Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৈত্রেয় জাতক || Bani Basu » Page 8

মৈত্রেয় জাতক || Bani Basu

মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – অতি প্রত্যূষে স্নান সেরেছেন সুমনা

আজ অতি প্রত্যূষে স্নান সেরেছেন সুমনা। তাঁর হৃদয়ে আজ অভ্যস্ত প্রশান্তি। কয়েকদিন আগেকার তমিস্রা যেন মন্ত্রবলে কোথায় অপসৃত হয়েছে। কহ্না তাঁর মাথায় উপর স্নিগ্ধ জল ঢালছে। হাত পা সব ভালো করে মেজে দিচ্ছে ধনপালী। সুমনা হাসিমুখে তাড়না করছেন ধনপালীকে— হয়েছে, হয়েছে আর কত মাজবি? পা দুটি যে রক্তবর্ণ হয়ে উঠল!

ধনপালী বলে—আর একটু দেবী, আর একটু ধৈর্য ধরুন। বসন্ত সমাগমে পুরাতন ত্বকগুলি জীর্ণ হয়ে নূতন ত্বক জন্মাচ্ছে, সেই নূতন ত্বককে পথ করে দিতে হবে তো! আর ওই নূতন ত্বকের বর্ণ হল পদ্মের কোরকের মতো। আমি মেজে মেজে আপনার ত্বক রক্তবর্ণ করিনি দেবী!

—ভালো ভালো পালি, প্রসাধনাচার্যা পালি, বিসাখার কাছে যে শুনলাম লিপি অভ্যাস করছিস, কী হল?

কহ্না উত্তর দিল—তা যদি বলেন দেবি, ও সবে পারদর্শী হয়ে উঠছে ময়ূরী। আমরা দুজনে ওই যে বললেন প্রসাধনাচাৰ্যা…

সুমনা হেসে বললেন—আচাৰ্যা হলে কী কী শেখাবি কহ্না!

ধনপালী বলল— ও কী জানে! আমি কী শেখাবো শুনুন। প্রসাধনে প্রথম স্থান সংবাহনের। এতে দেহে রক্তগুলি অবাধে চলাচল করতে পায়, ফলে ত্বকে আসে দীপ্তি, সংবাহনের পর প্রাণশক্তি কর্মশক্তি দ্বিগুণিত হয়ে যায়। সংবাহনের প্রক্রিয়া আছে, সঠিক না জেনে করলে লাভের চেয়ে হানিই অধিক।

—এই বিদ্যাটি কি তুই কুক্ষিগত করে রেখে দিবি ঠিক করেছিস?

ধনপালী বলল—তা নয়, কিন্তু যথার্থ শিষ্যা না পেলে শেখাবোও না।

কহ্না বলল—না দেবি সংবাহনই সব নয়। দুগ্ধস্নান করলে ত্বকের কোমলতা, মসৃণতা বাড়ে, আর গৌরবর্ণা হতে হলে হিঙ্গুলচূর্ণ ব্যবহার করতে হয়। চর্মার হিঙ্গুল ব্যবহার করলে শঙ্খশ্বেত বর্ণ হবে, হরিদ্রাভ বর্ণ যদি চান তো শুকতণ্ডুক হিঙ্গুল চাই, আর পদ্মকোরকের মতে বর্ণ পেতে হলে হংসপাদ হিঙ্গুলই প্রশস্ত। তবে দীর্ঘদিন হিঙ্গুল ব্যবহার করা ভালো নয়, পারদ আছে তো! ত্বকে যাতে কোনপ্রকার ব্যাধি না-হয় সেইজন্যই হরিদ্রা কাঁচা অবস্থায় পেষণ করে প্রলেপ লাগানো উচিত।

ধনপালী ও সুমনা হাসছেন দেখে কহ্না অপ্রতিভ হয়ে থেমে গেল।

সুমনা বললেন—আমাদের সাকেতের গৃহে যে নিষাদ-দাসী রন্তিকা রয়েছে ওর গাত্রবর্ণ শ্বেতকাঞ্চন করতে পারিস?

কহ্না বলল—আপনি পরিহাস করছেন দেবী, কিন্তু নিয়মিত এগুলি ব্যবহার করলে রন্তিকারও গাত্রবর্ণের উন্নতি হবে, তবে প্রয়োজনই বা কী! দেবী উপ্‌পলবননাকে দেখেছেন? নীল পদ্মের অভ্যন্তরের মতো গাত্রবর্ণ। কী অপরূপ সুন্দরী! বিসাখা ভদ্দার রূপ যদি বসন্তের সকাল হয়, যখন চতুর্দিকে গাছে গাছে পত্রোদ্গম হচ্ছে, সূর্যরশ্মি বক্রভাবে পড়ছে নির্মল তড়াগের জলে, তা হলে উপ্‌পলবন্‌না যেন শীতরাত্রির আকাশ। নক্ষত্রময়, কৃষ্ণদীপ্তি। স্তব্ধ, বোধের অতীত, অনুপাখ্য।

—কে বলে কহ্না তুই প্রসাধনচর্যা ছাড়া আর কিছু শিখিসনি—সুমনা বললেন, তাঁর মুখে কৌতুকের সঙ্গে প্রশংসার, অভিব্যক্তি মিশে আছে।

কহ্না লজ্জা পেয়ে নীরব হয়ে গেল। কিন্তু ধনপালী উৎসাহিত হয়ে বলল—কহ্না আজকাল অনেক সূক্ত রচনা করে দেবী, ওকে বলতে বলুন। ওর কিন্তু সত্যই নতুন নতুন ক্ষমতা জন্মাচ্ছে। একমাত্র বিশাখা ভদ্দা ছাড়া আর কারও সাক্ষাতে বলে না।

কিছুক্ষণ সাধ্য-সাধনার পর কহ্না সুমনার স্নান শেষ করিয়ে তাঁর গায়ে একটি স্থূল পট্টবসন জড়িয়ে দিল। তারপর নতমুখে ধীরে ধীরে বলতে লাগল—

নখের প্রভায় মূর্ছা যায় লোকে

এতো রূপ!

দু হাতে বর্ষণ করেও ফুরোয় না

এতো ধন।

জয়ধ্বনি ওঠে দিকে দিকে

এতে যশ!

শুধু দর্পণে বিম্বিত দেখি দাসী।

বিস্মিত চোখে কহ্নার দিকে চেয়ে সুমনা বললেন— কহ্না, পালী, বিসাখা তোদের মুক্তি দিয়েছে না!

ধনপালী বলল—হ্যাঁ দেবী, আমরা যেদিন ইচ্ছা চলে যেতে পারি। কিন্তু যেতে ইচ্ছা হয় না।

কহ্না ধীরে ধীরে বলল—কোথায়ই বা যাবো দেবী?

—বিসাখা তোদের বিবাহের ব্যবস্থা করছে না?

—বিবাহ করলেও তো দাসীই থাকব!

সুমনা চমকে উঠলেন, কহ্না বলল—কারও না কারও ইচ্ছাধীন তো থাকতেই হবে।

—স্বেচ্ছাচারী হতে চাস!

—স্বেচ্ছাচারেই বা সুখ কই! সেও তো স্বভাবের দাসীত্ব দেবি!

—তা হলে তোর বিচারে মুক্ত কে? আমাকে মুক্ত মনে করিস!

—না দেবি! গহপতি আপনাকে বাঁধেন না, আপনার অনেক ধন, অনেক রূপ, কিন্তু কই মুক্ত আপনি! কার ইচ্ছায় কদিন ধরে আপনার মুখ আঁধার ছিল? আহারে রুচি ছিল না। প্রসাধনে মন ছিল না, দুঃখিনী অনাথার মতো ভূমিশয্যা অবলম্বন করেছিলেন?

আবার কার ইচ্ছায় এমন করে হেসে উঠেছেন? কহ্নার সঙ্গে পালীর সঙ্গে রসালাপ করছেন?

—কোথা থেকে এরূপ কথা বলতে শিখলি কহ্না?

—কী জানি? কহ্না তার কালো চোখ দুটি সুমনার দিকে পরিপূর্ণ মেলে বলল।

—তুই কি ভিক্ষুণী হবি, কহ্না?

—স্থির করতে পারি না দেবী, ভিক্ষুণীদের কুটিরে যাই, সেখানেও শান্তি দেখি না।

—সে কী? কী দেখিস তবে?

—ছব্‌বগ্‌গীয় (ষড়বর্গীয় ছ জনের দল) ভিক্ষুরা আছে, তারা ভিক্ষুণীদের গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়, অশ্লীল বাক্য বলে, পথে ঘাটে দাঁড়িয়ে কৌতুক করে। কিন্তু তথাগত নিয়ম করেছেন ভিক্ষুণীরা কখনও ভিক্ষুদের বিচার করতে পারবে না। নিন্দা করতে পারবে না। তাই নীরবে সব সইতে হয়।

—বলিস কী? শুনেছিলাম অবশ্য অট্‌ঠগুরুধম্ম আজীবন পালন করার শর্তে মহাপ্রজাবতী ভিক্ষুণীসঙ্ঘ স্থাপন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তাই বলে ভিক্ষুণীদের অপমান হবে, তাঁরা কিছু বলতে পারবেন না?

কহ্না বলল—জানেন তো দেবী, কয়েকজন ভিক্ষুণী আছেন কেউ কেউ পূর্বজীবনে দাসী ছিলেন। কিংবা দরিদ্রঘরের গৃহিণী ছিলেন। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন—কী শ্ৰম! কী শ্ৰম! পব্‌বজ্যা নিয়ে অন্তত তিন প্রকার বক্র পদার্থ থেকে তো মুক্তি পেয়েছি—উদূখল, মুষল ও কুব্জস্বামী। আবার কয়েকজন আছেন, নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে যে-গৃহে ভালো ভিক্ষা পাওয়া যায় সেখানে যান, অন্যদের যেতে দেন না সাবধানে গন্তব্য লুকিয়ে রাখেন। …এখন এই যদি সংসারবিমুক্তাদের অবস্থা হয় তো সেখানে গিয়ে মুক্তি সন্ধান করে কী লাভ?

সুমনা অবাক হয়েছিলেন। ময়ূরী তাঁর বেশবাস নিয়ে আসতে তিনি যেন বহু দূর থেকে ফিরে এলেন।

ময়ূরী বলল—দেবী এত কী চিন্তা করছেন?

ধনপালী বলল—দ্যাখ না, কহ্না একরাশি কথা বলে দেবীকে উৎকণ্ঠিত করল।

কহ্না হাত জোড় করে মার্জনা চাইতে যাচ্ছিল, সুমনা তার হাত দুটি ধরে তাকে নিবৃত্ত করলেন, তারপর বললেন—না না পালি, ও কথা বলিস না, আচ্ছা কহ্না ভিক্ষুণী সঙ্ঘের মধ্যে আর কেমন নারী দেখিস?

—সকলে তো আর এক স্থানে থাকেন না দেবি, যেমন যেমন পান তেমন তেমন থাকেন, ভিক্ষুদের জন্য ওইরূপ রাজকীয় বিহার, ভিক্ষুণীদের জন্য কিছুই নেই। সন্তানশোকে অধীর হয়ে যাঁরা পব্‌বজ্জা নিয়েছেন যেমন ভিক্ষুণী গোতমী, ভিক্ষুণী পটাচারা এঁরা তো সদাই ধ্যানে মগ্ন থাকেন, স্বপ্নচালিতের মতো দৈনন্দিন কর্ম করে যান, শুনতে পাই শীঘ্রই অর্হত্ত্ব লাভ করবেন; কয়েকজন আছেন যেমন ভদ্দা কুণ্ডলকেশা…জানেন তো ইনি হত্যা করেছিলেন…

—হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, দুর্বৃত্ত স্বামী ভদ্দাকে হত্যা করার অপচেষ্টা করায় ভদ্দা তাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়…

—শুনেছি দেবি; ইনি অত্যন্ত তেজস্বিনী, আমার কেমন ভয়-ভয় করে। আর অগ্গসাবিকা খেমা তো রূপে-বৈদগ্ধ্যে অতুলনীয়া, দূর থেকে দেখি যেমন করে মধ্যদিনের সূর্যকে দেখে মানুষে, ভুলতে পারি না তিনি রাজ্ঞী ছিলেন, রাজকন্যা ছিলেন। ভিক্ষুধম্ম গ্রহণ করলেও এইসব সংস্কার, পার্থক্য থেকেই যায় দেবি।

—আর দেবী মহাপ্রজাবতী? দেবী যশোধরা?

—ওঁরা তো বৈশালীতে। বৈশালীতেই সবচেয়ে বড় ভিক্ষুণী উপসয় (উপাশ্রয়) তো!

সুমনা বেশবাস শেষ করে নিলেন। অনেকদিন পরে তাঁর হৃদয়ের মধ্যে আবার সেই প্রথম যৌবনের স্মৃতি। কুশাবতী মল্ল…কুশাবতী মল্ল। সমস্ত হৃদয় দিয়ে যদি কাউকে শ্রদ্ধা করে থাকেন, তিনি হলেন কুশাবতীমল্ল। স্বরূপমল্ল ও কুশাবতীমল্ল। তাঁকে কত শিখিয়েছিলেন এঁরা। ধনুর্বাণচালনা, অসিচালনা, অশ্বারোহণ, মল্লবিদ্যা, হস্তি-বিদ্যা, শিখিয়েছিলেন দৌত্যকর্ম, রাষ্ট্রশাসনের মূল নীতিগুলি। কী উৎসাহ তখন! কী তেজ! প্রতিটি দিন মনে হত এই জীবন আমার, এই পৃথিবী আমার, এই আকাশ-বাতাস সবই বড় অনুকূল। স্বরূপমল্ল বলতেন— আকাশে সূর্যের মতো বাঁচতে হয়। বিমল শক্তি ও বোধির নম্র বিভায় ধীরে ধীরে মনুষ্যকুল আলোকিত করে, তারপর তেজে সব ক্ষুদ্র, অশুভ বস্তু পুড়িয়ে দিয়। স্বরূপের মত ছিল, নারী পুরুষ সবাইকে অস্ত্র ধরতে জানতে হবে। এখনও সুমনা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন স্বরূপের কণ্ঠস্বর: মল্লদের একসময়ে ছিল গোষ্ঠীজীবন। পশুপালন, মৃগয়া, রন্ধনাদি গৃহকর্ম, শিশুপালন সবই নারী-পুরুষ একত্রে করত। তারপর ভূমি শ্যামস্বর্ণ উপহার দিল, তখনও পাশাপাশি কস্‌সন করেছে নারী-পুরুষ, বীজবপন ও শস্য কাটার কাজ নারী, ভূমি প্রস্তুত, ভূমিতে লাঙল দেওয়া পুরুষ। শিশু যতদিন না একটু বড় হত মা গৃহে থাকত, শস্য বাছা, মণ্ড প্রস্তুত করা, চক্র ঘুরিয়ে মৃৎপাত্র নির্মাণ করা—এই সকল করত। তারপর বিদ্যা এলো। বালক-বালিকা তখনও একত্রে বিদ্যা শুনেছে। সঞ্চিত সম্পদ বাড়ল, গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার, সম্পদ আগে গোষ্ঠী পেত, এখন বিবাদ আরম্ভ হল, গোষ্ঠী পিতা গোষ্ঠীমাতা হয়ত অন্যায্য কর্ম করেছিলেন কোনও সময়ে, তাঁদের কথা কেউ মানল না, সব পিতারা একত্র হয়ে স্থির করল, তাদের সন্তানরা তাদের সম্পদ পাবে, নারীরাও অন্য কারো সন্তান যাতে ধারণ করতে না পারে, তাই তাদের স্বচ্ছন্দতা বন্ধ হতে থাকল, বন্ধ হল যুদ্ধ, বন্ধ হল বিদ্যা। এখন সেই মল্লরা কোথায়? জম্বুদ্বীপের ভূমিতে মল্ল-চিহ্ন না থাকারই মতো। কুশাবতী সেই বীর মল্লনারীদের শেষ চিহ্ন। কুশাবতীর বংশ বাঁচিয়ে রেখেছিল অস্ত্রবিদ্যার চর্চা। সেই কুশাবতীর ভাই বন্ধুল ও তার পত্নী মল্লিকার সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হল। ভাবতে ভাবতে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন সুমনা। সেই বন্ধুল যিনি ছিলেন মল্লকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অসিচালক, ধনুর্গ্রহ, তক্ষশিলায় পসেনদির সতীর্থ। ষড়যন্ত্র করে মল্লরা এই বীরপুরুষকে এমন ক্ষুব্ধ করল যে তিনি চলে গেলেন কোসল রাজ্যে। নিজের স্বাধীনতা চিরদিনের মতো বিসর্জন দিয়ে। মল্লিকার কাছে শুনছিলেন কীভাবে তার প্রথম সন্তান হবার সময়ে দোহদ পূর্ণ করতে বন্ধুল তাকে বৈশালীর অভিষেক হ্রদে স্নান করিয়ে এনেছিলেন। ওই হ্রদে শুধুমাত্র সংস্থানায়কদের অভিষেকস্নান হয়, সারাক্ষণ প্রহরা থাকে। মল্লিকাকে নিয়ে বন্ধুলের রথ যখন শ্রাবস্তীর দিকে ছুটে চলেছে প্রহরারত সৈনিকেরা তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করে। একটি সংকীর্ণ পথে যখন তারা দীর্ঘ একটি পঙ্‌ক্তিতে আসছিল, তখন বন্ধুল একটিমাত্র তীরে তাদের সবাইকে বিদ্ধ করেছিলেন।

কুশাবতীর কণ্ঠ শুনতে পান তিনি, তখন তাঁর চোদ্দ বছর বয়স, সবে রজোদর্শন করেছেন। কুশাবতী করুণ স্বরে বললেন—প্রকৃতির পাশে বাঁধা পড়ে গেলে সুমনা। এখন থেকে প্রতিটি পুরুষকে ভয় করে চলতে হবে পাছে সে তোমার গর্ভে অবৈধ সন্তান উৎপন্ন করে।

সুমনা বলেন—কেন আচার্যা, ছুরিকা রাখব সঙ্গে, তাছাড়া মল্ল কৌশলগুলি তো আছেই!

—তা সত্য। কিন্তু এগুলি প্রয়োগ করতে হবে, এটাই কি চরম দুঃখের কথা নয়? যার সঙ্গে একদিন পাশাপাশি কাজ করেছি, বিদ্যাভ্যাস করেছি, যুদ্ধ করেছি, যার প্রণয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি, তার বিরুদ্ধে আজ অস্ত্রধারণ করতে হচ্ছে এর চেয়ে সর্বনাশ আর কিছু আছে?

—কেন আচার্যা, পূর্বে কি পুরুষরা নারীদের প্রতি বলপ্রয়োগ করত না?

—কখনোই না। কোনও নারীর প্রতি আকর্ষণ জন্মালে, অনুরাগ জন্মালে তাকে প্রণয়-সম্ভাষণ করত মল্লপুরুষ, নারীর যদি তাতে অনুরাগ জন্মাতো তখনই তারা মিলিত হত।

—কিন্তু এই যে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিবাদ, কৌমে কৌমে যুদ্ধ। তখন তো শুনেছি, বিজিত নারীদের যথেচ্ছ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত, অত্যাচার করা হত।

—তখন নারী অস্ত্র ফেলে দিয়েছে সুমনা।

—সেই সময়ের থেকে অন্তত আমরা ভালো আছি। তাই নয় আর্যে!

—তা ঠিক। কিন্তু নারীর গর্ভধারণ ও প্রজাবৃদ্ধির ওপর এত গুরুত্ব দেওয়ায় নারীর সর্বনাশ তো হচ্ছেই, সমাজেরও সর্বনাশ হচ্ছে।

—কী ভাবে? —সুমনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, প্রজাবৃদ্ধির অর্থ তো শক্তিবৃদ্ধি?

—সুমনা, প্রিয় শিষ্যা আমার, যত প্রজাবৃদ্ধি হবে এই ভূমির জন্য, সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, বিবাদ ততই তীব্র হবে। ততই উদ্বৃত্ত হয়ে যাবে মানুষ। দেখো না, আমাদের গৃহে গৃহে কত দাস-দাসী! একটি পুরুষ অন্তত তিনটি কি চারটি স্ত্রী রাখছে। প্রতিটি স্ত্রীর যদি দশটি সন্তান হয়, তাহলে এক পরিবারে এক প্রজন্মে চল্লিশজন প্রজা বেড়ে যাচ্ছে। ভূমিতে আর কুলোচ্ছে না। নূতন ভূমি প্রয়োজন হচ্ছে। নূতন ভূমি না পাওয়া গেলে কয়েকটি মানুষ উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ভাবে আমি চোখের সামনে দেখতে পাই সমগ্র পৃথিবী প্রজায় ভরে গেছে, তাদের ভরণ করবার মতো ক্ষেত্ৰভূমি, বনভূমি, চারণভূমি নেই। পৃথিবী কম্পিত হচ্ছে লাঙলের আঘাতে, আবর্জনায় ভরে যাচ্ছে মুক্ত ভূমি। পুষ্করিণী, নদী সব নানারূপ মলে পরিপূর্ণ। বাতাস কলুষিত হয়ে যাচ্ছে এবং দাসেদের আর্তনাদে পরিপূরিত হচ্ছে এই জম্বুদ্বীপ। কয়েকজন মাত্র প্রভু, আর সবাই দাস। নারীরা তো দাসী বটেই। গৃহদাসী, গর্ভদাসী, রূপদাসী।

কুশাবতীর মতো চিন্তা করতে কাউকে আজ অবধি দেখেননি সুমনা। আজ কহ্নার কাছ থেকে শুনলেন গৃহশ্রমের বিপুল ভার থেকে মুক্তি পেতে প্রব্রজ্যা নিচ্ছেন নারীরা, অবাঞ্ছিত স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পেতে নিচ্ছেন। সন্তানহারা জননী, প্রেমকঞ্চিতা রমণী যে প্রব্রজ্যা নেন তা তিনি আগেই জানেন। এ নিয়ে হয়ত এত চিন্তা করতেন না, যদি না তাঁর নিজের কন্যাকে নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিত। বিশাখা, যাকে তিনি সর্বপ্রকার বিদ্যা, স্বাচ্ছন্দ্য ও মুক্তির অধিকার দিয়ে বড় করে তুলেছেন, যে বিশাখা রূপে গুণে, সেবায়, কর্মে, মহত্ত্বে নারীরত্ন, মনুষ্যরত্ন সেই বিশাখাকে কিনা বিবাহ করতে হল কৃপণ, নীচমনা মিগারের কুলে, তার নীচমনা, রমণীর মতো দেখতে পুত্র পুণ্যবর্ধনকে! হ্যাঁ, তাঁর কোনই সন্দেহ নেই পুণ্যবর্ধন একটি অতি সাধারণ পুরুষ, বিশাখার স্বামী হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই। তাঁর নিজের এই-ই ধারণা। ধনপালী তাঁকে সামান্যই ইঙ্গিত দিয়েছে, খুলে বলেনি কিছু, কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। অথচ কাউকে দোষ দিতে পারেন না। ঘটনাচক্র, ভবিতব্য এ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশাখার অতিরিক্ত বুদ্ধভক্তির মূল কারণ যে তার এই বিপুল অশান্তি ও হতাশা, প্রেমহীন জীবনের ঊষরতা সামনে দেখে তাঁর কন্যা যে তথাগতর শরণ নিয়েছে এতে তাঁর সন্দেহমাত্র নেই। তাঁরও না, ধনঞ্জয়েরও না। উপাসক তো তাঁরাও। বিশাখার মতো দুবেলা সঙেঘ যাবার প্রয়োজন তো তাঁদের হয় না! এতো অল্প বয়সে এই কর্মভার! এ-ও তাঁরা বুঝতে পারেন না। তার জীবনের সর্বব্যাপী অতৃপ্তিকে তাঁর বুদ্ধিমতী সৌম্যস্বভাবা কন্যা কর্মে, সেবায়, আরাধনায় ভুলতে চাইছে। কন্যার চোখের সেই অশ্রুকণা, সেই করুণ ঘোষণা—আমি পরাজয় স্বীকার করবো না মা! ভাবতে সুমনার হৃৎকম্প হচ্ছে। অথচ এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী! একবার মোক্ষক্রিয়া করাবার সুযোগ এসেছিল। হল না। মযার্দাজ্ঞানের গতি অতি সূক্ষ্ম। তিনি প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু বিশাখা তো প্রস্তুত ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই অবাঞ্ছিত পতিসঙ্গ যা মনে করতেও তার মুখ শুষ্ক হয়ে যায় সেই ভবিতব্যই মেনে নিল কন্যা। তাঁর তো সাকেত ফেরবার সময় এসে গেল। বিশাখার মুখে কদিন গভীর আনন্দের বিভা দেখেছেন। সুমনা চিন্তাশীল—যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ বিশাখার আচরণে কেন? এ রহস্য তাঁকে ভাবায়। কিন্তু স্বভাবে তিনি আনন্দময়ী। কন্যার সুখ তা যে ভাবেই আসুক, তাঁকে সুখী করেছে। তিনি অনুভব করছেন বিশাখা তাঁর গর্ভ থেকে ছিন্ন হচ্ছে। কোন্ পৃথিবীতে সে প্রশ্বাস নেবে, কোন্ ভূমির অন্ন গ্রহণ করবে, কোন্ নদীর জল সে পান করবে এখন সে নিজে স্থির করে নিচ্ছে। সুমনার ভূমিকা সেখানে অল্পই।

তিনি সস্নেহে কহ্নাকে বললেন—আমার সঙ্গে সাকেতে যাবি?

কহ্না বলল—যাবো, যাবো দেবী। নিশ্চয় যাবো।

অপরাহ্ণে আজ শেষবারের মতো জেতবনে গিয়ে সংবাদ শুনে স্তম্ভিত হলেন সুমনা। উৎপলবর্ণা, সেই নীলোৎপলের মতো বর্ণ, নীলোৎপলের মতো চোখ, নীল জ্যোৎস্না রাত্রির মতো কেশ, উৎপলবর্ণা প্রব্রজ্যা নিয়েছে। সঙেঘ একটা চাপা উত্তেজনা, শ্রমণাদের মধ্যে দমিত উল্লাস, সমবেত শ্রাবকদের মধ্যে সম্ভ্রমমিশ্রিত বিষাদ লক্ষ্য করলেন সুমনা। উৎপলবর্ণা বহু যুবকের বাঞ্ছিত ছিল। সে অধিক কথা বলত না। বিশাখার মতো হাস্য-পরিহাসে পটু ছিল না। বিশাখা মৃদুস্বরে বলল— মা, আমি জানতাম এইরূপই হবে।

—কেন? সুমনা জিজ্ঞাসা করলেন,— উৎপলবর্ণা কি একথা বলেছিল?

—না মা, উপ্‌পলবন্‌নার কথা বড় দুঃখের।

—মুখভাব দেখে যেন সেইরূপই মনে হত। কিন্তু কেন?

—ওর পিতা সেট্‌ঠি হলেও সুদত্তপমুখের মতো ধনী নন। ও বড় হতে না হতেই যোগ্য-অযোগ্য নানা প্রকার আঢ্য যুবক, প্রৌঢ়, ধনী রাজ-অমাত্য, তাঁদের পুত্ররা সব ওর পাণিপ্রার্থী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমি জানি উপ্‌পলবন্‌না তার এক মাতুলপুত্রের অনুরাগিণী ছিল। এত সব ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ওকে বিবাহ করতে চাইছিলেন যে ওর পিতা অত্যন্ত বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। একজনের সঙ্গে বিবাহ দিলে অন্যান্যরা ক্রুদ্ধ হবেন। আর মা, সাবত্থিতে অমাত্যদের রাগিয়ে কেউ থাকতে পারে না। আমার অনুমান, নিরুপায় হয়ে উপ্‌পলবন্‌নার পিতা তাকে সঙঘপ্রবেশ করতে পরামর্শ দিয়েছেন।

সুমনা অন্যমনা হয়ে বললেন—দর্পণে বিম্বিত দেখি দাসী…

—কী বললে মা! —বিশাখা জিজ্ঞেস করল।

—কিছু না বিসাখা, ভাবছিলাম অম্বপালীর কথা। বহু ব্যক্তি তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিল বলে সে গণিকা হল। আর এই উপ্‌পলবন্‌না হল শ্রমণা, একই কারণে।

—মা, উপ্‌পলবন্‌নার ভাগ্য দেবী অম্বপালীর থেকে ভালো নয়? —বিশাখা মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

সুমনা বলেন— মূলত দুজনের ভাগ্যই এক, একেবারে এক। ভেবে দেখো বিসাখা, নিরুপায় রমণী। এত রূপ-গুণ, কিন্তু পুরুষের ইচ্ছার অধীন। সমাজের নিয়ম-নীতিগুলি তো পুরুষরাই গড়ে।

—মা, পুরুষরা না-গড়ে যদি নারীরা গড়ত, তাহলে সমাজ কেমন হত?

সুমনা সহসা উত্তর দিতে পারলেন না।

—অন্ততপক্ষে ভিক্ষুণী বা স্বৈরিণী হওয়া তার ইচ্ছাধীন থাকত। —একটু ভেবে তিনি বললেন।

—আচ্ছা মা। নারী কি পুরুষকে এভাবে অধীন রাখতে পারতো? পুরুষের বাহুবল তো অধিক।

—বিসাখা, নারী ইচ্ছা করলে অনুশীলন করলে, বলে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে তুমি তো জানো।

—তাহলে কি এখন পুরুষ অধিকাংশই যেমন স্বেচ্ছাচারী, ব্যভিচারী, নারী, তেমন হত?

সুমনা চিন্তা করে বললেন— হয়ত। কিন্তু নারীকে গর্ভে সন্তানধারণ করতে হয় বলে সে পুরুষের মতো ব্যভিচারী হতে পারে না বিশাখা। প্রকৃতি তাকে বাধা দেয়। কিন্তু তুমি নারীর গড়া সমাজের কথাই বা ভাবছো কেন? এমন সমাজও তো হতে পারে যেখানে উভয়ে মিলে নিয়মগুলি গড়ে। কারুরই অধিকতর প্রাধান্য নেই!

—কিন্তু মা বাহুবলের যেমন সাম্য হয় না, বুদ্ধিবল, অর্থবল, এগুলিরও তো কোনও সাম্য দেখি না। আর যারই ক্ষমতা একটু অধিক, সে অল্প ক্ষমতার মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করে। আমাদের সেট্‌ঠিদের অর্থবল অধিক বলে কত মানুষকে আমরা কিনে রেখেছি। আমাদের বুদ্ধিবল, বিদ্যাবল অধিক বলে, এসব বল যাদের অল্প তারা আমাদের সম্ভ্রম করে। আর দণ্ডনীতি রাজা ও রাজপুরুষদের হাতে বলে তাঁরা সবাইকার ওপর কর্তৃত্ব করেন। নারীই গড়ুক, পুরুষই গড়ুক এই ক্ষমতাভেদ থাকবেই।

সুমনা চিন্তিত হয়ে বললেন— তুমি তো ঠিকই বলেছো বিসাখা, তুমি এই ক্ষমতাভেদের বিষয়টি কী করে চিন্তা করলে?

—মা, আমি মহিষী মল্লিকাদেবীর কাছে যাই, সেনাধ্যক্ষ বন্ধুল ভদ্র ও তাঁর পত্নী দেবী মল্লিকার কাছে যাই, গহপতি প্রতদ্দন ও সুনক্ষত্তর গৃহেও যাই। অমাত্য আর্য মৃগধর, আর্য সিরিভদ্দ এঁদের গৃহেও আমার যাতায়াত আছে। মা, সাকেতে আমি নিজ গৃহসীমা, পরিবারসীমার মধ্যে থাকতাম, অত দেখিনি। এখানে কত দেখি, তা ছাড়াও এখানে মহাত্মাদের কথা শুনি ধম্মসেনাপতি স্থবির সারিপুত্ত, স্থবির মহামোগ্‌গল্লান, ভিক্ষুণীদের কথাও শুনি। শুনে শুনে দেখে দেখে এইটুকু বুঝেছি।

—মহামোগ্‌গল্লান বা থের সারিপুত্ত কোনও বিকল্পর কথা বলেন না?

—বলেন মা, তথাগত যা বলেছেন তা-ই বলেন, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা।

—এইগুলি তো ব্রহ্মবিহার? ধ্যানের বিষয় বিশাখা!

—হ্যাঁ, মা তাই। কিন্তু আমি ভাবি শুধু ধ্যান কেন, এগুলি তো আমাদের দৈনন্দিন কর্মেরও বিষয় হতে পারে। সর্বপ্রকার জীবের প্রতি শুধু মৈত্রীভাবনা নয়, মৈত্রী পূর্ণ ব্যবহারের অভ্যাস যদি আমরা করি, যদি করুণার অনুবর্তী হয়ে সবার দুঃখমোচনের চেষ্টা করি, সুখী ব্যক্তির সুখ স্থায়ী হোক এভাবে চিন্তা করি, যদি ভাবি সকল জীবই সমান, কেউ কারো থেকে অধিক প্রীতি বা অধিক ঘৃণার পাত্র নয়, সবল-দুর্বল, ধনী-দরিদ্র, বৃদ্ধ-যুবা, সুন্দর-অসুন্দর সকলে সমান, তাহলে?

—কন্যা, তুমি নিজেই তো বললে ক্ষমতাভেদ জীবজগতের নিয়ম। তাকে মানুষ কী করে অতিক্রম করবে?

—ক্ষমতায় সমান হওয়া সম্ভব নয় মা, এবং তা হলে জগৎ-সংসার সুষ্ঠুভাবে চলাও দুষ্কর। কিন্তু মৈত্রী ও করুণার পূর্ণ ব্যবহার করতে তো কোনও অসুবিধা নেই! ক্ষমতাভেদ, কর্তব্যভেদ, কৃতিভেদ থাকলো। কিন্তু বিচারভেদ, দৃষ্টিভেদ রইলো না। ভিক্ষুরা নির্জনে বসে এই চতুর্ভাবনা এবং আরও একটি ভাবনা ‘অশুভ’ অর্থাৎ আমাদের দেহ ঘৃণিত বস্তু, জীবন জন্মমৃত্যুর অধীন—এই ভাবনা অভ্যাস করেন। কিন্তু আমরা গৃহীরা সদাই নানাপ্রকার কর্মে নিরত, যদি মৈত্রী-তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্যবহারিক জীবন চালিত করতে পারতাম! তবে, একমাত্র তবেই সেই বিকল্প সমাজ গড়ে উঠতে পারত।

সুমনা হেসে বললেন— বিশাখা, ধরো তথাগত বুদ্ধ ও তাঁর ভিক্ষুকুলের প্রচারগুণে, প্রভাবগুণে মানুষ তোমার এই মৈত্রীভাবনায় প্রতিষ্ঠ হল। এক আদর্শ সমাজ, আদর্শ লোকব্যবহার, আদর্শ জীবনযাত্রা আমরা সবাই পেলাম। তখন তোমার তথাগত বুদ্ধর নির্বাণের কী হবে? দুঃখ-দুর্দশার অংশটুকু বাদ গেলে তো এ জীবন পরম সুখময়। নির্বাণামৃতের জন্য তখন কে-ই বা সংসার-ত্যাগ করবে?

—বিশাখা বলল— মা, তথাগত বুদ্ধ তাঁর ধম্মকে নদীপারাপারের ভেলা বলেছেন, নদী পার হয়ে গেলে যেমন ভেলা ত্যাগ করা যায়, সমস্যাগুলির সমাধান হয়ে গেলে আমরা তেমনি তথাগতোক্ত ধম্ম ছেড়ে দিতে পারি। কেউ নিষেধ করছে না তো? তা ছাড়া মৈত্রীসাধনায় মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায় কমবে। কিন্তু সেই আধিদৈবিক অশুভগুলি ব্যাধি-জরা মৃত্যু—এসব কি যাবে? নির্বাণপদের জন্য আকুতিও মানুষের থাকবেই।

দেশনা-স্থলের যেখানে মাতা-পুত্ৰীতে এইসব কথাবার্তা হচ্ছিল, সেখানে তাঁদের ঘিরে ছিল বিশাখার তিন সখী এবং অদূরে হাঁ করে সে-সব কথা শুনছিল যশ ও নন্দিয়। ওঁরা আরো খানিকটা এগিয়ে যেতে, বসন্তসন্ধ্যার বাতাস মৃদুমন্দ বইতে লাগল, চিক্কণ আম্রপল্লবগুলি দুলতে থাকল, স্থবির সারিপুত্ত বুদ্ধাসনের একটু পাশে এসে আসন নিলেন। তিনিই আজকে শাস্তা।

নন্দিয় বলল— যশ, কুরুদেশে শুনেছি গামের বালিকারাও তত্ত্বালোচনা করে, পণ্ডিতদের ব্যাকরণের ভুল ধরে, শুনেছো?

—শুনেছি বই কি। যত বড় বড় পণ্ডিত যেমন বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, যাজ্ঞবল্ক্য সব তো কুরুদেশেরই সন্তান।

—দেখো, আমাদের এই মধ্যদেশকে ওরা যতই অবজ্ঞা করুন, একজন ধনীগৃহের বধূ তার মাতার সঙ্গে মৈত্রী ও সাম্য-তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছে—এ ব্যাপারে বোধহয় ওরাও আমাদের হারাতে পারবে না।

যশ বলল— তা ছাড়া ওরা করে চর্বিত-চর্বণ’। কতকগুলি সূত্র শিখেছে, সেগুলির প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন করেছে। বুদ্ধিও ক্ষুরধার। কিন্তু ইনি, এই দেবী বিশাখা ইনি তো তথাগত বুদ্ধর প্রচারিত একটি তত্ত্বকে কেমন নিজস্ব ব্যাখ্যা দিলেন। যা ধ্যানের বিষয় তাকে কর্মের বিষয় করে নেবার কথা বললেন।

—ওঁর সঙ্গে যে সখীগুলি ছিল লক্ষ্য করেছিলে? নন্দিয় বলল— বুদ্ধিতে ভক্তিতে যেন রসপাত্রর মতো পূর্ণ।

—ও তুমি তা-ও লক্ষ্য করেছো? যশ তির্যক কটাক্ষ হানল—তোমার তীর্থিক সংস্কারগুলি অতি দ্রুতই ত্যাগ করছো নন্দিয়।

নন্দিয় অপ্রতিভ হয়ে বলল— হানি হয়েছে কিছু? তাতে?

যশ হেসে বলল— না, হানি ঠিক হয়নি। কিন্তু ভাবছি, সেনাপতি সীহর কাছে তথাগতসংবাদ নিয়ে তাহলে তুমি যাবে কী? তোমার যে রূপ মতিগতি…

—তুমিই না হয় গেলে ভাই যশ। আবার এদিকে মহামাচ্চ সিরিভদ্দর কম্মটিও তো আছে। আমি না হয়…

“হে ইন্দ্র, হে বরুণ, হে সোম হে অগ্নি এইরূপ প্রার্থনায় কোনও ফল নাই। তোমাদেরই সাধানাগুণে অর্হৎ, বোধিসত্ত্ব, বুদ্ধ এইভাবে উত্তরোত্তর দেবত্ব-পদ প্রাপ্ত হতে হবে। তথাগত এই কথাই বলেন, —তিনি বলে থাকেন; তোমাদের নিজেদের মধ্যে সব আছে। বিপদের সময়ে ঊর্ধ্ব থেকে কোনও দেবতা শক্তি দেন না। তোমাদের চিত্তই সে শক্তি দেয়। এই আত্মশক্তিকে চিনে নাও। ঈশ আছেন কি নাই, আত্মা আছে কি নাই—এমত আলোচনায় কোনও লাভ হয় না। কার উদ্দেশে যজ্ঞ করবে? যজ্ঞ যদি করতে চাও দান করো। পূজা যদি করতে চাও মাতা পিতাকে করো”…স্থবির সারিপুত্ত তাঁর দেশনা আরম্ভ করলেন।

ভিক্ষুণী উৎপলবর্ণা যেদিন তাঁর নির্জন সাধনকুটিতে ধর্ষিত হলেন, সেদিন জেতবনের দেশনাস্থলী পূর্ণ ছিল। আষাঢ়ি পূর্ণিমার উপোসথের অন্তে তথাগত আবার জেতবনে অবস্থান করছেন। নানা দিক থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন অন্যান্য দহর ভিক্ষুরাও। বর্ষাবাসের সময়টি বাদ দিয়ে স্থবির সারিপুত্ত, স্থবির কাশ্যপ, মহা মোগ্‌গল্লান, কৌণ্ডিন্য এঁরা প্রায় সকইে বহুজনের হিতের কথা স্মরণে রেখে দিকে দিকে বেরিয়ে পড়েন। বর্ষা আরম্ভ হলে কোনও বিহারে ফিরে আসেন।

তথাগত যখন সদ্য-সদ্য বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন, অমৃত হিল্লোলে হৃদয়ের তট থেকে থেকেই প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে সেই সময়েই তিনি নিজেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেবার প্রেষণা অনুভব করেন। তাঁর অন্তরটি যেন বাইরের শরীরকে বহু বহু গুণ ছাড়িয়ে গেছে আকারে, আয়তনে। তা যেন তরল, কিংবা বায়বীয়, যতই ছড়ানো যাবে, ততই পূর্ণ হয়ে উঠবে হৃদয়। কিন্তু…কিন্তু বড় কঠিন যে! মনকে সংবৃত, সংযুত করা বড় কঠিন। এই ধ্যানমার্গ, এই শীল পালন যেমন সহজ, তেমনই কঠিন। এ কি সাধারণজন নিতে পারবেন? তথাগত তাঁর নিজস্ব প্রাপ্তির তন্ময়তায় ফিরেই যাচ্ছিলেন। সেই সময় অতি সাধারণ একটি দৃশ্য দেখলেন। সরোবরে পদ্ম ফুটেছে। কোনটি আধফোটা, কোনটি তখনও কোরক, কোনটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত। এমন দৃশ্য তো মানুষ দেখেই থাকে। কিন্তু তথাগত তখন প্রত্যেকটি দৃশ্যকে অলৌকিক প্রভায় বিভাসিত, অর্থময় ঘটনা বলে দেখছেন। তাই দেখলেন—মনুষ্যকূলও অমনি। কারুর বোধিচিত্ত উন্মুখ হয়ে রয়েছে, কেউ এখনও আধো-ঘুমে, সামান্য স্পর্শেই অন্তর জেগে উঠবে। কেউ বা মুদিত কমলকলি। বহু চেষ্টায় তার দলগুলি খোলে কি না খোলে। সকলে নিতে পারবে না বলে যারা প্রস্তুত হয়ে রয়েছে, যারা স্পর্শমাত্রের অপেক্ষায় রয়েছে তাদেরও কি বঞ্চিত করবেন? তথাগত সেই দিনই মনস্থির করে ফেলেছিলেন।

পরে ইসিপতন থেকে বারাণসী, বারাণসী থেকে রাজগৃহ যেতে যেতে তাঁর শিষ্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলল। এদের সবার প্রতিই তাঁর নির্দেশ, সবার মধ্যে বিতরণ করো মৈত্রীতত্ত্ব। করুণা, প্রেম, সহনশীলতা, হার্দিক সহযোগ এইগুলি প্রকৃত মানবলক্ষণ। কর্মময় জীবনের প্রতি মুহূর্তে চর্চা করো সংবেদী হৃদয়ধর্মের, পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করো পঞ্চশীল পালন করে। তার পর অষ্টশীল, তারও পর দশশীল। হৃদয়টি যখন পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে তখন আরম্ভ করবে অমৃত পদের জন্য নিভৃত সাধনা।

এই নিভৃত সাধনাই তো করতে গিয়েছিলেন উৎপলবর্ণা। শ্রাবস্তীর উপান্তে একটি ছোট কুটির বেঁধে দিয়েছিলেন পিতা। আভরণহীন, সামান্য মাটির কুটির। মাটিতে শোওয়া, মাটিতে বসা, কোনদিন ভিক্ষায় বেরোনো, কোনদিন উপান্তবাসীরা কিছু দিয়ে গেলে তাই। আর সমস্ত সময়টা শুধু ধ্যান। উৎপলবর্ণা চিরদিনই শান্তচিত্ত, বাধ্য, বিনীত, ভক্তিমতী। তাকে ঘিরে চতুর্দিকে যে এত মুগ্ধতার ঢেউ, তা উৎপলবর্ণাকে স্পর্শ করে না কোনদিনই। কোন শিশুকাল থেকে মাতুলপুত্র রোহিতনন্দর সঙ্গে তার বন্ধুতা। রোহিতই তার প্রথম, তার একমাত্র। যখন দলে দলে প্রভাবশালী পাণিপ্রার্থী এসে তার পিতাকে অস্থির করে দিতে লাগল, রোহিত বলেছিল তারা দুজনে গোপনে শ্রাবস্তী ত্যাগ করে যাবে, চলে যাবে বারাণসী। সেখানে রোহিতের আচার্য গঙ্গাধর আছেন। আরও কিছু সতীর্থ আছে। বারাণসীতেই বাস করবে তারা। কিন্তু অমাত্য সিরিভদ্দর পুত্র দীর্ঘায়ু যেদিন পিতাকে শাসিয়ে গেল কন্যাকে অন্যত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করলে তিনি ধনে-প্রাণে বিপন্ন হবেন, সেই দিনই উৎপলবর্ণা স্থির করে ফেলল বারাণসী যাওয়া হবে না। রোহিত অনেক বুঝিয়েও তাকে সম্মত করতে পারেনি।

সেই রোহিতই রাত্রির তৃতীয় যামে তার উপান্তকুটিরের শিথিলদুয়ার খুলে প্রবেশ করল।

—উপ্‌পলা, উপ্‌পলা…অস্পষ্ট স্বর।

কুটিরের মাটিতে তার কাষায় খবনপাবুরণ বিছিয়ে নিদ্রিত উৎপলবর্ণা। রোহিতের ডাকে ধীরে ধীরে উঠে বসল।

রোহিত বলল—চলো উপ্‌পলা। দ্রুতগামী অশ্ব সংগ্রহ করে এনেছি। পুরুষের অধোবাস আর উত্তরীয় এনেছি। বেশ পরিবর্তন করে নাও।

রোহিতের একটুও সংশয় ছিল না। কিন্তু উপ্‌পলা তার মাথায় বজ্রপাত করে বলল—সেট্‌ঠি সিরিভদ্দ, সেঠ্‌ঠি মিগধরের প্রভাব যে সমগ্র কোসলরাজ্যে ছড়িয়ে আছে। বারাণসী নামেই মগধ, ওখানে গিয়েও রক্ষা পাবে না রোহিত, এ কল্পনা ত্যাগ করো।

—বারাণসীও যাবো না তা হলে। কোসল রাজ্যের সমীপে কোথাও যাবো না। রাজগৃহে যাবো।

—রাজগৃহে পৌঁছবার বহু পূর্বেই অমাত্যদের অশ্ব তোমাকে ধরে ফেলবে। কিংবা যদি যেতেই পারো, আরও কত উগ্গ কত দীঘ্‌ঘায়ু, কত মিগধর প্রতিদিন তোমার জীবন বিপন্ন করবে, রোহিত তার চেয়ে এই ভালো। —উৎপলবর্ণার কণ্ঠ শান্ত।

—সে ক্ষেত্রে একসঙ্গে মরবো উপ্‌পলা। তুমি ছাড়া আমার জীবন যে অর্থহীন…বলতে বলতে রোহিত উপ্‌পলাকে উন্মাদের মতো চুম্বন করতে লাগল।

—রোহিত, রোহিত, আমি দশশীল পালনের শপথ নিয়েছি, আমি ভিক্ষুণী, আমাকে চুম্বন করতে নেই!

—উপ্‌পলা তুমি ভিক্ষুণী নও, তুমি আমার বধূ। আমার প্রিয়া।

—রোহিত দেখো, আমার মস্তক মুণ্ডিত।

—তোমার অতুলনীয় নীলোজ্জ্বল কেশদাম আবার জন্মাবে উপ্‌পলা।

—রোহিত আমি কাষায় ধারণ করেছি, এই বসনকে কাম দিয়ে অশুদ্ধ করতে নেই।

—তুমি কাষায় বর্ণেও নীলাম্বরের মতোই বাঞ্ছিতা, রোহিতের প্রণয় তোমাকে আরও শুদ্ধ করবে।

—আমি অপ্রাপণীয়া। রোহিত তুমি আমার আশা ত্যাগ করো। অমি ত্রিরত্নের উপাসিকা।

—তোমার ত্রিররত্ন আমি চূর্ণ করে দেবো উপ্‌পলা। রোহিত এবার উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, বুদ্ধ, বুদ্ধ। সবাইকে উদ্ধার করবেন! সকল সমস্যার উত্তর বুদ্ধ!

—বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি—উৎপলবর্ণা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল।

রোহিত আর সহ্য করতে পারল না।

—দেখি তুমি কী ভাবে বুদ্ধের শরণ নাও—উৎপলবর্ণার কোনও অনুনয়, কোনও নিষেধই সে শুনল না। মানল না।

তার উদ্দাম কামনা শান্ত হলে রোহিত অর্ধস্ফুট উষার আলোয় উৎপলবর্ণার মুখ দেখল। সভয়ে বলল—তুমি কে? তুমি তো আমার উপ্‌পলা নও!

—আমি ভিক্ষুণী উপ্‌পলবন্‌না, তথাগত বুদ্ধের শরণাগত।

রোহিত উদ্‌ভ্রান্তের মতো কুটির থেকে বেরিয়ে গেল। উপান্তবাসীদের অনেকেই ছুটে এলো।

—কে? কে আপনি? পব্‌বাজিকার কুটিরে কী অভিপ্রায়ে গিয়েছিলেন?

—আমি রোহিত নন্দ। ভিক্ষুণীর ধর্মনাশ করেছি।

উপান্তবাসীরা রোহিতকে ছাড়েনি। কুলপুত্ত হলে হবে কী? সন্ন্যাসিনীর ধম্মনাশ করেছে না। তারা রোহিতকে প্রহার করে। তারপর ছেড়ে দেয়।

অনেক শ্রমণেরই আজকের প্রশ্ন—ভিক্ষুণী উপ্‌পলার ধর্ম নষ্ট হয়েছে। তিনি অশুদ্ধ, তিনি কী করে সংঘভুক্ত হতে পারেন?

গৌতম জিজ্ঞাসা করলেন, ধম্ম ঠিক কোথায় থাকে? সমনগণ?

ভিক্ষুদের নিরুত্তর দেখে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন—কোথায়? হস্তপদে? না বক্ষে? না উদরে? না উপস্থে? না জানুতে? কোথায়?

ভিক্ষুরা চিন্তা করে বললেন—বক্ষেই হবে।

উত্তরাসঙ্গে ঢাকা আছে তোমাদের বক্ষস্থল, ঠিক কোন স্থানে ধম্ম রয়েছে দেখে তথাগতকে দেখাও সমন।

—বক্ষের চর্মে বা মাংসে বা অস্থিতে তো নেই, ভন্তে!

—তবে কি বক্ষটি চিরলে ধম্মকে দেখতে পাওয়া যাবে?

—না, ভন্তে, ধম্ম হৃদয়ে থাকে হৃদয় বক্ষের মধ্যে হলেও তার অবস্থান নির্দেশ করা যায় না।

—শরীরের মধ্যে যার অবস্থান নির্দিষ্ট করা যায় না, শরীর আক্রান্ত হলে তা নষ্ট হয় কী করে?

—কিন্তু ভন্তে, মনটি, হৃদয়টি? তাও কি সংক্রমিত হয়নি?

—যে ভিক্ষুণীর হৃদয়ে ত্রিরত্নের বসবাস, মার তাঁকে সংক্রমণ করতে পারে না সমন। উপ্‌পলা সকৃদাগামি মার্গে প্রবেশ করেছেন। তিনি শীঘ্রই অনাগামি ফল লাভ করবেন। অর্হৎ হতে তাঁর আর বিলম্ব নেই।

এই সময়ে নিগারমাতা বিশাখা উঠে দাঁড়াল। সে প্রায়ই দেশনা-স্থলে নিজের প্রশ্নগুল অকপটে উপস্থিত করে।

—ভন্তে, একটা কথা। অট্‌ঠগুরু ধম্ম গ্রহণ করে ভিক্ষুণী সংঘ ভিক্ষুসংঘের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে, সংঘ কিন্তু তাঁদের রক্ষার ব্যবস্থা করেনি। আজ পব্‌বাজিকা উপ্‌পলবন্‌নার দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়ে গেল। সংঘে প্রবেশ করেও নারীরা কত অসহায়! সংঘ তার শরণাগত নারীকে রক্ষা করে না।

সামনের পঙ্‌ক্তিতে একজন বয়স্ক শ্রোতা বলে উঠলেন—নারীদের সংঘে প্রবেশ করাই তো অনুচিত। ধর্মাচরণ করতে ইচ্ছা হলে তো গৃহেই তা করা যায়। নারীরা গৃহেই শোভা পায়।

—ভন্তে, আমি এই শ্রাবকের কথার উত্তর দিতে পারি? বিশাখা বলে উঠল।

তথাগত স্মিতমুখে মৌন রইলেন। মৌনই তাঁর সম্মতি।

বিশাখা বলল—ভদ্র, নারীরা কি শুধু শোভা পাবার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে?

—না, নারীরা সৃষ্টি হয়েছে প্রজাবৃদ্ধির জন্য।

—আচ্ছা। তবে নারীরা একাই প্রজাবৃদ্ধি করতে যথেষ্ট? পুরুষের প্রয়োজন নেই?

—না, এ কথা সত্য নয়।

—আর ভদ্র, যে সকল নারী প্রজাবৃদ্ধি করে না, কিন্তু শোভাবৃদ্ধি করে অর্থাৎ গণিকা ও প্রব্রাজিকা—তারা তা হলে নারী নয়।

—না, এ কথাও সত্য নয়, ভদ্রে।

—ধর্মাচরণে সম্পূর্ণ মন চলে গেলে যদি অন্ন সুসিদ্ধ করতে ভুল হয়ে যায়, কিংবা খাদ্য পুড়ে যায়। তবে কি গৃহের পুরুষ নারীকে ক্ষমা করবে?

—না, গৃহিণীর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। অসিদ্ধ অন্ন পোড়া যাউই বা কীভাবে খাওয়া যায়!

—তাহলে গৃহে থেকে ধর্মাচরণ নির্বিঘ্নে করা কী ভাবে সম্ভব ভদ্র?

শ্রাবক রুষ্ট মুখে নীরব রইলেন। তিনি বিশাখার কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছেন। বিশাখার কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গেল।

তখন ভিক্ষুণী ভদ্রা বললেন—আচ্ছা, তথাগতই কি প্রথম নারীদের প্রব্রজ্যা দিলেন?

শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন—তা কেন? নিগ্গণ্ঠদের মধ্যে তো পব্‌বাজিকা রয়েছেন। সন্ন্যাসিনীরাও আছেন। অরণ্যে, অরণ্যপ্রান্তে বাস করেন।

—অর্থাৎ, নারীদের সংঘভুক্ত করে তথাগত কোনও অশাস্ত্রীয় কাজও করেননি।

এতক্ষণে শাস্তা দশবল কথা বললেন—আয়ুষ্মতী বিসাখা ঠিকই বলেছে। ভিক্ষুণীদের আরক্ষার জন্য বিহার গড়তে অনুমতি দিন মহারাজ।

—অবশ্য, অবশ্যই—মহারাজ পসেনদি উৎসাহ ভরে বললেন।

—বিসাখা, আগামী কাল থেকেই সাবত্থির ভিক্ষুণী বিহার নিম্মাণ আরম্ভ হবে।

তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। উৎপলবর্ণা তাঁর কুটিরে মৃদুস্বরে কথা বলছেন ভদ্রার সঙ্গে, এমন সময়ে ভিক্ষুণী মিত্রা ব্যস্ত হয়ে প্রবেশ করলেন। উপাধ্যায়া খেমার আদেশে ভদ্রা আজ উৎপলবর্ণার সঙ্গে থাকবেন, আর কারো এ স্থানে আসার কথা নয়। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কী ব্যাপার? শ্ৰমণা?

মিত্রা বললেন—তোমরা শোননি? বাইরে কত কোলাহল! ওরা বলাবলি করছে সব…

—কী? ভদ্রা প্রশ্ন করলেন।

—রোহিত নামে সেই ব্যক্তি আত্মঘাতী হয়েছে।

কেউ কোনও কথা বলল না।

মিত্রাই বললেন—লোকটির তো প্রাণদণ্ড হওয়াই উচিত ছিল, তা নিজেই নিজেকে সে দণ্ড দিল। ভালো। অতি উত্তম হয়েছে। ভিক্ষুণীর ধর্মনাশ করা? পাপাত্মা! নীচাশয়!…ক্রমশই উত্তেজিত হচ্ছেন মিত্রা।

ভদ্রা বললেন—এ প্রসঙ্গ থাক, শ্রমণা। বৃথা মৌনও যেমন ভালো নয়, বৃথা বাক্যব্যয়ও তেমনই মন্দ।

মিত্রা বললেন—উপ্‌পলে, আমিও আজ থাকি তোমার সঙ্গে?

উৎপলাবর্ণা বললেন—না।

রাত্রি গভীর হলে ভিক্ষুণী উৎপলবর্ণা তাঁর মৃত্তিকাশয্যা থেকে উঠে পড়লেন। ভদ্রা জাগ্রত ছিলেন। তিনি শুধু চেয়ে দেখলেন। প্রণয়, তুমি নাও, তুমি বহু বলি নাও। এমনই তোমার স্বভাব। আমি জেনেছি, উপ্‌পলা জানল। আরো কত নারী জানবে। কুটির দুয়ার খুলে উপ্‌পলা বাইরে বেরিয়ে এলেন। চন্দ্রালোকিত শুক্লপক্ষের অরণ্য। অপরূপ, রহস্যময় শোভা ধারণ করেছে। সেই চন্দ্রালোক ধৌত করে দিচ্ছে উৎপলবর্ণাকে। তিনি ভাবলেন রোহিত আর নেই। শিশু রোহিত, বালক রোহিত, কিশোর রোহিত, পূর্ণ যুবক রোহিত উৎপলবর্ণার সমগ্র জীবনের পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। কেন সে আত্মঘাতী হল? এ যে পাপ? সুগতি হবে না রোহিতের। সে কি তা জানত না? নাকি তার লজ্জা তার দুঃখ এত গভীর যে সে আর কিছুই ভাবতে পারেনি! রোহিত যখন তাঁকে আলিঙ্গন করেছিল, তিনি প্রথমে বিবশ হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু সদ্যগৃহীত প্রতিজ্ঞাগুলি তাঁর অন্তরকে, দেহকে সুকঠিন করে দিল। তিনি প্রস্তর প্রতিমার মতো হয়ে গেলেন। বা বলা যায় শবের মতো। প্রথম ঊষার আলোয় সেই শবমূর্তি দেখে রোহিত চমকে উঠেছিল।

কেন? কেন তিনি পিতার কথায় সম্মত হলেন? কেন রোহিতের প্রস্তাব মতো কোসল ছেড়ে মগধে বা অন্য কোথাও পালিয়ে গেলেন না! কী হত? মৃত্যু হত। রোহিতকে কেউ হত্যা করলে তিনিও প্রত্যাঘাত করবার চেষ্টা করতে পারতেন। আবার মৃত্যু বা বিপদ না-ও হতে পারতো। হয়তো রোহিতের কথা শুনলে কোনও দূর বিদেশে তাঁরা সুখেশান্তিতে গৃহ-জীবন কাটাতে পারতেন। প্রণয়গম্ভীর, হাস্যচঞ্চলতামুখর গৃহ-জীবন। রোহিত তো এইটুকুই চেয়েছিল, এর জন্য মূল্য দিতেও প্রস্তুত ছিল। জ্যোৎস্নাবিধৌত চরাচরের দিকে চেয়ে উৎপলবর্ণা অনুভব করলেন রোহিত আত্মঘাতী নয়। তিনি—তিনিই তার প্রাণঘাতিনী। প্রণয়পাত্র রোহিতকে তিনি নিজ হাতে হত্যা করেছেন। কামে কলুষিত হননি তিনি। হয়েছেন হত্যার অপরাধে। বিবাহ করেও অষ্টশীল পালন করা তাঁর পক্ষে কোনও কঠিন ব্যাপারই ছিল না। কেন না তিনি স্বভাবেই ধর্মশীলা। অবৈধ কাম থেকেই নিরস্ত হতে বলে ধম্ম। তিনি কি হতে পারতেন না বিশাখার মতো উপাসিকা! পিতা দুর্বল। তাঁর প্রতি করুণা করে তিনি প্রব্রজ্যা নেবার প্রস্তাব মেনে নিলেন। হতভাগ্য রোহিতের কথা তিনি একবারও ভাবলেন না। তীক্ষ সূচের মতো যন্ত্রণাসকল বিদ্ধ করতে লাগল তাঁকে। ধীরে ধীরে সূচগুলি শলাকা হয়ে গেল। উৎপলবর্ণা কোনদিনই নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন না। সব ব্যথা নিজের মধ্যে পরিপাক করে নেওয়ারই অভ্যাস তাঁর। আজ যে ব্যথা অনুভব করছেন তা তাঁর নিজের জন্য নয়, রোহিতের জন্য। দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুত বিবাহের সম্ভাবনা ধুলোয় লুটিয়ে উপ্‌পলা যখন কেশ মুণ্ডন করে চীবর-পাত্র ধারণ করল কী সে প্রাণান্তকর কষ্ট যা রোহিতকে দু পায়ে দলেছিল! তারপর সাধনকুটিরে মধ্যযামে যখন সে উপ্‌পলার দ্বারা প্রত্যাখাত হল! তার সমস্ত পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিল উপ্‌পলা। তারপর সে যখন উপ্‌পলাকে শেষ পর্যন্ত দৈহিক মিলনের বাঁধনে বাঁধতে চাইল! তখন, তখনই বোধ হয় সবচেয়ে বড় আঘাত এলো। তখনই আপাদমস্তক নিরুদ্ধ উপ্‌পলাকে অনুভব করে সে বুঝতে পারে উপ্‌পলা আছে, অথচ নেই। তার আবাল্য-প্রণয়ীর স্নেহের, আকাঙ্ক্ষার কোনও মূল্য নেই উপ্‌পলার কাছে। উৎপলবর্ণা স্পষ্ট দেখতে পেলেন রোহিত উদ্‌ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে—তুমি কে? তুমি তো আমার উপ্‌পলা নও?—সে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে, সে উপলব্ধি করেছে একজন ভিক্ষুণীর প্রতি সে বলাৎকার করেছে মাত্র। তাই উপান্তবাসীরা যখন তাকে প্রহার করে সে তা মাথা পেতে নিয়েছিল, একটুও বাধা দেয়নি। জ্যোৎস্নার মধ্যে বিদেহী রোহিত আত্মবিস্মৃতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনি দেখতে পেলেন। তার এই অবস্থার জন্য দায়ী উপ্‌পলা। যে তাকে সবচেয়ে ভালোবাসত। উৎপলবর্ণা নিম্ববৃক্ষমূলে সেই অপূর্ব জ্যোৎস্নায় অননুভূতপূর্ব যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালেন, অথচ হারালেন না। যেন কোনও গূঢ় মর্মের মধ্যে জেগে রইলেন।

জীবনমৃত্যুর অতীত, সময়ের অতীত সেই ছায়ালোকে ছায়াশরীর উৎপলবর্ণারা ছায়াশরীর রোহিতদের প্রণয়সম্ভাষণ করে ফিরতে লাগল। আবার অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ রোহিতরা অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ উপ্‌পলাদের চুম্বন করতে লাগল। অমৃত উত্থিত হতে লাগল, এই অমৃত আকাশপ্রমাণ ঊর্ধ্বধারায় উৎক্ষিপ্ত হয়ে আবার দ্বিগুণ বেগে ঝরে পড়তে লাগল, বহু রোহিত বহু উপ্‌পলা সেই অমৃতধারা পান করবার জন্য ঊর্ধ্বমুখ হয়ে আছে। জিহ্বায় পড়বামাত্র জিহ্বা জ্বলে গেল। ধীরে ধীরে শরীর জ্বলে গেল, অসহ্য যাতনা, তারপর বিবশ, অচেতন।

কতক্ষণ এইভাবে কেটেছে—বহু জন্ম বহু মৃত্যুর মাঝখানে দ্যুলোক না ভুলোক মহাবেগে ঘুরছে। মেঘরাজি ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রবল গতিতে ভেসে চলেছে। জ্যোতিষ্কগুলি জ্বলছে, নিবছে কোনটি ক্ষীণ হতে হতে একেবারেই নিবে গেল। কোনটি জ্বলতে জ্বলতে উল্কার মতো একদিক দিয়ে উধাও হয়ে গেল। আবার লক্ষ জ্যোতিষ্ক জন্মালো, কী বিশাল, বিরাট অন্তরিক্ষ। বহু মনুষ্যশরীর ওইভাবে দৃষ্ট হচ্ছে, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, ওর মধ্যে উপ্‌পলাই বা কোথায়? রোহিতই বা কোথায়? কে যেন শিরে হাত রাখল। ওষ্ঠে মধু সিঞ্চন করল, কে যেন উপ্‌পলার শিরটি নিজের ক্রোড়ে তুলে নিল।

বালার্কের প্রথম উদ্ভাস তাঁর মুখের ওপর পড়েছে।

উপ্‌পলা ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন—ভগবন! তাঁর দু চোখ দিয়ে দরদর ধারে অশ্রুপাত হচ্ছে।

তথাগত শুধু তাঁর হাতটি শিরে রাখলেন। একটু পরে পত্রপুট থেকে আরও একটু মধু ঢেলে দিলেন, উপ্‌পলা বললেন—প্রভু, আমাকে কি অমৃত পান করাচ্ছেন!

—না উপ্‌পলে—অমৃত তো পান করার বস্তুত নয়। অমৃত একটি ভাব। যথার্থ সাধনার পর সেই ভাবটি তোমার মধ্যে যাবে, আসবে, যাবে, আসবে, তারপর স্থিত হবে। তা ছাড়া অমৃত কেউ কাউকে দিতে পারে না উপ্‌পলা। নিজেকে অর্জন করতে হয়, আত্মচেষ্টার দ্বারা।

—ভগবন, তবে আপনার ভূমিকা কী?

—তথাগত অমৃতপদ লাভ করেছেন। তাঁকে দেখলে, তাঁর বচন শুনলে অমৃত পাওয়া সম্ভব, এই প্রত্যয় জন্মাবে।

—কিন্তু এই যে আমার হৃদয়, তনু, মন, সব শান্ত, ধীর, আনন্দাপ্লুত হয়ে যাচ্ছে, সে কি তথাগতর করুণায় নয়?

গৌতম নীরব রইলেন।

উপ্‌পলা আবার বললেন—ভগবন, আমি যে বহু জ্যোতিষ্ক, বহু মানুষের বহু উপ্‌পলা বহু রোহিতের ছায়াসংগ্রাম দেখলাম, উৎপত্তি এবং লয় দেখলাম—সে কী? কেন?

—তোমার মধ্যে পূর্বনিবাসজ্ঞানের অভ্যুদয় হচ্ছে উপ্‌পলে।

—আমি যে অমৃতধারাকে বিষনির্ঝরে পরিণত হতে দেখলাম ভগবন!

—অধিকার করার বাসনা নিয়ে অমৃত পান করতে গেলে তা হলাহল হয়ে যায় উপ্‌পলে, তুমি তাই দেখেছো।

—আর বাসনারহিত হলে?

—হলাহলও অমৃত হয়ে যায়।

—কিন্তু বাসনারহিত হলে অমৃতের জন্য আর্তিও তো থাকে না প্রভু! বাসনারহিত মানুষ আর শবের মধ্যে পার্থক্য কী?

—বাসনারহিত হৃদয় মৈত্রী ও করুণার চিরপ্রস্ফুরমান উৎস হয়ে থাকে উপ্‌পলে, যতক্ষণ না সম্পূর্ণ বাসনারহিত হচ্ছো সেই অবস্থা বুঝতে পারবে না। তবে বুঝতে তোমার অধিক বিলম্বও নেই।

—ভগবন, রোহিত কি অধিকার করার বাসনা নিয়ে এসেছিল বলে তার অমৃত হলাহল হয়ে গেল?

—তাই উপ্‌পলে, এবং উপ্‌পলা তাকে স্নেহ করত বলে সে-ও হলাহলের তীব্র স্বাদ পেয়েছে।

—প্রভু, রোহিত আত্মঘাতী হয়েছে, লোকে বলছে সে ভিক্ষুণীকে বলাৎকার ও আত্মঘাত এই দুই কারণেই মহাপাপী। তার কি উদ্ধার নেই?

—কে এ কথা বলে উপ্‌পলে? যে বলে সে জানে না। রোহিত বাসনার বিষ পরিপূর্ণ পান করেছে বলেই বিতৃষ্ণ হয়েছে, মৃত্যুর সময়ে সে বিগততৃষ্ণ, বীতশোক ছিল। তার এই কর্ম থেকে যে গ্রাণের দীপটি জ্বলবে তার শিখাটি থাকবে অমৃতলোকের দিকে স্থির।

উপ্‌পলা উঠে বসলেন। পূর্ণ দৃষ্টিতে তথাগতর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তথাগত উঠে দাঁড়িয়েছেন, মুখমণ্ডল প্রসন্ন, বিভাময়। তাঁর দৃষ্টি উপ্‌পলার চোখের ওপর নিবদ্ধ। অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন—দীপ জ্বলছে। রোহিতের প্রাণের দীপ। শিখাটি আকাশের দিকে মুখ করে নিষ্কম্প। এই হবে তোমার কর্মস্থান উপ্‌পলে। আজ থেকে তুমি আমার অগ্গসাবিকা। ভিক্ষুণী খেমা থাকেন ডান দিকে, তুমি থাকবে বাম দিকে। সব্বে জীবা সুখিত্তা হোন্তু। গুনগুন করে বলতে বলতে তথাগত ধীরে ধীরে বনপথ পার হয়ে লোকপথের দিকে চলে গেলেন।

বনভূমির অপর দিকেই শ্মশান। রোহিতের শব বয়ে নিয়ে তার ভাইয়েরা, বন্ধুরা শবদাহ করল। মাতা-পিতা, ভগ্নীরা সবাই আর্তস্বরে রোদন করতে করতে চিতায় অগ্নিসংযোগ করল। চিতা নির্বাপিত হলে, ভস্মাধার অচিরবতীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে বনভূমির পাশ দিয়ে তারা বিলাপ করতে করতে চলে গেল। রোহিতের মাতা, উপ্‌পলার মাতুলানী—বনভূমির দিকে তাকিয়ে উচ্চৈঃস্বরে অভিসম্পাত দিয়ে গেলেন। হয়ত তিনি ভেতরে প্রবেশ করতেন। অভিসম্পাতগুলি আরও শাণিত করে উপ্‌পলার প্রতি নিক্ষেপ করবেন বলে। কিন্তু দু’ হাতে বৃক্ষগুলির শাখা-প্রশাখা সরাতে সরাতে এক দীপ্তবর্ণা দীপ্তচক্ষু কুণ্ডলকেশী শ্ৰমণা এসে দাঁড়ালেন, শবযাত্রীর দল সভয়ে স্থানত্যাগ করল।

উপ্‌পলা সেই নিম্ববৃক্ষমূলে একইভাবে বসে। চোখ দুটি মুদিত। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। কোনও শব্দ কানে গেল না, চিতা-ধুম তাঁর নাসিকায় পৌঁছল না। তিনি শুধু দেখছেন রোহিত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে, হতে হতে সে একটি দীপ হয়ে গেল। দীপগাছটি পুরোই মৃদু আলো দিয়ে গড়া। তার শিখা কে অন্য একটি শিখা থেকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। জ্বলছে, রোহিত আলোময় দীপ হয়ে জ্বলছে, ধীরে ধীরে পুরো দীপগাছটিই শিখা হয়ে গেল। মৃদু, নীলাভ অচঞ্চল একটি শিখা। সারাদিন জ্বলছে, সারারাত। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। উৎপলবর্ণা সেই দীপশিখার সঙ্গে আপন শিখা মেশাতে লাগলেন। গাঢ়, গভীর, অনিঃশেষ এক ঊর্ধশিখ মিলনরজনী। শুধু ভদ্রা দিনের পর দিন পাশে থেকে মধু, জল ও পায়স দিয়ে তাঁর শরীর রক্ষা করতে লাগলেন।

একসালা গ্রামের সম্পন্ন কর্ষকের গৃহ। প্রশস্ত অঙ্গনের মধ্যে ছড়িয়ে আছে কুটির কটি। অঙ্গনে ধান ঝাড়াই হচ্ছে। কৰ্ষক স্বয়ং এবং তার তিন পুত্র এই কাজে নিযুক্ত। কর্ষকের পত্নী তার দুই পুত্রবধুকে নিয়ে গোষ্ঠের কাজগুলি সারছে। গরুগুলিকে গোচরে নিয়ে গেছে কর্ষকের চতুর্থ পুত্র ও জ্যেষ্ঠ পৌত্র। দুই কন্যা পাকশালে কুল্মাষ প্রস্তুত করছে। কাঞ্জিক তো আছেই, মাটির পাত্রে পাত্রে সেগুলি ভাগ করে রেখেছে তারা। মুদগ এবং যব একত্র সিদ্ধ করে তার মধ্যে খুদ দিয়ে মেখে কুল্মাষ পিণ্ড প্রস্তুত করতে হয়। কনিষ্ঠা কন্যা লোলা বলল—জেট্‌ঠা, অতিথের জন্যে কি আজও যাউ পাক করবো?

জ্যেষ্ঠা কন্যা পদুমা বলল—অতিথি কত উঁচু কুলের, আকারখানা দেখিস না? গোরা কেমন। দোর ছাড়িয়ে কত উঁচু! যাউ পাক করবি না তো কী!

মধ্যমা সুতনা হাঁড়ির মধ্যেটা দেখে নিয়ে বলল—পুরনো শালিধানের তণ্ডুল দেখছি অল্পই আছে। গোহালে মায়ের কাছে গিয়ে শুধিয়ে আয় না!

লোলা পাকশালা থেকে বেরিয়ে দেখল মাটির সংকীর্ণ পথটি যেখানে দূরে বনপথের সঙ্গে মিশে গেছে সেইখানে অতিথিকে দেখা যাচ্ছে। অতি প্রত্যূষে তিনি গ্রাম ছাড়িয়ে বন, নদীর তট এই সমস্ত স্থানে চলে যান, যখন ফেরেন, কৰ্ষক পরিবারের পুরুষদের তখন প্রাতরাশ হয়ে যায়। আজ অতিথি অনেক আগেই ফিরছেন। কনিষ্ঠা লোলা এখনও বালিকাই। এই অতিথি সম্পর্কে তার অতিশয় কৌতূহল জন্মাচ্ছে। তাদের গৃহে অতিথি অনেক আসেন। সন্ন্যাসী বা পরিব্রাজক এলে গৃহের ভেতরে ঢোকেন না। বাইরের প্রাঙ্গণে অম্ববৃক্ষের তলায় বসে থাকেন। আহারের জন্য আমন্ত্রণ জানালে তবেই গ্রহণ করেন, নইলে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যান গ্রামে। কর্ষণ, বপন বা শস্য কাটার কাজ যখন সকলকে ব্যস্ত রাখে, তখন অতিথিদের ভোজনের পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার অসুবিধা হয়। কিন্তু শস্য কেটে ঘরে তোলার পর, কাজের ভার কিছুটা অল্প হয়ে যায়, সে সময়ে গৃহে অন্নও থাকে প্রচুর, অতিথিসেবার সুযোগ পাওয়া যায়। সবে তিন দিন হল শস্য কাটার কাজ শেষ হয়েছে। অতিথিও এসেছেন দিন তিনেক। কোনও অতিথিই সাধারণত তিন দিনের অধিক থাকেন না। গৃহস্থের অন্নও গ্রহণ করেন না। রুগ্ণ হয়ে পড়লে স্বতন্ত্র কথা। এই অতিথিও কবে চলে যাবেন, লোলা ভয়ে ভয়ে আছে। বস্তুত দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকতার মধ্যে এই অতিথিরাই আসেন ছন্দ পরিবর্তন করতে। বিশেষত এই মানুষটি অতি মনোহর, কৌতূহলকর। শুধু চেয়ে থাকতেই লোলার এত ভালো লাগে!

গৃহের সংলগ্ন তাদের শাক ও পর্ণের ক্ষেত। দুটি সৌভঞ্জন গাছে চমৎকার ফুল এসেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে শুভ্র ফুলগুলি ঝুলছে। মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। গৃহের পেছনে একটি সিন্ধুবার গাছে বিরাট একটি মৌচাক হয়েছে। লোলা ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র কুলুঙ্ক স্থির করেছে গোপনে ওই মৌচাকটি পাড়বে। পিতা, ভ্রাতাদের দেখে দেখে তারা ভালোই শিখে গেছে এ সব।

কয়েকটি প্রজাপতি লোলার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল, একটু লম্ফঝম্প করে সে একটিকে ধরে ফেলল। তার মুঠির ভেতরটা সুলসুল করছে। লোলার বিষম হাসি পাচ্ছে তাই। সে হাসতে হাসতে প্রাঙ্গণময় ছুটে বেড়াতে লাগল। চমৎকার নীল ও সোনালি বর্ণের প্রজাপতিটি। সে প্রজাপতিটি পুষবে।

এইভাবেই তার সোজাসুজি সংঘর্ষ হয়ে গেল অতিথির সঙ্গে।

অতিথি বললেন—অহো লোলা, তুমি কি সহসাই একটি প্রজাপতি হয়ে গেছো?

লোলার মুঠি খুলে গেল। প্রজাপতিটি ফুরুৎ করে উড়ে গেল। যাঃ।

লোলা বলল—আপনার বাঁ কাঁধে ও কী?

—বলো তো কী? প্রজাপতি নিশ্চয়ই নয়!

অত বিশাল বস্তুটিকে প্রজাপতি কল্পনা করার সম্ভাবনামাত্রেই লোলা উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল, তারপর বলল—আপনি তো অমন সুন্দর নীল সোনালি প্রজাপতিটি উড়িয়ে দিলেন।

—উড়তে উড়তে প্রজাপতিটি লোলার মধ্যেই অন্তর্হিত হয়েছে মনে হচ্ছে—অতিথি মৃদু হেসে বললেন।

কথা বলতে বলতে উভয়ে ভেতরের অঙ্গনে প্রবেশ করল। অতিথি পাকশালের দাওয়ায় কাঁধের ভারটি নামিয়ে রাখলেন। একটি অল্প বয়স্ক বন্য শূকর। প্রচুর কদলীপত্র দিয়ে সেটিকে ঢেকেছেন, তারপরে লতা দিয়ে বেঁধেছেন অতিথি।

গৃহকর্তা এবং তার পুত্ররা সবাই উৎসাহে হাতের কাজ ফেলে ছুটে এলো।

জ্যেষ্ঠ সাম বলল—আপনি কি এটিকে মারলেন অজ্জ?

অতিথি পিঠ থেকে তূণ এবং ধনুক নামাতে নামাতে বললেন—মহাবনের দিকে গেলে আমি সর্বদাই সশস্ত্র হয়ে যাই। চমৎকার শূকরটি চোখে পড়ল, মৃগয়া করে আনলাম। গৃহিণী জবালা পুত্রবধূদের নিয়ে গোহাল থেকে ফিরে এসে শূকরটি দেখে আনন্দ করতে লাগলেন। সকলেই হাত মুখ ধুয়ে প্রাতরাশে বসল। এদের কোনও ভক্তগৃহ (খাবার ঘর) নেই। পাকশালার দাওয়ায় বসেই ভোজন সারা হয়।

জবালা পরিবেশন করতে গিয়ে বললেন—এ কি অতিথের যাউ কই?—তখন লোলা এবং অন্য দুই কন্যারও মনে পড়ল—যাউ তো পাক করা হয়নি? গৃহিণীর তর্জন শুনে, অতিথি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারটি জানতে পারলেন। বললেন—আমার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থায় আমি কখনওই সম্মত নই। আপনাদের যা পাক হয়েছে আমিও তাই-ই ভোজন করবো।

গৃহকর্তা তক্কারি বললেন—তা-ও কি হয় কাত্যায়ন, আপনি কত বড় কুলের মানুষ। বিদ্বান পণ্ডিত, গান্ধারের পণ্ডিত আবার। ওরে বাপা! আপনাকে কি কাঁজি-মাজি খাওয়াতে পারি?

অতিথি বললেন—সমগ্র জাম্বু দ্বীপ ভ্রমণ করার বাসনা আমার। আপনি এবং আমি কতটা ভিন্ন কতটা অভিন্ন দেখব বলে বেরিয়েছি। কাঞ্জিক যদি আমাকে না দেওয়া হয়, তা হলে আপনি আর নিজের কতটুকু আমায় দিলেন?

—আপনাকে আমি বুঝতে পারি না, কাত্যায়ন—সরল চোখ দুটি তুলে কৰ্ষক তক্কারি বললেন—আপনি আর আমি কতটা ভিন্ন কতটা অভিন্ন? সবটাই তো ভিন্ন? আপনি তক্ষশিলার স্নাতক, মহাপণ্ডিত, কুলপুত্ত তো বটেই, অতি উচ্চ কুলে জন্ম আপনার। ব্রাহ্মণ তার ওপরে। আপনি রুপোর পাহাড়ের মতো শোভা পান। আর আমি…

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন অতিথি—তুলনার সূত্রগুলি আপনার সবই ভ্রান্ত। যাই হোক এক পাত্র কাঞ্জিক হবে কী?—বলে অতিথি কাত্যায়ন তাঁর পাত্রটি গৃহিণীর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন।

গৃহিণী সহাস্যে অতিথির পাতে কাঞ্জিক ঢেলে দিলেন। জ্যেষ্ঠা কন্যাটি কদলীপত্রে কুল্মাষপিণ্ড রেখে গেল।

তক্কারি বললেন—এ বৎসর বস্‌সন ভালো হয়েছে তাই। ভূমি তো নয় যেন ক্ষীরপাত্র। ধান হয়েছে চমৎকার। যব আশাতীত। শাকও বহু প্রকারের ফলেছে। ওদিকে গোচরটি ঘাসে থই থই করছে। গাভীগুলি ভালো করে ঘাস খেতে পেলে দুধের পাত্র উপচে দেবে, বলদ আমার বারোটি বুঝলেন অজ্জ। গত বছর যাগের জন্য দুটি বলদ একপ্রকার কেড়ে নিয়ে গেল, পরিবর্তে ক’টি কাংস্যপাত্তর দিয়েছে। তা কাংস্যপাত্র কি ধুয়ে জল খাবো? আমাদের কসস্‌কের ঘরে মৃৎপাত্রই তো যথেষ্ট! তা সে যাই হোক বারো বলদের হাল আমরা। বলদগুলি পেট পুরে খেতে পেলে গভীর করে লাঙল টানবে…এই সৌভাগ্যের বছরে আপনার মতো পণ্ডিতের পায়ের ধুলো পড়ল গৃহে আপনাকে শালিধানের যাউ পরিবেশন করতে পারছি না আমার কত ভাগ্য!

অতিথি বললেন—বর্ষণ ভালো না হলে কী করেন?

—চম্পা নদীর খাল একটি আছে। কিন্তু একটুও বস্‌সণ না হলে শস্য হবে না কাত্যায়ন। নদীখাল থেকে জল এনে সেচ করা অতিশয় শ্রমসাপেক্ষ। ক্ষেত্রে একটি কূপ আছে, কিন্তু বৃষ্টি না হলে সেটিও শুকিয়ে যায়। এ সব সময়ে সঞ্চিত ধান, লবণ আর এই কাননে যা পর্ণ-সৰ্ণ হয় তাই দিয়েই ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে হয় এরূপ সময়েই তো গ্রামবাসীরা বনে ফলমূল আহরণ করতে গিয়ে বনেচরদের হাতে মরে, কিংবা নগরে গিয়ে ধনীগৃহে দাস হয়। বীজগুলি খেয়ে ফেললে পরের বৎসরেও বিপদে পড়তে হয়।

লোলা এতক্ষণ গণ্ডে হাত রেখে পিতা ও অতিথির কথা শুনছিল। সে বলে উঠল—তক্ষশিলা কোথায়?

গৃহিণী বললেন—লোলা, গোচরে কুল্মাষ দিয়ে আয়।

লোলা মাথা নেড়ে বলল—সুতনাকে পাঠাও, আমি এখন তক্ষশিলার কাহিনী শুনব। অজ্জ, বলুন না তক্ষশিলা কোথায়!

লোলার পিতা বললেন—উত্তর কুরু দেশের ওদিকে হবে। যেমন দূর, তেমন দুর্গম।

কন্যাকে তক্ষশিলার অবস্থান বিষয়ে অবহিত করতে পেরেই বোধহয় কৰ্ষক তক্কারি পরম সন্তোষের সঙ্গে অবশিষ্ট কাঞ্জিকটুকু খেয়ে ফেললেন।

—একেকজন আচারিয়র কী ক্ষমতা! সেবায় তুষ্ট করতে পারলে মাথায় একটি হাত রাখবেন আর তাবৎ বিদ্যা মাথার মধ্যে এসে যাবে —খেয়ে-দেয়ে তিনি বললেন।

লোলা বলল—সত্যি? আমি তক্ষশিলায় যাবো। যদি আচারিয়কে তুষ্ট করতে পারি, বিদ্যা পাবো? বলুন না অজ্জ। আচ্ছা আচারিয় কী প্রকার? বৃক্ষদেবতার মতো?

—তক্ষশিলার আচারিয়রা আমি যতদূর জানি ইন্দ্ৰমায়ায় অদৃশ্য থাকেন। বহু-যজ্ঞ করলে তরে আবির্ভূত হন। —লোলার পিতা বললেন।

অতিথি সহাস্যে বললেন—এরূপ কাহিনী আপনি কোথা থেকে শুনেছেন?

কস্‌সেক ভেবে-চিন্তে বললেন—শুনে আসছি। পিতার কাছ থেকে শুনেছি সম্ভবত। অতিথিরা এলে তাঁদের কাছ থেকে পথের বিবরণ শোনা আমার পিতার অভ্যাস ছিল। আচ্ছা কাত্যায়ন, আপনি তো এখন সারাদিন ধরে কী যেন লিখবেন। কী ও? লিপি?

অতিথি বললেন—না, লিপি ঠিক নয়, ও বোধ হয় আমার ভাবনা-চিন্তা।

—ভাবনা-চিন্তা? সে তো মাথায় থাকে?

—লিপিবদ্ধ করবার প্রয়োজন বোধ করি, ভদ্র।

এতক্ষণ কর্ষকের পুত্ররা অনেক কষ্টে কৌতূহল সংবরণ করে ছিল। এবার দ্বিতীয় পুত্র রাম বলল—কোন ভাবনা লিপিবদ্ধ করেন ভদ্র?

—এই যেমন রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক…

—রাজার সঙ্গে প্রজার আবার সম্পর্ক কী?—জ্যেষ্ঠ সাম বলল।

তক্কারি বললেন—মহাবন কেটে ক্ষেত প্রস্তুত করেছি। সে যে কী কষ্ট কাত্যায়ন! তখন গামনী ছিলেন না। তারপর তাতে হাল চালিয়ে, বীজ বুনে, ব্রহ্মার কৃপায় যথেষ্ট বৃষ্টিতে ধানগুলি লালন করেছি। কেটে ঘরে তুলছি বছরের পর বছর, বৃক্ষদেবতার অর্চনা করি গন্ধমাল্য দিয়ে, বৃষ্টি তেমন না হলে ইন্দ্রমূর্তি আছে, ব্রত করে নারীরা, দূর নিগম গাম থেকে গামভোজক আসেন বছরে একবার। গণনা করে যা নেবার নিয়ে যান। মহারাজ ব্রহ্মদত্তর কাছে কোনও অপরাধ তো করিনি।

—কোনও অপরাধের প্রশ্ন নেই কৰ্ষক। কিন্তু আপনি ব্রহ্মদত্তর নাম করলেন কেন? ব্রহ্মদত্ত তো বহুদিন গত হয়েছেন! এখন রাজা তো মগধাধিপ বিম্বিসার।

ওই হল—তক্কারি বললেন—রাজায় রাজায় ভিন্নতাই বা কী! এঁরা সব দেবতা। আমরা হলাম গিয়ে অধম মানুষ। ওঁরা সব ইন্দ্ৰমায়া জানেন।

রাজাকে, আচাৰ্য্যকে, পণ্ডিতকে—সকলকেই তা হলে আপনারা মায়াবি দেবতাসদৃশ বলে মনে করেন, কৰ্ষক? এ ধারণা তো ঠিক নয়!

লোলার হতে কুল্মাষ পিণ্ড। সে এক হাতে সেটি ধরে অন্য হাত দিয়ে অল্প অল্প খাচ্ছিল, তার খাওয়া থেমে গেল। সে বলল—অজ্জ, রাজারও কি আমাদের মতো দুটো হাত থাকে?

—রাজার, আচার্যর সবারই দুটোই হাত, দুটোই পা, অবয়বগুলি সব একই প্রকার। কোনও মায়াই কারো জানা নেই।

—কেন রাজা কি দেখেছেন যে বলছেন?—তক্কারি একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন।

—মহারাজ বিম্বিসারকে তো অতি নিকট থেকে দেখেছি। তিনি আপনার আমার মতোই মানুষ।

সব সময় অলঙ্কার বা পঞ্চ রাজচিহ্ন ধারণ করতেও ভালোবাসেন না। ছদ্মবেশে প্রজাদের মধ্যে ঘুরে বেড়ান।

—ছদ্মবেশ! সর্বনাশ!—সাম বলল—সে ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ আপনিও তো ছদ্মবেশী রাজা হতে পারেন।

রাম সসম্ভ্রমে বলল—আপনাকে দেখেই অন্য প্রকার মনে হয়। আমি প্রথমেই আমার পত্নীকে বলেছিলাম…

অতিথি বললেন—আমি রাজা নই। কিন্তু রাজা এরূপ ছদ্মবেশ নিতেই পারেন। আপনারা জানেন তো বাহুবলে মহারাজ বিম্বিসার এই মগধরাজ্য একত্র করেছেন, অঙ্গরাজ্যে জয় করেছেন…

—আমরা এ সব কিছুই জানি না—তক্কারি সবিস্ময়ে বললেন, তা ছাড়া রাজার রাজায় তো কতই যুদ্ধ হয়।

—অঙ্গ মগধের যুদ্ধ হলে আপনারা কোন পক্ষে ছিলেন? অবশ্য যুদ্ধের কথাই জানেন না যখন এ প্রশ্ন করা বৃথা। তবু জিজ্ঞাসা করি। ধরুন এখন যদি মগধের সঙ্গে অবন্তীর যুদ্ধ হয় কার পক্ষ নেবেন?

—অবন্তী কোথায় তা জানি না। কিন্তু অবন্তীরাজ যদি জয়লাভ করেন তো তাঁরই পক্ষ নিতে হবে।

অতিথির মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি বললেন—যে রাজাকে এখন কর দিচ্ছেন তিনি মহারাজ বিম্বিসার। বাহুবল যেমন আছে তেমন হৃদয়ও আছে। করভার বাড়ান না। গ্রামণীদের ডেকে সভা করেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে গ্রাম-সংবাদ নেন। তিনি যদি আক্রান্ত হন, তার অর্থ আপনারাও আক্রান্ত হলেন। সৎ, মহানুভব রাজা। ইন্দ্ৰমায়া জানেন না। কিন্তু তিনি পিতার মতো।

সাম আবার সসম্ভ্রমে বলল—আপনার মতো যদি হন তিনি, তা হলে আমরা অবশ্যই তাঁর পক্ষে। কিন্তু যুদ্ধকালে আমরা কস্‌সকরা কিভাবে তাঁর পক্ষ নেওয়াটা দেখতে পারি।

—যুদ্ধকালে যদি আপনাদের সবারই কিছু অস্ত্র শিক্ষা থাকে তো গ্রামরক্ষার কাজে লাগবে তা। আপনারা কি কিছুই জানেন না? দস্যুর উপদ্রব হলে কী করেন?

—গ্রামের উপান্তে চণ্ডালপল্লী আছে। তারা ভালো বংশধাবন করতে পারে অজ্জ, উৎসবে যেমন খেলা দেখায়, দস্যু-টস্যু এলেও তেমনি বংশধাবন ভালোই কাজে লাগবে।

—এ প্রকার বিদ্যা আপনাদেরও জানা উচিত।

—আমাদের কনিঠ্ঠ ভাই ভালো বাঁশ চালাতে জানে। সহজ ক্ষমতা আছে।

—এ গ্রামে আপনাদের একটি অস্ত্রশিক্ষাগার থাকলে ভালো। কারণ বিদেশি সৈন্য তো প্রথমে প্রত্যন্ত গ্রামগুলিই আক্রমণ করবে…।

—আপনার কথা শুনে আমার হৃৎকম্প হচ্ছে…তক্কারি বললেন, অবন্তী কি মগধ আক্রমণ করছে?

—করেনি। আমাদের এই জম্বুদ্বীপের রাজারা হয়ত পরস্পরকে আক্রমণ আর করবেন না। কিন্তু জম্বুদ্বীপের বাইরেও তো পৃথিবী আছে, সেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী নৃপতি জম্বুদ্বীপের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে, সে রূপ সুঃসময়ে আপনাদেরও মগধরাজ বিম্বিসারের পশ্চাতে থাকতে হবে। তাঁর প্রতি আনুগত্য নিয়ে। নিজেদের গ্রাম রক্ষার কিছু ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিছু শস্য সঞ্চয় করে যেতে হবে অসময়ের জন্য।

—জম্বুদ্বীপের বাইরে কোন দিক থেকে শত্রু রাজা আসতে পারে?

—সভয়ে জিজ্ঞাসা করল রাম।

—উত্তর-পশ্চিম থেকে আসবার সম্ভাবনা আছে।

পুরুষেরা কাজে যোগ দিতে চলে গেলে, লোলা অতিথির কাছে এসে বসল বলল—মহারাজ বিম্বিসার কেমন, অজ্জ?

—অতিশয় মহানুভব। তোমাদের সবার কথা চিন্তা করেন।

—লোলার কথাও?

অতিথি একটু হাসলেন—হ্যাঁ, লোলার কথাও।

—দেখতে কেমন?

অতিথি বললেন—একটি পোড়া কাঠের খণ্ড নিয়ে এসো তো!

লোলা অবিলম্বে পাকশাল থেকে কাঠের টুকরো নিয়ে এলো।

অতিথি দাওয়ার ওপর সযত্নে একটি চিত্র লিখলেন। তারপর বললেন—ভালো করে দেখো লোলা। এই হলেন ব্যক্তি বিম্বিসার। এইবার মাথায় কিরীট দিলাম, কানে কুণ্ডল দিচ্ছি, বাহুতে অঙ্গদ—কণ্ঠে মণিহার। ইনি হয়ে গেলেন এক অভিজাত রাজপুরুষ। এইবার বক্ষে বর্ম দিলাম, কটিতে তরবারি, কাঁধে ধনুর্বাণ—ইনি উপরন্তু একজন মহারথ যোদ্ধা হলেন। হলেন তো? সবশেষে আমি এঁর চক্ষু লিখছি। এই চক্ষুর দৃষ্টি দেখলেই বুঝতে পারবে ইনি তোমাদের কথা ভাবছেন। অতিথি প্রতিকৃতির মুখের মধ্যে সযত্নে চোখ দুটো আঁকলেন, বললেন—এই হলেন মহারাজ বিম্বিসার।

লোলা অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইল প্রতিকৃতিটির দিকে, তারপর অতিথির দিকে অপাঙ্গে চাইল, বলল বুঝেছি।

—কী বুঝেছো বালিকা?

—বুঝেছি—বলে লোলা মুখ টিপে হাসল।

অতিথিকে একটি কুটির দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ একটি কক্ষ আর তার সম্মুখের দাওয়া। রাত্রে গৃহের একমাত্র পৌত্রটি ও কনিষ্ঠ পুত্রটি এখানে শোয়। সারাদিন রাজশাস্ত্র লেখার কাজ করলেন অতিথি। মধ্যাহ্নের কিছু পূর্বে গিয়ে পুষ্করিণীতে স্নান করলেন। মধ্যাহ্নে পাকশালার দাওয়ায় বসে দেখলেন তার থেকে একটু দূরত্বে গৃহের পুরুষদের পাতাগুলি রাখা। তাঁকে দেওয়া হয়েছে রক্তবর্ণ কম্বলের আসন, সামনে কাংস্যপাত্রে ভোজ্য। উত্তম শালিধানের চালের অন্ন, ঘৃতের গন্ধে অঙ্গনটি ভরে গেছে। তিন চার প্রকার ব্যঞ্জন। অম্ল, দধি—এবং অবশ্যই শূকর মাংস।

প্রতিবাদের মধ্যে যেতে ইচ্ছে হল না। তিনি শুধু বললেন—লোলা কই? লোলা আমাদের সঙ্গে ভোজনে বসুক।

পাকশালের দুয়ারে দাঁড়ানো গৃহিণী জবালা আর দাওয়ায় বসা গৃহকর্তা তক্কারির মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় হল। তক্কারি বললেন,—লোলাকে কাত্যায়ন স্নেহ করেন, লোলা বসুক।

লোলা বসুক, লোলা বসুক—একটা বর উঠল। এরই মধ্যে তার পাত্রটি ডান হাতে ধরে লোলা অতিথির অবিদূরে এসে বসল। অতিথি তাঁর পাত্র থেকে কিছু কিছু ভোজ্য লোলার পাত্রে তুলে দিলেন। সকলেই সসম্ভ্রমে নীরব রইল।

ভোজনের সময়ে কেউই বিশেষ কথা বলছে না। অতিথি বললেন,—বন্যা বরাহটি তো অতি সুস্বাদু পাক হয়েছে।

জবালা মৃদুস্বরে বললেন—প্রচুর মাংস অজ্জ, আমরা প্রতিবেশী গৃহেও কিছু পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনার অনুমতি নেওয়া হয়নি।

অতিথি হেসে বললেন—গৃহের খাদ্য কী রূপ ভাগ হবে তার জন্য অতিথির অনুমতির প্রয়োজন কী? অতিথি মৃগয়া করতে ভালোবাস। এরপর আপনাদের শীঘ্রই মৃগমাংস খাওয়াবো।

লোলা বলল—কালই তো একটি গোবৎস মারা হবে। শূলপক্ক হবে। এখন মৃগয়া করবেন না।

অতিথি মুখ তুলে তক্কারির দিকে চাইলেন—সে কী? আপনি হঠাৎ গোবৎসটি মারবার ব্যবস্থা করছেন কেন?

তক্কারি বললেন—মাননীয় অতিথির জন্য আমরা তো কিছুই করিনি। ঘরের খুদ-মুগের পিণ্ড পর্যন্ত খাইয়েছি। একদিন…

—সে ক্ষেত্রে আমি আজ এই ভোজনের পরেই যাত্রা করছি। গৃহস্থের ঘরে তিন রাতের অধিক থাকাই উচিত না।

লোলা বলল—না, না, আপনি যাবেন না অজ্জ।

রাম ও সাম দুজনেই সন্ত্রস্ত হয়ে হাত গুটিয়ে বসল। তক্কারি বললেন, —আপনি যা বলবেন তাই হবে কাত্যায়ন, আমি গো-বৎসটি মারবো না, আপনি অনুগ্রহ করে কিছুদিন থাকুন।

অতিথি মুখের হাসি গোপন করে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। ভোজন সমাপ্ত হল। কিন্তু রাত্রে গৃহের কনিষ্ঠ পুত্র ও পৌত্রটি অতিথির কক্ষে শুতে এলো না।

রাত্রে দীপ জ্বালিয়ে এদের তৈল ব্যয় করতে তাঁর সঙ্কোচ হয়। তেলের মূল্য দিতে আরো সঙ্কোচ হয়। সুতরাং রাত্রে লেখার কাজ বন্ধ থাকে। যতক্ষণ চাঁদ বা তারার আলোয় পথ একটুও দেখা যায়, তিনি চংক্রমণ করেন, তারপর নিজকক্ষে এসে গবাক্ষের পাশে একটি ছোট বেত্ৰপীঠ নিয়ে বসে থাকেন। ভাবেন। অনেক ভাবনা চেষ্টা করে মন থেকে সরিয়ে দেন। নগরের স্মৃতিজটিলতা থেকে তিনি এখন কত দূরে! এই প্রত্যন্ত গ্রাম যা এক কোণে সকল পথের আয়ত্তের বাইরে আশ্রয় পেয়েছে, এখানে রাত্রির অন্ধকারে বসে বসে রাজগৃহের দীপদণ্ডালোকিত পথগুলি কল্পনা করা যায় না। কল্পনা করা যায় না সেই সব পণ্যঋদ্ধ আপণশ্রেণী, প্রাসাদগুলি, রাজপুরুষ, শ্রেষ্ঠীদের সেই বৈভব। নৃত্য, গীত, শিল্প, বিদ্যা, শ্ৰমণদের সেই ভিক্ষাবিলাস, বেণুবনে দেশনা। তিনি রাজগৃহ থেকে এই গ্রামভূমির দিকেই ক্রমশ এগিয়েছেন। অঙ্গ মগধের সীমায় চম্পা নদী। চম্পা পার হয়ে যা পূর্বে অঙ্গদেশ ছিল, এখন মগধের অন্তর্ভুক্ত, সেই রাজ্যের বহু গ্রামে গেছেন, চম্পা নগরীতে অধিক দিন থাকেননি, কিন্তু দেখেছেন তা-ও। বড় সুন্দর এই জীবনধারা। শান্ত, শিষ্ট। কিন্তু বড় অজ্ঞ। বিদ্যার কথা তিনি ভাবছেন না। কিন্তু নিজের দেশের রাজা কে, রাজা কীরূপ, কবে যুদ্ধ হল, রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন এলো, কাকে কর দেয়, কার প্রতি অনুগত থাকতে হবে, উত্তরকুরু, গান্ধার, অবন্তী এইসব দেশগুলি অন্তত পক্ষে কোন দিকে এটুকুও না জানা বড় নৈরাশ্যজনক। বংশের পর বংশ এদের জীবনযাত্রা দু-চারটি গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বৈবাহিক সম্পর্কের জন্যও এরা বেশি দূরে যাবে না। বংশের পর বংশ শুধু কয়েক যোজনের ভূমিকে পৃথিবী বলে জানবে। ওই লোলা নামে বালিকাটি বুদ্ধিমতী, কৌতূহলী—তার জীবন শেষ হবে এই প্রকার একটি কুটিরে খাদ্য পরিবেশন করতে করতে। এই সরলতা কাম্য, কিন্তু অজ্ঞতা যাক। রাজশক্তির সঙ্গে আরো একটু প্রত্যক্ষ সম্পর্ক হোক, না হলে দূরের স্বপ্নলোকের কোনও মায়াবি রাজপুরুষের প্রতি আনুগত্য, ভক্তি, ভালোবাসাই বা প্রত্যাশা করা যায় কী ভাবে?—আবার দূরত্বও চাই। সম্ভ্রম না থাকলে আস্থাও তো থাকে না।

অতি প্রত্যূষে উঠে স্নানসেরে নিয়ে তিনি পুঁথি খুলে বসলেন। রাজার সঙ্গে প্রজার এই নাতিনিকট, নাতিদূর সম্পর্কের নীতির কথা এখুনিই লিখে ফেলা প্রয়োজন। একটা নতুন কথা তাঁর মনে হচ্ছে, রাজার মাঝে মাঝে নিজ রাজ্য পরিভ্রমণ করা উচিত। আসুন তিনি লোকজন, সৈন্যসামন্ত নিয়ে, কিন্তু কোনও সুবিধাজনক স্থানে স্কন্ধাবার রেখে ছদ্মবেশে নিকটবর্তী ও দূর দূর কোণের এই সকল গ্রামভূমি পরিক্রমা করলে তিনি বুঝতে পারবেন তাদের সঠিক অবস্থা, প্রয়োজন। কারণ রাজধানী থেকে যতই দূর যাওয়া যাবে, ততই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায়। বছরে একবার অন্তত রাজা রাজধানী থেকে বেরিয়ে যাবেন গোপনে, বিশ্বস্ত উপরাজ অর্থধর্মানুশাসক ও বিনিশ্চয়ামাত্যর ওপর রাজ্যভার দিয়ে। এক এক বৎসর যাবেন একেক দিকে।

পরবর্তী দু-একদিনের মধ্যে অতিথি বুঝতে পারলেন সমগ্র একসালা গ্রামের লোক ভেবেছে তিনিই ছদ্মবেশী বিম্বিসার। তাদের আচার-আচরণ আগের থেকেও সম্ভ্রমপূর্ণ। মাঝে মাঝে তক্কারিগৃহে নানা প্রকার উপহার আসছে। যেদিন তিনি একটি বিরাট মৃহ ও বন্য বরাহ মৃগয়া করে গ্রামকেন্দ্রে ভোজের ব্যবস্থা করলেন, নিজেই মাংসগুলি শূলপক্ক করছিলেন, একটু দূরত্ব রেখে গ্রামবাসীরা চেষ্টা করছিল তাঁর হাত থেকে শূলগুলি নিয়ে নিতে। শেষে যখন পরিবেশন আরম্ভ হল, ফিসফিস শব্দ শুনে তিনি কান খাড়া করলেন। ওরা বলছে—রাজার প্রসাদ, রাজার প্রসাদ। স্বয়ং রাজার হাতের মারা হরিণ বরা, তাঁরই হাতে ঝলসানো—কোনও গামে, কেউ কোথাও কখনো খেয়েছে?…এমন রাজা হলে তাঁর জন্যে প্রাণ দিতে পারি আমরা হাসতে হাসতে।

এই শেষ কথাগুলি শুনতে শুনতে অতিথির হৃদয়ের ভেতরে এক মহোল্লাসের ভাব জন্ম নিল। এরা যদি তাঁকেই মহারাজ বিম্বিসার ভাবে তো ক্ষতি কী? এক অর্থে তিনি তো বিম্বিসারই। তাঁরই প্রসারিত সত্তা। চক্রবর্তী রাজার আগে আগে নাকি তাঁর চক্র যায়। এখন তিনি বুঝতে পারছেন এই চক্র কোনও অস্ত্র নয়, বিম্বিসারের চক্র তিনিই হতে পারেন, হয়েছেন।

পরের দিন প্রত্যূষে তিনি একসালা গ্রাম ছেড়ে যাবার জন্য পুঁথিপত্র বেঁধে ফেললেন। কাউকে স্বভাবতই জানাননি। তক্কারি-গৃহ অনেকটা ছাড়িয়ে এসেছেন, পেছনে থেকে—রাজা, রাজা ডাক শুনে দাঁড়ালেন। লোলা ছুটতে ছুটতে আসছে।

—কাউকে না বলে চলে এসেছেন? আমাকেও বলেননি? ওরা যে বলে লোলা রাজার পিয়।

—ভুল হয়ে গেছে লোলা। তুমি অবশ্যই আমার প্রিয়পাত্রী, তোমাকে একটা উপহার দেবার ইচ্ছা ছিল আমার কিন্তু একবার এক বালিকাকে উপহার দিয়ে তাকে প্রাণান্তিক বিপদে ফেলে দিয়েছিলাম তাই কোনও উপহার, কোনও স্মৃতিচিহ্ন দেবো না, লোলা। বস্তু ব্যতীত এই অতিথিকে যদি মনে রাখতে পারো তবেই বুঝবো তুমি সত্যসত্যই তাকে ভক্তি করো।

লোলা সজল চোখে বলল—আমি আপনাকে চিরকাল মনে রাখবো রাজা, যখন বৃদ্ধা অতিবৃদ্ধা আরও বৃদ্ধা পিতামহী প্রপিতামহী হয়ে যাবো, তখনও…তখনও—কিন্তু আপনি অনেক দূর যাবেন। মা আপনার জন্য খজ্জ পাঠিয়ে দিয়েছে। এই পেটিকায় আছে। উপহারের দ্রব্যগুলি তো সবই ফেলে এলেন—এই পেটিকাটিতে খজ্জ এনেছি।

—কী এনেছ বালিকা—অতিথি হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন।

—শুকনো মাংস আছে, মৃগমাংস, দু-তিনদিন থাকবে, চিঁড়ে আছে, মণ্ড আছে, আর দেখুন—সে পেটিকাটি খুলে দেখালো শালপাতার দীর্ঘাকার পাত্রে—দেখুন এগুলি লোলার অতিপ্রিয় খজ্জ—অতিথি দেখলেন পত্রপুটে রয়েছে কিছু ভাজা চণক।

লোলা বলল—মা বলছিলেন এগুলি ঘোড়ার বা গাধার খজ্জ, এগুলি কেউ কাউকে দেয় না। আমি লুকিয়ে এনেছি। আপনি রাগ করবেন না তো?

অতিথি অন্যমনস্কের মতো বালিকাটির শিরে হাত রাখলেন, বললেন—তুমি, তোমার অন্তরাত্মাই একমাত্র সঠিক কথাটি বুঝেছে। অনেক সরস, সুরসাল, মূল্যবান খাদ্য আছে, মাংস, মৎস্য, পায়স,…কিন্তু সবসময়ের জন্য, সব সরলমতি মানুষ-মানুষীর কাছে প্রিয় এই চণক। আমার মনে থাকবে…

অশ্রুমুখী বালিকাটিকে পথহীন গ্রামের সেই বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে রেখে চণক চলে গেলেন।

পরে যখন মহারাজ বিম্বিসার রাজনীতির জটিল ঘূর্ণাবর্তে পড়ে নিহত হলেন, তখন মগধের প্রজারা অনেকেই জানতেই পারেনি। যারা জেনেছিল তারাও ওসব রাজাদের ব্যাপার বলে যে যার কাজে মনোনিবেশ করেছিল। শুধু একসালা গ্রামের তরুণী বধূ লোলা গ্রামপ্রান্ত থেকে ক্রমবিলীয়মান সেই উন্নত দেহ, রজতবর্ণ অতিথির কথা মনে করে বড় কান্না কেঁদেছিল। বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল অঙ্গরাজ্যের প্রান্তিক কয়েকটি গ্রাম যেখানে যেখানে চণক একদা বাস করেছিলেন।

ছায়া পূর্ব দিগন্তে ক্রমপ্রসরমান। সকাল থেকে সন্ধ্যা, আবার সন্ধ্যা থেকে সকাল। একইভাবে যাওয়া আসা করে। গান্ধার-ভবনের দাস-দাসীগুলি দিনের পর দিন এই বৈচিত্র্যহীনতায় ক্ষুব্ধ! এই গান্ধাররমণী জিতসোমাকে তারা কতভাবেই না দেখল! ইনি যখন সদ্য সদ্য গান্ধার থেকে এলেন, মগধের রাজ-অন্তঃপুর চমকে উঠেছিল। শঙ্খশ্বেত গাত্রবর্ণ। শ্বেতমর্মরের মূর্তি বলে ভুল হয়। আকৰ্ণবিস্তৃত ভ্রূ। দীর্ঘ নয়ন। চোখের মণি দুটি যেন মৃদু নীলাভ জলে ভাসছে। চোখের পাতাগুলি দীর্ঘ এবং বক্র। নাসা কান যেন স্ফটিক দিয়ে কেউ সযত্নে নির্মাণ করেছে। দ্যুতিময় দীর্ঘ কেশ। দীর্ঘ একটি মণিময় দীপদণ্ড বুঝি। একমাত্র দেবী ক্ষেমার মধ্যে এই জাতীয় রূপগরিমা দেখা ছিল। ইনি যেন আরও অলৌকিক। চিত্রের মতো, বা স্বর্গীয়। ছেল্লনা দেবীর আদেশে যেদিন নৃত্য-গীত করলেন— সবাই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এসেছিলেন দেবী কোশলকুমারী, দেবী ক্ষেমা, দেবী উপচেলা। অন্তঃপুরিকারা সবাই ছিলেন।

প্রমোদগৃহের মুক্ত দ্বারপথে সমস্ত শরীরে অদ্ভূত কয়েকটি চক্রাকার পাক দিতে দিতে প্রবেশ করলেন নটী জিতসোমা। সোনার কাজ করা সূর্যাস্ত বর্ণের মসৃণ দুকূলবসন সঙ্গে সঙ্গে পাক খাচ্ছিল। তারপর মণিকুট্টিমের বিভিন্ন জায়গায় নটী পুরো শরীর দিয়ে রক্তকমল ফোটাতে লাগলেন। একে একে বারোটি কমল ফুটল। তখন কক্ষের মাঝখানে জানু ভেঙে বসে তিনি প্রস্ফুটিত কমলিনীর সংগীত গাইলেন। বীণা ছিল না। ছিল শুধু মৃদঙ্গ। অন্তরাল থেকে বাজছিল। গান্ধার-ভবনের দাসীরা এখনও সেই সব নৃত্য ও গীতের কথা গল্প করে। দেবী ছেল্লনা বলেছিলেন— একে রাজগৃহ-নটীর পদ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলে তো সালবতীর নৃত্য-গীত বানরীর লম্ফ-ঝম্প মনে হবে, তাই না জেটঠা!

কোশলকুমারী বলেন— তা নয়। সালবতী যথেষ্ট কুশলী। কিন্তু জিতসোমার সৌন্দর্যের ধরনটি আমাদের অচেনা। তার নৃত্য-গীতের ধরনও তাই। আমরা এরূপ দেখিনি, নটী এই যে গীত গাইলে— এ সুর, এ ভাষা কোথাকার?

—পারস্যের, দেবী। পারসিক বণিকরা গান্ধার ও কাশ্মীরে প্রায়ই যাতায়াত করেন, তাঁদের সঙ্গে পারসিক নটীও আসেন কিছু কিছু। আমার মা শিখেছিলেন তাঁদের থেকেই।

পরবর্তী সমাজোৎসবে রাজগৃহের প্রধান নৃত্যগৃহে তোমার নৃত্য-গীতের আয়োজন করি? এমন রত্ন পাঠিয়েছেন গান্ধার-রাজ, সবাই দেখুক!

দেবী উপচেলা বললেন— রাজগহে তো কোলাহল পড়ে যাবে জেটঠা এমন নটী দেখলে। দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে থাকবে।

কোশলকুমারী হেসে বলেছিলেন— অম্বপালীর খ্যাতিও কি ম্লান হয়ে যাবে, ভগিনী উপচেলা? তা হলে বৈশালীর কী হবে?

বৈশালী দেবী ছেল্লনা ও দেবী উপচেলার পিতৃভূমি। দুজনেই বৈশালী সম্পর্কে অত্যন্ত দাম্ভিক ও স্পর্শকাতর। ছেল্লনা বললেন— বৈশালীর সমৃদ্ধি-প্রতিপত্তি কি একমাত্র অম্বপালীর ওপরই নির্ভর করে আছে নাকি?

কোশলকুমারী মৃদু হেসে সম্ভবত তাঁর দুই সপত্নীর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে বললেন— সেনাপতি সীহ, অভয় এঁদের বাহুবল, পিতৃব্য ছেটক ইত্যাদির শাসনদক্ষতা, জিন মহাবীরের তপস্যার পুণ্য ইত্যাদির কথা বলছ তো? লোকে কিন্তু বলে থাকে—বৈশালীর প্রতিপত্তির অর্ধেক যদি এঁদের জন্য তো বাকি অর্ধেকের জন্য শংসা প্রাপ্য একা অম্বপালীর।

সমাজোৎসবে বেরোবার নামেই কিন্তু নটী জিতসোমা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর তো কুমারের প্রাসাদে এবং পরে গান্ধার-ভবনে তাঁকে পাঠানো হল। দাস-দাসীদের আশা ছিল— এই গান্ধার-ভবন রাজগৃহের শ্রেষ্ঠ প্রমোদভবন হয়ে উঠবে। ধনী, জ্ঞানী, গুণী, শক্তিমান— নানা ধরনের ব্যক্তি আসবেন। প্রতিদিন নিত্যনতুন সমারোহ হবে। কিন্তু জিতসোমা আর সেভাবে নাচলেন না, গাইলেন না। কখনও কখনও আপনমনে গীত গান, দাসীরা উৎকৰ্ণ হয়ে থাকে, কিন্তু দু’চার কলি গাইবার পর দেবী নীরব হয়ে যান। তাঁর চলায়, বলায় অবশ্যই একটি অপূর্ব ছন্দ আছে। কিন্তু জিতসোমা দাসীদের সঙ্গে সহজ সখিত্বের ভঙ্গিতে কথা বলতেও পারেন না। তিনি এখনও গান্ধার রমণী, বিদেশিনী। মগধের দাস-দাসীরা তাঁর আদেশ পালন করে কিন্তু মনের তল পায় না। ইনি দূরত্ব রেখে চলেন। তা-ও যতদিন আচার্যপুত্ত ছিলেন, তিস্‌সকুমার ছিলেন, একটা আনন্দের বাতাবরণ ছিল। মহারাজ বিম্বিসার আসতেন, তিনজনে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা জমে উঠত, ভালো ভালো খাদ্য পানীয়র ব্যবস্থা হত। গৃহসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন জিতসোমা। কিন্তু অজ্জ চণক ও তিস্‌সকুমার চলে যাবার পরে এই গান্ধাররমণীর মধ্যে কেমন একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। প্রতিদিন প্রসাধন ও সাজসজ্জার সেই সমারোহ আর নেই। ভোজ্য তালিকা কী হবে তা নিয়ে দেবী মাথা ঘামান না। গান্ধার-ভবনের সাজসজ্জার সেই পারিপাট্য? তা-ও যেন আগের মতো আর নেই। অথচ তারা বুঝতে পারে এই ভবন এবং এই রমণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মহারাজ বিম্বিসার আসেন, কুমার কুনিয় আসেন, আসেন মহাবেজ্জ জীবকও। এত কি লেখে এই রমণী? এত কী-ই বা বলে? এইসব রাজা-রাজকুমার জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা কী-ই বা এতো আলোচনা করেন এর সঙ্গে?

দ্বিপ্রহর পার হয়ে যাবার পর তারা ভোজনের জন্য তাড়া দিতে গিয়েছিল। কর্ত্রী লেখায় মগ্ন, একবার মুখ তুললেন, যেন তাদের এই প্রথম দেখছেন।

—ভোজন? কেন? কোথায়?

—সে কি? আপনি মধ্যাহ্নে খাবেন না!

অনেকক্ষণ বিহ্বলভাবে তাকিয়ে থেকে কর্ত্রী সহজ হলেন। বললেন— অহো, কী অন্যায়, আমি খাইনি বুঝি? তোমরা সবাই খেয়ে নাও ধীরা। আমাকে বরং একটু দুগ্ধ দিয়ে যাও।

দুগ্ধ, ফল, মিষ্টান্ন, মধু… দিনের বেলায় এর অধিক কিছু প্রায়ই খাওয়া হয় না। পশ্চিমের বাতায়নের কাছে লেখার ফলকটি টেনে নিয়ে গেছেন কর্ত্রী। রক্তাভ মৃদু আলো এসে পড়ছে পুঁথির ওপর। শ্বেতবসন। শ্বেত উত্তরীয়টি অবগুণ্ঠন দিয়ে মাথা থেকে কণ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছেন। বিরাট বৈদূর্যের অঙ্গুরীয়টি আঙুলে করে ঘোরাচ্ছেন মাঝে মাঝে, এমনই মুদ্রাদোষ এই গান্ধারীর। অঙ্গুরীয়টি বোধ হয় একটু শিথিলও হয়ে গেছে। কানের হীরাগুলি ঝলকাচ্ছে। ডান হাতের মণিবন্ধের স্বর্ণাভরণ পাশে খুলে রেখেছেন। চাপ পড়লে পুঁথির ভূর্জপত্রগুলির ক্ষতি হতে পারে।

দাসীরা বলাবলি করে দেবী কৃশ হয়ে যাচ্ছেন। বলয় হাতে ঢলঢল করছে। প্রসাধন করেন না, ওষ্ঠাধর দুটি কেমন বিবর্ণ দেখায় নারীদের কী রূপ বিষয়ে এত উদাসীন হতে হয়! কুমার কুনিয়কে তুষ্ট করতে পারলে দেবীর জীবনে বিলাস, শ্রী ও ক্ষমতার নতুন উৎসই খুলে যাবে, সেই সঙ্গে যাবে তাঁর দাসদাসীদেরও। কিন্তু এই রমণীর কোনও বিষয়েই যেন কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।

জিতসোমা এখন অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এক নীতির কথা লিখছে। সে একেবারে তন্ময়। লিখছে: রাজাদের তিন ভয়। বহিঃশত্রু ভয়, অন্তঃশত্রু ভয় ও আত্ম ভয়। বৈভব এবং ক্ষমতার স্বাদ রাজাকে ভোগী, আত্মপর, শক্তির ব্যবহারে স্বৈরাচারী করে তুলতে পারে। এই হল আত্মভয়। যে রাজা বা রাজশক্তি বোঝে না তার ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা কোনওটাই নিজস্ব নয়, সে রাজশক্তিকে ঘৃণা করে না এমন ব্যক্তি নেই। তার পতনও আসন্ন। রাজভৃতকদের সাহায্যে প্রজাদের ওপর অত্যাচার। প্রজাদত্ত রাজস্বের ব্যক্তিগত ব্যবহার যা পরস্বাপহরণেরই নামান্তর, নিজস্বার্থে যখন-তখন যাকে-তাকে শাস্তি দেওয়া, এই লক্ষণগুলি প্রকট হলেই বুঝতে হবে রাজ্য বিপন্ন। রাজা নিজেই নিজের শত্রু।

‘অন্তঃশত্রুভয়’ অংশে সে লিখল: বহুপত্নীক রাজা মনোযোগ সমবণ্টন করতে না পারলে পত্নীদের মধ্যেই শত্রু সৃষ্টি হবে। ভোজনকালে মার্জারকে বা পাচককে না খাইয়ে তিনি খাদ্যগ্রহণ করবেন না। রাজনীতিক কারণে ভিন্ন রাজ্যের কন্যা বিবাহ করতে বাধ্য হলে সেই কন্যাকে বৈদেশিক রাজার মতোই সম্মাননীয় মনে করবেন। যেখানে সেখানে ইন্দ্রিয়পরবশ হয়ে পত্নী বা উপপত্নী গ্রহণ করবেন না। অন্তঃপুরে প্রবেশ করার আগে জেনে নেবেন তা নিরাপদ কিনা। পত্নীর চেয়েও কঠিন পুত্র পালন করা। উভয় সম্পর্ক থেকেই উপাংশু-হত্যার ভয় আছে। শিশুকাল থেকেই পরিপার্শ্বর কারণে রাজপুত্রের মনে দম্ভ, ভোগেচ্ছা ও রাজ্যলিপ্সা জন্মায়। তাই রাজপুত্র বড় হবেন গৃহ থেকে দূরে আচার্যের কাছে, অন্যান্য ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে এক ভাবে, এক নিয়মে। উপযুক্ত আচার্যের কাছে অতিরিক্ত শস্ত্র শিক্ষা ও রাজনীতি শিক্ষার পরও তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবৃত্ত হলে তাঁর সঙ্গে উভয়বিধ আচার্য বসবাস করবেন। সুনির্বাচিত যুবাদের পরিকল্পিতভাবে রাজপুত্রের অনুচর করে দিতে হবে। এঁদের মধ্যে কয়েকজন থাকবেন রাজারও ঘনিষ্ঠ। রাজপুত্র অবিনীত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলে কয়েকজন গূঢ়পুরুষ রক্ষী ও সখার মতো তাঁকে সর্বদা ঘিরে থাকবেন। তাতেও যদি সংযত না হন তো, সেই কুমারকে নির্বাসন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কৌশলে। ঔপরাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে প্রত্যন্ত প্রদেশে পাঠানো হোক। দস্যু ও বহিঃশত্রুদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত থাকুন তিনি। এইভাবে যদি সেই দুর্বিনীত রাজকুমারের মৃত্যুও হয়, হোক।

স্পষ্ট মুক্তামালার মতো অক্ষরে এই পর্যন্ত তার ভাবনা-চিন্তা শ্লোকনিবদ্ধ করল জিতসোমা, রক্তাভ রোদে অক্ষরগুলি দেখতে দেখতে চোখ জ্বালা করে জল আসছে। বাতায়নের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল সে। সূর্যাস্তের প্রভায় বৈকাল-স্নান করছে জম্বুবন। আজ এই যে নীতি লেখা হল সেগুলি জম্বুবনের ছায়ায় ছায়ায় অস্তসূর্যের আলো মেখে দূর ভবিষ্যতের দিকে চলে যাচ্ছে— এমনই মনে হল তার। বিম্বিসার, তাঁর পুত্র অজাতশত্রু, তার পুত্র, তার পুত্র। একইভাবে মহারাজ পসেনদি, তাঁর পুত্র বিরূঢ়ব, তার পুত্র, তার পুত্র। মহারাজ পুষ্করসারী তাঁর বংশধারা সমগ্র পৃথিবী, দূরতম সময়ের যে রাজপুরুষরা… তাঁদের ক্ষেত্রেও এই নীতির ব্যত্যয় হবে না। রাজারা যদি একপত্নীক হন, তাঁদের পরিজনভয় কিছু কমবে, কিন্তু রাজাসনে বসলেই যে চরিত্র দুষ্ট হয়ে যাওয়া এই ভয় চিরকাল থাকবে। আচ্ছা, সেই দূর-ভবিষ্যতে সোমার ‘রাজশাস্ত্র’ পড়ে কি সে সময়ের রাজারা সতর্ক হবেন? আত্মজিজ্ঞাসু, সংযত হবেন?

সোমার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল, দাসী ধীরা এসে সসম্ভ্রমে জানাল কুমার কুনিয় আসছেন। সোমা পুঁথিটি বাঁধল। তার আঙুলগুলি এখন সামান্য কাঁপছে। এই কুমার কক্ষে প্রবেশ করলেই একটা রূঢ় পৌরুষের গন্ধ পায় সে। তার গান্ধারের অভিজ্ঞতাগুলি মনে পড়ে যায়। কিন্তু ভেতরের অস্বস্তি সে গোপন রাখে।

এখন যেমন বুঝতে পারছে, কুমার ঘরে ঢুকেছে। সেই উগ্র গন্ধ, প্রচুর শক্তি, বাসনা, দেহের সঙ্গে মনের অভিন্নতা, আগ্রাসী ব্যক্তিত্ব অথচ কোথায় একটা হীনতা বোধ। এইসব বিকিরণ করতে করতে এই কুমার আসে। একে উপেক্ষা করা কঠিন।

কুনিয়র সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সময় সে যেমন দাম্ভিক, দুর্দম, নিষ্ঠুর ছিল, এখন ততটা নেই। কিন্তু জিতসোমা এখনও জানে না একে সে জয় করতে পেরেছে কি না। সে বুঝে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কুমারের এই আপাত-সংযম তার কোনও কূটনীতি কি না। সে মুখ তুলে বলল— বসুন কুমার। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য নত হয়ে অভিবাদনও করল।

কুমারের পায়ের কাছে গজদন্তের বহুমূল্য আসন, কুমারেরই উপহার, সেদিকে একবার তাকাল কুনিয়। কিন্তু বসল না। কপাটবক্ষ মেলে যেমন দাঁড়িয়েছিল, দাঁড়িয়েই রইল। কুনিয়র আকারে বিম্বিসারের মতো সৌষ্ঠব নেই। কিন্তু সে বিপুলদেহী। দেহটি যেন লৌহবর্ম। পেশীতে তরঙ্গ খেলছে। উজ্জ্বল মাজা তামার মতো ত্বক, রোমশ। বাঁ-হাতের বাহুসন্ধি থেকে বাকি হাতটি বক্র। সবসময়ে করতল সমেত উত্তান হয়ে থাকে। মুখটি দেহের তুলনায় ছোট। গম্ভীর, ভ্রূকুটি কুটিল, দাম্ভিক কিন্তু কোথাও যেন একটা বালসুলভ সরলতাও আছে। সে সযত্নে শুশ্রূ এবং গুম্ফ রাখে। কিন্তু কেশ অধিক দীর্ঘ হতে দেয় না। মাথার চারপাশে কুঞ্চিত কেশগুলি একটি বৃত্তের মতো দেখায়।

কুনিয় ঘুরে ঘুরে ঘরের মধ্যে রাখা তার উপহারগুলি দেখতে লাগল। মণি-ফলক, রত্নখচিত গজদন্তের ফলক, জিতসোমা লিখতে ভালোবাসে বলে। সূক্ষ্ম দুকূল সব, নানা বর্ণের। কালো মুক্তার অলঙ্কার। দুষ্প্রাপ্য সুগন্ধি। সবই যেমন সে দিয়েছে তেমনি পড়ে রয়েছে।

দাসী এই সময়ে পানীয় নিয়ে এলো। স্ফটিকের পাত্রটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল কুমার। তারপর পানীয় একনিশ্বাসে পান করে ফলকের ওপর রেখে দিল। পীঠিকার ওপর বসল। কর্কশ কণ্ঠে বলল— তুমি কি প্রব্রজ্যা নেবে?

—না তো!

—তবে? তর্কসভা ডাকবো না কি?

—কোনও প্রয়োজন তো দেখি না!

—তা হলে?

—তা হলে কী?

—তা হলে শরীর পাত করে এই বিদ্যা-চর্চা কেন?

সোমা কোনও উত্তর দিল না।

কুনিয় স্বরে ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলল— গণিকার কন্যা গণিকা। এই পরিচয় বুঝি। এই পরিচয় স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক নয় তা ছল বলে সন্দেহ হয়।

—বেদবিৎ বিদ্বানের কন্যা বিদ্যাচর্চা করবে এ-ও তো স্বাভাবিক, নয় কী?

—গোপনে গণিকাসংসর্গ করে, সে পণ্ডিত্যের আবার বেদবিদ্যা! কুনিয় বিদ্রূপ করে উঠল।

—চরিত্রের মর্যাদা যদি দিতে না-ও চান, বিদ্যার মর্যাদা তো দিতেই হয়, শান্ত স্বরে সোমা বলল।

—চরিত্র ছাড়া বিদ্যার কী মূল্য?

—চরিত্র ছাড়া শক্তিরই বা কী মূল্য?

—শক্তির মূল্য এই যে শক্তি দিয়ে দাস-দাসী কেনা যায়।

জিতসোমার মুখে রক্তাভা দেখা দিল, সে ধীরে ধীরে বলল— দাসী হলে হয়ত কেনা যায়, নইলে যায় না।

—যে অধিক শক্তিমান সে কিনে রাখলে অন্যের পক্ষে কেনা দুষ্কর বটে।

—আপনাকে বলে বলে আমি ক্লান্ত কুমার যে মহারাজ আমাকে বহুদিন মুক্তি দিয়েছেন। আপনি কি কখনও তাঁকে জিজ্ঞাসা করেননি? উত্তর পাননি? এই অপমানকর অবিশ্বাসের কারণ কী?

কুমার বলল— মুক্তি দিয়েছেন? তা হলে তিনি নিত্য এই গৃহে আসেন কিসের জন্য?

—সখ্য থাকতে পারে, দায়িত্ব থাকতে পারে, স্নেহও অসম্ভব নয়।

—সখ্য! হাসালে নটী! কিন্তু তুমি যদি মুক্তই হবে তবে কোন সম্পর্কে মহারাজের অনুগ্রহ ভোগ করছ? কোন পরিচয়ে?

—আপনি তো স্নেহ, সখ্য এসবের কোনটিই বোঝেন না। মানেনও না।

—আমি বুঝি না-বুঝি, তুমি কেন কিছু না দিয়ে ভিক্ষাজীবীর মতো রাজানুগ্রহ ভোগ করছ? আবার বলছ তুমি মুক্ত?

কুমার উঠে পড়ল, কক্ষের মধ্যে পদচারণা করতে লাগল— মহান রাজা! মহারাজ! সবাই মহান! মহানুভব। মহর্ষি দেবরাত, মহারাজ বিম্বিসার, মহাশ্রমণ বুদ্ধ, মহাবৈদ্য জীবক। শুধু কুনিয়ই তুচ্ছ। ক্ষুদ্র। তাকে রাজধানী থেকে দূরে একটি ঔপরাজ্য দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতা কিছু নেই। সমস্ত ভোগসামগ্রী, খ্যাতি, যশ পুঞ্জিত হচ্ছে রাজগৃহে। এই রাজগৃহে। যেদিকেই চাও মহারাজ সেনিয় পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন।

জিতসোমা ধীরে ধীরে বলল— মহানকে মহান বলে স্বীকার করতেও চরিত্রের প্রয়োজন হয়। যাঁর পুত্র হওয়ার সুযোগে নিজেকে রাজকুমার বলতে পারছেন তাঁকে ঈর্ষা করে…

নিজের মুঠিতে মুষ্ট্যাঘাত করল কুমার কুনিয়। হুংকার দিয়ে বলল— পুত্র হওয়ার সুযোগ? রাজকুমার? পুত্র হওয়ার সুযোগ কারা পাচ্ছে? এই রাজগৃহে অতুল ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা ভোগ করে কারা? কুনিয়? না মহামহিম অভয়, বিমল কৌণ্ডিন্য, জীবক মহাবৈদ্য? পথ-কুক্কুরের দল সব! বৈদেহীপুত্র অজাতশত্রুকে সুদূর চম্পায় নির্বাসিত রেখে মগধের সিংহাসন এইসব প্রিয় পুত্রদের কাউকে দিয়ে যাবার গোপন আয়োজন হচ্ছে কিনা কে বলতে পারে? আবার বৈশালীর ভাগিনেয় দুটিও তো আছে! লোভী, নির্বোধ! যাক, তোমাকেই বা এ সব কথা বলছি কেন নটী! তুমি তো অবশ্যই মগধরাজের চর। তবে আমি গ্রাহ্য করি না কিছুই। শ্ৰমণ বুদ্ধের চেয়েও অনেক ঋদ্ধিমান শক্তিধরের আশ্রয় আমি পেয়েছি। আর কাউকে গ্রাহ্য করি না। এখন তুমি বলো নটী, আমার সঙ্গে চম্পায় যাবে কি না, সত্যই যদি মুক্ত হও, কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারে না।

“>—বারবার আমাকে নটী বলে কোনও লাভ নেই কুমার, নৃত্য-গীত আমি বহু দিন ত্যাগ করেছি। আপনার বা অন্য কারো মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্য-গীত করব না, সুতরাং চম্পায় আমায় নিয়ে গিয়ে আপনার লাভ?

—তোমাকে স্বতন্ত্র প্রাসাদ দেব, বিদ্যাচর্চা করতে চাও স্বচ্ছন্দে করতে পারবে। আমি তোমার সাহায্য চাই জিতসোমা। তুমি বহুদর্শী, বুদ্ধি ধরো, নিজে অনুত্তেজিত থেকে অন্যকে প্ররোচিত করে তার গোপন ভয়গুলি ভালোই জেনে নিতে পারো, যেমন আজ আমার নিলে। চম্পায় চলো, আমার কথা রাখো। — মৃদু অনুনয়ের সুর কি কুমারের কণ্ঠে?

—যাবো। কিন্তু কোন পরিচয়ে কুমার? জিতসোমা সহসা কী মনে করে বলল।

এত সহজে সম্মতি পেয়ে কুনিয় অবাক হয়ে গেল। বলল —কেন! আমার অন্তঃপুরিকা হয়ে? তোমাকে গান্ধর্ব-বিবাহ করব। অবশ্য অগ্রমহিষী করা যাবে না। কিন্তু তোমার যে-রূপ প্রজ্ঞা তাতে কার্যত তুমিই অন্তঃপুরের কর্ত্রী হবে সোমা। কী? সম্মত?

—জিতসোমা ধীরে ধীরে বলল— চম্পায় যাবো। কিন্তু মহিষী হয়ে নয়। অন্তঃপুরের কর্তৃত্বে আমার প্রয়োজন নেই কুমার। আপনার মুখ্য সচিবের পদ দিতে পারেন? উপযুক্ত ভৃতি দেবেন। প্রাসাদ, রথ, অশ্ব, দাস-দাসী সবই রাজনৈতিক পরামর্শের বিনিময়ে অর্জন করে নেবো।

—নারী সচিব? —কুমার কুনিয় সবিস্ময়ে বলল, —কেউ কোথাও কখনও শুনেছে?

—কেন, বারাণসীরাজ এসুকারির বুদ্ধিমতী মহিষী কি রাজার অবর্তমানে রাজ্য পরিচালনা করেননি? স্বামী বা পুত্রের অকালমৃত্যুতে রাজ্যভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন এমন রানি বা রাজকুমারীরও তো অভাব নেই। কুশকুমার তাঁর অনুপস্থিতিতে জননী শীলাবতীকে রাজ্যভার দিয়ে যাননি?

—দেশে কোনও রাজা না থাকলে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু ভৃতিভোগী সচিব হবে নারী? হয় প্রব্রাজিকা, নয় কুলস্ত্রী। বড় জোর উপাধ্যায়া! এ ছাড়া আর্য নারীর আর কোনও পরিচয় তো হয় না! কোনও শাস্ত্রে নারী সচিবের কথা বলে না।

—নারী সচিব হতে পারে না এমন কথাই কি কোনও শাস্ত্রে বলেছে?

কুমার অধৈর্য হয়ে বলল— বৃথা বাক্যব্যয় করছ সোমা। এসব আমাকে অগ্রাহ্য করার কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। যাবে তো চলো, নইলে বলপ্রয়োগ করবো।

—করুন। সোমারও নানাপ্রকার বলের কথা জানা আছে। একটু পরে সোমা বলল— প্রস্তাবটি ভেবে দেখবেন।

কুমার কুনিয় চলে যাবার পর আজ অনেক দিন পর জিতসোমা দাস-দাসীদের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কথা বলল, সংবাদ নিল অশ্ব ও গাভীগুলির। বেশবাস প্রসাধন করল। এবং দুটি দাসকে নিয়ে রথ ছুটিয়ে দিল বৈভার পর্বতের দিকে। তার মুখ্য উদ্দেশ্য বাইরের বাতাসে শ্বাস নেওয়া। গৌণ উদ্দেশ্য অজিত কেশকম্বলীর কাছে যাওয়া। এই আজীবিক তাকে অতিশয় কৌতূহলাক্রান্ত করেছেন। ‘রাজশাস্ত্র’র প্রতিলিপি তো সে আর করছে না! সে নিজেই লিখছে এবং লিখতে লিখতে প্রতিদিন অনুভব করছে এক কঠিন, নির্মোহ, প্রবল বাস্তববোধসম্পন্ন জীবনদর্শনের প্রয়োজন। রাজা যিনি হবেন তিনি মানুষ হলেও মানুষ নন। তিনি প্রতিনিধি। এক অর্থে পুতুল। তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পরিজন কেউই ঠিক সাধারণ মানুষের জ্ঞাতিজনের মতো নয়। প্রত্যেকের থেকে তাঁকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। শুধু উপাংশু-হত্যাই নয়। অবাঞ্ছিত প্রভাব আছে, অতিস্নেহজনিত দুর্বলতার প্রশ্ন আছে। কোনরূপ বিশৃঙ্খলা ঘটলে তার কারণ যদি কোনও উচ্চপদস্থ, প্রিয় রাজপুরুষও হন রাজা তাঁকে কঠিন শাস্তি দিতে বাধ্য। তিনি সামগ্রিকভাবে প্রজাদের মঙ্গল দেখেন। কোনও ব্যক্তিবিশেষের শুভসাধনে তিনি দায়বদ্ধ নন। একজনের মঙ্গল তো আরেক জনের পক্ষে মঙ্গল না-ও হতে পারে। রাজা সামগ্রিক মঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রাখতে গিয়ে ব্যক্তিবিশেষের অপ্রিয় হতে পারেন। রাজশক্তির মানবিকতা ও যান্ত্রিকতা এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়-সাধন অতি কঠিন কর্ম।

আচার্য দেবরাত সম্ভবত এইসব সমস্যার কথা ভাববার সময় পাননি। এবং আচার্যপুত্র রাজনীতির সম্পূর্ণ অন্য একটি দিক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সবটাই আদর্শের ব্যাপার এবং আশু ফললাভের অনুকূল নয়। সোমা অতি নিকট থেকে রাজযন্ত্রকে দেখছে। দেখছে বিশদভাবে। তাই তীর্থঙ্কর অজিতের কথাগুলি তার শ্রবণযোগ্য মনে হয়। আজ কুমার কুনিয় তাকে নিজের অজ্ঞাতেই পথের সন্ধান দিয়ে গেছে।

তার মনে পড়ে যখন সে মুক্তি পেয়েই আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, অভিভূত হয়ে গিয়েছিল দৈবরাতের সংসর্গে আসতে পেরে, তখন দৈবরাত তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কতকটা সেই চিন্তারই পুনরাবৃত্তি আজ করে গেল কুনিয়। প্রব্রাজিকা, কুলস্ত্রী, নটী, দাসী এইগুলিই নারীর পরিচয়। এর বাইরে কিছু নেই। কেন নেই? মহারাজ বিম্বিসারের কাছ থেকে সে সাকেতের দেবী সুমনার কথা শুনেছে। অন্তঃপুরে কোনও গভীর সংকট হলে তিনি তাঁর বাল্যসখী সুমনার পরামর্শ নেন। রাজার অন্তঃপুর তো সাধারণ মানুষের অন্তঃপুর নয়! সেখানে অসন্তোষ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ঈর্ষার বীজ থেকে রাজদ্রোহ জন্ম নেয়। তা নারী যদি এই দ্রোহ শান্ত করতে পারে, নারী যদি ‘রাজশাস্ত্র’ও লিখতে পারে তা হলে দায়িত্বপূর্ণ পদলাভে তার বাধা কোথায়? সোমার জীবন ছিল দিকদিশাহীন। কোনও লক্ষ্য ছিল না সামনে। সত্যই তো, সে ভিক্ষাজীবীর অধিক কী? কুমার ঠিকই বলেছেন। এই রাজপ্রসাদের পরিবর্তে সে তো কিছু দেয় না। কী অধিকারে গান্ধার-ভবনে থাকে সে! আচার্যপুত্রের প্রাসাদ-পরিচালনার ভার নিয়ে এসেছিল, মহারাজের গোপন ইচ্ছা ছিল আচার্যপুত্রের সঙ্গে তার… জিতসোমা সারথির হাত থেকে রাশ কেড়ে নেয়। — দ্রুত চালাও, দ্রুত চালাও সূত…। না। সে স্বাধীন। নিজের যোগ্যতায় নিজেই উপার্জন করবে।

বসে আছেন মহামান্য শ্রেষ্ঠীরা। জটিল শ্রেষ্ঠীকে সামনের পঙক্তিতেই দেখা গেল। রাজসচিব বর্ষকারও আসছেন। কোনও নারী নেই। সামান্য অস্বস্তি। বিন্দু বিন্দু স্বেদ জিতসোমার কপালে। অনেকেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। জিতসোমা প্রাণপণে সমস্ত অস্বস্তি জয় করে একপাশে বসল। অন্য শ্রাবকরা সসম্ভ্রমে দূরে সরে গেল। আর ঠিক তখনই জিতসোমা দেখতে পেল কুমার কুনিয় বসে আছেন জটিল শ্ৰেষ্ঠীর পাশেই। এবং তার পেছনে ভিড়ের মধ্যে মিশে—লোকপাল। একটি সিন্ধুবারের শাখায় বিরাট একটি উল্কা জ্বালানো হল। সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে। বস্তুত জিতসোমা কিছুই শুনছে না। কুমার বলছিল বটে শ্রমণ বুদ্ধর চেয়েও ঋদ্ধিমান কারো আশ্রয় পেয়েছে সে। এই তীর্থঙ্কর অজিতই কি সেই ব্যক্তি নাকি? কিন্তু লোকপাল এখানে কেন? অবশ্যই মহারাজ রাজগৃহের সমস্ত সন্ন্যাসী, শ্ৰমণ, তীর্থঙ্করদেরই সম্মান দেন, দানও করেন, কিন্তু দেশনা শুনতে যান কি? আর, লোকপাল বেশেই বা কেন? তিনি কি নিজেই কুমার কুনিয়র ওপর দৃষ্টি রাখছেন? চর নিয়োগ করলে ভালো হত না?

হঠাৎ সোমার শরীর শিউরে উঠল। এ-ও তো হতে পারে মহারাজ তারই ওপর দৃষ্টি রাখছেন! কুমার ঘন ঘন গান্ধার-ভবনে যায়। সে সম্পর্কে মহারাজের সঙ্গে কোনও কথা হয় না। তিনিও প্রশ্ন করেন না, সোমাও বলে না। কিন্তু এই ছদ্মবেশে? সোমা তো এ বেশ চেনে। সোমার চেনা ছদ্মবেশে তিনি সোমারই ওপর দৃষ্টি রাখবেন? নাঃ!

দেশনা শেষ হতে না-হতেই সোমা উঠে পড়ল। কুমার তাকে দেখতে না পায়। লোকপালকে কোথাও দেখতে পেল না সে। মনে নানাপ্রকার প্রশ্ন উঠতে থাকলেও একটা কথা সোমার মনে হল—মহারাজ বিম্বিসার নিঃসন্দেহে উত্থানযুক্ত রাজা। উদ্যমী রাজার এইভাবেই চরিত্র নির্দেশ করে সে। সবসময়ই সতর্ক ও উদ্যোগী যিনি তিনিই উত্থানযুক্ত। রাজা যদি উদ্যমী হন, তো অমাত্যরাও উদ্যমী হবে।

আরও রাত্রে আহারাদি শেষ করে, সোমা আবার লেখা নিয়ে বসবে ভেবে পাকশালা থেকে ছোট একটি উল্কা নিয়ে চণকের বাসকক্ষে প্রবেশ করল। ছায়া-ছায়া একটি মূর্তি তার কক্ষের গজদন্তপীঠে যেন বসে আছে।

—কে? —সে উল্কাটি উঁচু করে ধরল।

আগন্তুক বললেন— দীপ জ্বালো সোমা।

—মহারাজ!

—অভিবাদন করতে হবে না সোমা, বলো কী বুঝলে?

“>—কী বিষয়ে কী বুঝবো মহারাজ!

লোকপাল পেটিকার ওপর থেকে পুঁথিটি তুলে নিলেন, বললেন— প্রতিলিপি করছ এই পুঁথির?

—ধরুন তাই।

—যদি করে থাকো, তা হলে বলো কুমার কুনিয়, অমাত্য বর্ষকার, আজীবিক অজিত এবং দেবরাতপুত্রী একত্র হলে তার কী অর্থ করা যায়!

—আরও একজনকে দেখতে পাননি মহারাজ, তাঁকে বাদ দিয়ে তো অর্থ হতে পারে না!

—আর কে? লোকপাল ভ্রূকুটি করলেন।

প্রদীপ জ্বেলে, ভস্মাধারে উল্কা নিবিয়ে দিল সোমা। তার পরে বলল— কেন? স্বয়ং মহারাজও ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলেন, তাঁকে আপনি দেখতে পাননি?

—সোমা এই রাজগৃহের পর্বতে পর্বতে অতি সূক্ষ্মভাবে বুদ্ধবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে কেউ। কে বা কারা বোঝবার জন্য আমাকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়।

—চর নিয়োগ করতে পারেন না?

—কোনও কোনও বিষয় আছে, যাতে চরের ওপর নির্ভর করতে পারি না। তুমি যদি এই রাজশাস্ত্রের শেষ প্রকরণটির প্রতিলিপি করে থাকো তো তোমার জানা উচিত রাজা প্রকৃতপক্ষে নির্বান্ধব। ভৃত্যদের ওপর দৃষ্টি রাখবার জন্য আরও ভৃত্য, তাদের ওপর দৃষ্টি রাখবার জন্য আবার আরও ভৃত্য… এই প্রকার সংশয়চক্র স্থাপনে আমার বড় বিরাগ!

—মহারাজ, শ্ৰমণ বুদ্ধ কি আপনাকে তাঁর দায়িত্ব দিয়েছেন?

—তা নয় সোমা।

—তিনি আত্মরক্ষা করতে জানেন, আপনার ওপর নির্ভর করে তিনি ধম্ম প্রচার করতে আসেননি। আপনি নিজেকে রক্ষা করুন।

—অমাত্য বর্ষকার এবং কুনিয়র যোগাযোগের কথা বলছ কি?

—বলছি, কিন্তু এঁরা কেউ ছদ্মবেশে ছিলেন না। গোপন করতে যাননি যে অজিত কেশকম্বলীর দেশনা শুনতে গিয়েছেন। সে অধিকার তো সবারই আছে।

—ঠিকই। আছে। তবু এই দৃশ্য আমার স্বাভাবিক লাগেনি।

—কেন লাগেনি ভাবুন মহারাজ। আর যদি ভাবতে বিরাগ বোধ করেন তো সোমাকে ভাবতে দিন।

—সোমা কি একা একাই এ সব কথা ভাবতে পারবে? সোমার চক্ষু কোথায়? কর্ণ কোথায়?

—তবে চক্ষু এবং কর্ণ দিন সোমাকে। সোমা তার অধীত শাস্ত্র প্রয়োগ করুক।

লোকপাল ভাবতে লাগলেন। কিছু পরে বললেন— সোমা তা হলে তোমায় আবারও নটী হতে হয়।

সোমার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল, সে বলল— আরও একটি পথ তো আছে মহারাজ, ভাবতে পারেন না কেন?

—কী পথ?

—সোমাকে তো অমাত্য-পদও দিতে পারেন।

—অমাত্য? লোকপাল বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

সোমা বলল— না, না, সোমা অমাত্য কেন হবে, মহারাজ? নারী যে! যত গুরুত্বপূর্ণ কর্মই করুক, রাজাকে ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা, রাজপুত্রকে সুপথে পরিচালনা করা, রাজ্যশাসনের নীতিগুলিতে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তব পরিবর্তন করা, যা-ই হোক না কেন, তাকে তা করতে হবে হয় অবরোধের মধ্য থেকে, আর তা নয়ত শত পুরুষের বিকৃত মনোরঞ্জনের কুৎসিত দায় নিয়ে জীবন শেষ করতে করতে। আশ্চর্য এই, আপনার মতো শক্তিমান হৃদয়বান পুরুষেরও এ কথা বলতে লজ্জা হয় না মহারাজ, কারো তো হয়ই না, আপনারও হয় না, এমন কি আপনারও হয় না!

—কী বলছ সোমা? তুমি কাঁদছ নাকি?

সোমার বুক ফুলে ফুলে উঠছে, সমস্ত দেহের বর্ণে রক্তিমা। সে বলল— কান্না পরাধীন নারীর অস্ত্র। অজ্ঞ, অসহায়, দুর্বল রমণীর মোহন অস্ত্র মহারাজ। যে নারী ‘রাজশাস্ত্র’ লেখে সে কাঁদে না।

লোকপাল সোমাকে শান্ত করতে তার শির স্পর্শ করতে গিয়েছিলেন। কী ভেবে পেছিয়ে এলেন। বললেন— সোমা, তুমি যা বলছ তা আমি কখনও শুনিনি। কিন্তু তুমি রাজশাস্ত্র লেখার কথা কী বললে? দেখলাম পুঁথিতে যতটা লেখা হয়েছে তার শেষে লিখেছ ইতি সোমচণককৃত রাজভয়নাম সপ্তদশ প্রকরণ। তুমি কি নিজেও প্রণেতা…

সোমা তখনও শান্ত হয়নি। লোকপাল বললেন, —সোমা, বিম্বিসার তোমাকে অমাত্য পদ দিতে পারে। তোমার সে যোগ্যতা আছে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কিন্তু এই সমাজ নারীপুরুষের কর্মবিভেদ-রেখার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে ভিক্ষুণী ক্ষেমা শুনেছি অভিজ্ঞাসম্পদে সবার শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হয়েছেন। তিনি তথাগতর অগ্রশ্রাবিকা। তাঁকে আজকাল বাগ্মিতার জন্য পট্‌ঠা, ভাণিকা ইত্যাদি বলা হচ্ছে। কিন্তু থের সারিপুত্ত বা মোগগল্লানের মতো তথাগতর প্রতিনিধিত্ব করতে তো তাঁকে আজও দেখিনি! হয়ত আমি তোমাকে অমাত্য পদ দেবো, কিন্তু… তুমি ঠিকই ধরেছ সোমা পত্নী ব্যতীত অন্য নারীর কাছে কাম-উপভোগের জন্য গেলে কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু পরামর্শের জন্য গেলে, গম্ভীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য গেলে সবাই ভ্রূকুটি করবে। অথচ নারীর কাছ থেকে যে পরামর্শ নেওয়া হয় না, তা-ও সত্য নয়! সোমা… একটু… আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও।

অঙ্গরাজ্যের পূর্বপ্রান্তে যে গ্রামটিতে পৌঁছলেন চণক তার কোনও নাম নেই। ভূমিতে এত ঘাস, গুল্ম, যে মনে হয় না মানুষ বাস করে। পূর্বে-দক্ষিণে জঙ্গল। কয়েকটি কুটির এখানে-সেখানে। এতদিন যা দেখেছেন যত দরিদ্রই হোক খানিকটা গোচর, একটি সভাপ্রাঙ্গণ, পরপর শস্যক্ষেত, শস্য ঝাড়াই করবার অঙ্গন, এগুলি অন্তত গ্রামে থাকতই। কেমন পরিত্যক্ত আকৃতি এ গ্রামটির। আয়তনেও ছোট। চণকের তীব্র পিপাসা পেয়েছিল, তিনি কোনও কূপ বা পুষ্করিণী চোখের সামনে দেখতে পেলেন না। তাই একটি কুটিরের দ্বারে গিয়ে আঘাত করলেন। অনেকবার আঘাত করবার পর ভেতর থেকে ছিন্ন-মলিন বসন পরা একটি পুরুষ বেরিয়ে এলো।

—আমি অতিথি, একটু জল পাবো?

লোকটি কিছু না বলে অন্তর্হিত হল। কিছুক্ষণ পর একটি কাংস্যপাত্রে জল নিয়ে এলো, পাত্রটি সুন্দর, সুগঠন। কিন্তু তেমন পরিষ্কার নয়। চণকের ঘৃণা হচ্ছিল কিন্তু তিনি জল পান করলেন।

—কী নাম এ গ্রামের?

—নাম নাই। এ কোনও গেরস্ত গাম নয়। আশেপাশে দেখুন। রুক্ষ গলা লোকটির।

চণক সামান্য অবাক হলেন। সারা অঙ্গ-মগধের যতগুলি গ্রামে তিনি গেছেন কোথাও আতিথ্যের অভাব হয়নি। সকলে হয়ত সমান সমাদর করেনি, করবার ক্ষমতাও সবার ছিল না। কিন্তু এরূপ ব্যবহার তিনি কোথাও পাননি।

কিছুদূর এগিয়ে আরেকটি কুটিরের দরজায় তিনি আঘাত করলেন। একটি বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো। আপাদমস্তক তাঁকে দেখে নিয়ে বলল— কোথা হতে আসছেন?

—রাজগৃহ। লোকটি চমকে উঠল।

—কোথায় যাবেন?

—আপাতত এই গ্রাম।

—কিন্তু এখানে তো অতিথ্ সেবার কোনও ব্যবস্থাই নেই! বৃদ্ধা ছাড়া ইত্থি নেই… চণক কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। বললেন— এখন তো আমি অত্যন্ত ক্লান্ত। কিছুটা বিশ্রাম নিতে হবেই। আমার সেবার জন্য ভাবতে হবে না। এই প্রাঙ্গণে আজ রাতটা হয়ত থাকবো। কালই আবার চলে যাবো। তিনি ধূলিধূসর প্রাঙ্গণে নিজের পেটিকা থেকে আসন বার করে বিছিয়ে বসলেন।

অল্পক্ষণ পরে বৃদ্ধটি বেরিয়ে এসে বলল— পেছনে কুয়ো আছে। আমার তো জল তোলার শক্তি-মক্তি নেই…

—না, না, আপনাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু দেখিয়ে দিন।

বৃদ্ধের পেছন পেছন গিয়ে চণক কুটিরের পেছনে কূপ দেখতে পেলেন। হাত-পা-মুখ ধুচ্ছেন, বৃদ্ধটি জিজ্ঞেস করল— আপনি কি রাজপুরুষ?

—ধরুন তাই।

—এদিকে এসেছেন…

—রাজ্যের সংবাদাদি নিতে তো রাজপুরুষ আসতেই পারেন। পারেন না?

—ঘোড়া নেই, সাজ নেই, তরোয়াল নেই…

—এইসব ছোট ছোট গ্রাম, সংকীর্ণ পথ—ঘোড়া কি এখানে চলবে? আর সাজ? সাজের প্রয়োজন কী?

—অস্তর?

—অস্ত্র আছে। রাজমুদ্রাও আছে। দেখবেন?

—না, না। বলছেন যখন, নিশ্চয়ই আছে।

কুয়োর জলে চিঁড়ে ভিজিয়ে, মধু মিশিয়ে ভোজন সারলেন তিনি। সবই সঙ্গে ছিল। শুধু পাত্র চেয়ে নিতে হল। সেই অপরিষ্কার কাংস্যপাত্র। কূপের পাশ থেকে মাটি তুলে নিজেই পাত্রটিকে ভালো করে মেজে নিলেন তিনি। ভোজনের আগে বৃদ্ধকে বললেন— আপনি একটু খান।

—না, না, বৃদ্ধ বলল— আমার খাওয়া হয়ে গেছে। তারপর বলল— বেলা দু পহর হল অতিথকে কিছু খেতে দিতে পারলাম না… রাজভট আমাদের ক্ষমা করবেন। তবে একটু দুধ দিতে পারি, নেবেন কী! দুঃপ্রকাশ করলেও বৃদ্ধের মুখভাবে দুঃখের কোনও লক্ষণ নেই।

কোথা থেকে এক পাত্র দুধ গরম করে এনে দিল বৃদ্ধ কে জানে! চণকের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বৃদ্ধ ক্ষুণ্ণ হতে পারে মনে করে তিনি একটু পান করলেন। স্বাদ ভালো নয়। অর্ধেকটা পান করে তিনি পাত্রগুলি ধোবার ছল করে কূপের কাছে গিয়ে দুধটি ফেলে দিলেন। ফিরে বৃদ্ধটিকে আর দেখতে পেলেন না। প্রাঙ্গণে একটি নিমগাছ। তেমন ছায়া নেই। তবু তার তলাটা একটু পরিষ্কার করে, বৃক্ষকাণ্ডে ঠেস দিয়ে চণক বসে রইলেন। পেটিকা দুটি তাঁর জানুর তলায়। পাদুকা খুলে, পরিষ্কার করে আবার পরে নিয়েছেন। বসে থাকতে থাকতে তাঁর তন্দ্রা মতো এলো। তাঁর কেমন মনে হল, বৃদ্ধ একা নয়। এই কুটিরে আরও লোক আছে। শুধু এই কুটিরে নয়, সব কুটিরেই। এই বৃদ্ধটি বা অন্য কুটিরের শীর্ণ লোকটি যেন নিদ্রা যাচ্ছিল। ভাবতে ভাবতে চণক ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্ন দেখলেন— লোকজনে পূর্ণ এক সমৃদ্ধ নগর। তিনি হট্টে এসেছেন। নানাপ্রকার পণ্য। বহু লোকে ক্রয়-বিক্রয় করছে। কিন্তু সবাই মূক। ইঙ্গিতে কাজ সারছে। প্রত্যেকে যাবার সময়ে ইঙ্গিতে চণককে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে— ঘোড়া কোথায়? সাজ কোথায়? অস্তর কোথায়? তারপর স্বপ্ন মিলিয়ে গেল। যখন ঘুম ভাঙল অমানিশির ঘন অন্ধকার দেখে চণক বুঝলেন তিনি এত ঘুম সম্ভবত জীবনে কখনও ঘুমোননি। উঠে বসতে, হাত-পা নাড়বার চেষ্টা করতে দেখলেন সেগুলি এখনও ভারী হয়ে আছে। অনেক চেষ্টায় বৃক্ষকাণ্ড ধরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে তিনি বুঝলেন তাঁকে কোনও তীব্র নিদ্রাকর্ষক ভেষজ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর পাদুকা নেই। ওই পাঁচ তলিকা চর্ম ও কাষ্ঠের পাদুকা বিশেষভাবে প্রস্তুত। ওর মধ্যে তাঁর পাথেয় থাকে। তবে জানুর তলা থেকে চর্মের পেটিকাটি ওরা নিতে পারেনি। বেত্ৰপেটিকাটি একপাশে পড়ে রয়েছে। তাতেও হাত দেয়নি। চর্মপেটিকার মধ্যে তার বেশবাস ছাড়াও আছে তীর ও ছুরিকা। ধনু তিনি নিজেই কাজ চালাবার মতো নির্মাণ করে নেন। চণক অরণি কাষ্ঠগুলি বার করলেন, অনেক চেষ্টায় আগুন জ্বেলে পেটিকার মধ্যে রাখা একটি ক্ষুদ্র উল্কা জ্বালালেন, ছুরিকাটি হাতে নিলেন তারপরে কুটিরের খোলা দ্বার দিয়ে ঢুকলেন! দুটি মাত্র ভাগ ঘরটির। তুষ ও খড় বিছানো। ইঁদুরে প্রচুর মাটি তুলেছে। ঘরের হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে চণক বুঝতে পারলেন— এখানে রাত্রে অনেকেই ছিল। অন্য কুটিরগুলিতেও তিনি সন্ধান করে দেখলেন— একই অবস্থা মনে হল। সব কুটিরগুলিরই পেছন দিকে একটি বড় গহ্বর। মহামারী হলে লোকে এরূপ গর্ত করে গৃহ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

ক্রমে অন্ধকার তরল হলে পরিত্যক্ত গ্রামটির আকৃতি তাঁর কাছে আরও স্পষ্ট হল। জীবকের দেওয়া একটি ভেষজ খেয়ে তিনি খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন। তারপর একটি বড় গাছ দেখে তার ওপর চড়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। লোকগুলি পালিয়ে গেছে, তাঁর পাদুকা নিয়ে গেছে, অর্থাৎ চোর। দিনের বেলায় সবাই ঘুমোচ্ছিল, এরা তা হলে রাত্রে দস্যুবৃত্তি করে। আর কী? দস্যুবৃত্তি করে অথচ অশ্ব গাধা, কোনও পশুই নেই। নেই কী? একটি অন্তত গাভী নিশ্চয় আছে না হলে দুধ দিল কী করে? চারিদিকে বহু দূর দৃশ্যমান, অতগুলি লোক, বৃদ্ধ, স্ত্রী, রুগ্ণ এরাও আছে, দস্যু যখন কিছু অপহৃত দ্রব্যাদি নিশ্চয় আছে। এত সব নিয়ে এরই মধ্যে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল!

তাঁর কী মনে হল তিনি জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। উচ্চৈঃস্বরে বলতে লাগলেন— ভো দস্যুগণ, এই রাজপুরুষ তোমাদের শাস্তি দিতে আসেননি। — মগধাধিপতি মহারাজ বিম্বিসার প্রত্যন্ত দেশে প্রজাদের দুর্দশা দূর করবার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। এখনও যদি আত্মসমর্পণ না করো, অন্য গ্রামবাসীরা যা পাচ্ছে সে সুযোগ তোমরা আর পাবে না। পূর্বের জঙ্গলে, দক্ষিণের জঙ্গলে অনেকক্ষণ ধরে এইভাবে ঘোষণা করার পর চণক গ্রামটিতে ফিরে এলেন। কূপের জলে স্নান করে, বেশ পরিবর্তন করে, কিছু শুকনো মণ্ড খেলেন, জলপান করলেন। তারপর সেই নিমগাছের তলায় বসে বসে রাজশাস্ত্র রচনা করতে লাগলেন।

মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন লেখায়। সামনে একটি ছায়া পড়ল। চকিতে পেছনে ফিরলেন চণক। সেই বৃদ্ধ। তার হাতে তাঁর পাদুকা দুটি।

সে দুটি তাঁর পায়ের কাছে রেখে সে একপাশে জড়সড় হয়ে বসল। হাঁটু দুটি উঠে আছে। তাঁর শ্বেত শ্মশ্রু হাঁটুর ওপর পড়েছে। চণক পেটিকা থেকে লোলার দেওয়া, তিলের মণ্ড বার করে তার দিকে এগিয়ে দিলেন। লোকটি নিচ্ছিল না। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন— এতে কিন্তু কোনপ্রকার বিষ বা নিদ্রাকর্ষক ভেষজ মেশানো নেই। লোকটি নড়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে মণ্ড নিল। চণক আবার লেখায় মন দিলেন।

কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ বলল— আপনি আচারিয় না রাজভট!

—দুই-ই হাতে পারি, চণক পুঁথি থেকে মুখ না তুলে বললেন।

—ও পুঁথি কিসের? —সসম্ভ্রমে লোকটি বলল।

—রাজ্য পরিদর্শন করে যা অভিজ্ঞতা হচ্ছে সব লিখে রাখছি। মহারাজের আদেশ।

—আমাদের ক্ষমা করুন। বড় দলিদ্দ আমরা। লোকটি কাঁদো কাঁদো।

—তোমরা কে?

—আমরা? আমরা হতভাগার দল!

কী রূপ হত তোমাদের ভাগ্য শুনি!

বৃদ্ধ কিছু সাধ্য-সাধনার পর বলল।

—পোতলি বলে একটি ছোট গামে থাকতাম। কম্মার গাম। নিতান্ত অপ্পোধন (অল্প ধন) বসস্ন হল না, শস্য জ্বলে গেল, কস্‌সকের ঘরেই অন্ন নেই, আমরা অনাহারে মরতে লাগলাম। শিশুগুলি মরে গেল, অনেক বৃদ্ধ, ইখিরাও মরে গেল। তরুণীগুলিকে, সমর্থ রমণীদেরও বিক্রয় করে দিলাম। তার পরিবর্তে কিছু শস্য পাই। কিছুদিন চলে গেল। কিন্তু পরবৎসরও সময়ে বসসন হল না। গামের যুবারা, আর আমরা যে কজন বৃদ্ধ ছিলাম…

চণক বললেন— দস্যুবৃত্তি আরম্ভ করলে?— বৃদ্ধ মুখ নিচু করে মাথা নাড়ল।

—তারপর?

—আশপাশের গামের লোক জানতে পেরে প্রহার করে আমাদের তাড়িয়ে দিল। ভস্ত্রাগুলি আর কিছু কিছু যন্ত্র নিয়ে অনেক স্থান ঘুরতে ঘুরতে এই স্থানে এসে পড়েছি। দেখছেন তো পরিত্যক্ত গাম। কোনও সময়ে মহামারী হয়েছিল, মনে হয় লোকে কুটিরগুলি ফেলে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। এখানেই সম্প্রতি আশ্রয় নিয়েছি। ভোররাত পর্যন্ত যুবারা যা পায় দস্যুবৃত্তি করে আনে। অনেক সময়েই কিছু পায় না। তেমন অস্তর-শস্তর যান কিছুই তো নাই। অপ্পোবলও (অল্পবলও) বটে। যা আনে অন্নের ব্যবস্থা করতেই শেষ হয়ে যায়। আমার আর এক জনের পত্নী বর্তমান, তারাই কোনক্রমে পাক-সাক করে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বলে বৃদ্ধ চোখ মুছতে লাগল।

—তোমাদের কুঠার আছে?

বৃদ্ধ অবাক হয়ে বলল— কুঠার? কী হবে?

—আছে কি না বলো না। কৃষ্ণায়সের ভালো কুঠার?

—হ্যাঁ, তা আছে। যতগুলি নির্মাণ করেছিলাম, বিকোলো না…

—যুবাদের ডেকে আনো। ভয় নেই।

অনেকক্ষণ পরে দুজন চারজন করে মলিন ছিন্ন বসন পরা শ্মশ্রূ-গুম্ফে ঢাকা মুখ যুবাগুলি আসতে লাগল। সবাই একত্র হলে চণক দেখলেন, একুশ বাইশটি যুবক, তিন চারজন বৃদ্ধ, দুটি বৃদ্ধা…

—গাভী কটি আছে।

—তিনটি।

—কুঠার কটি? লোকগুলি পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

—কুঠার কটি?–চণক আবার প্রশ্ন করলেন।

—আছে। যতগুলি মানুষ ততগুলিই প্রায়।

—শাণিত করো তো প্রায়ই? এক ঘায়ে মানুষ বা পশুর মুণ্ড কাটতে পারো?

যুবাগুলি নীরব। একটি বৃদ্ধা কেঁদে উঠল।

চণক বললেন— যদি একঘায়ে নরমুণ্ড কি পশুমুণ্ড কাটতে পেরে থাকো, তো কিছু বৃক্ষও কাটতে পারবে। যতগুলি পরিবার আছ তত কুল্যবাপ ভূমি এই জঙ্গলের মধ্যে মেপে দেবো। তার মধ্যে বৃক্ষগুলি কেটে, গুল্ম পরিষ্কার করে এবং পুড়িয়ে বাপক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। এই গ্রামভূমিতে পরিচ্ছন্ন কুটির বাঁধতে হবে। কম্মার শাল বসাবে। কিন্তু সকলকে একই বৃত্তি নিলে চলবে না।

—কস্‌সন আমরা জানি না অজ্জ।

—কর্ষণে অভিজ্ঞ লোক আমি ভিন্ন গ্রাম থেকে আনাবার ব্যবস্থা করছি। বীজের ব্যবস্থাও করব। লাঙল তোমরা নির্মাণ করে নেবে। রাজা হালের বলদ, বীজ ধান, এবং যতদিন না প্রথম শস্য হয়, খাদ্য সংস্থানের জন্য সহায়তা করবেন। তোমাদের অপহৃত দ্রব্য কী কী আছে দেখি!

প্রথমে কেউই কিছু বলতে চায় না। অবশেষে জানা গেল জঙ্গলে মাটির তলায় পোঁতা আছে প্রচুর কাংস্যপাত্র। কোশলের কোনও সার্থর ওপর দস্যুবৃত্তি করে সেসব সংগ্রহ করেছে এরা। তাম্রপিণ্ড ও কৃষ্ণায়সও আছে যথেষ্ট। খাদ্যের মধ্যে সঞ্চিত ধান, চিঁড়ে, লবণ এবং গুড় যা আছে অন্তত মাসেককাল চলবেই।

এইভাবেই রাজপোতলি গ্রামের পত্তন হল। এবং রাজপোতলিই মগধ রাজ্যে প্রথম গ্রাম যেখানে সর্বপ্রকার বৃত্তির প্রজাই বাস করে। কম্মার, কুম্ভকার, কর্ষক, গো-পালক, গো-বৈদ্য, নহাপিত, সূত্রধার, পর্ণিক, আপণিক… সব। উপরন্তু রাজপোতলিই হল মগধরাজ্যের প্রথম রক্তহীন রাজ্যবিস্তার। জনপদনিবেশ।

এই প্রথম চণক তাঁর ‘রাজশাস্ত্রে’ আলোচিত একটি নীতি অনুযায়ী কাজ করতে পারলেন। ‘জনপদনিবেশ’ নামে প্রকরণে তিনি লিখেছিলেন— জনপদ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দুর্গ বা পুর এবং জনপদ বা গ্রাম স্বতন্ত্র থাকবে। জনপদসম্পদ রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। পরিত্যক্ত, ভূতপূর্বই হোক অভূতপূর্বই হোক জনপদ রাষ্ট্র স্বীয় তত্ত্বাবধানে নতুন করে সৃষ্টি করবে। কমপক্ষে পঞ্চাশটি ও সর্বাধিক পাঁচশ পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা থাকবে এই জনপদে। প্রধানত কৰ্ষক থাকলেও সকল বৃত্তির প্রজা জনবহুল অঞ্চল থেকে এনে বাস করাতে হবে। রাজসাহায্যে কৃতক্ষেত্র এই সকল ভূমি ঐকপুরুষিক হবে। অর্থাৎ এক পুরুষই মাত্র তার ওপর প্রজার অধিকার থাকবে, কিন্তু পরবর্তী পুরুষ রাজার কাছে আবেদন করে ভূমির অধিকার পেতে পারে। কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণাদি— বীজ, গবাদি পশু, অর্থ সবই পিতৃসম রাজা প্রজাদের মধ্যে বিতরণ করবেন। তবে প্রজা এগুলি ঋণ বলে গ্রহণ করবেন। ক্ষেত্রবিশেষে উদ্যমী প্রজাকে নিষ্কর ভূমি দেওয়া যেতে পারে।

জঙ্গল পরিষ্কার করার প্রাথমিক কাজ আরম্ভ হয়ে যাবার পর গ্রামবৃদ্ধটিকে কর্মাধ্যক্ষ রেখে চণক চম্পার দিকে যাত্রা করলেন গঙ্গাপথে। চম্পাতেই তিনি তাঁর অশ্ব, আরও কিছু অস্ত্র, ধন ইত্যাদি রেখেছিলেন। রাজপোতলির জন্য তাঁকে বীজ গোধন ইত্যাদি আনতে হবে।

যে আবসথাগারে তাঁর দ্রব্যাদি অশ্ব গচ্ছিত রেখেছিলেন, সেটির প্রভু শুনেছিলেন মগধের ধনীশ্রেষ্ঠ মেণ্ডক। এবারে চম্পায় গিয়ে তাঁর প্রধান লাভ হল মেণ্ডক শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয়। চণকের কাছে মগধরাজের যে মুদ্রা আছে তারই বলে তিনি মগধরাজ্যের যে কোনও ঔপরাজ্যের কোষ থেকে অর্থ এবং অন্যান্য সাহায্য পেতে পারেন। কিন্তু চম্পার প্রশাসন-ব্যবস্থা কিছু জটিল। শাসন-ভার মগধের, কিন্তু চম্পা-নগরীর রাজস্ব ব্রাহ্মণ সোনদণ্ডকে দান করেছেন বিম্বিসার। নগরীর রাজস্ব এবং অঙ্গ-রাজ্যর বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব, সার্থদের থেকে সংগৃহীত শুল্কাদি, সবই এক রাজকোষে সংগৃহীত হয়। পরে ভাণ্ডাগারিক গণনা ও পরিমাপ করে সেগুলি স্বতন্ত্র করেন। চণক শুনলেন উপরাজ অজাতশত্রু এখন রাজগৃহে। তাঁর অনুপস্থিতিতে কিছু করা যাবে না। ভাণ্ডাগারিক মহোদয়ই তাঁকে পরামর্শ দিলেন—মেণ্ডকশ্রেষ্ঠী এখন চম্পায় অবস্থান করছেন। তাঁর কাছে চলে যান।

আবসথাগারের সংলগ্ন গৃহটিই মেণ্ডকের। চণকের যেতে কোনও অসুবিধা হল না। মেণ্ডক যে শুধু তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন তাই নয়, চণকের যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে দেবারও ব্যবস্থা করলেন।

ছিলেন মেণ্ডক এবং তাঁর পুত্র ধনঞ্জয়। উভয়ের সঙ্গেই পরিচয় হল। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের পর মেণ্ডক অনেক অনুরোধ করে তাঁদের গৃহেই চণকের থাকবার ব্যবস্থা করলেন। চণকের জনপদনিবেশের পরিকল্পনা শুনে উভয়েই চমৎকৃত হলেন।

চণক বললেন— কী অদ্ভুত দেখুন, এই যে সামান্যজন, এরা তো নিজের উদ্যোগেই ওই বন পরিষ্কার করে গ্রাম বসাতে পারতো! কিন্তু করেনি। তার পরিবর্তে দস্যুবৃত্তি করল। কৰ্ষণ জানে না এটা কোনও কারণই নয়। কেননা নিজেদের খাদ্যের উপযোগী কিছু শাক-পৰ্ণ উদ্বৃত্ত সমেত উৎপন্ন করা এই উর্বর মৃত্তিকায় যে কেউ করতে পারে!

মেণ্ডক বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু একটুও ন্যুব্জ হননি। মাথাটি সোজা করে বললেন,— দেবরাত, এই উদ্যোগ বা ভূমি অধিকার করার সাহস হয়নি বলেই, এরা সামান্যজন।

চণক বললেন— একজনও তো বলতে পারতো— এই অকর্ষিত বনভূমি কারো নয়। আপনি কোথা থেকে কে রাজভৃত্য এলেন, এই বন পরিমাপ করতে?

ধনঞ্জয় বললেন— যে মুহূর্তে মহারাজ বিম্বিসার অঙ্গদেশ জয় করেছেন, সে মুহূর্তেই সম্ভবত স্থির হয়ে গেছে যতদূর পর্যন্ত অন্য কোনও রাজার অধিকারসীমা আরম্ভ হচ্ছে, ততদূর পর্যন্ত মগধরাজেরই।

—কিন্তু এরা মহারাজ বিম্বিসারের নাম জানে না। অস্পষ্টভাবে জানে শুধু রাজগৃহ একটি ক্ষমতা-কেন্দ্র। এরা অঙ্গর প্রজা না মগধের, অঙ্গমগধ এক কি না এসব রাজনৈতিক চেতনা এদের নেই।

মেণ্ডক হেসে বললেন— তা যদি বলো আয়ুষ্মান, এ রাজনৈতিক চেতনা যতদিন না জাগে ততদিনই ভালো। রাজাদের ভালো। রাজার আশ্রয় ও রাজার প্রশ্রয়স্বরূপ যারা সেই শ্ৰেষ্ঠীকুলেরও ভালো।

—কেন পিতা, আপনি কি মনে করেন এই সামান্যজনেদের অজ্ঞতার ওপরই রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা! শ্রেষ্ঠীদের প্রতিষ্ঠা! রাজারা কি বাহুবলের দ্বারা শ্ৰেষ্ঠীরা কি ধনবলের দ্বারা এদের রক্ষা করেন না?

মেণ্ডক মাথা নেড়ে বললেন— ধনঞ্জয়, এদের চেতনা নেই। কিন্তু রাজারা অন্তত মহারাজ বিম্বিসারের মতো রাজারা জানেন ভূমি প্রকৃতপক্ষে কার। তোমার আমার মতো শ্ৰেষ্ঠীরা জানি ধন কোথা থেকে কীভাবে আসে। তাই আমরা এদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্যের অঙ্গ বলে জানি। কিন্তু সকল রাজা, সকল শ্রেষ্ঠীর যদি সে চেতনা না থাকে? যদি কালক্রমে এঁরা সবাই ভুলে যান যে ভূমি সবার, বাহুবলে, বুদ্ধিবলে তাকে তাঁরা ভোগ করছেন, লাভ সংগ্রহ করছেন এইমাত্র।

ধনঞ্জয় বললেন এই চেতনার প্রচারই তো করছেন ভগবান বুদ্ধ। তিনি শ্রেষ্ঠীদের দান-যজ্ঞ করতে বলছেন। দান-যজ্ঞই শ্রেষ্ঠ, অন্য যজ্ঞ নয়। এমন কথা তো আমরা আগে কখনও শুনিনি। ইনি সামাজিক বা আর্থিক বিন্যাসের একটি মূল সূত্র ধরতে পেরেছেন!

চণক বললেন— কিন্তু শ্ৰেষ্ঠীবর, দান কি দারিদ্র্য সমস্যার পূর্ণ সমাধান করতে পারে? দান তো একটি বিরাট দরিদ্র শ্রেণীকে চিরকাল ভিক্ষুক করে রেখে দিচ্ছে। তারপর দেখুন এরা যদি জানে সংসার পালনে বা অন্যভাবে কোনও অভাব উপস্থিত হলেই কোনও দানবীরের কাছ থেকে সে অভাব পূর্ণ হবে তা হলে উদ্যোগ-উদ্যমের কোনও স্থানই কি থাকছে জীবনে?

উপরন্তু এই ভগবান বলছেন সংসার দুঃখময়। জীবনকে, ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক সুস্থ প্রকাশগুলিকে দমন করে, প্রত্যাখ্যান করে তবে দুঃখচক্র থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় এবং তাই-ই নির্বাণ ও আনন্দ। অর্থাৎ জীবনের বিপরীতে আনন্দের অবস্থান। মানুষ যদি লৌকিক জীবনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটাই ধম্ম বলে বোঝে তা হলে এ জীবনকে উন্নত করবার জন্য কোনও উদ্যমই তো তার থাকবে না। দেখুন শ্ৰেষ্ঠী, ইনি একটা বিরাট জনশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছেন কিন্তু।

ধনঞ্জয় মেণ্ডক দুজনেই বললেন— আপনি ভগবান বুদ্ধকে দেখেছেন? তাঁর কথা শুনেছেন?

চণক বলল— দেখেছি। সেটাই তো সমস্যা। ইনি অলৌকিক ব্যক্তিমায়ার অধিকারী। এঁর মুখ থেকে এসব কথা শুনলে সেই মুহূর্তে আমার মতো তার্কিক, সংশয়ীরও মনে হয়, ঠিক, ঠিক। একেবারে ঠিক। বড় সুন্দর, শান্ত এই বুদ্ধচ্ছটা, বুদ্ধমণ্ডল, এর মধ্যে প্রবেশ করি।

মেণ্ডক মন দিয়ে শুনতে শুনতে মাথা নাড়ছিলেন। ধনঞ্জয় বললেন— কিন্তু লৌকিক জীবনকে উন্নত করার জন্য ইনি শীল পালনের কথা বলে থাকেন, সেটি শুনেছেন?

—শুনেছি— চণক বলল— ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চতুর্বর্গের ধারণাই বা মন্দ কিসে? একটা সুষম নিয়ন্ত্রিত জীবনের আদর্শ চতুর্বর্গ থেকে পাওয়া যায় না কী? ইনি যে পঞ্চশীলের কথা বলেন— তা তবু বোঝা যায়, কিন্তু অষ্টশীলের কথা চিন্তা করুন। সাধারণ সমাজ জীবনযাপনে রত মানুষের পক্ষে এই অষ্টশীলের অনেকগুলিই কিন্তু দুঃসাধ্য।

ধনঞ্জয় বললেন—ইনি কিন্তু জনকে নিষ্ক্রিয় করার পক্ষে নয়। ইনি কর্মে বিশ্বাস করেন। যেমন কর্ম করবে তেমনই ফললাভ হবে, ইহজীবনে তো বটেই, এমন কি জন্মান্তরেও।

—অথচ ইনি আত্মা মানেন না। কে সে যে কর্মের ফল পায়?

তথাগত বলেন এই চিন্তাগুলি নিরর্থক। জানবার কোনও প্রয়োজন নেই। কর্মগুলিকে শুদ্ধ করবার দিকেই সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, ধনঞ্জয় বললেন।

—অথচ, তুষিত স্বর্গের দেবতাদের কথা ইনি বলেন, দেবযোনি পাওয়ার কথা বলেন। শ্ৰেষ্ঠীবর, তথাগত বুদ্ধর ধম্মে প্রচুর স্ববিরোধ আছে। সুষ্ঠু নৈতিক জীবনযাপনের দিকে যাওয়া ভালো। কিন্তু মতটির একটি যুক্তিগ্রাহ্য কাঠামো তো থাকবে? —চণক চিন্তিত স্বরে বললেন।

—আপনার মতো পণ্ডিত ব্যক্তি হয়ত এই যুক্তির কথা বলবেন কিন্তু যে-সব সাধারণজনের জন্য এই ধম্ম তাদের মনে কি অত প্রশ্ন জাগে? তারা ধরবার মতো বোঝবার মতো কোনও পথ পেলেই হল।

চণক বলল—শ্রেষ্ঠীবর কিছু মনে করবেন না। আপনারা তো সাধারণজন নন। রাজারাও সাধারণ নন। কিন্তু আপনারাই তো ধম্মের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। জেতবনবিহার করে দিলেন একজন শ্রেষ্ঠী, বেণুবন দিলেন একজন রাজা, আম্রবন দিলেন একজন প্রতিথযশা, সুপণ্ডিত, বৈদ্য এবং রাজপুরুষ। ধম্ম যদি সাধারণের জন্য হয় যারা ভালো করে সব কিছু না বুঝে একটি স্পষ্ট মত ও পথ পেলে তাকে গ্রহণ করে, তবে আপনারা কেন এ ধম্ম নিচ্ছেন, কী পেলেন আপনারা?

মেণ্ডক মৃদু-মৃদু হেসে বললেন—ধনঞ্জয় উত্তর দাও দৈবরাতের প্রশ্নের।

ধনঞ্জয় বললেন—ভালো লেগেছে তথাগতর কথা। কিন্তু কেন লেগেছে তা তো জানি না। নিশ্চয় কোনও গূঢ় কারণ আছে, তাই না দৈবরাত? না কি অভিসন্ধি?

চণক হাসলেন। ধনঞ্জয় বললেন— আমি ভেবে বলবো।

ভোজনশালায় অনিমেষে চণকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ধনঞ্জয় পত্নী দেবী সুমনা। সুমনা অন্তর্বত্মী। বহুদিন পর। তাঁদের আশা এবার পুত্র হবে, ধনঞ্জয়ের সাম্রাজ্য পরিচালনা করবে সে। সুমনার সাধ হয়েছে তিনি ভ্রমণ করবেন, আপাতত অঙ্গদেশে এসেছেন। ভদ্দিয়তে কিছুকাল কাটিয়ে এসেছেন, এখন চম্পায় গগ্গরা দিঘিতে স্নান করবার ইচ্ছা হয়েছে। দেবরাত চণককে সুমনার বড় ভালো লেগেছে। বীরপুত্র লাভ করার জন্য তিনি ষণ্ডমাংস খাচ্ছেন। বিদ্বান পুত্র লাভের জন্যও কিছু নিয়ম পালন করছেন। কেন তিনি জানেন না। ধনঞ্জয় বলেন— বীরপুত্র নিয়ে কী হবে সুমনা! ক্রমশ অস্ত্রধারী ক্ষত্রিয়, বিদ্যাজীবী ব্রাহ্মণ, উপার্জনকারী বৈশ্য এবং সেবাকারী দাস স্বতন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। এ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের পুত্র ধনুর্গ্রহ হলে রাজার অনুবর্তী হয়ে যাবে, বিদ্যোৎসুক হলে তক্ষশিলা কি বারাণসীর অনুবর্তী হবে। ধনঞ্জয়ের সাম্রাজ্য দেখবে কে?

সুমনা বলেন—আমি যে ধারায় শিক্ষিত হয়েছি, পুত্রকেও সেইভাবেই শিক্ষিত করতে চাই, সেট্‌ঠি।

—কন্যাকেও তো তা-ই করেছিলে সুমনা, লাভ কী হল?

—কী বলছ? লাভ হয়নি? বিসাখা যে কর্মান্ত স্থাপন করেছে, তাতে অন্তত একশটি পরিবারের কর্মসংস্থান, অন্নসংস্থান হচ্ছে, সাবত্থির ভিক্ষুণী সংঘের প্রতি যাতে ন্যায় হয়, সুবিচার হয় তা আমার কন্যা দেখছে, মিগার সেট্‌ঠির ধনসম্পদেরও সুব্যবস্থা করছে সে—

ধনঞ্জয় বললেন—হ্যাঁ, জনবহুল রাজপথে হস্তিসম্মোহন-বিদ্যার প্রয়োগও করল। বলতে চাও সে একাধারে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য। ব্রাহ্মণও কী?

—হ্যাঁ, ব্রাহ্মণও, সখীগুলিকে অতিশয় শিক্ষিত করে তুলেছে বিসাখা।

—ভালো, তবে ব্রাহ্মণও।

—এবং দাসও সেট্‌ঠি। বিসাখা তার শ্বশুর ও শ্বশ্রূ এবং তথাগত বুদ্ধর সেবা করে, তা-ও অতি নিপুণভাবে।

—সবই ঠিক, সুমনা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার কন্যা যে…

—জানি, সেট্‌ঠি। বলো না, আর বলো না। কৃপণং হ দুহিতা। বড় করুণ এই দুহিতা হওয়া। কিন্তু বিসাখা আত্মবলে ক্রমশই সেই দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করছে এই আমার বিশ্বাস।

—ভালো—ধনঞ্জয় দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

—এই গান্ধার যুবকের সঙ্গে আমাদের আগে দেখা হয়নি কেন? —সুমনা অন্যমনে বলেন।

—অতি সহজ কারণ। যুবকটি গান্ধারে থাকত এবং আমরা সাকেতে।

—না সেট্‌ঠি আমি যখন মহাদেবী খেমাকে প্রব্রজ্যা থেকে নিবৃত্ত করবার জন্য রাজগহে ছিলাম, সে সময়ে দৈবরাত গান্ধারের দূত হয়ে রাজগহেই অবস্থান করছিল। তখনও বিসাখার বিবাহ হয়নি।

ধনঞ্জয় কটাক্ষে তাকালেন পত্নীর দিকে, বললেন— বৃথা কল্পনা করে দুঃখ পেতে নারীরাই পারে। কেন হল না, কেন পেলাম না…

সুমনা বললেন— কল্পনা করে সুখও পেতে পারি।

—কেমন?

—এই দৈবরাতের মতো যদি আমার পুত্ত হয়!

—গান্ধার যুবক কূটবুদ্ধিশালী। সব কিছুর পেছনে কারণ সন্ধান করে, বণিক ও রাজাদের বুদ্ধভক্তির পেছনে অভিসন্ধির ঘ্রাণ পাচ্ছে।

—সত্যি?

হাসিমুখে ধনঞ্জয় বললেন— আয়ুষ্মান, আমার পত্নী আর আমি উভয়ে মিলে আমাদের বুদ্ধভক্তির কারণ একটা বার করেছি।

চম্পার এই গৃহের সম্মুখবর্তী কাননে সুন্দর একটি সরোবর। মণিময় তার ঘাট। সেখানেই তিনজনে বসেছিলেন সন্ধ্যার পূর্বে।

চণক বললেন— আমি কিন্তু আপনাদের বুদ্ধভক্তির প্রতি কটাক্ষ করছি না। ভ্রমেও এমন ভাববেন না। প্রকৃত কথা, আমি সব কিছুর পেছনে দৈব বা ভাগ্য আছে এই মত বিশ্বাস করি না। আমার মনে হয় যা যা ঘটছে, তার মধ্যে কোনও অন্তর্নিহিত কারণ থাকে। কারণটি আবিষ্কার করতে পারলে ইতি-কর্তব্য কী স্থির করা সহজ হয়।

—হ্যাঁ, শাস্ত্রকার বলেই আপনার অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন এ কথা সত্য—ধনঞ্জয় বললেন।

সুমনা স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বললেন—বলো আয়ুষ্মান, তুমি কী রূপ ব্যাখ্যা করছ বুদ্ধভক্তির।

চণক বললেন—দেবি, প্রথমে আমার কতকগুলি চিন্তা আপনাদের কাছে নিবেদন করি, তারপরে বুদ্ধপ্রসঙ্গে আসবো। এই যে বেদবিরোধী বা বলা ভালো যজ্ঞবিরোধী তীর্থঙ্কররা পূরণ কাশ্যপ, নির্গ্রন্থ নাতপুত্র, সঞ্জয় বৈরট্টিপুত্র, অজিত কেশকম্বলী এবং মস্করী গোশাল—এঁরা সবাই মধ্যদেশে জন্ম নিয়েছেন এঁদের মত এখানেই গড়ে উঠেছে। এখানে প্রচারেও এঁরা সুফল পাচ্ছেন। কেন? কেন উত্তর-পশ্চিমে নয়?

সুমনা জিজ্ঞেস করলেন—গান্ধার বা ওইসব পশ্চিম দেশে এ প্রকার কাউকে দেখোনি?

—না। সন্ন্যাসীরা চিরকাল ছিলেন। কিন্তু যজ্ঞবিরোধী এই সব তীর্থঙ্কররা মধ্যদেশের সন্তান। এখন দেবি, আমার মতো আপনারা যদি ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্বে আসতেন বৈদিক ধর্মের একটা ক্রমিক অবনমন লক্ষ করতেন। বেদকথিত যজ্ঞবিধি যেন বহু দুরের এক ভিন্ন দেশের রীতি যা মধ্যদেশীয়দের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মধ্যদেশেরও তো একটা নিজস্ব প্রতিভা আছে। বিশেষত সরযূ, মহীগণ্ডক, গঙ্গার মধ্যবর্তী এই যে ভূখণ্ড, কোশল, মগধ—এখানে নতুন একটা জাগরণ ঘটছে।

—সত্যই, সুমনা বললেন, কেউ কি কখনও ভেবেছিল আমাদের সেনিয় মহারাজ বিম্বিসার হবে?

—এই নতুন দেশে নতুন প্রতিভা জন্ম নেবে এটাই স্বাভাবিক। এই নতুন প্রতিভা যেমন নতুন রাজশক্তির জন্ম দিয়েছে, তেমনই দিয়েছে ধর্মের নতুন পথের দিশারীর, এবং অর্থ-ব্যবস্থারও নতুন প্রতিভাধরদের, অর্থাৎ আপনাদের। আপনাদের মতো বাণিজ্যবলে বলীয়ান শ্রেষ্ঠী ক্রমশই যাঁরা নিজেদের ক্ষমতাবলে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠছেন এরূপ ব্যাপার কিন্তু প্রতীচ্যেও নেই। উদীচ্যেও নেই।

—কেন দৈবরাত, ধনঞ্জয় বললেন, আমরাও তো পশ্চিমের, উত্তরের বণিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, বণিকের অভাব তো দেখি না!

—আছে শ্রেষ্ঠীবর, কিন্তু কেমন? —অশ্ববণিকরা আসে কাম্বোজ থেকে, কম্বল নিয়ে আসে কাশ্মীরী বণিকরা, আপনাদের এখান থেকে যত প্রকার পণ্য নিয়ে সার্থ যাতায়াত করে ওদিকে তত নেই। বা থাকলেও অশীতি কোটি সুবর্ণের সম্পদ করেছেন এমন বণিক ওখানে কই? লোহিতায়স, কৃষ্ণায়স, রৌপ্য, স্বর্ণ, দুকূলবসন, কাষ্ঠ, ও গজদন্তনির্মিত বস্তু, কাংস্যপাত্র, গুড় ইত্যাদি খাদ্যবস্তু কী আপনারা স্বর্ণে পরিণত করেননি? উপরন্তু, আপনারা নিজেদের প্রয়োজনমত আয়তাকার, চতুষ্কোণ মুদ্রাগুলি প্রস্তুত করছেন। বাহুবল, বিদ্যাবলই সব নয় শ্রেষ্ঠীবর, ধনবল একটা বিরাট শক্তি। সেই শক্তি আপনারা নিজ প্রতিভায় অর্জন করেছেন। উত্তর-পশ্চিমে, বহুদিন ‘পণি’ বলে বণিকদের হেয় মনে করত। এই বৃত্তির প্রকৃত মর্যাদা আপনারাই প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন এই নতুন মধ্যদেশীয় প্রতিভাগুলি যা মধ্যদেশের নিজস্ব সেগুলি অর্থাৎ রাজশক্তি, ধনশক্তি এবং ধর্ম-দর্শননীতি এরা একত্র হবে, পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এটাই স্বাভাবিক।

সুমনা বললেন— তা হলে এঁরা সবাই উত্তর-পশ্চিমের সংস্কৃতির বিরোধী? এমনই কি বলছ পুত্ত?

—কোথাও কোথাও স্পষ্টই বিরোধী। যেমন ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের ব্যাপারে, পশুবলির ব্যাপারে। কিন্তু বিরোধটাই প্রকৃত কথা নয়। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে—ভিন্নতা, নূতনত্ব। মধ্যদেশ তার আত্মপরিচয় এঁদেরই মধ্যে পেয়েছে।

—বিদ্যায় এখনও পশ্চিমকেই আমরা আচার্য বলে মনে করি—ধনঞ্জয় বললেন।

চণক বলল—আমি যদি সঠিক বুঝে থাকি, তা হলে মগধের সাম্রাজ্য ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে জম্বুদ্বীপ ছেয়ে ফেলবে। আমি আজ পিতার আরব্ধ যে ‘রাজশাস্ত্র’ শেষ করছি—মগধ রাজশক্তির প্রধান নীতিনির্ধারক হবে সেই শাস্ত্র। এবং রাজগৃহের নিকটে কোথাও তক্ষশিলার মতো বিদ্যা-কেন্দ্র গড়ে উঠবে। হয়ত বা তথাগত বুদ্ধের বচনকে কেন্দ্র করেই।

—বুদ্ধের বচন তো অতি সহজ সরল, তাকে কেন্দ্র করে…

ধনঞ্জয়ের কথা শেষ হল না। সুমনা বললেন— আয়ুষ্মান চণক ঠিকই বলেছে সেট্‌ঠি। বুদ্ধের বচন আপাত-সরল। কিন্তু এর ভেতরে অনেক তর্ক-বিতর্কের অবকাশ আছে। সেগুলি যত দিন যাচ্ছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

চণক বললেন— শুধু তাই-ই নয়। আমি থের সারিপুত্ত ও মোগ্‌গল্লানের দেশনা শুনেছি। তাঁরা বুদ্ধকথিত ধম্মের অনেক জটিল দিক নিয়ে আলোচনা করেন। ধৰ্ম্ম-চর্চা-কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু শ্ৰেষ্ঠীবর, আপনারা বুদ্ধভক্তির যে কারণ নির্দেশ করেছেন তা তো কই শোনা হল না?

ধনঞ্জয় সুমনার দিকে চেয়ে হাসলেন একবার। বললেন— ব্রাহ্মণদের থেকে ইনি বণিকদের ওপরে স্থান দেন। হয়ত তাই…

কিন্তু এ কথা কি ঠিক? গৌতমের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে সবাই-ই তো ব্রাহ্মণ! কাশ্যপ ভাইয়েরা, সারিপুত্র, মৌদগল্যায়ন এবং শাক্যকুলের সব রাজকুমার? তাঁরা তো ক্ষত্রিয়! চণক সংশয়ের সুর কণ্ঠে রেখে থেমে গেলেন।

সুমনা বললেন— তুমি শুনেছ কি না জানি না আয়ুষ্মান, ইনি রাজগহের অন্ত্যজদের মধ্য থেকেও সাবক গ্রহণ করেছেন। বুদ্ধসঙ্ঘের মধ্যে বর্ণ দিয়ে কোনও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ নেই। তবু তারই মধ্যে শ্রেষ্ঠীদের ওপর তাঁর করুণা একটু অধিক। আমরা তো অন্তত তাই অনুভব করি। শ্ৰেষ্ঠীদের গুরুত্ব ইনি মেনে নিয়েছেন। এমন কি বাণিজ্য যে অতি শ্লাঘ্য জীবিকা এ বিষয়ে ইনি প্রায়ই উপদেশ দেন। উদ্যোগী পুরুষ কীভাবে একটি মরা ইঁদুর থেকেও বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হতে পারে এ নিয়ে উনি গল্প বলেন। আমি নিজে শুনেছি। সাবত্থির অনেক লোকে তাতে উদ্বুদ্ধও হয়েছে।

চণক আশ্চর্য হয়ে বললেন— তাই নাকি?

—সে যাই হোক, সুমনা হেসে বললেন— তুমি শীঘ্রই সাকেতে আসবে। ধনঞ্জয়গৃহে অবস্থান করবে। কেমন?

চণক স্মিতমুখে সম্মতি জানান। সুমনার চিত্তে স্নেহের আনন্দের এক অদ্ভুত পরিপ্লাবন। কেন, কে জানে? মনে মনে তাঁর গর্ভস্থ পুত্রকেই এর কারণ বলে মনে করেন সুমনা। আর সংগোপনে নত হয়ে থাকেন জেতবনবিহারী তথাগত বুদ্ধর কাছে। তাঁর কেমন মনে হয় অধিক বয়সে এই পুত্রলাভ তাঁরই আশীর্বাদ। কেন এ বিশ্বাস? কারণ নেই তেমন। এ হল বিশ্বাস।

ধনঞ্জয় বললেন— শুধু সাকেত কেন, এই তো কাছেই ভদ্দিয়, আমাদের আদি গৃহ। সাবত্থিতে রয়েছে আমার কন্যা বিসাখার গৃহ…সর্বত্রই তোমাকে যেতে হবে আয়ুষ্মান, যদি মধ্যদেশীয় গহপতিদের তুমি যথাযথ জানতে চাও।

সুমনা অনুরোধের কণ্ঠে বললেন— বচ্চ, তুমি মাতৃহীন, তোমাকে স্বহস্তে যত্ন করবার জন্য আমি ব্যাকুল হয়েছি। অবশ্যই সাকেতে আসবে…

কিন্তু দেবী সুমনার কোনও ইচ্ছাই পূর্ণ হয়নি। সাকেতে নিজকৃত সেই সুন্দর সপ্তভূমিক প্রাসাদে একটি কন্যার জন্ম দিয়ে ধনঞ্জয়-পত্নী, বিশাখাজননী, বিম্বিসার-সখী যখন মারা যান, দেবরাত চণক তখন বহু দূর। কন্যা বিসাখাও তখন প্রসবগৃহে। তাকে জননীর মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি।

শোকার্ত ধনঞ্জয় নবজাতিকার মুখদর্শন করেননি। পরিজনরাই শিশুর নিদারুণ জন্মদুঃখ মুছে দিতে করুণহৃদয়ে তার নামকরণ করলেন—সুজাতা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress