Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ (১৯৯৪) || Humayun Ahmed » Page 3

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ (১৯৯৪) || Humayun Ahmed

আমি বাথরুম সারলাম

আমি বাথরুম সারলাম। চোখে-মুখে খানিকটা পানি দিলাম। ছিটিকিনি খুলতে আমার বেগ পেতে হলো না। বাথরুমের বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আর তখন শোবার ঘরে ধাপ করে শব্দ হলো।

এর মানে কী?

কানে ভুল শুনছি। ধাপ করে শব্দ হবার কী আছে? চেয়ার টানার শব্দ হচ্ছে। কে যেন চেয়ার টানছে। মেঝের উপর চেয়ার টানার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ। কে চেয়ার টানবে?

আমি শোবার ঘরে শুয়ে পড়লাম। কোনো দুর্বলতাকে প্রশয় দেয়া যাবে না। ভয় পাওয়া যাবে না। কিছুতেই না। ভয় এমন বস্তু যে, একবার ভয় পেলেই তা ফুলে-ফোঁপে বাড়তে থাকে।

আমি শোবার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বেজে উঠল। আমি রিসিভার কানে তুলে বললাম, হ্যালো।

ওসি রমনা থানা বলছি।

স্নামালিকুম ভাই।

ওয়ালাইকুম সালাম–মিজান সাহেব, আমি ঐ মনসুরকে টেলিফোন করেছিলাম। আপনার স্ত্রী ওখানে নেই। কনফার্ম। পুলিশের টেলিফোন পেয়ে সে ভ্যাবাচক খেয়ে গেছে। সে বলেছে আপনার স্ত্রী তার কাছে যান নি, তবে তিনি টেলিফোন করেছিলেন।

কী বললেন? টেলিফোন করেছিল?

জি। রাত নটার দিকে টেলিফোন করেছিল। আপনার নাকি তাকে নিয়ে কোনো বিয়েতে যাবার কথা। আপনি তাকে ফেলে চলে গেছেন, এই নিয়ে দুঃখ করছিলেন।

ও।

কাজেই আপনি কোনো রকম দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আর শুনুন ভাই, আমি ঐ মনসুর ব্যাটাকে আন্ডার অবজারভেশন রাখব। লাইফ হেল কবে দিব। কোনো চিন্তা করবেন না।…

তার কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই আমি খাটের দিকে তোকালাম। আমি এটা কী দেখছি? রুবা শুয়ে নেই। সে বসে আছে। কুকুর। যেমন থাবা গেড়ে বসে সেও ঠিক সে-রকম থাবা গেড়ে বসে আছে। তবে তাকিয়ে আছে খোলা দরজার দিকে। আমার দিকে না। ব্যাপারটা এতই অস্বাভাবিক যে কিছুক্ষণ আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম। এক সময় দৃশ্যের অস্বাভাবিকতা আমোব মাথায় ঢুকাল। ঝন ঝন একটা শব্দ হলো–দেখি টেলিফোন রিসিভার আমার হাত থেকে পড়ে গেছে।

টেলিফোন রিসিভার থেকে শব্দ আসছে–হ্যালো। হ্যালো। হ্যালো। ক্ষীণ আওয়াজ যেন অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে। আমি টেলিফোনের কানেকশন খুলে ফেললাম। টেলিফোন কানেকশন খুলতে যতটা সময় লাগানো উচিত তারচেয়েও বেশি সময় লাগালাম। যেন টেলিফোন কানেকশন খোলা এই মুহুর্তে সবচে জরুরি কাজ। এটাই একমাত্র সত্য আর সব মিথ্যা।

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলে কেমন হয়? চোখ রেস্ট পাক। রেক্ট পেলে সব স্বাভাবিক হবে। তখন দেখা যাবে কেউ কুকুরের মতো থাবা গেড়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বসে নেই। সবই ভ্ৰান্তি। কিন্তু চোখ বন্ধ করার মতো সাহসও পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, একবার যদি চোখ বন্ধ করি তাহলে আর চোখ খুলতে পারব না। কিংবা খুললেও সেই চোখে কিছুই দেখব না। এসব হচ্ছে দুর্বল মনের কল্পনা। দুর্বল মনের কোনো কল্পনাকে প্রশ্ৰয় দেয়া ঠিক হবে না। এখন মন শক্ত করতে হবে। অনেক কাজ বাকি আছে। আসল কাজই বাকি। এতক্ষণ যা করেছি। সব নকল কাজ।

ডেডবডি সরাতে হবে। দ্রুত সরাতে হবে। এমনভাবে সরাতে হবে যেন কেউ এর কোনো খোঁজ না পায়। ডেডবডি পাওয়া না গেলে খুনের মামলা দাঁড় হয় না। খুন হয়েছে কি-না তা জানার প্রথম শর্ত হলো ডেডবডি। সুরতহাল হবে। ডাক্তাররা বলবেন, খুন। তবেই না মামলা চালু হবে।

ডেডবডি সামলানোর প্রচলিত যে কটি পদ্ধতি আছে তার সব কটিতে গণ্ডগোল আছে। একটাও ফুল প্রািফ নয়। লোকজন কী করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেয়? দুদিন না যেতেই বস্তা ভেসে উঠে। উৎসাহী লোকজন ছুটে আসে। বস্তা খোলা হয়। পত্রিকায় রিপোর্টের পর রিপোর্ট বের হতে থাকে। আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে, মাটি খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়া। পদ্ধতিটা খারাপ না, তবে এর জন্যে গর্ত গভীর হতে হবে। মাটি চাপা। দেবার এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে, যা অসম্ভব কঠিন কাজ।

আমার পদ্ধতি ভিন্ন। সহজভাবে পদ্ধতিটা হলো–ডিসপারসান পদ্ধতি। টুকরো টুকরো করে বড় একটা অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া। যত ক্ষুদ্র টুকরা হবে এবং যত বেশি ছড়ানো যাবে তত দ্রুত হত্যার প্রধান আলামত মৃতদেহ উবে যাবে। কোনো টুকবা কুকুরে খাবে, কোনোটা খাবে কাক। আমি ঠিক করেছি–ডেডবডি বাথরুমে নিয়ে… ..ছোট ছোট পিস করা হবে… ..থাক, এখন এসব চিন্তা করে লাভ নেই। আপাতত কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকি। তারপর চোখ খুলিব এবং দেখব রুবা বসে নেই। আগে যেভাবে বিছানায় ছিল এখন সেভাবে বিছানাতেই আছে।

আমি চোখ বন্ধ করলাম এবং মনে মনে বলতে থাকলাম–ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান, ওয়ান থাউজেন্ড টু, ওয়ান থাউজেন্ড খ্রি…। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে আছি সেই আন্দাজ পাওয়ার জন্যই বলা। ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান বলতে এক সেকেন্ড সময় লাগে।

ওয়ান থাউজেন্ড থাটি পর্যন্ত আমি চোখ বন্ধ করে আছি। অর্থাৎ প্ৰায় ৩০ সেকেন্ড চোখ বন্ধ। অনেকখানি সময়। চোখ খুললাম।

রুবা বসে আছে। তবে এখন সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে পলকহীন চোখে। ঈষৎ হং করে আছে। জিভ দেখা যাচ্ছে। জিহবার রঙ এখনো গাঢ় কালো।

যে বসে আছে সে রুবা নয়। She is dead… Dead and gone… অন্য কেউ। আমি টেলিফোনের কাছে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম, আর তখনই রুবা স্পষ্ট করে বলল, পানি খাব।

সে কি সত্যি কথা বলছে, না। আমি ভুল শুনছি? অডিটরী হেলুসিনেশন। আমার মাথা বোধহয় জট পাকিয়ে গেছে। সে আবারো বলল, পানি খাব।

আমি লক্ষ করলাম, কথাগুলি বলার সময় তার ঠোঁট নড়ল না, জিহবা, নড়ল না। গলার স্বর রুবার মতোই, তবে অস্পষ্ট, জড়ানো।

আমি বললাম, পানি খাবে?

হুঁ, তিয়াশ হয়েছে।

রুবাই কথা বলছে। তিয়াশ শব্দটা রুবার শব্দ। এটা রুবা বলে। আমি কী করব? পানি এনে দেব? আমার পক্ষে এমন হাস্যকর কিছু করা কি সম্ভব? আমি পানি এনে দিচ্ছি একটা মৃতদেহকে। আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, রুবা!

श्।

তুমি বেঁচে নেই। তুমি মারা গেছ। You are dead. Dead like a stone.

পানি খাব।

তুমি আমার কথা বুঝতে পারছি? আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি।

ও।

তুমি শুয়েছিলে। আমি একটা বালিশ এনে তোমার মুখের ওপর চেপে ধরেছি।

ও।

তুমি যে মাবা গেছ তা কি বুঝতে পারছি?

পানি।

পানি আমি তোমাকে এনে দেব। তুমি ভেব না। আমি তোমাকে দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। আমার ভয় খুব কম। অন্য যে কেউ এই অবস্থায় এটফেল করে মরে যেত। আমি মবি নি এবং আমি কথা বলছি তোমার সঙ্গে। আমি কি বলছি বুঝতে পারছি? বুঝতে পারলে মাথা নাড়াও।

রুবা মাথা নাড়ল না। যেভাবে বসেছিল। সেভাবেই বসে রইল।

আমি খাবার ঘরে ঢুকলাম। প্রথমে বের করলাম ব্ৰান্ডিব বোতল। পুরো কাপ। ভর্তি করে ব্ৰান্ডি ঢালিলাম। ব্ৰান্ডির জন্য আলাদা গ্রাস আছে। গ্লাস বের করতে ইচ্ছা করছে না। অতি দ্রুত স্নায়ুর উপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দিতে হবে। তখন শরীর ঠিক হবে। সব ফিরে যাবে আগের জায়গায়। ব্যাক টু দি প্যাভিলিসন।

কাপের ওপর পিপড়া ভাসছে। ভাসুক। পিপড়া খাওয়া ভালো। পিপড়া খেলে সাঁতার শেখা যায়। আচ্ছা, আমি কি সাঁতার জানি? সাঁতার জানি কি জানি না। অনেক ভেবেও মনে করতে পারলাম না। তার মানে আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। মুখ ভর্তি ব্ৰান্ডি নিয়ে গিলে ফেললাম। জিহবা, নাড়ি-চুড়ি জ্বলতে লাগল। জুলুক। জ্বলে ছাই হয়ে যাক।

এই, এই!

রুবা ডাকছে। পানি খেতে চায়। তাকে পানি খেতে দেব, না এক কাপ ব্ৰান্ডি দেব?

কেউ পানি চাইলে নিষেধ করতে নেই। কেউ পানি চাইলে তাকে পানি দিতে হয়, পানি না দিলে রোজ হাশরের ময়দানে যখন তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাবে তখন পানি পাওয়া যাবে না। এই কথা বলতেন। আমার মা। কোনো ভিখিরি পানি চাইলে আমার মা অতি ব্যস্ত হয়ে বলতেন–মিজান, ও মিজান! বাপধন, পানি দিয়ে আয়। টিনের মধ্যে টেস্ট বিস্কুট আছে। বিস্কুট দিয়ে পানি দে।

ভিখিরিদের পানি খাওয়ানোর জন্যে আমাদের একটা বড় এলুমিনিয়ামের গ্লাস ছিল। মাসের প্রথমেই বড় একটা টিন ভর্তি টেস্ট বিসকিট কিনে রাখা হতো। অন্য বিসকিটগুলো নরম হয়ে যায়। টেষ্ট বিসকিট কখনো নরম হয় না, যতই দিন যায় ততই শক্ত হতে থাকে–শক্ত হতে হতে এক সময় লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়।

একবার এক ভিখিরি ভিক্ষা চাইতে এসেছে–আমি যথারীতি তাকে এক গ্রাস পানি এবং একটা টোস্ট বিসকিট দিলাম। সেই বুড়ো ভিখিরি বিসকিট দেখে আনন্দে অভিভূত হলো। আমি দেখলাম, সে পানিতে বিসকিট ভিজিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। লোকে চায়ে বিসকিট ভিজিয়ে খায়, সে খাচ্ছে পানিতে ভিজিয়ে। কিন্তু বিসকিট নরম হচ্ছে না।

আমার মা দিনের পর দিন ভিখিরিদের পানি খাইয়ে গেলেন। নিজে মৃত্যুর সময় পানি খেতে পারলেন না। তার জলাতঙ্ক হয়েছিল। কুকুর তাঁকে কামড়ায় নি–শুধু আদর করে আঁচড়ে দিয়েছিল।

এই কুকুর ছিল মায়ের পোষা। দুপুরের দিকে বাসায় এসে দরজা ধাক্কাতো। মা একটা টিনের থালায় ভাত-মাছ দিয়ে বলতেন–ধর খা।

সে ভাত-মাছ খেয়ে আরাম করে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে বিদেয় হতো। অসুস্থ হবার পর কুকুরটা এলো চোখ লাল করে। কী ভয়ঙ্কর চেহারা! মা বললেন, এই, তোর কী হয়েছে রে? তুই এই রকম করছিস কেন?

কুকুর ঘড়ঘড় আওয়াজ করল। সেই আওয়াজও ভয়াবহ। মা কিছুই বুঝতে পারলেন না। নিজেই টিনের থালায় ভাত বেড়ে দিলেন। কুকুর খাবারে মুখ দিল না। বাপ দিয়ে মার কোলে উঠে তাঁকে আঁচড়ে দিল। মা বিরক্ত গলায় বললেন–করে কী, করে কী? তিনি ছিঃ ছিঃ করে উঠে গেলেন। অবেলায় গোসল করলেন। সন্ধ্যার দিকে তাঁর অল্প জ্বর হলো। পরদিন দিব্যি ভালো। তখনো তিনি জানেন না। তাঁর শরীরে ভয়ঙ্কর বিষ ঢুকে গেছে। যখন জানা গেল তখন করার কিছুই ছিল না।

মৃত্যুর সময় তাঁকে স্টোর রুমে তালাবন্ধ করে রাখা হলো স্টোর রুমের একটা জানালা। সেই জানালায় শিক বসানো। মা দুহাতে শিক চেপে ধরে শ্লেষ্মা জড়ানো ভারি গলায় চিৎকার করতেন, পানি! পানি! রুবা পানি পানি বলছে। তার গলার স্বরটা কি ভারি শোনাচ্ছে না? শ্লেষ্মা জড়ানো মনে হচ্ছে না? না-কি আবারও শোনার ভুল? মার কথাই বা এখন মনে পড়ল কেন? আমি মার কথা মনে করতেই চাই না। মনে করিও না। এটা কি ব্ৰান্ডি খাওয়ার জন্যে হয়েছে? মাথা ঝিমঝিম করছে, শরীর হালকা। এতটা ব্ৰান্ডি এক সঙ্গে খাওয়া ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। একটা ভুল যদি কেউ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে আরো তিনটা ভুল করে। ভুল একা চলে না, সে চলে সঙ্গিী-সাথি নিয়ে। আমি এখন পরপর কয়েকটা ভুল করব। সেই ভুলগুলি কী কী?

শোবার ঘর থেকে আবার শব্দ হলো–পানি, পানি।

আমি গ্লাস ভর্তি করে পানি নিলাম। রুবার নিজের গ্রাসেই নিলাম। সে অন্যের গ্লাসের পানি খেতে পারে না। এখন সে বেঁচে নেই। সে সে… কী বলতে চাচ্ছি। বুঝতে পারছি না। মৃত মানুষের জন্যে পানি নিয়ে যাচ্ছি, এটা কি দ্বিতীয় ভুল না? আচ্ছা, আমি একজন মৃত মানুষের জন্যে পানি নিয়ে যাচ্ছি কেন?

পানির গ্লাস রুবার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে হাত বাড়িয়েছে কিন্তু গ্লাস ধরতে পারছে না। তার আঙ্গুল কাঁপছে। আমি বিছানার পাশে সাইড টেবিলে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম। সে পারলে টেবিল থেকে গ্রাস নেবে। না পারলে নেবে না। আমার পানি দেবার কথা, আমি দিয়েছি। বাকিটা তার ব্যাপার।

রুবা এগুচ্ছে। হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে। তাকে দেখাচ্ছে কুকুরের মতো। জলাতঙ্ক রোগি শেষের দিকে কুকুরের মতো হয়ে যায়। কুকুরের মতো ঘড়ঘড় শব্দ করে, মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে এবং জিহবা বের করে দেয়। এটা আমার কথা না; ইদ্রিস বলে আমাদের যে কাজের ছেলে ছিল তার কথা।

মার যখন জলাতঙ্ক ধরা পড়ল তখন সে চুপি চুপি আমাকে বলল। আমার তখন সাত বৎসর বয়স। ইদ্রিস আমার শিক্ষাগুরু। কত কিছু আমাকে সে শেখায়। তার প্রতিটি শব্দ আমি বিশ্বাস করি।

বুঝছেন ছোট মিয়া, কুত্তায্য কামড়াইলে পেডে কুত্তার বাচ্চা হয়। মেয়েছেলের পেডেও হয়। পুরুষ ছেলের পেডেও হয়। আব্ব মানুষটা আস্তে আস্তে কুত্তার লাহান হয়। তার শ‍ইল্যে লোম উইঠা যায়–ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। এক আচানক দৃশ্য ছোট মিয়া.।

তুমি দেখেছ?

কত দেখলাম। অখন তুমিও দেখবা।

স্টোর রুমের আশেপাশে আমাদের যাওয়া নিষেধ ছিল। তারপরেও মাঝে মাঝে উঁকি দিতাম মা কতটা কুকুর হয়েছেন দেখার জন্যে। মা আমাকে চিনতে পারতেন না। কাউকেই পারতেন না। শুধু আমার বড়বোনকে চিনতেন। বড়বোনকে দেখলেই বলতেন–মিনা, বাতাস বাতাস।

কেন বলতেন। আমরা জনতাম না। বোধহয় তার গরম লাগত। স্টোর ঘরটা ছিল ছোট। একটাই জানালা। মা শেষদিকে টেনে টেনে তাঁর গায়ের সব কাপড় ছিঁড়ে ফেললেন। পুরো নগ্ন হয়ে মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলেন। যা পেতেন, কামড়ে ধরতেন। একদিন দেখি, পুরনো জুতা চিবুচ্ছেন। ইদ্রিস বলল, ছোটমিয়া দেখছেনক্যামনে কুত্তা হইতাছে? খিক্‌ খিকখিক।

ব্যাপারটা তার কাছে খুব মজার মনে হচ্ছিল। সে বলতে গেলে সারাক্ষণই স্টোররুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। বাবা একদিন তাকে মারলেন। ভয়ঙ্কর মার। ইদ্রিসের ঠোঁট কেটে গেল। দাঁত ভেঙে গেল। রক্তে তার গেঞ্জি মাখামাখি। সে নাকি স্টোর রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে খিকখিক করে হাসছিল। বাবা হুঁঙ্কার দিলেন। হারামজাদা, তোকে আমি খুন করে ফেলব। হুঁঙ্কার এবং চড় থাপ্পড়, কিল ঘুসি। বাবারও বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মার মৃত্যুর কাছাকাছি সময় তিনি যা করে সবই পাগলের কাজ। সুস্থ মানুষের কাজ না। সুস্থ মানুষ এইসব করে না। যেমনমঙ্গলবার শেষরাতে বাবা বিছানা থেকে আমাদের টেনে নামালেন। চাপা হুঁঙ্কার–অজু বুদ্ধ কর। আমরা চার ভাইবোন অজু করলাম। আর আমার সাথে—তোর মাকে দেখবি।

আমরা স্টোর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। স্টোর রুম অন্ধকার। বাবা মার ওপর টর্চের আলো ফেললেন। কী কুৎসিত দৃশ্য! যেন একটা পশু চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে–ধো ঘো শব্দ হচ্ছে। বাবা বললেন, দেখলি?

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, হুঁ।

এখন আয় আমার সাথে।

আমরা বাবার শোবার ঘরে ঢুকলাম। সেখানে বিছানায় পাটি পাতা। বাবা বললেন, পাটিতে বসে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বল, হে আল্লাহপাক, আমার মার সব কন্টের অবসান কর। আমার মার মৃত্যু দাও। স্বামীর কথা আল্লাহ শুনবে না। স্বামীরা প্রায়ই স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে। ছেলেমেয়ের কথা শুনবে। তোয়া করে।

আমরা দোয়া করলাম।

বাবা পাথরের মতো মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দোয়া শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, আমাদের কাজের মেয়ে রহিমাবু এসে বললআম্মাজান নড়াচড়া করতেছে না, মনে হয়। উনার মৃত্যু হইছে।

আমা তোয়া করেছি বলে মার মৃত্যু হয়েছে এটা আমি মনে করি না। আমি আমার অন্য ভাই বানদের কথা জানি না। কিন্তু আমি নিজে মার মৃত্যুর কথা আল্লাহকে বলি নি। আমি হাত তুলে চুপচাপ বসেছিলাম। ভাইবোনদের তোয়ার কারণে মার মৃত্যু হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমার ধারণা, দোয়া না করলেও মঙ্গলবার ভোরবেলা তাঁর মৃত্যু হতো।

মার মৃত্যুর পর বাবা চাকরি ছেড়ে দিলেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি স্টোর রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতেন। খাওয়া-দাওয়ার খুব অনিয়ম করতেন। হয়তো টেবিলে খাওয়া দেয়া হয়েছে, তাকে খেতে ডাকা হলো, তিনি বললেন, না।

আমার মনে হয় তার মাথার গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। একদিন হঠাৎ বললেন, তিনি আর পানি খাবেন না।–আমার স্ত্রী পানির জন্যে ছটফট করেছে, পানি পায় নাই। जांभि९3 नेि शान्त না।

তামে পানি অবশ্যি খাওয়ানো হয়। আমার ছোটখালা কাঁদতে কাঁদতে যখন বলেন, পানি খান দুলাভাই। আপনি মারা গেলে বাচ্চাদের কে দেখবে? বাবা পানি খান। তাঁর মাথা কিন্তু সারে না। কথাবার্তা বন্ধ করে দেন।

তাঁর একটাই কথা–একটা মানুষ যে কোনোদিন কোনো অন্যায় করে নাই, কোনো পাপ করে নাই, মানুষের দুঃখ দেখলে যে অস্থির হয়ে যেত— তার কেন এই কষ্ট?

বাব তখন খুব অসুস্থ, আমরা সবাই তাঁকে ঘিরে আছি, তখন তিনি একদিন বললেন–তোরা শুনে রাখা। কেউ পানি চাইলে তোর মা অস্থির হয়ে পড়ত—কোনো ফকির-মিসকিন বলতে পারবে না। সে পানি চেয়েছে, তোদের মা শুধু পানি তাকে দিয়েছে। পানি দিয়েছে, পানির সঙ্গে কিছু খেতে দিয়েছে। সে মরাল কীভাবে? পানির তৃষ্ণায়।

কোনো মেয়ে ছেঁড়া শাড়ি পরে এসেছে। এমন শাড়ি যে শরীর ঢাকতে পারছে না।–তোদের মা তৎক্ষণাৎ তাকে শাড়ি দিয়েছে। কত রাগোরাগিও এই নিয়ে তোদের মার সঙ্গে করেছি। সে কী বলত? বলত, আহা, শরীর ঢাকতে পারছে না–লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে–কী লাজ! সে মরাল কীভাবে লজ্জার মধ্যে। সে যখন মরল নগ্ন অবস্থায় মরল। হেন লোক নেই যে তাকে নগ্ন দেখে নি।

পশু-পাখির জন্যে তার মমতার শেষ ছিল না। একটা কাক এসে রেলিং-এ বসলে সে কী করত? ভাত ছিটিয়ে দিত। বলত, আহা বেচারা, খিদে পেটে এসেছে। কুকুরবেড়াল যেটাই এসেছে, টিনের থালায়.খাবার দিয়েছে। সে মরাল কীভাবে? কুকুরের হাতে।… ..কেন? বল কেন? চুপ করে থাকবি না। বল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *