ময়নাগড়ের দিঘির ধারে
ময়নাগড়ের দিঘির ধারে সন্ধেবেলায় চুপটি করে বসে আছে বটেশ্বর। চোখে জল, হাতে একখানা বাঁশি। পুবধারে মস্ত পূর্ণিমার চাঁদ গাছপালা ভেঙে ঠেলে উঠবার চেষ্টা করছে। দিঘির দক্ষিণ দিককার নিবিড় জঙ্গল পেরিয়ে দখিনা বাতাস এসে দিঘির জলে স্নান করে শীতল সমীরণে পরিণত হয়ে জলে হিলিবিলি কাঁপন তুলে, বটেশ্বরের মিলিটারি গোঁফ ছুঁয়ে বাড়িবাড়ি ছুটে যাচ্ছে। চাঁদ দেখে দক্ষিণের জঙ্গল থেকে শেয়ালেরা ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া’ বলে হিন্দিতে পরস্পরকে প্রশ্ন করছে। বেলগাছ থেকে একটা প্যাঁচা জানান দিল হাম হ্যায়, হাম হ্যায়।’
বটেশ্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের বাঁশিটার দিকে তাকাল। বহুঁকালের পুরনো মস্ত বাঁশি, গায়ে রুপোর পাত বসানো, তাতে ফুলকারি নকশা। দিনতিনেক আগে সকালবেলায় ঝোলা কাঁধে একটা লোক এসে হাজির। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ঢলঢলে জামা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। রোগাভোগা চেহারার লোকটা বলল, কোনও রাজবাড়ির কিছু জিনিস সে নিলামে কিনেছে, আর সেগুলোই বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করছে। পুরনো আমলের রুপোর টাকা, জরিবসানো চামড়ার খাপে ছোট্ট ছুরি, অচল পকেটঘড়ি, পেতলের দোয়াতদানি, পাশা খেলার ছক, হাতির দাঁতের পুতুল, এরকম বিস্তর জিনিস ছিল তার সঙ্গে আর ছিল এই বাঁশিটা। বটেশ্বর জীবনে কখনও বাঁশি বাজায়নি, তবে বাজানোর শখটা ছিল। লোকটা বলল, “যেমন তেমন বাঁশি নয় বাবু, রাজবাড়ির
পুরনো কর্মচারীরা বলেছে, এ হল মোহন রায়ের বাঁশি।”
“মোহন রায়টা কে?”। “তা কি আমিই জানি! তবে কেষ্টবিষ্টু কেউ হবেন। বাঁশিতে নাকি ভর হয়।”
লোকটা দুশো টাকা দাম চেয়েছিল। বিস্তর ঝোলাঝুলি করে একশো টাকায় যখন রফা হয়েছে তখন বটেশ্বরের বউ খবর পেয়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করে বলল, “টাকা কি খোলামকুচি? একটা বাঁশির দাম একশো টাকা! বলি জীবনে কখনও বাঁশিতে ফুঁ দাওনি, তোমার হঠাৎ কেষ্টঠাকুর হওয়ার সাধ হল কেন? ও বাঁশি যদি কেননা তা হলে আমি হয় বাঁশি উনুনে গুঁজে দেব, না হয় তো বাপের বাড়ি চলে যাব।”
ফলে বাঁশিটা তখন কেনা হল না বটে, কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে বটেশ্বর যখন বাজারে গেল তখন দেখতে পেল বুড়ো শিবতলায় লোকটা হা-ক্লান্ত হয়ে বসে আছে। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সে বাঁশিটা কিনে ফেলল। ফেরার সময় খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকে গোয়ালঘরের পাটাতনে বাঁশ বাখারির ভিতরে খুঁজে রেখে দিয়ে এল।
আশ্চর্যের বিষয়, সেদিন রাতে তার ভাল ঘুম হল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল বাঁশিটা যেন তাকে ডাকছে। নিশির ডাকের মতো, চুম্বকের মতো। কেবলই ভয় হতে লাগল, বাঁশিটা চুরি যাবে
তো! দ্বিতীয় রাতেও ঠিক তাই হল। নিশুত রাতে বার বার উঠে বাঁশির নীরব আহ্বান শুনতে পেল সে। কিন্তু বউয়ের ভয়ে বেরোতে পারল না।
আজ তার বউ বিকেলে পাড়া-বেড়াতে গেছে। সেই ফাঁকে বাঁশিটি বের করে নিয়ে দিঘির ধারে এসে বসেছে বটেশ্বর। খুব নিরাপদ জায়গা। কালীদহ দিঘি ভূতের আখড়া বলে সন্ধের পর কেউ এধারে আসে না। উত্তর ধারে বাঁশবনের আড়াল আছে।
বটেশ্বর বাঁশি বাজাতে জানে না বটে, কিন্তু বাঁশিটাকে সে বড় ভালবেসে ফেলেছে। কী মোলায়েম এর গা, কী সুন্দর কারুকাজ। হেসে খেলে একশো দেড়শো বছর বয়স হবে। এমন বাঁশির আওয়াজও মিঠে হওয়ার কথা। কিন্তু হায়, বটেশ্বর বাঁশিতে ফুঁ দিতেও জানে না।
নিজের অপদার্থতার কথা ভেবে তার চোখে জল আসছিল। জীবনে সে কিছুই তেমন পেরে ওঠেনি। ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল হাঁদু মল্লিকের মতো বড়লোক হবে। হতে পারল কি? হরিপদ কানুনগোর মতো ফুটফুটে চেহারাও তো ভগবান তাকে দেননি। ব্রজকিশোর দাসের পেল্লায় স্বাস্থ্যের ওপর কি কম লোভ ছিল তার? কিছুদিন ব্যায়াম ট্যায়াম করে শেষে হাল ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তারক রায়ের মতো সুরেলা গলা কি তার হতে পারত না? আর কিছু না হোক গোটা মহকুমা যাকে এক ডাকে চেনে সেই শাজাহান, সিরাজদ্দৌলা বা টিপু সুলতানের ভূমিকায় দুনিয়া কাঁপানো অভিনেতা রাজেন হালদারের মতো হতেই বা দোষ কী ছিল? কিংবা লেখাপড়ায় সোনার মেডেল পেয়ে গরিবের ছেলে পাঁচুগোপাল যে ধাঁ করে বিলেত চলে গেল। সেরকমটা কি একেবারেই হতে পারত না তার? পাঁচুগোপাল যে স্কুলে পড়েছে সে-ই নরেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে তো সেও পড়ত। জামা নেই, জুতো নেই, খাবার জুটত না, তবু পাঁচু সোনার মেডেল পেল। আর বটেশ্বর? এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে উঠতে যেন দম বেরিয়ে যেত তার। মনে হত পরের ক্লাসটা কত উঁচুতে রে বাপ! পেটে বিদ্যে নেই, গলায় গান নেই, শরীরে স্বাস্থ্য নেই, মুখে রূপ নেই, বেঁচে থাকাটার ওপরেই ভারী ঘেন্না হয় তার।
কালীদহের ভাঙা পৈঠায় বসে এইসব ভাবতে ভাবতে আর চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে বাঁশিটার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল। একশো টাকা দিয়ে কিনেছে বটে কিন্তু এবাঁশি বাজানোর সাধ্য তার নেই। বাঁশিটাকে আদর করতে করতে সে ফিসফিস করে বলল, আহা, যদি আমি তোকে একটু বাজাতে পারতাম!”
বটেশ্বরকে চমকে দিয়ে ঠিক এই সময়ে কাছের আমগাছ থেকে একটা পাখি পরিষ্কার ইংরিজিতে বলে উঠল, “ডু ইট! ডু ইট! ডু ইট!”
সত্যিই বলল নাকি? না, ও তার শোনার ভুল! পাখি কতরকম ডাক ডাকে। ওরা তো আর ইংরেজি জানে না।
তবু ডাকটা নিয়তির নির্দেশ বলেই কেন যেন মনে হচ্ছিল তার। কে জানে বাপু, দুনিয়ায় কত অশৈলী কাণ্ডই তো ঘটে। তাই বটেশ্বর সাবধানে চারপাশটা একটু দেখে নিল। না, কেউ কোথাও নেই। থাকার কথাও নয়। কেউ দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে। একা একাও তার লজ্জা করছে। নিজের কাছেও কি মানুষ লজ্জা পায় না? দোনামেমানা করে সে বলে উঠল, “চেষ্টা করব?”
অমনি কালীদহের মোটাসোটা পুরনো ব্যাঙগুলোর একটা জলের কাছ থেকে মোটা গলায় বলে উঠল, “লজ্জা কী? লজ্জা কী? লজ্জা কী?”
ফের বটেশ্বর চমকাল। নাঃ, নিয়তি আজ যেন চারদিক থেকে তাকে হুকুম দিচ্ছে। খুবই লাজুক মুখে আড়বাঁশিটা তুলে সে খুব জোরে একটা ফুঁ দিল। বলাই বাহুল্য, কোনও আওয়াজ বেরোল না। শুধু ফস করে খানিকটা বাতাস বেরিয়ে গেল। বড় লজ্জা পেয়ে ক্ষান্ত হল বটেশ্বর।
কাছেই ভাঙা শিবের দেউল। দেওয়াল কেটে একশো অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। সেখান থেকে একটা তক্ষক বলে উঠল, “চেষ্টা করো! চেষ্টা করো! চেষ্টা করো!”
বটেশ্বর অবাক থেকে অবাকতর হচ্ছে। এসব কি ছদ্মবেশী দৈববাণী নাকি? চতুর্দিকে কি একটা অলৌকিক ষড়যন্ত্র চলছে? বাঁশিওলা বলেছিল বটে যে, বাঁশিতে ভর হয়। তা হলে কি তার মতো আনাড়ির ফুয়ে বাঁশি বেজে উঠবে?।
একটু ভরসামতো হল বটেশ্বরের। আরও বার কয়েক ফুঁ দিয়ে দেখল সে। না, শুধু ফস ফস করে হাওয়া বেরোল, আওয়াজ হল না। হতাশ হয়ে সে চুপ করে বসে রইল।
বিমর্ষ মনে বাড়ি ফিরে বাঁশিটা গোয়ালঘরে যথাস্থানে রেখে বটেশ্বর যখন ঘরে ঢুকল তখন তার বউ বলল, “ওগো, আজ সন্ধেবেলায় দুটো লোক তোমার খোঁজে এসেছিল।”
“তারা কারা?”
“কে জানে, চেনা লোক নয়। একজন খুব লম্বাচওড়া, আর একজন কেমন যেন শকুন, শকুন চেহারা।”
“কী দরকার তাদের?”
“শকুনের মতো লোকটা জিজ্ঞেস করল একজন বুড়ো মানুষের কাছ থেকে আমরা একটা রুপোবাঁধানো বাঁশি কিনেছি কি না। যদি কিনে থাকি তবে তারা বাঁশিটা ডবল দামে কিনে নেবে। শুনে আমার ভারী মনখারাপ হয়ে গেল। বাঁশিটা তোমাকে কিনতে দিলেই ভাল করতুম। ডবল দাম পাওয়া যেত।”
বটেশ্বরের বুকের ভিতরটা খুব ধুকুর পুকুর করছিল। বলল, “তা তুমি কী বললে?”
“বললুম, একজন বুড়োমানুষ বাঁশি বেচতে এসেছিল বটে, দরদামও হয়েছিল, কিন্তু শেষ অবধি আমরা নিইনি। তখন জিজ্ঞেস করল, বাঁশিটা কে কিনেছে তা আমি জানি কি না। আমি বললাম, অত দাম দিয়ে ও বাঁশি এখানে কে কিনবে। তবে আমি ঠিক জানি না। দেখলাম বাঁশির জন্য খুব গরজ।”
“এলেবেলে লোক, নাকি পয়সাওয়ালা?”
“না, না, বেশ পয়সাওলা লোক বলেই মনে হল। শকুনির মতো দেখতে লোকটার হাতে কয়েকটা আংটি ছিল, গলায় সোনার চেন, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি আর পরনে ধাক্কাপেড়ে ধুতি। লোকটার বেশ চোমড়ানো গোঁফ আর বাবরি চুল। তবে চোখ দুটো যেন বাঘের মতো জ্বলজ্বলে, তাকালে ভয়-ভয় করে।”
“আর সঙ্গের লোকটা?”
“সে কথাবার্তা বলেনি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে পালোয়ান টালোয়ান মনে হয়। পাহাড়ের মতো শরীর। এখন মনে হচ্ছে বাঁশিটা তোমাকে কিনতে না দিয়ে ভুলই হয়েছে।”
বটেশ্বর একথার জবাব দিল না। চিন্তিত মুখে সে কুয়োপাড়ে হাত মুখ ধুতে গেল। বাঁশিটার কী এমন মহিমা যে, লোকে ডবল দামে কিনতে চায়! ঘটনাটা বেশ চিন্তায় ফেলে দিল তাকে। তবে এটা বোঝ শক্ত নয় যে, বাঁশিটা খুব সাধারণ বাঁশি হলে লোকে বাড়ি বয়ে খবর করতে আসত না। সুতরাং বটেশ্বরের বুকের ধুকধুকুনিটা কমল না। একটা অজানা আশঙ্কায় তার মনটা কু ডাকতে লাগল।
ময়নাগড়ে নানান মানুষের নানান সমস্যা। যেমন কালীপদ সমাদ্দার। সে হল চিরকেলে ব্যথা-বেদনার রুগি। ব্যথা ছাড়া জীবনে একটা দিনও কাটায়নি সে। একদিন দাঁতব্যথায় কাতরায় তো পরদিন কান কটকটানির চোটে বাপ রে মা রে করে চেঁচায়। পরদিনই হয়তো কানের বদলে হাঁটু কামড়ে ধরে একটা কেঁদো বাঘ যেন হাড়মাস চিবোতে থাকে। দু’দিন পর মাজায় যেন কুড়ুলের কোপ পড়ার মতো ঝলকে ঝলকে ব্যথা শানিয়ে ওঠে। কোমর সারল তো মাথায় যেন কেউটের ছোবলের মতো ব্যথার বিষ তাকে কাহিল করে ফেলে। যেদিন আর কোনও ব্যথা না থাকে সেদিন পেটের মধ্যে পুরনো আমাশার ব্যথাটা চাগিয়ে উঠে তাকে পাগল করে তোলে। ব্রজ কবরেজ অনেক নিরখ পরখ করে বলেছে, আসলে ব্যথা তোমার একটাই, তবে সেটা বানরের মতো এ ডালে ও ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। ও ব্যথা যেমন চালাক তেমনি বজ্জাত। হাঁটুর ব্যথার ওষুধ দিলে ও গিয়ে মাজায় ঘাপটি মেরে থাকে। মাজায় ওষুধ পড়লেই লম্ফ দিয়ে দাঁতের গোড়ায় গিয়ে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে তাড়া খেলে গিয়ে কানের মধ্যে সেঁধোয়। ওর নাগাল পাওয়াই ভার, তাই বাগে আনাও শক্ত।”
ব্যথার ইতিবৃত্ত শুনে হোমিওপ্যাথ নগেন পাল চিন্তিত মুখে বলেছিল, ব্যথা তো আমি এক ডোজেই কমিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ওই মাজার ব্যথা তারপর কী মূর্তি ধারণ করবে সেইটেই ভাবনার কথা। নিত্যকালীপিসির পিঠের ব্যথা কমাতে গিয়ে কী হয়েছিল জানো? পিঠের ব্যথা সারতেই তার মাথার গণ্ডগোল দেখা দিল। চেঁচায়, কাঁদে, বিড়বিড় করে। দিলাম মাথার ওষুধ, মাথা ভাল হয়ে গিয়ে পিঠের ব্যথা ফিরে এল। তাই আমি বলি কী, ওই মাজার ব্যথাকে না ঘাঁটানোই ভাল। কাবলিওয়ালাকে তাড়ালে হয়তো কাঁপালিক এসে থানা গেড়ে বসবে। তাতে লাভ কী?
ময়নাগড়ের অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার প্রভঞ্জন প্রামাণিক ইঞ্জেকশন ছাড়া কথাই কয় না। যে রুগিই আসুক আর তার যে রোগই হয়ে থাকুক না কেন প্রভঞ্জন আগে তাকে একটা ইঞ্জেকশন ঠুকে দেবেই। রুগিদের উদ্দেশে তার একটাই কথা, ইঞ্জেকশন নাও, সব সেরে যাবে। দেখা যায়, প্রভঞ্জন যেমন ইঞ্জেকশন দিতে ভালবাসে তেমনি অনেক লোক আছে যারা ইঞ্জেকশন নিতেও খুব পছন্দ করে। বুড়ো উকিল তারাপদ সেন তো প্রায়ই সন্ধেবেলা এসে প্রভঞ্জনের ডাক্তারখানায় বসে, আর বলে, দাও তো ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন ঠুকে। ওটি না নিলে আজকাল বড় আইঢাই হয়, কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনে হয় আজ যেন কী একটা হয়নি। বিশ্বম্ভর সাঁতরা কোনও শুভ কাজে যাওয়ার আগে প্রভঞ্জনের কাছে একটা ইঞ্জেকশন না নিয়ে যায় না। জরুরি মোকদ্দমা বা শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্নে যাওয়ার আগে ইঞ্জেকশন একেবারে বাঁধা।
এই তো সেদিন হাটপুকুরের গজানন বিশ্বাসের মেজো মেয়ে শেফালিকে ভূতে ধরেছিল। শোনা সুরে কথা কয়, এলোচুলে ঘুরে বেড়ায়, দাঁতকপাটি লাগে। ওম বদ্যি কিছু করতে পারল না। তখন ডাকা হল প্রভঞ্জনকে। প্রভঞ্জন গিয়েই ইঞ্জেকশন বের করে ওষুধ ভরে উঁচ উঁচিয়ে যেই শেফালির দিকে এগিয়েছে অমনি ভূতটা শেফালিকে ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, “যাচ্ছি ডাক্তারবাবু, যাচ্ছি। আপনার জ্বালায় কি কোথাও তিষ্ঠোবার উপায় আছে?”
কালীপদকে তিনশো বাহান্ন নম্বর ইঞ্জেকশনটা দিয়ে ঘটনাটা প্রভঞ্জন নিজেই বলেছিল। বলল, “ইঞ্জেকশনে সারে না এমন রোগ দেখিনি বাপু। তোর ব্যথাটা যখন সারছে না তখন ধরে নিতে হবে ওটা তোর আসল ব্যথা নয়, ব্যথার বাতিক। বাতিকও আমি সারাতে পারি বটে, কিন্তু ভয় কী জানিস? ভয় হল, উটের যেমন কুঁজ, গোরুর যেমন গলকম্বল, হাতির যেমন শুড়, তোরও তেমনি ওই বাতিক। বাতিক সারালে তুই কি বাঁচবি?”
সুতরাং ব্যথা-বেদনা নিয়েই কালীপদ বেঁচে আছে। গতকাল তার হাঁটুতে ব্যথা ছিল। আজ হাঁটুর ব্যথা নেই, কিন্তু সকাল থেকে দাঁতের কনকনানি শুরু হয়েছে। সন্ধেবেলা সে এই গ্রীষ্মকালে কম্ফর্টারে গাল মাথা জড়িয়ে বসে আছে আর আহা উঁহু করছে।
এমন সময় দুটো লোক এসে হাজির হল। এলেবেলে লোক নয়, রীতিমতো সম্রান্ত চেহারার একজন মাঝবয়সী মানুষ, তার পরনে রেশমি পাঞ্জাবি, ধাক্কাপেড়ে ধুতি। মস্ত গোঁফ এবং বাবরি চুল। চেহারাটা রোগাটে হলেও বেশ শক্তসমর্থ। দেখে মনে হয় রাজা জমিদারের পরিবারের লোক। সঙ্গে একজন কুস্তিগিরের মতো লোক, যেমন লম্বা তেমন চওড়া।
প্রথমজনই কথা শুরু করল। বেশ গমগমে গলায় বলল, “আমরা একটা জিনিসের সন্ধানে অনেক দূর থেকে এসেছি। একটু সাহায্য করতে পারেন?”
এরকম বড় মাপের একজন মানুষ বাড়িতে আসায় ভারী তটস্থ হয়ে পড়ল কালীপদ। হাতজোড় করে “আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য।” বলে তাদের বৈঠকখানায় বসাল। তারপর হাত কচলে বলল, “বলুন কী করতে পারি।”
“আপনি কেতুগড় রাজবাড়ির নাম শুনেছেন?”
“খুব শুনেছি।”
“আমি ওই পরিবারেরই একজন বংশধর। আমার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।”।
“কী সৌভাগ্য! আপনিই কি রাজাবাহাদুর?”
লোকটার দাঁতগুলো বেশ বড় বড়। সেই দাঁত দেখিয়ে একটু হেসে বলল, “না, না, রাজাগজা নই। রাজতন্ত্রই নেই তো রাজা। আমাদের অবস্থাও আগের মতো নেই। কিছুদিন আগে কেতুগড়ের রাজবাড়ি থেকে কিছু জিনিস চুরি যায়। ছিচকে চোরেরই কাজ। দামি জিনিসপত্র কিছুই তেমন খোয়া যায়নি। তবু তার মধ্যে দুটো একটা জিনিস পুরনো স্মারক হিসেবে আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আমরা জিনিসগুলো উদ্ধার করতে চাই।”
কালীপদ ভারী ব্যস্ত হয়ে বলল, “বটেই তো! তা হলে পুলিশের কাছে–”
লোকটা হাত তুলে তাকে থামাল। হাতে হিরের আংটি ঝিলিক দিয়ে উঠল। লোকটা বলল, “পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের তো আঠারো মাসে বছর। চোর ধরতে ধরতে জিনিসগুলো বেহাত হয়ে যাবে। তাই আমরা নিজেরাও একটু চেষ্টা করছি। যে লোকটা চুরি করেছিল সে বুড়োমতো, গোঁফদাড়ি আছে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আমরা খবর পেয়েছি যে এই ময়নাগড়েই কিছু জিনিস বিক্রি করে গেছে।”
লোকটার বর্ণনা শুনে কালীপদর মুখ শুকিয়ে গেল। কেননা কয়েকদিন আগে যখন তার কোমরে ব্যথা হয়েছিল তখন ওই লোকটা তার কাছে এসেছিল বটে, ঝোলার মধ্যে অনেক পুরনো আমলের জিনিস ছিল। তা থেকে একটা ভারী সুন্দর জাপানি পুতুল মেয়ের জন্য কিনেছিল বটে কালীপদ। লোকটা পঞ্চাশ টাকা দাম হেঁকেছিল, শেষে কুড়ি টাকায় দিয়ে দেয়।
সে যখন এসব কথা ভাবছে তখন নরেন্দ্রনারায়ণ তার বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। একটু হেসে বলল, “জিনিসগুলো আমরা সবই ডবল দামে কিনে নেব। কিন্তু যে জিনিসটা আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি তা হল একটা বাঁশি। বহু
পুরনো রুপোয় বাঁধানো বাঁশি।”
কালীপদ মাথা নেড়ে বলল, “বাঁশির কথা জানি না। তবে আমি একটা জাপানি পুতুল তার কাছ থেকে কিনেছিলাম বটে।”
“বাঁশিটা কে কিনেছে জানেন?”
“না।”
“এই ময়নাগড়েরই কেউ কিনেছে বলে আমাদের চর খবর দিয়েছে।”
“আমি বাঁশি কিনিনি রাজামশাই। চুরির জিনিস জানলে পুতুলটাও কিনতাম না, লোকটা বলেছিল কোনও রাজবাড়ি থেকে নিলামে কিনেছে।”
নরেন্দ্রনারায়ণ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাকে রাজামশাই বলে লজ্জা দেবেন না। রাজত্ব থাকলে অবশ্য আজ আমার রাজা হওয়ারই কথা, কিন্তু তা যখন নেই তখন আমি আর রাজাগজা নই, সাধারণ মানুষ।”
লোকটা যাই বলুক এর গা থেকে কালীপদ রাজা-রাজা গন্ধ পাচ্ছিল। ঘরে রাজাগজা আসাতেই কি না কে জানে তার দাঁতের ব্যথাটাও উবে গেছে, সে গদগদ হয়ে বলল, “আহা গায়ে রাজরক্তটা তো আছে। রাজত্ব না থাকলেও কি রাজার মহিমা কমে যায় নাকি? মরা হাতি লাখ টাকা।”
নরেন্দ্রনারায়ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শরীরে রাজার রক্তটাই যা আছে। যাকগে, জাপানি পুতুলটা আপনি বরং রেখেই দিন। ওটা না হলেও আমাদের চলবে। কিন্তু বাঁশিটা আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। আপনি কি এব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারেন?”
কালীপদ হাত কচলে বলল, “আজ্ঞে, আপনি যখন আদেশ করলেন তখন অবশ্যই খোঁজ করে দেখব। ও তো কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।”
“আমরা বাঁশির জন্য পুরস্কার দিতেও রাজি আছি আর ডবল দাম তো দেবই।”
কালীপদর চোখ চকচক করে উঠল, বলল, “যে আজ্ঞে।”
.
ময়নাগড়ের সবচেয়ে বড়লোক হল হাঁদু মল্লিক। তার মস্ত সুদের কারবার আর তেলের ব্যবসা। লাখো লাখো টাকা। তবে কিনা হাঁদু মল্লিককে দেখে সেটা বুঝবার উপায় নেই। সে হেঁটো ধুতি পরে, গায়ে মোটা কাপড়ের একখানা বিবর্ণ জামা। পায়ে শস্তা রবারের চটি, বেঁটেখাটো হাঁদু মল্লিক রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বড়মানুষ বলে চেনা দায়।
রোজকার মতোই হাঁদু সন্ধেবেলায় তার গদিতে বসে সারাদিনের হিসেব নিকেশ জাবদা খাতায় টুকে রাখছিল। এ সময়টায় তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না। তবে আজ সে কিছু আনমনা। হয়েছে কি, দিনদুই আগে দুপুরের দিকে দাড়িগোঁফওয়ালা একটা লুঙ্গি পরা লোক ঝোলাকাঁধে এসে হাজির। বলল, কোন রাজবাড়ি থেকে নিলামে কিছু জিনিস কিনে এনেছে। রাজবাড়ির জিনিস শুনে হাঁদুর একটু কৌতূহল হল। থলি থেকে বিস্তর অকাজের জিনিস বের করে দেখাল লোকটা। তার মধ্যে গোটা কুড়ি পঁচিশ পুরনো রুপোর টাকাও ছিল। রুপো দামি জিনিস বলে হাঁদু দরদাম করে গোটা দুই কিনে ফেলেছিল ত্রিশ টাকায়। জালি জিনিস হতে পারে ভেবে বেশি কিনতে সাহস হয়নি। কিন্তু গতকাল বিধু স্যাঁকরা এসে টাকাদুটো দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, “করেছেন কী হাঁদুবাবু, এ তো রুপোর টাকা নয়! রুপোর মোড়কে এ যে খাঁটি মোহর! ওজনটা দেখছেন না! রুপোর কি এত ওজন হয়?” বলে বিধু একপাশ থেকে একটু ছিলকে কেটে দেখাল, ভিতরে সোনা চকচক করছে। সেই থেকে মনটা বড় হায়-হায় করছে হাঁদুর। পঁচিশটা টাকা যদি সাহস করে কিনে ফেলত তা হলে কী ভালটাই না হত। এখন তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। এত দুঃখ হচ্ছে যে, হাঁটু ভাল করে খেতে বা ঘুমোতে পারছে না, পেটে বায়ু হয়ে যাচ্ছে, দুঃস্বপ্ন দেখছে। লোকটাকে খুঁজে আনতে সে তার পাইক পাঠিয়েছিল। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে।
গতকাল থেকে তাই মনটা বড় উচাটন। আজ হিসেব করতে বসেও মাথাটা গণ্ডগোল করছে। আজ হয়েছে কি, দু’ হাজার সাতশো নয়ের নয়, আট হাজার পাঁচশো সাতাশির সাত, দশ হাজার নশো আঠাশের আট, পাঁচশো ছাব্বিশের ছয়, সাত হাজার তিনশো বত্রিশের দুই আর দশ হাজার দুশো চুয়াল্লিশের চার, যোগ করে হবে ছত্রিশ। ছত্রিশের ছয় নামবে, হাতে থাকবে তিন। ঠিক এই খানটাতেই তার চল্লিশ বছরের হিসেব করা পাকা মাথায় কেমন যেন হরিবোল হয়ে গেল। কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না ছত্রিশের কত নামবে আর কত হাতে থাকবে। ছয় নেমে হাতে থাকবে তিন, নাকি তিন নেমে হাতে থাকবে ছয়! কোনটা নামে, কোনটা হাতে থাকে তা নিয়ে এমন গণ্ডগোলে সে কখনও পড়েনি। অগত্যা সে বিশু পালকে লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “ওহে বিশু, ছত্রিশের কত নামবে আর কত হাতে থাকবে বলে তো!”
বিশু সেই বিকেল থেকে দশটা টাকা হাওলাত চাইতে এসে বসে আছে। হাঁদু মল্লিক রাজি হচ্ছে না। বলেছে, আজ তিন মাস সাড়ে তিনশো টাকা ধার নিয়ে বসে আছ, একটি পয়সা ছোঁয়াওনি। বাহান্ন টাকা সুদ সমেত চারশ দু টাকা আগে শোধ দাও, তারপর নতুন ধারের কথা।
বিশু তবু আশায় আশায় বসে আছে।
ধার চাইতে সে আর যাবেই বা কোথায়। সব জায়গাতেই তার দেনা। ময়নাগড়ের সবাই তার পাওনাদার।
মেজাজটা আজ তার বড়ই খিচড়ে আছে। বিকেলেই দেখে এসেছে, সন্ধ্যা বাজারে মাছওয়ালা সনাতন কাদা চিংড়ির ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাদা চিংড়ি সে বড্ড ভালবাসে। চচ্চড়ি বেঁধে খেতে যেন অমৃত। দশটা টাকা হাওলাত পেলে হয়ে যেত। এতক্ষণ আর সে মাছ পড়ে নেই। হাঁদুর প্রশ্ন শুনে তাই সে খিঁচিয়ে উঠে বলল, “ছত্রিশের কত নামে আর কত হাতে থাকে তার আমি কী জানি! দশটা টাকা যখন ধার চেয়েছিলুম তখন খেয়াল ছিল না যে, এই শর্মাকেও একসময়ে দরকার হবে! দশটা টাকা ফেললেও না হয় চেষ্টা করে দেখতুম। তা যখন দাওনি তখন নিজের হিসেব তুমি নিজেই বোঝো।”
একধারে রাখাল মোক চুপচাপ বসে ছিল। সে হল ময়নাগড়ের সবচেয়ে বোকা তোক। রোজ সন্ধেবেলায় সে হাঁদুর গদিতে টাকার গন্ধ শুকতে আসে। টাকাপয়সার গন্ধ মাখানো বাতাসে শ্বাস নিলে তার ভারী আরাম বোধ হয়। হাঁটু মল্লিকের গদিতে সাতখানা সিন্দুকে টাকাপয়সা আর সোনাদানা গচ্ছিত। বাতাসে মম’ করছে টাকার গন্ধ। সকলে গন্ধটা পায় না বটে, কিন্তু রাখাল মোক পায়। আর সেই গন্ধে তার একটু নেশার মতোও হয়। ঘরে বাইরে সবাই রাখালকে বোকা বলেই জানে, রাখালও লোকের মুখে শুনে শুনে জেনে গেছে যে, সে খুব বোকা। নিজেকে বোকা বলে জানার পর থেকে সে খুব হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। লোকের সঙ্গে কথা কইবার আগেই সে বলে নেয়, “ভাই, আমি বড্ড বোকা, আমাকে একটু ভাল করে বুঝিয়ে বলতে হবে।” বাজারে গিয়ে দোকানিদের সে বলে “আমি বড্ড বোকা তো, তোমরা কিন্তু আমাকে আবার ঠকিয়ে দিও না,” এই তো কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে মাঝরাতে চোর ঢুকেছিল। রাখাল ঘুম ভেঙে চোরকে দেখে বলে উঠল, “আহা, করো কী, কয়রা কী, আমি যে বড্ড বোকা মানুষ। আমার বাড়িতে কি চুরি করতে আছে?” চোরটা খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “কে বলল আপনি বোকা? আপনাকে তো বেশ সেয়ানা লোক বলেই মনে হচ্ছে। চোরকে ভড়কে দিতে চান বুঝি?” রাখাল বেশ বুক ফুলিয়ে বলল, “মোটেই সেয়ানা নই হে, ময়নাগড় ছুঁড়লেও তুমি আমার মতো বোকা লোক পাবে না,” চোরটা একটা ফুৎকারে তার দাবি নস্যাৎ করে বলল, “ওই আনন্দেই থাকুন। পদ্মলোচন আঢ্যকে চেনেন? যে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বটপাতা দিয়ে সাজা পান খেয়ে তারিফ করেছিল? আর হরেন পাড়ই কি কম যায় নাকি? পাশের নন্দরামের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, হরেন পাড়ই গিয়ে সর্দারের হাতে পায়ে ধরে বলে কি, আমার বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো না দিলেই যে নয়। নন্দরামের বাড়িতে ডাকাতি হল আর আমার বাড়িতে যদি না হয় তা হলে কি শ্বশুরবাড়িতে আমার প্রেস্টিজ থাকবে? তা আপনি কি তাদের চেয়ে বেশি বোকা? বোকা হলেও আপনি মোটেই এক নম্বর নন, তিন চার বা পাঁচ নম্বর।” রাখাল এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক ওই সময়ে তার বউ উঠে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করায় চোরটা পালিয়ে যায়। উপরন্তু মাঝরাতে চোরের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বউয়ের ঘুম ভাঙানোয় বউ রেগে গিয়ে রাখালকে উত্তম কুস্তম বকাঝকা করে। আজকাল তাই নিজের বোকামি সম্পর্কে রাখালের একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। হয়তো সে নিরেট বোকা নয়, তার বোকামিতে হয়তো ফুটোফাটা আছে। চোরটা কত বাড়িতে ঘোরে, কত অভিজ্ঞতা।
টাকার গন্ধে রাখালের চোখ আরামে বুজে আসছিল, এমন সময় ছত্রিশ নিয়ে গণ্ডগোলটা তার কানে গেল। সে খুব ঠাহর করে সমস্যাটা শুনে নিয়ে হাঁদুকে বলল, “তোমার ছত্রিশ অবধি যাওয়ার দরকার কী? একটু কমিয়ে, কাটছাঁট করে তেত্রিশে নামিয়ে আনে। দেখবে ল্যাটা চুকে যাবে। তেত্রিশের যা নামবে তাই হাতে থাকবে। বুঝেছ? যা খুশি নামাও, ওঠাও, কোনও অসুবিধে নেই।”
হাঁদু চটে উঠে বলল, “ওই জন্যই তো তোমার কিছু হল না। শুয়ে, বসে আর ঝিমিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলে। যত সব মুখ এসে জোটে আমার কপালে। একটা সোজা অঙ্কের সোজা নিয়ম, তাই পেরে উঠছ না! ছত্রিশের কত নামে আর কত হাতে থাকে এ তো বাচ্চা ছেলেরও জানার কথা।”
এমন সময়ে কাছেপিঠে যেন বাজ পড়ার শব্দ হল। বাজ নয় অবশ্য, একটা বাজখাই গলা বলে উঠল, ছত্রিশের ছয় নামবে, হাতে থাকবে তিন।”
দৈববাণী হল কি না বুঝতে না পেরে হাঁটু ওপর দিকে চেয়ে দেখল। দৈববাণী অবশ্য হাঁদুর জীবনে নতুন কিছু নয়। কোনও বেয়াড়া, মতলববাজ খদ্দের এলে তার কানে কানে ফিসফিস করে দৈববাণী হয়। “দিও না হে একে ধারকর্জ দিও না।” কিন্তু এরকম বজ্রপাতের মতো বিকট দৈববাণী সে আর শোনেনি।
দৈববাণীর উদ্দেশে হাতজোড় করে একটা নমো ঠুকে হাঁটু ছত্রিশের ছয় নামাতে যাচ্ছিল, এমন সময় সেই দৈববাণীর গলাটাই দরজার কাছে থেকে এক পরদা নীচে নেমে বলল, “ভিতরে আসতে পারি?”
হাঁদু দেখল দরজার বাইরে দুটো লোক দাঁড়িয়ে। সামনের লোকটার পোশাকআশাক, গলার চেন, হাতে হিরের আংটি লক্ষের আলোতেও চোখে পড়ার মতো। সাধারণ খদ্দের নয়।
হাঁদু শশব্যস্তে বলল, “আসুন, আসুন। আস্তাজ্ঞে হোকে, বস্তাজ্ঞে হোক।”
রোগাটে, লম্বাটে, ফর্সাটে, গুফো এবং বাবরিবান লোকটাকে দেখে বিশু আর রাখালও নড়েচড়ে বসল।
হাঁদু হাতজোড় করে বলে উঠল, “আজ্ঞা করুন।“
লোকটা চারদিকটা একবার উদাস চোখে দেখে নিয়ে তার রাজকীয় গলায় বলল, “আমি কেতুগড় রাজবাড়ি থেকে আসছি। আমার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ। আমি রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের ভ্রাতুস্পুত্র।”
হাঁদু বিগলিত হয়ে বলল, “কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! এ যে ভাঙা ঘরে চাঁদের উদয়! এ যে ইঁদুরের গর্তে বেড়াল! এ যে এঁদো পুকুরে গাদাবোট! আরও কী যেন… ওহে বিশু, বলো না!”
বিশু কিছু বলার আগেই রাখাল বিশ্বাস বিগলিত হয়ে বলে ফেলল, “এ যেন পায়েসের বাটিতে পরমান্ন! এ যেন গদাহস্তে ভীমের প্রবেশ…”
বিশু তাড়াতাড়ি উঠে পায়ের ধুলো নিয়ে একগাল হেসে বলল, “তাই বলুন। দেখেই কেমন চেনা-চেনা লাগছিল।”
নরেন্দ্রনারায়ণ বরাভয়ের মুদ্রায় সবাইকে শান্ত করে তেমনি গম্ভীর গলায় বলল, “বিশেষ প্রয়োজনেই আমার ময়নাগড়ে আসা। রাজবাড়ি থেকে কিছু জিনিস চুরি গেছে। খবর পাওয়া গেছে দাড়ি গোঁফওয়ালা একজন মধ্যবয়সী লোক জিনিসগুলো এই গাঁয়ে এবং আশেপাশে বিক্রি করে গেছে। আমরা সেইসব জিনিসের সন্ধানেই এসেছি। আপনারা যদি কেউ কিছু কিনে থাকেন তা হলে আমরা সেগুলো ডবল দামে কিনে নেব। তবে সবচেয়ে গুরুতর জিনিসটি হচ্ছে একটা রুপোয় বাঁধানো বাঁশি। অন্য জিনিস পাওয়া না গেলেও বাঁশিটা আমাদের খুবই দরকার। ওটার জন্য হাজার টাকা পুরস্কার।
হাঁদুর বুক ধকধক করছে। দু-দুটো মোহর মাত্র ত্রিশ টাকায় কিনেছে সে। ডবল দাম পেলেও তো মোটে ষাট টাকা। মোহরের দাম যে অনেক বেশি। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বিগলিত মুখে বলল, “এসেছিল বটে একটা পাগলা মতো লোক। আমি চোরাই জিনিস দেখেই বুঝতে পারি কিনা। তাই তাকে বেশি পাত্তা দিইনি। চোর চোট্টাদের সঙ্গে কারবার করে কি মরব রাজামশাই?”
বিশু পাল দুঃখের গলায় বলল, “আহা, ডবল দামের কথা আগে জানলে কিছু জিনিস কিনে রাখতাম।”
রাখাল বিশ্বাসও বলল, ওঃ বড় ভুল হয়ে গেছে। লোকটা আমার বাড়িতেও এসেছিল বটে। তা রাজামশাই বাঁশিটা কি রুপোয় বাঁধানোনা হলেও চলবে? আমার সেজো ছেলে গুলু কয়েকদিন হল একটা বাঁশি হাতে ঘোরাঘুরি করছে দেখছি।”
নরেন্দ্রনারায়ণ দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “না, আমাদেরটা রুপোয় বাঁধানো এবং অনেক দিনের পুরনো। ও বাঁশি যার-তার হাতে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক।”
ক্লাস ফাঁইভ থেকে সিক্সে উঠতে সত্যগোপালের লেগেছিল দু’বছর। সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে পাক্কা তিন বছর। সেভেন থেকে এইটে উঠতে আরও তিন। প্রতি ক্লাসে উঠেই মনে হত, পরের ক্লাসটা কত উঁচুতে রে বাপ! তবু সে হাল ছাড়েনি। বিস্তর মেহনতে হাঁচোড়পাঁচোড় করে সে একদিন ক্লাস টেনেরও চৌকাঠ ধরে ফেলল। হেডস্যার পান্নালালবাবু পর্যন্ত অবাক হয়ে বলে ফেললেন, “সুয্যি কি পশ্চিমে উঠল নাকি রে সতু, তুইও ক্লাস টেন-এ উঠে পড়লি! বাঃ বাঃ, বড় খুশি হলুম। আর বছরদশেক আমার চাকরি আছে, তার মধ্যেই মাধ্যমিকের বেড়াটা ডিঙিয়ে যা তো বাবা!”
তা হেডস্যারের স্বপ্ন সার্থক করেছিল সত্যগোপাল। দশ বছর নয়, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে মাত্র চার বছরের চেষ্টায় মাধ্যমিকও পাশ করে ফেলল।
লোককে অবাক করে দেওয়ায় সত্যগোপালের জুড়ি নেই। মাধ্যমিক পাশ করে সে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে সমাজসেবায় নেমে পড়ল। সবাই জানে যে, সমাজসেবা মানে ভেরেণ্ডা ভাজা। সুতরাং সবাই ধরে নিয়েছিল সত্যগোপালের কিছু হবে না। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সবাইকে ফের অবাকই করে দিয়ে সে গোটা তল্লাটের একজন কেষ্টবিষ্ট হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, এলাকার যত স্কুল কলেজ আছে সে সবকটারই গভর্নিং বডির মেম্বার কিংবা প্রেসিডেন্ট, সব কটা ক্লাবের সে চেয়ারম্যান কিংবা সেক্রেটারি, পঞ্চায়েতের চাঁই, গরিব গুর্বোর নেতা। তল্লাটে যত সভা সমিতি হয় সব জায়গায় তার ডাক পড়ে। হয় সভাপতি, নয় প্রধান অতিথি, কিংবা বিশেষ অতিথি। যে স্কুলে সে পড়ত সেই স্কুলের চেয়ারম্যান হওয়ার পর পান্নাবাবু তো হাঁ। সে এমন হাঁ যে কিছুতেই বন্ধ হয় না। শেষে প্রভঞ্জন ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশনের ছুঁচ উঁচিয়ে ধরার পর সেই হাঁ বন্ধ হল।
পান্নালালবাবুকে সান্ত্বনা দিতে এসে মনোরঞ্জন কম্পাউন্ডার বলল, “ও হে পান্নালাল, এ হল ভাগ্যের খেলা। ভাগ্য জিনিসটা কেমন জানো? সোঁদরবনের বাঘ। কোথায় যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে টেরটিও পাবে না। হঠাৎ ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়ে টুটি কামড়ে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে সাকসেসের চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে বসে বসে কলসা নাড়বে। বুঝলে!”
পান্নালালাবাবু বুঝলেন কি না বোঝা গেল না। তবে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। ছাত্রের কৃতিত্ব দেখে তিনি বিশেষ পুলকিত হয়েছেন বলে মনে হল না।
যাই হোক, সত্যগোপাল এখন একজন ভারী ব্যস্ত মানুষ। এখানে উদ্বোধন, সেখানে বৃক্ষরোপণ, কোথাও মূর্তি উন্মোচন, তারপর রক্তদান শিবির, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান– সত্যগোপালের কি নাওয়া-খাওয়ার সময় আছে। সভা-সমিতির ছাড়া সে থাকতেও পারে না। তার ভারী আইঢাই হয়।
আজ ময়নাগড়ে বামাসুন্দরী কলেজে বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা আলোচনা সভা ছিল। সভাপতির ভাষণ দিতে উঠে সত্যগোপাল বলল, “আমাদের চারদিকে তো বিজ্ঞান ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চারদিকে যেন বিজ্ঞানের ঢেউ খেলছে। এই যে হাতে হাতঘড়ি চলছে, বিজ্ঞান। ওই যে মাথার ওপর পাখা ঘুরছে, বিজ্ঞান। ওই যে পকেটের ডটপেনটা, বিজ্ঞান। এই যে ধুতি-জামা পরে আছি, বিজ্ঞান, মোটরগাড়ি চলছে, রেলগাড়ি ছুটছে, এরোপ্লেন উড়ছে, সব বিজ্ঞান, সব বিজ্ঞান। এই যে মাইকে কথা বলছি এটা অবধি বিজ্ঞান। কিছুদিন আগে শহরে গিয়ে দেখে এলাম, সেখানে বিজ্ঞানের একেবারে মোচ্ছব লেগে গেছে। সর্বত্র কেবল কম্পাউন্ডার আর কম্পাউন্ডার। অফিসে কম্পাউন্ডার, ব্যাঙ্কে কম্পাউন্ডার, ডাকঘরে কম্পাউন্ডার, হাসপাতালে কম্পাউন্ডার। শোনা যাচ্ছে, এবার থেকে কম্পাউন্ডাররাই সব কিছু করবে! চাষবাস, চিকিৎসা, হিসেবনিকেশ, চিঠিপত্র লেখা, সবই নাকি করবে কম্পাউন্ডার। এমনকী তারা ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে, কলকারখানা চালাবে। মানুষ গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে শুধু।”
শ্রোতাদের মধ্যে মনোরঞ্জন কম্পাউন্ডার ছিল। শ্রোতারা খুব হাসাহাসি করছিল বটে, কিন্তু সে চিন্তিত মুখে পাশে বসা গিরিন খাসনবিশকে ফিসফিস করে বলল, “কম্পাউন্ডারদের ঘাড়ে এত কাজ চাপিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে ভায়া? এই বুড়ো বয়সে আমি কি অত কাজ পেরে উঠব? এ তো খুব চিন্তার কথা হে।”
গিরিন খাসনবিশের ওষুধের দোকান। সে চাপা গলায় বলল, “ভাবছেন কেন? এ তো দেখছি কম্পাউন্ডারদের কপাল খুলে গেল! যাকে বলা যায় কম্পাউন্ডারদের স্বর্ণযুগ! পেটেন্ট ওষুধের দাপটে কম্পাউন্ডারদের চাকরি যাওয়াতেই বোধহয় সরকার বাহাদুর নড়েচড়ে বসেছে। এতদিনে তাদের হিল্লে হল।”
“তা বলে ছবি আঁকা! কবিতা লেখা! ওসব কি পেরে উঠব?”
“চেষ্টা করলে লোকে কি না পারে বলুন!”
সত্যগোপাল হাসি হাসি মুখে বলল, “বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অবদান হল ওই কম্পাউন্ডার।”
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সচ্চিদানন্দবাবু পাশ থেকে সসম্ভ্রমে চাপা গলায় বললেন, “ওটাকে কেউ কেউ কম্পিউটারও বলে থাকে।”
সত্যগোপাল একটু অবাক হয়ে বলে, “বলে নাকি?”
কলেজের ফিজিক্স ল্যাবরেটারির জন্য দু’লাখ টাকার একটা সরকারি অনুদান কিছুদিন আগে এই সত্যগোপালই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। তা ছাড়া সচ্চিদানন্দবাবুর সেজো মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধও হচ্ছে আবার সত্যগোপালের শালার সঙ্গে। তাই সচ্চিদানন্দবাবু খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “বললেও হয়। কম্পাউন্ডারও যে চলে না তা নয়, তবে কম্পিউটার কথাটারই চল একটু বেশি আর কী।”
প্রবল হাততালির শব্দে অবশ্য সচ্চিদানন্দবাবুর কথা শোনা গেল না।
হাতজোড় করে সত্যগোপাল সমবেত শ্রোতার হাততালি হাসি হাসি মুখ করে গ্রহণ করল। সে যখনই যেখানে বক্তৃতা করে সেখানেই হাততালির একেবারে বন্যা বয়ে যায়। অবশ্য একথাও ঠিক যে, সব হাততালি সবসময়ে জায়গামতো পড়ে না, উলটোপালটা জায়গাতেও পড়ে। যেখানে পড়ার কথা নয়, সেখানেও। এই তো সেদিন গোবিন্দপুরের বৃক্ষরোপণ উৎসবে গিয়ে বক্তৃতায় তাড়াহুড়োয় বৃক্ষকে বিক্ষ বলে ফেলেছিল বলে খুব হাততালি পড়ল। তারপর গয়েশবাবুর শোকসভাটায় হল কী, তিরোধান কথাটা ভুল করে অন্তর্ধান বলে ফেলেছিল সত্যগোপাল। হাততালি আর থামতে চায় না। তা হোক, উলটোপালটা পড়লেও ওই হাততালিই সত্যগোপালকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওই হাততালিই তাকে চাঙ্গা রাখে।
হাততালি তখনও থামেনি, সত্যগোপালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্যাংলা এসে তার কানে কানে বলল, “ওদিকে যে পালঘাটে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভার সময় পার হয়ে যাচ্ছে দাদা। দেখে এলাম সভাপতির মালা শুকিয়ে গেছে, প্রধান অতিথি বুড়ো নিবারণবাবু টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাদা, তাঁর নাক ডাকছে। আরও ভয়ের কথা হল, সভার মাঠেই বাজারের ষাঁড় বাবুরাম রাতে এসে শোয়। সে এসে পড়লে সভা ভেঙে যাবে।”
সত্যগোপাল “তাই তো!” বলে তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়ল। সভায় পৌঁছে দেখা গেল, মহিলারা রান্না চাপাতে বাড়ি ফিরে গেছে, ফাঁকা জায়গায় বাচ্চারা হইহই করে খেলছে, দু-চারজন লোক এধারে ওধারে বসে গুলতানি করছে। কর্মকর্তারা অবশ্য সত্যগোপালকে খুব খাতির করে নিয়ে মঞ্চে তুলে দিল। সমিতির সম্পাদক বলল, “একটু তাড়াতাড়ি করবেন সত্যবাবু। ওই বাবুরাম ষাঁড়টা বড় বজ্জাত। যেমন গোঁ, তেমনি তেজ। তার আসার সময়ও হয়েছে কিনা।”
মৎস্যজীবীদের সভায় মাছ নিয়ে অনেক কথাই বলার ছিল সত্যগোপালের। যেমন, ভগবান একবার মৎস্য অবতার হয়ে এসে পৃথিবী উদ্ধার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের একটা কোটেশনও ঠিক করা ছিল, মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে, এখন সুখেতে তারা জলক্রীড়া করে। তারপর আরও কোটেশন, মৎস্য মারিব, খাইব সুখে এবং মাছের মায়ের পুত্রশোক, এবং মাছের তেলে মাছভাজা। তা ছাড়া না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে এবং কৈ মাছ ভাজা খেতে শৈল গেছে ভুলে–এ দুটো কোটেশনও জুতসই জায়গায় লাগানোর মতলব ছিল তার। কিন্তু সবে ‘ভাই ও বন্ধুগণ” বলে বক্তৃতা শুরু করতেই কে বা কারা যেন বাঁ ধার থেকে চেঁচিয়ে উঠল। “ওই যে, বাবুরাম আসছে!”
সত্যগোপাল যে বাবুরামকে যমের মতো ডরায় তার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় সে একদিন ইস্কুল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ফেরার পথে কলা খেয়ে কলার খোসাটা বাবুরামের গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিল। বাবুরাম তাতে কিছু মনে করেনি, খোসাটা অবহেলার সঙ্গে খেয়ে নিয়ে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল। কিন্তু বচা বলল, “এ তুই কী করলি সতু? বাবুরাম কে জানিস! সাক্ষাৎ শিবের চেলা। সবাই বাবুরামকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। এঁটো কলার খোসা ছুঁড়ে মারলি, তোর পাপ হবে না?!!”
সত্যগোপাল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “তা হলে কী করব?”
“যা, ওকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আয়।”
কাজটা সহজ নয়। বুকের পাটা দরকার। কিন্তু সামনেই অ্যানুয়েল পরীক্ষা, এ সময়ে ভগবান পাপ দিয়ে ফেললে যে, পরীক্ষায় ডাব্বা মারতে হবে সেটা চিন্তা করেই সত্যগোপাল মরিয়া হয়ে সন্তর্পণে গিয়ে কী করে বাবুরামের সামনের দুটো পায়ের খুর ছুঁয়ে মাথায় ঠেকিয়েই দৌড়ে পালিয়ে এল।
বচা বলল, “দূর! তুই তো ওর হাতে প্রণাম করলি। হাতে প্রণাম করলে কি পাপ কাটে?”
“যাঃ, ওটা হাত কেন হবে? গোরুর তো চারটেই পা।”
“তোকে বলেছে! পা বলে মনে হলেও বাবুরামের সামনের পা দুটো মোটেই পা নয়, হাত। পিছনের পা দুটোই আসল পা।”
এ কথায় একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল সত্যগোপাল। কে জানে বাবা, হতেও পারে। বুক বেঁধে সুতরাং সে দ্বিতীয়বার বাবুরামের দিকে এগিয়ে গেল। এবং খুব দুঃসাহসের সঙ্গে পিছনের পা দুটোর খুরে হাত দিল।
কলার খোসা ছোঁড়া এবং প্রথমবার পায়ের ধুলো নেওয়া পর্যন্ত সহ্য করেছে বাবুরাম। কিছু বলেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার তার পায়ে হাত দেওয়ায় বাবুরাম অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে তেড়ে ফুড়ে উঠে এমন তাড়া লাগাল সত্যগোপালকে যে আর কহতব্য নয়। সত্যগোপাল শেষ অবধি পালঘাটের খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়। সত্যগোপালের ধারণা, বাবুরাম আজও ঘটনাটা ভোলেনি। কালেভদ্রে তাকে দেখলে বাবুরাম দূর থেকেও তার দিকে আড়ে আড়ে চায় আর ফোঁস ফোঁস করে।
সুতরাং বাবুরাম আসছে শুনে যদি সত্যগোপাল মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়িমরি দৌড় লাগায় তাতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। এই দৌড়টা অতি ছোঁয়াচে জিনিস। সত্যগোপালকে দৌড়োতে দেখে বুড়ো নিবারণবাবুও মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় লাগালেন। পিছনে প্যাংলাও।
ইস্কুলে লেখাপড়ায় ডাব্বা মারলেও স্কুলের স্পোর্টসে বরাবর সত্য ফাস্ট সেকেন্ড হয়ে প্রাইজ পেয়েছে। দৌড়টা তার ভালই আসে। জেলেপাড়ার রাস্তা ধরে সে দৌড়োচ্ছিলও ভালই। কিন্তু দেখা গেল আশি বছরের নিবারণবাবুও কম যান না। তিনি প্যাংলাকে ছাড়িয়ে সত্যগোপালকে প্রায় ধরে ফেললেন। ছুটতে ছুটতেই বললেন, “হুঁ হুঁ বাবা, বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখেছ, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে।”
অবাক সত্যগোপাল বলে, “তাই দেখছি! রোজ সকালে উঠে দৌড় প্র্যাকটিস করেন নাকি?”
“পাগল হয়েছ? ওসব আমার পোষায় না। তবে আমার একটা কেলে গোরু আছে। সেটা ভয়ানক পাজি। রোজই খোঁটা উপড়ে পালায়। সেটাকে ঘরে আনতে রোজ বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আর এই করতে গিয়ে আমার হাঁটুর বাত, মাজার ব্যথা, অনিদ্রা সব উধাও হয়েছে। আজকাল খুব খিদে হয়, ঘুমটাও হচ্ছে পাথরের মতো। সব জিনিসের ভাল আর মন্দ দুটোই আছে, বুঝলে ভায়া? এখন তো মনে হয়, শূন্য গোয়ালের চেয়ে দুষ্টু গোরুই ভাল।”
সত্যগোপাল হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “বাবুরাম কি এখনও তেড়ে আসছে?”
নিবারণবাবু অবাক হয়ে বললেন, “বাবুরাম। কোথায় বাবুরাম?”
“এই যে কে বলল, বাবুরাম আসছে!”
“দুর দূর! তুমিও যেমন! বাবুরাম আসবে কি, আজ জামতলায় নবীন পালের বাড়িতে মদনমোহনের কাঁঠালভোগ। রাজ্যের কাঁঠাল এসেছে ভোগে। বাবুরাম বিকেল থেকেই সেখানে থানা গেড়েছে। যা কাঁঠাল সেঁটেছে তার আর নড়ার সাধ্যি নেই।”
“তা হলে আপনি ছুটছেন কেন?”
“আহা, আমি তো তোমার দেখাদেখি ছুটছি। তোমাকে অমন আচমকা ছুটতে দেখে ভাবলাম, সত্যগোপাল যখন ছুটছে তখন নিশ্চয়ই কোনও বিপত্তি ঘটেছে।”
সত্যগোপাল দাঁড়িয়ে খানিক দম নিল। ছিঃ ছিঃ, এখন ভারী লজ্জা করছে তার। পাবলিকের সামনে ওরকম কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসাটা তার উচিত হয়নি। তার ভাবমূর্তিটা যে একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল!
বাড়ি ফেরার সময় প্যাংলা অবশ্য বলল, তার ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি হয়নি। পরিস্থিতির চাপে মাঝে-মাঝে নেতাদের ভাবমূর্তি টলোমলো হয় বটে, কিন্তু দু-চারদিনের মধ্যেই আবার আঁট হয়ে বসে যায়। তার কারণ, পাবলিক কোনও ঘটনাই বেশিদিন মনে রাখতে পারে না।
সত্যগোপাল দুঃখ করে বলল, “মাছের ওপর বারোটা কোটেশন মুখস্থ ছিল রে, সেগুলো যে জলে গেল।”
“তাতে কী, বক্তৃতা তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। এই তো কাল কালীতলায় নবীন সঙ্ঘের সঙ্গে ভবতারিণী বিদ্যাপীঠের বিন্ধ্যবাসিনী স্মৃতি শিন্ডের ফাঁইনাল ফুটবল ম্যাচেও আপনি সভাপতি। কোটেশনগুলো সেখানেই ঝেড়ে দেবেন।”
“দূর! ফুটবলের সঙ্গে কি মাছ যায়!”
“আহা, লোকে অত খতিয়ে দেখে না। এই তো সেদিন তাঁতিপাড়ায় অষ্টপ্রহর মহানাম সংকীর্তনের উদ্বোধনী ভাষণে আপনি পাটচাষিদের দুঃখ আর চিংড়ির ফলন বাড়ানোর কথা বললেন, কেউ কিছু আপত্তি করেছে কি? লোকে তো হাততালিও দিল। বললুম না, লোকে অত তলিয়ে বোঝে না। আপনার বক্তৃতার ডেস্থ বোঝার এলেমই নেই ওদের।”
বাড়ির বাইরেই একটা হোঁকা এবং একজন রোগাটে চেহারার লোক পায়চারি করছিল। রোগা লোকটার পরনে দামি ধাক্কাপেড়ে ধুতি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, বাবরি চুল, পুরুষ্টু গোঁফ, পায়ে নাগরা। দেখলে সম্রম হয়। সত্যগোপালকে দেখে এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, “আপনিই সত্যগোপাল ঘোষ? বড়ই সৌভাগ্য আমার।”
সত্যগোপাল বলল, “সভা কোথায় বলুন তো!”
“আজ্ঞে, সভা নয়।”
“তবে কি ফাংশন?”
“আজ্ঞে না।”
“তা হলে নিশ্চয়ই ফুটবল ম্যাচ!”
“আজ্ঞে না। ওসব নয়।”
“কেত্তনের আসরেও আমি যাই বটে। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। খোল কত্তালের শব্দে আমার বড় মাথা ধরে যায়। তা আপনাদের কেত্তনটা হবে কোথায়?”
“কেত্তনের শব্দে আমার আবার মাথা ধরে না, মাথা ঘোরে।”
“সেটাও খুব খারাপ জিনিস।”
“খারাপ বলে খারাপ! আমাদের ঠাকুরদালানে তো রোজ সন্ধের পর কেত্তনের আসর বসত। বড় বড় কীর্তনীয়া আসত। আমরা ঠাকুর্দা রাজা তেজেন্দ্রনারায়ণের আবার খুব কেত্তনের বাই ছিল কিনা।
“রাজা! আপনি কি রাজপুত্তুর নাকি মশাই! আগে বলতে হয়! এঃ হেঃ, আপনার এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা তো ঠিক হচ্ছে না! কী বলিস প্যাংলা?”
প্যাংলা বিগলিত হয়ে বলল, ‘সর-ননী খাওয়া শরীর তো, ঘ্যাচাং করে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।”
লোকটা মৃদু হেসে বলল, “আরে না না। রাজত্বই নেই তো রাজা। রাজাগজা নই। ওই পৈতৃক বাড়িটাই যা আছে। ঠাটবাট বজায় রাখাই কঠিন।”
প্যাংলা বলল, ‘কিন্তু আপনার ঠাটবাট তো কিছু কম দেখছি না। আঙুলে আংটি ঝিলিক মারছে, তা ধরুন দু-চার হাজার টাকা তো হবেই! পায়ের জুতোজোড়াও চমকাচ্ছে, তা ধরুন এক দেড়শো টাকা হেসেখেলে দাম হবে না?”
তা হবে বোধহয়। দেওয়ান জ্যাঠা জানেন। কেনাকাটা তো আর আমরা করি না। দেওয়ান জ্যাঠাই করেন।”
সত্যগোপাল বলল, “তা রাজবাড়িটা কি কাছেপিঠে কোথাও?”
“বেশি দূরেও নয়। কেতুগড়ের নাম শুনেছেন কি?”
সত্যগোপাল একটু ভাবিত হয়ে বলল, “তা শুনেছি বোধহয়। নামটা যেন চেনা-চেনা ঠেকছে। কী বলিস রে প্যাংলা?”
“কেতুগড় তো! তা কেতুগড়ের নাম কি আর শুনিনি। কত জায়গারই নাম নিত্যি শুনছি, কেতুগড় আর কী দোষ করল? তা কেত্তনটা হচ্ছে কবে?”
মাথা নেড়ে লোকটা বলল, “কেত্তন হচ্ছে না। আমি বর্তমান রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের ভাইপো নরেন্দ্রনারায়ণ। রাজবাড়ি থেকে সম্প্রতি কিছু জিনিস চুরি গেছে। খবর আছে জিনিসগুলো এই ময়নাগড় এবং আশেপাশেই আছে। আমরা সেগুলো উদ্ধার করতে বেরিয়েছি। বিশেষ করে রুপোয় বাঁধানো একটা বাঁশি।”
সত্যগোপাল অবাক হয়ে বলল, “বাঁশি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বহু পুরনো জিনিস। শ’দেড়েক বছর আগে কেতুগড় রাজবাড়ির দরবারে মোহন রায় নামে একজন বাঁশুরে ছিলেন। ভবঘুরে আর ক্ষ্যাপাটে গোছের লোক। মাঝে মাঝে কোথায় উধাও হয়ে যেতেন। কেউ বলত লোকটা মস্ত সাধক, কেউ বলত জাদুকর। তাঁকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। চুরি যাওয়া বাঁশিটা তাঁরই। আমরা সেটা উদ্ধার করতে এসেছি। হাজার টাকা পুরস্কার। আপনি তো গণ্যমান্য লোক, সবাই আপনাকে ভারী ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আপনি একটু চেষ্টা করলে বাঁশিটা উদ্ধার হয়।”
“বাঁশিটাই খুঁজছেন কেন বলুন তো?”
“আজ্ঞে, পুরনো জিনিস তো, একটা স্মৃতিচিহ্ন। তা ছাড়া লোকে বলে, ও বাঁশি আর কেউ বাজাতে পারে না। যদিও বা কেউ বাজাতে পারে তা হলে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়বে। আমরা আসলে কথাটা বিশ্বাস করি না। গুজবই হবে। তবু বলাও তো যায় না। আমরা চাই
বেঘোরে একটা লোকের প্রাণ যাক। আপনি একটু চেষ্টা করলে বাঁশিটা উদ্ধার হয়। একটা লোকের প্রাণও বাঁচে।”