জংলামতো ছায়াময় জায়গা
জংলামতো ছায়াময় জায়গা। আধো আলো আধো অন্ধকারে দুটা কচুগাছ। একটা কচুগাছে রোদ এসে পড়েছে। তির্যক আলো পড়ার জন্যেই হয়তো কচুপাতার সবুজ রঙ ঝলমল করছে। দুটি কচুপাতাতেই শিশির জমে আছে। চিকমিক করছে শিশির।
শওকতের ইচ্ছা করছে কচুপাতায় আস্তে করে টোকা দিতে। যাতে শিশিরবিন্দুগুলি গড়িয়ে পড়ে। ঝরে পড়ছে শিশির দেখতেও খুব সুন্দর লাগার কথা। কাজটা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দৃশ্যটা বাস্তব না। জলরঙে আঁকা ছবি। ছবির পাতায় টোকা দিয়ে শিশির ঝরানো যাবে না। ছবিতে সময় স্থির হয়ে থাকে। সময়কে আটকে দিতে পারেন শুধুমাত্র চিত্রকররা। কার কথা যেন? ও আচ্ছা, ব্রিটিশ, পেইন্টার কনস্টবলের কথা। ইনি সাত বছর ধরে এঁকেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবি— Landscape with trees and a distant mansion.
এই ছবিটা কনস্টবল সাহেবকে দেখাতে পারলে হতো। শওকত বলত, আচ্ছা স্যার, আপনার কি ইচ্ছা করছে না কচুপাতায় টোকা দিয়ে শিশিরবিন্দু ঝরিয়ে দিতে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কনস্টবল সাহেব তার দিকে কঠিন চোখে তাকাতেন, জবাব দিতেন না। তখন শওকত বলত, স্যার, আপনার তো ডিটেল কাজের দিকে ঝোঁক। এই ছবির ডিটেলের কাজ দেখেছেন? আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন জলরঙে ডিটেলের কাজ করা খুবই কঠিন। ছবির গ্রান্ডমাস্টাররা এই কারণেই জলরঙ পছন্দ করতেন না।
শওকত প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। নতুন প্যাকেট। এখনো খোলা হয় নি। এই বাড়িতে সিগারেট খাওয়া যায় কি-না সে জানে না। আজকাল প্রায় বাড়িতেই সিগারেট ধরানো নিষিদ্ধ। এটা একটা নতুন ফ্যাশন। সিগারেট ঠোঁটে দেয়ামাত্র ঘরের কত্রী চোখ কপালে তুলে বলবেন—ভাই, এই বাড়ি স্মোক-ফ্রি। সিগারেট খাবার জন্যে বারান্দায় জায়গা করা আছে। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
এ বাড়ির ড্রয়িংরুমের সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে। এ বাড়িটাও স্মোকফ্রি। শওকত যেখানে বসে আছে, তার পাশেই সাইড টেবিলে অবশ্যি একটা এসট্রে রাখা আছে। ক্রিস্টালের তৈরি এসট্টে। এত সুন্দর যে সেখানে সিগারেটের ছাই ফেলতে হলে বুকের কলিজা বড় হওয়া লাগে। দেখে মনে হচ্ছে না কেউ এখানে কোনোদিন ছাই ফেলেছে।
ড্রয়িংরুম ফাঁকা। সিগারেট ধরানো মাত্র কেউ বলবে না এই বাড়ি স্মোক ফ্রি। তারপরেও শওকত মন স্থির করতে পারছে না। সে বসে আছে পনের মিনিটের মতো হয়েছে। এর মধ্যে একজন বাবুর্চি টাইপ লোক শান্তিনিকেতনি ভাষায় বলেছে, আপনাকে চা দেব? শওকত বলেছে, হ্যাঁ। সেই চা এখনো আসে নি। একা একা বসে থাকতে শওকতের খুব যে খারাপ লাগছে তা না। অতি বড়লোকদের ড্রয়িংরুমে এমন সব জিনিস থাকে যা দেখে সুন্দর সময় কাটানো যায়।
কোনো কোনো বাড়ির ড্রয়িংরুম মিউজিয়ামের মতো সাজানো থাকে; মুখোশ, গালার তৈরি মূর্তি, পাথরের মূর্তি, কষ্টিপাথরের মূর্তি, লাফিং বুদ্ধা। আবার কিছু ড্রয়িংরুম হয় আর্ট গ্যালারি। বিখ্যাত সব পেইন্টারদের ছবি। যামিনী রায়, নন্দলাল বসু, ফিদা মকবুল হোসেন। দেশীয় পেইন্টারদের মধ্যে জয়নুল আবেদীন ছাড়া আর কেউ পাত্তা পান না।
আবার কিছু কিছু বাড়ির ড্রয়িংরুম দেখে মনে হয়— ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে ঢুকে পড়া হয়েছে। পৃথিবীর নানান দেশের নানান জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। গৃহকর্তা যেসব দেশ ভ্রমণ করেছেন, সেসব দেশের কিছু না কিছু জিনিস কিনেছেন। এস্কিমোদের মাথার ফার টুপি থেকে ইফেল টাওয়ারের ক্রিস্টাল রেপ্লিকা। কিছুই বাদ নেই।
এই বাড়ির ড্রয়িংরুমের চরিত্রটা শওকতের কাছে এখনো পরিষ্কার হয় নি। দর্শনীয় একটা ঝাড়বাতি আছে। যদিও ঝাড়বাতির চল এখন উঠে গেছে। নতুন কনসেপ্টে ড্রয়িংরুম হতে হবে সিম্পল, ঘরোয়া। ইংরেজি ভাষায় কমফর্টবেল এন্ড কোজি। আধুনিক ড্রয়িংরুমে দুটার বেশি পেইন্টিং থাকবে না। এ বাড়িতে আছে কচুপাতার উপর শিশির।
তিনটা ফ্যামিলি ছবি থাকতে পারে। তিনটার বেশি কখনো না। এই ড্রয়িংরুমে তিনটাই আছে।
স্যার, আপনার চা।
শওকত তাকাল। বাবুর্চি টাইপ লোকটা শেষপর্যন্ত চা এনেছে। এককাপ চা। চায়ের সঙ্গে পিরিচ দিয়ে ঢাকা ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি। পানিটা যে খুবই ঠাণ্ডা সেটা বুঝা যাচ্ছে গ্লাসের গায়ে জমা বিন্দু বিন্দু পানির কণা দেখে। শওকতের এমনিতে কখনোই পানির তৃষ্ণা হয় না। শুধু ঠাণ্ডা পানির গ্লাস দেখলে প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়ে যায়। শওকত পানি খেতে খেতে বলল, আপনার নাম কী?
লোকটি হাসিমুখে বলল, স্যার আমার নাম আকবর। এই ড্রয়িংরুমে কি সিগারেট খাবার অনুমতি আছে?
অবশ্যই আছে। আপনার কাছে সিগারেট আছে? না-কি আনিয়ে দেব?
সিগারেট-ম্যাচ সবই আমার সঙ্গে আছে। আমি যে এসেছি আপনার ম্যাডাম কি তা জানেন?
জি জানেন। উনি গোসলে ঢুকেছেন বলে দেরি হচ্ছে। আপনি চা খেতে খেতে চলে আসবেন। স্যার, আপনাকে কি খবরের কাগজ দেব?
দরকার নেই। এ বাড়িতে আপনার কাজটা কী?
আমি কেয়ারটেকার। সব ধরনের কাজই কিছু কিছু করতে হয়।
আপনার ভাষা খুবই সুন্দর। দেশের বাড়ি কোথায়?
যশোহর।
আপনি কি আমাকে আরেক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবেন?
অবশ্যই পারব।
শওকত সিগারেট ধরাল। চায়ের কাপে চুমুক দিল। বড়লোকদের বাড়ির চা কেন জানি সবসময়ই কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। এই চা ঠাণ্ডা না, গরম এবং খেতেও ভালো। শওকত আবারো তাকাল কচুপাতার ছবির দিকে। আলো-ছায়ার খেলাটা এত সুন্দর এসেছে! এই শিল্পীকে মন খুলে অভিনন্দন জানাতে পারলে ভালো হতো। সেটা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এই ছবি তারই আঁকা। নিজেকে নিজে ধন্যবাদ দেয়ার চল সমাজে নেই।
স্যার, আপনার পানি।
থ্যাংক য়্যু।
স্যার, আর কিছু লাগবে?
না, আর কিছু লাগবে না।
চা আরেক কাপ দেই?
না, থ্যাংক য়্যু।
আকবর নামের মানুষটা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। Uninteresting Face. এই চেহারার পোট্রেট করা যায় না। একটা সময় ছিল যখন নতুন কোনো মুখ দেখলেই সে মনে মনে ঠিক করে ফেলত এই মুখের পোট্রেট করা যায় কি যায় না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে সে দুভাগে ভাগ করেছিল— Intersting Face, Uninteresting Face. Interesting Face-এর বাংলা কী হবে? মজাদার চেহারা, না-কি আকর্ষণীয় চেহারা? আকর্ষণীয় চেহারা অবশ্যই হবে না। অনেক চেহারা মোটেই আকর্ষণীয় না, কিন্তু খুবই interesting.
চা শেষ হয়ে আসছে। আকবরের কথানুসারে এর মধ্যেই তার ম্যাডামের চলে আসার কথা। হয়তো যে-কোনো মুহূর্তে চলে আসবে। তার ম্যাডামের নাম রেবেকা। শওকতের সঙ্গে বিয়ের পর নামের শেষে সে শওকতের শ লাগাত। সে লিখত রেবেকা শ। নাম শুনলে মনে হতো বার্নাড শর ভাতিজি।
রেবেকার সঙ্গে তার বিয়ে মাত্র সাত বছর টিকেছে। আরো সূক্ষ্ম হিসাব করলে বলতে হয় বিয়ে টিকেছে ছয় বছর নয় মাস। তার বিবাহিত জীবন শেষ হলো ছয়-নয়ে। ছয়-নয়ের প্যাচ কঠিন প্যাচ।
শওকতের চা এবং সিগারেট দুটাই এক সঙ্গে শেষ হয়েছে। আকবরের কথা শুনে আরেক কাপ চায়ের কথা বললে ভালো হতো। দ্বিতীয় কাপ চা এবং দ্বিতীয় সিগারেটের সঙ্গে কিছু অ্যাডভান্স চিন্তা করে রাখা। যেমন রেবেকা যখন ঘরে ঢুকবে সে তখন কী করবে? সম্মান দেখানোর মতো উঠে দাঁড়াবে? যে মেয়েটির সঙ্গে সে সাত বছর বিবাহিত জীবনযাপন করেছে, তাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর মধ্যে সামান্য হলেও কমেডি এলিমেন্ট আছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর কোনো মানে হয় না। আবার গঁাট হয়ে বসে থাকা আরো হাস্যকর। রেবেকা এখন অন্য আরেকজনের স্ত্রী। সমাজের সম্মানিত মহিলা। তাকে সম্মান দেখানো দোষের কিছু না। শওকত যদি কাঠের গুড়ির মতো বসে থাকে, তাহলে রেবেকা হয়তো ভুরু কুঁচকে বিরক্তি বিরক্তি ভাব নিয়ে তাকাবে। কিন্তু শওকত যদি অতি বিনয়ী হয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায়, তাহলে রেবেকা কিছুটা লজ্জা পাবে। লজ্জা পুরোপুরি কাটার আগেই শওকত বলবে, রেবেকা কেমন আছ? আবেগবর্জিত স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক প্রশ্ন।
রেবেকা বলবে, ভালো।
তারপরই শওকত আরো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলবে, মিস্টার অ্যান্ডারসন কেমন আছেন?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রেবেকা একটু হলেও থতমত খাবে। আগের স্বামীর মুখে বর্তমান স্বামীবিষয়ক প্রশ্ন কোনো মেয়েরই সহজভাবে নেবার কথা না।
সরি, তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি।
রেবেকা পেছন দিক থেকে কখন ঘরে ঢুকেছে শওকত বুঝতেই পারে নি। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সামনের টেবিলের কোনায় হাঁটুর খোচা লাগল। পিরিচে রাখা চায়ের কাপটা পিরিচে পড়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। কাপে চা ছিল না। চা থাকলে চা গড়িয়ে বিশ্রী কাণ্ড হতো।
শওকত বলল, কেমন আছ রেবেকা?
রেবেকা বসতে বসতে বলল, ভালো আছি।
শওকতের এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটা করার কথা। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার রেবেকার স্বামীর নাম এখন আর মনে পড়ছে না। শওকত নিশ্চয়ই বলতে পারে না, রেবেকা, তোমার আমেরিকান স্বামী কেমন আছেন? শওকতের স্মৃতিশক্তি দুর্বল না, রেবেকার স্বামীর নাম সে জানে। নিউজার্সিতে এই ভদ্রলোকের পুরনো বইয়ের একটা দোকান আছে। দোকানের নাম All gone! বাংলা করলে হয় সব চলে গেছে। ভদ্রলোক এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসথেটিকস পড়াতেন। রেবেকার সঙ্গে সেখানেই তার পরিচয়। ছাত্র পড়াতে ভালো লাগে না বলে তিনি পুরনো বইয়ের দোকান দিয়েছেন। তার এখন সময় কাটছে পুরনো বই পড়ে। শওকতের সব কিছু মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের নামটা শুধু মনে পড়ছে না। তার সাময়িক ব্ল্যাক আউট হয়েছে।
রেবেকা বলল, তোমার কি শরীর খারাপ না-কি?
শওকত বলল, না তো!
রেবেকা বলল, কেমন কপাল টপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছ।
একটা কথা মনে করার চেষ্টা করছি। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
রেবেকা বলল, চেষ্টা বেশি করলে মনে পড়বে না। রিলাক্সড থাক। মনে পড়বে।
শওকত এই প্রথম রেবেকার দিকে তাকাল। যেসব বাঙালি মেয়ে দেশের বাইরে থাকে তাদের চেহারায় আলগা এক ধরনের লালিত্য দেখা যায়। গায়ের রঙও হয় উজ্জ্বল ও রেবেকাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার বয়স কমে গেছে। চেহারায় কেমন যেন বিদেশিনী বিদেশিনী ভাব চলে এসেছে। এরকম হয়েছে চুলের কারণে। রেবেকার চুল ছিল লম্বা এবং কোঁকড়ানো। কোঁকড়ানো ভাব এখন আর নেই। চুল কেটে সে ছোটও করেছে। তবে এতে তাকে দেখতে খারাপ লাগছে না। বরং আগের চেয়েও সুন্দর লাগছে।
শওকত বলল, তুমি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছ।
রেবেকা বলল, থ্যাংক য়্যু।
শওকত বলল, মিস্টার অ্যান্ডারসন কেমন আছেন?
বলেই সে খুব তৃপ্তি বোধ করল। নামটা শেষপর্যন্ত মনে পড়েছে।
রেবেকা বলল, সে ভালো আছে। এই নামটাই কি তুমি মনে করার চেষ্টা করছিলে?
শওকত বলল, হ্যাঁ।
রেবেকা বলল, চা খাবে?
চা একবার খেয়েছি।
আরেকবার খাও। আমি সকালে কোনো নাশতা করি না। এক কাপ চা আরেকটা টোস্ট বিস্কিট খাই। আজ এখনো খাওয়া হয় নি। তোমার সঙ্গে খাব বলে অপেক্ষা করছিলাম।
চা দিতে বলো।
তুমি নাশতা খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
কী নাশতা করলে?
পরোটা আর বুটের ডাল।
রেস্টুরেন্টের রান্না?
হ্যাঁ।
খাওয়া-দাওয়া কি সব হোটেল থেকে আসে?
একবেলা ঘরে রান্না হয়।
একবেলাটা কখন?
রাতে।
কে রাঁধে?
আমি নিজেই রাঁধি। ভাত ডিম ভাজি ডাল। সিম্পল ফুড।
বাসায় কাজের কোনো লোক নেই?
একজন ছিল। মায়ের অসুখ বলে দেশে গিয়েছিল, আর ফেরে নি।
রেবেকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি চায়ের কথা বলে আসি। চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?
না।
তোমাকে অতি ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন যে করলাম, তার পেছনে কারণ আছে। তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমার এখন আগ্রহ দেখানোর কিছু নেই।
কারণটা কী?
আমি দেশে এসেছি পনের দিনের জন্য। সঙ্গে করে ইমনকে নিয়ে এসেছি। সে তার এবারের জন্মদিন তোমার সঙ্গে করতে চায়। আমি ঠিক করেছি চারপাঁচদিন একনাগাড়ে তাকে তোমার সঙ্গে থাকতে দেব।
আমার কথা কি তার মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন? তোমার সঙ্গে যখন আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তখন ইমনের বয়স পাঁচ বছর তিন মাস। চার বছর থেকেই শিশুদের সব স্মৃতি থাকে।
ইমন কোথায়?
সে তার নানুর কাছে গিয়েছে। তার শরীরটা ভালো না।
কী হয়েছে?
জ্বর বমি এইসব। দেশের ওয়েদার তাকে স্যুট করছে না।
শওকত আগ্রহ নিয়ে বলল, ইমনকে কবে নিয়ে যাব?
রেবেকা বলল, ওর জন্মদিন কবে তোমার কি মনে আছে?
না। ভুলে গেছি।
আমারো তাই ধারণা। ওর জন্মদিন এই মাসের নয় তারিখ। তুমি পাঁচ তারিখ এসে ওকে নিয়ে যাবে। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি চা নিয়ে আসছি।
ড্রয়িংরুমে শওকত এখন একা। সে আগেও একা বসেছিল, তখন নিজেকে একা একা মনে হয় নি। এখন মনে হচ্ছে। সবচে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে রেবেকা যখন বলল, আমি সঙ্গে করে ইমনকে নিয়ে এসেছি, তখন সে বুঝতেই পারে নি ইমনটা কে? যখন বুঝতে পারল তখন হঠাৎ সব জট পাকিয়ে গেল। সে ভুলে গেল এই মাসের নয় তারিখে ইমনের জন্মদিন। সে কখনো এই দিন ভুল করে না। ঐ দিন সে একটা সাদা ক্যানভাসে মনের সুখে হলুদ রঙে মাখায় লেমন ইয়েলো। কারণ শওকত তার ছেলের নাম রেখেছিল লেমন ইয়েলো। রঙের নামে নাম। ছেলের জন্ম হলো মিডফোর্ট হাসপাতালে। ছেলেকে দেখে সে বিস্মিত হয়ে বলেছিল— একী! এই ছেলে দেখি সন্ধ্যার আকাশের সমস্ত লেমন ইয়েলো রঙ নিয়ে চলে এসেছে। আমি এই ছেলের নাম রাখলাম লেমন ইয়েলো!
লেমন ইয়েলো দেশে এসেছে। সে তার বাবার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে।
রেবেকা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। শওকত আবারো উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার উঠে না দাঁড়ালেও চলত। কেন দাঁড়াল সে নিজেও জানে না।
রেবেকা বলল, তুমি এখন কী করছ?
শওকত বলল, একটা ডেইলি পেপারে ইলাস্ট্রেশন করি। আর দুটা ম্যাগাজিনে পার্ট টাইম ইলাস্ট্রেশন করি। বইমেলার সময় বইয়ের কাভার করি। সেট ডিজাইন করি।
তোমার চলে যায়?
হুঁ। দেশে টাকা পাঠাতে হয় না। মা মারা গেছেন। আমার নিজের তো আর টাকা বেশি লাগে না।
তোমার মার মৃত্যু তাহলে তোমার জন্যে একটা রিলিফের মতো হয়েছে। প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হবে এই টেনশন নেই।
শওকত ক্ষীণ স্বরে বলল, ঠিকই বলেছ।
রেবেকা বলল, যে কয়দিন ইমনকে রাখবে তার খাওয়া-দাওয়ার দিকে লক্ষ রাখবে। হোটেলের কোনো খাবার বা ফাস্ট ফুড খাওয়াবে না। খাওয়া নিয়ে সে মমাটেও যন্ত্রণা করে না। এক গ্লাস দুধ, এক পিস পাউরুটি, একটা হাফ বয়েলড় ডিম হলেই তার হয়।
তুমি চিন্তা করো না, আমি বাইরের খাবার খাওয়াব না।
ছবি আঁকাআঁকি কি বন্ধ?
বন্ধই বলা চলে।
ছবি আঁকছ না কেন?
ইচ্ছা করে না।
ছেলেকে যখন কাছে নিয়ে রাখবে, তখন একটা দুটা ছবি আঁকার চেষ্টা করবে। ইমন তার বাবার ছবি আঁকা নিয়ে খুব একসাইটেড।
ও আচ্ছা।
ফাদারস ডে-তে তাদের স্কুলে বাবাকে নিয়ে রচনা লিখতে বলা হয়েছিল। ইমন একটা দীর্ঘ রচনা লিখেছে। রচনার শিরোনাম হচ্ছে My Painter Father.
বলো কী?
আমি তার রচনাটার ফটোকপি নিয়ে এসেছি। তোমাকে দিয়ে দেব। এটা পড়া থাকলে ছেলে তার বাবা সম্পর্কে কী ভাবছে তা তোমার জানতে সুবিধা হবে। আমি চাই এই অল্প কয়েকটা দিন ইমন যেন আনন্দে থাকে।
আমি চেষ্টা করব। ইমনকে নিতে কবে আসব?
আগেই তো বলেছি, পাঁচ তারিখে চলে এসো।
এখন তাহলে উঠি?
এক মিনিট দাঁড়াও, ইমনের লেখা এসেটা তোমাকে দিচ্ছি। ইমন যেন জানতে না পারে, সে লজ্জা পাবে।
ওকে কিছু বলব না।
একটা কথা তোমাকে বলতে ভুলে গেছি— রাতে কিন্তু সে অন্ধকার ঘরে ঘুমুতে পারে না। অবশ্যই ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখবে।
হুঁ রাখব।
তোমার বাসায় কি এসি আছে?
না।
এখন অবশ্য গরম সেরকম না। ঠিক আছে, তুমি যে অবস্থায় থাক ছেলে সেই অবস্থাটাই দেখুক। তার জন্যে আলাদা কিছু করতে হবে না।
ইমনের লেখা ইংরেজি রচনার বাংলাটা এরকম–
আমার পেইন্টার বাবা
আমার বাবা থাকেন বাংলাদেশে। সেখানের সবচে বড় শহরটার নাম টাকা। তিনি ঢাকায় থাকেন এবং দিনরাত ছবি আঁকেন। গাছপালার ছবি, নদীর ছবি এইসব। তিনি গাছপালার ছবি বেশি আঁকেন কারণ বাংলাদেশে অনেক গাছ। পুরো দেশটা সবুজ। এই জন্যেই বাংলাদেশের পতাকার রঙও সবুক। সবুজের মাঝখানে লাল সূর্য আঁকা।
আমার বাবাকে আমি খুবই পছন্দ করি। তিনি আমাকে পছন্দ করেন কি-না আমি জানি না। মনে হয় করেন না। কারণ তিনি কখনোই আমার বার্থডেতে কোনো কার্ড পাঠান নি। এই নিয়ে আমি মোটেও মন খারাপ করি না। কারণ তিনি খুব ব্যস্ত মানুষ। তাঁকে দিন-রাত ছবি আঁকতে হয়।
আমি আমার বাবাকে তিনটা কার্ড পাঠিয়েছি। তিনটা কার্ডের ছবি আমি নিজে এঁকেছি। একটাতে ছিল ক্রিসমাস ট্রি। আরেকটা ছবিতে আমি মাছ মারতে লেক ইওনিতে গিয়েছি। অন্য কার্ডটা শুধু ডিজাইন। কার্ডগুলো পাঠাতে আমার খুবই লজ্জা লাগছিল। কারণ, আমার বাবা কত ভালো ছবি আঁকেন। আর আমি তো ছবি আঁকতেই পারি না। আমি যখন রঙ দেই, তখন একটা রঙের সঙ্গে আরেকটা রঙ মিশে কেমন যেন হয়ে যায়। যদি কখনো বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাহলে আমি তার কাছ থেকে ছবি আঁকা শিখব।
আমার আঁকা তিনটা কার্ডের কোনোটাই শেষপর্যন্ত বাবাকে পাঠানো হয় নি, কারণ আমার মা বাবার ঠিকানা জানতেন না। মার কোনো দোষ নেই, কারণ বাবার স্বভাব হচ্ছে দুদিন পর পর বাড়ি বদলানো। বড় বড় শিল্পীরা এরকমই হয়। ভ্যানগ নামের শিল্পীর কোনো বাড়ি-ঘরই ছিল না। আমাদের আর্ট টিচার মিস সুরেনসন বলেছেন— ভ্যানগগ তার প্রেমিকাকে নিজের কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন। আমি মনে মনে খুব হেসেছি। কাটা কান কি কাউকে উপহার হিসেবে দেয়া যায়? আমি শব্দ করে হাসি নি কারণ শব্দ করে হাসলে মিস সুরেনসন রাগ করেন।
রাগ করলেও আমাদের সবার উচিত শব্দ করে হাসা এবং শব্দ করে কাদা। কারণ তাতে আমাদের লাংস পরিষ্কার থাকে। এই কথাটা আমাদেরকে বলেছেন আমাদের গেম টিচার। আমি যদিও কোনো গেম পারি না, তারপরেও আমি গেম টিচারকে খুব পছন্দ করি। তাকে সবাই ডাকে কনি। কিন্তু তার নাম রিচার্ড বে হাফ। আমি গেম টিচারকে আমার বাবার কথা বলেছি। তিনি বলেছেন–তোমার বাবা তো একজন অতি ভালোমানুষ। তার সঙ্গে আমি দেখা করতে
দেখা করা সম্ভব না। কারণ বাবা তো আর আমেরিকায় থাকেন না। বাবা যদি আমেরিকায় থাকতেন তাহলে আমি অবশ্যই বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দিতাম। বাবাকে বলতাম, তুমি মিস্টার কনির একটা পোট্রেট এঁকে দাও। পোট্রেট করার সময় তার গালের কাটা দাগটা মুছে দিও। এই কাটা দাগটা উনি পছন্দ করেন না।
মিস্টার কনি আমাকে বলেছেন বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে কখনো মন খারাপ করতে নেই। তুমি দূর থেকে তোমার বাবাকে ভালোবাসবে। তোমার বাবাও দূর থেকে তোমাকে ভালোবাসবেন। যখন তোমাদের দেখা হবে তখন দেখবে তোমার এবং তোমার বাবার ভালোবাসার মধ্যে রেসলিং শুরু হবে। সব রেসলিং-এ একজন হারে একজন জিতে। এই রেসলিং-এ দুজনই জিতবে।
মিস্টার কনি এত মজার মজার কথা বলেন! মজা করে কথা বললেও তিনি আসলে খুবই জ্ঞানী।
শওকত তার ছেলের লেখা রচনা অতি দ্রুত একবার শেষ করে দ্বিতীয়বার পড়তে শুরু করল। প্রথমবার পড়তে কোনো সমস্যা হয় নি, দ্বিতীয়বার পড়তে খুব কষ্ট হলো। এক একটা লাইন পড়ে, চিঠি ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।