নিজের বাড়িতে পাঁচু
নিজের বাড়িতে পাঁচু যে ঘরটায় শোয় সেটাকে ঘর বললে বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ঘর হতে গেলে যা-যা লাগে তার অনেক কিছুই নেই। যেমন ঘরের জন্য চাই চারটে দেওয়াল বা বেড়া। তা পাঁচুর ঘরখানার বেড়া মোটে তিনটে। অন্য দিকটা হাঁ করে খোলা। বারান্দার এক কোণে দুদিক কোনওরকমে বেড়া দিয়ে ঘিরে পাঁচুর বৈঠকখানা তৈরি হয়েছে। দরজা মোটে নেই, তার দরকারও হচ্ছে না। একটা দিক উদোম খোলা। তা তাতে পাঁচুর কোনও অসুবিধেও নেই। রাতবিরেতে রাস্তার কুকুর-বেড়ালরা এসে তার নড়বড়ে তক্তপোশের তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। বর্ষাবাদলায় আর এই শীতকালটায় যা একটু অসুবিধে। তা সেসব পাঁচু গায়ে মাখে না। ওসব তার সয়ে গেছে। উদোম ঘরে থাকে বলে মাঝে-মাঝে নানা ঘটনাও দেখতে পায়। এই যে গাঁয়ের নিশি চৌকিদার ঘুমোতে-ঘুমোতে গাঁ চৌকি দিয়ে বেড়ায়, এই কি কেউ জানে? পাঁচু জানে।
তা একদিন সে নিশি চৌকিদারকে দিনের বেলায় বাজারে পাকড়াও করে বলল, ও নিশিদাদা, রাতে যখন তুমি গাঁয়ে পাহারা দাও, তখন তোমার নাক ডাকে কেন গো?
নিশি চোখ বড়-বড় করে বলল, ওরে চুপ-চুপ! কাউকে বলে ফেলিসনি যেন! অনেক সাধ্যসাধনা করে শেখা রে ভাই, লোকে টের পেলে পঞ্চায়েতে নালিশ হবে, আমার চাকরি যাবে।
কিন্তু কেউ কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটতে পারে?
আহা, কাজটা এমন শক্তই বা কী! পা দুখানাকে জাগিয়ে রেখে আমার বাকিটা ঘুমোয়। অব্যেস করলে তুইও পারবি।
এই যেমন বিষ্ণু চোর। তার স্বভাব হল কারও বাড়ি থেকে সোনাদানা, টাকাপয়সা বা গয়নাগাটি সরাবে না। তার লোভ হল খাবার জিনিস। একদিন গ্রীষ্মকালে বিষ্ণুর পিছু নিয়েছিল পাঁচু। রাত বারোটা নাগাদ বিষ্ণু উদ্ধববাবুর বাগানে বসে আস্ত একখানা পাকা কাঁঠাল, কুড়িখানা পাকা আম খেল। তারপর পশুপতিবাবুর বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে আধ হাঁড়ি পান্তা আর তেঁতুল দিয়ে রান্না চুনো মাছের ঝোল খেল। নরহরিবাবুর বাড়িতে কিছু না পেয়ে খেল আধ ডজন কাঁচা ডিম। ব্যায়ামবীর গদাধরের বাড়িতে সারারাত ধরে নীচু আঁচে এক সের মাংসের আখনি রান্না হয়, সকালে গদাধর ব্যায়ামের পর সেটা খায়, তা বিষ্ণু সেই এক হাঁড়ি আখনি চেটেপুটে খেয়ে যখন শ্রীপদদের বাড়িতে ঢুকে তাদের মিষ্টির দোকানের জন্য রাতে তৈরি করা রসগোল্লার গামলা সাবড়ে ফেলল, তখন পাঁচু আর থাকতে না পেরে সামনে গিয়ে সটান বলল, বিষ্ণুদাদা, বলি এত খাবারদাবার যাচ্ছে কোথায় বলো তো! ভগবান তো তোমাকে একটার বেশি পেট দেয়নি।
বিষ্ণু খুব অভিমান করে বলল, আমার খাওয়াটাই বেশি দেখলি রে পাঁচু! বেহান থেকে শুরু করে সুয্যি পাটে নামা অবধি আমাকে কখনও কুটোগাছটি দাঁতে কাটতে দেখেছিস? সারাদিন উপোসি পেটে পড়ে-পড়ে ঘুমোই, এই নিশুত রাতেই যা দুটি পেটে যায়। খাওয়াটা দেখলি আর উপোসটা দেখলি না?
তা আজ রাতেও পাঁচুর ঘুম আসছিল না। তার তক্তপোশের নীচে যে কেলো কুকুরটা থাকে, সেটা মাঝে মাঝে কেন যেন খ্যাক খ্যাক করে উঠছিল। থানার পেটা ঘড়িতে যখন ঢংঢং করে রাত দুটো বাজল, তখন হাই তুলে উঠে বসে রইল পচু। আজ বড্ড শীত পড়েছে, ছেঁড়া কম্বলে শীত মানছে না। ঠান্ডায় হাত-পায়ে ব্যথাও হয়েছে খুব। চারদিকে ঘন কুয়াশা, অন্ধকার। তবে পাঁচু অন্ধকার আবছায়াতেও অনেক কিছু দেখতে পায়। তার চোখ খুব ভালো। কানও সজাগ। গাছের পাতা খসলেও সে টের পায়।
ঘণ্টার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার পরই সে সামনের রাস্তায়। যেন একজোড়া খুব হালকা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা এতই ক্ষীণ যে, অন্য কেউ টেরই পাবে না। রাতে যারা ঘোরাফেরা করে তাদের পায়ের শব্দ পাঁচু খুব চেনে। কিন্তু এটা চেনা শব্দ নয়। দক্ষিণ থেকে কেউ উত্তরমুখো যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে বেশ, ধীরেসুস্থে, যেন বেড়াতে বেরিয়েছে।
পাঁচু বিছানা থেকে নেমে বারান্দা পেরিয়ে সামনের জমিটা ডিঙিয়ে রাস্তায় উঠে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। দেখল, খুব বেঁটেমতো গোলাকার চেহারার একটা কিম্ভুত কিছু দুলে-দুলে আসছে। কাছে আসতেই ভারী অবাক হয়ে গেল পাঁচু। মানুষ নাকি? এ কীরকম ধারা মানুষ?
কাছাকাছি আসতেই বস্তুটাকে দেখতে পেল পাঁচু। চোখ কচলে ফের ভালো করে তাকিয়ে দেখল, বস্তুটা মানুষের মতো নয়, আবার মানুষ বললেও ভুল হয় না। বুক, পেট, সব যেন একটা গোলাকার বলের মতো। তার উপরে বেজায় বড় একটা মুণ্ডু, দুখানা বেঁটে পা, দুখানা ছোট ছোট হাত, এরকম বেঢপ মানুষ পাঁচু কখনও দেখেনি।
হাঁটতে-হাঁটতে মানুষটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে চারদিকটা চেয়ে দেখে নিল। আর সেই সময় মুভুটা দিব্যি ডাইনে-বাঁয়ে পাক খেল। ঘাড় না থাকলেও মুণ্ডু যে এমন ঘুরতে পারে, তা
দেখলে বিশ্বাস হয় না। চারদিকটা দেখে মানুষটা হঠাৎ শিসের মতো একটা সরু শব্দ করল। ভারী মিঠে সুরেলা শব্দ। অনেকটা বাঁশির মতো। সুরটা পাঁচুর চেনা সুর নয়। কিন্তু এতই সুন্দর যে, শুনলে প্রাণ-মন ভরে যায়। অল্প একটু শুনেই পাঁচুর যেন ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল।
একটু দাঁড়িয়ে মানুষটা আবার হেলেদুলে হাঁটতে শুরু করল। আর শিস দিচ্ছে না। একটু দূর থেকে পাঁচু নিঃশব্দে লোকটার পিছু নিল। লোকটা মাঝে-মাঝে দাঁড়াচ্ছে, শিস দিচ্ছে, ফের হাঁটছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না পাঁচু। কিন্তু কে জানে কেন, লোকটাকে তার খারাপ বলেও মনে হচ্ছে না।
টকাই ওস্তাদের বৈরাগ্য এসে গেল কিনা তা বুঝতে পারছে না নবা। জটাবাবার দয়াতেই কি এসব হয়েছে? আজকাল কাজকর্মের দিকে ওস্তাদের নজরই নেই। রাত্রি দশটা বাজতে না-বাজতেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর নাক ডাকিয়ে সে কী ঘুম রে বাবা! তা এরকম চললে নবার যে হাঁড়ির হাল হবে, তা কি ওস্তাদ বুঝতে পারছে না? মুশকিল হল যে, এতকাল টকাইয়ের শাগরেদগিরি করেও তেমন মানুষ হয়ে ওঠেনি। একা-একা কাজকর্ম করতে গেলেই নানা ভজঘট্ট বেধে যায়। এই তো পরশুদিন খগেনবাবুর বাড়িতে হানা দিয়ে ভারী অবাক হয়ে দেখল, দক্ষিণ দিকের ঘরখানার জানলার পাল্লা খোলা আর গ্রিলটা ভারী নড়বড় করছে। একটু টানাটানিতেই সেই গ্রিলখানাও ঝুলে পড়ল। সুবর্ণ সুযোগ আর কাকে বলে! নবা টুক করে জানলা গলে ঘরে ঢুকে পড়ল।
ভগবান যে আছেন তা মাঝে-মাঝে বড্ড বেশি টের পাওয়া যায়। কারণ, নবা অবাক হয়ে দেখল তাকে মেহনত থেকে বাঁচাবার জন্যই যেন ছিটকিনি নেমে গেল। নবা বাটামটাও খুলে ফেলল। একটুও শব্দ হয়নি। পরিষ্কার হাতে পরিপাটি কাজটি করে ফেলতে পেরে ভারীত খুশি হল সে। হ্যাঁ, টকাই ওস্তাদের শাগরেদের যোগ্য কাজই বটে! দরজা ঠেলে সামান্য ফাঁক করে সরু হয়ে ঢুকে পড়ল সে। ঢুকেও বেশ খুশিই হল সে। ঘরে দিব্যি হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে, অন্ধকারে হাতড়ে মরার দরকার নেই। ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে কাজে হাত দিতে গিয়ে একটু চক্ষুলজ্জায় পড়ে যেতে হল নবাকে। কারণ, দেখতে পেল, নন্দবাবু মশারির ভিতরে বিছানায় বসে জুলজুল করে তার দিকেই চেয়ে আছেন।
নবা লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে নতমুখে বলল, এই একটু এসে পড়েছিলাম আরকি এদিকে!
নন্দবাবু শশব্যস্তে বলে উঠলেন, আস্তাজ্ঞে হোক, আস্তাজ্ঞে হোক। আসবেন বইকী ভাই, এ আপনার নিজের বাড়ি বলে মনে করবেন, কী সৌভাগ্য আমার! তা ভাই আপনি কে বলুন তো, কোথা থেকে আসছেন? এই শীতের রাতে ঠান্ডায় কষ্ট হয়নি তো!
ফাপরে পড়ে নবা আমতা-আমতা করে বলল, তা ঠান্ডাটা খুব পড়েছে বটে মশাই! তবে কিনা বিষয়কৰ্ম বলে। কথা! ঠান্ডা গায়ে মাখলে কি আমাদের চলে?
বটেই তো! বটেই তো! তবে মাফলার বা বাঁদুরে টুপিতে মাথাটাথা একটু ঢেকেঢুকে তো আসতে হয় ভাই! পট করে আবার ঠান্ডা না লেগে যায়। তার উপর বাইরে ওই শীতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কত কষ্ট করে শিক দিয়ে পরদা ফাঁক করতে হল, তার দিয়ে ছিটকিনি খুলতে হল, সুতো বেঁধে বাটাম নামাতে হল, তা এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল ভাই? আগে থেকে একটা খবর দিয়ে রাখলে আপনার
জন্য কি আর ওটুকু কাজ আমিই করে রাখতুম না!
নবা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, না, কষ্ট কীসের? আমরা হলুম গে মেহনতি মানুষ! খেটেই খেতে হয় কিনা।
না ভাই, ওটা কোনও কাজের কথা নয়। এই আমাদের মতো অধম লোকেরা থাকতে আপনার মতো গুণী মানুষেরা কষ্ট করবেন কেন? আপনি হলেন শিল্পী মানুষ। কী পাকা হাত আপনার! চোখ জুড়িয়ে যায়। একটুও শব্দ হল না, একটা ভুল হল না, নিখুঁতভাবে ছিটকিনি নেমে গেল, বাটাম খুলে গেল। আমি তো আগাগোড়া মুগ্ধ হয়ে দেখছিলুম। কী বলব ভাই, নিতান্ত বয়সে আপনি ছোট, নইলে আমার খুব পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে।
কথাবার্তা বেশ উচ্চগ্রামেই হচ্ছিল। নিশুত রাতে কথাবার্তার শব্দ উঁচুতে উঠলে বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। আর সেরকম লক্ষণ টেরও পাচ্ছিল নবা। এপাশ ওপাশের ঘর থেকে সাড়াশব্দ হতে লেগেছে। কে যেন বলে উঠল, ও ঘরে কাঁদের কথাবার্তা হচ্ছে?
একজন মহিলা কাকে যেন ঘুম থেকে ঠেলে তুলছেন, ও পটল, ওঠ, ওঠ, তোর বাবার ঘরে কী হচ্ছে দ্যাখ তো গিয়ে!
নবা বেগতিক বুঝে তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, তা হলে নন্দবাবু, আজ বরং আসি। আজ আপনি ব্যস্ত আছেন তো, বরং আর-একদিন আসা যাবে…!
নন্দবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, সে কী ভাই, এখনই যাবেন কী? ভালো করে আপ্যায়ন করা হল না, অভ্যর্থনা হল না, পরিচয় অবধি হয়নি, এক কাপ চা খেলেন না, সঙ্গে দুটো মুচমুচে বিস্কুট, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা হল না, এখনই কি ছাড়া যায় আপনাকে? দুঃখ দেবেন না ভাই, বরং জুত করে বসুন।
নবা শশব্যস্তে বলে উঠল, বসার জো নেই নন্দবাবু, আমার পিসির এখন-তখন অবস্থা, আজ আর চাপাচাপি করবেন না, একটা ভালো দিন দেখে বেড়াতে-বেড়াতে চলে আসবখন…
বলেই পট করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে ছুট লাগাল নবা। পিছনে অবশ্য নন্দবাবু চেঁচাচ্ছিলেন, ও ভাই, ও চোরভাই, আবার আসবেন কিন্তু ভাই, বড় দুঃখ দিয়ে গেলেন।
তা নবার এখন বেশ দুঃসময়ই যাচ্ছে। টকাই ওস্তাদ গতর না নাড়লে এমনই চলবে।
সকালবেলাতে গিয়েই সে টকাইয়ের বাড়িতে থানা গেড়ে বসল। বলল, ওস্তাদ, কাজকর্ম যে বড় ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে। আপনি গতর না নাড়লে যে রাজ্যপাট সব আনাড়ি চোরছ্যাচড়াদের হাতে চলে যাবে। কাঁচা হাতের মোটা দাগের কাজ দেখে লোকে যে ছ্যাঃ ছ্যাঃ করতে লেগেছে।
টকাই সকালের দিকে একটু সাধনভজন করে। একটু ব্যায়াম-প্রাণায়ামও করতে হয়। সেসব সেরে সবে একটু বসে জিরোচ্ছিল। নবার দিকে চেয়ে ভু কুচকে বলল, কাল রাতে কারও বাড়িতে ঢুকেছিলি বুঝি?
নবা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ঘাড়টাড় চুলকে বলল, ওই একটু ছোটখাটো কাজ, হাত মকশো করতেই গিয়েছিলাম ধরে নিন।
সুবিধে হল না বুঝি?
আজ্ঞে, ঠিক তা নয়। কাজের বেশ প্রশংসাই হয়েছে। নন্দগোপালবাবু তো খুব বাহবাই দিলেন। ফের আর-একদিন যেতেও বলেছেন।
টকাই বিস্মিত হয়ে বলে, নন্দগোপাল! হুঁ! যে চোরের আক্কেল আছে, সে কখনও নন্দগোপালের ঘরে ঢোকে?
কেন ওস্তাদ?
বিগলিত ভাব দেখে ভুলেও ভাবিসনি যে, নন্দগোপাল সোজা পাত্তর। ও হল পুলিশের আড়কাঠি। সারা গায়ের সব খবর গিয়ে থানায় জানিয়ে আসে। তোর নামধাম, নাড়িনক্ষত্র সব তার খাতায় টোকা আছে। আজই যদি পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাটকে পোরে, তা হলে অবাক হোস না।
ও বাবা! তবে কী হবে ওস্তাদ? চোরধর্ম বলে একটা কথা আছে জানিস? চোরদের অনেক রাছবিচার করে কাজে নামতে হয়। যার-তার বাড়িতে গিয়ে হামলে পড়লেই তো হল না! কার চৌকাঠ ডিঙোতে নেই, কার কাছ থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে হয়, কার ছায়া মাড়াতে নেই, সে সমস্ত শেখার জিনিস, বুঝলি?
যে আজ্ঞে। তবে আপনি এই কম বয়সেই রিটায়ার নিয়ে নেওয়ায় আমি যে বড় বিপদে পড়েছি ওস্তাদ। এখনও কত কী হাতেকলমে শেখা বাকি রয়ে গেছে। সিলেবাস তো এখনও অর্ধেকই শেষ হয়নি। কোচিং-এ বেজায় ফাঁক পড়ে যাচ্ছে যে!
রিটায়ার করেছি তোকে কে বলল? এ সব পাপ কাজে একটু অনিচ্ছে এসেছে ঠিকই, তবে অন্য দিকে কাজ বেজায় বেড়ে গেছে।
নবার চোখ চকচক করে উঠল, তা হলে কি চুরি ছেড়ে ডাকাতি ধরে ফেললেন ওস্তাদ? আহা, ডাকাতি বড় জব্বর জিনিস। আমার মনের মতো কাজ। চরিতে বড় মগজ খেলাতে হয়, হাত মশা করতে হয়, গেরস্তের হাতে হেনস্থা হওয়ারও ভয় থাকে। ডাকাতি একেবারে খোলামেলা জিনিস। বন্দুক-তলোয়ার নিয়ে জোকার দিয়ে পড়ো, চেঁছেপুঁছে নিয়ে এসো। গেরস্ত ভয়ে ঘরের কোণে বসে ইষ্টনাম জপ করবে আর হাতে-পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষে চাইবে। সে-ই। ভালো ওস্তাদ! পাকা চোর হওয়ার অনেক মেহনত, অনেক হ্যাপা। ডাকাতি একেবারে জলের মতো সোজা কাজ।
ওরে মুখ, ডাকাতির নামে নাল গড়াচ্ছে! বলি, আর্ষ কাকে বলে জানি?
আজ্ঞে না ওস্তাদ!
আর্ষ মানে হল ঋষির দেওয়া নিদান। প্রত্যেক বংশেরই আদিতে একজন করে মুনি বা ঋষি থাকেন। আর্য হল সেই ঋষির দেওয়া বিবিধ ব্যবস্থা। এই যে পাঁচকড়িবাবুর বাড়িতে কাসুন্দি তৈরি নিষেধ, ওই যে উদ্ধববাবুর বাড়িতে শোল বা বোয়াল মাছ ঢোকে না, এই যে ভজহরিবাবুদের বংশে দুর্গাপুজো হয় না, সে কেন জানিস? আর্য নেই বলে। ওদের মুনি-ঋষিরা ওসব নিষেধ করে গেছেন।
নবা একটু ভাবিত হয়ে বলল, তাই বটে ওস্তাদ। আমার বাড়িতে কেউ কখনও পুব দিকে রওনা হত না। পুব দিকে যেতে হলে আগে পশ্চিম দিকে রওনা হয়ে তারপর ঘুরপুথে পুব দিকে যেত। আমরা পুব দিকে গেলে নাকি ঘোর অমঙ্গল। তা অমি যেমন ভুলে মেরে দিয়েছি বলেই কি আমার কিছু হচ্ছে না ওস্তাদ?
ওই তো বললুম, ঋষিবাক্য লঙঘন করা মহা পাপ। আমারও ডাকাতির আর্ষ নেই, বুঝলি? চুরি পর্যন্ত অ্যালাউ, কিন্তু ডাকাতি কখনও নয়।
এইবার জলের মতো বুঝেছি। আর-একটু বুঝলেই অন্ধকারটা কেটে যায়।
আর কী বুঝতে চাস?
ওই যে চুরি ছেড়ে আর-একটা কী যেন করার কথা ভাবছেন?
টকাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বড়ই গুহ্য কথা রে। তোকে বলা কি ঠিক হবে?
নবা করুণ গলায় বলল, না বললে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ধড়ফড় করে মরে যাব ওস্তাদ। গুহ্য কথা না শুনলে যে বড় মুহ্যমান অবস্থা হয় আমার।
তা হলে বলছি শোন। ওই জটাবাবা লোকটা সাধুফাদু কিছু নয়। ওই হিজিবিজি ছেলেটাও জালি। প্রথম দিন দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ওদের অন্য কোনও মতলব অছে। জটাবাবার বেদিটা তো দেখেছিলি। তোর অবশ্য দেখার চোখ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, চট আর কম্বলে ঢাকা বেদিটা আসলে একটা বড়সড় কাঠের বাক্স। তোর যেমন দেখার চোখ নেই, তেমনই শোনারও কান নেই। থাকলে টের পেতিস, ওই ঘরখানায় ওই দুজন ছাড়া তৃতীয় আর-একজন কেউ ছিল। আমি তার শ্বাসের শব্দ পেয়েছি। তোকে বলেছিলাম সেই কথা। আমি তিন-চারদিন করে নিশুতি রাতে গিয়ে জটাবাবার আস্তানায় নজর রেখেছি। কী দেখেছি জানিস?
নবা বড়-বড় চোখ করে শুনছিল, বলল, কী ওস্তাদ?
নিশুতি রাতে ওরা ঢাকনা সরিয়ে কাঠের বাক্সটা থেকে একটা অদ্ভুত জীবকে বের করে। মানুষ বলে মনে হয় না, কিন্তু দেখতে আবার খানিকটা মানুষের মতোই। খুব বেঁটে, পেট আর বুক মিলিয়ে অনেকটা বলের মতো গোলাকার, মাথাটাও গোল। তবে নাক, মুখ, চোখ, সবই আছে। মনে হয় আজব জীবটাকে ওরা সারাদিন কড়া ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, রাত্তিরবেলা জাগায়। কিন্তু ওষুধের জন্য কিম্ভুত জীবটার ঘুম ভাঙতেই চায় না। তাই তাকে ওরা গরম লোহার শিক দিয়ে ছ্যাকা দেয়, থাপ্পড় মারে, নানা অত্যাচার করে।
এ তো খুব অন্যায় কথা ওস্তাদ! দেশটা যে অরাজকতায় ভরে গেল!
এখন মুখ বন্ধ রেখে শোন। ওই বেঁটে মানুষটা কথাটথা কয় কিনা আমি সেটা মন দিয়ে শুনবার চেষ্টা করেছি। মাঝে-মাঝে একটুআধটু কথাও বলে বটে, তবে অস্পষ্ট সব শব্দ। অং, বং, ফুস গোছের কিছু আওয়াজ। সেসব কথা ওই জটাবাবা আর তার চেলাও বুঝতে পারে না। তবে বেঁটে লোকটা মাঝে-মাঝে শিস দেওয়ার মতো ভারী সুন্দর সুরেলা শব্দ করতে পারে। এত সুন্দর শব্দ আমি জীবনে শুনিনি। প্রাণটা যেন ভরে যায়। রাত্তিরে বেঁটে লোকটাকে ওরা খেতেও দেয়। শুধু ফল ছাড়া সে অবস্য কিছুই খায়
। ফল বলতে শুধু আপেল, আঙুর নয়, তার সঙ্গে বটফল, নাটাফল, এসবও খায়। বেঁটে লোকটাকে ওরা কোথা থেকে ধরে এনেছে আর কী করতে চায়, সেটা রোজ হানা দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না। তবে লুকোছাপার বহর দেখে অনুমান করছি, ওদের মতলব ভাল নয়। তাই ভাবছি, আজ রাতে ওদের হাত থেকে ওই বেঁটে লোকটাকে উদ্ধার করব।
নবা মহা উৎসাহে বলে উঠল, তা হলে দলবল জোটাই ওস্তাদ? লাঠিসোঁটাও বের করি!
দূর বোকা! জটাবাবা আর তার চেলার অস্তর কিছু নেই? একদিন জটাবাবাকে দেখলাম, ঝোলা থেকে একটা ছোটখাটো বন্দুক গোছের জিনিস বের করে গুলির ফিতে পরাচ্ছে। হামলা করতে গেলে আঁঝরা করে দেবে। সব ব্যাপারেই মোটা দাগের কাজে ঝোঁক কেন তোর? মাথা খাটাতে পারিস না? মনে রাখবি, সব সময়েই গা-জোয়ারির চেয়ে বুদ্ধি খাঁটিয়ে কৌশলে কাজ উদ্ধার করাই ভালো।
তা হলে কী করতে হবে ওস্তাদ?
লক্ষ করেছি, জটাবাবা আর তার চেলা দুজনে সারাদিন পালা করে ঘুমোয়। একজন ঘুমোলে অন্যজন পাহারায় থাকে। দুজনের কেউ ঘর ফাঁকা রেখে যায় না। আর-একটা কথা হল, গেরস্তদের ফাঁকি দিয়ে বোকা বানানো যত সোজা, শয়তান লোকদের ঠকানো তত সোজা নয়। তার উপর এরা হল পাষণ্ড, খুনখারাপি করতে পেছপা হবে না। ভাবছি, আজ রাতে এমন একটা কাণ্ড করতে হবে, যাতে দুজনেই তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর..
নবা ডগমগ হয়ে বলে, সে তো খুব সোজা। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলেই তো হয়।
দূর আহাম্মক! আগুন দিলে ওই জতুগৃহ চোখের পলকে ছাই হয়ে যাবে। তিনজনের কেউ বাঁচবে না। মনে রাখিস, আমরা চোর হলেও খুনি নই কিন্তু! ওসব পাপ চিন্তা করবি তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেব।
আজ্ঞে, ভুল হয়ে গেছে ওস্তাদ! আর এ কথা মনেও আনব না। তা মতলবটা কী ভঁজলেন?
ভাবছি, ইদানীং ময়নাগড়ে খুব বাঘের উৎপাত হয়েছে। আমাদের দুর্গাপদ চমৎকার বাঘের ডাক নকল করতে পারে। তাকে দিয়ে কাজ হাসিল হয় কিনা!
আজ্ঞে, খুব হয়। আমি চললুম দুর্গাপদকে খবর দিতে।
ওরে, অত উতলা হোসনি। ওরা জঙ্গলে থাকে, বাঘের ডাক কিছু কম শোনেনি। তবে শুধু বাঘের গর্জন নয়, সেইসঙ্গে মানুষের আর্তনাদ মিশিয়ে দিলে কাজ হতে পারে। ভাবটা এমন হতে হবে, যাতে মনে হয়, কোনও লোককে বাঘে ধরেছে। তাতে ওরা একটু চমকাবে। নিশুত রাতে উত্তরের জঙ্গলে মানুষের গতিবিধি তো স্বাভাবিক নয়। ওরা ধরে নেবে যে, নিশ্চয়ই ওদের উপর চড়াও হতে এসে বাঘের খপ্পরে পড়ে গেছে। সরেজমিনে দেখার জন্য ওরা অস্তর নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, বুঝেছিস?
হেঃ হেঃ, একেবারে জলের মতো। চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতেও পাচ্ছি ওস্তাদ। ওই তো জটাবাবা বেরিয়ে এল, হাতে মেশিনগান, চোখ দুখানা ধকধক করছে, আর ওই যে পিছনে হিজিবিজি, তারও হাতে পিস্তল। জটাবাবা হাঁক মারল, কে রে? কার এত বুকের পাটা যে সিংহের গুহায় ঢুকেছিস…?
.
টকাই হেসে বলল, আর তোকে যাত্রার পার্ট করতে হবে না। মাথা ঠান্ডা কর। বরং বাঘে ধরলে মানুষ যে
প্রাণভয়ে চেঁচায়, সেটা একটু প্র্যাকটিস কর। আজ রাতে তোকে দিয়েই ওই পার্টটা করাব বলে ভাবছি। পারবি না?
খুব পারব ওস্তাদ। ওই তো বোশেখ মাসে হাবু দাসের উঠোনে মাঝরাত্তিরে চুরি করতে ঢুকে আমার পায়ের উপর দিয়ে একটা হেলে সাপ বেয়ে গিয়েছিল। কী চেঁচানটাই না চেঁচিয়েছিলাম বাপ! গাঁ-সুন্ধু লোক আঁতকে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল।
হ্যাঁ, ওইরকম চেঁচানো চাই। যা, দুর্গাপদকে খবর দিয়ে বাড়ি গিয়ে প্র্যাকটিস কর। সন্ধের মুখে তৈরি হয়ে চলে আসিস।
নবা এতদিন পর মনের মতো কাজ পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে মালোপাড়ায় গিয়ে দুর্গাপদকে খবর দিয়ে বাড়িতে ফিরে মা কালীকে বেজায় ভক্তিভরে পেন্নাম ঠুকল। ওস্তাদ টকাইকে যে ফের চাঙা করা গেছে, এটাই মস্ত লাভ।
সারাদিন নবা বাড়ির পাশের মাঠটায় বসে চেঁচানি প্র্যাকটিস করতে লাগল। কিন্তু ফল যা দাঁড়াল তা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়। তার বাঁচাও বাঁচাও, মেরে ফেললে, খেয়ে ফেললে। চিৎকার শুনে লোকজন সব লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসতে লাগল। কিন্তু এসে কেউ কিছু বুঝতে পারল
উদ্ধববাবু বললেন, বলি ওরে নবা, তোর চেঁচানি শুনে তো মনে হচ্ছে তোকে বাঘেই ধরেছে। কিন্তু বাঘটা গেল কোথায়? বাঘ তোকে খেল, না তুই-ই বাঘটাকে খেয়ে ফেললি বাপ?
ভজহরিবাবু বললেন, রিখটার স্কেলে এই চেঁচানির মাপ হল সাড়ে ছয়। এরকম চেঁচালে বাঘ-সিংহের আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার কথা।
শিবেন গম্ভীরভাবে বলল, শব্দের মাপ রিখটার স্কেল দিয়ে হয়না ভজহরিবাবু। ওটা হল ডেসিবেল।
গদাধর মাল ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বলল, আরে বাঘফাঘ নয়, নবা ভূত দেখেছে। আজকাল এ গাঁয়ে বেশ ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে দেখছি।
ভজহরিবাবু প্রতিবাদ করে বললেন, কক্ষনো নয়। নবা মেরে ফেললে, খেয়ে ফেললে বলে চেঁচাচ্ছে। সায়েন্সে স্পষ্ট করে বলা আছে, ভূত কখনও মানুষ খায় না। ভূতের খাদ্য হল অক্সিজেন, হাইড্রোজেন আর নাইট্রোজেন।
গদাধর রোষকষায়িত লোচনে ভজহরির দিকে চেয়ে বলল, ভূতের মেনু আপনি কিছুই জানেন না। প্রায় রাতেই আমার মাংসের আখনি আজকাল ভূতে চেটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, তারা হাড়টাড় চিবোতে পারে না বলে সেগুলো ফেলে যায়।
নবার বুড়ি মা এসে তাড়াতাড়ি ছেলেকে দু-হাতে আগলে ধরে বলল, ওগো, তোমরা ওসব অলক্ষুনে কথা বোলো না তো! বাছা আমার এমনিতেই ভিতুর ডিম। বাঘটাঘ নয় বাবারা, আমি জানি, নবাকে নিশ্চয়ই ভেঁয়োপিঁপড়ে কামড়েছে। বরাবর পিঁপড়ের কামড় খেয়ে ওই রকম করে চেঁচায়। নরম শরীর তো ব্যথা-বেদনা মোটেই সইতে পারে না।
মায়ের হাত ধরে নবা বাড়ি ফিরল বটে, কিন্তু সারা সকাল ঘণ্টাদুয়েক টানা চেঁচানোর ফলে বিকেলের দিকটায় টের পেল, গলাটা ফেঁসে গিয়ে কেমন যেন ভাঙা আওয়াজ বেরোচ্ছে। সর্বনাশ আর কাকে বলে! টকাই ওস্তাদ এই গলা শুনলে কি আর পার্টটা তাকে দেবে? যথারীতি সন্ধেবেলা কালীকে পেন্নাম ঠুকে বেরিয়ে পড়ল নবা। টকাইয়ের বাড়িতে দুর্গাপদও এসে জুটে গেছে। তিনজনে মিলে ঠিক কী করতে হবে তা ভালো করে বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
উত্তরের জঙ্গল-রাস্তা বড় কম নয়। ঠান্ডাটাও আজ যেন জোর পেয়েছে। উত্তুরে হাওয়া দিচ্ছে জোর। রাত আটটার মধ্যেই গা একেবারে নিঃঝুম। শীতের চোটে আর বাঘের ভয়ে রাস্তাঘাট শুনশান। তিনজনে পা চালিয়ে হেঁটে রাত নটার মধ্যেই উত্তরের জঙ্গলে পৌঁছে গেল। জ্যোৎস্না রাত নয়, তবে অন্ধকারেই তাদের চলাফেরার অভ্যাস বলে অসুবিধে হল না। জটাবাবার কুটিরের কাছাকাছি একটা ঝুপসি বটগাছ। তার আড়াল থেকে তারা জটাবাবার কুটিরে পিদিমের মিটমিটে আলোর আভাস দেখতে পেল।
টকাই দুর্গাপদকে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, দুর্গা, এইবার।
দুর্গাপদ মুখের কাছে দুই হাতের পাত ঠোঙা করে ধরে যে বাঘের ডাকটা ছাড়ল তা শুনলে বাঘ পর্যন্ত অবাক হয়ে যায়। কী গম্ভীর গর্জন রে বাবা। আকাশ বাতাস যেন প্রকম্পিত হয়ে গেল। টকাই নবাকে খোঁচা দিয়ে বলল, এবার তুই।
তা নবার পার্টও কিছু খারাপ হল না। দিব্যি বাঘের ধরা মানুষের মতো সে গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাতে লাগল, বাপ রে, মা রে, খেয়ে ফেলল, মেরে ফেলল…! সেইসঙ্গে মুহুর্মুহু দুর্গার বাঘের ডাক।
বিস্তর বাঘ গর্জন আর মর্মন্তুদ আর্তনাদ করার পরও জটাবাবার কুটির থেকে কেউ উঁকি মারল না দেখে নবা মাথা চুলকে বলল, কী হল বলো তো ওস্তাদ! পার্টে কি কোনও ভুল হল?
দুর্গাপদ কাঁপা গলায় বলল, না রে, ভুল হয়নি। ওই যে…
দুর্গাপদ যেদিকে আঙুল তুলে দেখাল, সেদিকে চেয়ে নবা এবার পার্ট ভুলে সত্যিকারের প্রাণভয়ে চেঁচাতে লাগল, ওরে বাপ রে, মেরে ফেলল রে, খেয়ে ফেলল রে…
বাঘটা অবশ্য মোটেই উত্তেজিত হল না, তেমন ঘাবড়ালও না। জুলজুলে চোখে তাদের দিকে একটু চেয়ে থেকে, বোধ হয় দুর্গাপদকে মনে-মনে শাবাশ জানিয়ে একটা হাই তুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
বাঘ চলে যাওয়ার পরও অবশ্য নবা চেঁচিয়েই যাচ্ছিল। টকাই একটা ধমক দিয়ে বলল, দ্যাখ নবা, বাঘেরও ঘেন্নাপিত্তি আছে। ওরা বেছেগুছেই খায়। তোর ঘাড় মটকালে কি ও ওর জাতভাইদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে?
নবা ধমক খেয়ে চুপ করল বটে, কিন্তু তার দাঁতে-ঘাতে ঠকঠকানিটা থামছিল না। সে কেঁপে-কেঁপে বলল, কিন্তু এ যে সত্যিকারের বাঘ ওস্তাদ!
তাতেই প্রমাণ হয় যে, তোরা দুজনেই পার্ট খুব ভাল করেছিস। কিন্তু পার্ট তো আর বাঘের জন্য করা নয়, জটাবাবা আর তার শাগরেদের জন্য করা। তা সেখানে এত চেঁচামেচিতেও কোনও হেলদোল নেই যে!
নবা মিয়োনো গলায় বলল, হয় বাঘের ডাক শুনে ভয়ে মূর্ছা গিয়েছেন, নয়তো বন্দুক বাগিয়ে আমাদের জন্য ওত পেতে আছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, নবার কথাই সত্যি। জটাবাবা ঘরের একধারে অজ্ঞান হয়ে চিতপটাং পড়ে আছেন। তবে ভয়ে নয়, তার মুখে-চোয়ালে-নাকে রক্ত আর কালশিটে। কে বা কারা বেধড়ক মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে গিয়েছে। কাঠের বাক্সটার ডালা খোলা, তার ভিতের সেই বেঁটে লোকটাও নেই। আর হিজিবিজিও নেই।
নবা চাপা গলায় বলল, ওস্তাদ, যারা এ লোকটাকে এরকম মেরেছে, তাদের গায়ে বোধ হয় খুব জোর, কী বলেন?
তাই তো মনে হচ্ছে।
তা হলে কি আমাদের এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে? তারা যদি হঠাৎ করে ফিরে আসে, তা হলে আমাদের দেখে হয়তো খুব রাগ করবে।
তা তো করতেই পারে।
তা হলে আমাদের আর এখানে সময় নষ্ট করার দরকারটা কী? মা আজ কই মাছের পাতুরি করেছে। পইপই করে বলে দিয়েছে যেমন তাড়াতাড়ি ফিরি।
টকাই অন্যমনস্কভাবে কী যেন ভাবতে-ভাবতে বলল, তা যাবি তো যা না। তবে কিনা তাদের সঙ্গে তো তোর পথেও দেখা হয়ে যেতে পারে! সেটা কি ভালো হবে রে নবা?
নবা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, মা অবশ্য বলেছে, জরুরি কাজ থাকলে একটু দেরি হলেও ক্ষতি নেই।