রাত্রে ডরোথিকে খাবার পৌঁছে দিয়ে
রাত্রে ডরোথিকে খাবার পৌঁছে দিয়ে অর্জুন পোস্ট অফিসের মোড়ে এসে দাঁড়াল। জলপাইগুড়ি শহরে রাত আটটার পর রাস্তায় মানুষ কমে যায়। কিন্তু এই মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করার অভ্যেস অনেকের আছে। অর্জুন পরিচিত মুখ খুঁজল, পেল না। ঠিক তখনই সে গাড়িটাকে দেখতে পেল। সাধারণ গতিতেই রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছে। সামনের আসনে ড্রাইভারের পাশে একটা লোক বসে আছে। এই গাড়িটাকে সে গতকাল দেখেছে বেশ বেপরোয়া গতিতে চালাতে। গত রাতের অপরাধের জন্যে এখন গিয়ে কিছু বলা যায় না।
মোড়ের দোকান থেকে সে এক গ্লাস চা নিল। ডরোথি আসার পর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য জানা ছাড়া কোনও উত্তেজক ঘটনা ঘটেনি। বরং বলা যেতে পারে বেশ একঘেঁয়ে লাগছে। ডরোথি যাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে তাদের আত্মীয়রা ওকে গালাগাল দিতে পারত, এই নিয়ে শহরে টেনশন বাড়তে পারত, কিন্তু কিছুই হয়নি। অনেকখানি সময় চলে গেলে মানুষ আর উত্তেজিত হয় না। মিরজাফর বিশ্বাসঘাতক ছিলেন কি না তা নিয়ে এখন মানুষ মাথা ঘামায় না। যারা ঘামাতে চায়, তাদের সংখ্যা খুব কম।
কমলাকান্ত রায় অথবা দেবদাস মিত্রের পর্ব চুকে গেছে। শেষতম ব্যক্তি তারিণী সেনকে আজ পাওয়া গেল। আগামিকাল বিকেলে ওর সঙ্গে কথা বলে ডরোথি ফিরে যাবে। ফেরার টিকিট তাহলে কাল সকালে করে ফেলা উচিত। সে তারিণী সেনের ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবল। তারিণী ছিল কুখ্যাত ডাকাত। টাটুতে চেপে ডাকাতি করত। ওর ভয়ে সবাই কাঁপত। শেষ পর্যন্ত তারিণী এক সময় ধরা পড়ল। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে বিচার হল না, ছাড়া পেয়ে গেল। শহর থেকে ফিরে গিয়ে তারিণী ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছিল। এই সময় সে বিপ্লবীদের কথা ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দিত। কোন ইংরেজের কাছে? ডায়েরি যদি সত্যি হয় তা হলে রিচার্ড অথবা ম্যাক সাহেবের সঙ্গেই তারিণীর যোগাযোগ ছিল। সেই জন্য লোকটার হাত বিপ্লবীরা কেটে নিতে পারে। প্রশ্ন হল, যারা হাত কেটেছিল তাদের নাম কি তারিনী ম্যাকসাহেবকে বলেছিল? বললে তিনি যদি কোনও অ্যাকশন নিতেন তা হলে সেটা বিমল হোড় মশাই অথবা সুধীরবাবু নিশ্চয়ই বলতেন। ম্যাক সাহেব নিশ্চয়ই কোন অ্যাকশন নেননি। দেশে ফিরে গিয়ে বৃদ্ধ বয়সে তাঁর এই কারণে অনুশোচনা হতেই পারে, যা ডায়েরিতে লিখে গেছেন তিনি। কিন্তু খটকা লাগছে অন্য জায়গায়। তারিণী সেন জলপাইগুড়িতে এসে ম্যাক সাহেবের সঙ্গে দেখা করত কি না তা জানা যায়নি। কিন্তু ম্যাকসাহেব প্রায়ই নদী পেরিয়ে ওদিকে যেতেন। কমলাকান্ত রায় অথবা দেবদাস মিত্রকে আহত অবস্থায় নদীর ওপারেই পাওয়া গিয়েছে। নিশ্চয়ই তখন তাঁর সঙ্গে তারিণীর দেখা হত। কী কথা হত? তারিণী যে ডাকাতি করত, তা রবিনহুডের মতো খরচ করে উড়িয়ে দেয়নি। সেই সব সম্পদ কোথায় গেল? অর্জুনের মনে হল তারিণী সেনের সঙ্গে কথা বললে অনেক গোপন তথ্য জানা যাবে। যেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। অবশ্য মনে হওয়ার পেছনে ছুটে কোনও লাভ নেই।
চায়ের দাম মিটিয়ে বাইকে উঠতেই অর্জুন গাড়িটাকে দেখতে পেল। কালো রঙের অ্যাম্বাসাডারটা। গাড়িটা মোড় ঘুরে হাকিমপাড়ার দিকে চলল। গাড়িটা ফাঁকা রাস্তায় বেশ জোরেই যাচ্ছিল। অর্জুনের মনে হল ড্রাইভার ছাড়া আরও দুজন আরোহী রয়েছে গাড়িতে। অথচ একটু আগে একজন কম ছিল। তৃতীয়জন বসে আছে পেছনের আসনে। এই গাড়ির যাত্রীদের কেউ তিস্তা ভবনে থাকে। এত রাত্রে ওরা কোথায় যাচ্ছে? ওদের সম্পর্কে একটু খোঁজ নেওয়া দরকার। ডরোথি তিস্তা ভবনে একা রয়েছে। ওর কোনও বিপদ হলে সে দায়ী হবে। অমলদা তাকে চিঠি লিখেছেন ডরোথির দায়িত্ব দিয়ে। সে মিনিট দেড়েকের মধ্যে তিস্য ভবনে পৌঁছে গেল। গেট খোলা। ভেতরে ঢুকে বাইক বন্ধ করে নেমে দাঁড়াল সে। চৌকিদারটা কোথায়? সে ওপরে উঠল। দোতলায় আলো জ্বলছে। ডরোথির ঘরের সামনে পৌঁছে সে হকচকিয়ে গেল। দরজায় তালা দেওয়া।
সে এপাশ-ওপাশে তাকাল। দরজায় তালা দিয়ে কাছাকাছি গেলে ওঠার সময় দেখা যেত। এত রাত্রে কোথায় গেল মেয়েটা! হঠাৎ কালো গাড়ির তৃতীয় আরোহীর ঝাপসা মূর্তি স্মরণে এল। ডরোথি কি? ওই কালো গাড়িতে সে কেন যাবে? এমন হতে পারে, বা এখানে আছে তাদের সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছে এবং অনুরোধ ফেরাতে না পেরে এখন বেড়াতে বেরিয়েছে। অজানা জায়গায় ডরোথি নিজের ওপর যতই আস্থা রাখুক এভাবে যাওয়া যে ঠিক নয়, এটা তার বোঝা উচিত।
অর্জুন নীচে নেমে চৌকিদারকে দেখতে পেল। লোকটা বালিশ বগলে নিয়ে আসছে। এই তিস্তা ভবনের একজন কেয়ারটেকার আছেন। কাল ওঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে। যে-কোনও মানুষ যদি একটুও বাধা না পেয়ে ওপরে উঠে যায়, তা হলে তো মুশকিল!
অর্জুন চৌকিদারকে বলল, মেমসাহেবকে দেখেছ?
হ্যাঁ। একটু আগে গাড়িতে করে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গের বাঙালিবাবু বললেন যে ফিরতে একটু রাত হবে।
সঙ্গে যারা গেল তারা কি এখানেই উঠেছে?
না, বাবু। কাল বিকেলে ওঁরা এসেছিলেন। রাত্রেও একবার। আবার আজ আপনি খাবার দিয়ে চলে যাওয়ার পর গাড়ি নিয়ে আসেন।
কোথায় গেল ওরা, কিছু শুনলে?
ইংরেজিতে কথা বলছিল, তাই বুঝতে পারিনি।
অর্জুনের চোয়াল শক্ত হল। এই লোক দুটো কে? সুধীর মৈত্রের বাড়িতে রাতদুপুরে যারা হামলা করেছিল তারাই মনে হচ্ছে। ডরোথির সঙ্গে এদের কী করে যোগাযোগ হল? ডরোথিকে সে সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিয়ে জলপাইগুড়িতে এসেছে। সেখানে কারও সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখেনি সে। তা হলে গতকাল থেকে লোক দুটো এখানে এসে যোগাযোগ করছে কী করে?
অর্জুন বাইকে উঠল। ডরোথিকে সুধীর মৈত্রের নাম-ঠিকানা বলে আসার রই গত রাত্রে লোক দুটো পাহাড়ি পাড়ায় পৌঁছেছিল। অর্থাৎ ডরোথিই ওদের সন্ধান দিয়েছে। নিজেকে কী রকম প্রতারিত বলে মনে হচ্ছে এখানে। মনে হচ্ছে কলকাতা থেকেই ডরোথির সঙ্গে ওদের যোগাযোগ। ডরোথি যে তিনজনের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে। সত্যি কি ক্ষমা চাইতে এসেছে? তা হলে পেছনে দুজন গোপন সঙ্গী নিয়ে আসবে কেন? তাকে দিয়ে মানুষজনের সন্ধান করিয়ে ও কোন কাজ হাসিল করতে চায়? মেয়েটার মুখ মনে পড়ল। একবারের জন্য মনে হয়নি ওর গোপন কোনও মতলব আছে। তা ছাড়া ওকে পাঠিয়েছেন অমলদা। ওর সম্পর্কে কিছু না জেনে অমলদা কি অর্জুনের কাছে পাঠাবেন? তার এখন কী করা উচিত?
বাইকে চেপে শহরে চলে এল সে। দরজায় তালা দেওয়া রয়েছে। ঘরে ঢুকে যদি ডরোথির জিনিসপত্র, বিশেষ করে ওই নোটবুক দেখা যেত, তা হলে কিছুটা সুবিধে হত। হঠাৎ ওর মনে হল ওরা তারিণী সেনের কাছে যাচ্ছে না তো? এত রাত্রে গ্রামে গাড়ি ঢুকলে মানুষ অন্য রকম আচরণ করতে পারে। ডাক্তার বলেছেন আজ তারিণী সেনের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ডরোথি কি কথাটাকে বিশ্বাস করেনি? ওরা কী এমন কথা আলাদা করে বলতে চায়, যা কাল অর্জুনের সঙ্গে গিয়ে ডরোথি বলতে পারত না? অর্জুনের মনে হল তারিণী সেনের বিপদও হতে পারে। শুধু ক্ষমা চাইতে এত রাত্রে এভাবে গোপনে কেউ অত দূরে যেতে পারে না। তারিণীকে বাঁচানো দরকার।
অর্জুন ঘড়ি দেখল। ওরা এতক্ষণে দোমহনি ছাড়িয়ে গেছে। বাইক চালিয়ে ওদের ধরা যাবে না। সে দ্রুত জলপাইগুড়ি থানায় চলে এল। থানার ও সি অবনীবাবু নিজের টেবিলে বসে কাজ করছিলেন এত রাত্রেও। অর্জুনকে দেখে বললেন, আবার কিসে জড়ালেন?
অর্জুন বলল, একটা উপকার করতে হবে। ময়নাগুড়ি থানায় ফোন করে বলুন একটা কালো অ্যাম্বাসাডার হুচলুডাঙা হয়ে পূর্বদহে যাচ্ছে। যে করেই হোক ওদের আটকাতে হবে। প্লিজ।
অবনীবাবু অবাক হলেন, ওদের অপরাধ?
আপনাকে সব বলব। শুনতে গেলে যে-সময় লাগবে, তা আমাদের হাতে নেই।
কিন্তু আটকাতে গেলে তো কারণ দেখাতে হবে।
অর্জুন অসহায় চোখে তাকাল। তারপর বলল, ধরুন, পূর্বদহের কোনও মন্দির থেকে প্রাচীন মূর্তি চুরি গেছে। তাই রাত্রে কাউকে ওদিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
সত্যি চুরি গেছে নাকি?
না। তবে তার চেয়ে ভয়ানক কিছু হতে পারে।
অবনীবাবু টেলিফোনের রিসিভার তুললেন, দেখবেন মশাই, যেন বিপদে না পড়ি। তবে আপনার ওপর আমার আস্থা আছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ময়নাগুড়ির লাইন পাওয়া গেল। অবনীবাবু অর্জুনের অনুরোধ জানালেন। ওপার থেকে পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন গাড়িটাকে আটক করা হবে কি না! অর্জুন মাথা নাড়তে অবনী সেইরকম জানিয়ে দিলেন।
অবনীবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, খবর কী? কদিন থেকে একটি বিদেশিনী মহিলাকে নিয়ে ঘুরছেন বলে শুনতে পেলাম।
ভুল শোনেননি। তাকে নিয়েই এই বিভ্রাট।
অর্জুন ধীরে, ধীরে সব ঘটনা অবনীবাবুকে খুলে বলল। অবনীবাবু মন দিয়ে শুনে বললেন, না, মশাই। একটি ব্রিটিশ মেয়ে তার পূর্বপুরুষের করা অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা চাইতে এতদূরে একা চলে আসবে, একথা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।
ঠিকই। কিন্তু কিছু বিদেশিনী -হিলা তো একসময় আমাদেরই মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। এই যেমন এখন মাদার টেরেসা। তাঁকে তো আমরা মা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি।
অবনীবাবু মাথা নাড়লেন, উনি মহামানবী। যেমন সিস্টার নিবেদিতা। কিন্তু সাধারণ বিদেশিনীদের সম্পর্কে অতটা ভাবার কোনও দরকার নেই, যতক্ষণ
প্রমাণ পাচ্ছেন। যাকগে, আপনার কি মনে হয় উনি তারিণী সেনের জন্যেই এসেছেন?
এখন তাই মনে হচ্ছে। কমলাকান্ত রায় অথবা দেবদাস মিত্র ওঁর লক্ষ্য নয়। ওঁদের নাম উনি হয়তো দাদুর ডায়েরিতে পেয়েছিলেন, ওই পর্যন্ত।
তা হলে তারিণী সেনের ওপর সিনেমা করতে কেউ আসেনি?
আমি বিশ্বাস করছি না।
ওই লোক দুটোর সঙ্গে ডরোথির যোগাযোগ হল কী করে?
তা জানি না।
ডরোথির পাসপোর্ট আপনি দেখেছেন?
না। দেখার কথাও নয়।
তা হলে ওই দুজনের সঙ্গে এত রাত্রে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া এবং তা আপনাকে না বলে—শুধু একারণেই আপনার সন্দেহ হচ্ছে?
না। ওরা গতকালও ডরোথির সঙ্গে দুবার যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু সে একথা আমাকে জানায়নি। ডরোথির কাছ থেকে খবর পেয়েই ওরা সুধীরবাবুর বাড়িতে গিয়েছিল। অত রাত্রে যারা সুধীরবাবুর বাড়িতে যেতে পারে, তারা তারিণী সেনকে তুলে নিয়ে আসতে দ্বিধা করবে না, যদি তেমন প্রয়োজন থাকে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। অবনীবাবু রিসিভার তুলে কথা শুনতে-শুনতে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, ওদের কোনও অজুহাত দেখিয়ে আধ ঘণ্টা আটকে রেখে তবে ছাড়ুন। দেখবেন যেন কোনও মতে সন্দেহ না করে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, ময়নাগুড়ি থানা থেকে একটা পেট্রোল ভ্যানকে ওয়ারলেসে খবর দিয়েছিল। ওরা গাড়িটাকে আটকেছে। হাইওয়েতে জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার পুলিশের আছে। ওরা তিনজনেই ওখানে আধ ঘণ্টার মতো থাকবে। তারপর ফিরে আসতেও মিনিট কুড়ি। তার মানে আমাদের হাতে পঞ্চাশ মিনিট। চলুন, একবার ডরোথির ঘরটা দেখে আসি। চটপট। অবনীবাবু উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু ওর ঘরে তালা মারা। অর্জুন বলল, ল্যাংড়া পাঁচুকে পেলে হত।
অবনীবাবু বললেন, একটা চান্স নেওয়া যেতে পারে। হাসপাতালের উলটো দিকের গলিতে ও নেশা করতে আসে। অবশ্য এখন যা রাত হয়েছে। তাতে না পাওয়ারই সম্ভাবনা। চলুন, পথেই তো পড়বে।
ল্যাংড়া পাঁচু অর্জুনের কাছে কৃতজ্ঞ। তাকে জেল থেকে বাঁচিয়েছে সে। আগে তালা খোলার নৈপুণ্যের কারণে ডাকাতদের সঙ্গী ছিল। এখন লটারির টিকিট বিক্রি করে। অবনীবাবুর জিপে হাসপাতালের সামনের গলিতে যাওয়ামাত্র কিছু লোক এদিক-ওদিক পালাতে লাগল। আধো অন্ধকারেও পুলিশের জিপ ঠিক চিনে ফেলেছিল তারা। কিন্তু একটি গলা চিৎকার করে উঠল, পালাচ্ছিস কেন? এই হতভাগারা? আমি চোর-ডাকাত নই যে পালাব। হুম।
অর্জুন দেখল ল্যাংড়া পাঁচু বাবু হয়ে বসে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল, তোমার অবস্থা কীরকম?
চোখ বড় করে দেখার চেষ্টা করল ল্যাংড়া পাঁচু। চিনতে একটু কষ্ট হল। তারপর চিনে ফেলতেই মাথা নাড়ল, এখনও দশটা বাজেনি।
এখন এগারোটা বেজে গেছে।
অসম্ভব। দশটার মধ্যে আমি ঘরে ফিরে যাই। আমি যখন যাইনি, তখন এগারোটা বাজবে কী করে?
উঠতে পারবে? অর্জুন ধমক দিল।
আপনি আদেশ করলে আমি উড়তেও পারব।
ল্যাংড়া পাঁচুকে ধরে-ধরে নিয়ে এল অর্জুন জিপের কাছে। অবনীবাবুকে দেখে ল্যাংড়া পাঁচু বলল, আই বাপ, শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাবেন নাকি?
তাকে গাড়িতে তুলে অর্জুন বলল, তোমার মাথা কেমন আছে এখন?
আপনাদের চিনতে পারছি।
তা হলেই হবে। একটা তালা খুলবে তুমি।
না। অসম্ভব! আপনার নির্দেশে ওকাজ ছেড়ে দিয়েছি আমি।
মানুষের উপকার হলে কেন করবে না?
কেউ আমার উপকার করে না। আমি কেন করব?
অর্জুন কিছু বলার আগে গাড়ি চালাতে-চালাতে অবনীবাবু বললেন, কেন, অর্জুনবাবু তোমার উপকার করেননি?
একশোবার। সবাইকে বলি সেকথা। ল্যাংড়া পাঁচু মাথা নাড়ল, কিন্তু সঙ্গে যন্ত্রপাতি নেই। সব ফেলে দিয়েছি তিস্তার জলে।
অর্জুন বলল, দ্যাখো পাঁচু, একটি মানুষের জীবন বিপন্ন। তাকে রক্ষা করতে চাই আমরা। এই তালা সেই কারণে খোলা দরকার।
অ। এটা প্রথমে বললেই পারতেন। মোটা তার চাই।
অবনীবাবু গাড়ির ড্রয়ার খুলে তার বের করে দিলেন। ল্যাংড়া পাঁচু সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কিছু একটা বানাতে লাগল।
পুলিশের গাড়ি দেখে চৌকিদার ছুটে এল। অবনীবাবু চাপা গলায় বললেন, আপনি ওকে নিয়ে এগিয়ে যান, আমি এর সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। আপনার মেমসাহেব যদি ফিরে আসে, তা হলে হর্ন বাজাব। অর্জুন ঘাড় নেড়ে ল্যাংড়া পাঁচুকে ইশারা করল।
অবনীবাবু কেয়ারটেকারের সঙ্গে সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগলেন। অর্জুনরা যে গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকছে তা দেখেও দেখল না চৌকিদার। অবশ্য অর্জুনের জন্য ওর কোনও চিন্তা ছিল না। সিঁড়ি ভেঙে ল্যাংড়া পাঁচু দ্রুত ওপরে উঠে এল অর্জুনের পেছন-পেছন। নির্জন দোতলায় আলো জ্বলছে, দরজায় তালা, যেমনটি অর্জুন দেখে গিয়েছিল।
ল্যাংড়া পাঁচু তালার গায়ে হাত বোলালো, এ যে দেখছি বিলিতি জিনিস।
হতে পারে। চটপট খোল।
এরকম তালা অনেকদিন আগে একবার খুলেছিলাম। বার্মিংহাম না কি যেন একটা জায়গায় তৈরি হয়। বেশ খানদানি তালা।
আঃ। কথা বোলো না। অর্জুন বিরক্ত হল।
আপনি বুঝতে পারছেন না। এমন জিনিস তো চট করে দেখতে পাওয়া যায় না। আহা। কী ফিনিশ! চাবি ছাড়া যে কেউ এটা খুলে দেখাক। তার পায়ের ধুলো মাথায় নেব আমি। একেবারে রানি তালা। চোখ বন্ধ করে বলে যাচ্ছিল ল্যাংড়া পাঁচু, তালার গায়ে হাত বোলাতে-বোলাতে। তারপরই সোজা হল, মনে হচ্ছে পেয়েছি। তা তালা খুলে আবার লাগাতে হবে, না এটাকে নিয়ে যাব?
আবার লাগাতে হবে।
অ। কথাটা মনঃপুত হল না লোকটার। অর্জুন দেখছিল যেভাবে ডাক্তাররা অপারেশন করে, সেইভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছে ল্যাংড়া পাঁচ, এরই মধ্যে। মিনিটদুয়েক চুপচাপ কেটে গেল। অর্জুন অস্থির হয়ে উঠছিল। ঠিক তখনই হাসির শব্দ কানে এল। তালা হাতে নিয়ে ল্যাংড়া পাঁচু হাসছে। আবার হার মানলি। আমার নাম পাঁচগোপাল রে!
অর্জুন চট করে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল। ঘরের এক কোণে সুটকেসটা রয়েছে। টেবিলের ওপর হাতব্যাগ। চটপট সেটা খুলল। পাসপোর্ট রয়েছে ওপরে। সেটার পাতায় নজর বোলাতে লাগল। ডরোথি ভারতে এসেছে সাতদিন আগে। প্রথমে দিল্লিতেই নেমেছে সে। দিল্লি থেকে কলকাতায় নিশ্চয়ই ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে পৌঁছেছে, তাই পাসপোর্টে তার কোনও এন্ট্রি নেই। বাগডোগরায় পৌঁছবার আগে ও দিল্লি এবং কলকাতায় পাঁচদিন কী করছিল তা জানা যাচ্ছে না। পাসপোর্ট বলছে ডরোথি মাস ছয়েক আগে আর-একবার দিল্লিতে এসেছিল। দুদিন ছিল মাত্র। এ কথা ডরোথি একবারও বলেনি।
ব্যাগে শ তিনেক পাউন্ড ছাড়া প্লেনের টিকিট দেখতে পেল। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের। এ ছাড়া একটা চাবি এবং প্রসাধনী সামগ্রী। নোট বইটাকে দেখতে পেল না সে। এবার সুটকেসটা। ব্যাগটাকে ভাল করে যথাস্থানে রেখে সে সুটকেসের সামনে গেল। তালাবন্ধ। নম্বর ঘুরিয়ে লক করে দেওয়া হয়েছে। হয়তো চেষ্টা করলে ল্যাংড়া পাঁচু এটাকে খুলতে পারবে, কিন্তু তার জন্য আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অর্জুন ওয়াড্রোব খুলে দেখল সেখানে কিছু ব্যবহৃত পোশাক ঝুলছে। পোশাকগুলো হাতড়ে দেখল পকেটে কিছু নেই। বিছানার দিকে তাকাল। একেবারে নিপাট বিছানা নয়। বালিশের পাশে একটা বই। থ্রিলার। অর্জুন থ্রিলারটা তুলে নিল। ওপরে রিভলভারের ছবি। পাতা উলটে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। সেটাকে রেখে বালিশটা তুলতেই নোটবুকটা চোখে পড়ল। চটপট পাতা ওলটাল। প্রথম দিকে কিছু কোটেশন লিখে রাখা হয়েছে। মানুষের জীবন নিয়ে সাহিত্যিকদের রচনা থেকে নির্বাচিত লাইন। তারপরের পাতায় কিছু ইংরেজি নাম, নামের পাশে ওয়ান, টু লেখা। হঠাৎ এক পাতায় লেখা বিল মেট রে ইন ডেহি। পাতাগুলোর খানিকটা সাদা। হঠাৎ লেখা কমলাকান্ত রে, দেবদাস মিটার অ্যান্ড তারিণী সেন। তারিণী সেনের নামটার চারপাশে লাইন টেনে ঘর করা হয়েছে। কমলাকান্তর নামের পাশ থেকে একটা লাইন বেঁকিয়ে নিচে নামিয়ে সেই বক্সের গায়ে শেষ করেছে ডরোথি। নোটবুকে আর কোনও লেখা নেই। ওটাকে বালিশের নিচে নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল অর্জুন।
ল্যাংড়া পাঁচু তখনও তালাটাকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে। অর্জুন তাকে বলল, এবার ওটা লাগিয়ে দাও!
হাসল ল্যাংড়া পাঁচু, আমি বোধ হয় অভিমন্যু হয়ে গেলাম। ওর চুপসে যাওয়া মুখের হাসিটাকে ঠিক শকুনির হাসি মনে হল। কী আজেবাজে বকছ?
সত্যি বাবু! এ খানদানি জিনিস। গুরুবলে খুলে ফেলেছি। কিন্তু বন্ধ করতে গিয়ে বুঝতে পারছি এ কী জিনিস।
দ্যাখো, আমার হাতে সময় নেই। যেমন করে পায়রা বন্ধ করো। অর্জুনের গলায় এবার বেশ উত্তেজনা। ডরোথি যেন না বুঝতে পারে ঘরে কেউ ঢুকেছিল।
দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল ল্যাংড়া পাঁচু। তালাটাকে কড়ায় ঝুলিয়ে জিভে শব্দ করল, যেন কোনও পোষা প্রাণীকে আদর করছে। অর্জুন গাড়ির হর্ন শোনার জন্য কান খাড়া করল। যে-কোনও মুহূর্তে ডরোথিরা ফিরে আসতে পারে। ওদের মুখোমুখি এখনই হতে চায় না সে।
ল্যাংড়া পাঁচু যতবারই তালা বন্ধ করে টেনে দেখছে, ততবারই ওটা খুলে যাচ্ছে। তার মুখ থেকে ছোটখাটো গালাগালি বেরিয়ে আসছিল। অন্য সময় হলে অর্জুন আপত্তি করত, কিন্তু এখন করল না। সে বলল, তোমার এত নাম, আর তুমি হার মানবে?
হার মানলে আপনার জন্যে মানব।
তার মানে?
আপনি সেই যে আমাকে থানা থেকে বের করে এনে বললেন লাইন ছেড়ে দিতে, তারপর তো আর চচা নেই। খুলবে কেন? ল্যাংড়া পাঁচু তখনও তালা ঘোরাচ্ছে।
অর্জুন ঢোঁক গিলল। হঠাৎ ল্যাংড়া পাঁচু তারটাকে পকেটে পুরে ওপর থেকে তালার মাথায় আঘাত করতে ওটা ভেতরে ঢুকে আটকে গেল। ওর মুখ থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ ছিটকে উঠল, যাঃ বাবা। চাপ দিলেই তো বন্ধ হত। আমি এতক্ষণ ওর পেটের ভেতরে তার ঘোরাচ্ছিলাম। সহজ জিনিসটা কখনওই মাথায় আসে না।
অর্জুন এগিয়ে গিয়ে তালাটাকে টেনে দেখল ওটা আটকে গেছে। সে চাপা গলায় ল্যাংড়া পাঁচুকে বলল, চটপট নেমে এসো।
নেমে আসার পথে ল্যাংড়া পাঁচু বকরবকর করছিল, এর আগে সে কত রকমের জটিল তালা খুলেছে, অথচ কোনওটাই বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আজ বুঝতে পারছে যে, কোনও জিনিস খোলা অথবা ভাঙা সহজ, কিন্তু বন্ধ করা অথবা গড়া খুব কঠিন।
নিচে নেমে অর্জুন বলল, এবার সোজা বাড়ি ফিরে যাও।
অ্যাও দূর থেকে হেঁটে বাড়ি যাব?
রিকশায় যাও। পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে সে লোকটাকে দিল।
মাথা নাড়ল লোকটা, এত রাতে রিকশা পাব না।
অগত্যা ওকে জিপের পেছনে বসাতে হল। অবনীবাবু তখনও চৌকিদারটার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলেন। এবার জিপ ঘুরিয়ে তিস্তা ভবনে পৌঁছবার বিপরীত দিকে খানিকটা গিয়ে একটা অন্ধকার জায়গায় ওটাকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন, কিছু পেলেন?
তেমন কিছু নয়। তবে দুটো তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ডরোথি যে মিথ্যেবাদী, তা স্পষ্ট।
যেমন?
ওর পাসপোর্ট বলছে, এর আগে মাস ছয়েক আগেই ডরোথি দিল্লিতে এসেছিল। আর এবার এসেছে দিন সাতেক আগে। এসে ও পাঁচ দিন কোথাও ছিল। এসব কথা আমাকে বলেনি ডরোথি। অর্জুন জানাল।
দিন সাতেক আগে ও যদি দিল্লিতে আসে তা হলে অমলবাবুর চিঠি এত দেরিতে পৌঁছল কেন আপনার কাছে? ও যদি সরাসরি দিল্লি থেকে বাগডোগরাতে চলে আসত, তা হলে আপনি জানতেও পারতেন না, কারণ তখনও চিঠি আপনার কাছে পৌঁছতো না। অমলবাবু এমন ভুল নিশ্চয়ই করবেন না। অবনীবাবুর কথায় যুক্তি ছিল।
ঠিক। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না।
আপনি চিঠিটা গতকাল পেয়েছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু কোথায় পোস্ট করা হয়েছে তা দেখিনি। ওটা দেখতে হবে।
আপনার কাছে যে-মেয়েটা এত মিথ্যে কথা বলছে, তাকে অমলবাবু কেন যে রেকমেন্ড করলেন, বুঝতে পারছি না।
জানি না, অমলদার সঙ্গে কীভাবে পরিচয়!
অর্জুনের কথা শেষ না হওয়ার আগে হেডলাইটের আলো এগিয়ে এল। গাড়িটা বিপরীত প্রান্ত থেকে এলেও তিস্তা ভবনের গেটের সামনে থেমে যাওয়ায় ওদের জিপ পর্যন্ত হেডলাইটের আলো পৌঁছল না। পেছনের দরজা খুলে দুজন নেমে পড়ল। অথচ যাওয়ার সময় পেছনের আসনে একজনই ছিল এবং সে ডরোথি। ওরা গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলে কালো অ্যাম্বাসাডার মুখ ঘুরিয়ে আবার গেটের সামনে পৌঁছল। অর্থাৎ ডরোথিকে কেউ একজন পৌঁছে দিতে গেল।
অর্জুন বলল, চৌকিদার আবার বলে না দেয়!
অবনীবাবু মাথা নাড়লেন, লোকটা মরে গেলেও মুখ খুলবে না। ব্যবস্থা করেছি।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে লোকটা ফিরে গেট বন্ধ করে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। অবনীবাবু ইঞ্জিন চালু করলেন, ওদের অনুসরণ করা যাক।
আমার মনে হচ্ছে ওরা শিলিগুড়িতে ফিরে যাবে।
এক শহরে থাকছে না বলছেন?
হ্যাঁ। বোধ হয় সেটা সন্দেহ এড়াতে।
তা হলে তো বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। যেতে-আসতে দেড় ঘণ্টা।
কালো অ্যাম্বাসাডারটা এখন বেশ জোরে ছুটছে। অবনীবাবু অনেকটা দুরত্ব রেখে ওটাকে অনুসরণ করছিলেন। ক্রমশ কদমতলার মোড় ঘুরে শান্তিপাড়ার মোড় হয়ে গাড়িটা শিলিগুড়ির পথ ধরতে অবনীবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন, আর যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এখন ওদের আটকে কোনও লাভ নেই।
রায়কতপাড়ার মোড়ে ল্যাংড়া পাঁচুকে বাইক থেকে নামিয়ে অর্জুন যখন বাড়ি ফিরে এল, তখন মধ্যরাত। মা জেগেই ছিলেন। খানিকটা বকুনি খেল সে। দেরির কারণ যে ডরোথি, এটা বলতে কোথায় বাধল। মা যদি বোঝেন কেউ অসৎ, তা হলে তার জন্য কোনও কাজ করবেন না। ডরোথির সঙ্গে আগামী কালও তাকে ভাল ব্যবহার করতে হবে, দুপুরে খাবার পৌঁছে দিতেও হবে। জানলে মা খাবারটা তৈরি করে দেবেন না। অতএব বকুনি হজম করতে হল অর্জুনকে।
টেবিলে অমলদার চিঠিটা পড়ে ছিল। সেটাকে তুলে খামের গায়ে স্ট্যাম্প দেখতে গিয়ে মাথা নাড়ল অর্জুন। চিঠিটা পোস্ট করা হয়েছে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট অঞ্চল থেকে। টিকিটগুলো ভারতবর্ষের। অর্থাৎ ডরোথি অমলদার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে এসে কলকাতা থেকে পোস্ট করেছে। চিঠিটা যখন সে পড়েছিল তখন আর খামটা খেয়াল করেনি। চিঠির ওপর লন্ডন এবং তারিখ আছে। তারিখটা ডরোথি রওনা হওয়ার দুদিন আগের। খামের ওপর অর্জুনের ঠিকানা টাইপ করে বসানো। আর খামটাও বিদেশি, এ-দেশের স্ট্যাম্প বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ওপরে। এটা নিশ্চয়ই আগে থেকে পরিকল্পনা করেই করা হয়েছে। কথা হল, অমলদা কেন নিজে পোস্ট না করে ডরোথির হাতে তুলে দিলেন?
রাত্রে ভাল ঘুম এল না। বারংবার মনে হচ্ছিল ডরোথি তাকে যেমন প্রতারণা করেছে, অমলদাকেও তেমনই। কিন্তু কেন সেটা করতে গেল? বোঝা যাচ্ছে, তারিণী সেন এখন ওর লক্ষ্য। এখন, না আগে থেকেই? নোটবুকে ওই নামটার চার পাশে বাক্স আঁকা আছে। অর্থাৎ ডরোথি আগেই জানত যে, বাক্সটা মূল্যবান। আর ওই বাক্সের গায়ে কমলাকান্ত রায়ের নামের পাশ থেকে একটা লাইন নামানো হচ্ছে। তার মানে কি কমলাকান্ত রায়ের সঙ্গে তারিণী সেনের কোনও যোগাযোগ ছিল? মুশকিল হচ্ছে তারিণী সেনের আর্থিক এবং শারীরিক অবস্থা যা, তার জন্য লন্ডনের কোনও ইংরেজ মহিলার কোনও উদ্বেগ থাকা তো অস্বাভাবিক, ক্ষমাটমা চাওয়ার ব্যাপারটা এখন নেহাতই একটা আড়াল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে অর্জুন সোজা রওনা হল তিস্তা ভবনের দিকে। খুব হালকা রোদ উঠেছে আজ। বাতাস বইছে চমৎকার। তিস্তা ভবনের বাগানে ডরোথিকে দেখতে পাওয়া গেল। একটা গাছের পাতা খুব মন দিয়ে লক্ষ করছে। বাইকের আওয়াজে বোধ হয় তার চমক ভাঙল। অর্জুন গুড মর্নিং বলতে সে হেসে সাড়া দিল।
ঘুম হয়েছিল?
নাঃ। নিজের বিছানার অভ্যেস বড় খারাপ। যাকগে, আমরা কখন যাব?
বিকেলে। গতকাল ডাক্তার তো সে রকমই বলল।
ওকে দেখে মনে হচ্ছে, এখনই কোনও হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।
ঠিক আছে, ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করব। উনি যদি বলেন, তা হলে করা যাবে।
দেখে আমার এত ভয় করছিল। যদি আজ পর্যন্ত বেঁচে না থাকেন তা হলে আমার এখানে আসাই বৃথা হবে। ডরোথি হাঁটতে লাগল।
তা তো হবেই। অন্য দুজন মারা গিয়েছেন আগে, তারিণীবাবু এখনও বেঁচে আছেন, ওঁর সঙ্গে তোমার কথা হওয়া দরকার।
কথা মানে দাদুর হয়ে ব্যাপারটা জানানো। ব্যস।
ব্রেকফাস্ট করেছ?
নাঃ। একটু পরে করব। তুমি?
আমি খেয়ে বেরিয়েছি।
তোমাকে আমার জন্যে কষ্ট করতে হচ্ছে।
আরে না। অমলদার আদেশ আমার শিরোধার্য। তা ছাড়া তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আমার ভালই লাগছে।
ধন্যবাদ। তুমি কখনও বিদেশে গিয়েছ?
তা গিয়েছি। হিথরো এবং কেনেডি এয়ারপোর্ট দেখা হয়ে গেছে।
তাই নাকি? অবাক হয়ে তাকাল ডরোথি। যেন এতটা আশা করেনি সে। জিজ্ঞেস করল, বেড়াতে গিয়েছিলে?
ওই আর কি! অর্জুন হাসল, এখন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
নাঃ। বইটা শেষ করব। খুব ইন্টারেস্টিং।
ক্রাইম থ্রিলার?
হ্যাঁ।
জলপাইগুড়িতে একসময় খুব ক্রাইম হত। এখানকার পুলিশের খুব নাম আছে।
তাই নাকি? ডরোথি তাকাল।
হ্যাঁ। কদিন আগে হাইওয়ে থেকে ওরা কুখ্যাত ক্রিমিনালদের ধরেছে।
ও। ডরোথি মুখ ঘুরিয়ে নিল।
একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেসা করা হয়নি। মিস্টার অমল সোমের সঙ্গে তোমার কীভাবে আলাপ হল? উনি কি এখন লন্ডনেই থাকেন?
আমি ওঁকে ঠিক জানি না। আমার এক আত্মীয় ওঁকে চেনেন। আমি ইন্ডিয়ার এদিকটায় আসতে চাই শুনে উনি মিস্টার সোমের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ওই একবারই দেখি ওঁকে। আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিলেন এই পর্যন্ত।
আরও কিছুক্ষণ অনাবশ্যক কথাবার্তা চালিয়ে অর্জুন বিদায় নিল। ঠিক হল, বিকেল হওয়ার আগেই ওরা রওনা হবে। দুপুরে লাঞ্চ নিয়ে অর্জুনকে আসতে নিষেধ করল ডরোথি। আজ ওর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। দরকার হলে এখান থেকেই টোস্ট আর ওমলেট খেয়ে নেবে। মেয়েটাকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল এখন।
বাড়ি ফিরে মাকে খাবার তৈরি করতে নিষেধ করে ছটা লুচি, বেগুনভাজা আর মিষ্টি পেটে পুরল অর্জুন। ডরোথির মুখটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। কী চমৎকার অভিনয় করে গেল মেয়েটা! গত রাতে বেরিয়ে আসার কথা বেমালুম চেপে গেল। অর্জুন এখানকার পুলিশের কৃতিত্বের বর্ণনা করায় অন্যমনস্ক হয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ডরোথি কোনও একটা গোপন কাজে সঙ্গী নিয়ে এসেছে এটা স্পষ্ট, কিন্তু কাজটা কী, তা বুঝতে পারছে না সে।