যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ ((Yagneshworer Yagna)
এক সময় যজ্ঞেশ্বরের অবস্থা ভালোই ছিল । এখন প্রাচীন ভাঙা কোঠাবাড়িটাকে সাপ – ব্যাঙ-বাদুড়ের হস্তে সমর্পণ করিয়া খোড়ো ঘরে ভগবদগীতা লইয়া কালযাপন করিতেছেন ।
এগারো বৎসর পূর্বে তাঁহার মেয়েটি যখন জন্মিয়াছিল তখন বংশের সৌভাগ্যশশী কৃষ্ণপক্ষের শেষকলায় আসিয়া ঠেকিয়াছে । সেইজন্য সাধ করিয়া মেয়ের নাম রাখিয়াছিলেন কমলা । ভাবিয়াছিলেন , যদি এই কৌশলে ফাঁকি দিয়া চঞ্চলা লক্ষ্মীকে কন্যারূপে ঘরে ধরিয়া রাখিতে পারেন । লক্ষ্মী সে ফন্দিতে ধরা দিলেন না , কিন্তু মেয়েটির মুখে নিজের শ্রী রাখিয়া গেলেন । বড়ো সুন্দরী মেয়ে ।
মেয়েটির বিবাহ সম্বন্ধে যজ্ঞেশ্বরের যে খুব উচ্চ আশা ছিল তাহা নহে । কাছাকাছি যে-কোনো একটি সৎপাত্রে বিবাহ দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন । কিন্তু তাঁহার জ্যাঠাইমা তাঁহার বড়ো আদরের কমলাকে বড়ো ঘর না হইলে দিবেন না , পণ করিয়া বসিয়া আছেন । তাঁহার নিজের হাতে অল্প – কিছু সংগতি ছিল , ভালো পাত্র পাইলে তাহা বাহির করিয়া দিবেন , স্থির করিয়াছেন ।
অবশেষে জ্যাঠাইমার উত্তেজনায় শাস্ত্রাধ্যয়নগুঞ্জিত শান্ত পল্লীগৃহ ছাড়িয়া যজ্ঞেশ্বর পাত্রসন্ধানে বাহির হইলেন । রাজশাহিতে তাঁহার এক আত্মীয় উকিলের বাড়িতে গিয়া আশ্রয় লইলেন ।
এই উকিলের মক্কেল ছিলেন জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরী । তাঁহার একমাত্র পুত্র বিভূতিভূষণ এই উকিলের অভিভাবকতায় কলেজে পড়াশুনা করিত । ছেলেটি কখন যে মেয়েটিকে আসিয়া দেখিয়াছিল তাহা ভগবান প্রজাপতিই জানিতেন ।
কিন্তু প্রজাপতির চক্রান্ত যজ্ঞেশ্বরের বুঝিবার সাধ্য ছিল না । তাই বিভূতি সম্বন্ধে তাঁহার মনে কোনোপ্রকার দুরাশা স্থান পায় নাই । নিরীহ যজ্ঞেশ্বরের অল্প আশা , অল্প সাহস ; বিভূতির মতো ছেলে যে তাঁহার জামাই হইতে পারে এ তাঁহার সম্ভব বলিয়া বোধ হইল না ।
উকিলের যত্নে একটি চলনসই পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে । তাহার বুদ্ধিশুদ্ধি না থাক্ বিষয়-আশয় আছে । পাস একটিও দেয় নাই বটে কিন্তু কালেক্টরিতে ৩২৭৫ টাকা খাজনা দিয়া থাকে ।
পাত্রের দল একদিন আসিয়া মেয়েটিকে পছন্দ করিয়া ক্ষীরের ছাঁচ , নারিকেলের মিষ্টান্ন ও নাটোরের কাঁচাগোল্লা খাইয়া গেল । বিভূতি তাহার অনতিকাল পরে আসিয়া খবর শুনিলেন । যজ্ঞেশ্বর মনের আনন্দে তাঁহাকেও কাঁচাগোল্লা খাওয়াইতে উদ্যত হইলেন । কিন্তু ক্ষুধার অত্যন্ত অভাব জানাইয়া বিভূতি কিছু খাইল না । কাহারো সহিত ভালো করিয়া কথাই কহিল না , বাড়ি চলিয়া গেল ।
সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় উকিলবাবু বিভূতির কাছ হইতে এক পত্র পাইলেন । মর্মটা এই , যজ্ঞেশ্বরের কন্যাকে তাহার বড়ো পছন্দ এবং তাহাকে সে বিবাহ করিতে উৎসুক ।
উকিল ভাবিলেন , ‘ এ তো বিষম মুশকিলে পড়িলাম । গৌরসুন্দরবাবু ভাবিবেন , আমিই আমার আত্মীয়কন্যার সহিত তাঁহার ছেলের বিবাহের চক্রান্ত করিতেছি । ‘
অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া তিনি যজ্ঞেশ্বরকে দেশে পাঠাইলেন , এবং পূর্বোক্ত পাত্রটির সহিত বিবাহের দিন যথাসম্ভব নিকটবর্তী করিয়া দিলেন । বিভূতিকে ডাকিয়া অভিভাবকমহাশয় পড়াশুনা ছাড়া আর-কোনো দিকে মন দিতে বিশেষ করিয়া নিষেধ করিলেন । শুনিয়া রাগে বিভূতির জেদ চার গুণ বাড়িয়া গেল ।
বিবাহের আয়োজন উদ্যোগ চলিতেছে এমন সময় একদিন যজ্ঞেশ্বরের খোড়ো ঘরে বিভূতিভূষণ স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত ।
যজ্ঞেশ্বর ব্যস্ত হইয়া কহিলেন , “ এসো, বাবা , এসো । ” কিন্তু কোথায় বসাইবেন , কী খাওয়াইবেন , কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না । এখানে নাটোরের কাঁচাগোল্লা কোথায়।
বিভূতিভূষণ যখন স্নানের পূর্বে রোয়াকে বসিয়া তেল মাখিতেছেন তখন জ্যাঠাইমা তাঁহার রজতগিরিনিভ গৌর পুষ্ট দেহটি দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন । যজ্ঞেশ্বরকে ডাকিয়া কহিলেন , “ এই ছেলেটির সঙ্গে আমাদের কমলের বিবাহ হয় না কি । ”
“ ভীরু যজ্ঞেশ্বর বিস্ফারিত নেত্রে কহিলেন , সে কি হয়! ”
জ্যাঠাইমা কহিলেন , “ কেন হইবে না । চেষ্টা করিলেই হয় । ” এই বলিয়া তিনি বাথানপাড়ার গোয়ালাদের ঘর হইতে ভালো ছানা ও ক্ষীর আনাইয়া বিবিধ আকার ও আয়তনের মোদক-নির্মাণে প্রবৃত্ত হইলেন ।
স্নানাহারের পর বিভূতিভূষণ সলজ্জে সসংকোচে নিজের বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন । যজ্ঞেশ্বর আনন্দে ব্যাকুল হইয়া জ্যাঠাইমাকে সুসংবাদ দিলেন ।
জ্যাঠাইমা শান্ত মুখে কহিলেন , “ তা বেশ হয়েছে, বাপু , কিন্তু তুমি একটু ঠাণ্ডা হও । ” তাঁহার পক্ষে এটা কিছুই আশাতীত হয় নাই । যদি কমলার জন্য এক দিক হইতে কাবুলের আমীর ও অন্য দিক হইতে চীনের সম্রাট তাঁহার দ্বারস্থ হইত তিনি আশ্চর্য হইতেন না ।
ক্ষীণাশ্বাস যজ্ঞেশ্বর বিভূতিভূষণের হাত ধরিয়া বলিতে লাগিলেন , “ দেখো বাবা , আমার সকল দিক যেন নষ্ট না হয় । ”
বিবাহের প্রস্তাব পাকা করিয়া বিভূতিভূষণ তাঁহার বাপের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ।
গৌরসুন্দর নিজে নিরক্ষর ছিলেন বলিয়া শিক্ষিত ছেলেটিকে মনে মনে বিশেষ খাতির করিতেন । তাঁহার কোনো আচরণে বা মতে পাছে তাঁহার ছেলের কাছে সুশিক্ষা বা শিষ্টতার অভাব ধরা পড়ে এই সংকোচ তিনি দূর করিতে পারিতেন না । তাঁহার একমাত্র প্রাণাধিক পুত্র যেন বাপকে মনে মনে ধিক্কার না দেয় , যেন অশিক্ষিত বাপের জন্য তাহাকে লজ্জিত না হইতে হয় , এ চেষ্টা তাঁহার সর্বদা ছিল । কিন্তু তবু যখন শুনিলেন বিভূতি দরিদ্রকন্যাকে বিবাহ করিতে উদ্যত , তখন প্রথমটা রাগ প্রকাশ করিয়া উঠিলেন । বিভূতি নতশিরে চুপ করিয়া রহিল । তখন গৌরসুন্দর কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া নিজেকে সংশোধন করিয়া লইয়া কহিলেন , “ আমি কি পণের লোভে তোমাকে বিবাহ করিতে বলিতেছি । তা মনে করিয়ো না । নিজের ছেলেকে লইয়া বেহাইয়ের সঙ্গে দরদস্তুর করিতে বসিব , আমি তেমন ছোটোলোক নই । কিন্তু বড়ো ঘরের মেয়ে চাই । ”
বিভূতিভূষণ বুঝাইয়া দিলেন , যজ্ঞেশ্বর সম্ভ্রান্তবংশীয় , সম্প্রতি গরিব হইয়াছেন ।
গৌরসুন্দর দায়ে পড়িয়া মত দিলেন। কিন্তু মনে মনে যজ্ঞেশ্বরের প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন ।
তখন দুই পক্ষে কথাবার্তা চলিতে লাগিল । আর-সব ঠিক হইল কিন্তু বিবাহ হইবে কোথায় তাহা লইয়া কিছুতেই নিষ্পত্তি হয় না । গৌরসুন্দর এক ছেলের বিবাহে খুব ধুমধাম করিতে চান , কিন্তু বুড়াশিবতলার সেই খোড়ো ঘরে সমস্ত ধুমধাম ব্যর্থ হইয়া যাইবে । তিনি জেদ করিলেন , তাঁহারই বাড়িতে বিবাহসভা হইবে ।
শুনিয়া মাতৃহীনা কন্যার দিদিমা কান্না জুড়িয়া দিলেন । তাঁহাদেরও তো এক সময় সুদিন ছিল , আজ লক্ষ্মী বিমুখ হইয়াছেন বলিয়া কি সমস্ত সাধ জলাঞ্জলি দিতে হইবে , পিতৃপুরুষের মান বজায় থাকিবে না ? সে হইবে না ; আমাদের ঘর খোড়ো হউক আর যাই হউক , এইখানেই বিবাহ দিতে হইবে ।
নিরীহপ্রকৃতি যজ্ঞেশ্বর অত্যন্ত দ্বিধায় পড়িয়া গেলেন । অবশেষে বিভূতিভূষণের চেষ্টায় কন্যাগৃহেই বিবাহ স্থির হইল ।
ইহাতে গৌরসুন্দর এবং তাঁহার দলবল কন্যাকর্তার উপর আরো চটিয়া গেলেন । সকলেই স্থির করিলেন , স্পর্ধিত দরিদ্রকে অপদস্থ করিতে হইবে । বরযাত্র যাহা জোটানো হইল তাহা পল্টনবিশেষ । এ সম্বন্ধে গৌরসুন্দর ছেলের কোনো পরামর্শ লইলেন না ।
বৈশাখ মাসে বিবাহের দিন স্থির হইল । যজ্ঞেশ্বর তাহার স্বল্পাবশিষ্ট যথাসর্বস্ব পণ করিয়া আয়োজন করিয়াছে । নূতন আটচালা বাঁধিয়াছে , পাবনা হইতে ঘি ময়দা চিনি দধি প্রভৃতি আনাইয়াছে । জ্যাঠাইমা তাঁহার যে গোপন পুঁজির বলে স্বগৃহেই বিবাহপ্রস্তাবে জেদ করিয়াছিলেন তাহার প্রায় শেষ পয়সাটি পর্যন্ত বাহির করিয়া দিয়াছেন ।
এমন সময় দুর্ভাগার অদৃষ্টক্রমে বিবাহের দুই দিন আগে হইতে প্রচণ্ড দুর্যোগ আরম্ভ হইল । ঝড় যদি-বা থামে তো বৃষ্টি থামে না , কিছুক্ষণের জন্য যদি-বা নরম পড়িয়া আসে আবার দ্বিগুণ বেগে আরম্ভ হয় । এমন বর্ষণ বিশ পঁচিশ বছরের মধ্যে কেহ দেখে নাই ।
গৌরসুন্দর পূর্ব হইতেই গুটিকতক হাতি ও পালকি স্টেশনে হাজির রাখিয়াছিলেন । আশপাশের গ্রাম হইতে যজ্ঞেশ্বর ছইওয়ালা গোরুর গাড়ির জোগাড় করিতে লাগিলেন । দুর্দিনে গাড়োয়ানরা নড়িতে চায় না , হাতে পায়ে ধরিয়া দ্বিগুণ মূল্য কবুল করিয়া যজ্ঞেশ্বর তাহাদের রাজি করিলেন । বরযাত্রের মধ্যে যাহাদিগকে গোরুর গাড়িতে চড়িতে হইল তাহারা চটিয়া আগুন হইল ।
গ্রামের পথে জল দাঁড়াইয়া গেছে । হাতির পা বসিয়া যায় , গাড়ির চাকা ঠেলিয়া তোলা দায় হইল । তখনও বৃষ্টির বিরাম নাই । বরযাত্রগণ ভিজিয়া, কাদা মাখিয়া, বিধিবিড়ম্বনার প্রতিশোধ কন্যাকর্তার উপর তুলিবে বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া রাখিল । হতভাগ্য যজ্ঞেশ্বরকে এই অসাময়িক বৃষ্টির জন্য জবাবদিহি করিতে হইবে ।
বর সদলবলে কন্যাকর্তার কুটিরে আসিয়া পৌঁছিলেন । অভাবনীয় লোকসমাগম দেখিয়া গৃহস্বামীর বুক দমিয়া গেল । ব্যাকুল যজ্ঞেশ্বর কাহাকে কোথায় বসাইবেন ভাবিয়া পান না , কপালে করাঘাত করিয়া কেবলই বলিতে থাকেন , “ বড়ো কষ্ট দিলাম বড়ো কষ্ট দিলাম । ” যে আটচালা বানাইয়াছিলেন তাহার চারি দিক হইতে জল পড়িতেছে । বৈশাখ মাসে যে এমন শ্রাবণধারা বহিবে তাহা তিনি স্বপ্নেও আশঙ্কা করেন নাই । গণ্ডগ্রামের ভদ্র অভদ্র সমস্ত লোকই যজ্ঞেশ্বরকে সাহায্য করিতে উপস্থিত হইয়াছিল ; সংকীর্ণ স্থানকে তাহারা আরো সংকীর্ণ করিয়া তুলিল এবং বৃষ্টির কল্লোলের উপর তাহাদের কলরব যোগ হইয়া একটি সমুদ্রমন্থনের মতো গোলমালের উৎপত্তি হইল । পল্লীবৃদ্ধগণ ধনী অতিথিদের সম্মাননার উপযুক্ত উপায় না দেখিয়া যাহাকে-তাহাকে ক্রমাগতই জোড়হস্তে বিনয় করিয়া বেড়াইতে লাগিল ।
বরকে যখন অন্তঃপুরে লইয়া গেল তখন ক্রুদ্ধ বরযাত্রীর দল রব তুলিল , তাহাদের ক্ষুধা পাইয়াছে , আহার চাই । মুখ পাংশুবর্ণ করিয়া যজ্ঞেশ্বর গলায় কাপড় দিয়া সকলকে বলিলেন , “ আমার সাধ্যমত যাহা-কিছু আয়োজন করিয়াছিলাম সব জলে ভাসিয়া গেছে । ”
দ্রব্যসামগ্রী কতক পাবনা হইতে পথের মধ্যে কতক-বা ভগ্নপ্রায় পাকশালায় গলিয়া গুলিয়া উনান নিবিয়া একাকার হইয়া গেছে । সহসা উপযুক্ত পরিমাণ আহার্য সংগ্রহ করা যাইতে পারে বুড়াশিবতলা এমন গ্রামই নহে ।
গৌরসুন্দর যজ্ঞেশ্বরের দুর্গতিতে খুশি হইলেন । কহিলেন , “ এতগুলা মানুষকে তো অনাহারে রাখা যায় না , কিছু তো উপায় করিতে হইবে । ”
বরযাত্রগণ খেপিয়া উঠিয়া মহা হাঙ্গামা করিতে লাগিল । কহিল , “ আমরা স্টেশনে গিয়া ট্রেন ধরিয়া এখনই বাড়ি ফিরিয়া যাই । ”
যজ্ঞেশ্বর হাত জোড় করিয়া কহিলেন , “ একেবারে উপবাস নয় । শিবতলার ছানা বিখ্যাত । উপযুক্ত পরিমাণে ছানা কদমা সংগ্রহ আছে । আমার অন্তরের মধ্যে যাহা হইতেছে তাহা অন্তর্যামীই জানেন । ”
যজ্ঞেশ্বরের দুর্গতি দেখিয়া বাথানপাড়ার গোয়ালারা বলিয়াছিল , “ ভয় কী ঠাকুর , ছানা যিনি যত খাইতে পারেন আমরা জোগাইয়া দিব । ” বিদেশের বরযাত্রীগণ না খাইয়া ফিরিলে শিবতলা গ্রামের অপমান ; সেই অপমান ঠেকাইবার জন্য গোয়ালারা প্রচুর ছানার বন্দোবস্ত করিয়াছে ।
বরযাত্রগণ পরামর্শ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল , “ যত আবশ্যক ছানা জোগাইতে পারিবে তো ? ”
যজ্ঞেশ্বর কথঞ্চিৎ আশান্বিত হইয়া কহিল , “ তা পারিব । ” “ আচ্ছা, তবে আনো ” বলিয়া বরযাত্রগণ বসিয়া গেল । গৌরসুন্দর বসিলেন না , তিনি নীরবে এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া কৌতুক দেখিতে লাগিলেন ।
আহারস্থানের চারিদিকেই পুষ্করিণী ভরিয়া উঠিয়া জলে কাদায় একাকার হইয়া গেছে । যজ্ঞেশ্বর যেমন- যেমন পাতে ছানা দিয়া যাইতে লাগিলেন তৎক্ষণাৎ বরযাত্রগণ তাহা কাঁধ ডিঙাইয়া পশ্চাতে কাদার মধ্যে টপ্ টপ্ করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল ।
উপায়বিহীন যজ্ঞেশ্বরের চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল । বারংবার সকলের কাছে জোড়হাত করিতে লাগিলেন ; কহিলেন , “ আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি , আপনাদের নির্যাতনের যোগ্য নই । ”
একজন শুস্কহাষ্য হাসিয়া উত্তর করিল , “ মেয়ের বাপ তো বটেন , সে অপরাধ যায় কোথায় । ” যজ্ঞেশ্বরের স্বগ্রামের বৃদ্ধগণ বারবার ধিক্কার করিয়া বলিতে লাগিল , “ তোমার যেমন অবস্থা সেইমত ঘরে কন্যাদান করিলেই এ দুর্গতি ঘটিত না । ”
এ দিকে অন্তঃপুরে মেয়ের দিদিমা অকল্যাণশঙ্কাসত্ত্বেও অশ্রু সংবরণ করিতে পারিলেন না । দেখিয়া মেয়ের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল । যজ্ঞেশ্বরের জ্যাঠাইমা আসিয়া বিভূতিকে কহিলেন , “ ভাই , অপরাধ যা হইবার তা তো হইয়া গেছে , এখন মাপ করো , আজিকার মতো শুভকর্ম সম্পন্ন হইতে দাও । ”
এ দিকে ছানার অন্যায় অপব্যয় দেখিয়া গোয়ালার দল রাগিয়া হাঙ্গামা করিতে উদ্যত । পাছে বরযাত্রদের সহিত তাহাদের একটা বিবাদ বাধিয়া যায় এই আশঙ্কায় যজ্ঞেশ্বর তাহাদিগকে ঠাণ্ডা করিবার জন্য বহুতর চেষ্টা করিতে লাগিলেন । এমন সময় ভোজনশালায় অসময়ে বর আসিয়া উপস্থিত । বরযাত্ররা ভাবিল , বর বুঝি রাগ করিয়া অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছেন; তাহাদের উৎসাহ বাড়িয়া উঠিল ।
বিভূতি রুদ্ধকন্ঠে কহিলেন , “ বাবা , আমাদের এ কিরকম ব্যবহার । ” বলিয়া একটা ছানার থালা স্বহস্তে লইয়া তিনি পরিবেশনে প্রবৃত্ত হইলেন । গোয়ালাদিগকে বলিলেন , “ তোমরা পশ্চাৎ দাঁড়াও , কাহারো ছানা যদি পাঁকে পড়ে তো সেগুলা আবার পাতে তুলিয়া দিতে হইবে । ”
গৌরসুন্দরের মুখের দিকে চাহিয়া দুই-একজন উঠিবে কি না ইতস্তত করিতেছিল — বিভূতি কহিলেন , “ বাবা , তুমিও বসিয়া যাও , অনেক রাত হইয়াছে । ”
গৌরসুন্দর বসিয়া গেলেন । ছানা যথাস্থানে পৌঁছিতে লাগিল ।