যতীন দাস (প্রলয়শিখা)
আসিল শরৎ সৌরাশ্বিন
দেবদেবী যবে ঘুমায়ে রয়
পাষাণ-স্বর্গ হিমালয়-চূড়ে
শুভ্র মৌলি তুষারময়।
ধরার অশ্রু – সাত সাগরের
লোনা জল উঠি রাত্রিদিন
ধোঁয়াইয়া ওঠে স্বর্গের পানে,
অভিমানে জমে হয় তু্হিন।
পাষাণ স্বর্গ, পাষাণ দেবতা,
কোথা দুর্গতিনাশিনী মা,
বলির রক্তে রাঙিয়া উঠেছে
যুগে যুগে দশ দিক-সীমা।
খড়ের মাটির দুর্গা গড়িয়া
দুর্গে বন্দি পূজারিদল
করে অভিনয়! দেবী-বিগ্রহ
জড় গতিহীন চির-অচল।
দেবতা ঘুমান, ঘুমায় মানুষ,
এরই মাঝে নিজ তপোবলে
জোর করে নেয় দেবতার বর
দৈত্য-দানব দলে দলে।
মোরা পূজা করি, পূজা শেষে চাই
পায়ের পদ্ম শুভ-আশিস,
ওরা চেয়ে নেয় কালীর খড়গ,
বিষ্ণুর গদা, শিবের বিষ।
তপস্যা নাই, ঢাকঢোল পিটে
দেবতা জাগাতে করি পূজা,
দশপ্রহরণধারিণী এল না
দশশো বছরে দশভুজা।….
এমনই শরৎ সৌরাশ্বিনে
অকাল-বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল লঙ্কেশ্বরে
বধিতে ত্রেতায় রাম-অবতার,
আজিও আমরা সে দেবীপূজার
অভিনয় করে চলিয়াছি,
লঙ্কা-সায়রি রাবণ মোদেরে
ধরিয়া গলায় দেয় কাছি!
দুঃসাহসীরা দুর্গা বলিয়া
হয়তো কাছিতে পড়ে ঝুলে,
দেবীর আসন তেমনই অটল,
শুধু নিমেষের তরে দুলে।
বলি দিয়া মোরা পূজেছি দেবীরে
নব-ভারতের পূজারিদল
গিয়াছিনু ভুলি – দেবীরে জাগাতে
দিতে হল আঁখি-নীলোৎপল।
মহিষ-অসুর-মর্দিনী মা গো,
জাগো এইবার, খড়গ ধরো।
দিয়াছি ‘যতীন’ অঞ্জলি নব –
ভারতের আঁখি-ইন্দিবর।
টুটে তপস্যা, ওঠে জাগি ওই
পূজারত অভিনব ভারত,
ভারত-সিন্ধু গর্জি উঠিল
নিযুত শঙ্খ মন্ত্রবৎ।
‘উলু উলু’ বোলে পুরনারী, দোলে
হিম-কৈলাস টালমাটাল,
কারাগারে টুটে অর্গল, ওঠে
রাঙিয়া আশার পূর্বভাল।
ছুটে বিমুক্ত-পিঞ্জর, পায়ে
লুটে শৃঙ্খল ছিন্ন ওই,
নাচে ভৈরব, ভৈরবী নাচে
ছিন্নমস্তা তাথই থই।
আকাশে আকাশে বৃংহিত – নাদ
করে কোটি মেঘ ঐরাবত,
সাগর শুষিয়া ছিটাইছে বারি,
ও কী ফুল হানে পুষ্পরথ।
এ কী এ শ্মশান-উল্লাস নাচে
ধূর্জটি-শিরে ভাগীরথী,
অকূল তিমিরে সহসা ভাতিল
নব-উদিচীর নব জ্যোতি।
বিস্ময়ে আঁখি মেলিয়া চাহিনু,
দেখা যায় শুধু দেবীচরণ,
মৃত্যুঞ্জয় মহাকাল শিব
যে চরণ-তলে মাগে মরণ!
ভৈরব নাচে ঊর্ধ্বে, নিম্নে
খণ্ডিত শির মহিষাসুর,
দুলিছে রক্ত-সিক্ত খড়গ,
কাঁপিছে তরাসে অসুর-পুর।
চিৎকারি ওঠে উল্লাসে
নব-ভারতের নব-পূজারিদল,
‘চাই না মা তোর শুভদ আশিস,
চাই শুধু ওই চরণতল –
যে চরণে তোর বাহন সিংহ,
মহিষ-অসুর মথিয়া যাস।
যদি বর দিস, দিয়ে যা বরদা,
দিয়ে যা শক্তি দৈত্য-ত্রাস’ ।
শুধু দেখা যায় দেবীর রক্ত –
চরণ, খড়গ, মহিষাসুর, –
ওকে ও চরণ-নিম্নে ঘুমায়
সমর-শয়নে বিজয়ী শূর?
কে যতী-ইন্দ্র তরুণ তাপস
দিয়া গেলে তুমি এ কী এ দান?
শবে শবে গেলে প্রাণ সঞ্চারি –
কেশব, বিলায়ে তোমার প্রাণ!
তিলে তিলে ক্ষয় করি আপনারে
তিলোত্তমারে সৃজিলে, হায়!
সুন্দ ও উপসুন্দ অসুর
বিনাশিতে তব তপ-প্রভায়!
হাতে ছিল তব চক্র ও গদা,
গ্রহণ করনি হেলায়, বীর!
বুকে ছিল প্রাণ, তাই দিয়ে রণ
জিনে গেলে প্রাণহীন জাতির।
তোমার হাতের শ্বেত-শতদল,
শুভ্র মহাপ্রাণ তোমার,
দিয়া গেলে তব জাতিরে আশিস,
তোমার হাতের নমস্কার!
লইবে কে বীর উন্নত-শির
দেবতার দান সে শতদল,
টলিয়া উঠেছে বিস্ময়ে ত্রাসে
বিন্ধ্য হইতে হিম-অচল।
নামিয়া আসিল এতদিনে বুঝি
হিমগিরি হতে পাষাণী মা,
কে জানে কাঘার রক্তে রাঙিয়া
উঠিতেছে দশদিক-সীমা!
দেখালে মায়ের রক্তচরণ,
কে দেখাবি দেবীমূর্তি মা-র,
ভারত চাহিয়া আছে তার পানে,
কে করিবে প্রতি-নমস্কার!