Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যদিও সন্ধ্যা (২০০০) || Humayun Ahmed » Page 6

যদিও সন্ধ্যা (২০০০) || Humayun Ahmed

আনিকা চিন্তাই করতে পারে নি

আনিকা চিন্তাই করতে পারে নি, আজও তার অফিসে পৌছাতে দেরি হবে। অন্যদিনের চেয়ে দশ মিনিট আগে সে ঘর থেকে বের হয়েছে। সেই হিসাব ধরলে পনেরো মিনিট আগে অফিসে পৌছানোর কথা, অথচ এলিফ্যান্ট রোডের জ্যামে সে চল্লিশ মিনিট ধরে আটকা পড়ে আছে। জ্যামের কারণ রাস্তার মাঝখানে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে একটি ট্রাক। ট্রাকের পাশের খালি জায়গাটা দিয়ে এক সঙ্গে দুটা গাড়ি ঢুকতে গিয়ে গিট্টু লেগে গেছে। কেউ নড়তে পারছে না। কারো তেমন মাথাব্যথাও নেই। সবাই গা ছেড়ে অপেক্ষা করছে। কিছু একটা হবে। কখন হবে কীভাবে হবে সেটা নিয়ে কারো কোনো টেনশন দেখা যাচ্ছে না। ফ্লাস্কে করে এক ছেলে রঙ চা বিক্রি করছে। অনেকেই আগ্রহ করে সেই চা খাচ্ছে।

ছেলেটা আনিকার কাছে এসে বলল, আফা, চা খাইবেন?

আনিকা বলল, যা ভাগ। থাপ্পড় খাবি।

আনিকা ভেবেই পাচ্ছে না ফট করে থাপ্পড় দেবার কথাটা সে কেন বলল। তার মেজাজ কি এতটাই খারাপ হয়েছে? প্রতি সপ্তাহে তার দুই-তিনদিন লেট হচ্ছে। অন্যদেরও লেট হচ্ছে। অন্যদেরটা কারোর চোখে পড়ছে না। তারটা চোখে পড়ছে। সেকশান অফিসার সিদ্দিক সাহেব গতকাল খুব ভালো মানুষের মতো তার ঘরে এসে বললেন, মিস আনিকা, আপনি কি দুই আড়াইশ টাকা খরচ করতে পারবেন?

আনিকা তটস্থ হয়ে বলল, কোন ব্যাপারে স্যার?

একটা দেয়ালঘড়ি কিনে আপনার শোবার ঘরে টানিয়ে রাখবেন। আজকাল দেয়ালঘড়ি সস্তা হয়ে গেছে। দুই আড়াইশ টাকায় ভালো ঘড়ি পাওয়া যায়। আমার ধারণা আপনার বাসায় কোনো দেয়ালঘড়ি নেই।

অপমানে আনিকার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, এইবার বেতন পেয়েই একটা ভালো ঘড়ি কিনব স্যার।

জ্যাম বোধহয় ছুটেছে। সব গাড়ি একসঙ্গে চলা শুরু করেছে। এতক্ষণ কারো কোনো ব্যস্ততা ছিল না। এখন ব্যস্ততার সীমা নেই— কে কার আগে যাবে! যেন অলিম্পিকের দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ফার্স্ট হয়ে সোনা জিততে হবে।

এক ঘণ্টা বাইশ মিনিট লেট করে আনিকা অফিসে পৌঁছল।

সিদ্দিক সাহেব আজ কী বলবেন কে জানে! আজ হয়তো বলবেন— মিস আনিকা, আপনাকে অফিসের খরচে একটা ঘড়ি কিনে দেই?

শান্ত গলায় কঠিন অপমানের কথা একটা মানুষ কী করে বলে কে জানে! আনিকার ইচ্ছা করছে অফিসে না ঢুকে বাসায় চলে যেতে। পর পর তিনদিন বাসায় কাটিয়ে অফিসে হাজির হবে। যার যা ইচ্ছা বলুক।

যা ইচ্ছা করে তা করা যায় না। মানুষ চলে অনিচ্ছার পথে। তাকে বাধ্য হয়ে চলতে হয়। আনিকা তার ঘরে ঢুকল। তার ঘরে সে একা না, আরেকজন সিনিয়র কলিগ আছেন। জাহানারা। অফিসে তার নাম পান আপা। তিনি সারাক্ষণ পান খান। শুধু যে নিজে খান তা না, অন্যদেরও খাওয়াবার চেষ্টা করেন। ময়মনসিংহের মিকচার জরদা, মহেশখালির পান।

জাহানারা আনিকাকে দেখে কেমন যেন অন্যরকম চোখে তাকাল।

আনিকার বুক উঁৎ করে উঠল। আজ মনে হয় বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে।

আনিকা বলল, আপা কেমন আছেন? আজ দেরি হয়ে গেল। কেউ কি আমার খোঁজ করেছিল?

জাহানারা শুকনা গলায় বললেন, বড় সাহেব দুবার এসে খোঁজ করেছেন। তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।

আনিকা টোক গিলল। আজ ভালো যন্ত্রণা হবে। এখনো সময় আছে চেয়ারে না বসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেই হয়। তিনদিন বাসায় শুয়ে বসে থাকবে। বেইলী রোডে নাটক পাড়ায় নাটক দেখবে, ফুচকা খাবে। একদিন যাবে শওকতের বাসায়। শওকত তার ছেলেকে নিয়ে কী আহ্লাদী করছে দেখবে। ছেলের জন্মদিনে শওকত কি তাকে ডাকবে? মনে হয় ডাকবে না। ডাকুক বা না ডাকুক, জন্মদিনের একটা উপহার তো কিনতে হবে। ছেলেদের উপহার কেনার যন্ত্রণা আছে। একটা দিন লাগবে উপহার বেছে বের করতে। যত কিছুই সে ভাবুক, শেষপর্যন্ত বড় সাহেবের কামরায় তাকে ঢুকতেই হবে। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় নিজের স্বাধীনতায় সে আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে নি।

সিদ্দিক সাহেব আনিকাকে দেখে বললেন, ও আচ্ছা আপনি এসেছেন। বসুন বসুন।

আনিকা বসল।

সিদ্দিক সাহেব তার সামনের খবরের কাগজ ভঁজ করে রাখতে রাখতে বললেন, আজকের কাগজ দেখেছেন? জোকস কর্নারে মজার একটা জোক ছাপা হয়েছে। টিচার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছে— ঘোড়া এবং হাতি, এদের পার্থক্য কী? ছাত্র বলেছে, ঘোড়ার লেজ পেছনে থাকে, হাতির লেজ সামনে থাকে। হা হা হা। এইসব জোকস এরা কোথায় পায় কে জানে!

আনিকা অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার আচারআচরণের কোনো মানে সে বুঝতে পারছে না।

মিস আনিকা!

জি স্যার।

আপনার কী রাশি বলুন তো।

তুলা রাশি। লিবরা।

আজকের দিনে আপনার রাশিফল কী বলছে দেখি— তুলা রাশি : বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকুন। দূরপাল্লার ভ্রমণে বের হবেন না। চাকরি ও ব্যবসায় আর্থিক গোলযোগের সম্ভাবনা। আপনি কি রাশিফলে বিশ্বাস করেন?

আনিকা বলল, আমি বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাসও করি না।

সিদ্দিক সাহেব হাসিমুখে বললেন, আমিও বিশ্বাস করি না, তবে আমার বেলায় খুব মিলে। আমি পত্রিকা খুলে প্রথম পড়ি রাশিফল। তারপর পড়ি জোকস, তারপর ফ্রন্ট পেইজে যাই।

আনিকা বুঝতে পারছে না এই মানুষটার সমস্যা কী? হড়বড় করে এত কথা কেন বলছে! কোনো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে। ঘটনাটা কী?

মিস আনিকা!

জি স্যার।

আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। সুসংবাদ এবং সারপ্রাইজ। বিগ সারপ্রাইজ। চা খাবেন?

জি-না স্যার, চা খাব না। সারপ্রাইজটা কী?

আপনার প্রমোশন হয়েছে। আমাদের চাকরিতে প্রমোশন তো রেয়ার ঘটনা। দশ বছর বার বছর একই পোস্টে ঘটঘটর করেও কিছু হয় না। আপনার ভাগ্য খুবই ভালো। কনগ্রাচুলেশনস।

আনিকা হতভম্ব হয়ে গেল। তার প্রমোশন হয়েছে। তার মানে সে এখন সিদ্দিক সাহেবের ব্যাংকের একজন। অফিসের গাড়ি তাকে নিয়ে আসবে, দিয়ে আসবে। অফিসের কোয়ার্টারের জন্যে অ্যাপ্লাই করতে পারবে। সম্পূর্ণ তার নিজের আলাদা একটা ঘর হবে। ঘরের সামনে টুলের উপর পিওন বসে থাকবে।

মিস আনিকা!

জি স্যার।

আপনি কি খুশি হয়েছেন?

অবশ্যই খুশি হয়েছি। খুশি হবো না কেন? এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।

কল্পনার বাইরে থাকবে কেন? আপনি দুটা সেকশনাল পরীক্ষাতেই খুব ভালো করেছেন। আপনি কাজ-কর্মেও স্মার্ট। আপনার রেকর্ডস তো খুবই ভাললা। আমাদের মিষ্টি কবে খাওয়াবেন?

আজই খাওয়াব।

আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে বাসায় যান। আত্মীয়স্বজনদের সুসংবাদটা দিন।

আনিকা চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হলো। এই আনন্দের খবরটা প্রথমেই শওকতকে দিতে ইচ্ছা করছে। সে কি মিষ্টি নিয়ে শওকতের বাসায় যাবে? শওকত যখন বলবে, মিষ্টি কিসের? সে বলবে, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তার মিষ্টি। আমার চাচাশ্বশুর আমাকে দেখতে এসেছিলেন, তার মিষ্টি।

শওকতের বাসায় যাওয়া যাবে না। মিতুর শ্বশুরবাড়িতে অবশ্যি যাওয়া যায়। মিতুর বরের জন্যে একটা পাঞ্জাবি, এক প্যাকেট মিষ্টি।

আনিকা নিজের ঘরে ঢুকল। জাহানারা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কী লজ্জার ব্যাপার! দীর্ঘদিনের সহকর্মী আজ তাকে দেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আনিকার লজ্জা লাগছে, আবার খুব ভালোও লাগছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আজ ছুটি নেয়াই ভালো। প্রমোশন পেয়ে একজন একটু পর পর আনন্দে কাদছে এই দৃশ্য দেখে সবাই আড়ালে হাসাহাসি করবে। সে এখন একজন ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার। তাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করার সুযোগ সে দেবে না।

প্রমোশনের খবর মনে হয় সবাই জেনে গেছে। অফিস থেকে বের হতেই কারপুলের এক ড্রাইভার ছুটে এসে বলল, আপা, কোথায় যাবেন?

আনিকা বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না, বাসায় চলে যাব।

ড্রাইভার বলল, একটু দাঁড়ান আপা, গাড়ি নিয়ে আসি।

আনিকা বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। না না গাড়ি লাগবে না এই বলে সে কি হাঁটতে শুরু করবে? না-কি বলবে, আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিন। তাতেই হবে।

আনিকা তার অফিসের গাড়িতে বসে আছে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার। কোনো বিস্ময়ই মানুষ একা নিতে পারে না। আনিকার এমনই কপাল, তার জীবনের সমস্ত বিস্ময়কর ঘটনা সে আর কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে নি।

কত নাটকীয় ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে! এমন কি হতে পারে না হঠাৎ তার চোখে পড়বে রাস্তার এক মাথায় শওকত দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, এই জায়গায় এসে তাদের গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ল। গাড়ির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আনিকা ডাকল। শওকত অবাক হয়ে কাছে এসে বলবে, সরকারি গাড়ি দেখছি! তুমি গাড়ি পাও জানতাম না তো! আনিকা তখন অবহেলার ভঙ্গিতে বলবে, আগে পেতাম না, এখন প্রমোশন হয়েছে। এখন পাচ্ছি।

প্রমোশন আবার কবে হলো?

বাদ দাও তো, প্রমোশন কবে হলো সেই আলাপ এখন করতে ইচ্ছা করছে না। তুমি সিগারেট ফেলে গাড়িতে উঠে আস।

আনিকা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। গাড়িতে উঠে আসতে বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। সরকারি গাড়িতে বাইরের লোক তোলার নিয়ম নিশ্চয়ই নাই।

ড্রাইভার বলল, আপা, আপনার বাসা কোন দিকে?

আনিকা বলল, বাসায় যাব না। আপনি একটা কাজ করুন, আমাকে নিউমার্কেটের গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। আমি কয়েকটা ওষুধ কিনব।

আমি অপেক্ষা করি?

আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাবেন। আমার দেরি হবে।

প্রথমেই আনিকা কয়েকটা গানের ক্যাসেট কিনল। তার মধ্যে নজরুলগীতির একটা ক্যাসেট আছে। সেখানে মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম গানটা আছে। ক্যাসেটগুলি কেনার পর পরই মনে হলো— শুধু শুধু টাকাগুলি নষ্ট করেছে। তাদের বাসায় ক্যাসেট শোনার কোনো যন্ত্র নেই। আনিকার সামান্য মন খারাপ হলো। অকারণে টাকা নষ্ট করতে তার মায়া লাগে। সে বেশ কৃপণ মেয়ে।

আজকের শুভদিনটা মনে রাখার জন্যে শওকতের জন্যে কিছু কেনা দরকার। দামি কিছু না। দুই আড়াইশ টাকার মধ্যে কিছু। একটা শার্ট কেনা যেতে পারে। আজকাল কাপড়-চোপড় সস্তা হয়েছে। দুই আড়াইশ টাকায় ভালো শার্ট পাওয়া যায়।

অনেক ঘোরাঘুরির পর একটা শার্ট আনিকার পছন্দ হলো। দাম তিনশ পঞ্চাশ টাকা। ফিক্সড প্রাইসের দোকান। এক টাকাও কমাবে না। তিনশ টাকায় শার্টটা কেনার সে অনেক চেষ্টা করল। দোকানদার রাজি হলো না।

আনিকা ঠিক করল শওকতকে কিছু না দিয়ে তার ছেলের জন্যে উপহার কিনবে। শওকতের জন্যে শার্টের বাজেট ছিল আড়াইশ টাকা। তার সঙ্গে আরো আড়াইশ যোগ করে পাঁচশ টাকা হবে। পাঁচশ টাকার মধ্যে কিছু। যে ছেলে আমেরিকার মতো জায়গায় বড় হয়েছে, তাকে নিশ্চয়ই এক-দেড়শ টাকার খেলনা দেয়া যায় না।

আনিকা অনেকগুলো দোকানে ঘুরল। কোনো কিছুই মনে ধরছে না। একটা কচ্ছপ শুধু পছন্দ হয়েছে। কচ্ছপটা সারাক্ষণ শুধু মাথা দোলায়। রঙ-বেরঙের কচ্ছপ কোনো কারণ ছাড়াই মাথা দোলাচ্ছে। দেখতে মজা লাগে। কচ্ছপটার দাম মাত্র একশ পঁচিশ টাকা। এত কম দামি জিনিস বিদেশী ছেলেকে উপহার দেয়া ঠিক না। আরো ভালো কিছু দেখতে হবে। জিনিসটা দেখতে সুন্দর হবে। দাম পাঁচশ টাকার মধ্যে থাকবে।

দুপুর দুটা পঁচিশ মিনিটে আনিকা নিউমার্কেট থেকে বের হলো। তার হাতে কচ্ছপ। একশ পঁচিশ টাকা দামের কচ্ছপ তাকে দোকানি দিয়েছে নব্বই টাকায়।

নিউমার্কেটের গেট থেকে বের হবার পরপরই একটা ইয়েলো ক্যাব এসে তার গা ঘেঁসে দাঁড়াল। ড্রাইভার মুখ বের করে বলল, আপা আমাকে চিনেছেন?

আনিকা বলল, হ্যাঁ চিনেছি।

কেমন আছেন আপা?

ভালো।

কোথায় যাবেন? উঠেন গাড়িতে উঠেন।

কোনো কথা না বলে আনিকা গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার বলল, বাসায় যাবেন, না ঐ দিনের মতো কিছুক্ষণ ঘুরবেন? আনিকা বলল, আপনার গাড়িতে কি এসি আছে? এসি থাকলে কিছুক্ষণ ঘুরব।

এসি আছে। নতুন গ্যাস ভরেছি, ভালো ঠাণ্ডা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন গাড়ির মধ্যে মাঘ মাস।

গাড়িতে ক্যাসেটপ্লেয়ার আছে? ক্যাসেটপ্লেয়ার থাকলে গান শুনব। আমি ক্যাসেট কিনে এনেছি।

ক্যাসেটপ্লেয়ার নষ্ট। ঠিক করব ঠিক করব বলে ঠিক করা হয় না। টেক্সিক্যাবে সবাই এসি চায়। কেউ গান শুনতে চায় না। টেক্সিক্যাবে উঠে গান শুনবে এত সৌখিন মানুষ বাংলাদেশে নাই। বিলেত-আমেরিকায় থাকলে থাকতে পারে।

আপনি কথা কম বলে গাড়ি চালান। আপনি কথা বেশি বলেন।

ড্রাইভার বলল, একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করব, তারপর আর কিছু জিজ্ঞেস করব না। ফাঁকা রাস্তায় যতক্ষণ বলেন ঘুরব।

আনিকা বলল, কথাটা কী?

উনার সঙ্গে কি পরে দেখা হয়েছে?

কার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

ঐ যে ভদ্রলোক যাকে বিয়ে করতে গেলেন। কাজি অফিসের সামনে থেকে ঐ লোক ছুটে গেল। আমার পরিবারকে ঘটনাটা বলেছিলাম, সে মনে খুবই কষ্ট পেয়েছে।

আপনি অনেক কথা বলে ফেলেছেন, আর কথা বলবেন না।

জি আচ্ছা।

আপনার ছেলেমেয়ে আছে?

একটা মেয়ে, ক্লাস টুতে পড়ে।

মেয়ের নাম কী?

উজ্জলা।

উজ্জলা আবার কেমন নাম?

মেয়ের গায়ের রঙ উজ্জ্বল, এই জন্যে তার মা শখ করে নাম রেখেছে উলা। ভালো নাম মুসাম্মত উজ্জলা বেগম।

আনিকা হাতে ধরে রাখা কচ্ছপটা ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, এই কচ্ছপটা রাখুন। উজ্জলাকে দেবেন। আমার উপহার। আর শুনুন, এখন থেকে কোনো কথা বলবেন না। মুখ বন্ধ করে গাড়ি চালাবেন। একটা শব্দ যদি বলেন, আমি গাড়ি থেকে নেমে যাব। শব্দও বলতে হবে না, গলা খাকারি দিলেও নেমে যাব।

গাড়ির এসি সত্যি ভালো। আনিকার এখন শীত শীত লাগছে।

একটা পাতলা সুতির চাদর থাকলে ভালো হতো। সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা। গাড়ির ক্যাসেটপ্লেয়ারটা ভালো থাকলে গান শোনা যেত— মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম। হাত প্রেমে ধরতে হয়। অপ্রেমে হাত ধরা যায় না। সে যে শওকতের হাত ধরে আছে, সেই হাত কি প্রেমে ধরে আছে, না অপ্রেমে ধরে আছে? ইদানীং তার খুব ঘনঘন মনে হচ্ছে— শওকত নামের মানুষটার প্রতি তার কোনো প্রেম নেই। যা আছে তা অন্য কিছু। এই অন্য কিছুটা কী তা সে জানে না। খুব বুদ্ধিমান কোনো মানুষের সঙ্গে যদি পরিচয় থাকত, তাকে সে জিজ্ঞেস করত। মিসির আলির মতো বুদ্ধিমান কেউ। যিনি একটা দুটা প্রশ্ন করেই সব জেনে ফেলতেন। কিংবা তাকে প্রশ্নও করতে হতো না। তিনি চোখের দিকে তাকিয়েই বলে ফেলতেন।

আনিকা পা উঠিয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসল। চোখ বন্ধ করল। এখন কেন জানি তার মনে হচ্ছে গাড়িতে গান বাজছে। এটা মন্দ না। গান হচ্ছে কল্পনায়।

কল্পনায় গান শুনতে শুনতে মিসির আলী সাহেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। দেখা যেতে পারে এই বৃদ্ধ তার সমস্যার সমাধান করতে পারেন কি-না। সে কী জন্যে শওকত নামের মানুষটার সঙ্গে ঝুলে আছে। মিসির আলী প্রশ্ন করছেন, সে জবাব দিচ্ছে।

প্রশ্ন : উনার সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়?

উত্তর : অনেক দিনের।

প্রশ্ন : শোন আনিকা, তুমি এক-দুই শব্দে প্রশ্নের জবাব দেবে না। এক দুই শব্দে প্রশ্নের জবাব দিতে হয় পুলিশের কাছে। আমি পুলিশ না। আমার প্রশ্নের জবাব বিস্তারিতভাবে দেবে। সেই বিস্তারিত জবাব থেকে অনেক কিছু বের হয়ে আসবে। এখন বলো, শওকত নামের মানুষটার সঙ্গে তোমার কত দিনের পরিচয় এবং কীভাবে পরিচয়?

উত্তর : আমার বড়ভাই এবং উনি এক ক্লাশে পড়তেন। দুজনের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব ছিল। তারা দুজন এক সঙ্গে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। উনি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আমি পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাকে চিনি।

উনার বিষয়ে আপনাকে একটা মজার কথা বলি— পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাকে আমি নাম ধরে ডাকতাম। ভাইয়া তাঁকে ডাকত শওকত। আমিও ডাকতাম শওকত। হয়তো কোনো একদিন উনি বাসায় এসেছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে বলতাম— ভাইয়া, শওকত এসেছে। ভাইয়া আমাকে বকাবকি করত। বলত, নাম ধরে ডাকছিস কেন? আমি বলতাম, তুমিও তো নাম ধরেই ডাক। একটু বড় হবার পর আমি শওকত ভাই ডাকা শুরুর চেষ্টা করি; তখন উনি বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকে, আমার খুব মজা লাগে। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে।

প্রশ্ন : তোমার বড়ভাইয়ের প্রসঙ্গে বলো।

উত্তর : উনি আমার আপন ভাই ছিলেন না। উনি ছিলেন আমার সৎভাই। উনার মার মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। ভাইয়া আমাকে খুব আদর করতেন। আমার ভাইয়া আমাকে যে আদর করতেন, পৃথিবীর কোনো ভাই তার বোনকে এত আদর কখনো করে নি, ভবিষ্যতেও করবে না।

প্রশ্ন : উনি মারা গেছেন?

উত্তর : জি, উনি মারা গেছেন। আমি তখন সেভেনে পড়ি।

প্রশ্ন : তোমার ভাই কীভাবে মারা গেছেন?

উত্তর : সেটা আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।

প্রশ্ন : অপঘাতে মারা গেছেন?

উত্তর : হ্যাঁ, অপঘাতে মারা গেছেন। ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। আমার বাবা-মা দুজনই ভাইয়াকে খুব যন্ত্রণা দিতেন। সারাক্ষণ বকাবকি, সারাক্ষণ রাগারাগি। ভাইয়ার আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়াটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। বাবা বলতেন, সব বখাটেরা আর্ট কলেজে পড়তে যায়। এটার নাম আর্ট কলেজ না, এটার নাম বখাটে কলেজ। বাবা তার কলেজে পড়ার খরচ দেয়া বন্ধ করে দিলেন। তখন শওকত তার কলেজের বেতন দিত। রঙ-তুলি কিনে দিত। শওকতের অবস্থা তো ভালো ছিল না। তারও খুব কষ্ট হতো। শেষে ভাইয়া কলেজ ছেড়ে দিল। দিনরাত বসে বসে থাকত। তখন তার মধ্যে সামান্য মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিল। রাত জেগে ছবি আঁকত। ছবির মানুষগুলির সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলত।

প্রশ্ন : কী কথা?

উত্তর : কী কথা বলত আমার মনে নেই। সারারাত জেগে জেগে ছবি আঁকত আর কথা বলত— এইটা মনে আছে। তারপর একদিন বাবাকে লম্বা একটা চিঠি লিখে সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরে গেল।

প্রশ্ন : সেই চিঠিতে কী লেখা?

উত্তর : কী লেখা আমি বলতে পারব না। বাবা সেই চিঠি কাউকে পড়তে দেন নি। মিসির আলী সাহেব শুনুন, আমি কিন্তু ভালো মেয়ে না। আমি খুব খারাপ মেয়ে। আমি কতটা খারাপ আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। ভাইয়ার মৃত্যুর পর আমি ঠিক করেছিলাম— দোকান থেকে ইঁদুর মারা বিষ কিনে এনে চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে বাবা-মা দুজনকেই খাওয়াব। শুধু যে চিন্তা করেছিলাম তা না, বিষ কেনার জন্যে ঘর থেকে বেরও হয়েছিলাম। শুনুন, আমি এখন ঘুমিয়ে পড়ব। খুব ঘুম পাচ্ছে। যতটুকু শুনেছেন সেখান থেকে অ্যানালাইসিস করে কিছু বলতে পারবেন?

মিসির আলী : পারব। শওকত নামের মানুষটির প্রতি তোমার কোনো প্রেম নেই। তুমি তার হাত ধরেছ অপ্রেমে। তোমার ভাইয়ার প্রতি তোমার যে প্রচণ্ড আবেগ এবং ভালোবাসা ছিল, সেই আবেগ আর ভালোবাসাই তুমি ভাইয়ার বন্ধুর দিকে ছড়িয়ে দিয়েছ। বাবার মৃত্যুর পর মানুষজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফাদার ফিগার খোঁজার জন্যে। তুমি ব্যস্ত হয়েছ ব্রাদার ফিগারের জন্যে।

উত্তর : আপনি কিছুই জানেন না। শওকত যেদিন বিয়ে করলেন, সেদিন সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত আমি কোনো কিছু মুখে দেই নি। রাত এগারোটার সময় আমি এক গ্লাস পানি খাই আর তার সঙ্গে নয়টা ঘুমের ওষুধ খাই। ভাইয়া যে ওষুধগুলি খেয়েছিল সেই ওষুধ। আমি খুব আনলাকি মেয়ে তো, ওষুধ খাবার পরও আমার মৃত্যু হয় নি। আমি খুব আনলাকি মেয়ে সেই জন্যেই আমি বেঁচে যাই। আমাকে কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নি। স্টোমাক ওয়াশ করে নি। তিন-চারদিন বিছানায় আধমরার মতো পড়ে থেকে সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর যে কাজটা করি তা হলো—শওকতের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই। তাকে বলি, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আমি তোমার কোনো কথা শুনব না। তুমি অবশ্যই আমাকে বিয়ে করবে। উনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এরকম ছটফট করছ কেন? বসো তো। ঠাণ্ডা হয়ে বসে কথা বলো। চা খাবে? আমি চা বানিয়ে আনি, চা খাও।

মিসির আলী : তুমি যখন কথা বললে, তখন শওকত সাহেবের স্ত্রী বাসায় ছিলেন না?

উত্তর : না, ছিলেন না। আর থাকলেও আমি তাঁর সামনেও এই কথাগুলি বলতাম। এখন বুঝেছেন আমি যে শওকতের হাত ধরেছি তা অপ্রেমে ধরি নি। প্রেমেই ধরেছি। এখন আপনি বিদেয় হন। ফুটেন। আপনার সঙ্গে বকবক করে আমার মাথা ধরে গেছে।

আনিকার চোখ বন্ধ। মাথার যন্ত্রণার জন্য মদিনাবাসীর গান শুনতে ভালো লাগছে না। আনিকা চোখ মেলে বিরক্ত গলায় বলল, ড্রাইভার সাহেব, ক্যাসেটটা বন্ধ করেন তো।

ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, আপা, ক্যাসেট তো বাজতেছে না। ক্যাসেটপ্লেয়ার নষ্ট।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress