বেঁটে, কিম্ভুত, গোলগাল
বেঁটে, কিম্ভুত, গোলগাল চেহারার লোকটা হেলেদুলে একটা আহ্লাদি দুলকি চালে হাঁটছে। পিছনে একটু তফাতে পাঁচু। লোকটা যে সুরেলা, অদ্ভুত সুন্দর শিসের শব্দ করছে, তাতে পাঁচুর যেন ঘুম-ঘুম ভাব হচ্ছে। যেন সে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে হাঁটছে। চারদিকে জ্যোৎস্নামাখা কুয়াশায় যেন নানা স্বপ্নের ছবি ফুটে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না পাঁচু। কিন্তু কিছু একটা হচ্ছে, যা তার জীবনে আগে কখনও ঘটেনি। চারদিকে মায়াবী ওই শিসের শব্দের ঢেউ যেন ময়নাগড়কে এক অন্য জগৎ করে তুলছে।
খুব আবছা, স্বপ্নালু, ঘুম-ঘুম চোখে পাঁচু দেখতে পেল, বটতলার জংলা ঝোঁপঝাড়ের ভিতর থেকে একটা ছোট ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে যেন এই বেঁটে লোকটার হাত ধরে হাঁটতে লাগল। কে ও? যজ্ঞেশ্বর না? আরও একজন কে যেন পাশের পুকুর থেকে উঠে এসে পিছু নিল বেঁটে লোকটার। হ্যাঁ, পাঁচু একে চেনে। ও হল কলসিকানাই।
কিন্তু এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? পাঁচু একবার ভাবল, এসব স্বপ্ন। সে ফিরবার জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। এক আশ্চর্য চুম্বকের টানে সে ওর পিছু পিছু মন্থর পায়ে হাঁটতে লাগল। ওই আশ্চর্য সুরে তার দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। গানবাজনার সে কিছুই জানে না, তবু কেন যে এমন হচ্ছে!
হঠাৎ রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে নেমে যাচ্ছিল বেঁটে মানুষটা। পাঁচু জানে ওখানে একটা পচা ডোবা আছে। তাতে থকথকে কাদা। পড়লে আর উঠতে পারে না কেউ। তাই সে চেঁচিয়ে বারণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বরই বেরোল না।
কিন্তু ডোবায় পড়লে যে লোকটার ঘোর বিপদ হবে। তাই পাঁচু প্রাণপণে ছুটতে চেষ্টা করল। এমনিতে সে হরিণের মতো দৌড়তে পারে বটে, কিন্তু এখন পারল না। মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম সব তন্তু যেন আটকে ধরেছিল তাকে। তবু প্রাণপণে সব ছিঁড়েছুঁড়ে সে ছুটবার চেষ্টা করতে লাগল।
যখন গিয়ে ডোবার নাগালের ধারে পৌঁছোল, তখন শিসটা থেমে গিয়েছে। সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভিতরটা হায়-হায় করে উঠল পাঁচুর। লোকটা কি তবে ডুবেই গেল কাদায়?
সে মনস্থির করে ডোবায় ঝাঁপ দেবে বলে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে নামতেই কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
পাঁচু বলল, কে? কে তুমি?
ফিরে যাও।
লোকটা যে ডুবে গেল!
ফিরে যাও। নইলে বিপদ হবে।
পাঁচু আর এগোল না। তবে মনটা বড় ভার হয়ে রইল। কথাটা কে বলল, তা অবশ্য সে বুঝতে পারল না। যজ্ঞেশ্বর কি? নাকি কলসি কানাই?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরে আসছিল পাঁচু। নিজের বাড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ একটা লম্বা লোক তার পথ আটকে দাঁড়াল।
পাঁচু যে!
পাঁচু খুব অভিমানের সঙ্গে বলল, হিজিবিজিদাদা, তুমি যে বোকা লোক খুঁজে বেড়াচ্ছিলে! বোকা লোক পেলেই নাকি কাজ দেবে! তা সেই থেকে আমি হাঁ করে তোমার জন্য বসে আছি। তুমি কোথায় হাওয়া হয়ে গেলে বলো তো!
হিজিবিজি একগাল হেসে বলল, ওরে বাপু, হাওয়া হতে হয় কী আর সাধে! গা-ঢাকা না দিলে যে আমার বড় বিপদ হচ্ছে।
কী বিপদ হিজিবিজিদাদা?
বোকা লোক খুঁজছি শুনে আমার চারদিকে বোকা লোকের গাদাগাদি লেগে যাচ্ছিল যে। বুড়োশিবতলার হাটবারে তো একেবারে লাইন লেগে গেল। এ বলে, আমি সবচেয়ে বোকা, তো আর-একজন বলে, আমি ওর চেয়েও বোকা। আর-একজন বলল, ওরা আর কী এমন বোকা! আমার মতো বোকা ভূ-ভারতে নেই। আমি রোজ বাজার করতে যাই, কিন্তু রোজ আমাকে রাস্তার লোককে জিগ্যেস করে করে বাজারের পথের হদিস জানতে হয়। আর বাড়ি ফেরার সময়ও তাই। ফস করে পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ওটা বোকামির লক্ষণ নয় লক্ষ্মণবাবু, ওটা ভুলো মনের লক্ষণ। এই আমাকে দেখুন, এমন নিরেট বোকা পাবেন না। তিনের সঙ্গে দুই যোগ করলে যত হয় জিগ্যেস করলে বরাবর বলে এসেছি সাত। পিছন থেকে আর একজন বলল, তাতে কী? কেউ অঙ্কে কঁচা হলেই কি বোকা হতে হবে নাকি? বরং আমার কথাই ধরুন, মুগবেড়ের গোহাটায় গরু কিনতে গিয়ে এক ফড়েবাজের সঙ্গে আলাপ হল। তা সে বলল, গরুর দুধের আজকাল চাহিদা নেই, উপকারও নেই। আসল জিনিস হল ছাগলের দুধ। গরু কিনে ঠকতে যাবে কেন, বরং আমার ছাগলটা নিয়ে যাও। দাম বরং কটাকা কমিয়ে দিচ্ছি। আমি এমন বোকা যে, তার কথার খপ্পরে পড়ে গরুর বদলে ছাগল কিনে ফেললুম। একজন তাকে কনুইয়ের গুতোয় সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি হলে গোরুর দাম দিয়ে বেড়াল কিনে আনতুম। ওরে বাপু, আসল বোকা ওকে বলে না, এই আমাকে দ্যাখো, আমার বউ বলে আমি নাকি বিশ্ব বোকা। নিখিল বঙ্গ বোকা সম্মেলনে আমি সেবার ফার্স্ট হয়েছিলাম।
পাঁচ গম্ভীর হয়ে বলল, আমার তো এদের তেমন বোকা বলে মনেই হচ্ছে না।
খুব ঠিক কথা। আমারও মনে হচ্ছে না। যারা নিজেদের বোকা বলে বুঝতে পারে, তারা আবার বোকা কীসের? আসল বোকা হল সে-ই, যে নিজে বুঝতেই পারে না যে, সে বোকা।
পাঁচু করুণ মুখ করে বলল, তা হলে আমার কী হবে হিজিবিজিদাদা? আমি যে বোকা, সেটা যে আমিও বুঝতে পারি!
সেই জন্যই তো তোমাকে বলছিলাম, সত্যিকারের বোকা লোক খুঁজে বের করা খুব কঠিন। ভগবান বোকা লোক মোটেই সাপ্লাই দিচ্ছেন না। তাই তো বুড়োশিবতলার হাট থেকে পালিয়ে বাঁচতে হল। তারপর থেকে গা-ঢাকা দিয়েই থাকতে হয়েছে। বোকা লোকরা কোমর বেঁধে খুঁজছে কিনা আমাকে!
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বোকা হয়েও সুখ নেই। দেখছি।
তোমার দুঃখেরও কিছু নেই। তোমার মতো চালাকচতুর, চটপটে, চারচোখা ছেলের কাজের অভাব হবে না। তবে আমি এখন বোকা ছেড়ে মোটা লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি।
সে আবার কীরকম।
এই ধরো, বেশ গোলগাল মোটাসোটা চেহারার লোক। বেঁটে মতো হলে খুবই ভালো হয়। যদি সন্ধান দিতে পার, তবে হাতে-হাতে পঞ্চাশ টাকা নগদ পাবে।
ঠোঁট উলটে পাঁচু বলে, এ গাঁয়ে মোটা লোকের অভাব কী? গদাধর মোটা, ভজহরিবাবু মোটা, বিষ্ণুবাবু মোটা…
আহা, ওদের কথা হচ্ছে না। যেমন-তেমন মোটা হলে চলবে না। মোটা-মোটা বেঁটে, বিটকেলোনা হলে ভালো হয়। তা সন্ধানে আছে নাকি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাঁচু বলল, সন্ধান তো ছিল। কিন্তু সেই লোকটা যে মজা পুকুরের কাদায় ডুবে গেছে!
আঁ! বলে একটা বুকফাটা চিৎকার দিয়ে উঠল হিজিবিজি। তারপর পাঁচুর কাধ ধরে একটা রাম-ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সত্যি বলছ? কোথায় সেই মজা পুকুর?
পাঁচু একটু ঘাবড়ে গিয়ে দু-পা পিছিয়ে বলল, সত্যি কথাই বলছি। নিজের চোখেই দেখা বলতে পার। একটু আগেই বিটকেল মানুষটা সটান গিয়ে পুকুরে ডুবেছে…
তার হাতে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে হিজিবিজি বলল, চলো, চলো, শিগগির চলল। লোকটা বেহাত হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে যে!
পাঁচুর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে প্রায় দৌড়তে-দৌড়তে হিজিবিজি বলছিল, সর্বনাশ হয়ে যাবে! কোথায় সেই মজা পুকুর?
পাঁচু বিরক্ত হয়ে বলল, আহা, কোথায় আন্দাজে ছুটছ? পুকুর তো ডান ধারে।
পুকুরের ধারে এসে তারা দেখল, চারদিকে গাছগাছালির ঘন ছায়ায় নিথর পুকুর। কোথাও কোনও হুটোপাটির শব্দও নেই।
হিজিবিজি ব্যস্তমনস্ক হয়ে বলল, পুকুর থেকে ওকে তুলতেই হবে! জলে নামো। এর জন্য টাকা দেব।
পাঁচু বলল, পাগল নাকি? পুকুরে থকথকে কাদা, একবার নামলে আর উঠতে হবে না। জন্ম থেকে দেখে আসছি, এই পুকুরে কেউ নামে না। কলসি-কানাই তো এখানেই ডুবে মরেছিল।
হিজিবিজি হাসিখুসি ভাবটা উবে গেছে। সে কঠিন গলায় বলে, ওসব শুনতে চাই না। লোকটাকে পুকুর থেকে তুলতেই হবে। আমার কাছে ভালো নাইলনের দড়ি আছে। তোমার কোমরে বেঁধে দিচ্ছি। পুকুরে নামো, বিপদ বুঝলে আমি টেনে তুলব।
পাচু পিছিয়ে গিয়ে বলে, এই ঠান্ডায় আমি পুকুরে নামতে পারব না হিজিবিজিদাদা। নামতে হলে তুমি নামো।
হিজিবিজি হঠাৎ লোহার মতো শক্ত হাতে তার ঘাড়টা চেপে ধরে মাথায় একটা রামগাট্টা বসিয়ে দিয়ে বলল, ভালো কথায় কাজ না হলে তোর বিপদ আছে। ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দেব।
পাঁচু বুঝতে পারল, হিজিবিজিকে সে যত ভালোমানুষ মনে করেছিল, তত ভালোমানুষ ও নয়। গাট্টার চোটে তার মাথা ঝিমঝিম করে চোখে অন্ধকার দেখে বসে পড়ল মাটিতে।
হিজিবিজি কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা লম্বা নাইলনের দড়ি বের করে পাঁচুর কোমরে এক প্রান্ত বেঁধে দিয়ে বলল, যাও আর সময় নষ্ট কোরো না। কথা না শুনলে কিন্তু বিপদ হবে।
পাঁচু তবু ইতস্তত করতে লাগল। হিজিবিজি সোজা তার ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে পুকুরের ধারে গিয়ে প্রচণ্ড একটা ধাক্কায় জলে ফেলে দিল।
বরফের মতো ঠান্ডা জলে পড়ে গিয়ে পাঁচু মা গো বলে চেঁচিয়ে উঠল প্রথমে। তারপর পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়তে লাগল। উপরে খানিকটা জল থাকলেও জলের দু-তিন ফুট নীচে ভসভসে কাদায় গেঁথে গেলে আর কিছু করার থাকে না। হিজিবিজি পুকুরের ধার থেকে কঠিন গলায় আদেশ দিল, ডুব দাও। ডুব দিয়ে দিয়ে খোঁজো লোকটাকে। দেরি কোরো না, তা হলে মরবে।
কিন্তু জলে-কাদায় ডুবন্ত মানুষ খুঁজবে কী, পাঁচুর নিজের প্রাণই রক্ষা করা দায়। সাঁতার সে খুবই ভালো জানে বটে, কিন্তু এই হাজামজা কাদার পুকুরে সাঁতার জেনে হবে কোন অষ্টরম্ভা? পাঁচু ভেসে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু উপর থেকে একটা গাছের শুকনো ডাল দিয়ে তার মাথায় একটা ঘা মেরে হিজিবিজি বলল, ডুব দাও। ডুব দিলে তুলবে কী করে লোকটাকে?
অগত্যা ডুব দিতে হল পাঁচুকে। আর ডুব দিতেই হল বিপত্তি। আর এই সাঙ্ঘাতিক ঠান্ডায় হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিলই। ডুব দেওয়ার পর নীচেকার কাদামাটি ঘুলিয়ে উঠে নাকে-মুখে ঢুকে যাচ্ছিল। নীচের কাদায় বসে যাচ্ছিল কোমরসুদ্ধ পা। চেষ্টা করেও পাঁচু আর উপর দিকে উঠতে পারছিল না। তার উপর দমও ফুরিয়ে আসছে।
মরতে আজ খুব একটা দুঃখ হচ্ছে না পাঁচুর। এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে এই অনাদরে, অপমানে বেঁচে থাকার মানেই হয় না। মরে বরং ভূত হয়ে দিব্যি গাছে-গাছে ঘুরে বেড়ানো যাবে। সেও একরকম ভালো। তাই আকুপাকু করলেও ভিতরে তেমন হায়-হায় করছিল না।
ঠিক এই সময় তার কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, দূর বোকা, আহাম্মক কোথাকার! ডান দিকে কোনাকুনি এগোতে থাক।
কে বলল কে জানে। তবে বিকার অবস্থায় লোকে অনেক ভুল দ্যাখে, ভুল শোনে। সেরকম কিছু হবে বোধ হয়। তবে সে ডানদিকে ফেরার একটা চেষ্টা করল। হাত পা প্রবলভাবে নাড়ানাড়ি করায় একটু এগিয়েও গেল সে।
কে যেন বলল, এবার মাথা ভোলা দে।
তাই দিল পাঁচু। মাথাটা ভুস করে জলের উপর ভেসে উঠল। সে দেখতে পেল, জলের মধ্যে হোগলার জঙ্গলের আড়ালে পড়েছে সে। হিজিবিজি তাকে দেখতে পাচ্ছে না। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, তার পায়ের নীচে শক্ত মাটি। ঠেকছে। সে কোমরের দড়িটা খুলে ফেলে সন্তর্পণে জল থেকে উঠে জঙ্গলের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ঠাহর করে দেখল, হিজিবিজি দড়িটা টেনে দেখছে। তারপর চাপা গলায় একটা হুঙ্কার দিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা কিছু বের করে এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। তাকেই খুঁজছে বোধহয়।
কানেকানে কে যেন ফের চাপা গলায় বলে উঠল, জল ছেড়ে উঠো না, মরবে। ডান দিকে এগিয়ে যাও।
তাই এগোল পাঁচু। আশ্চর্যের বিষয়, পুকুরে জলের নীচে একটা সরু কার্নিসমতো রয়েছে। সেই কার্নিস ধরেই জল ভেঙে এগোতে-এাগাতে সে জলে গজিয়ে ওঠা নানা আগাছার গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপর পা বাড়িয়ে অনুভব করল, কার্নিসটা বাঁক নিয়েছে। আর বাঁকের মুখটায় একটা বড় নালার বাধানো মুখ।
ভাবনাচিন্তার সময় নেই। পাঁচু একটু হামাগুড়ি দিয়ে নালার মুখে ঢুকে পড়ল। নালার মধ্যে হাঁটুজলের বেশি নয়। তবে কাদাটাদা নেই। দিব্যি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল সে। একটু পরেই নালাটা যেখানে শেষ, সেটা একটা বেশ বড়সড় চৌবাচ্চার মতো জায়গা। মাথা তুলে দাঁড়াতেও কোনও অসুবিধে নেই। হাতড়ে-হাতড়ে অন্ধকারে পাঁচু আন্দাজ করল, এটা একটা বড় চৌবাচ্চাই বটে। বেশ উঁচু কানা। তবে একধারে উপরে ওঠার সরু সিঁড়ি আছে। পাঁচু সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল।
আশ্চর্যের বিষয়, যেখানে উঠে এল সেটা একটা বেশ বড়সড় ঘর। ঘরের ভিতরে একটা সোঁদা গন্ধ। কত বড় ঘর বা ঘরে কী আছে তা অন্ধকারে দেখা গেল না। পাঁচুর বেশ শীত করছিল। গায়ের জামাটা খুলে নিংড়ে নিল সে। তারপর সেটা দিয়ে মাথা আর গা মুছে নিল। অন্ধকারে চারদিকটা ঠাহর করার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু অন্ধকারে চারদিককার আন্দাজ পাওয়া মুশকিল।
হঠাৎ বাঁ-দিক থেকে একটা ভারী চাপা কাতর ধ্বনি শুনতে পেল সে। যেন কেউ খুব ব্যথা বা বেদনায় ককিয়ে উঠছে। পাঁচু ভয় পেল না। সহজে ভয় পায় না সে। চাপা গলায় বলল, কে, কে গো তুমি?
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর হঠাৎ চারদিকে একটা ঢেউ তুলে একটা ভারী সুরেলা শিসের শব্দ ভেসে এল। সেই বেঁটে, মোটা, গোল চেহারার লোকটাই তো শিস দিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে! তবে কি লোকটা বেঁচে আছে?
পুকুরে ডুবে মরেনি?
শিসের শব্দ লক্ষ করে মাঝখানে এগিয়ে গেল পাঁচু। একবারে কাছে গিয়ে হাত বাড়াতেই মানুষের শরীরের স্পর্শ পেল সে। শিসটা থেমে গেল হঠাৎ।
পাঁচু কোমল গলায় বলল, তুমি কে?
লোকটা বলল, হিজিবিজি।
তুমিই হিজিবিজি?
লোকটা ফের বলল, হিজিবিজি।
আমি তোমার কাছে একটু বসব?
হুঁ।
পাঁচু বসল মেঝের উপর, পাশাপাশি। লোকটা ফের শিস দিতে লাগল। পাঁচু দুনিয়া ভুলে মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল, এমন সুন্দর সুর সে কখনও শোনেনি।
.
চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দেওয়ায় লোকটার জ্ঞান ফিরল। তবে চোখ চাওয়ার আগেই তিনি কাতর গলায় মাগো, বাবা গো করে কিছুক্ষণ ছটফট করলেন। তারপর চোখ চেয়ে লোকজন দেখে ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠে বললেন, আমার দেহে কি প্রাণটা এখনও আছে, নাকি বেরিয়ে পড়েছে?
টাকই খুব মন দিয়ে জটাবাবার দাড়ি-গোঁফের মধ্যে লুকনো ধূর্ত মুখটা দেখে নিচ্ছিল। বলল, বাবাজির যে প্রাণের বড় মায়া দেখছি! তা প্রাণ নিয়ে এরকম টানাহ্যাঁচড়া পড়ল কেন? আপনার ওই ঢ্যাঙাপানা স্যাঙাতটাই বা গায়েব হল কোথা?
জটাবাবা কাতরাতে কাতরাতে বললেন, ওই কমণ্ডলু থেকে মুখে আগে একটু জল দাও দিকি। গলাটা কাঠ হয়ে আছে। টকাইয়ের ইশারায় নব গিয়ে কমণ্ডলু নিয়ে এল। ঢকঢক করে খানিক জল খেয়ে জটাবাবা কষ্টেসৃষ্টে উঠে বসে চারদিকে খোলা চোখে চেয়ে দেখলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
টকাই সায় দিয়ে বলে, বটেই তো। বাঃ, বাবাজির মুখ থেকে বেশ ভালো-ভালো কথা বেরোয় তো! তা দিব্যদৃষ্টিটা খুলল কী করে বাবাজি? রদ্দা খেয়ে নাকি?
কাহিল গলাতেও একটা হুংকার ছাড়ার চেষ্টা করে বাবাজি বললেন, রদ্দা মেরে পালাবে কোথায়? এমন মারণউচাটন ঝাড়ব যে, লাট খেয়ে এসে এইখানে পড়ে মরবে। মুখে রক্ত উঠবে না? জোর পেয়ে দুম করে ঘুসো বসিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা কার এমন আস্পদ্দা হল যে, আপনাকে ঘুসো মেরে চলে গেল?
জটাবাবা স্তিমিত চোখে টকাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, তুমি কে বলো তো! মুখোনা চেনা-চেনা ঠেকছে।
নবা গদগদ গলায় বলে, আহা, একে চিনতে পারছেন না বাবাজি? এ যে টকাই ওস্তাদ! এই তো সেদিন দুজনে আপনাকে নমো ঠুকে গেলুম! এর মধ্যেই ভুলে গেলেন?
জটাবাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ওরে, কতজনাকে আর মনে রাখব? যজমান কি আমার একটা দুটো? সারা পৃথিবীতে লাখো-লাখো ছড়িয়ে আছে যে। তা তুই কি চোর ডাকাত নাকি?
আমি চোর-ডাকাত হলে কি আপনার কিছু সুবিধে হয় বাবাজি?
জটাবাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বললেন, তা জানি না বাপু। মারধর খেয়ে মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করছে। কিছুই তেমন মনে পড়ছে না।
টকাই মিষ্টি করে জিগ্যেস করে, আপনি সাধু-সন্নিসি মানুষ, সাধনভজন নিয়ে থাকেন, আপনাকে তো মারধর করার কথা নয়। বলি গুপ্তধনটনের খবর আছে নাকি আপনার কাছে?
জটাবাবা মাথা নেড়ে বললেন, না রে বাপ, গুপ্তধন নয়।
তবে কী?
কিছু মনে পড়ছে না রে বাপু। মাথাটা বড্ড গুলিয়ে গেছে।
ওই বড় বাক্সটার মধ্যে যে কেষ্টর জীবটাকে পুরে রেখেছিলেন, তার কী ব্যবস্থা করেছেন বলুন তো বাবাজি! মেরেটেরে ফেলেছেন নাকি? তা হলে বলতে হয় আপনি সাধুবেশে অতি পাষণ্ড লোক।
জটাবাবা জুলজুলে চোখে টকাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ওসব আমি কিছু জানি না বাপু, মদনা জানে।
মদনা, সে আবার কে?
জটাবাবা এবার নিজেই কমণ্ডলু তুলে খানিক জল খেয়ে বললেন, মদনা যে কে তাও কি ছাই জানি!
মদনা আপনার চেলা নাকি?
জটাবাবা মাথা নেড়ে বলেন, না। বিষ্ণুপুরের বটতলায় আস্তানা গেড়েছিলুম। সেইখানেই এসে জুটল খুব চালাক চতুর লোক। মেলা ভেকিও জানে দেখলাম। বলল, তাকে নাকি পুলিশ ঝুটমুট হয়রান করছে, একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে চায়। তা আমি সাধু-ফকির মানুষ, আমার আর কাকে ভয়? তাই নিলুম সঙ্গে জুটিয়ে। তারপর ঘুরতে-ঘুরতে এই ময়নাগড়ের জঙ্গলে। এর বেশি কিছু আমি জানি না বাপু।
কিন্তু বাবাজি, জানলে ভালো করতেন। ওই বাক্সটার মধ্যে যাকে পুরে রেখেছিলেন, সে কিন্তু কোনও জন্তু জানোয়ার নয়। দেখতে বিটকেল হলেও, সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার লোকও নয়। তাকে দিয়ে কী করানোর মতলব ছিল আপনার বলুন তো?
সেসব মদনা জানে। আমাকে জিগ্যেস করে লাভ নেই।
তাকে পেলেন কোথায়? সেটাও কি মদনা জানে? আর মদনাই যদি সব জানে, তা হলে আপনি বাবাজি কি চোখ উলটে ছিলেন? আমি নিজের চোখে রোজ রাত্তিরে ওই বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখেছি, আপনারা দুটি পাষণ্ড মিলে মানুষটার উপর কী অত্যাচারটাই না করেন। ঝেড়ে কাশুন তো বাবাজি, আপনারা আসলে কারা, আর মতলবটাই বা কী?
নবা আর দুর্গাপদ এতক্ষণ কথা কয়নি। নবা এবার একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ওস্তাদ, আপনি শিল্পী মানুষ, জীবনে কখনও মোটাদাগের কাজ করেননি। জটাবাবাকে পাঁচ মিনিটের জন্য আমার আর দুর্গাপদর হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। আমরা জিব টেনে কথা বের করে আনছি।
জটাবাবা জুলজুল করে নবা আর দুর্গাপদকে জরিপ করে নিলেন। তিনি রোগাভোগা লোক, আর এ-দুজন পেল্লায় জোয়ান। কমণ্ডলু থেকে আর একটু জল গলায় ঢেলে জটাবাবা বললেন, তিষ্ট রে পাপিষ্ঠ, আমি কিন্তু মারণউচাটন জানি।
নবা বলল, সে আমরাও জানি। আপনার মারণউচাটনের চেয়ে আমাদেরটায় আরও ভালো কাজ হয়, দেখবেন? ওস্তাদ, যান, একটু ফাঁকায় গিয়ে দাঁড়ান। ইদিকে কান দেবেন না। পাঁচ মিনিট পর দেখবেন বাবাজির মুখ থেকে হড়হড় করে কথা বেরোচ্ছে।
একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে টকাই বলল, যা ভালো বুঝিস কর। তবে প্রাণে মারিস না বাপু। আর দেখিস, যেন মেলা চেঁচামেচি না করে। আর্তনাদ জিনিসটা আমি সইতে পারি না।
তাই হবে ওস্তাদ।
জটাবাবা ঘ্যাসঘ্যাস করে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, ভালো কথাই তো বললুম বাপু। তবু বিশ্বেস হচ্ছে না কেন বলো তো! কিছু ভুল বলেছি বলেও তো মনে হচ্ছে না। এসময় মদনাটাই বা গেল কোথায়? এদিকে যে আমার বেজায় বিপদ। এই জন্যই তাকে পইপই করে বলেছিলুম, ওরে, এই বিটকেল ফুটবলের মতো জীবটাকে ছেড়ে দে। তা বলে কিনা, ওটা নাকি অন্য কোন গ্রহ নক্ষত্রের জীব। বেচলে মেলা টাকা পাওয়া যাবে।
টকাই বলল, এই তো কথা বেরোচ্ছে দেখছি। তা বিটকেল জীবটাকে পেলেন কোথায়?
দুখানা হাত উলটে হতাশার ভঙ্গি করে জটাবাবা বললেন, আমি কোথায় পাব? অত সুলুকসন্ধান কি জানি! তবে শুনেছি, ময়নাগড়ের রাজবাড়ির ভিতরে লুকিয়ে ছিল। মদনা তাকে উদ্ধার করে আনে।
আপনার চেলার নাম মদনা নাকি? জটাবাবা বললেন, আসল নাম জানি না বাপু। যে নামটা বলেছিল, সেটাই বলছি। তবে সে আমার চেলাটেলা নয়।
আপনাকে মারধর করল কে?
মাথা নেড়ে জটাবাবা বললেন, জানি না। কদিন যাবৎই কারা যেন ঘুরঘুর করছে আশপাশে। তাদের দেখাও যায় না, শোনাও যায় না, কিন্তু কেমন যেন টের পাওয়া যায়। খানিকটা অশরীরীর মতো। তা মদনকে কথাটা বলতেই সে বলল, আমিও টের পেয়েছি, একটু সাবধান থাকুন। তা সাবধান আর কী থাকব বাবা, অশরীরীর হাত থেকে কি আর কারও রেহাই আছে? নিশুতি রাতে শুনতে পেতাম, কারা যেন আশপাশে ঘুরছে, গাছ ঝাঁকাচ্ছে। প্রায়ই দেখতুম, সকালের দিকে হরিণছানারা এসে ঘরে ঢুকে ওই কাঠের বাক্সটার কাছে বসে আছে। মেলা রংবেরঙের প্রজাপতি এসে বসে থাকত বাক্সটার গায়ে। বাঁদরের পাল এসে নানারকম বুনো ফল বাক্সটার কাছে রেখে চলে যেত। এসব অশৈলী কাণ্ড দেখে বড় ভয় পেতুম।
তা হলে আপনি আর আপনার স্যাঙাত, দুই পাষণ্ড মিলে ওই কেষ্টর জীবের উপর অত্যাচার করতেন কেন?
বলছি বাবা, বলছি। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তিরও আমাকে করতে হবে। মদনা বলেছিল, হিজিবিজি নাকি এমন সুন্দর শিস দিতে পারে, যা শুনে স্বর্গের দেবতারাও নেমে আসতে পারে। সেই শিস শুনলে নাকি মানুষের পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে আসতে চায়। মদন নাকি একবার আড়াল থেকে সেই শিস শুনে প্রায় মূৰ্ছা গিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের কথা হল, হিজিবিজিকে ধরে আনার পর শত চেষ্টাতেও তাকে শিস দেওয়াতে পারিনি আমরা। কত আদর করে বাবা-বাছা বলেও পারিনি। শেষে আমাদের যেন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। তাই খ্যাপা রাগে অত্যাচার করে ফেলেছি। এখন নিজের উপর বড় ঘেন্না হচ্ছে বাবারা।
বাবাজির কি অনুতাপও হচ্ছে নাকি?
হচ্ছে, হচ্ছে। অনুতাপ তুষানল, দগ্ধে-দন্ধে মারে। মারধর করো, সইবে। কিন্তু অনুতাপ বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। ভিতরটা আংরা করে দেয়।
ওর নাম কি হিজিবিজি?
তা জানি না। মাঝে-মাঝে শুধু বলত, হিজিবিজি, হিজিবিজি।
তারপর কী হল বলুন। বলছি, বাবা, বলছি। আজ সকালবেলায় মদন যেন কোথায় বেরোল। একা বসে সাধনভজনের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আজ বড় গা ছমছম করছিল। কোথা থেকে একটা বোঁটকা গন্ধ আসছিল। বাইরে মাঝে-মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত হাওয়ার শব্দ হচ্ছে। শুকনো পাতার উপর পা ফেলে কারা যেন হাঁটছে। বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে কত দিন আর কত রাত কাটিয়েছি, কিন্তু আজকের মতো এরকম অস্বস্তি কখনও হয়নি। মনে হচ্ছিল, আজ একটা কিছু ঘটবে। আমাকে পাষণ্ডই ভাবো কিংবা যাই ভাবো বাপু, সাধু হওয়ার জন্যই কিন্তু সংসার ছেড়েছিলুম। শেষ অবধি সাধু হতে পারিনি, ভেক ধরে ঘুরে বেড়াই। তবু লোকটা আমি তেমন খারাপ ছিলুম না হে। একটু মনুষ্যত্ব যেন এখনও আছে। তাই আজ সন্ধেবেলায় ভাবলুম, হিজিবিজিকে এরকমভাবে আটকে রেখে বড় পাপ হচ্ছে। কিন্তু ছেড়ে দিলে যদি বাঘে খায়, কি বুনো কুকুরে ধরে, সেই ভয়ে ছাড়তেও দনোমনো হচ্ছিল। তারপর ভাবলুম, ওই বন্দিদশা থেকে তো আগে মুক্ত করি, ছাড়ার কথা পরে ভাবা যাবে। মনটা স্থির করে বাক্সের ডালা খুলে দিয়ে বললুম, বাবা হিজিবিজি, দোষঘাট ও না, তোমার প্রতি বড় অত্যাচার-অবিচার করেছি, আজ ক্ষমা করে দাও।
তারপর? হিজিবিজি কী বুঝল, কে জানে! তবে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে গুটগুট করে বেরিয়ে গেল।
সত্যি বলছেন তো?
সত্যি বলছি বাবা, মারো, কাটো যা খুশি করো, মিথ্যে বলব না। হিজিবিজি চলে যাওয়ার পর মাথাটা একটু থিতু হল। ভালো করলাম না মন্দ করলাম কে জানে। মদন হয়তো এসে আমাকে খুনই করবে। তবু যা ভালো বুঝেছি, করেছি।
তারপর কী হল?
জটাবাবা শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে চেটে মিয়ানো গলায় বললে, খুব দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। এই জঙ্গলে মাঝে-মাঝে বাঘ ঘুরে বেড়ায়, বুনো কুকুরও আছে। তাদের পাল্লায় পড়লে হিজিবিজি চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে। এই সব ভেবে সাধনভজনে মন বসাতে পারছিলাম না। হঠাৎ শুনি, বাইরে থেকে একটা অদ্ভুত সুন্দর শিসের শব্দ হচ্ছে। সে এমনই সুর, প্রাণ যেন আনচান করে ওঠে। মনে হয় যেন, স্বর্গের দেবতাদেরই বোধহয় আগমন ঘটেছে। কী বলব বাবারা, আমার চারদিকে বাতাসটাও যেন নেচে উঠেছিল সেই সুরে। পাগলের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু দরজায় থমকে দাঁড়াতে হল, যা দৃশ্য দেখলাম, জন্মেও ভুলব না।
কী দেখলেন বাবাজি?
জটাবাবার চোখ দুটো যেন হঠাৎ স্বপ্নাতুর হয়ে গেল। উধ্বদৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থাকলেন। চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়ছে। স্বলিত কণ্ঠে বললেন, যারা জন্মের তপস্যাঁতেও ও জিনিস দেখিনি, দেখলাম, হিজিবিজি দুলে-দুলে হাঁটছে। আর তার পিছনে চলেছে রাজ্যের জন্তু-জানোয়ার। দুটো হরিণ, একটা বাঘ, কয়েকটা খরগোশ, আরও কী কী যেন! পোষমানা জীবজন্তুর মতো হিজিবিজির সঙ্গে চলেছে, একটু পরে তারা অন্ধকারে মিলয়ে গেল।
তারপর কী হল বাবাজি?
ওই কাণ্ড দেখে নিজের উপর বড় ঘেন্না হল বাবা।
সাধনভজন করি, কিন্তু কই, বুনো জন্তুরা তো কখনও পোষ মানেনি আমার! তবে কি ওই হিজিবিজি আসলে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কেউ? যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তো আমার বড় অধর্ম হয়েছে! আত্মগ্লানি আর অনুশোচনায় বসে-বসে তাই চোখের জল ফেলছিলাম। এমন সময় একটা মাঝবয়সি লোক কোথা থেকে এসে উদয় হল। পাকানো চেহারা, চোখ যেন ধকধক করে জ্বলছে। ঘরে ঢুকেই হাঁক মেরে বলল, কই, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস আমার হিজিবিজিকে? আমি থতমত খেয়ে বললুম, সে নেই। চলে গিয়েছে। লোকটা এ কথায় ভারী অবাক হয়ে বলল, সর্বনাশ! কোথায় গেছে? মাথা নেড়ে বললুম, জানি না। তারপর লোকটা হঠাৎ তেড়ে এসে আমার উপর চড়াও হল। কী মার! কী মার! প্রথম কয়েকটা ঘুসো খেয়েও জ্ঞান ছিল। তারপর কিছু মনে নেই।
লোকটা কে?
তা কী করে বলব বাবা! হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা জামা আর চাঁদরের মতো কিছু ছিল। গোঁফ আছে। বাবুগোছের লোক। নয়, গতরে খেটে খাওয়া লোক। রাগের চোটে যেরকম ফুঁসছিল, তাতে আমাকে যে খুন করেনি সেটাই ভাগ্যি।
এবার যে আপনাকে গা তুলতে হবে বাবাজি। চলুন।
কোথায় যেতে হবে বাপু?
তা জানি না। তবে হিজিবিজিকে খুঁজে বের না করলেই নয়। আপনার কথা শুনে যা বুঝেছি, তাতে মনে হয়, আপনার স্যাঙাত মদনা খুব ভালো লোক নয়। হিজিবিজি যদি ফের তার খপ্পরে পড়ে, তা হলে তার কপালে দুঃখ আছে।
জটাবাবা মাথা নেড়ে বললেন, তা বটে। শুনেছি হিজিবিজিকে বিক্রি করলে সে নাকি মোটা টাকা পাবে। কয়েক লাখ।
বাবাজি, অভয় দেন তো একটা কথা কই।
বলো বাপু।
আপনাদের দুজনের কাছেই বন্দুক-পিস্তল আছে। কেন বলুন তো? বন্দুক-পিস্তলও কি সাধনভজনে লাগে?
জটাবাবার মুখোনা হঠাৎ যেন ফ্যাকাসে মেরে গেল। আমতা-আমতা করে বললেন, সে আমার জিনিস নয় বাপু। মদনার জিনিস।
আপনি বন্দুক চালাতে পারেন?
মদনাই একটুআধটু শিখিয়েছে। তবে বাপু সত্যি কথাই বলি, ওসব আমি পছন্দ করি না। আপনি কি বলতে চান, আপনি খুব ভাল মানুষ! যত দোষ ওই মদনার? যাকগে, আপনাকে আর জ্বালাতন করতে চাই না। উঠুন। নবা কম্বলটম্বর সরিয়ে বন্দুকটন্দুক যা পাস বের কর তো। থানায় জমা করতে হবে।