আপনার স্ত্রী?

আজ্ঞে।

দাস সাহেবের প্রশ্নের মানে মাখন বোঝে। তার মতো হঠাৎ লাখপতি কয়েকজনকে সে জানে, যারা মোটর হাঁকায় শুধু বাজারের স্ত্রীলোক নিয়ে বাড়ির স্ত্রী বাড়িতেই থাকে।

সুশীলা ভাবে, তাতে আশ্চর্য কী! যে-রকম উনি বুড়িয়ে গেছেন অল্পদিনে! ওঁর কাছে আমাকে নেহাত কচিই দেখায়। দুটি গাড়িই ততক্ষণে থেমেছে। পিছনে অন্য গাড়ির হর্ন শুরু করেছে অভদ্র আওয়াজ।

দাস সাহেব নেমে এ গাড়িতে এসে ওঠে। ড্রাইভারকে বলে দেওয়া হয় এ গাড়ির পিছনে আসতে। দাস সাহেব ভেতরে ঢোকা মাত্র মাখন আর সুশীলা টের পায় এই বিকেলবেলাই সে মদ খেয়েছে।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দেননি?

এই যে দিচ্ছি। শুনছ, ইনি আমাদের মি. দাস।

পরনের বেনারসীর রঙের মতো সুশীলা সলজ্জ ভঙ্গিতে একটু হাসে, নববধূর মতো। বৌয়ের মতোই যে তাকে দেখাচ্ছে সুশীলার তাতে সন্দেহ ছিল না। দাস সাহেব আলাপি লোক, অল্প সময়ে আলাপ জমিয়ে ফেলে। যে চাপা ক্ষোভ শুরু হয়েছিল মাখনের মনে, অল্পে অল্পে তলে তলে তা বাড়তে থাকে। স্ত্রীর সঙ্গে একজন। যখন কোথাও যাচ্ছে, বিনা আহ্বানে কেউ এভাবে গাড়ি চড়াও হয়ে তাদের ঘাড়ে চাপে না–অন্তত তাদের সঙ্গে সাধারণ ভদ্রতা বজায় রাখবার কিছুমাত্র প্রয়োজনও মানুষটা যদি বোধ করে। বার বার এই কথাটাই মাখনের মনে হতে থাকে যে অন্য কেউ হলে তার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করার কথা দাস ভাবতে পারত না।

দাস বলে, চা খেয়েছেন?

সুশীলা বলে, না।

আসুন না আমার ওখানে, চা-টা খাওয়া যাবে।

মাখনের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাস যোগ দেয়, সেই কন্ট্রাক্টের কথাটাও আপনার সঙ্গে আলোচনা করা যাবে। আপনাকে খুঁজছিলাম।

মাখনের দুচোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সুশীলার নিশ্বাস আটকে যায়। আজ কদিন ধরে মাখন এই কন্ট্রাক্টটা বাগাবার চেষ্টা করছিল–প্রকাণ্ড কন্ট্রাক্ট, লাখ টাকার ওপর ঘরে আসবে। দাস যেন কেমন আমল দিচ্ছিল না তাকে, কথা তুললে এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিল। ঈশ্বরীপ্রসাদকে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতে দেখে আর তার সঙ্গে দাসের দহরম-মহরম দেখে ব্যাপার অনেকটা অনুমান করে নিয়ে আশা একরকম মাখন ছেড়ে দিয়েছিল। দাস আজ ও-বিষয়েই তার সঙ্গে কথা কইতে চায়। এই দরকারে তাকে দাস খুঁজছিল।

সম্ভ্রান্ত শহরতলিতে দাসের মস্ত বাড়ি। সামনে সম্ভ্রান্ত বাগান। অনেকগুলো চাকর-খানসামা নিয়ে এত বড় বাড়িতে দাস একা থাকে। বিয়ে করেনি, বৌ নেই। আত্মীয়স্বজনের সে সাহায্য করে কিন্তু কাছে রাখে না। শখ হলে মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গ উপভোগ করে দু-চার দিনের জন্য, ছুটি ভোগ করার মতো।

যেই আসুক সাহেব বাড়ি নেই বলে দরজা থেকে বিদায় করে দেবার হুকুম জারি করে দাস তাদের ভেতরে নিয়ে বসায়। ঘরের সাজসজ্জা আর আসবাবপত্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে সুশীলা, নিজেদের বাড়িতে এখানকার কোনো বিশেষত্ব আমদানি করবে মনে মনে স্থির করে। তারপর আসে চা। এ কথা হতে হতে আসে কন্ট্রাক্টের। কথা। সুশীলার সামনেই আলোচনা চলতে থাকে, গভীর আগ্রহের সঙ্গে সে সব কথা শোনবার ও বোঝবার চেষ্টা করে, উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে টিপটিপ করে। মাখনের সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ হবার পর সুশীলার দিকে দাসের বিশেষ মনোযোগ দেখা যায় না, কথাতেই তাকে মশগুল মনে হয়। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ঘরে আলো জ্বলে স্নিগ্ধ।

তারপর দাস বলে, হাওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলা দরকার। বসুন, ফোন করে আসছি।

ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে সুশীলার দিকে চেয়ে হেসে বলে, খালি কাজের কথা বলছি, রাগ করবেন না।

সুশীলা তাড়াতাড়ি বলে, না, না।

দাস চলে গেলে চাপা গলায় সুশীলা বলে, সোয়া লক্ষের মতো হবে!

বেশিও হতে পারে।

ফেরবার পথে কালীঘাটে পুজো দিয়ে বাড়ি যাব। গলা বুজে আসে সুশীলার।

খানিক পরে ফিরে আসে দাস।

মাখনবাবু!

আজ্ঞে?

হাওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বললাম। আপনাকে গিয়ে একবার কথা বলতে হবে। কাগজপত্রগুলো নিয়ে আপনি এখুনি চলে যান। দুটো সই করিয়ে নিয়ে আসবেন। দাস নিশ্চিন্তভাবে বসে।-আমরা ততক্ষণ গল্প করি। আপনাদের না-খাইয়ে ছাড়ছি না। দাস একটা সিগারেট ধরায়। সুশীলাকে বলে, উনি ঘুরে আসুন, আমরা ততক্ষণ আলাপ জমাই। আর এক কাপ চা খাবেন?

সুশীলা আর মাখন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। পাখা ঘোরবার আওয়াজে ঘরের স্তব্ধতা গমগম করতে থাকে। মাখন সুশীলা দুজনেরই মনে হয় আওয়াজটা হচ্ছে তাদের মাথার মধ্যে-অকথ্য বিশৃঙ্খল উদ্ভট আওয়াজ।

তারপর মাখন বলে, তুমি চা-টা খাও, আমি চট করে ঘুরে আসছি।

সুশীলা ঢোক গিলে বলে, দেরি কোরো না।

না, যাব আর আসব।

গাড়ি রাস্তায় পড়তেই মাখন ড্রাইভারকে বলে, জোরসে চালাও। জোরসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *