মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – সাকেতের সীমানা
১০
ওই তো অদূরে দেখা যাচ্ছে সাকেতের সীমানা। রাজগৃহ তো পর্বত দিয়েই ঘেরা, তা সত্ত্বেও নগরীর প্রবেশদ্বার আছে, প্রাচীর আছে। শ্রাবস্তীরও চারিদিকে প্রাচীর। বৈশালীরও। সাকেতের তেমন কিছু নেই। কিন্তু আছে অঞ্জন বন। দূর থেকে দেখা যায় এই শাল-অরণ্য। আর তার ওপর জেগে থাকে ধনঞ্জয়ের বিমানটি। এই বিমান দেখেই লোকে সাকেত চেনে। রাজন্য উগ্রসেনেরও এমন নেই। সুমনা একবার নিষেধ করেছিলেন ধনঞ্জয়কে। শ্ৰেষ্ঠীর যত সম্পদই থাক, বাইরে যেন তা রাজার ঐশ্বর্যের বহিঃপ্রকাশকে ছাড়িয়ে না যায়। ধনঞ্জয় স্বভাবে খুব বিনয়ী নন। বলেছিলেন, ‘রাজা বিম্বিসার বা প্রসেনজিৎ হলে ভাবনার কথা ছিল, এ তো সামান্য এক মাণ্ডলিক রাজা। সপ্তভূমিক প্রসাদ ও তার ওপর মনোহর চূড়া আমার অনেক দিনের সাধ সুমনা।’ সাকেত দেখা দিতেই সুমনার চিত্তের ভেতরটা রোদ পড়ে সোনার স্তূপের মতো ঝলমল করে উঠল। সাকেত তাঁর মুক্তি, সাকেত তাঁর কল্পনা, কল্পভূমি।
যখন ধনঞ্জয়ের ওপর আদেশ হল ভদ্দিয় ছেড়ে শ্রাবস্তীতে আসবার! কী চিন্তা সবাইকার! শ্বশ্রূমাতা পদ্মাবতী দেবী ভয় পেলেন। ভিন্ন রাজ্য, বলা তো যায় না, আজ মগধের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, কাল তো না-ও থাকতে পারে! ষোলটি মোট মহাজনপদ, তো তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভাঙচুর তো লেগেই আছে। কুরু-পাঞ্চালের বিশাল যুদ্ধ হল, দুই বংশেই এখন প্রদীপ নিবু-নিবু। মেণ্ডক বললেন, ‘মহারাজ বিম্বিসার আর রাজা প্রসেনজিৎ দুজনে দুজনের শ্যালক।’ পদ্মাবতী বললেন, ‘কুরু পাঞ্চালের যুদ্ধে শুনেছি মামা ভাগনের বিরুদ্ধে, শ্যালক ভগ্নীপতির বিরুদ্ধে, গুরু শিষ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। রাজাদের কী মতিস্থির আছে? যদি কখনও মগধে কোশলে যুদ্ধ লাগে মেণ্ডক অর্থসাহায্য করবেন মগধকে, আর তাঁর পূত্র অর্থ দেবেন কোশলকে।’ অনেক বাদ-প্রতিবাদ। কিন্তু সুমনার চিত্তে কেমন একটা আনন্দের বাতাস লেগেছিল। বিবাহের প্রথম কয়েক বছরের রোমাঞ্চ, সার্থর সঙ্গে বাণিজ্যযাত্রার সে স্বাদ জীবনে কখনও ভুলবেন না, কিন্তু তার পর? শ্রেষ্ঠী পরিবারের বিশাল কর্মযষ্ট্রের মধ্যে কবে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন, হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর বীর্য, শক্তিমত্তা, তাঁর বেদবিদ্যা, ধনুর্বেদ, সব, স-ব। ধনঞ্জয় তখন বেশির ভাগই বাইরে থাকতেন। মেণ্ডক পরিবারে সুমনা নিশ্চিহ্ন।
রাজগৃহে স্বরূপ মল্ল ও তাঁর স্ত্রী কুশাবতী মল্লর কাছ থেকে অস্ত্র ও ব্যায়াম শিক্ষা করতেন সুমনা। একবার স্বরূপ মল্ল তাঁকে বলেছিলেন, ‘কল্যাণি, একটা সময় ছিল যখন আমাদের স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকারা পর্যন্ত অশ্বারোহণ, অস্ত্রধারণ জানত। মত্ত মাতঙ্গের মতো বল ছিল নারীদের দেহে। তারা আমাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করত। নইলে কি আর যক্ষরক্ষ অসুর নিধন করে এই অপরূপ সপ্তসিন্ধুবিতে জম্বুদ্বীপ আমরা অধিকার করতে পারতাম!’
‘কেন আচার্য! এ কি আমাদের নিজেদের দেশ নয়? আমরা কি যযাতিপুত্র অনু দ্রুহ্যু যদু তুর্বসুর থেকে উৎপন্ন হইনি? যযাতি তো সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর ছিলেন। সূতদের থেকে তো আমরা এমনই শুনেছি।’
কুশাবতী বললেন, ‘ছিলেন হয়ত। সবই তো বহু কাল আগেকার কথা। কত শ’ কত হাজার বছর আগে কে জানে! শাক্যরা তো ওক্কাকুর পুত্র-কন্যাদের অন্তর্বিবাহের ফলে জাত হয়েছে শুনি। বজ্জিরাও তাই। যমজ ভাইবোন। কিন্তু তার পূর্বে? যযাতিতে গিয়েই তো সবাই পৌঁছই। তার পূর্বে কী? তারও পূর্বে? আমাদের একটি দাস ছিল, বন থেকে সংগ্রহ করা। সে কোনদিন পোষ মানেনি। দাসের মতো ব্যবহার সহ্য করত না। আমরা অবশ্য তা করতামও না। সেই দাসটি, তার নাম কচ্ছু। সে তোমার আচার্য স্বরূপ মল্লকে অনেক গৃঢ় বিদ্যা শিখিয়েছিল। বিষ প্রস্তুতের পদ্ধতি। সাপের বিষ নেমে যায় ক্ষত সেরে যায় এমন ঔষধি চিনিয়েছিল। ইনিও বিনিময়ে তাকে অনেক কিছু শেখান। সে-ও অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়ে যথেষ্ট উপার্জন করত। তা সেই কচ্ছু বলত, তোমরা কে? তোমরা তো উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ের ওপার থেকে এসেছ বিদেশি। এই পৃথিবীর প্রকৃত প্রভু তো আমরা দাসরাই। আমাদের কত কোম থাকত বড় বড় নগরে, সেসব তোমরা ধ্বংস করে দিয়েছ, আমাদের থেকেই শিখেছ কৃষিবিদ্যা। আমরা আমাদের পিতৃপুরুষ, তাঁরা তাঁদের পিতৃপুরুষ, তাঁরা আবার তাঁদেরও পিতৃপুরুষদের থেকে শুনে আসছেন। তার চক্ষু জ্বলত বলবার সময়ে। উদরী রোগে মারা যায়। মারা যাবার আগে খালি বলত—জানতাম, তোমাদের আর্য মানুষদের পাপ আমাদের স্পর্শ করেছে, এ তোমাদের রোগ। আমাদের অরণ্যে বার্ধক্য আর হিংস্র জন্তুর আক্রমণক্ষত ছাড়া আর কোনও রোগ নেই।’
অরণ্যচারী কালো মানুষদের কথা ভাবতে গিয়ে, বহু দূর অতীতে কোনও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়-ডিঙিয়ে আসা অশ্বারোহী-অশ্বারোহিণী পূর্বপুরুষদের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন সুমনা। সত্যিই তো ‘আর্য’ শব্দের মূলে ‘ঋ’ ধাতু। বিভিন্ন গণে যে ঋ ধাতু দেখতে পাওয়া যায় তাদের বেশির ভাগেরই অর্থ গতি। সে হিসেবে ‘আর্য’ শব্দের অর্থ হতে পারে ‘যারা চলে, গতিশীল, যাযাবর’ আবার বেদে দাশ ধাতুর অর্থ ‘দান’ করা। যিনি দেন তিনি নিশ্চয়ই কোনও অর্থেই দীন হতে পারেন না। কিন্তু সে তো দাশ!
সারথি বলল, ‘দেবি, সর্বাঙ্গসুন্দর আপনার সাকেত ওই দেখা যাচ্ছে।’
সুমনা হেসে বললেন, ‘আমি আগেই দেখেছি।’
সত্যি! সাকেতকে নিবার্চন করে ধনঞ্জয় একটা কাজের মতো কাজই করেছিলেন। স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে ভিন্ন দেশে একলা বসবাস করার রোমাঞ্চ নিয়ে তিনি শিবিকায় বসলেন। যথোচিত ম্লানমুখে। তাঁর শিবিকার কিছু দূরেই পাশাপাশি চলেছেন কোশলরাজ পসেনদি (প্রসেনজিৎ) এবং ধনঞ্জয়। পসেনদির ঘোড়াটি দুধ-সাদা, ধনঞ্জয়েরটা কপিশ। পসেনদি তো সেনিয়র সমবয়স্কই! কিন্তু স্থূল হয়ে পড়েছেন। বিলাসপ্রিয় নাকি? কাঁধে, উদরে এত চর্বি জমলে যুদ্ধ করবেন কী করে। সেনাপতি বন্ধুল আর দীঘকারায়ণের হাতেই সব ফেলে রাখলে চলবে? সেনিয় নিজে সৈন্য পরিচালনা করে অসম সাহস ও বীর্যের সঙ্গে। অঙ্গদেশ কীভাবে অধিকার করল! সেনিয়কে দিয়ে সুমনার আশা অনেক। এখন পসেনদি ও ধনঞ্জয়কে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখে তাঁর ঈর্ষা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এক লাফে গিয়ে ধনঞ্জয়ের ঘোড়াটিতে চড়ে বসেন। বহু দিনের অনভ্যাস। তবু ঘোড়ায় চড়া একবার যে শিখেছে সে কখনও ভোলে না। তবে শিবিকা ছাড়তে খুব একটা ভরসাও পাচ্ছিলেন না। সেনিয় আসার সময়ে বলেছিল, ‘সুমনা আমার শ্যালকটিকে সাবধান।’ কী অর্থে বলেছিল কে জানে! কিন্তু সুমনা শিবিকার অন্তরালে থাকতেই মনস্থ করেছিলেন। রাজাদের মন! কোন নারীকে কখন ভালো লাগবে, তাঁর জীবনটি, তাঁর পরিবারের জীবনটি শেষ করে ছেড়ে দেবেন।
গোধূলিবেলায় তাঁরা পৌঁছেছিলেন একটি অপূর্ব স্থানে। দূরে দেখা যায় রুপোলি জলের ধারা, শ্রেণিবদ্ধ রাজপথে তমাল, পিয়াল, বকুল, সপ্তপর্ণীর সারি। কাঠের ও ইষ্টকের হর্ম্য সামান্যই, বাকি সব পরিচ্ছন্ন মাটির কুটির। দিকচক্রবাল তাই আরও উদার, আরও বৃহৎ মনে হচ্ছে। একটা লঘু হলুদে-সবুজে মেশা উত্তরীয় যেন পৃথিবীর গায়ে বিছিয়ে রয়েছে। পরিচ্ছন্ন সোনালি আকাশের পটে শতখানেক শ্বেত এবং পাটল গরুর দল ঘরে ফিরছে। গোধূলির আলোয় শ্বেত গাভীগুলিকে পদ্মাবর্ণের মনে হচ্ছে। হঠাৎ এদিকে ওদিকে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে উঠতে লাগল। যেন পৃথিবীর বুকে তারা ফুটছে। ধনঞ্জয় বললেন, ‘মহারাজ, এ স্থানটি কোন রাজ্যে পড়ে?’
‘আমারই রাজ্যে শ্রেষ্ঠী।’
‘শ্রাবস্তী থেকে কত দূর?’
‘এক দিনের পথ।’
‘নাম কী স্থানটির?’
‘সাকেত।’
‘বাঃ, সায়ংকৃত সাকেত। যদি এই স্থানেই বসবাস করতে ইচ্ছা করি?’
‘শ্রাবস্তীতে যাবেন না শ্রেষ্ঠী?’
‘শ্রাবস্তী রাজধানী। সেখানে সর্বদাই বড় হট্টরোল। বহু লোকের বাস। আমার গৃহিণী আবার একটু নির্জনতা ভালোবাসেন।’
‘ভালো, তাহলে এখানেই আপনার বস্ত্রাবাস ফেলতে আজ্ঞা দিচ্ছি। রজ্জুকদের কাল সকালেই ডাকিয়ে আপনার ভূমিসীমা সব ঠিক করে দেব।’
সাকেত সুমনার আত্মভূমি। সুমনা ধনঞ্জয়কে বলেন, ‘তুমি বলেছিলে সায়ংকৃত, আমি বলি এ আমার স্বয়ংকৃত। সাকেতে আছে শ্রাবস্তী, রাজগৃহ ইত্যাদি বড় বড় নগরের পরিশীলন। সেই সঙ্গে ভদ্দিয়র মতো ছোট নগরের অনাবিল নির্জনতাও। সাকেতের রাজা উগ্রসেন মানুষটিও খুব ভালো। ক্ষত্রিয়ের অহঙ্কার নেই। ধনঞ্জয় যেভাবে সাকেতের উন্নতির পরিকল্পনা করতে চান, সুপরামর্শ মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিয়েছেন। আশেপাশে গ্রামগুলি বেশ সমৃদ্ধ। ধান ও যব ক্ষেতগুলি প্রতি বছরই পূর্ণ হয়ে যায়। ধনঞ্জয় সরযূতীর বাঁধিয়ে দিয়েছেন। মণিময় (সাদা পাথরের) ঘাট হয়েছে। নদীমুখী পথগুলিও খুব শীঘ্র নির্মিত হয়ে গেছে। গ্রামের সব গৃহ থেকে, নগরের সব গৃহ থেকে দাসেরা শ্রম দিয়েছে, বিনিময়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র ও প্রতি দিন কয়েক মাষক করে দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রভুরা প্রথমটা আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু উগ্রসেন ধনঞ্জয়ের পক্ষে ছিলেন। পালা করে দাস পাঠাতে তখন আর আপত্তি করেনি কেউ। পথগুলি তো সবারই প্রয়োজন হয়। নগর আর কতটুকু! নগর ঘিরে শস্যক্ষেত, ফলের, নানাবিধ শাক ও পর্ণের ক্ষেত, উদ্যান এ সবই তো বেশি। কাজেই গ্রামবাসীদের পথগুলি কাজে লাগে। ধনঞ্জয়ের গৃহে পূজাপার্বণ যজ্ঞ থাকলে প্রধান প্রধান গৃহপতিদের নিমন্ত্রণ হয়। দরিদ্রদেরও অন্নবস্ত্র দান করা হয়। তখন এইসব পথ মানুষের চলাচলে, গোশকটে, ঘোড়ার ক্ষুরে ভেঙে যায়। ধনঞ্জয় তাই সম্প্রতি পথ সংস্কারের সময়ে পাথর ব্যবহার করিয়েছেন।
শাঁখ বাজছে। বহু জোড়া শাঁখ। দুয়ারে ঘটে আম্রপল্লব। ‘কি রে ধনপালি, শাঁখ বাজাচ্ছিস কেন? এই ময়ূরি, হল কি তোদের? দ্বারে ঘট—এসব কী?’
‘বিসাখাভদ্দা বলেছে’, হাসতে হাসতে আরও জোরে শাঁখে ফুঁ দিল সবাই। দু মাস কেটে গেল, ঘরের ঘরনী ঘরে এলে,’ বর্ষিয়সী এক পুরাঙ্গনা বললেন, ‘বিসাখা তো ঠিকই করেছে।’
‘দেহে যেন প্রাণ এলো, ঘর যেন আঁধার হয়ে ছিল’, আরেক জন বললেন।
সুমনা বোঝেন এসবই স্তুতিবাদ। তবু জিজ্ঞাসা করেন, ‘কেন? বিসাখাকে তো সব ভার দিয়ে গেছি। সে কি পারেনি?’
‘না, না, তা কেন? তবে কন্যা যদি চাঁদ হয় তো মাতা যে সূর্যা। পার্থক্য একটা থাকেই!’
বিশাখা এসে দাঁড়িয়েছে, মুখে হাসি, চোখে আনন্দের অশ্রু।
‘বিসাখা, বপ্প মঙ্গল কেমন হল বচ্চে?’
‘সব ঠিকঠাক হয়েছে মা।’
‘মাঙ্গলিক দ্রব্যগুলি সব ঠিকঠাক সংগ্রহ হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ মা, কোনও ভুল হয়নি।’
‘লাঙলের গায়ে গোরোচনা, চন্দনের তিলক?
‘হ্যাঁ।’
‘বলদগুলিকে সাজিয়েছিলে?’
‘নিশ্চয়।’
‘আর বাস্তুযাগের মঙ্গলঘট? সোনার দিলেন তোমার পিতা, না রূপার?’
‘রজত মোক্ষ ফলদায়ী মা, বাবা তো মুক্তি চান না, তাই সুবর্ণই দিলেন, পুরোহিতের সুবিধে হল।’
বিশাখার অনুচরীরা উত্তরীয়প্রান্ত মুখে দিয়ে হাসতে লাগল।
সুমনা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও কী কু-অভ্যাস, মুখে বস্ত্রখণ্ড দিচ্ছিস কেন? তা বিসাখা যজ্ঞের সময়ে তোমার পিতা একাই ছিলেন, না…’
এবার সবাই আবার হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বিশাখার মুখ লাল হয়ে গেছে, সে বলল, ‘কাষ্ঠফলকে তোমার একটি চিত্র এঁকেছিলাম মা, সেই প্রতিমা পিতার পাশে রেখেছিলাম!’
‘কৌতুক হচ্ছে?’ সুমনার মুখেও হাসি। ‘তোমার এ ব্যবস্থা আচার্য ক্ষত্রপাণি মেনে নিলেন?’
‘নিলেন তো দেখলাম।’
‘বৈদিক যুগে পত্নীর যজ্ঞভাগিনী হয়ে বসবার নির্দেশ আছে। আমি ভাবছিলাম তোমার পিতা যদি পুকুর-প্রতিষ্ঠা আর বাস্তুযাগটি পিছিয়ে দেন!’
‘পিতা দিতে চেয়েছিলেন, আমি বাধা দিলাম। আমি দীর্ঘদিন ধরে তোমার চিত্রটি এঁকেছি মা, তাই দিয়েই কাজ হবে না কেন? তথাগত বুদ্ধ তো বলেইছেন যাগযজ্ঞের এত সব খুঁটিনাটি বিধি—এসব অপ্রয়োজনীয়। পুরোহিত দেব ক্ষত্রপাণি একটু আপত্তি করছিলেন। কিন্তু তারপর আমি জোর করে বলতে মেনে নিলেন।’
‘বুদ্ধের কথা মনে আছে? তুই তো তখন বেশ ছোট!’
‘মা আমার বেশ মনে আছে অজ্জা-মা কী একটা শুভযোগে গঙ্গাস্নানের অভিলাষ জানাচ্ছিলেন, ভগবান বললেন, “কেন ভদ্দিয়তে এত সুন্দর কাকচক্ষুর মতো নির্মল জলের সরোবর রয়েছে, স্নানের অসুবিধা কী?” অজ্জা-মা বললেন, “শুভযোগে গঙ্গাস্নান করলে সর্ব পাপ ক্ষয় হয় যে!” ভগবান তাতে হেসে বললেন, “রাজদ্বারে নিত্য যে সব চোর, দস্যু, নরঘাতক আসে সেগুলিকে এবার থেকে গঙ্গাস্নানে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়, পাপস্খালন হয়ে যাবে! আর এই যে শুনি মেণ্ডক-পিতা, সারা ভদ্দিয়নগরে নাকি এমন ব্যক্তি নেই যে তাঁর কাছে উপকৃত হয়নি। তা, তাঁর কর্মফল আর হত্যাকারীর কর্মফল এক হয়ে যাবে উদকশুদ্ধির ফলে, এ কখনও হয় আর্যে?”
‘বাঃ, তোর তো খুব সুন্দর মনে আছে?’
মাতা-কন্যা কথা বলতে বলতে ততক্ষণে সুমনার কক্ষে এসে গেছেন। বিশাখা দুষ্টু হেসে বলল, ‘কেন মনে থাকবে না মা, আমরা ছোটরা অর্থাৎ আমি, পিতৃব্যকন্যা দেবী, জ্যেষ্ঠতাত পুত্র কুণ্ডিন আমরা সকলেই তো ভেবেছিলাম অজ্জা-মার সঙ্গে গঙ্গাস্নান করে আমাদের পাপগুলিও এই বেলা ধুয়ে আসব।’
সুমনা হেসে বললেন ‘তোমাদের পাপগুলি আবার কী ছিল?’
বিসাখা হাসি মুখে বলল, ‘জেট্ঠর পাপ অনেক। প্রজাপতি ও ফড়িং-এর পাখা ছিঁড়ে দেওয়া ছিল তার নিত্যকর্ম। এ ছাড়াও সে আমাদের ছোটদের সুযোগ পেলেই প্রহার করত। পিতামহর কাছে যখন-তখন মিথ্যা কথা বলে কত কাহন যে নিত!’
সুমনা বললেন, ‘আর দেবী? দেবীর মতো ভালোমানুষ মেয়ের আবার কী পাপ?’
‘দেবী? দেবী অজ্জা-মার মাথার পাকা চুল তুলে দিয়ে মাষক পেত তো? দুটি তুললে চারটি বলতো। তা ছাড়া খুড়িমার কুসুমবর্ণ বারাণসী বস্ত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পরতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল। খুড়িমা যখন সইয়ের মেয়ের বিয়েতে পরতে গিয়ে দেখলেন, সে কী চেঁচামেচি! দেবী পালংকের তলায় লুকিয়ে রইল। মাঝখান থেকে আমাদের মার্জারীটা, সেই ধবলাটা, সে খুব মার খেল।’
সুমনা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর তুই? তুই কী করেছিলি?’
বিশাখার মুখ পাংশু হয়ে গেল। দেখে একটু অবাক হলেন সুমনা। কিছুক্ষণ পর আত্মসংবরণ করে বিশাখা ধীরে ধীরে বলল, ‘মা, আমিই বোধ হয় সত্যিকার পাপ করেছিলাম।’
‘সে কী?’ সুমনা উৎকণ্ঠা গোপন করতে পারলেন না।
‘হ্যাঁ মা। আমি তীর ছোঁড়া অভ্যাস করতাম তো নিত্য!’
‘হ্যাঁ, সে তো আমারই নির্বন্ধে।
‘হ্যাঁ মা, কিন্তু লক্ষ্যভেদে জেট্ঠ ভাইদের সঙ্গে পারতাম না, তাই গোপনে গাঁয়ে চলে যেতাম, নানারকম লক্ষ্যবস্তু স্থির করতাম। ঝুলন্ত আম্রফল, কখনও বদরিকা, কখনও কুটিরের চালে অলাবু। তারপর একদিন শীতের প্রাক্কালে উড়ন্ত হাঁসে তীর সন্ধান করতে লাগলাম। দশ বারোটি হাঁস আমি এভাবে মেরেছি মা। কিন্তু কোনটিই দেখিনি। গাঁয়ের চণ্ডাল ও পুক্কুশরা ছুটোছুটি করে সেগুলি দূর থেকে নিয়ে যেত।’
সুমনা বললেন, ‘বেশ করেছিলে। ধনুর্বেদ কি অহিংস হবার জন্যে কেউ শিক্ষা করে? রক্ত, ক্ষত, মৃত্যু এসব দেখে বিহ্বল যাতে না হও তার জন্যেও তো এসব শিখতে হয় বিসাখা।’
‘তারপর শোনোই না মা। রোজই হাঁস মারি, আর তীর লেগেছে এই আনন্দে ছুটে চলে আসি। শেষে একদিন কী যে দুর্বুদ্ধি হল একটি ছুটন্ত চণ্ডাল বালকের বাম গুল্ফে তীর সন্ধান করলাম। উঃ, সে কী রক্তপাত মা, ছেলেটির সে কী বুকফাটা আর্তনাদ।’ বলতে বলতে বিশাখা ডান হাতে নিজের বক্ষের কাছে বন্ধনী আঁকড়ে ধরল।
‘তারপর?’ সুমনা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।
‘আমি আগেই তীর টেনে ফেলে দিয়ে জবার পাতা থেঁতলে দিয়ে তার রক্ত বন্ধ করলাম, তারপর তাকে কোলে নিয়ে তার কুটিরে পৌঁছে দিই। বলিনি ইচ্ছা করে করেছি। সে বালকটিও বুঝতে পারেনি। অজ্জা-মার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে দিই ছেলেটির চিকিৎসার জন্য। সে অর্থ কিন্তু ওরা উল্লাস করে মদ্যমাংস খেয়ে উড়িয়ে দিল, বলল, বৈদ্য ওদের দেখবেন না। বনের লতাগুল্মই ওদের ওষুধ।’
‘তুমি চণ্ডাল বালকটিকে কোলে নিয়েছিলে? খুব অশুচি ওরা। থাক, না জেনে করেছ।’
‘মা, বালকটি নোংরা ছিল না মোটেই। বেশ হৃষ্টপুষ্ট তৈলসিক্ত বালক। তবে ওদের পল্লী খুব নোংরা। বড় দরিদ্র। অত দরিদ্র হলে বোধ হয় আমরাও শুচিতা রক্ষা করতে পারবো না। মা, বুদ্ধ তথাগত এই অশুচিতা, দারিদ্র্য—এসব নিয়ে কিছু বলেননি?’
সুমনা চিন্তা করে বললেন, ‘বোধ হয় বলেছিলেন। ওই উদকশুদ্ধির প্রসঙ্গেই। তবে তখন আমরা তাঁর জ্যোতিঃপুঞ্জ দেখে বিবশ হয়ে বসেছিলাম। সব কথা হয়তো ঠিকমতো কানে প্রবেশ করেনি। সত্যিই, অনেক সন্ন্যাসী দেখেছি, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্তকে তো রাজগৃহে অনেকবার দেখেছি, সম্প্রতি পুরণ কাস্যপকেও দেখলাম। কিন্তু কুমার সিদ্ধার্থর মতো অমন অলৌকিক প্রভা আর কারও নেই।’
‘উনি যে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন মা। শিষ্যরা বলে সম্যক-সম্বুদ্ধ।’
সুমনা কী যেন ভাবছিলেন। বললেন, ‘ওঁর বৈদিক ক্রিয়া-কাণ্ড সব কিছুই তুচ্ছ করাটা আমি কিন্তু এখনও ঠিক মেনে নিতে পারি না। যজ্ঞাগ্নিতে হবিঃ অর্পণ করার পর কেমন একটা স্বর্গীয় সুগন্ধ ওঠে। সেই সুগন্ধী ধূম যেন আমাকে স্বর্গের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। তা ছাড়া শুনতে পাই, উনি নারীদের বড় অসম্মান দেখিয়েছেন, দেখান।’
‘কই আমাদের ভদ্দিয়র গৃহে তো তেমন কিছু দেখিনি মা!’
‘না, মেয়েদের সামনে উনি কিছু বলেন না, কিন্তু যখন সঙেঘ ভিক্ষুদের উপদেশ দেন তখন মেয়েদের সম্পর্কে কী না বলেন! কোনও গৃহী পব্বজ্যা নেওয়ার পরে যদি স্ত্রীর জন্য উদ্বিগ্ন হন, উনি গল্প বলেন ওই স্ত্রী নাকি জন্মে জন্মে তার অনিষ্টকারিণী ছিল। এসব কী? তা ছাড়া ভিক্ষুণী সংঘ যে গঠিত হয়েছে তার স্থান সম্পূর্ণ ভিক্ষু সংঘের নীচে। কেন? সংসারত্যাগী ভিক্ষুর আবার ছোট বড় কী? অথচ দেবী ক্ষেমা…’ সুমনা চুপ করে গেলেন।
‘দেবী ক্ষেমা কী মা?’
‘তোমার পিতা আসুন, সব বলব। এবার রাজগৃহ থেকে পেটিকা ভরা সংবাদ এনেছি।’
বেলা পড়ে এসেছে। সুমনার জন্য অপেক্ষা করে করে অবশেষে ধনঞ্জয় চলে গেছেন সরযূতীরে। নৌবণিকদের সঙ্গে তাঁর প্রয়োজন আছে। মায়ের ঘরে মা এবং মেয়ে অনেক দিন পরে একা। দু’জনের কথা আর ফুরোতে চায় না। গৃহস্থালির খুঁটি-নাটি। এটা হয়েছে কি না, ওটা বাদ গেল কেন? মেয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে সুমনার চোখ ফিরছে না। হঠাৎ যেন বিশাখা বড় হয়ে গেছে। এমনিতেই সে বয়সের তুলনায় পরিণত। এখন যেন আরও বড় বড় লাগছে। সুমনাব বুকের ভেতরটা খালি খালি ঠেকে! বিশাখা ধনঞ্জয় সেট্ঠির আদরের কন্যা। গর্বের কন্যা। কিন্তু সুমনার সে মানসপুত্রী। সারা জীবন ধরে যা শিখেছেন, যা ভেবেছেন, যা যা স্বপ্ন দেখেছেন সবই সযত্নে মেয়ের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর মনের মধ্যে এক গভীর একাকিত্ব। শত কাজেও যা ভরতে চায় না। সেই একাকিত্বই কি তাঁকে এভাবে মেয়ের মধ্যে একজন সঙ্গী গড়ে তুলতে প্রবৃত্ত করেছে? কত শিখেছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুরই যথার্থ প্রয়োগ করা গেল না। কারও সঙ্গে কথা বলে, কারও সঙ্গে মেলামেশা করে সুখ পান না। সাকেতে তাঁর কোনও সখী নেই। ভদ্দিয়তে তো ছিলই না। শাশুড়ি পদ্মাবতী ছিলেন খুব গুণী রমণী। খুবই প্রাজ্ঞ। একমাত্র তাঁর সঙ্গে কথাবার্তাতেই কিছুটা প্রাণের আরাম ছিল। কিন্তু তাঁর অন্যান্য সব দেবর-জায়ারা গণ্ডমূর্খ। এমন নয় যে গৃহে আচার্যর কাছে কোনদিন কিছু শেখেনি। কিন্তু দেবার্চনাবিধি, স্বামীবন্দনা, শাটিকা এবং পেটিকা এর বাইরে আর কিছুতেই যেন তাদের আগ্রহ নেই। সার্থ ফিরে এলে তুমুল উৎসব লেগে যেত মেণ্ডক সেট্ঠির অন্তঃপুরে—দেখো দেখো, এই মরকতটি কী উজ্জ্বল? কী সুগোল! এটি আমি অঙ্গুরীয়তে পরব।
—দেখো না এই চিত্রল মৃগের চর্ম কী সুখস্পর্শ! আমি এটি শয্যার আস্তরণ করব। চর্মকারদের বললেই হবে, কেটে কেটে জুড়ে দেবে।
—এইরূপ কিলিঞ্জক আগে কখনও দেখেছিস? গ্রীষ্মকালে নাকি শীতল থাকে। ভারি চমৎকার!
কারও একবার মনে উদয় হত না কোথাকার এই মরকত অথবা পদ্মরাগ, কোন দুর্গম পাহাড় না নদীতীর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গেল। কোথায় ছিল ওই চিত্রল হরিণগুলি, তাদের কি সার্থর ধানুকীরাই মারল না চর্মগুলি কিনে এনেছে! ওই শীতল কিলিঞ্জকের বেতগুলিই বা কোথায় জন্মায়! সুমনার ইচ্ছা হত জানতে। কিন্তু এসব প্রশ্ন করলে তাঁর দেবর-জায়ারা বলাবলি করত জ্যেষ্ঠার বেশ কতকগুলি সন্তান হওয়া প্রয়োজন। তিনি ছিলেন হংসকুলে বক, শ্বশুর মেণ্ডক বলতেন বককুলে হংস। রাজান্তঃপুরে গিয়েও রানিদের মতো অভিজাত রমণীদের সংস্পর্শে আসেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যেও স্বার্থসিদ্ধি আর পারস্পরিক প্রতিযোগিতার তাড়নায় আর সব চিত্তবৃত্তি নষ্ট হয়ে গেছে।
সুমনা একাত্মতা অনুভব করেন খানিকটা নিগ্গণ্ঠদের পব্বাজিকাদের সঙ্গে, তাঁরা অনেক জানেন, সংসারে থাকেন না, তবু কত বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু পব্বাজিকাদের পোশাক পরিচ্ছদ, মুণ্ডিত মস্তক, সবরকম রমণীত্ব, রমণীয়ত্ব পরিহার করে চলা তাঁর ভালো লাগে না। তিনি ভালোবাসেন নীল কঞ্চুক, পাটলবর্ণ শাটিকা, শ্বেত উত্তরীয়ে গোরোচনা দিয়ে আঁকা হংসমিথুন। তিনি ভালোবাসেন সোনার কাঞ্চী, মুক্তার কণ্ঠহার, চন্দনের পত্রলেখা। খুব গোপনে গোপনে সুমনা এক জনের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, সে হল অম্বপালী। বৈশালীর প্রসিদ্ধ গণিকা। সেনিয়র প্রথম প্রেম। অধিক শোনেননি, কিন্তু যেটুকু শুনেছেন এই নারীরত্নকে তাঁর সখী করতে ইচ্ছা হয়। এ কথা তিনি মুখেও উচ্চারণ করতে পারেন না। এ তো হয় না। কিন্তু যদি হত!
‘বপ্লমঙ্গলে নদীতীরে কেমন উৎসব হল বিসাখা!’ তিনি উৎসুক সুরে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘চুড়ান্ত সমারোহ মা। জাতী পুষ্পের অলঙ্কার যা করেছিল, আসল মুক্তাকে হার মানিয়ে দেয়! কত নতুন নতুন সই হল। আর… আর… তিসস্ভদ্র, তিস্স্কে খুব অপমান করেছি মা!’
‘সে কি, কেন!’
‘আমায় মালা পরাতে এসেছিল। সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যাকে কি পথে ওভাবে বিব্রত করা উচিত?’
‘কিন্তু এ তো সাকেতের চলিত উৎসব, কত দিন থেকে হয়ে আসছে। আচ্ছা বিসাখা, তিষ্য তো যথেষ্ট সুপাত্র, তক্ষশিলা থেকে স্নাতক হয়ে আসবার পর আরও শিক্ষা করছে। সুদর্শন। ওকে কি তোর ভালো লাগে না?’
‘তিষ্যকে আমি ঠিক—’ বিশাখা দ্বিধান্বিত স্বরে থেমে যায়।
সুমনা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি তোর যোগ্য পাত্র এত জায়গায় তো ঘুরলাম, কোথাওই দেখিনি। কিন্তু বিসাখা যোগ্য মানে কী? যোগ্যতার সংজ্ঞা আমাদের নির্ণয় করতে হবে। তোমার পিতা যে কোথায় গেলেন, শুনলাম সাবত্থি থেকে কতকগুলি ব্রাহ্মণ কী না কী এক সেট্ঠিপুত্তের পক্ষ থেকে রত্নমালা নিয়ে এসে বসে আছেন! সেই সেট্ঠি কুমারই বা কী করে তোমার যোগ্য হয়? আমাদের আরও সংবাদ চাই! আরও বিশদ। অথচ তার সময় কি আর আছে? আচ্ছা বিসাখা, তিষ্যকে কি তোমার একটুও মনে ধরে না!’
যেন আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সুমনা, যেন তিনি জলে ডুবে যাচ্ছেন, তৃণগুচ্ছ আঁকড়ে ধরেছেন। তিষ্য শোভন, সুন্দর, মার্জিত, শিক্ষিত, সদ্বংশজাত, তা ছাড়া পাত্র হিসেবে তিষ্যর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হল সে সাকেতের মানুষ। বিশাখা তাঁর মানসকন্যা। তাঁর একমাত্র সখী, এই কন্যাকে দূরদেশে পাঠিয়ে তিনি কেমন করে বেঁচে থাকবেন?
বিশাখা সহসা জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, প্রণয় কী?’
‘কেন বচ্চে? নিজের অন্তর দিয়ে জানোনি?’
‘না, মা।’
‘তবে তো জানানো দুরূহ। নিজের জীবনেই ধীরে ধীরে অনুভব করবে মা।’
‘মা!’ বিশাখা যেন কিছু বলতে চায়।
‘বল? কী বলতে চাস?’
‘বিবাহ কেন হয়? প্রণয়ের জন্য? না প্রজা-উৎপাদনের জন্য? না অন্ন, যব, লবণ, শর্করা, মধু তৈজস, শয্যা, ধনসম্পদ সব গুছিয়ে রাখবার জন্য? বিশাখার মুখ গম্ভীর। সে পরিহাস করছে না। অপেক্ষা করছে শান্তভাবে। ‘মা, বিবাহ কার সঙ্গে হয়? পতির সঙ্গে, না পতির পরিবারের সঙ্গে, না সমাজের সঙ্গে?’
—সুমনা চুপ করে আছেন।
‘বলো মা, বলো। যা সত্য তাই বলো। প্রণয় যদি একটি সুন্দর মিথ্যা হয় যা দিয়ে অন্যসব ঢাকা থাকে, তা বলো। আর অন্যগুলি যদি প্রণয়ে পৌঁছবার সোপানস্বরূপ হয়, প্রণয়কে কেন্দ্র করে ঘূর্ণিত কর্মচক্র হয় তাও বলো! বলবে যা সত্যি। বিসাখাকে স্তোক দিও না মা।’
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন সুমনা। তারপর বিশাখার মুখটি নিজের দিকে তুলে ধরে বললেন, ‘আমার মনে হয় প্রণয় একটি সুন্দর সত্য বিসাখা। কিন্তু এই সত্য যে সবাই দেখতে পাবেই এমন কোনও কথা নেই। প্রণয় জীবনের পর্বে পর্বে রূপ বদলায়। যে তার একটি রূপকেই ধ্রুব বলে মনে করে সে দুঃখ পায়! প্রণয়কে কেন্দ্র করেই পরিবারের কর্মচক্র ঘোরার কথা, কিন্তু তা তো সব সময়ে হয় না। জীবনের অপূর্ণতার এই সব দায় আমাদের বহন করতেই হয়। কিন্তু, এ সব কথা হঠাৎ তোমার মনে আসছে কেন?’
‘এখনও আসবে না!’ বিশাখা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এক যুবা আমাকে দিনেরাতে প্রশ্ন করছে আমি তাকে ভালোবাসি কি না, হৃদয়ের অন্তস্তল খুঁজেও এর উত্তর মেলেনি, মা। যদি প্রণয়ই বিবাহের ভিত্তি হয় তাহলে তাকে আমার বিবাহ করা উচিত হবে না। মিথ্যাচার হবে। আর বিবাহের কারণ যদি অন্যগুলি হয়, সেগুলি আমি অনায়াসে পারবো। কিন্তু তবু এই সামান্য সামাজিক স্বার্থের জন্য আমার জন্মস্থান, আমার পিতৃগৃহ, আমার মাতৃসঙ্গ ছেড়ে সাবত্থি চলে যাওয়া আমার যথেষ্ট মনে হয় না। সহজে বলছি মা, সে ক্ষেত্রে বিবাহে আমার রুচি নেই।’
সুমনা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে তোমায় অপেক্ষা করতে হয় বিসাখা, কিন্তু সময় কি আর আছে?’
ধনপালী এসে সংবাদ দিল ধনঞ্জয় আসছেন। বিশাখা ঘর ছেড়ে যাচ্ছিল, সুমনা বললেন, ‘কোথায় যাও বিসাখা, অপেক্ষা করো, তুমি বড় হয়েছ, রাজগহ থেকে যেসব সংবাদ বয়ে এনেছি সব শোনো!’
‘কী সংবাদ?’ ধনঞ্জয় উৎসুক মুখে ত্বরিত পদে ঘরে ঢুকলেন। সুমনা প্রণাম করলেন। পিতা-মাতার দৃষ্টি-বিনিময় লক্ষ্য করে মুখ নামিয়ে নিল বিশাখা। এই-ই কি প্রণয়লক্ষণ? সে শুনেছে কোন অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় বালিকা সুমনাকে দেখে পুত্রবধু নির্বাচন করেছিলেন পিতামহ মেণ্ডক। তার পিতা সে সময়ে কোথায় ছিলেন? তার খুব সন্দেহ পিতাও সে সময়ে উপস্থিত ছিলেন, মেণ্ডকের নির্বাচনের পেছনে নিশ্চয়ই তার পিতার আকুলতা ছিল, মায়েরও কি ছিল না? আসলে তার বাবা-মা অন্য প্রকার। অনেক সময়ে তাঁরা সমবয়সী সমকৰ্মা সখা-সখীর মতো। আবার কখনও কখনও নববিবাহিত বরবধুর মতো হয়ে ওঠে তাঁদের হাবভাব। তার বাবা-মার ক্ষেত্রে যে প্রণয় একটি সুন্দর সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে, তার জীবনে কি তা দেখা দেবে? তার ভেতরে কোথাও কোনও কুসুম ফোটার সৌরভ বিসাখা পাচ্ছে না অথচ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে বুঝতে পারছে।
ধনঞ্জয় বললেন, ‘বলো সুমনা, রাজগৃহের খবর ভালো?’
‘ভালো, আবার ভালো নয়ও!’
‘সে আবার কী?’
‘ভদ্দাকে জানতে তো? রাজ কোষাধ্যক্ষের মেয়ে? সেই যে খুব চঞ্চল মেয়েটি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার পিতা তো তার বিবাহ দিতে পারছিলেন না। কাউকেই তার মনে ধরছিল না। শেষ পর্যন্ত পথে এক চোরকে দেখে তার ভালো লাগে।’
‘সে আবার কী?’
‘সত্যই অদ্ভুত। চোরের রাজা সম্ভক। পুরোহিত ঘরের ছেলে। স্বভাব-চোর, কিছুতেই শোধরাতে পেরে তার পিতা-মাতা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।’
‘এ-ও তো অদ্ভুত কথা সুমনা। শোধরানো যাবে না বলে কোনও কথা আছে! নিজের সন্তানকে বহিষ্কার?
‘তারপর শোনোই না। ভদ্দার তো তার প্রতি তীব্র প্রণয়, পিতা-মাতা কত করে বোঝালেন, সে কিছুতেই শুনল না। অবশেষে রাজরক্ষীদের বহু উৎকোচ দিয়ে সম্ভকের প্রাণরক্ষা হল, মহা সমারোহ করে ভদ্দার সঙ্গেই বিয়েও হল। এত বছর ভালোই ছিল, চর্ব্য-চোষ্য খাচ্ছে, সমাদরে আছে, সুন্দরী ভার্যা। কিন্তু একদিন ভদ্দাকে বললে সমস্ত অলংকার পরে গিদ্ধকুট পর্বতে যেতে হবে, সে নাকি গিরিদেবতার পূজা দেবে মানসিক করেছিল। গিরিশৃঙ্গে গিয়ে চোরটা বলে সমস্ত অলংকার দিয়ে দাও এখুনি। ভদ্দা বোঝায় যে, অলংকার তো তারই, চোর সে কথা শুনবে কেন? তখন ভদ্রা বুঝতে পারে, অলংকার নিয়েই ক্ষান্ত হবে না ওই ঘৃণ্য চোর, তাকেও নিশ্চয় হত্যা করবে। তখন বুদ্ধি করে বলে, শেষবারের মতো সালংকারা অবস্থায় সে স্বামীকে আলিঙ্গন করতে চায়। আলিঙ্গনের ছলে ভদ্দা চোরটিকে পর্বতশৃঙ্গ থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। তারপর আর কোনও কথা না। সোজা গিয়ে জৈন ভিক্ষুণী সংঘে যোগ দিয়েছে। রাজগহে হুলুস্থূল।’
বিশাখা বলল, ‘প্রণয়ের মধ্যে তাহলে বিবেকের একটা বড় স্থান রয়েছে মা।’
‘নিশ্চয়’, সুমনা বললেন। ‘শুধু রূপমুগ্ধতাকে কী প্রণয় বলে?’
ধনঞ্জয় বললেন, মেয়েটির সাহসের প্রশংসা করতে হয়। সংকল্পের জোর দেখো! চোরকে বিবাহ করবে তো করবেই। তার পরে উপস্থিত বুদ্ধির বশে নিষ্ঠুর স্বামীকে হত্যা করল, সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল প্রব্রজ্যা নিয়ে। দেখে রাখো এ মেয়ে একদিন বহু ঊর্ধ্বে উঠবে।’
একজন দাসী উষ্ণ দুধ আর মিষ্টান্ন রেখে গেল। ধনঞ্জয় দুধের পাত্র মুখে তুললেন, একটু পরে বললেন, ‘তা রাজপুরী থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কে? কোশলদেবী?’
‘উহুঃ। সেনিয়। সেনিয়ই ডেকে পাঠিয়েছেন।’
‘বলো কি? সর্বার্থকের পদবী এবার তোমাকেই দিয়ে দিন না মহারাজ!’
‘রসিকতা রাখো, বড় অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে রাজগহে।’
‘বলো, বলো শুনছি।’
‘দেবী ক্ষেমা পব্বজ্জা নেবেন।’
ধনঞ্জয় দুধের পাত্ৰ কাষ্ঠফলকে নামিয়ে রাখলেন, ‘কী বললে? দেবী ক্ষেমা? প্রব্রজ্যা?’
‘হ্যাঁ গো। দেবী ক্ষেমা প্রব্রজ্যা নিতে চেয়েছেন…’
বিসাখা অবাক হয়ে বলল, ‘মা, দেবী ক্ষেমা তো রাজার মহিষীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী! সবচেয়ে বিলাসীও।’
‘হ্যাঁ রে, দুধ দিয়ে, হরিদ্রা দিয়ে, চন্দন জল দিয়ে স্নান করে, প্রহরে প্রহরে বেশবাস এবং অলঙ্কার পরিবর্তন করে। কোনও দুর্গন্ধ সইতে পারে না বলে ওর গৃহ-মার্জারটাকে পর্যন্ত চন্দনজলে স্নান করানো হয়। মণ্ডনের যে কতরকম প্রক্রিয়া আছে, কত চূর্ণ, কত অবলেপ্য, কত মুকুর, কত সুরভিসার—সে তুই ধারণা করতে পারবি না। হিঙ্গুল চূর্ণ ব্যবহার করে নিয়মিত। ধনঞ্জয়ের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘রাজা মুখে হর্ষ দেখাচ্ছেন, ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়েছেন। তাই আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন যদি ফেরাতে পারি। সোজাসুজি নয়। পাকেপ্রকারে। প্রকৃতপক্ষে রাজা তো নিজের জালে নিজেই জড়িয়েছেন কি না!’
‘কি প্রকার?’
‘কলণ্ডক নিবাপে শ্রমণ গৌতম আশ্রয় নেবার পর মহারাজ তো প্রায়ই সব মহিষীদের সঙ্গে নিয়ে উপদেশ শুনতে যেতেন। কোশলদেবী যেতেন, ছেল্লনাদেবীর পিতৃবংশ মহাবীরের ভক্ত, তবু তিনি যেতেন। যেতেন না খালি দেবী ক্ষেমা। মহারাজ পরিহাস করে বলতেন গৌতম দৈহিক রূপকে কোনও মূল্য দেন না, তাঁর কাছে অপ্সরীও যা বানরীও তা। সেই জন্যেই বোধ হয় দেবী যেতে চান না! তাঁর অতুল রূপের সমাদর হবে না। শুনতে শুনতে ক্ষেমা একদিন বললেন, “মহারাজ কি মনে করেন বাইরের রূপ ছাড়া আমার মধ্যে সমাদর করবার মতো আর কিছু নেই? আর যদি সত্যি তাই-ই হয় তবে সে রূপের যোগ্য সমাদর কি রাজান্তঃপুরে হয়নি বলেই রূপ পরখ করবার জন্য শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসীর বিচারের আশায় বসে আছি!” তা এ কথা শোনার পরও মহারাজের চৈতন্য হয়নি, তুমি তো জানো সেট্ঠি, বিম্বিসার কেমন গোঁয়ার। বেণুবন উদ্যানের সৌন্দর্য দেখাবার ছল করে তিনি ক্ষেমাদেবীকে গৌতম সকাশে পাঠান। সেখান থেকে ফিরে এসে মহিষী কিছুদিন বড় আনমনা হয়ে থাকেন, তারপর মহারাজকে জানিয়েছেন তিনি পব্বজজ্যা নেবেন। মহারাজের তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।’
‘তা, পারলে মা তাঁকে নিবৃত্ত করতে?’ বিশাখা সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল।
নিশ্বাস ফেলে সুমনা বললেন, ‘না, মহাদেবী ক্ষেমার পব্বজ্জ্যা গ্রহণ উৎসব আরম্ভ হবে ঠিক হয়েছে আগামী আষাঢ়ী পূর্ণিমায়, আমিও দ্রুত রথে করে রাজগহ থেকে পালিয়ে এসেছি। তাঁর অনুপম গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ কেশকলাপ উন্মূল হয়ে যাবে। শ্ৰীঅঙ্গে চীবর ধারণ করে, ভিক্ষাপাত্র হাতে চলে যাবেন, এ আমি সইতে পারব না! মহারাজ অবশ্য স্বর্ণমণ্ডিত শিবিকায় করে পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন, বেণুবন আরাম তো দিয়েইছেন গৌতমকে, আরও বহু উপচার ভিক্ষু সংঘকে দেবার ব্যবস্থা করছেন। মনোগত ইচ্ছা বোধ হয় যে মহাদেবীকে ভিক্ষুণী বেশে কেউ দেখতে না পায়, এবং সংঘে গিয়ে দেবীর খাওয়া শোওয়ার কোনও কষ্ট না হয়।
ধনঞ্জয় দুঃখের হাসি হেসে বললেন, ‘তোমার সেনিয় কি জানেন না ভিক্ষুণীর বিলাসে অধিকার নেই! দিনে একবারের বেশি সে খায় না। তা-ও ভিক্ষান্ন! গৌতমের সংঘের নিয়ম খুব কঠিন। আর উপসম্পদা পাবার আগে পর্যন্ত তো কথাই নেই! রানি বলে নিয়মের কোনও শৈথিল্য হবে না।
আর সত্যিই, হবেই বা কেন? দেবী ক্ষেমা তো উপাসিকা হলে পারতেন সুমনা। গৃহী ভক্তদেরও তো তথাগত সমাদর করেন, কর্মস্থান বলে দেন, এসব শুনেছি।’
সুমনা বললেন, ‘শুনতে সহজ সেট্ঠি, রানি পব্বজ্যা নিলেন, আসলে ভেতরের ব্যাপার অনেক জটিল। পব্বজ্যা নেবার পথ অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে মনের মধ্যে নির্মিত হয়। সেই পথ ধরে আসে তথাগতর উপদেশ, তথাগতর অলোকসামান্য উপস্থিতি।
ধনঞ্জয় ছদ্ম ভয়ে বললেন, ‘তুমিও কি প্রব্রজ্যা নেবে মনে করছ না কি?’
সুমনা হাসলেন না। বললেন, ‘সেটাই তো কথা। আমি তো কই নিচ্ছি না। দেবী ক্ষেমাই নিলেন কেন? তোমার ভগ্নী রত্নাবলী নিল কেন? ভদ্রা ভিক্ষুণী সংঘে যোগ দিল কেন? ভেবে দেখো এদের সবার ভেতরে একটা সূত্র আছে। একটি সাধারণ সূত্র।’
ধনঞ্জয় বললেন, ‘হ্যাঁ, তিনজনেই সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। একজন রানি। দুজন সেট্ঠি পরিবারের। সাধারণ সুত্র তো আছে বটেই।’
বিশাখা বলল, ‘না পিতা। সাধারণ সূত্র হল যত ধন, যত রূপই থাক এঁরা দুঃখী। সবাই দুঃখী। অজ্জা রত্নাবলীর পতি বারো বৎসর নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন, তারপর পিতামহ তাঁর মোক্ষক্রিয়া করিয়ে তাঁকে আবার বিবাহ দিতে চাইলেন। কিন্তু ওই বারো বৎসরেই বিবাহিত জীবনের অনিশ্চয়তা, অসারতা অজ্জা রত্নাবলী বুঝে গিয়েছিলেন। নারী কি বস্তুবিশেষ, যে তার প্রভু না থাকলেই তাকে হস্তান্তরিত করে দেওয়া হবে! আর ভদ্রাদেবীর দুঃখ তো স্বয়ংপ্রকাশ। একটা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত চোর, তাকে তিনি প্রণয় দিলেন, সম্পদ দিলেন, সেবা দিলেন, সে হতভাগ্য ঘৃণ্য পশুটা বলে কি না অলঙ্কারের জন্যেই তোমাকে চেয়েছি, অলঙ্কারগুলি দাও? উহ্, ভদ্রা বলে তাকে শুধু পর্বতশিখর থেকে ফেলে দিয়েছিলেন, আমি হলে ওর হস্ত-পদ-নাসিকা ছেদন করে ওকে কুকুর দিয়ে খাওয়াতাম।’ বলতে বলতে উত্তেজনায় বিশাখার মুখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল, তার নাসিকা স্ফুরিত হচ্ছে, কপালে স্বেদবিন্দু।
ধনঞ্জয় বিশাখার পিঠে হাত দিয়ে সস্নেহে বললেন, ‘তোমার উত্তেজনার কারণ নেই মা। তুমি অত্যন্ত বিবেকী! মূর্খের মতো কাজ তো তুমি কখনওই করবে না। মোহেরও কোনও লক্ষণ তোমার মধ্যে কখনও দেখিনি।’
বিশাখা বলল, ‘পিতা। কেন জানি না, অন্য কারও দুঃখের কথা শুনলে, বিশেষত নারীদের, আমি যেন কেমন একাত্ম হয়ে যাই তাদের সঙ্গে। অজ্জা রত্নাবলী যেন আমিই, আমিই যেন দেবী ভদ্রা, আমার এরূপ হয়। আর তুমি মূর্খতার কথা বলছ, মোহের কথা বলছ? যতই বিবেকী হোক, কেউ বলতে পারে না সে কখনও মূর্খতা করবে না, মোহের বশবর্তী হবে না। আর না হলেও যে জীবন সর্বাঙ্গসুন্দর হবে, ভাগ্যপীড়িত হবে না, এমন কথা কি কেউ দিতে পারে?’
বিশাখার মনের মধ্যে ভীষণ আলোড়ন চলছে তার বিবাহের কথা হওয়ার জন্যেই বোধ হয়। সুমনা ধনঞ্জয় দুজনেই বুঝতে পেরে নীরব হয়ে রইলেন। ধনঞ্জয় তাঁর হাত রেখেছেন বিশাখার পিঠে, মা সুমনা একটি হাত জড়িয়ে রেখেছেন নিজের হাতে। হাতটি শীতল, বড়ই শীতল।
কিছুক্ষণ পর বিশাখা মুখ তুলে হাসল, বলল, ‘কই মা, মহাদেবী ক্ষেমার কথাটা শেষ করো!’
‘এই যে করি।’ বলে সুমনা চুপ করে রইলেন। ধনঞ্জয় তাঁকে চোখের ইঙ্গিতে নিষেধ করছেন বলতে।
বিশাখা বলল, ‘বলবে না? মা আমি তো আর শিশু নেই! পঞ্চদশ বর্ষ পার হয়ে গেছি। যতদূর সম্ভব আমাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, জীবনের, সংসার-জীবনের কী কী বিপদ, কী ধরনের জটিলতা থাকতে পারে। মা বলো!’
সুমনা ধীরে ধীরে বললেন, ‘রানিকে তো একা পাওয়াই দুরূহ। গভীর রাতে দেখি শয্যা ছেড়ে গবাক্ষপথে বাইরে চেয়ে আছেন, আমি বললাম রাজ্ঞী এই সুন্দর বিলাসবহুল প্রাসাদ, কোমল শয্যা, এত সেবা, এত সুখের অভ্যাস, এসব ছেড়ে পাথরের ওপর সংঘাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতে পারবেন? ভিক্ষার মিশ্রিত কদন্ন খেতে পারবেন? দেবী বললেন, তুমি রানি হওনি তাই জানো না এই বিলাস, এই সেবা, এই সুখ মিথ্যে। একেই মায়া বলে। রানির জীবন এক অতলস্পর্শী শূন্যতা। এক মহাগহ্বরে হাহাকার, আমি বললাম—আপনার পুত্র হওয়ার সময় তো যায়নি, কেন এত হতাশ হচ্ছেন? দেবী বললেন, “পুত্র! সুমনা। রাজরানির পুত্ৰসুখ বলতেও কিছু নেই। কোশলদেবীকে দেখো না? কোনদিন নিজের পুত্রকে কোলে নিতে পেরেছেন সাধ মিটিয়ে? শাসন করতে পেরেছেন? ক্রমশই ক্ৰোধী, দুর্বিনীত হয়ে উঠছে। পেরেছেন তাকে শান্ত করতে? সুমনা। সুদুর সাগল থেকে যখন মগধে এসেছিলাম, পিতা-মাতা নিভৃতে বলে দিয়েছিলেন—এই রাজা চিরকাল ছোট রাজ্যের রাজা থাকবে না কন্যা। তোমার অতুল রূপবৈভবে, তোমার গুণগ্রামে বশীভূত রেখো এঁকে, সেইসঙ্গে এঁর প্রতিভাকে চেতিয়ে তুলো। সুমনা আমি পারিনি, আমাকে বিবাহ করবার অল্পদিন পরেই দেখলাম, ছেল্লনার গৃহেই তাঁকে বেশি সময় কাটাতে হয়, নইলে বৈশালীর লিচ্ছবিরা কুপিত হবে। শুধু রূপ নয়, আমার প্রণয়ই বা আদৃত হল কই? আমি যে রাজকন্যা, রাজনীতির ব্যাপারে কিছু স্বাভাবিক বুদ্ধি ধরি তার অস্তিত্বই বা কোথায় স্বীকৃত হল? আমার অভিমানকে রাজা রূপগর্ব বলে ভুল করেন, আমার হতাশাকে মনে করেন উদাসীনতা। দেব তথাগতকে আমি দেখতে যাইনি কেন জানো? মহারাজ যার প্রতি সমাদর দেখাতে অগ্নিসাক্ষী করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন তার প্রতি তিনি উদাসীন, অথচ এক সন্ন্যাসীর প্রতি তাঁর এ কী তীব্র আকর্ষণ! আমার ঈর্ষা হত, সত্য বলছি। আর শুধু তথাগতই তো নয়, রাজধানীর চারপাশের গিরিগুহাগুলি তো নানা পন্থের সন্ন্যাসীতে পূর্ণ। কত আজীবক, তীর্থিক, কত জটিল সন্ন্যাসী। রাজা তাঁদের এত সমাদর করেন কেন বলো তো? তিনি রাজবংশের সন্তান নন, অথচ মহারাজাধিরাজ হতে চান, মহাজনদের আর্শীবাদ ও অলৌকিক সহায়তার জন্য তিনি মনে মনে লালায়িত। এ কি আমি বুঝি না? তথাগতকে আমি দেখতে যাইনি, স্বীকারই তো করেছি সুমনা, আমার ঈর্ষা হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলাম! তিনি প্রতীত্যসমুৎপাদতত্ত্ব ব্যাখ্যা করছিলেন। কী বলব সুমনা, আমি যেন চোখের সামনে দেখলাম আমি জরতী হয়ে যাচ্ছি, ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি, সামান্যতম মর্যাদাও আর কেউ আমায় দিচ্ছে না। ওই মৃত্যু এসে আমায় গ্রাস করল, তৃষ্ণা গেল না, প্রণয়ের তৃষ্ণা, মর্যাদার তৃষ্ণা, সন্তানের তৃষ্ণা, আবার জন্মালাম, আমার যৌবনকষ্ট, জরাকষ্ট, মৃত্যুদুঃখ, চক্র ঘুরছে, ভবচক্র। নত্থি রাগসমো অগ্গি, নত্থি দোসসমে কলি।/ নত্থি খন্দাদিসা দুক্খা, নত্থি সন্তিপরং সুখম॥ আকাঙ্ক্ষার সমান আগুন আর নেই। শরীরের মতো দুঃখময়ও আর কিছু নেই। শান্তি, শান্তি, শান্তির মতো সুখও আর নেই। সুমনা আমার মনে হল, উনি আমারই জন্য রাজগৃহে এসেছেন, আমার মতো হতভাগিনীরও মুক্তির আশা আছে। রাজপুরীর এই স্থবির, অচল, জিঘাংসা-ঈর্ষাময় জীবনের থেকে অন্য পথে। হয়ত কঠিন। খুবই কঠিন। তবু তো কিছু! তবু তো আশা! এখানে যে কিছুই নেই সুমনা!’
সুমনা সজল চোখে মাথা নিচু করলেন। বিশাখা মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কোলে মুখ রেখেছে। তার নিশ্বাসের উষ্ণতা, তিনি অনুভব করছেন কোলে। ধনঞ্জয়ও মাথা নিচু করে চুপ করে আছেন।
অনেকক্ষণ পরে সুমনা বললেন, ‘যাক, রাজ পরিবারের সুখ-দুঃখের কথা ছেড়ে এবার আমাদের নিজেদের সুখ-দুঃখের কথায় আসি। সেট্ঠি, সেনিয়র ইচ্ছা বিসাখার সঙ্গে কুমার অজাতশত্রুর বিবাহ দেয়।’
‘বলো কী!’
‘হ্যাঁ। সোজাসুজি প্রস্তাবটা করেননি। আমার মন বোঝবার জন্য কতকগুলি সংকেত করেছেন মাত্র। অগ্ৰমাহিষী কোশলদেবীর বোধ হয় বিশেষ ইচ্ছা। বলছিলেন—আমাদের মধ্যে এত সখিত্ব, কোনও উপায়ে যদি একে আত্মীয়তার পরিণত করা যেত!’
বিশাখা হঠাৎ মায়ের কোলের মধ্যে মাথা নাড়তে লাগল, ‘না মা, না না না।’
‘অবশ্যই না’, সুমনা বললেন।
ধনঞ্জয় বললেন, ‘কুমার অদূর ভবিষ্যতে মগধের রাজা হবেন। শীঘ্রই তো চম্পার শাসনভার নিয়ে যাচ্ছেন শুনলাম। বিসাখার মতো অসামান্য মেয়ে মগধের রানি হবে এতে তোমাদের মাতা কন্যা কারও মত নেই? আশ্চর্য!’
সুমনা বললেন, ‘সেট্ঠি, কুমার অজাতশত্রু অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। শস্ত্রনিপুণ, অল্প বয়সেই যুদ্ধকুশল, রাজনীতিও বোঝে, সবই ঠিক। কিন্তু লোভী, কোপনস্বভাব, হঠকারী। তারপর হাতে একটা ত্রুটি আছে। যে জন্য ওকে কুনিয় বলে সবাই। বিম্বিসারের উপযুক্ত পুত্রই যেন নয় ও। তা ছাড়াও দেবী ক্ষেমার যে মনোদুঃখের কথা শোনালাম তার পরেও তুমি বিসাখার জন্য রানির পদ প্রার্থনীয় মনে করো? কীসের অভাব তার? জগতে এমন কী বস্তু আছে যা আমরা বিসাখার জন্য এনে দিতে পারি না! বেশি লোভ ভালো নয় সেট্ঠি।’
ধনঞ্জয় চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কিন্তু মহারাজ যদি এ প্রস্তাব পাঠান, আমি না বলব কী করে? এ তো আমি অত্যন্ত বিপদে পড়লাম দেখছি!’
সহসা বিসাখা মুখ তুলে বলল, ‘পিতা মহারাজের প্রস্তাব আসবার আগেই যদি আমার বাগদান হয়ে যায়, এমন কি বিবাহ স্থির হয়ে যায় তাহলেও কি মহারাজ তোমার ওপর জোর করতে পারেন, বা অসন্তুষ্ট হতে পারেন?’
ধনঞ্জয় বললেন, ‘না। মহারাজ ধার্মিক-স্বভাব। অন্যায় জোর করবার পাত্র নন।’
‘তাহলে? তাহলে তো আমার বাগদান হয়েই গেছে। আমি যে মিগার সেট্ঠির পাঠানো আশীর্বাদী কণ্ঠহার গ্রহণ করেছি পিতা, সারা সাকেতের লোক, এমন কি রাজকুমার তিষ্য পর্যন্ত এ ঘটনার সাক্ষ্য দিতে পারে।’
সুমনা ও ধনঞ্জয় চমৎকৃত হয়ে কন্যার মুখের দিকে চাইলেন। ঠিক, সত্যিই তো! উপায় তো রয়েছে!
ধনঞ্জয় বললেন, ‘কিন্তু সেট্ঠি মিগার ঠিক আমাদের সমমানের নয়। পুত্রটি শুনছি রূপবান, গুণবান, কিন্তু সবই তো শোনা কথা। একটু সংবাদাদি না নিয়ে..’
বিশাখা বলল, ‘পিতা, রাজরানি হবার চেয়ে আমি ভিক্ষুণী হওয়া অনেক শ্রেয় মনে করি। সেট্ঠি ঘরের আচার-বিচার অন্ততপক্ষে আমার চেনা। সেট্ঠিকুমাররা কেমন হয় সাধারণত, সে জ্ঞানও আমার আছে।’
সুমনা বললেন, ‘বিসাখা ঠিক বলেছে। এখন আর দ্বিধা করবার সময় নেই। সত্বর ব্রাহ্মণদের ডেকে পাঠাও। সম্মতি জানিয়ে শ্রাবস্তীতে মাঙ্গলিক উপচার পাঠাবার ব্যবস্থা করো। আর বিলম্ব নয়।’
ধনঞ্জয় গাত্রোত্থান করলেন। দাস-দাসীদের ডাকা হল। দেবী সুমনা সাবত্থির ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলাপ করবেন। আজই দ্রুতগামী অশ্বে শুভ সংবাদ নিয়ে তোক চলে যাবে শ্রাবস্তীতে মিগার শ্ৰেষ্ঠীর গৃহে। পেছনে শিবিকায় বহুমূল্য আশীর্বাদী উপঢৌকন নিয়ে যাবেন স্বয়ং আচার্য ক্ষত্রপাণি, এবং তিন ব্রাহ্মণ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্ৰেষ্ঠীগৃহে সাড়া পড়ে গেল।
‘শুনেছিস কহ্না, বিসাখাভদ্দার বিবাহ স্থির হয়ে গেল।
‘কোথায়?’
‘ওই যে তিন বটু এসেছে সাবত্থি থেকে। মিগার সেট্ঠির সুপুত্তুর পুন্নবদ্ধন রে! পঞ্চ কল্যাণী কন্যে না হলে বিবাহ করবে না, শপথ করেছিল।’
‘হি হি হি হি, কী আনন্দ, না?’
‘তা বিসাখাভদ্দার যা হাব-ভাব তাতে তিনিও পঞ্চকল্যাণ টল্যান কোনও প্রতিজ্ঞা করেননি তো?’
‘বীর্যশুল্কা হলে পারতেন বিসাখাভদ্দা।’
শাঁখ বাজা, শাঁখ বাজা। মৃদঙ্গ, পটহ, যেখানে যা আছে বাজা।’
‘বিসাখে, ও বিসাখে, এবার তবে সত্যিই চললি?’
‘উদায়ী, আর দেরি করো না। ভাণ্ডারে কী কী আছে তার তালিকা উপস্থিত করো। গণকরা লেখকরা সব কোথায় গেল? আচ্ছা তো?’ ‘মণিকার স্বর্ণকারেরা সব আসতে লেগেছে যে!’ ‘তাঁত বসাবার ঘর কোনটা হবে?’ ‘ভদ্দিয়তে তুমি লিপিখানা নিয়ে চলে যাও মণিভদ্র’ ‘নিমন্ত্রণপত্র রচনার ভার কে নেবে? রাজা প্রসেনজিৎ, রাজা বিম্বিসার এঁদেরও তো নিমন্ত্রণ পাঠাতে হবে?’ ‘হাত চালাও।’ ‘গ্রামগুলিতে সংবাদ দাও। তারা যেন ঠিক সময়ে উপহার নিয়ে উপস্থিত হতে পারে।’
১১
মহামাত্র দর্ভসেন বেশ হৃষ্ট। মগধরাজের উত্তরটি তাঁর খুব মনোমত হয়েছে। গজদন্তের পেটিকায় প্রত্যুপহার। খুব লঘুভার। কী তাতে আছে দর্ভসেন জানেন না। পেটিকাটি নিশ্ছিদ্রভাবে বন্ধ। উপহার যা-ই হোক, সে দেব পুষ্করসারী বুঝবেন। দর্ভসেনের আসল কাজ লিপিটি বয়ে নিয়ে যাওয়া। পেটিকাটি বাহুল্য। তবে অত লঘুভার যখন, তখন নিশ্চয় অতি দুর্মূল্য বস্তুই আছে। দর্ভসেন জানেন না পেটিকার মধ্যে আছে শুধু এক রেশম বস্ত্র, তাতে হিঙ্গুলরস দিয়ে শ্রমণ গৌতমের সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হবার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। এই-ই পুক্কুসাতীকে বিম্বিসারের উপহার। একমাত্র পুক্কুসাতীই যার মূল্য বুঝতে পারবেন। আগামী কালই দূতবাহিনী গান্ধারের দিকে যাত্রা করবে, উত্তরের বাণিজ্যপথ ধরে। চণকের দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘চণকের এত আয়োজন, এত মনোযোগের দৌত্য সার্থক হল তাহলে শেষ পর্যন্ত, তার পদোন্নতি তো অবশ্যম্ভাবী।
সম্পাতি তুমি কী বলো?’
সম্পাতি সংক্ষেপে বলল, ‘অবশ্যই!’
দর্ভসেন তাতে সুখী হলেন না। তাঁর আশা ছিল অন্তত সম্পাতি বলবে, নেতা তো মহামাত্র দর্ভসেন। কৃতিত্ব তো তাঁরই। চণকের থেকে তিনি এতটা বিনয় আশা করেননি, কিন্তু সম্পাতির থেকেও নম্রতাটুকু কি তাঁর প্রাপ্য ছিল না!
চণকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কি হে চণক! কবে মগধরাজ সৈন্য পাঠাবেন, মধ্যাহ্নভোজনের সময়ে কিছু বললেন না কি?’
চণক বলল, ‘না।’
দুদিন হয়ে গেছে চণক রাজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসেছে কিন্তু সে-সম্পর্কে সে নিজে থেকে কিছুই বলছে না। দর্ভসেন চেয়েছিলেন সে নিজে থেকেই সব বিবরণ দেবে। জিজ্ঞাসা করার দীনতা তিনি স্বীকার করতে চান না। অথচ কৌতূহল সংবরণ করতেও পারছেন না। আসলে মহামাত্র দর্ভসেনের অবস্থা একটু অসম্মানজনক হয়ে উঠেছে। গান্ধার রাজ্যে তাঁর পিতামহের সময় থেকেই চরাধ্যক্ষের পদটি তাঁদের বংশের। স্বরাজ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি আকাশচুম্বী। তিনি অত্যন্ত কুশলী। বীরপুরুষও। কিন্তু সারা জীবনে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজের সুযোগ পাননি। মগধের দৌত্যকার্যের দায়িত্ব যখন গান্ধাররাজ তাঁকে না দিয়ে সদ্য আগত যুবক চণককে দিতে মনস্থ করলেন তখন দর্ভসেন যার-পর-নাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। চণক তাঁর বাহিনী নিয়ে বার হয়ে গেলে তিনি তাঁর ক্ষোভের কথা গান্ধারাধিপতির কাছে স্পষ্ট ভাষার প্রকাশ করেন।
‘এবার তবে রাজকার্য থেকে আমাকে অব্যাহতি দিন মহারাজ!’
‘সে কি মহামাত্র?’
‘গুরুত্বপূর্ণ দৌত্যকর্ম যদি অনভিজ্ঞ তরুণদের হাতে ন্যস্ত করা যায় তাহলে আমাদের মতো প্রবীণ মস্তকের তো আর কোনও প্রয়োজন দেখি না মহারাজ!’
পুষ্করসারী মানুষটি একটু দুর্বল প্রকৃতির। বয়স্ক অমাত্যকে তিনি মোটেই ক্ষুব্ধ করতে চাননি। দর্ভসেন যে ক্ষুণ্ণ হতে পারেন এ কথাও তাঁর মনে আসেনি। কেননা রাজ্যের চরশৃঙ্খলটি সারা বছর ধরেই খুব সক্রিয় রাখতে হয়। দৰ্ভসেন না থাকলে আর কাউকে সে কাজের ভার দিতে হয়। মগধের মতো সুদূর রাজ্যে তাঁকে পাঠানো মানে রাজধানীর অন্তঃপ্রশাসন একরকম বিকল হয়ে থাকা। এ ছাড়াও কয়েকটি গুপ্ত কারণে তিনি চণককে বেছেছিলেন। প্রথমত, তিনি জানতেন চণক অত্যন্ত ভ্রমণপিপাসু, ভ্রমণপটুও বটে। তাকে বেশি দিন সভার গতানুগতিক কাজে ধরে রাখতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, সে অতিশয় প্রতিভাবান যুবক। বহু বর্ষে তক্ষশিলায় এরকম একটি ছাত্র আসে। তাকে দিয়ে যতটা কাজ করিয়ে নিতে পারেন ততই ভালো। তা ছাড়াও তিনি জানতেন চণকের পিতা কয়েক বছর গুপ্তভাবে মগধরাজ বিম্বিসারের আচার্য ছিলেন। সেই কারণে কোনও বিশেষ বিবেচনা মগধরাজের কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু দর্ভসেন তাঁকে বোঝালেন—দূরদেশ তরুণ চণককে পাঠিয়ে তিনি ভালো করেননি। চণকের পৃষ্ঠরক্ষা, এবং এক হিসেবে তার ওপর চরগিরি করবার দায়িত্বটা তিনি গান্ধাররাজকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে দিতে। মগধে আসবার পর প্রথম দিকটায় দর্ভসেন চণকের ওপর নিজের প্রভুত্ব বিস্তার করতে কিছুটা সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমশই যেন চণক তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। সে একে স্বল্পভাষী, মন্ত্রগুপ্তি তার স্বভাবের অঙ্গ। এ দিকে মাসাধিককাল মগধে কাটানোয় তার এ স্থানের অভিজ্ঞতা দর্ভসেনের চেয়ে বেশি, সে তো এসে থেকে শুধু রাজ অতিথিশালায় থাকেনি, পথে পথে, পাহাড়ে পাহাড়ে, বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে। উপরন্তু আবার মহারাজ বিম্বিসারের আচার্যপুত্র হওয়ায় তার বিশেষ সমাদর। দর্ভসেনের বহুদর্শিতা, কর্মকুশলতা, কিছুই যেন যথাযথ কাজে লাগছে না। চণক যেন কেমন করে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য, অতিরিক্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তার মৌনতার বর্মে লেগে দর্ভসেনের সমস্ত বক্রোক্তিই ঝড়ে পড়ে যায়, কুশের তীরের মতো। চণক তাঁকে অবজ্ঞা না করেও, তাঁর অবাধ্য না হয়েও, নিজের মতে চলছে। দলের অবিসংবাদী নেতৃত্ব তিনি দিতে পারছেন না। তিনি ধরে আছেন বাইরের খোলসটা। ভেতরের আসল নীতিনির্ধারণের কাজটা যেন চণকই করছে।
পর দিন প্রত্যূষেই গান্ধার-যাত্রা, অথচ অপরাহ্ণ থেকে চণকের দেখা নেই। রাজপুরী থেকে যামভেরী শোনা গেল। দর্ভসেন হাতের কাছে চণককে না পেয়ে সম্পাতিকেই কটু কথা শোনান—‘কী হে সম্পাতি তোমাদের এমন উদাসীন, নিরুৎসাহ মতিগতি তো আমার ভালো ঠেকছে না? আরও কটা দিন রাজগৃহে থেকে যাবে মনে করছ না কি? তোমার সখা তো মনে হচ্ছে ওই নটী শ্ৰীমতীর গৃহেই রাত্রিযাপন করছে নিত্য।’
সম্পাতি সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, ‘না আর্য, চণক শ্রীমতী বা অন্য কোনও নগরবধূর গৃহে যায় না। আমার মনে হয় ও গৃধ্রকূটে গেছে। বিশেষ ভালোবাসে ওখানে যেতে। কাল চলে যাবে তাই শেষ বারের মতো…।’
‘এত রাত পর্যন্ত?’ দর্ভসেন তিক্ত সুরে বললেন, ‘শ্রীমতীর গৃহে গেলে সে তার যৌবনধর্মেই যেত, বুঝতে পারতাম ব্যাপারটা। কিন্তু গৃধ্রকূটে সে কোন দেবতার পুজো দিতে যায় শুনি!’
এই সময়ে চণক প্রবেশ করল। তার কপালে বিরক্তির কুঞ্চন। দর্ভসেন দেখেও দেখলেন না, আবার সেই একই কথা বললেন, ‘বলি চণক তোমার ব্যাপারটা কী হে? কোথায় যাচ্ছ, কোথায় এত রাত অবধি বিচরণ করে বেড়াচ্ছ, দলপতিকে জানাবারও প্রয়োজন মনে কর না, না কি?’
চণক রুক্ষ স্বরে বলল, ‘আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারেও কি মহামাত্র মাথা গলাবেন? তেমন তো কোনও কথা ছিল না।’
‘দৌত্য-পর্বে দূতের কোনও ব্যক্তিগত জীবন থাকে না চণক। গম্ভীর স্বরে দর্ভসেন বললেন, ‘তুমি তো দেখছি সমস্ত শিষ্টাচার লঙঘন করছ, এখনও পর্যন্ত মগধরাজের সঙ্গে তোমার কী নিভৃতালাপ হল তা পর্যন্ত বলনি। আমি কিন্তু অপেক্ষা করে আছি।’
চণক বিরক্তি গোপন করে বলল, ‘আর্য দর্ভসেন, মহারাজ বিম্বিসারের গৃহে দূত চণকের নিমন্ত্রণ ছিল না। মহারাজ সতীর্থকে ডেকে আলাপ করতে চেয়েছিলেন। দণ্ডনীতি আমাদের আলোচনার বাইরে ছিল। আপনার অসামান্য কৌতূহল শান্ত করবার জন্য এইটুকু বললাম। এটুকুও বলবার কোনও সঙ্গত কারণ ছিল না।’
‘তাহলে এ তোমার অনুগ্রহ বলো! ভালো। গান্ধারে ফিরে তোমার পদোন্নতির জন্য রাজসকাশে নিশ্চয়ই প্রার্থনা জানাবো।’ গম্ভীর রাগত গলায় দর্ভসেন বললেন।
‘আপনাকে কোনও প্রার্থনাই জানাতে হবে না মহামাত্র। কারণ আমি গান্ধারে ফিরছি না।’
‘তার অর্থ?’ ক্রোধে ও বিস্ময়ে দর্ভসেন মুখ তুলে তাকালেন।
চণক বলল, ‘আমি দেব পুষ্করসারীর কার্য সম্পাদনের জন্য আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও শক্তিতে যতটুকু পেরেছি, করেছি। মহামাত্র যদি এসে নেতৃত্বভার গ্রহণ না করতেন, তাহলে অগত্যা মগধের উত্তর ও প্রত্যুপহার নিয়ে আমাকে গান্ধারে ফিরতেই হত। কিন্তু যোগ্যতর, অভিজ্ঞতর ব্যক্তির হাতে নির্ভয়ে এ দায় সমর্পণ করে এবার আমি মুক্ত হতে চাই। এখন আমি কিছু দিন পূর্ব দেশে ভ্রমণ করব। মহারাজের কাছে অনুমতি চেয়ে পত্র লিখেছি। সম্পাতির হাতে পাঠাবো।’
‘অনুমতি? অনুমতির অপেক্ষা রাখছ তুমি? নিজের যা মন চায় স্বেচ্ছাচারীর মতো তা-ই তো করছ দেখছি!’
‘ঠিক আছে, অনুমতির পরিবর্তে যদি পদত্যাগ বলি তাহলে যথাযথ হবে তত?’
‘চণক, তোমার স্পর্ধা ও দুঃসাহস মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, মনে রেখো। সম্পাতির হাতে তুমি পদত্যাগপত্র পাঠাবে মহারাজ পুষ্করসারীর কাছে এই সুদূর মগধ থেকে? তুমি তো দেখছি। রাজদ্রোহী…’
দর্ভসেনের কথা শেষ হল না। চণক হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখ জ্বলছে, তর্জনী সাপের ফণার মতো উদ্যত। সে বলল, ‘যথেষ্ট, মহামাত্র দর্ভসেন, অনেক বলে ফেলেছেন। আর নয়। আপনার স্পর্ধা ও দুঃসাহস মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর একটি অনুদার বাক্য উচ্চারণ করুন, করে দেখুন চণক অস্ত্রের ব্যবহার জানে কি না!’ বলতে বলতে সে কটিতে লম্বমান তার ছুরিকার বাঁটে হাত দিল। তার পরই ঝটিতি কোষমুক্ত করল ছুরিকা।
সম্পাতি দৌড়ে এসে তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল, ‘চণক, চণক, ধৈর্য হারিও না বন্ধু।
চণক ছুরিকা কোষবদ্ধ করে বলল, ‘ধৈর্য আজ প্রায় এক পক্ষ কাল ধারণ করে আছি, কেন জানো সম্পাতি? ইনি যতই রূঢ় ও হিংসুক হোন না কেন, ছিলেন পিতার সতীর্থ। অর্থাৎ আমার পিতৃব্য সম্পৰ্কীয়। শুধু আমার পেছন পেছন মগধে এসে সম্ভবত স্ব-নির্বাচিত দলপতিত্ব করে আমাকে বিব্রত করছেন তাই-ই নয়, মিথ্যা দুর্নাম দেবার চেষ্টা করছেন কলঙ্কিত করবার চেষ্টা করছেন, সমানে। সম্পাতি আমার পত্র রচনা হয়ে গেছে, যাত্রার আগেই পাবে, আমি এখন চললাম।’ চণক কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।
দর্ভসেন প্রথমটা একেবারে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন, এখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সম্পাতি এই মুহূর্তে আমি ওই দুর্বিনীত, রাজদ্রোহী যুবককে গান্ধার রাজ্যের পক্ষ থেকে পদচ্যুত করলাম। রাজসকাশে পূর্বাপর সব জানাবো। তিনি যা হয় শাস্তিবিধান করবেন।’
সম্পাতি মৃদুস্বরে বলল, ‘কিন্তু তার পূর্বেই তো চণক গান্ধারসভার কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিয়েছে মহামাত্র! যাই হোক, এ ঘটনা খুবই দুঃখজনক, আমি চণককে ডেকে আনছি। সে নিশ্চয় আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আপনি শান্ত হোন।’
সম্পাতি বেরিয়ে গেলে, দর্ভসেন একা কক্ষটিতে বসে ক্রমশ শান্ত হয়ে এলেন, তাঁর বৃত্তিতে ক্রোধ সর্বদা পরিত্যাজ্য। কেননা ক্রোধ বুদ্ধিভ্রংশ ঘটায়। বসে বসে অন্ধ রাত্রির দিকে তাকিয়ে রইলেন দর্ভসেন। বাতায়নের বাইরে কাননে কয়েকটি দীপদণ্ডের আলো জ্বলছে। তার ওদিকে নির্মম তমিস্রা। আকাশে আজও সরের মতো মেঘ। তাই তারার আলোর প্রসাদ রাজগহ, নগরীর পথঘাট আদৌ পাচ্ছে না। চণক তাঁকে হিংসুক বলে গেল। উল্লেখ করে গেল তিনি তার পিতার সহাধ্যায়ী ছিলেন। সহাধ্যায়ীই বটে! সে সময়ে তক্ষশিলার যতেক আচার্য, বৎস কাত্যায়ন দেবরাত বলতে অজ্ঞান ছিলেন। তিন বেদ, বেদাঙ্গগুলি ছাড়াও দণ্ডনীতি, বার্তা, ইতিহাস, ইতিবৃত্ত অনেকগুলিতেই সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত করেছিল। সবাই বলতেন সে অসাধারণ প্রতিভাধর। অনেকে রাজ অমাত্য দ্যুমৎসেনের পুত্র বলে কোনও আচার্যই তরুণ দর্ভসেনকে কোনও বিশেষ সমাদর দেখাননি। তবু তিনি দণ্ডনীতিতে উচ্চ থেকে উচ্চতর পাঠ নিচ্ছেলেন। রাজসভায় পিতার বিভাগে তাঁর নিয়োগ এক প্রকার বাঁধা। কিন্তু তাঁর আচার্য, কৃষ্ণাত্রেয় একদিন স্মিত উজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘বৎস দর্ভসেন তোমাকে খুব আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার যা-কিছু জানা আছে সবই তোমাকে শিখিয়েছি, তবে তার থেকেও যদি উচ্চে যেতে চাও তো পথ আছে, আরও শিখবে?’
দর্ভসেন সাগ্রহে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় শিখব আচার্য দেব।’
‘তবে তক্ষশিলার চূড়ামণিস্বরূপ কাত্যায়ন দেবরাতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করো। সে দণ্ডনীতি নিয়ে চর্চা করছে। রাজকৃত্যের, শাসনযন্ত্রের উচ্চতর মার্গ সম্পর্কে নতুন নতুন তত্ত্ব-চিন্তা সে-ই করছে এখন। সম্ভবত পুঁথিও লিখছে।’
‘বলছেন কি আচার্য? সতীর্থের শিষ্যত্ব? সম্ভব না কি?’
আশ্চর্য হয়ে আচার্য কৃষ্ণাত্রেয় বলেছিলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় আচার্যের ক্ষেত্রে আবার পাত্ৰাপাত্র ভেদ আছে না কি? তুমি কি রাজা প্রবাহণের কথা শোননি? শোননি মহাপণ্ডিত গৌতম শেষ পর্যন্ত কীভাবে তাঁর কাছে ব্রহ্মবিদ্যা শিখতে বাধ্য হয়েছিলেন! তুমি সেই বাক্সিদ্ধ যোগীর কথা শোননি যাকে ব্যাধের কাছ থেকে ধর্ম বিষয়ে শেষ পাঠ নিতে হয়েছিল! আর শ্বেতকেতু? শ্বেতকেতু যে চণ্ডালের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি বলে তার দু পায়ের মধ্য দিয়ে গলে যেতে বাধ্য হয়েছিল! সতীর্থ তো ভালো দর্ভসেন, অহংকার বর্জন করতে না পারলে কী করে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে? অবশ্য সবটাই তোমার অভিরুচি। আমি জোর করছি না।’
দর্ভসেন নিজগৃহে ফিরে এসেছিলেন, দণ্ডনীতি বিষয়ে এত দিনের যা জানা, যা গতানুগতিক সেই পর্যন্ত শিক্ষা করে। একেবারে মহাজনাশ্রিত মহাজন পদলাঞ্ছিত রাজনীতির সোজা পথ ধরে চলেন তিনি। এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে, চণক আরও কিছু জানে। আরও কিছু বোধ হয় শিখেছে পিতার কাছ থেকে। সোজাসুজি মগধ সভায় দৌত্য করতে না এসে সে প্রথমে অজ্ঞাতবাস করে গোপনে সমগ্র পূর্বদেশের সংবাদ নিল। প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সম্পর্কে কত তথ্য এখন তার নখদর্পণে। প্রথমে এটাকে অর্বাচীনের অল্পদর্শিতা ভেবেছিলেন তিনি। এখন তাঁর মনে হচ্ছে এর মধ্যে উচ্চতর বুদ্ধির ইঙ্গিত আছে। সত্যিই আছে। এই যে চণক এখুনি গান্ধার ফিরছে না, এর মধ্যেও কোনও কূট উদ্দেশ্য আছে তার। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক এই চণক। অল্প দিনেই দেব পুষ্করসারীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে, এখানে এসে মগধরাজেরও বিশেষ স্নেহ পেল। তিনি গোপনে একটি সংকল্প করলেন।
রাজগৃহ-গিরিব্রজে ভোর হচ্ছে। শেষ রাতে সামান্য নিদ্রার পর আবার সূর্যোদয়ের মুহূর্তেই গাত্রোত্থান করেছেন দর্ভসেন। দাসদাসীরা তাঁর প্রসাধন সম্পূর্ণ করে দিয়েছে। প্রাতরাশে বসেছেন, সামনে চিত্রফলকের ওপর বহুবিধ ফল, যবাগু, অপূপ এবং দুধ রয়েছে। চণককে সঙ্গে করে সম্পতি প্রবেশ করল। দু’জনকেই দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমোয়নি। চোখ ঈষৎ আরক্ত কিন্তু স্নাত এবং নববস্ত্র পরিহিত। দাসীরা তাদের প্রাতরাশ এনে রাখলে চোখের ইঙ্গিতে দাসীদের কক্ষ ত্যাগ করে যেতে বললেন দর্ভসেন।
চণক তাঁকে প্রণিপাত করে বলল, ‘গতরাত্রের জন্য ক্ষমা চাইছি মহামাত্র।’
বলছে বটে, কিন্তু চণকের চোখের অভিব্যক্তি এখনও কঠিন, ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ। মনে মনে হাসলেন দর্ভসেন, ভাবলেন যতই উচ্চমার্গে যাতায়াত করো হে চণক, দর্ভসেনের কাছে এখনও তুমি বালকই। কূটনীতির কিছুই জানে না। মুখে বললেন, ‘তোমার যেমন সৎ শিক্ষা সেই অনুযায়ীই তুমি ক্ষমা চাইছ চণক। ভালোই করেছ, না হলে জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কনিষ্ঠদের সম্পর্কটি ভগ্নসেতুর মতো হয়ে যায়, তার ওপর দিয়ে আর কোনও আলোচনা, পারস্পরিক জ্ঞান-বুদ্ধির যাতায়াতই সম্ভব হয় না। তবে আমারও ত্রুটি হয়েছে বৎস চণক। বয়োবৃদ্ধ বলেই আমার সব সময়ে স্মরণে থাকে না এখন, রাজকার্যে আমরা প্রায় সমগোত্রীয়। তুমিও আমাকে মার্জনা করো যুবক। নিজেই বলছ আমি তোমার পিতৃব্যসম। পিতৃব্যের তো তিরস্কারেরও অধিকার থাকে! সেই ভেবেই…’
চণকের চোখের ভাব কোমল হয়ে এলো, সে বলল, ‘মহামাত্র জানি না আবার কতদিনে মাতৃভূমিতে ফিরব। এ কথা সত্য সেখানে আমার পিতামাতা কেউ জীবিত নেই, জ্যেষ্ঠা ভগ্নীদ্বয় বিবাহিত, স্বামীগৃহে সুখে কালাতিপাত করছে। আমার পিছুটান নেই। কিন্তু মাতৃভূমি! মাতৃভূমির গভীর টান আমার রক্তের মধ্যে আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। আপনাকে সম্পাতিকে এবং বাহিনীর লোকজনকে এখন আমার অত্যন্ত আপনজন মনে হচ্ছে, হৃদয় মথিত হচ্ছে গতরাত্রের মনান্তরের জন্য।’
দর্ভসেন স্নেহের হাসি হেসে বললেন, ‘তা তো হবেই চণক। হতেই পারে। কিন্তু তুমিই বা এমন ধনুকভাঙা পণ করেছ কেন যে গান্ধারে ফিরবে না! এই দৌত্যে সাফল্যের পর আরও বড় পদ তোমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করে আছে, অন্তত আমি তো মহারাজের কাছে সেই মর্মেই প্রার্থনা জানাব, স্থির করেছি।’
চণক বলল, ‘না আর্য। আমি এখন মগধেই থাকবো মনস্থ করেছি। মগধ, কোশল, বৈশালী…তারপর অঙ্গ..’
দর্ভসেন খুব সরলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মগধরাজ কি তোমাকে কোনও উচ্চপদ দিতে চেয়েছেন চণক।’
চণক একবার তাঁর দিকে চাইল, তারপর বলল, ‘না। তবে তিনি আমার সংকল্পের কথা শুনেছেন। তাঁর সম্মতি আছে।’
‘তুমি কিসের আশায় এই হতভাগা দেশে বাস করতে চাইছ, চণক? দর্ভসেন জোরের সঙ্গে বললেন, ‘অসংস্কৃত মূর্খ, এদের জাতজন্মের কোনও ঠিকানা নেই। অনার্যদের সঙ্গে যথেচ্ছ বৈবাহিক সম্পর্ক করে করে সব তাম্রবর্ণ, খর্বাকার। সম্মান প্রদর্শন করতে জানে না। কী ভাষা! আহা! লঠঠিবন, বেলুবন, বচ্চ, বচ্চ, সেট্ঠি, সেট্ঠি শুনতে শুনতে কান আমার বধির হবার উপক্রম হয়েছে।’
চণক বলল, ‘কিন্তু এই-ই তো প্রজাবর্গের ভাষা মহামাত্র! আমাদের গান্ধারেও তো পথে-ঘাটে লোকে এই ভাষাতেই কথা বলে, সামান্য পার্থক্য আছে, কিন্তু এই প্রকারই তো মোটের ওপর।’
‘তারা বলুক। কিন্তু তাই বলে রাজা, অমাত্য, আচার্য, কবি সবাই এই অপভ্রংশ ভাষায় কথা কইবে? ছিঃ! পবিত্র দেবভাষার কী শ্ৰীই হয়েছে! তার ওপর এরা কীভাবে মানুষের শারীরিক ত্রুটি নিয়ে নামকরণ করে দেখেছ? আমাদের স্নানের জল যে আনে, সেই দাসটিকে এরা বলে দন্তুল ভদ্দক, তার দাঁতগুলি বড় বড় বলে। আর যে প্রকোষ্ঠগুলি পরিষ্কার করে তার নাম খুজ্জ মহীপাল, সে কুব্জ বলে। আর শুধু দাসদাসী বা সাধারণ লোকের ব্যাপারেই নয়, নিজেদের রাজকুমারকেই তো এরা কুনিয় বলে উল্লেখ করে, কুনিক আর কি! কোন্ হাতে না আঙুলে কী একটা ত্রুটি আছে না কি! একটি শ্রেষ্ঠীকে কালকর্ণী বলে উল্লেখ করে। কালকন্নি কালকনি করে বুঝতে পারি না, তার পরে সন্ধান করে আমাদের অনুচরদের থেকে জানলাম— ওর সঙ্গে বাণিজ্য করতে গিয়ে নাকি অনেকের বিপদ হয়েছে, তাই সকালে কেউ ওর মুখ দেখে না, আসল নাম শ্রীধর। এখন সে নাম সবাই ভুলে গেছে। বৃদ্ধ মানুষটি কালকন্নি বলেই পরিচিত। ছিঃ!’
চণক কৌতুকভরা মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, এদেশের লোকেরা ভারি খোলামেলা স্বভাবের, সেটা সত্য।’
দর্ভসেন বললেন, এটা খোলামেলা স্বভাবের চিহ্ন হল! আর এরূপ হবে না-ই বা কেন? এরা তো খোলাখুলি দাসদের, শূদ্রদের বিবাহ করছে, দাস রাজন্যদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও। রাজা স্বয়ং তো বোধ হয় নাগবংশীয় কোনও…’ অসঙ্গত হয়ে যাচ্ছে ভেবে দর্ভসেন থেমে গেলেন। শত হোক, চণক এখন মগধরাজের রীতিমতো মিত্র। কী থেকে কী হয়ে যায়!
চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘মহামাত্র যা যা বললেন সবই সত্য। কিন্তু তিনি সেগুলি যেভাবে দেখছেন, আমি সেভাবে দেখছি না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য মৌলিক ও অনমনীয়। তর্ক করে লাভ নেই, তাই এই আলোচনা আমি বিলম্বিত করতে চাই না। শুধু এটুকু বলে ক্ষান্ত হচ্ছি যা আপনার কাছে শুধু দোষ বলে প্রতিভাত হচ্ছে, আমার কাছে তা খুবই কৌতূহলজনক বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়। এই রাজগৃহ নগর তিন দিক থেকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা সুরক্ষিত স্বাভাবিক দুর্গনগরী। এমনটা আর সমগ্র উদীচী প্রাচীতে কোথাও নেই। এর চতুর্দিকে বিস্তৃত সমতলভূমি, কোথাও বন্ধুর পার্বত্যভূমি, দক্ষিণে ঘন অরণ্য, উত্তরে খুব কাছেই নিত্যপ্রবাহিণী গঙ্গা। এই মগধ আমার কাছে যথার্থ চক্রবর্তী-ক্ষেত্র বলে প্রতিভাত হচ্ছে।’
‘চক্রবর্তী-ক্ষেত্র!’ দর্ভসেন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
‘তুমি কি স্বপ্ন দেখছ চণক? চণকের আহার শেষ হয়েছিল, সে মধুমিশ্রিত দুগ্ধ এক পাত্র এক নিশ্বাসে পান করে উঠবার অনুমতি চাইল। তার মুখ স্মিত, চোখের দৃষ্টি যেন এখানে নেই। শুধু দৃষ্টির ওপর ভর করেই সে যেন অন্য কোথাও চলে গেছে।
‘তুমি কি মনে করো শ্রেণীক বিম্বিসার যাকে এরা সেনিয় বলে সে চক্রবর্তী রাজা হবে, আর তাই তুমি মগধ রাজসভার আশ্রয় নিচ্ছ গান্ধার ছেড়ে?’ বিস্ময়ে যেন কূল পাচ্ছেন না দর্ভসেন।
চণক বলল, ‘হবেন কিনা জানি না, মহামাত্র। তবে হবার কতকগুলি আয়োজন প্রকৃতি করে রেখেছে। মনে রাখবেন তিনিই প্রথম রাজা যিনি নিজস্ব বেতনভুক সৈন্যবাহিনী রাখবার কথা চিন্তা করেছিলেন। আপনিই তো বললেন তিনি শ্রেণীক। সম্ভাবনা আছে। এই চক্রবর্তী-ক্ষেত্রকে ঠিকমতো বুঝলে, ব্যবহার করতে পারলে হবেন, না হলে হবেন না। তবে আমি মগধ রাজসভার আশ্রয় নিয়েছি এ ধারণা আপনার ভুল, সর্বৈব ভুল। আপনারা চলে গেলেই কিছু দিনের মধ্যেই আমি পূর্বদেশে যাত্রা করব! প্রকৃতপক্ষে ওই পূর্বদেশ, পূর্বাচলই আমাকে ক্রমাগত টানছে।’
চণক নত হয়ে নমস্কার জানিয়ে সম্পাতি ও দর্ভসেনের কাছ থেকে বিদায় নিল। মৃদুস্বরে বলল, মহামাত্র, সম্পাতি, জীবনে হয়ত আর কোনও দিন দেখা না-ও হতে পারে। আশীর্বাদ করুন আমি যেন জম্বুদ্বীপের সীমান্ত দেখতে পাই। পুবে, দক্ষিণে সব মহারণ্য, দুর্গম পর্বতশ্রেণী পার হতে পারি।’ সম্পতিকে আলিঙ্গন করে চণক আর কোন দিকে না তাকিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ তার গমনপথের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলেন দর্ভসেন। শেষে বললেন, ‘জম্বুদ্বীপের সীমানা? মহারণ্য? চক্রবর্তী-ক্ষেত্র? সম্পাতি, যুবকটি কি পাগল হয়ে গেল?’
১২
রাজগৃহে ঢুকে আনুমানিক এক ক্রোশের মতো দূরে গৃধ্রকূট। উত্তর-পূর্বে বৈপুল্ল এসে মিশেছে শৈলগিরিতে। তারই একটি শিখর— এই গৃধ্রকূট। অন্যান্য পাহাড়গুলি যেমন নানা পন্থের শ্রমণ ও সন্ন্যাসীতে একেবারে পূর্ণ, এটি ততটা নয়। নির্জন, রুক্ষ ভূমির ওপর কর্কশ পাহাড়, গাছপালা অল্প। কে যেন তার শিরে একটি বিশাল গৃধ্র-গ্রীবা মস্তক ও চক্ষু সমেত বসিয়ে দিয়েছে। বাঁ দিকে চক্ষু ন্যস্ত করে আছে। দেখলে আশ্চর্য লাগে। চণক তাঁর গাঢ় তাম্রবর্ণ অশ্বটিকে পাহাড়ের মূলে একটি শাল্মলী গাছের সঙ্গে বাঁধল। অশ্বটির গলার কাছটা, পুচ্ছের চারপাশে কিছুটা অংশ উজ্জ্বল শ্বেত। রাজ অতিথিশালার মন্দুরা থেকে এই অশ্বটিকেই সে বেছে নিয়েছে। অশ্বটি কয়েক দিনেই তাকে বেশ চিনে গেছে। সে নামতেই গ্রীবাটি এগিয়ে দিল। আদর চায়। তাঁর কেশরের ওপর দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে চণক রজ্জু আলগা করে দিল। যতটা সম্ভব চরুক অশ্বটি।
পাহাড়ে চড়বার জন্য প্রকৃতি-নির্মিত কয়েকটি স্বাভাবিক সোপান আছে। সমান দূরত্বে নয়। এক পঙ্ক্তিতেও নয়। কিন্তু অনায়াসে পা রেখে রেখে ওপরে চড়া যায়। পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়েই চণকের প্রথম কাজ হল একবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করা। এইভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে তার ভেতরটা একটা ব্যাখ্যাতীত হর্ষ এবং প্রশান্তি, বিস্ময় এবং আত্মপ্রত্যয়ে ভরে যায়। এখান থেকে এই রাজগৃহ নগর প্রায় পুরোটা চিত্রের মতো দেখা যায়। এই শিখরের চেয়েও অনেক উঁচু কিছু যদি থাকত! তাহলে আরও দেখা যেত, দেখা যেত উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গার ধারা কীভাবে পূর্ব-দক্ষিণ গামিনী হয়েছে। গঙ্গার অপর পারে লিচ্ছবি বজ্জিদের স্বর্গশ্রীমণ্ডিত বৈশালী নগরী। দেখা যেত অচিরবতী আর সরযূ, অচিরবতীর উত্তরে শ্রাবস্তী, সরযূর দক্ষিণে সাকেত। এবং দেখা যেত সুদীর্ঘ উত্তরের বাণিজ্যপথটি কীভাবে গতিশীল নদীস্রোতের মতই মগধ থেকে গান্ধারের দিকে চলেছে। কিন্তু অত্যুচ্চ শিখর হলেও কি এসব দেখা যাবে? দৃষ্টির একটা সীমা আছে। সে সীমা তো মানুষের দৃষ্টি অতিক্রম করতে পারে না! দৃষ্টিশক্তির সহায়ক যদি কিছু থাকত! যাতে দূরের জিনিস দ্বিগুণিত, চতুর্গুণিত হয়ে অনেক কাছে চলে আসে। তক্ষশিলায় যারা সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রাদির বিষয়ে চর্চা করে থাকেন, সেই নক্ষত্র-দর্শকরা এই সহায়ক যন্ত্রের অভাবের কথা প্রায়ই বলে থাকেন। এখন জ্যোতির্বিদরা শুধু জানেন গ্রহ ও নক্ষত্র দুই জাতীয় জ্যোতিষ্ক আছে। আরও ভালোভাবে দেখতে পেলে এদের পার্থক্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে। হয়ত দেখা যাবে আরও অনেক প্রকার জ্যোতিষ্ক আছে। অভিজিৎ নক্ষত্রের সাহায্যে চন্দ্রের পর্যায়-কাল এখন আরও সঠিকভাবে চিহ্নিত হচ্ছে। চান্দ্রমাস থেকে সৌরমাসে বৎসর গণনার রীতি অনুসরণ করেও জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেভাবে খগোল পর্যবেক্ষণ করলে হয়ত আরও নক্ষত্র, আরও গ্রহ আবিষ্কৃত হবে। আবিষ্কৃত হবে অন্তরীক্ষ সম্পর্কে আরও অনেক নতুন তথ্য। ওপরে আকাশ, নীচে পৃথিবী। পাখিরা যেভাবে দেখতে পায় সেভাবে একটি চিত্রের মতো যদি এই পৃথিবীকে দেখা যেত! খালি চোখে এই পর্বতশীর্ষ থেকে যেভাবে দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, অরণ্য এবং জল অর্থাৎ নদ, নদী, হ্রদ, পুষ্করিণী ইত্যাদি, এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক স্থান জুড়ে আছে। ভূ-মণ্ডলের অধিকাংশই হল তার ওপর সমভূমি, কিছু অংশ উচ্চাবচ, বন্ধুর এবং কিছু অংশ উচ্চ, পর্বতসঙ্কুল।
শাস্ত্রে সপ্তদ্বীপের কথা বলা হয়। জম্বু, প্লক্ষ, শাল্মলী, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক ও পুষ্কর। আবার কেউ কেউ বলেন ও সব প্রাচীন ধারণা। আসলে দ্বীপ চারটি। এই চতুর্মহাদ্বীপের নাম উত্তরকুরু, পূর্ব বিদেশ, অপর গোদান ও জম্বু। এরা যথাক্রমে মহামেরুর উত্তরে, পূর্বে, পশ্চিমে ও দক্ষিণে বিন্যস্ত। জম্বুদ্বীপ আকৃতিতে ত্রিকোণ। দুটি মতের মধ্যেই জম্বুদ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। বালক বয়সে ভৃগুকচ্ছের পট্টনে গিয়ে নীলবর্ণ মহাবারিধি দেখে এসেছে সে। তার পিতা আচার্য দেবরাত বলতেন, ‘এই এক সীমা দেখলে স্ব-ভূমির। এবার চলে যাও হিমবন্তের কোলে। সেখানে যোজনের পর যোজন গহন অরণ্য এবং তুষারমৌলি পর্বতশ্রেণী। এক জীবনে সেই দুর্গম সুন্দর প্রদেশ দেখে ফুরিয়ে শেষ করতে পারবে না। তবে বহু সন্ন্যাসী থাকেন সে অঞ্চলে, মাঝে মাঝে লবণ ও অম্ল খেতে নেমে আসেন জনপদে। তখন তাঁদের কাছ থেকে হিমবন্ত প্রদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিতে পারবে। পায়ের নীচে মাটি আর মাথার ওপর আকাশ— এই দুই সম্পর্কে যতই জানবে ততই বোঝা যাবে জীব, জীবন, মৃত্যু কী, কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে গ্রথিত।
এইধরনের লবণাম্লসন্ধানী প্রব্রাজক দেখলেই গৃহে নিয়ে আসতেন তিনি। সাদরে ভোজন করাতেন। যতদিন ওঁরা থাকতেন ততদিন নিজেদের উদ্যানে একটি পর্ণশালা নির্মাণ করিয়ে সেখানেই তাঁকে থাকতে অনুরোধ করতেন। যতদিন পিতা বেঁচেছিলেন পর্ণশালাটি নিয়মিত সংস্কার করানো হত। সন্ন্যাসী আসুন বা না আসুন। এঁদেরই একজন তাকে চিত্রকূট পর্বতের কথা বলেছিলেন। সেখানে কাঞ্চনবর্ণ গুহা আছে। অসংখ্য নানা বর্ণের হংস অধ্যুষিত সেখানকার জলাশয়। তৃণহংস, পাণ্ডুহংস, মনঃশিলাহংস, শ্বেতহংস, পাকহংস—এমন বহু প্রকার। এঁর কাছেই বিশালকায় স্বর্ণবর্ণ ধৃতরাষ্ট্র হংসের কথা শোনে সে। এদের গলদেশ বেষ্টন করে নাকি তিনটি রক্তবর্ণ রেখা থাকে। তিনটি রেখা সেখান থেকে অধোদিকে নেমে গেছে। তিনটি রেখা পিঠের ওপর দিয়ে চলে গেছে।
আর একজন বলেছিলেন তিনি যে অঞ্চলে বাস করেন সেখানে একের পর এক সাতটি পর্বতমালা আছে। বাইরে থেকে ধরলে এদের প্রথমটির নাম ক্ষুদ্রকৃষ্ণ, তারপর মহাকৃষ্ণ, তৃতীয়টির নাম উদক, চতুর্থটির নাম চন্দ্রপার্শ্ব, পঞ্চমটি সূর্যপার্শ্ব, ষষ্ঠটি মণিপার্শ্ব এবং সপ্তমটির নাম সুবর্ণপার্শ্ব। বহু বিচিত্র গুহা আছে সেখানে। মাঝখানে অগভীর সরোবর। জলের শেষ সীমা পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানাপ্রকার গুল্ম, উৎকৃষ্ট মাস ও মুদ্গের বন, বন্য অলাবু, কুষ্মাণ্ড প্রভৃতিও পাওয়া যায়। পুষ্পের শোভা দেখলে না কি স্নানাহারের কথা ভুলে যেতে হয়। ফলাদির মধ্যে আছে ইক্ষুর বন। গজদন্তপ্রমাণ ফলবিশিষ্ট কদলীবন, পনসবন এবং সর্বশেষে নানা জাতির তরুলতাসমাকীর্ণ মহারণ্য। এমন একটি বটবৃক্ষ আছে নাকি, যেটিকে একটি ছোটখাটো পাহাড় বললে অত্যুক্তি হয় না। বহির্ভাগে বিস্তৃত বেণুবন।
অতি দুর্গম হিমবন্ত প্রদেশ। সেখানে যান একমাত্র এই সংসার- বিরক্ত প্রব্রাজকরা। যখন লোকালয়ে আসেন, তাঁদের দেহ জীর্ণ, শীর্ণ, কালিবর্ণ, জটা, শ্মশ্রু ইত্যাদিতে মুখের আকৃতি বোঝা যায় না। তপস্যাই এঁদের উদ্দেশ্য। ঘুরে ঘুরে কোথায় কী আছে দেখবার আগ্রহ নেই। কাজেই এঁদের কাছ থেকে খুব অল্প এবং সীমাবদ্ধ তথ্য পাওয়া যায়। ওই মহারণ্য পার হয়ে, পর্বতসানু পার হয়ে আরও উঁচুতে তুষারক্ষেত্র আছে। সেই তুষারক্ষেত্র বেয়ে ওপরে উঠলে কোথায় তার শেষ? তার ওপারে কী? এসব জানা যায় না। মানুষ যায় না ওসব দিকে।
চণক দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি ফেরালো। সেদিকে ওই মহাবন। ক্রমে ক্রমে পশ্চিম প্রান্তে বিন্ধ্যাটবীর সঙ্গে মিশবে এই বন। এখানে যে মানুষ থাকে তা চণক নিজের চোখেই দেখে এসেছে। যে আটবিকদের সঙ্গে এর আলাপ হয়েছিল তারা বলত আরও অনেক মানুষ আছে ওই মহাবনের বিভিন্ন স্থানে। এই দক্ষিণ-পূর্ব দেশই হল তার গন্তব্য। উত্তর সীমা, উত্তর-পশ্চিম সীমা মোটামুটি জানা আছে। দক্ষিণ এবং সমগ্র পূর্বাঞ্চল তাকে দেখতে হবে। সে এখন শুধু পথ সম্পর্কে চিন্তা করছে। কোনও সার্থর সঙ্গে যাবে, না একলা একলা ভ্রমণ করবে? ক’দিনই সে রাজগৃহ এবং সন্নিহিত অঞ্চলের একটি রেখাচিত্র আঁকবার চেষ্টা করছে। খানিকটা নিজের চোখে দেখা, খানিকটা লোকমুখে শোনা তথ্যর ওপর নির্ভর করে একটি রেখাচিত্র। যতই এগোবে এই রেখাচিত্রটিতে সে আরও সংযোজন করবে। গ্রহ-নক্ষত্রাদি, সূর্য, বিশেষত ধ্রুবতারা হবে তার নিয়ামক।
এই সময়ে চণক দেখল একটি মুণ্ডিত-মস্তক শ্রমণ তার দিকে আসছেন। গৈরিক সংঘাটিতে তাঁর শরীর ভালভাবে ঢাকা। ডান হাতটি দুলছে। শ্রমণ গৌরবর্ণ হলেও, সম্ভবত রোদে রোদে ঘোরার জন্য ঈষৎ মলিনত্বক হয়ে গেছেন। চোখ দুটির দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। চণকের ওপর তাঁর দৃষ্টি নেই। মুখ প্রশান্ত। চণক কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সসম্ভ্রমে বলল, ‘নমস্কার ভদন্ত’। চণকের দিকে তাকালেন শ্ৰমণ। স্মিত মুখ। ক্ষণপূর্বের দূরত্ব যেন আর নেই। যেন বহু যোজন দূরে কিছু দেখছিলেন, চণকের ডাকে এইমাত্র তাকে দেখতে পেলেন। হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। চণক বলল, ‘অপরাহ্ণ সমাগত, আপনি কি এখন নামবেন? আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’
‘সাহায্য লাগবে না ভদ্র, তা ছাড়া আমি এখন নামবও না।’
চণক বলল, ‘আপনি কি এখানে আজই এলেন? আমি নিত্যই প্রায় আসি। আপনাকে দেখিনি তো!’
‘আমি কিছুদিন এখানেই বাস করছি ভদ্র। নির্জনে।’
‘কোথায়?’
‘দূরে আঙুল দেখিয়ে শ্রমণ বললেন, ‘ওই দিকে একটি চত্তালের মতো প্রস্তরখণ্ড আছে, মাথার ওপরে আর একটি প্রস্তরখণ্ড। ওইখানে।’
‘বৃষ্টি হলে?’
‘প্রস্তরখণ্ডটি আমাকে মোটামুটি রক্ষা করে।’
‘অশন?’
‘সকালে ভিক্ষার্থে বেরোই নগরপ্রান্তে।’
‘আপনি কি রাজগৃহেই রয়েছেন?’
ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সায় দিলেন শ্রমণ। তারপর বললেন, ‘ইসিপতনে ছিলাম।’
চণক বলল, ‘এই গিরিচূড়া বড় সুন্দর। নির্জন ধ্যানের পক্ষে খুবই প্রশস্ত। তা ছাড়াও এখান থেকে রাজগৃহ নগর চিত্রের মতো দেখা যায়।’
শ্ৰমণ মৃদুস্বরে বললেন, ‘আপনি গয়াশিরে গিয়েছেন ভদ্র? অনেকে বলে ব্রহ্মযোনি।’
‘না তো? কোন দিকে?’
‘এখান থেকে দক্ষিণ দিকে। ব্রহ্মযোনির শিখর থেকে মগধ রাজ্য বহু দূর পর্যন্ত চিত্রের মতো দেখা যায়।’
চণক কিছু বলতে যাচ্ছিল। শ্রমণ হঠাৎ অধরে আঙুল রেখে পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন চণক দেখল পশ্চিমাকাশ যেন রক্ত বমন করছে। দূরে নীল বনানীরেখা। সহসা যেন মনে হয় বনে আগুন লেগে গেছে। চণক চমৎকৃত হয়ে বলল, ‘ভদন্ত, আপনি কেন এখানে অপেক্ষা করছিলেন বুঝতে পেরেছি। এই স্থান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য কী অপূর্ব! ঠিক যেন বনে বনে দাবাগ্নি জ্বলছে!’
শ্ৰমণ পশ্চিমাকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে যেন এক অতলস্পর্শী অভিনিবেশের মধ্য থেকে বলতে লাগলেন, ‘সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ওই হুতাশন! দেখ দেখ আদিত্য কেমন আদীপ্ত। সমগ্র দৃশ্যমান জগতে অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই সকল সমিধ পেয়ে পঞ্চেন্দ্রিয় জ্বলে উঠছে। বাসনাগ্নি, ক্রোধাগ্নি, কামাগ্নি, লোভাগ্নি, মোহাগ্নি। চক্ষু আদীপ্ত, শ্রোত্র আদীপ্ত, জিহ্বা আদীপ্ত, রসাদি আদীপ্ত, মনঃ সংস্পর্শ ও মনঃসংস্পর্শজনিত যে বোধ তা-ও আদীপ্ত। আর সেই দীপ্ত অনল থেকে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে মৃত্যু, রোগ, শোক, নৈরাশ্য।’ শেষের শব্দগুলি শ্রমণ বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন, ‘মৃত্যু, রোগ, শোক, নৈরাশ্য…’
সহসা একখণ্ড মেঘের আড়ালে চলে গেল অস্তসূর্য। মেঘের চারপাশ দিয়ে বিকীর্ণ হয়ে পড়ছে তার ছটা। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে ভস্ম উদ্গীরণ করতে লাগল। জমে উঠছে চারদিকে ভস্মের স্তূপ।
‘ওই অনলজ্বালা দেখে সংযত হও, প্রতি ইন্দ্রিয়ে নির্বেদ জাত হোক, সন্ধ্যাকাশের মতো বৈরাগ্য বরণ করো হে জ্ঞানী, হে সংযমী, ছিন্নমূল করো বাসনাকে। জন্মভয়, জরাভয়, ব্যাধিভয়, মৃত্যুভয় সমস্ত পার হয়ে বিমুক্ত হও, বিমুক্ত হও। শাশ্বত আনন্দ উপভোগ করো।’ শ্ৰমণ বলতে লাগলেন।
কাকে বলছেন? কখনও তিনি নিজেকেই বলছেন, কখনও মনে হচ্ছে চণককে শোনাচ্ছেন। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে আসছে। এবার নামতে হবে। আকাশের পটভূমি পেছনে নিয়ে একটি তমালতরুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন শ্রমণ। চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘ভদন্ত, আপনার কণ্ঠস্বর মধুর, আবৃত্তি গম্ভীর, যে সূক্তটি আপনি বললেন তা-ও মহৎ কবিতা। আপনি কি ওটি আমাকে শোনালেন?’
অন্ধকারে শ্রমণের কোনও ভাবান্তর হল কি না চণক বুঝতে পারল না। তিনি যেন ঘুম ভেঙে উঠে বললেন, ‘আদিত্তপরিয়ায় সুত্ত। ব্রহ্মযোনি পর্বতশিরে তিনি উপবিষ্ট আছেন। তাঁকে ঘিরে আমরা। রাজগৃহের অধিত্যকা সামনে বিস্তৃত। সহসা সামনের পাহাড়ে দাবানল দৃষ্ট হল। তখন তিনি আমাদের এই দেশনা করেছিলেন। ভদ্র, আজ দাবানল নেই, কিন্তু অস্তাচলের আকাশ অমনই আগুন-ঝরা। আপনি দাবাগ্নির কথা বললেন, তাই ভগবানের মুখনিঃসৃত সেই অদ্ভুত সর্বদর্শী, মর্মস্পর্শী বাণী এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল!’
‘কার বাণীর কথা বলছেন শ্রমণ?’
‘ভগবান তথাগতর।’
‘আপনার নাম কী ভদন্ত?’
‘আমি ভিক্ষু অস্সজি। আদিত্তপরিয়ায় সুত্তাংশটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তা হলে ভগবান বুদ্ধ তথাগতর ধর্মদেশনা শুনতে বেলুবনে যাবেন ভদ্র। সেই মহাশ্রমণ আপনার সর্বসংশয় ছিন্ন করবেন।’
চণক ধীরে ধীরে নামতে লাগল। সহসা আকাশে ঝাঁক ঝাঁক তারা বেরিয়ে এলো। সোপানগুলির ওপর মৃদু আলো পড়েছে। কোণগুলি যেন সেই জন্যেই দ্বিগুণ অন্ধকার। খানিকটা নেমে এসে একবার মুখ তুলে দেখল, শ্ৰমণ ঠিক সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আত্মমগ্ন, বিশ্বচরাচরের অস্তিত্ব যেন ভুলে গেছেন। হয়ত এখনও মনে মনে উচ্চারণ করছেন, ‘ওই দেখো, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে হুতাশন জ্বলছে….’
অন্ধকারের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে আছে তার অশ্ব। গ্রীবা ও পেছনের শ্বেত অংশগুলি ফুটে আছে। ‘চিত্তক!’ সে মৃদুস্বরে ডাকল, স্পর্শ করল অশ্বের মাথা পিঠ। হ্রেষাধ্বনি করে উঠল চিত্তক। এক লাফে তার পিঠে চড়ে নগর অভিমুখে চলল চণক। কিন্তু ধীরে। অতি মন্দ্র গতি। সে কোথায় যাচ্ছে যেন জানে না। অনেকক্ষণ পরে একটি চৌমাথায় এসে অনেকগুলি দীপস্তম্ভ দেখে তার চৈতন্য ফিরল। সে একটি চেনা পথের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। নগর যেন আজ অস্বাভাবিক শান্ত। সান্ধ্য উদ্দীপনা নেই। বিপণিগুলি অর্ধেক বন্ধ। গৃহে গৃহে মঙ্গলকলস। দুয়ারের মাথায় মাল্য ঝুলছে। কিন্তু গৃহদীপ যেন তেমন ভালো করে জ্বলছে না। সহস্র সহস্র চক্ষু মেলে আকাশ চেয়ে দেখছে নগরকে। যেন কিছু বলছে। বলতে চাইছে। নগরী অভিমানিনী রমণীর মতো মুখ ফিরিয়ে রয়েছে, শুনেও শুনছে না।
সে ধীরে ধীরে শ্রীমতীর গৃহে এসে দুয়ারে করাঘাত করল। দীপ হাতে একটি দাসী দরজা খুলে সরে দাঁড়াল, ‘আসুন ভদ্র।’ ঘোড়াটিকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেল একজন।
প্রাঙ্গণটি সোজা গিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে গেছে। বাঁক ফিরতেই শ্রীমণ্ডপের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাগুলি দেখা গেল। আর একটু এগিয়ে চণক দেখতে পেল বোধিকুমার এবং চারুবাক তো আছেনই। আছেন আরও অনেক অচেনা যুবা এবং প্রৌঢ়, সকলে যেন কী এক আলোচনায় মত্ত। খানিকটা নিম্ন কণ্ঠে। একটা অবিরাম গুঞ্জনধ্বনির মতো শোনাচ্ছে তাঁদের আলাপ। মাঝখানে শ্ৰীমতী, আজ তার পরনে ঘোর কৃষ্ণবর্ণের বসন, তাতে সোনার ছোট ছোট ফুল। রক্তবর্ণ উত্তরীয় দিয়ে সে অঙ্গ ঢেকে বসে আছে। বীণার দণ্ডের ওপর তার ডান হাতটি আলতো করে ফেলে রাখা, গভীর মনোযোগে সে উপস্থিত সবাইকার আলোচনা শুনছে।
চণক ধীরে ধীরে এক পাশে গিয়ে বসল। তাকে দেখে বোধিকুমার উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আরে কী সৌভাগ্য, চণক ভদ্র যে! আপনি গান্ধারে ফেরেননি এখনও!’ চণক উত্তর দিল না।
একটি অতি সুবেশ যুবক বলে উঠল, ‘এই তো আরেক জনও উপস্থিত রয়েছেন এঁরও মতামত নেওয়া যাক। আপনিই বলুন না ভদ্র, স্বয়ং মহারানিই যদি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, কাল মহারাজারও তো সে মতি হতে পারে! তারপর মহামাত্যরা, বিনিশ্চয়কতা, নগরপাল এঁরাই বা বাদ থাকেন কেন? আর কুলস্ত্রী কুলকন্যারা? তারা কি মহারানির পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না? তাহলে শেষ পর্যন্ত গৃহস্থাশ্রম থাকে কী করে?’
আর একজন বললেন, ‘রাজগৃহে তো সমনপন্থ একটা নয়। এতদিন ধরে রয়েছেন নিগ্গণ্ঠরা, রয়েছেন সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত, মক্খলি গোসাল প্রায়ই আসেন, রয়েছেন অজিত কেসকম্বলি। কই, এরকম ঘটনা তো ঘটেনি! যার ইচ্ছে হয়েছে, বিষয়বৈরাগ্য হয়েছে সে শান্তির সন্ধানে যোগ দিয়েছে এঁদের আশ্রমে। কিন্তু এ কী! দলে দলে সব অল্পবয়স্ক যুবা, কুমারী তরুণী, কুল-ইত্থি, পব্বজ্যা নিতে আরম্ভ করে দিল! সঞ্জয়ের শিষ্যগুলি তো সব সেই উপতিস্স আর কোলিতের পেছু পেছু সমন গোতমের শাসনে যোগ দিয়েছে। এসব কি ঠিক? ইনি তো দেখছি আমাদের গহে গহে বিচ্ছেদ ঘটাতে এসেছেন! সমাজে একটা ওলটপালট করে দিচ্ছেন! পতিরা পব্বজ্যা নিলে পত্নীরা তো একপ্রকার বিধবাই হবে। পুনর্বিবাহের অনুমতি দিলেও কি সবৎসা নারী আর বিবাহ করতে পারবে? আর পুত্ত? পুত্তরা যদি যায়? কে-ই বা গহধম্ম করবে, কে-ই বা গহের অগ্নিরক্ষা করবে? পুব্বপেতদের পিণ্ডদানই বা কে করবে? বলুন ভদ্দ, বলুন?’
কুলপুত্রটি উত্তেজিতভাবে চণকের দিকে চেয়ে রয়েছেন। চণক সুপ্তোত্থিতের মতো বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে? আপনি জিজ্ঞাসা করছেন?’
বোধিকুমার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘চণক ভদ্র বিদেশি, অল্পদিন হল তক্ষশিলা থেকে এসেছেন। অত কথা জানেন না। চণক, মহারানি ক্ষেমা আজ বুদ্ধশাসনে প্রবেশ করলেন। মহারাজ সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। বেলুবন উদ্যানে ভিক্ষুণীসংঘে চলে গেলেন রানি। মাথা মুড়িয়ে ফেলেছেন, অঙ্গে ত্রিচীবর, হাতে ভিক্ষাপাত্র। ভাবুন একবার!’
‘আপনি তক্ষশিলা থেকে আসছেন? বেদ-বেদাঙ্গ শিক্ষা শেষ করেছেন নিশ্চয়!’ কুলপুত্রটি খানিকটা সম্ভ্রমে, খানিকটা কৌতূহলে বলে উঠলেন।
চণক মাথা নেড়ে সায় দিল।
‘ব্রাহ্মণ?’
আবারও মাথা নাড়ল চণক।
‘আপনি হলেন গিয়ে উদীচ্য ব্রাহ্মণ। আপনিই ঠিক বুঝতে পারবেন আমাদের সমস্যাদি। সমন গোতম প্রথম রাজগৃহে আসার পর, অর্থাৎ কি না আসার সঙ্গে সঙ্গেই যে লোকে তাঁর তিসরন নিতে ছুটল এমন নয়। সঞ্জয়ের ওই দুই শিষ্য উপতিস্স্ আর মৌদগল্যায়ন কোলিত, যথেষ্ট বয়স্ক, বিদ্বান পণ্ডিত, তাঁদের গৌতম-শিষ্য অস্সজি ফট করে নিজেদের দলে টেনে নিল।’
অস্সজি নামটা শুনে উৎকর্ণ হয়েছিল চণক। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘অস্সজি কে?’
‘আরে সমন গোতমের ইসিপতনের শিষ্য। এঁদের পাঁচজনকে তো দিকে দিকে তাঁর সদ্ধর্ম প্রচার করতে পাঠিয়েছিলেন গোতম।’
‘তিনি কীভাবে বিদ্বান পণ্ডিতদের…’
‘কীভাবে আবার! ইন্দ্রজাল! এই অস্সজি যখন ভিক্ষায় বেরোন তাঁর চারদিকে মায়াজাল থাকে। দেখে অনেকেই মোহগ্রস্ত হয়। উপতিস্স্ নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কার কাছ থেকে উপদেশ পেয়ে এমন প্রশান্তি লাভ করেছেন। অমনি ভিক্ষু অস্সজি তাকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন সমন গোতমের কাছে। বাস, হয়ে গেল। অপর গুরুর শিষ্যদের এভাবে ভাঙিয়ে নেওয়া কি ঠিক?’
চণক জিজ্ঞাসা করল, ‘ত্রিশরণ কী?’
‘সমন গোতমের সদ্ধর্মের মূল মন্তর তো ওই তিসরন। বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি। ধম্মং সরণং গচ্ছামি। সংঘং সরণং গচ্ছামি—এই তিন বাক্য বলে পব্বজ্যা নিতে হয়।’
বোধিকুমার বলল, ‘কাশ্যপ ভ্রাতাদের কথাটাও একবার বলুন না ভদ্র রন্তিদেব।
রন্তিদেব নামে আর একটি কুলপুত্র বললেন, ‘সে তো আরও কলঙ্কের ব্যাপার। আপনি সম্যক বুঝবেন। উরুবেলায় তিন কাশ্যপ ভ্রাতার আশ্রম ছিল। এঁরা জটিল পন্থের। অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ। বহু শিষ্য। গৌতম এঁদেরও মোহগ্রস্ত করলেন। তিন ভাই—বেলা কাশ্যপ, নদী কাশ্যপ, গয়া কাশ্যপ অগ্নি জলে ফেলে দিয়ে সংঘে যোগ দিলেন। চিন্তা করুন! একজনও কি ভাবলেন না, কারুর অন্তত অগ্নিগৃহটি রক্ষা করা উচিত। আহবনীয় অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি এঁরা জলে ফেলে দিলেন কোন সাহসে? দেবতারা, পিতৃপুরুষরা কুপিত হবেন না?’
বোধিকুমার বলল, ‘প্রথম যখন এঁদের সবাইকে নিয়ে শ্রমণ গৌতম রাজগৃহে এলেন, তখন সবাই ভেবেছিল এঁরাই গুরু। গৌতম-আদি তাঁর শিষ্য। এমনই খ্যাতি ওই কাশ্যপদের। তো এখন তো সব জটা-টটা ফেলে দিয়ে তুবরক সেজে বসে আছেন!’
রন্তিদেব বললেন, ‘বেলট্ঠিপুত্ত তো ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। পারলে গোতমকে জ্যান্ত পোঁতেন।’
আর একজন বললেন, ‘কিন্তু এইসব গোতমপন্থীদের ভয় বলে কিছু নেই।’
‘ভয়’ কথাটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে চণকের মাথার মধ্যে কোথায় যেন একটা কপাট শব্দ করে খুলে গেল। হঠাৎ সভার আলোচনাধ্বনি চলে গেল বহু দূরে। চণক দেখতে পেল গৃধ্রর মতো বক্ৰচক্ষু এক গিরিশৃঙ্গ। নগ্ন। শস্যশ্যামল নয়। দিন শেষ হয়ে আসছে। অদূরে পশ্চিম দিকে মুখ করে তমালতরুর মতো কে একজন দাঁড়িয়ে। তরু না মানুষ? মানুষ না তরু? অস্তাচলে সূর্য অগ্নি বমন করছে : ‘সংযত হও হে জ্ঞানী, ছিন্নমূল করো বাসনাকে, জন্মভয়, ব্যাধিভয়, জরাভয়, মৃত্যুভয় সমস্ত পার হয়ে বিমুক্ত হও। বিমুক্ত হও।’ যেন তার কানের খুব কাছে মন্দ্রস্বরে কে আবৃত্তি করছে। তিনিই। সেই মানুষটিই। তাঁর কণ্ঠ মৃদু, অথচ তা সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে যাচ্ছে, ছাপিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুই সে শুনতে পাচ্ছে না। দেখতে পাচ্ছে না। ঘরের মধ্যে কুলকুমারদের গোষ্ঠী? নেই। উজ্জ্বল মণিদীপের আলোয় কৃষ্ণবসনা সুন্দরী? নেই। চণক একলা দাঁড়িয়ে আছে আদীপ্ত অগ্নিবলয়ের মাঝখানে। অদূরে এক তমালতরু মাত্র সঙ্গী।
কতক্ষণ এভাবে সে ছিল কে জানে! যখন সচেতন হল, ঘরে বোধিকুমার আর শ্রীমতী ছাড়া আর কেউ নেই। বোধিকুমারের উদ্বিগ্ন মুখ তার চোখের সামনেই। তাকে তাকাতে দেখে বোধিকুমার বলল, ‘কী হয়েছিল হঠাৎ চণক ভদ্র? আমরা তো ভিষ্ক ডাকতে পাঠালাম! সভা ভেঙে গেল। সবাই যে যার গৃহে চলে গেল, ভিষ্ক আনতে গেছে চন্দা, শ্ৰীমতীর প্রধানা দাসী।’
চণক বলল ‘কিছু তো হয়নি। আসলে আমি… অর্থাৎ আমার স্মৃতি একটি বিশেষ দৃশ্যে, না বোধ হয় দৃশ্য নয়, অনুভূতি… কিংবা তাও নয়… নাঃ আমি শুধু শুধু আপনাদের বিরক্ত করছি।’
শ্রীমতী বোধিকুমারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আপনাকে তখনই বলেছিলাম ভদ্র বোধিকুমার, এ কোনও অসুখ নয়। অসুখে মানুষ এমন মেরুদণ্ড সোজা করে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারে না। চোখের দৃষ্টি ওরূপ আবৃত হয় না। ওঁর হাতের ভঙ্গি দেখুন! আঙুলগুলি দেখুন! আমি বলছি বুদ্ধকথা শুনে উনি সোতাপন্ন হয়েছেন।’ তার কণ্ঠে গভীর সম্ভ্রমের সুর।
চণক চকিত হয়ে বলল, ‘সোতাপন্ন? স্রোতাপন্ন? সে কী ভদ্রে?’
এতক্ষণে শ্রীমতী পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি সজল। সে বলল, ‘আর্য, বুদ্ধের উপদেশবাণীর এমনই মহিমা যে সৎ ব্যক্তি শুনলেই হৃদয়ের মধ্যে কেমন সব ওলটপালট হয়ে যায়। জীবনের অসারতা সম্পর্কে জ্ঞান জন্মায়। সদ্ধর্মের অন্তরে প্রবেশের এই প্রথম দুয়ার।’
‘তুমি কোথা থেকে জানলে?’ বোধিকুমার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল।
‘আমার একটি দাস অনুচিত্ত, একদিন বেলুবনে গিয়েছিল। তথাগত বুদ্ধকে দেখে সে মুগ্ধ হয়। তারপর প্রতিদিনই সন্ধ্যায় ছুটি চাইত। একদিন সকালে চন্দা এসে সংবাদ দিল, অনুচিত্ত নিজের ঘরে ধ্যানমগ্ন হয়ে রয়েছে। আমি দেখতে গেলাম। ঠিক চণক ভদ্রের মতো। … অনুচিত্ত পব্বজ্যা নেওয়ার অনুমতি চাইল সকাতরে।’
বোধিকুমার বলল, ‘তুমি দিলে?’
‘না দিয়ে কেমন করে পারব ভদ্র?’
‘দেখো, ও হয়ত দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার জন্য একটা ভান করল।’
‘আপনি তো চণক ভদ্রর অবস্থা দেখলেন, ভান বলে মনে হল কী?’
বোধিকুমার মাথা নেড়ে বলল, ‘চণকের কথা স্বতন্ত্র। তিনি উচ্চশিক্ষিত। উচ্চ পদে নিযুক্ত। উদীচ্যবংশজাত ব্রাহ্মণ।’
‘আমার দাসটি অশিক্ষিত, নীচ পদে নিযুক্ত, নীচ কুলজাত হলেও তারও এই একই ভাব আমি দেখেছি, একদম এক। বোধি ভদ্র আপনি যদি অনুগ্রহ করে গিয়ে ভিষক্কে আসতে নিষেধ করে আসেন বড় ভাল হয়। ভিষক সন্নতি বড় ক্রোধী। অকারণে আসতে হলে ক্ষিপ্ত হবেন। পরে প্রয়োজন হলে আর তাঁকে ডেকে পাবো না।’
বোধিকুমার একবার শ্রীমতীর দিকে তাকাল। আর একবার চণকের দিকে। তার পরে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় প্রাঙ্গণের বাঁক ফিরতে ফিরতে বলে গেল, ‘আমি আর তাহলে আজকে ফিরছি না শ্ৰীমতী, তুমিই চণক ভদ্রকে গৃহে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।’
চণক চুপচাপ বসে। শ্রীমতী তার সামনে। সে-ও চুপ। কিছুক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে তার বীণাটি তুলে নিল। মুরলী নেই, মুরজ নেই, পটহ-মন্দিরা কিছুই নেই। শ্ৰীমতীর আঙুলগুলি লঘু স্পর্শে সঞ্জীবিত করে যাচ্ছে শুধু বীণার তারগুলিকে। প্রথমে সুরগুলি শুধু লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ায় শ্রীমণ্ডপের কোণে কোণে। কখনও অনুরণন মাত্র রেখে চুপ করে যায়। তার পর ক্রমশই তারা ধীর থেকে দ্রুত, মন্দ্র থেকে তীক্ষ্ণ, গম্ভীর থেকে করুণ হয়ে উঠতে লাগল। বাদিকা যেন অনেকগুলি পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এখন পথ খুঁজে পেয়েছে। বহুক্ষণ পরে একজন দাসী চন্দনকাঠের ফলকে আহার্য নিয়ে এলো। আর একজন রুপোর ভৃঙ্গারে জল। মুখ হাত ধোবার পাত্র। চণক বিনা বাক্যব্যয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিল। ফলকের ওপর রুপোর থালায় নানাপ্রকার ফল, ক্ষীরমণ্ড, দুধ। আজ পূর্ণিমা। শ্রীমতী উপোসথ পালন করে। চণকের বর্তমান অবস্থায় সে তার ফলাহারই প্রশস্ত মনে করেছে।
খাদ্যে হাত দিতে গিয়ে হঠাৎ চণক হাত গুটিয়ে নিল। ‘তোমার আহার্যও আনতে বলল ভদ্রে!’
শ্ৰীমতী একবার ইতস্তত করল। কুলস্ত্রীরা পুরুষদের পরেই খায়, নইলে পাপস্পর্শ করে সে শুনেছে। কিন্তু সে তো কুলস্ত্রী নয়। মৎস্য-মাংস থেকে মদ্যপানেও তো সে পুরুষকে সঙ্গ দিয়ে থাকে। তার ইঙ্গিতে দাসী তার জন্যও একটি থালি নিয়ে এলো। দু’জনের আহার শেষ হলে শ্ৰীমতী মুখ নিচু করে বলল, ‘শিবিকা প্রস্তুত আছে। ভদ্র এখন গৃহে ফিরে যেতে পারেন। সঙ্গে আমার দাসেরা যাবে। তাঁর অশ্বটিকেও তারা পৌঁছে দেবে।’
চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘আজ যদি শ্ৰীমতীর গৃহেই থাকি!’
‘সে কী?’ শ্রীমতী চমকে মুখ তুলে তাকাল। আজ তার উপোসথের দিন। সে বারবধূ হতে পারে তবু উপপাসথের সংযম পালন করছে আজকাল।
চণক বলল, ‘আজ চণক শ্রীমতীর কাছে প্রার্থী। সে কি ফিরে যাবে?’ তার দৃষ্টিতে এখনও স্বাভাবিকতা ফিরে আসেনি। কথাগুলি সে যেন যন্ত্রের মতো বলল।
‘ভদ্র, আপনাকে যে তথাগত বুদ্ধ স্মরণ করেছেন! শুধু বুদ্ধ-প্রসঙ্গ শুনেই যিনি সোতাপন্ন হন তিনি অতি উচ্চমার্গের মানুষ। তাঁকে বিপথগামী করলে মহাপাপ হবে আমার।’
চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘কী পথ, আর কী বিপথ আমাকে আগে নিজ চেষ্টায় জানতে হবে যে শ্ৰীমতী! তথাগত বুদ্ধ আমাকে স্মরণ করেছেন কি না জানি না, স্রোতাপন্ন হয়েছি কি না তাও জানি না। তবে শুধু বুদ্ধ-প্রসঙ্গ শুনেই আমার ভাবান্তর হয়নি। গৃধ্রকূট শিরে আজ শ্ৰমণ অস্সজির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি অপূর্ব ভঙ্গিতে আমাকে আদিত্তপরিয়ায় সুত্ত শোনালেন। ওই সুত্ত নাকি তাঁরা গয়াশিরে স্বয়ং শ্রমণ গোতমের কাছে শুনেছিলেন। তার পর থেকেই আমার ভেতরটা কেমন স্তব্ধ হয়ে আছে। কিন্তু শ্ৰমণ অস্সজির উচ্চারণের মহিমা বা তথাগতর বাণীর কাব্যসৌন্দর্য মানলেও, অস্তাচলের যে অরুণবর্ণ দীপ্ত আকাশ দেখে ওই সুত্ত শ্রমণ আমায় শোনালেন, সেই পশ্চিমাকাশের অস্তরাগকেও আমি সৌন্দর্যে কিছুমাত্র ন্যূন দেখি না। বস্তুত এই পৃথিবী, এই ভূমি, ওই আকাশ, উষাকাল, গোধূলি, সন্ধ্যারাত্রি, এই সবই আমায় প্রতিনিয়ত গভীরভাবে মুগ্ধ করছে। এগুলির কি কোনও অর্থই নেই? কোনও মূল্যই নেই?’ চণক যেন হাহাকার করে উঠল, ‘শ্রীমতী’, সে বলল, ‘আমাকে এই অনভিপ্রেত স্তব্ধতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। ওই সুত্তের মোহজাল ছিন্ন করো। ছিন্ন করো।’ দেহযন্ত্রের ভেতর থেকে যেন তার আর্তস্বর এতক্ষণে বেরিয়ে এলো।
তখন শ্রীমতী উজ্জ্বল শ্যামলবরণ একটি ছোট্ট পক্ষিশাবকের মতো উড়ে এসে চণকের বিস্তৃত বক্ষপটে আশ্রয় নিল। তার রক্তবর্ণ উত্তরীয়টি মাটিতে লুটোতে লাগল। তার বসনের সোনার কুসুমগুলি দীপালোকে চমকে চমকে উঠতে লাগল। তার প্রধানা পরিচারিকা চন্দা তাদের সুবাসিত শয়নকক্ষে নিয়ে গেল। যূথী মালিকার গন্ধে, চন্দনচূর্ণের গন্ধে ঘরটির অভ্যন্তর যেন তুষিত স্বর্গতুল্য বোধ হতে লাগল। চণক বলল, ‘শ্রীমতী তোমার বক্ষের পুষ্পস্তবক এই কি সদ্য প্রস্ফুটিত হল? তুমি কোন আকাশের পূর্ণিমা যেখানে এমন যুগল চাঁদের উদয় হয়! এই উদর, এই শ্রোণী কি রক্তমাংসের? এ যে সুখস্পর্শে ফুলের পাপড়িকেও হার মানায়! ওষ্ঠাধরে কি মধুভাণ্ড লুকিয়ে রেখেছ প্রিয়ে!’ বলে সে পরম সমাদরে শ্রীমতীকে আলিঙ্গন করে তার ওষ্ঠাধরে যেন সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়। রাত যত বাড়ে তার বিস্ময় তত তীব্র, চুম্বন তত আগ্রাসী, আলিঙ্গন ততই গাঢ় হয়ে ওঠে। সে যেন চুম্বন দিয়ে এই রমণীর সমস্ত অঙ্গ অভিষিক্ত করতে চায়। মাঝে মাঝে মুখ তুলে সে তদগত হয়ে বলে, ‘কী অপরূপ এই পৃথিবীর দিনগুলি, ওই আকাশ থেকে নামা ত্রিযামা রজনী, এই নারী! কোথা থেকে এত সৌন্দর্য তুমি পেলে নারী!’
শ্রীমতী মৃদু মধুর কণ্ঠে বলল, ‘নারী যদি সুন্দর হয়, তবে পুরুষ তুমি সুন্দরতর। কী বিস্ময় এই উন্নত শালতরুর মতো আকারে, মণিময় ফলকের মতো এই বক্ষপটে, ন্যগ্রোধকাণ্ডের মতো এই বলশালী রুক্ষ জঙঘায়। দেবতাদের এক আশ্চর্য সৃষ্টি তুমি পুরুষ। আমি কখনও শক্কদেবকে দেখিনি, দেখিনি বরুণ, অগ্নি বা ঈশানকে। কিন্তু তোমাকে দেখে যেন মনে হয় দেখেছি। দেখেছি। জেনেছি।’
যৌবনরহস্যের অনির্বচনীয় আনন্দের তরঙ্গভঙ্গে দোলায়িত হতে লাগল কাত্যায়ন চণক। এ-ও এক আদীপ্ত অগ্নিসম অনুভূতি। আদীপ্ত অঙ্গগুলি, আদীপ্ত রক্তস্রোত, আদীপ্ত হৃদয়, মস্তিষ্ক, চিন্তাস্রোত। কিন্তু হুতাশনে সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে না তো! উত্থিত হচ্ছে না তো জন্মভয়, জরাভয়, মৃত্যুভয়! বরং তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে সব। মৃত্যু এলে বুঝি মনে হবে এক দিন, অন্তত এক দিনও বড় দীপ্ত বাঁচা বেঁচেছিলাম! তার জন্য জরার মূল্য কি দেওয়া যায় না? এই আদীপ্ত প্রভাময় আনন্দের জন্য বারবার বহুবার সহস্রবার লক্ষবার তুমি দেবরাতপুত্র কাত্যায়ন চণককে জগতে পাঠিও হে ঈশ!
১৩
রাতের দ্বিতীয় যাম উত্তীর্ণ হয়েছে। স্তব্ধ নগরীর ওপর দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ অস্ত যাচ্ছে। অলৌকিক আলোয় নগরী যেন আর এ পৃথিবীর নগরী নেই। নাগরিকদের যাতায়াত নেই। পশুগুলি যে-যার বেষ্টনীতে শব্দ করছে না। নিশাচর পাখিগুলিও আজ বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন কি দক্ষিণ বনপ্রান্ত থেকে মাঝে মাঝেই যে শৃগালের কি তরক্ষুর তীক্ষ ডাক ভেসে আসে, তাও বুঝি শোনা যাচ্ছে না। বেণুবনের সৌন্দর্য এমনিতেই অপরিসীম। আজ এই পূর্ণিমা রাতে তা অলৌকিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিংশুক বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট শ্ৰমণা তা দেখছেন না। তাঁর চোখ দুটি মুদিত। তাঁর মস্তক মুণ্ডিত। পরিধানে ত্রিচীবর—অন্তর্বাসক, উত্তরাসঙ্গ (বহির্বাস), সংঘাটি বা পাঁচ হাত লম্বা চার হাত চওড়া একটি দোপাট্টা কাপড়। তা ছাড়াও ভেতরে তিনি পরে আছেন সংকচ্ছিকম বা বক্ষাচ্ছাদনী। যা সংঘের সবাইকার সাধারণ সম্পত্তি, সেই খবন পাবুরন বা পুরো শরীর ঢাকা বস্ত্রও তাঁকে একটি স্বতন্ত্র দেওয়া হয়েছে। শ্মশানে পরিত্যক্ত বস্তুস্তূপ থেকে সংগৃহীত বস্ত্রখণ্ড নিজেই সেলাই করে চীবর পরিধানই বিধেয়। কিন্তু এই শ্রমণার সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষুণীসংঘে বহুবিধ চীবরবস্ত্র এসেছে। তিনি আচাৰ্যার কাছ থেকে কোসেয্য বা রেশমী চীবর পেয়েছেন। গাঢ় গৈরিক, প্রায় রক্তবর্ণ সেই চীবরবস্ত্রের মধ্য থেকে শুধু তাঁর গলিত সোনার বর্ণের মুখমণ্ডল ফুটে রয়েছে। তাঁর আচার্যা ছিলেন স্বয়ং দেবী মহাপ্রজাবতী। মুণ্ডিত মস্তকে, গৈরিক বস্ত্রে তিনি তিনবার বিনীতভাবে প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করলেন। আচার্যা তাঁর নাম, বয়স, তিনি স্বামীর অনুমতি পেয়েছেন কি না ইত্যাদি কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। উত্তরে সন্তুষ্ট হবার পর তিনবার ত্রিশরণ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হল। তিনবার দশশীল মন্ত্র পাঠ করালেন থেরী মহাপ্রজাবতী। প্রাণিবধ করবে না, অদত্তাদান গ্রহণ করবে না, অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকবে, মিথ্যা কথা বলবে না। সুরাপান করবে না। বিকাল ভোজন করবে না। নৃত্য-গীত-বাদন থেকে বিরত থাকবে। মাল্য-গন্ধ-বিলেপন, ভূষণধারণ থেকে বিরত থাকবে, সুখশয্যা গ্রহণ করবে না। স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি গ্রহণ করবে না। সেই সঙ্গে চারটি বিষয়ে সতর্ক হবার নির্দেশ দিলেন আচার্যা। চীবর, পিণ্ডপাত অর্থাৎ ভিক্ষার অন্ন, শয়নাসন বা বাসস্থান এবং ভৈষয্য বা ঔষধ। হরীতকী এবং গোমূত্র দ্বারা প্রস্তুত ঔষধই ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের পক্ষে সেবনীয়। প্রত্যেকটি কর্ম অর্থাৎ চীবর পরবার সময়ে, ভিক্ষান্ন গ্রহণ করবার সময়ে, শয়ন-স্থান নির্বাচন করবার সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে—চীবরটি নিয়মমতো সংগ্রহ করা হয়েছে তো? এই ভিক্ষান্নে লোভকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি তো? ভোজন শুধু শরীররক্ষার জন্য। শয়নস্থান নির্বাচনেও বিবেক ও নির্বেদের পরিচয় দিতে হবে। সবই শুনে গেছেন, বলে গেছেন শ্রমণা। কিন্তু স্বয়ং দেবী মহাপ্রজাবতী যখন প্রসন্ন পূর্ণচন্দ্রের মতো স্মিত মুখে তাঁকে ‘এহি ভিক্ষুণী’, বলে আহ্বান করলেন তখন থেকেই শ্ৰমণা ধ্যানস্তিমিত হয়ে রয়েছেন। এই ধ্যান কিন্তু ঠিক ঊর্ধ্বলোকে, কোনও উচ্চ অনুভূতিতে হারিয়ে যাওয়া নয়। শ্ৰমণা চিত্তের গহনে স্থির হয়ে জানবার চেষ্টা করছেন সুখ কী? দুঃখের কী স্বরূপ? জরা কেন? কী ও কেন? মনে মনে নিজেই সহস্র প্রশ্ন করছেন, সহস্রবার উত্তর দিচ্ছেন নিজেই। কর্মফল ভোগ করবার জন্যই তো মানুষ জন্ম নেয়। যে কর্ম থেকে ক্ষত্রিয়ানী, রাজ্ঞী জন্মায় সে নিশ্চয় সুকর্ম। আবার যে কর্ম থেকে দুঃখী রাজ্ঞী জন্মায় তা কি কখনও সৎকর্ম হতে পারে? সুখী চণ্ডালিনীর অতীত কর্ম সুন্দর না দুঃখী রাজ্ঞীর অতীত কর্ম সুন্দর? চণ্ডালী জাতিতে হীন, সমাজে অনাদৃত, ব্রাহ্মণরা হয়ত তার ছায়া মাড়াবেন না। তাকে অধোবাতে অর্থাৎ তাঁর দিক থেকে যে বাতাস বইছে সেইটে ধরে যেতে বলবেন। এই চণ্ডালিনী হয়ত শবদাহিকা। কিংবা শবদাহের কাজে স্বামীকে সাহায্য করে। কিন্তু অন্য সময় সে যখন পরিষ্কার বসন পরে, হাতে পায়ে গলায় নানা প্রকার পিতলের গহনা পরে, মাথায় রক্তকুসুম, গলায় গন্ধপুষ্পের মালা পরে, পরিষ্কৃত, বীরপুরুষের মতো শোভন তার স্বামীর গাত্রলগ্ন হয়ে রাজমার্গের একধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা দেখে, সে যে চণ্ডালিনী তা দেখে বোঝা যায় না। হতে পারে কারও বাড়ির ভৃতিকা, কি ক্রীতদাসী, হতে পারে স্বাধীন কোনও পর্ণিকা। সে নিজে বলে উঠল, তাই তিনি জানতে পারলেন!
‘ওমা, ওমা, অমন রুপুসী রানি, কিসের দুঃখ গা যে অমন করে মাথা মুড়িয়ে সন্নিসি হতে চলল? আমি তো চাঁড়ালের ঘরে জন্মেছি। কই বাপু আমার তো অত দুঃখু নেই। বলো গো!’ বলে সে তার চণ্ডাল স্বামীর দিকে মুখ তুলে তাকাল, তার স্বামী তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিয়ে দূরে সরে গেল।
বেণুবন থেকে আধ ক্রোশ মতো দূরে স্বর্ণমণ্ডিত শিবিকা থেকে নেমে পদব্রজে তিনি যাচ্ছিলেন। দু’ধারে দাঁড়িয়ে দলে দলে নগরবাসী। কেউ জয়ধ্বনি দিচ্ছে, কেউ পুষ্পবৃষ্টি করছে, কেউ উত্তরীয়-প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছছে, কেউ হাত জোড় করে নমস্কার করছে। তাঁর মনে হচ্ছিল রাজমার্গ নয় তিনি মহামাৰ্গ দিয়ে চলেছেন। মহাজন মার্গ দিয়ে চলবার অধিকার তারাই পায় যারা নিজেরাও মহাজন। একটা গভীর প্রসন্নতায়, শান্ত গৌরববোধে সমাহিত থেকে তিনি ধীরে ধীরে পা ফেলছিলেন। এমন সময় তীব্র বেসুর বেজে উঠল নিস্তব্ধ রাজপথে—‘কিসের দুঃখু গা ওর, যে অমন করে মাথা মুড়িয়ে সন্নিসি হতে চলল!’ মেয়েটি কি তাঁর মুখের প্রসন্নতা, গতিভঙ্গির শান্ত, দৃঢ় সংকল্প—কিছু দেখতে পায়নি! সে কি তাঁর প্রসন্নতাটাকে ছদ্ম আবরণ মনে করেছিল? তাই এক টানে তাকে খুলে ফেলে তাঁর মর্মস্থলে তার অনার্য-দৃষ্টি, অ-সভ্য, অকপট দৃষ্টি বিঁধিয়ে দিল!
তাই তিনি জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বেণুবনে রাত্রির দ্বিতীয় যামে কিংশুক বৃক্ষচ্ছায়ে বসে মুদিত নয়নে ভাবছেন কী সেই জটিল কর্মতত্ত্ব! কবে এসব দুরূহ তত্ত্বের মীমাংসা তিনি করতে পারবেন! তথাগত কবে তাঁকে উপসম্পদা দেবেন? কবে তিনি সকৃদাগামী মার্গে প্রবেশ করবেন? ভবচক্রে আবার না ফেরার সাধনার চেয়েও বেশি তাঁর কাছে ভবচক্রের কারণ জানা, কর্মফলের মর্মোদ্ধার করা। বড় জটিল গণিত। এই দুরূহ অঙ্ক তাঁকে কষে বের করতে হবে। ইতিমধ্যে সংঘের অন্যান্য শ্রমণারা চেয়ে থাক তাঁর দিকে অবাক চোখে। ফিসফিস করে বলাবলি করুক, ‘প্রথম দিনেই ইনি যে দেখি ধ্যানের মধ্যে ডুবে কোথায় হারিয়ে গেছেন! রাজরানি! কোমল সাত স্তর শয্যা ছাড়া শোননি কোনওদিন! দেখো কঠিন মৃৎ-বেদীতে কেমন নিরুদ্বিগ্ন বসে আছেন! আহা সংঘাটিটি বিছিয়েও বসেননি।’
‘সত্যি! আচ্ছা আজ তো রাজবাড়ি থেকে ভিক্ষা এসেছে। কাল? কাল উনি কী করে ভিক্ষায় বার হবেন? এই নগরীতেই তো রানি ছিলেন! সোনার শিবিকায় অশ্বারোহিণী রক্ষিণী নিয়ে বেরোতেন!’ একজন ভাবকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘দ্যাখো ধ্যান থেকে চট করে ওঠেন কি না! উঠলে তো ভিক্ষায় বেরোবেন! দেখে তো মনে হচ্ছে ইনি তথাগতর মতো সেই মহা সঙ্কল্প করেছেন:
ইহাসনে শুষ্যযু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুলর্ভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে॥
‘দুর্লভ বোধিজ্ঞান না লাভ করে ইনি যদি উঠতে না চান! সত্যি সত্যি যদি ত্বক অস্থি মাংস সব শুকিয়ে খসে পড়ে যেতে থাকে, আমরা কী করব?’
থেরী চিত্তা বেরিয়ে এসেছেন। ‘তোমরা ভিক্ষুণীরা এত রাত্রে এত কী বকবক করছ? হয় ধ্যান করো, নয় নিদ্রা যাও।’
‘না, না, সমনা খেমার কথা বলছিলাম, ভাবছিলাম।’
‘সমনা খেমার কথা বলতে হবে না, ভাবতেও হবে না, নিজেদের কর্মস্থানগুলি নিয়ে চিন্তা করো। যাও, যাও বলছি!’ থেরীর কণ্ঠে ভর্ৎসনার সুর।
যামভেরীর শব্দে মহিষী কোশলদেবীর ঘুম ভাঙল। আজ সারা দিন নানা কাজকর্মে গেছে। পোষধের দিন। এমনিতেই অল্প কথা বলা, বসন-ভূষণের অতিরিক্ত পারিপাট্য ত্যাগ, গন্ধদ্রব্য, অনুলেপন, মাল্য এসব থেকে বিরত হয়ে নির্জনে চিন্তা করা, ধ্যান করা, এই তাঁর অভ্যাস। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, শুক্লাষ্টমী ও কৃষ্ণাষ্টমীতে পোষধ পালন করেন তিনি। কিন্তু মহাদেবী ক্ষেমার প্রব্রজ্যা গ্রহণ উপলক্ষ্যে বহুবিধ দান, দরিদ্র-ভোজন, তারপর বুদ্ধসংঘে বহুপ্রকার উপহার যেমন চীবরের জন্য বস্ত্রাদি, আসন্ন শীতের জন্য বিশেষ করে রক্তকম্বল, শুষ্ক খাদ্য নানাপ্রকার, নবনীত, তৈল, ঘৃতাদি, ঔষধের জন্য বহু তাম্র পাত্র, ভেষজ পাঠানো হল। স্বয়ং কোশলদেবীকে উপস্থিত থেকে সব কিছু করাতে হয়েছে। দেবী ক্ষেমা তাঁর সপত্নী হলেও তাঁর বিরহে তিনি একেবারে ম্লান হয়ে গেছেন। সুখদুঃখের কথা বলবার মানুষ রাজপুরীতে কই! ক্ষেমা ছিল, যদিও সে অল্প কথা বলত, নিজের প্রাসাদে নিজের গৃহপালিত বিড়াল, ময়ুর-ময়ূরী, শুক-সারী নিয়েই থাকতে ভালোবাসত, তবু তার সঙ্গে কোশলদেবীর অন্তরের যোগাযোগ ছিল। আর কারও সঙ্গে তেমনটা নেই। তাই দেবী ক্ষেমার প্রব্রজ্য গ্রহণের উৎসব হিসেবে যা যা করণীয় তিনি নিজের হাতে বা নিজের তত্ত্বাবধানে করে গেছেন। যতক্ষণ দেবী রাজপুরীতে ছিলেন ততক্ষণ তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। মনের গভীর আবেগে, সংসার-বিরাগে দেবী ক্ষেমা নিজেই নিজের কেশ অর্ধেক কেটে ফেলেছিলেন। নহাপিতনীকে দিয়ে সুন্দর করে চেঁছে পরিষ্কার করে দিতে হল, কী দীর্ঘ, অপূর্ব কৃষ্ণ কেশদাম, সে একবার ফিরেও দেখল না, সহচরীরা সেই কেশ নিয়ে নিল। যারা অল্পকেশ তাদের জন্য নাকি কবরী প্রস্তুত করবে। একটি গৈরিক পাটের বস্ত্র পরে সে এখান থেকে গেল। কোনও প্রয়োজন ছিল না। সংঘে গিয়েই মস্তক মুণ্ডন করতে পারত। সেখানে আচার্যার কাছ থেকে তিনি যেমন দেবেন তেমনই চীবর তো গ্রহণ করতেই হবে। চীবর, কায়বন্ধ, বাসি বা ছোট ক্ষুর, সুচ ও পরিস্রাবণ। কিন্তু ক্ষেমা রাজপুরীতেই কেশ ফেলে দিল, অলঙ্কারগুলি সবাইকে বিলিয়ে দিল, শ্বেত কাসিক বস্ত্রে সোনার ফুল ছিল, সে বস্ত্রও পরিত্যাগ করল। তার কাষায়বাসিনী, মুণ্ডিতকেশা, প্রব্রাজিকা মূর্তি সে কি রাজপুরীর সবাইকে দেখিয়ে যেতে চেয়েছিল! নাকি রাজ্ঞীর বেশ ত্যাগ করতে তার আর বিলম্ব সইছিল না!
পোষধে সর্ববিধ সংযম পালনীয়। কিন্তু মহারাজ বিম্বিসার যখন রাত্রি হতে না-হতেই কোশলদেবীর গৃহে প্রবেশ করলেন, তিনি পোষধের কথা মনে করিয়ে দিতে পারেননি। মায়া হয়েছিল। সারাক্ষণ, যতক্ষণ তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন, সকালে ব্যায়াম ও স্নানান্তে সভায় যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে দ্বিতীয়বার বেশ পরিবর্তন করে দরিদ্র-ভোজনাদির তত্ত্বাবধান করা, দানযজ্ঞ সমাপন করা, মহাদেবীকে শিবিকায় তুলে দিয়ে তাঁর অনুগমন করা, সারাক্ষণই তাঁর মুখে হাসি ছিল। মহারাজের হাসি বহু প্রকার। কোশলদেবী অল্প বয়স থেকে দেখে আসছেন, তিনি চেনেন সব হাসিগুলি। রাজার মুখে হাসি ছিল, উদ্ভাস ছিল না। ওষ্ঠাধর হাসছিল, চোখ দুটি ছিল ভাবহীন। কর্মচঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁর হাবে-ভাবে। কিন্তু রাত্রিতে সায়মাশ সমাধা করলেন যখন, প্রায় কিছুই স্পর্শ করলেন না। তারপর তাঁর কিছু নিভৃত রাজকার্য ছিল, কুটকক্ষে গেলেন। কোশলদেবীও নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন, আজ পল্যঙ্কে শয়ন করবেন না, মেঝের ওপর স্থূল কম্বলশয্যা প্রস্তুত করে দিয়ে গেছে দাসীরা। এমন সময়ে মহারাজ প্রবেশ করলেন। তাঁর মুখের ওপরের ত্বকটি, যা সর্বসাধারণের জন্যে, সেটিকে যেন তিনি ফেলে রেখে এসেছেন, মুখ কালিবর্ণ। ওষ্ঠাধরে হাসির লেশও নেই। বললেন, ‘দেবী, আজ আমি তোমার গৃহেই রাত কাটাব।’ তিনি লক্ষ করেননি হর্ম্যতলে সংযমীর শয্যা বিছানো।
‘নিশ্চয় মহারাজ’, কোশলদেবী তাঁকে হাত ধরে নিয়ে এলেন। পল্যঙ্কে বসিয়ে সুবাসিত জলে মুছিয়ে দিলেন পা দুটি। দাসীদের আসতে নিষেধ করলেন। মহারাজের শয়নবস্ত্র এনে দিলেন। পরতে সাহায্য করলেন। এবং দীপের আলো আরও কমিয়ে দিয়ে সন্তর্পণে তুলে ফেললেন নিজের সংযমশয্যা।
মহারাজ নিশ্চয় খুব ক্লান্ত ছিলেন। শোয়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে গেলেন। একটি হাত বুকের ওপর ছিল, কোশলদেবী সেটি নামিয়ে রাখলেন। শান্তভাবে শুয়ে রয়েছেন মহারাজ। প্রকৃতই ঘুমোচ্ছেন, না জেগে স্তব্ধ হয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে না। মৃদু দীপ জ্বলতে লাগলো, কোশলদেবী ধীরে ধীরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন।
এখন যামভেরীর শব্দে ঘুম ভেঙে মনে হল সমস্ত ঘরটা যেন হা-হা করছে। প্রশস্ত শয্যার অপরপ্রান্তে তো রাজা নেই! মৃদু দীপ মৃদুতর হয়ে গেছে। ঘরে বড় বড় ছায়া। কী এক অমঙ্গল আশঙ্কায় কোশলকুমারী উঠে বসলেন। হাত জোড় করে নমস্কার করলেন ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, অশ্বিনীদ্বয়, যম, ঈশান এবং সবশেষে তথাগত বুদ্ধকে। ‘রক্ষা করো, রক্ষা করো’, মৃদুকণ্ঠে প্রার্থনা জানালেন, তারপর একটি উত্তরীয়ে মাথা ও শরীর ঢেকে বেরোলেন। প্রতিহারীরা দাঁড়িয়ে আছে। মহাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মহারাজ কোথায়?’
‘বোধ হয় উদ্যানে দেবী!’
‘বোধ হয়! বোধ হয় কেন! সঙ্গে যাওনি!’
সন্ত্রস্ত হয়ে একজন বলল, ‘সঙ্গে আসতে নিষেধ করলেন।’
সোপানশ্রেণী বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেলেন কোশলকুমারী। স্থানে স্থানে প্রতিহারীরা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমোচ্ছে। যারা জেগে আছে তারা তাঁকে অভিবাদন করল। কেউ কেউ সঙ্গে যেতে চাইল। হাত তুলে নিষেধ করলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে কক্ষা থেকে কক্ষান্তর পার হয়ে এসে পৌঁছলেন অন্তঃপুরের বিশাল উদ্যানে। অদূরে জ্বলছে মালার মতো দীপগুলি। মাঝে মাঝে কয়েকটি নিবে গেছে। বহুক্ষণ পর্যন্ত সেগুলি যতবার নিবে যায় ততবার জ্বালিয়ে দেয় একজন উদ্যান-দীপরক্ষক। কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে নিশ্চয়ই আর অতটা সতর্ক থাকে না। ওটি একটি স্তূপ। প্রথম সম্যক সম্বুদ্ধ হয়ে যখন গৌতম রাজগৃহে আসেন, তিনি কলণ্ডক নিবাপে অবস্থান করছিলেন। সেই সময়ে মহারাজ তাঁর পায়ের একটি নখের কাটা অংশ চেয়ে নিয়েছিলেন। অন্তঃপুরের উদ্যানে তারই ওপর চৈত্য রচনা হয়েছে। অনাড়ম্বর একটি স্তূপ। কিন্তু প্রতিদিন দুবার তাকে বন্দনা করা হয়। প্রত্যূষে মাল্য-চন্দন দিয়ে। সন্ধ্যায় মাল্য-চন্দন এবং দীপ দিয়ে। অন্তঃপুরিকারা অনেকেই এই অর্চনায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। দূর থেকে, ওপরে নিজের কক্ষের বাতায়ন থেকে এই দীপমালা দেখতে পান তিনি। মনের ভেতরেও একটি মণিদীপ যেন জ্বলে ওঠে। আজ সেই স্তূপের পাশে একটি ছায়া দেখলেন। মহারাজ গভীর রাতে একাকী এসে স্তূপের সামনে বসে রয়েছেন। তিনি কি ধ্যানমগ্ন! মহিষী সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন। রাজার চোখ খোলা। তাঁর চোখে কি অশ্রুবিন্দু নাকি! সর্বনাশ! না, না। দীপালোক পড়ে চোখ চকচক করছে।
মৃদুস্বরে ডাকলেন তিনি, ‘মহারাজ!’
‘এসো রানি’ মৃদুতর স্বরে বললেন বিম্বিসার।
পাশে বসে পড়ে দু’হাত ধরে কোশলদেবী বললেন, ‘এত রাত্রে! স্তূপে একা! মহারাজ, আপনিও কি সংঘে প্রবেশ করবেন না কি?’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিম্বিসার বললেন, ‘আমি পাপী রানি, আমার সাধ্য কি সংঘে প্রবেশ করি।’
‘কে বলেছে আপনি পাপী?’
‘রাজাকে তো সে কথা কেউ বলে না, তাকে নিজের হৃদয় দিয়ে জানতে হয় মহাদেবি। কত অসংযম সারা জীবন ধরে, কী অনর্থক ব্যসন, অসামান্য প্রাচুর্য, যুদ্ধ, লোকক্ষয়, বহু মানুষের হৃদয়ে শেল বিদ্ধ করা, আমার পাপের কথা তো বলে শেষ করা যায় না!’
‘যুদ্ধ করে অঙ্গরাজ্য জয় করেছেন, ক্ষত্রিয়জনোচিত কর্ম করেছেন। এর মধ্যে পাপের কী হল! যাকে ব্যসন বলছেন, প্রাচুর্য বলছেন, তা রাজার জীবনের অঙ্গ, না থাকলে কেউ সম্মান দেবে না। কর্তৃত্বের অধিকার দেবে না মহারাজ। শ্রমণের যেমন ত্রিচীবর, বেদপন্থী সন্ন্যাসীদের যেমন জটা, অরণ্যের যেমন বৃক্ষ, শূন্যের যেমন নীলাম্বর, রাজারও তেমনি প্রাসাদ, রথ, হাতি, ঘোড়া, সোনা, রূপা, মণিমাণিক্য…।’
কোশলদেবীর কথা শেষ হল না। বিম্বিসার বলে উঠলেন, ‘রানি, তুমি তো জানো আমি কত অসংযমী। অম্বপালীর রূপগুণের খ্যাতি শুনে প্রতিচ্ছন্ন বেশে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তাকে ভালোবেসেছিলাম, সে আমাকে অনুনয় করেছিল, নগরবধূর জীবন থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে, আমি করিনি, লিচ্ছবিদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে জেনে পালিয়ে আসি, আমি কাপুরুষ রানি!’
‘বৃহত্তর স্বার্থের জন্য তো আপনি ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বলি দিয়েছেন মহারাজ, আপনি তো বরং সে জন্য বরণীয়, প্রশংসাৰ্হ। একটু আগেই লোকক্ষয়ের কথা বলছিলেন। আপনার আত্মসুখের জন্য যদি যুদ্ধ লাগত, লোকক্ষয় হত সেটাই তো হত অন্যায়, আর অন্যায় থেকেই তো পাপ!’
‘কিন্তু অম্বপালী যে পড়ে রইল সেই পাঁকের মধ্যে!’
‘আপনি তো তাকে পাঁকের মধ্যে ফেলেননি মহারাজ! তার ভাগ্য! তার ভাগ্যই তাকে ওই পথে নিয়ে গেছে। আর গণের আজ্ঞায় সে যদি বহুচারিণী হয়, বহুর সেবা করে, সে-ও তো একপ্রকার পুণ্যই!’ কোশলদেবীর কণ্ঠস্বর যেন রুক্ষ হয়ে উঠেছে।
‘পুণ্য! তুমি রাজকুলবধু হয়ে এই কথা বলছ রানি?’
মহারানি কি একটু অপ্রতিভ হলেন! শেষ যামের অন্ধকারে ভালো বোঝা গেল না। কিন্তু একটু পরেই বললেন, ‘কেন বলবো না মহারাজ? আপনি অম্বপালীর জীবনের অন্ধকার দিকটার কথা ভাবছেন, আমি ভাবছি আলোর দিকের কথা। চৌষট্টিকলায় সে পারঙ্গমা, লিচ্ছবিরা সর্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠ আচার্য রেখে তাকে পৃথিবীর বিদুষীদের অন্যতম করে তুলেছে, সেই সঙ্গে নৃত্য-গীত-বাদ্য-কাব্যে সে অতুলনীয়। কত বিদ্বান, পণ্ডিত, কবি, কত বুদ্ধিমান, রুচিমান মানুষের সঙ্গে তার জানাশোনা, কত জনের ভালোবাসা, অধিক কি মহারাজ আপনার মতো মানুষের ভালোবাসাও তো সে পেয়েছে! এগুলি কি সৌভাগ্য নয়! আমি আর দেবী ক্ষেমা তো অনেক সময়ে ধনঞ্জয়পত্নীর সঙ্গে এই বিষয়ে আললাচনা করতাম!’
‘মহিষী, একটা কথার উত্তর দেবে?’
‘যদি জানা থাকে তো নিশ্চয়ই দেবো মহারাজ?’
‘দেবী ক্ষেমাকে কি আমি কোনওভাবে অবহেলা করেছি! সেই জন্যেই কি তিনি…’
‘হাসালেন মহারাজ! নিজেকে এত বড় ভাববেন না। আপনার অবহেলায় প্রব্রজ্যা নেবে কোনও রমণী! তাহলে তো অনেকেরই প্রব্রজ্যা নেওয়ার কথা! শুনুন—বৈরাগ্য একটা দুর্লভ সম্পদ, কোনও দুঃখ থেকে যে বৈরাগ্য উৎপন্ন হয় আমি তার কথা বলছি না। বলছি, আত্মজ্ঞান লাভ করবার তীব্র ইচ্ছা থেকে যে বৈরাগ্য উৎপন্ন হয় তার কথা। দেখলেন না, ক্ষেমা নির্মমভাবে নিজের অত গর্বের কেশদাম কেটে ফেলল, অত আদরের অলঙ্কার, বস্ত্র সব দাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দিল! তিন দিন ধরে যে দানযজ্ঞ হল, তার বেশির ভাগই তো ক্ষেমার ত্যক্তবস্তু দান! এসব কিছুই ভালো লাগছিল না তার। সে জ্ঞানলাভ করতে চায়। কারও দিকে দৃক্পাত মাত্র না করে সে চলে গেল। সে অনাগামিফল লাভ করুক। আপনি তার জন্য অহেতুক দুঃখ করবেন না।’
‘আমি তাহলে কেন এত অশান্তি সত্ত্বেও বিরাগী হতে পারি না দেবি!’
‘আপনার যা কর্ম আপনি তাই করুন মহারাজ, যাতে নিযুক্ত রয়েছেন তাই সৎভাবে করুন, তথাগত কি বলেছেন অনাগামিফল লাভ করতে হলে ভিক্ষু হতেই হবে? উপাসকদের দ্বারা তা হবে না?’
‘না, তা নয়।’
‘তবে? চিত্তবৈকল্য পরিহার করুন মহারাজ! উঠুন! ছিঃ!’
বিম্বিসার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর মহিষীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার স্বস্তি, তুমি আমার সান্ত্বনা, দেবি। এত কথা তুমি কোথা থেকে কখন জানলে?’
রাজার বাহু ধরে প্রাসাদের দিকে এগোতে এগোতে কোশলদেবী বললেন, ‘অম্বপালীর মতো অতটা না হলেও আমরাও কিছু কিছু জানি বইকি!’
রাজা ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে মহিষীর দিকে তাকালেন। কিন্তু কোনও ভাবান্তর দেখতে পেলেন না। মহিষী বললেন, ‘শুধু আচার্যের শিক্ষাই তো সব নয় মহারাজ! প্রতিদিন জীবন থেকে, সুখ থেকে, দুঃখ থেকে, কলহ থেকে, সখ্য থেকে অবিরত শিক্ষালাভ করছি। সেই শিক্ষার মূল্য কি অল্প!’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘চলুন।’
ধীরে ধীরে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন দু’জনে। আর একটু পরেই ভোর হবে। এখন আর ঘুমোবার সময় নেই। তার প্রয়োজনও নেই। অদ্ভুতভাবে তাঁর পোষধ পালন হল, ভাবলেন কোশলদেবী। প্রতিহারীরা সন্ত্রস্ত হয়ে নমস্কার জানাচ্ছে। শয়নকক্ষে আর প্রবেশ করলেন না কেউ। পাশেই রয়েছে আরও একটি বিশাল কক্ষ। একটি দোলনায় সুখাসনে বসে দীর্ঘ আলোচনায় রাত ভোর করে দিলেন রাজ-দম্পতি।
অবশেষে রানি গেলেন স্নানে। বিম্বিসার গেলেন ব্যায়ামশালায়। মল্লযুদ্ধে মত্ত হয়ে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। রাত্রির দুঃস্বপ্নের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে পাপবোধ, নৈরাশ্য, বিরহযন্ত্রণা, ক্ষণবৈরাগ্য।
ঘোষক এসে জানাল, দেবী সুমনাকে সাকেতে পৌঁছে দিয়ে রক্ষীরা ফিরে এসেছে। তাদের কাছে মহারাজের জন্য পত্র আছে।
ঘর্মসিক্ত হাত দুটি মুছে পত্রে হাত দিলেন বিম্বিসার। পত্র দুটি। একটি সুবর্ণপট্টের মধ্যে গোটানো। আর একটি ভূর্জপত্রে কুঙ্কুমরাগ দিয়ে লিখিত। সেই পত্রটিই আগে খুললেন মহারাজ। তাতে লেখা আছে : ‘সেনিয়, এখানে পৌঁছে দেখি বল্পমঙ্গলের দিনে সরযূতীরের উৎসবে আমার কন্যাটি এক সেট্ঠি পুত্তের মালা পরে বসে আছে। সেট্ঠিটি সাবত্থির। নাম মিগার। তাঁর গুণধরটির নাম পুন্নবদ্ধন। সুতরাং আবাহ-বিবাহের আয়োজন করতেই হয়। সুমনাকে সারা জীবন অনেক মার মেরেছ। সেই সব পাপগুলির স্খালন হবে যদি বিসাখাকে আশীর্বাদ করতে ভালো ছেলেটির মতো সাকেতে আসো। বরের সঙ্গে আসবেন কোসলরাজ, তাঁর নববধূ মল্লিকাদেবীকে নিয়ে, আমার দিক থেকে মগধরাজ না থাকলে সৌষম্যরক্ষা হয় না। সঙ্গে আনবে কোসলদেবী, ছেল্লনাদেবী এবং অন্যান্যদের। তোমার অনুচর, রক্ষী, দাস-দাসী, অন্তঃপুরিকা-বাহিনীর জন্য প্রাসাদ নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। সুমনার মাথার তিনটি পক্ককেশের দিব্যি, এসো।’—
অন্য পত্রটি ধনঞ্জয়ের। আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণপত্র।
বিম্বিসার সুমনার পত্রটি আবার পড়লেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল সুমনার কন্যা বিশাখাকে কুনিয়র বধূ করেন। বিশাখা এখন কেমন হয়েছে তিনি জানেন না। শুনেছেন অসামান্য রূপসী, গুণবতী। কিন্তু শোনা কথার ওপর নির্ভর করবার প্রয়োজন কী? সুমনাকে দেখলেই তো বোঝা যায় তার কন্যা কেমন হবে। কুনিয় বড় হঠকারী, তাকে সংযত রাখতে একটি তেজস্বী কন্যার আবশ্যক ছিল। তিনি সামান্য ইঙ্গিত করেছিলেন। সুমনা সে ইঙ্গিত বুঝতে পারবে না এ তিনি মানতে পারেন না। সুমনা অতি চতুর। তাই কি এই স্বতন্ত্র পত্র! সুমনা গিয়ে দেখেছে কন্যার বিবাহ স্থির হয়ে গেছে? সত্য? এ কথা কি সত্য? সুমনার কন্যাটি তার বুকের পাঁজর, তার রূপগুণ সম্পর্কেও সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু কুনিয়! সে রাজকুমার হতে পারে, বীরপুরুষও হতে পারে, কিন্তু তার অঙ্গে ত্রুটি রয়েছে। সুমনা-ধনঞ্জয়ের মতো মাতা-পিতা কি চাইবে কুনিয়র মতো জামাতা!
কিন্তু তিনি স্বার্থপর, তিনি চেয়েছিলেন। হল না। তিনি যা চাইছেন, কিছু কাল পর্যন্ত তা হচ্ছিল, তথাগতকে তিনি বলেছিলেন জীবনে তিনি যা যা অভিলাষ করেছিলেন সব পূর্ণ হয়েছে : প্রথম, রাজ্যাভিষেকের অভিলাষ। সামান্য গোষ্ঠীপতির পুত্র থেকে তিনি রাজা, ক্ৰমে মহারাজ হয়েছেন। দ্বিতীয় ইচ্ছা, তাঁর রাজ্যে সম্যকসম্বুদ্ধর চরণধূলি পড়ে। এ ইচ্ছার জন্ম হয়েছিল সেইদিন, যেদিন তাঁর দিতে চাওয়া উচ্চপদ, ধনসম্পদ এসব প্রত্যাখ্যান করে শাক্যকুমার সিদ্ধার্থ তাঁর বুদ্ধত্বলাভের সংকল্প ঘোষণা করে চলে গেলেন, তখনই তিনি প্রার্থনা জানিয়েছিলেন বুদ্ধত্বলাভ করে সিদ্ধার্থ যেন তাঁর রাজ্যে আসেন। তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না যে এই যুবক বুদ্ধত্বলাভ করবেই। তাঁর দর্শন, উপদেশ শ্রবণ, এবং তাঁর উপদেশের মর্মার্থ গ্রহণ করতে পারা এগুলি ছিল তাঁর অবশিষ্ট অভিলাষ। এগুলি পূর্ণ হয়েছে, যদিও বুদ্ধর উপদেশের মর্ম তিনি প্রকৃতই বুঝেছেন কিনা তা বলা এখনি সম্ভব নয়। কিন্তু তার পর? যা চাইছেন তা হচ্ছে না। কুনিয়র নিরাপত্তার জন্য তাকে ভবিষ্যতে সৎপথে রাখবার জন্য সুমনাকন্যার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হল না। বিম্বিসার বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। তার পরেই চোখ পড়ল আরেকটি পঙ্ক্তির ওপর। ‘সুমনাকে সারা জীবন অনেক মার মেরেছ।’ কী অর্থ এর? কিশোর বয়সে বালিকা সুমনাকে তিনি সত্যিই অনেকবার প্রহার করেছেন। সুমনাও পাল্টা প্রহার করতে ছাড়েনি। কিন্তু সারা জীবন? সারা জীবন? সারা জীবনের কথা বলবে কেন সুমনা? শুধু কৌতুক! কৌতুকের অতিশয়োক্তি! না কি আরও কিছু! বিম্বিসার উচ্চাকাঙ্ক্ষী। রাজচক্রবর্তী হবার প্রবল বাসনায় সে কি অনেক নারীকে দুঃখ দিয়েছে! কোশলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহে কি সেনিয় একটি বালিকা সহাধ্যায়িনীকে উপেক্ষা করেছিল? তারপর অম্বপালীর উর্বশীতুল্য রূপগুণরাশির জন্য কোশলদেবীকে? দেবী ক্ষেমাকে? অম্বপালীসংক্রান্ত ব্যাপারটা যখন জানাজানি হয়ে গেল তখন সন্ধি করতে হল গণরাজ চেতকের কন্যা ছেল্লনাকে বিবাহ করে! গতকাল দেবী ক্ষেমা বিম্বিসারকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করে চলে গেলেন। আর আজ? আজ কি চলে যাচ্ছে আবাল্যসহচরী সুমনা! অতি সন্তর্পণে, নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে, অতি সুকৌশলে চলে যাচ্ছে!
ধনঞ্জয়ের প্রেরিত আনুষ্ঠানিক পত্রটি অন্যমনস্কভাবে হাতে করে অন্তঃপুরের দিকে চলে গেলেন মহারাজ বিম্বিসার।
১৪
বহু দূর থেকে একটা ধ্বনি ভেসে আসছে। ফাঁপা চর্মগোলকের ওপর ধাক্কা দিলে যে-রকম শব্দ হয় সে-রকম। দিম দিম দিমা দিম, দিম দিম্। ক্ষেতে কাজ করতে করতে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়াল নন্দ। এত দিন গেছে, এত দিন ধরে এখানে সে তার ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করছে, কই এ শব্দ তো শোনেনি! কোনও কোনও দিন শস্য কাটার সময়ে সন্ধ্যা হলে খড়ে আগুন দিয়ে সবাই আগুন পোহাতো। তখন শোনা গেছে ওই ধ্বনি। সামান্য একটু সময়ের জন্য। কিন্তু দিনের বেলায় কখনও নয়। যতদূর চোখ যায় ক্ষেতটি তার একার, অর্থাৎ তাদের পরিবারের। বর্ষার জল পেয়ে সবুজে সবুজ হয়ে আছে। এই সময়ে আগাছাগুলো কেটে দিতে হয়। সকাল থেকে সে তার ভাইদের সঙ্গে এই কাজই করছিল। ধানগাছ যেমন শনশন করে বাড়ে, আগাছাও তেমন শনশন করে বাড়ে। এই সময়ে নিড়িয়ে না ফেললে শস্যের ক্ষতি করবে। তাই তারা চার ভাই সকাল থেকে এই কাজে লেগে গেছে। দু’জন গেছে বাড়িতে খেতে। খেয়ে একটু বিশ্রাম করে আসবে। সে এই প্রান্তে কাজ করছে, আর একেবারে অপর প্রান্তে আছে তার সেজভাই সাম। সাধারণত দাসেরা তাদের সঙ্গে এ কাজ করে। তারাই বেশি করে, নন্দ প্রমুখ একটু-আধটু হাত লাগায়, তত্ত্বাবধান করে। কিন্তু এ বছর কয়েকটি দাস তাদের বিক্রি করে দিতে হয়েছে। গৃহভৃত্য ছাড়া আর বড় কেউ নেই। পরিবার বাড়ছে। ছোট ভাইয়ের গত বছর যমজ পুত্র হল। তার নিজেরও তিন পুত্র, দুই কন্যা। সামের চারটি। বড় ভাইয়ের সাতটি। তার পিতামহ, পিতামহী দু’জনেই জীবিত। দুই খুল্লতাতর পরিবারও নেহাত অল্প নয়। খুল্লতাতদের পুত্ররা, দু-চারটি সবে সাবালক হয়েছে। তাদেরও কাজ শেখানো হচ্ছে। আজ অপরাহ্ণে তাদেরও আসবার কথা। ওরা বড় হয়ে গেল। জ্যেষ্ঠের পুত্রগুলি বড় হয়ে গেলে ক্ষেতের কাজের জন্য দাস বিশেষ লাগবে না। পিতামহ এ কথা গর্ব করে বলেন। যদিও নন্দ বুঝতে পারে না, দাস যথেষ্ট না থাকলে তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে কি করে।
এই ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়ালে সত্যিই নন্দর মনে হয় সে-ই পৃথিবীর রাজা। এই ভূমির প্রকৃতি তার নখদর্পণে। ভূমির সঙ্গে আকাশের যে সব সময়ে একটা খেলা চলছে, বাতাসে, বৃষ্টিতে, শৈত্যে, গ্রীষ্মে, শিশিরে—তার পরিপূর্ণ সাক্ষী সে। সে ক্ষেত্রপাল। সে কৰ্ষক। রাজা একজন আছেন। সাকেতে থাকেন। উগ্গসেন। শুনেছে তাঁরও ওপর নাকি রাজা আছে। সে থাকে সাবত্থিতে। রাজা কেমন, রাজৈশ্বর্য কেমন অতশত সে জানে না, দেখেনি। তার প্রপিতামহ নাকি ছিলেন সেই দলে, যারা বন কেটে বসত করেছিল। তাদের ভূমি গ্রামের প্রত্যন্ত সীমায়, বনের কাছ ঘেঁষে। সে সময়ে এই ভূমি যথেষ্টরও বেশি ছিল। এখন তাদের ঊনচল্লিশ জনের বিশাল পরিবারে তা আর যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। দুগ্ধবতী গাভী যথেষ্ট রয়েছে। সুপেয় জলের পুষ্কর্ণী তাদের গৃহসীমার মধ্যেই। কাছে রয়েছে ছোট্ট দক্ষিণা নদী, সরযূর একটি ক্ষুদ্র শাখা। তাতে মাছ প্রচুর। তা সত্ত্বেও, ঠিক পিতার সময়ের অশন-বসন, যাগ-যজ্ঞ, দান-ধ্যান, লৌকিকতা এসব চালিয়ে উঠতে পারা যাচ্ছে না। অগ্নিহোত্র রক্ষা করার ব্যয়ই কি অল্প নাকি? পিতামহ এতটুকু নিয়মের অন্যথা হতে দেবেন না। দুগ্ধ, ঘৃত, পুরোডাশ, ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে দান-দক্ষিণা এসব নিয়মমতো চালাতে হবে। আর না চালিয়েই বা উপায় কী! দেবতাদের তো আর রাগালে চলে না, পিতৃপুরুষদের কষ্ট দেওয়াটাই কি ঠিক! তা ছাড়া আহিতাগ্নি গৃহস্থ বলে প্রত্যেক অমাবস্যায় এবং প্রত্যেক পূর্ণিমায় একটি করে ইষ্টিযাগ করতে হয়। এই তো কদিন আগে পূর্ণিমার পূর্ণমাস যাগ গেল। চারজন ঋত্বিক। দুদিন ধরে পরিশ্রমও যেমন, ব্যয়ও তেমন। এ ছাড়াও বর্ষাকালে পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় পশুযোগ আছে। এ বছর আগামী অমাবস্যার পরের অমাবস্যায় তাদের গৃহে পশুযোগ হবে স্থির হয়েছে। তাতে আবার লাগে ছ’জন ঋত্বিক। খুঁটিনাটি বহু নিয়ম। নন্দ অত জানে না, সে তো যজমানও নয়। যজমান তার পিতামহ। সে জানে না যজমানের পরিবারের প্রত্যেকেই এই সব যজ্ঞফল পায় কি না! সবাইকারই কি স্বর্গলাভ হয়? সে ভালো জানে না। সে জানে এ বছর তার অজপাল থেকে কৃষ্ণবর্ণ নধর একটি অজ তাকে দিতে হবে। অজটিকে শ্বাসরোধ করে মারা হবে। তার নাভির পাশের মেদ বা বপা আহুতি দেওয়া হবে। তার থেকে তাদের মঙ্গল হবে।
যাই হোক, মোট কথা তাদের আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছে। বছরে একবার শস্যের ষষ্ঠভাগ গ্রামণী নিয়ে সংগ্রহ করে রাখেন রাজকরের জন্য। সেটা কোনও সমস্যা নয়। সমস্যা এই বৃহৎ পরিবার নিয়মমতো প্রতিপালন এবং লৌকিক ও ধর্মানুষ্ঠান। পিতামহ গ্রামণীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাই আরও বন কেটে ভূমিসীমা বাড়াবার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। ভূমির তো ক্রয়-বিক্রয় চলে না। ভূমি হলেন জননী। তবে যে যতটা ভূমি বন কেটে বার করতে পারে, ততটা ভূমির শস্যের অধিকার তার। অবশ্যই গ্রামণীর অনুমতি চাই। তা সে সমস্যার তো সমাধান হয়ে গেছে। বনের এক অংশে বৃক্ষচ্ছেদকদের নিযুক্ত করা হয়েছে, বড় বড় গাছ কাটবে, গুল্মদি পরিষ্কার করবে। তারপর মাটি পিটিয়ে তার ভেতর থেকে পাথরের খণ্ড বৃক্ষমূল কাঁকর ইত্যাদি বেছে ফেলে দিয়ে কর্ষণের জন্য প্রস্তুত করার কাজটি তাদের ভাইদের। কাটা গাছগুলিও কাজে লাগবে। অতিরিক্ত ঘর চাই। ঘরের জন্য পালঙ্ক, পেটিকা, ফলক ইত্যাদি অনেক কিছুর প্রয়োজন হবে। তবে কাঁচা কাঠে তেমন কিছু হবে না। এ বছর গাছগুলি বৃষ্টিতে ভিজুক, রোদে পুড়ক, শুধু সেগুলিতে একটা করে চিহ্ন দিয়ে দিতে হবে। যাতে অন্য কেউ আবার নিয়ে না যায়।
বন কেটে কর্ষণের ভূমি প্রস্তুত করা খুবই পরিশ্রমসাপেক্ষ। গাছ কাটাও খুব বিপজ্জনক। যতদুর সম্ভব লোকালয়ের সীমার মধ্যে থেকে কাজ করাই সঙ্গত। কিন্তু নন্দদের ক্ষেত্রটিই যে গ্রামের এক ধারে, বন ঘেঁষে। তাই সে দিমা দিম দিম দিম শব্দ শুনে কান খাড়া করে রেখেছিল একটি বড়সড় হরিণের মতো। বাতাসের গতির দিকে তার কান। সে শুনছে, সাম কাজ করছে অনেক দূরে, সে শুনতে পেয়েছে কি না কে জানে! যাক শব্দটি মিলিয়ে যাচ্ছে। তার ভয় হচ্ছিল, বন্যরা যদি হঠাৎ তাকে আক্রমণ করে! সে একা এদিকে, তার ভাই সাম একা ওদিকে। সামও আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু শব্দটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে আবার হাতে তুলে নিল তার নিড়ানি। সকাল থেকে পরিশ্রম করে সে একাই তো অনেকটা কাজ করে ফেলেছে।
হঠাৎ আঁটোসাঁটো কটিবস্ত্র পরা একটি বৃক্ষচ্ছেদক ছুটতে ছুটতে বন থেকে বেরিয়ে এসে অদূরে লুটিয়ে পড়ল। নন্দ তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দেখল লোকটির মুখ থেকে ফেনা উঠছে। আক্ষেপ হচ্ছে তার হাতে পায়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্থির হয়ে গেল। জ্ঞান হারাল নাকি? নন্দ লোকটির ডান হাত তুলে নিয়ে নাড়ির স্পন্দন দেখবার চেষ্টা করল। কিছু বুঝল না। সে লক্ষ করল লোকটির চোখ দুটি কেমন উল্টে গেছে। তখন সে দেখল লোকটির ঘাড়ের কাছে একটি তীর বিঁধে আছে। সন্তর্পণে সে তীরটি টেনে তুলল। সরু কাঠের ফলা। এই ফলায় নিশ্চিত বিষ মেশানো আছে। তীক্ষ্ণ বিষ! সর্বনাশ! মুখটি ভালো করে দেখে মনে হল এ বোধ হয় জম্বুক। মোট আঠারো জন ছেদক নিযুক্ত করেছে সে। তাদের দলপতি নিশিপাল। কীভাবে কতটা রজ্জুর বেড় দিয়ে কোন কোন গাছ ফেলা হবে এসব ঠিকঠাক করার দায় তার। সে কোথায়! নন্দ মুখের দু পাশে হাত রেখে চিৎকার করে উঠল ‘ওহো-ও-ও-ও’। তিন চারবার চিৎকারের পর যেন অরণ্যের অভ্যন্তর থেকে প্রত্যুত্তর ভেসে এলো। নন্দ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। তার মাথার ওপর চক্রাকারে চিল ঘুরছে। দূরে, নীল আকাশে রোদের সেতু পার হতে হতে উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠছে সূর্য। ছায়াগুলো ক্রমশই খর্ব হয়ে আসছে। বর্ষাকালে রোদ যেদিন হয়, বড় প্রখর হয়। আশা করা যায়, তার আর দুই ভাই তাড়াতাড়ি আসবে। তাদের হাতে কাজের দায় ফেলে দিয়ে সে গৃহের শীতলতায় গিয়ে বিশ্রাম করতে পারবে। আজ আর আসতে হবে না। সাম! সামই বা কোথায় গেল? ইতিমধ্যে এ কী বিপদ! ছেদকরা কেউ আসছে না কেন? জম্বুক কি মরে গেল? তাই যদি হয় এখন এই মৃতদেহ নিয়ে সে কী করবে! ফেলে যেতে পারবে না। এখুনি শকুন, চিল ঝাঁপিয়ে পড়বে দেহটির ওপর। বহুক্ষণ পর তার ধৈর্য যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন খুব কাছ থেকে সে ‘ওহো-ও-ও’ চিৎকার শুনতে পেল। তার পরই দু’হাতে ডালপালা সরাতে সরাতে, আঁটোসাঁটো মোটা কাপড় পরনে, হাতে কুঠার নিশিপাল বেরিয়ে এলো। নন্দ মুখে কিছু না বলে জম্বুকের দেহটির দিকে আঙুল দেখালো। নিশিপাল কাছে এসে নানাভাবে পরীক্ষা করে বলল, ‘এ কী? এ তো মরে গেছে কর্তা! পায়ের কাছটা হিম হতে আরম্ভ করেছে।’
নন্দ বলল, ‘বন্যদের বাদ্যির শব্দ শুনতে পেয়েছিলে?’
নিশিপাল বলল, ‘কই, না!’
‘তাহলে তুমি উল্টো দিকে ছিলে বাতাসের মুখে শব্দ ছুটে আসছিল। আমি স্পষ্ট শুনেছি, বন্যদের সেই চর্মঢক্কার ধ্বনি। নিশিপাল তোমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। এই দ্যাখো বন্যদের বিষ মাখা তীর! তোমার দলের লোকেদের জড়ো করো। আজ আর ছেদনকার্য হবে না। জম্বুকের সৎকারের ব্যবস্থা করো। আমি বাড়ি চললাম।’
নন্দর সারা শরীর গরমে লাল, ঘাম বইছে, কপালে ভ্রূকুটি। সে আর সময় নষ্ট না করে গৃহের দিকে চলল। পরিশ্রমের ক্লান্তি, শুভকাজে বাধা পড়ায় অমঙ্গলের ভয়, জম্বুকের মৃত্যুতে উদ্বেগ—সব মিলিয়ে তাকে একেবারে হতোদ্যম করে দিয়েছে।
বন্যদের তীরবিদ্ধ হয়ে জম্বুক মরে গেছে? নিশিপাল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। জম্বুক ছেলেটি একেবারেই অল্পবয়স্ক। অল্প বুদ্ধিও। তার পিতার বিপণি আছে গ্রামে। বেশ বড় বিপণি। কিন্তু গণনা করতে পারে না, পরিমাপ ঠিক করতে পারে না, নগরী বা ভিন্ন গ্রাম থেকে, সার্থদের কাছ থেকে বাদ-বিতণ্ডা করে পণ্যও ঠিকমতো কেনা-কাটা করতে পারে না জম্বুক। তাই আঠারো বছর বয়স হওয়া মাত্র তাকে নিশিপালের দলে পাঠিয়ে দিয়েছেন তার বাবা। এত বড় ছেলে বসে থাকলে নানা কু-চিন্তা, নানা কু-অভ্যাস দেখা দেবে। তার চেয়ে গায়ে খেটে যা হয় উপার্জন করুক, অন্ততপক্ষে সময়টা ব্যস্তভাবে কাটাক! মাথায় ঈষৎ খাটো হলেও জম্বুকের বলশালী শক্তপোক্ত আকৃতি। বড় বড় প্রাচীন বনস্পতির গোড়ায় কুড়ল মেরে মেরে কী করে বৃত্তাকারে তাকে অর্ধেক ছেদন করে দড়ির ফাঁস ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিতে হয়, তারপর কয়েক জনে মিলে টান মেরে তাকে ধরাশায়ী করতে হয়, সে ভালোই শিখে গেছে। কিছু একটা করতে পারছে বলে উৎসাহও যথেষ্ট। যাঃ, বন্যরা তীরটা ওকেই মারল! নিশিপাল মাথায় হাত দিল। সবই ভাগ্য বলতে হবে। গোড়ার থেকেই ছেলেটার ভাগ্য মন্দ। নইলে পিতা বণিক, অত বড় বিপণি, গোলা। অন্যান্য পুত্রগুলি তো ওই বিপণি থেকেই দিব্যি উপার্জন করছে। গ্রাম-গ্রামান্তরে যাতায়াত করছে। জম্বুকের মাথায় সামান্য বুদ্ধিটুকুও দিলেন না কেন বিধাতা! ছিল কোথায় জম্বুক! দলের সঙ্গেই তো থাকবার কথা! আঠারো বছর বয়স হলেও, শিশুর মতো কৌতূহল জম্বুকের। হয়ত কোনও সময়ে দল থেকে ছিটকে পড়েছে বনের গাছ-পালা দেখবার জন্য, ফলমূল পাড়বার জন্য, বিপদ সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই নেই। শিশু যেমন আগুন দেখলে ভয় পায় না, বরং আগুনের দীপ্তিতে আকৃষ্ট হয়ে তাকে ধরতে যায়। এ তেমনি।
এখন এই মৃতদেহ ছেড়ে সে দলের লোকেদের ডাকতে যেতেও পারছে না। নন্দ-কর্তা তো সব দোষ যেন তার একার এমনি একটা ভাব দেখিয়ে চলে গেলেন। সাম-কর্তারও তো দেখা নেই। তিনি বোধ হয় আগেই সংগোপনে বাড়ি চলে গেছেন। সাম-কর্তার চোখ দুটি যেমন গোল গোল, দেহটিও তেমনি। উনি তেমন কষ্ট সইতে পারেন না। নিশিপাল বারবার তার মুখের দু পাশে হাত রেখে চিৎকার করতে লাগল। অবশেষে অপরাহ্ণের দিকে সে তার দলের সবাইকে একত্র করতে পারল। দলে একটি ছেদকের কিছু বিষ-চিকিৎসার অভিজ্ঞতা ছিল, সে হায় হায় করতে লাগল। সত্যিই নিশিপালের আগে যদি সে-ই প্রথম নন্দর ডাক শুনতে পেত জম্বুকটা হয়ত মরত না এত সহজে। কিন্তু এখন তো আর পশ্চাত্তাপ করে লাভ নেই। জম্বুক এখন মরে কাঠ হয়ে গেছে। বিষক্রিয়ার জন্য দেহের বর্ণও কেমন অস্বাভাবিক। যেন একটা গাছের মরা ডাল। সবাই মিলে বাঁশ বেঁধে খট্টা প্রস্তুত হল। তারপর জম্বুকের বাড়ি। এই বনান্তের শস্যক্ষেত থেকে সে অনেক দূরে। সাকেত নগরীর অনেক কাছাকাছি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এতক্ষণে তার গৃহ থেকেও কেউ-না-কেউ তো আসবে! নাকি অল্পবুদ্ধি সন্তান বলে মৃতের সৎকারেরও প্রয়োজন বোধ করে না এরা!
জম্বুকের বাড়ির কাছাকাছি এসে নিশিপাল এবং তার দলের লোকেরা দেখল জম্বুক-পিতা কাঁধের ওপর একটি গাত্রমার্জনী নিয়ে বৈকালিক স্নানে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সহাস্য মুখ। এই মাত্র বোধ হয় কারও সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তাদের কাঁধে খট্টা দেখে ঘটি হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন, ‘কে ম’লো রে? ও নিশিপাল! শ্মশানের দিকে নিয়ে না গিয়ে পল্লীর এদিকে কেন বাবা?’ ততক্ষণে নিশিপালরা খট্টাটি নামিয়ে রেখেছে। জম্বুক-পিতা, হাতে ঘটি, কাঁধে গামছা, একেবারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটি বালক বেরিয়ে এসেছিল। সে বোধ হয় দৌড়ে গিয়ে ভেতরে খবর দিল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে একটা গোলমাল, কান্নার শব্দ, কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে এলেন জম্বুকের মা, পেছনে পেছনে আরও অনেক স্ত্রীলোক। নিশিপাল তাদের চেনে না। সে তীরটা দেখিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল জম্বুকের পিতাকে। তার মা হাহাকার করতে লাগলেন।
‘ওরে আমার বাছা রে, কেমন করে এমন হল রে! কেমন নিঠুর পিতা! ধৈর্য নেই এতটুকু! বাছাকে আমার হাতে কুড়াল দিয়ে ঘরের বার করে দিলে। এই কি বণিকের ঘরের পুতের কাজ! না হয় বসেই খেত, শিশুগুলি, বালক-বালিকাগুলি কি আর বসে খায় না, কৃপণ বণিকের কত ধন যায় তাতে! ওরে জম্বুক, কে আমার বাগানের বেড়া বেঁধে দেবে রে? কে আর আছে এই বিলাসপ্রিয়, মহার্ঘ গৃহে যে বড় বড় পেটিকাগুলো বইবে অবলীলায়! কে হাসিমুখে দাসত্ব করবে সমস্ত পরিজনের? …আর তোমাকেও বলি নিশিপাল, তুমি কি জানতে না, বাছা আমার জাত-কাঠুরে নয়, তার ওপর একটু দৃষ্টি রাখতে তোমার কী হয়েছিল? শেষ পর্যন্ত অপঘাত!’
নিশিপাল অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে ভাষা নেই। কিন্তু এই দুঃসংবাদ তাকেই এভাবে বহন করে আনতে হবে এ কথা সে কখনওই ভাবেনি। তার ধারণা ছিল নন্দ সংবাদটা এদের দিয়ে গেছেন। ক্রোধে দুঃখে তার ভেতরটা জ্বলছিল।
জম্বুকের বড় ভাইয়ের পুত্রটি মুখাগ্নি করবার পর চিতাটি যখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল তখন সে নিঃশব্দে শ্মশান থেকে বেরিয়ে এলো। দক্ষিণা নদীর জলে স্নান করে ভিজে কাপড়ে এঁটে পরে চলল নন্দ-কর্তার বাড়ি।
আঙনে প্রদীপ জ্বলছে। গৃহাভ্যন্তর থেকে উপুর্যপরি শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। সেই সঙ্গে উত্তম যবাগু পাকের সুগন্ধ। কয়েকটি বালক-বালিকা বোধ হয় খেলা করতে অন্য কোথাও গিয়েছিল, ধূলিধূসর পায়ে কলকল শব্দ করতে করতে ভেতরে ঢুকল। গৃহ-বলভীতে পারাবতগুলি আশপাশ ফিরছে আর বকুম বকুম করছে। আঙনের পুষ্পিত কদমগাছের ওপর থেকে একটি ময়ূর ঝাঁপ দিয়ে নেমে এসে একটি এঁকেবেঁকে পালিয়ে যেতে থাকা ডুন্ডুভ সাপ ধরল।
নিশিপালের ডাকে নন্দ বেরিয়ে এলো। বেশ স্নাত, সুন্দর। ধৌত বসন পরেছে। বুকে চন্দন লেপেছে। গরমটা বোধ হয় বড্ডই লেগেছে কর্তার।
নিশিপাল রুক্ষ গলায় বলল, ‘অন্য লোকে দেখে নিন, কাল থেকে আমরা আর আপনার কাজ করব না।’
নন্দ ত্রস্ত হয়ে বলল, ‘বলছ কি নিশিপাল! কেন? জম্বুক যে বন্যদের তীরে মরে গেল, সে কি আমার দোষ?’
নিশিপাল বলল, ‘বণিকের ঘরে একাটা সংবাদও তো দেবেন। তারা নিশ্চিন্তে দিনান্তের কৃত্য পালন করে যাচ্ছেন, এদিকে তাদের কনিট্ঠটি অপঘাতে মারা গেছে! আমরা যে যমদূতের মতো গিয়ে ঘরের আঙনে দাঁড়ালাম। বণিকপত্নীর কী কান্না! আমাকে তো তিরস্কারের পর তিরস্কার শুনতে হল। জম্বুকের পিতাকেও। তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। কী পরিস্থিতি বলুন তো! ধিক্ আপনাকে! ধিক্!
নন্দ মুখ নিচু করে বলল, ‘শোনো নিশিপাল, শোনো। আমি সত্যই খুব অন্যায় করেছি। কিন্তু সংবাদ দিতে পারিনি…কেমন একটা অপরাধ বোধ হচ্ছিল। যদিও অপরাধ আমার নয়। আমি তো ভেবেইছিলাম সংবাদটা দিয়েই যাবো। কিন্তু জম্বুক-পিতার বিপণির পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম তিনি হৃষ্ট মুখে নালিকায় করে গুড় পরিমাপ করছেন, আর কলস ভরছেন, তাঁর মধ্যমপুত্রটিও দ্রোণ নিয়ে কী জানি কী সব মেপে তুলছিল, কহাপনগুলি গণনা করছিল আরেক জন। আমি কিছুতেই সংবাদটা তাঁকে দিতে পারিনি।’
নিশিপাল কোনও কথা না বলে পেছন ফিরে চলতে আরম্ভ করল। নন্দ কয়েকবার ডাকল, ‘নিশিপাল! নিশিপাল!’ নিশিপাল সাড়াও দিল না, ফিরলও না। নন্দ মুখ চুন করে বাড়ির ভেতরে ফিরে গেল। সমস্ত ঘটনাটা পিতাকে পিতামহ বলতে হবে এবার। তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে। পিতামহ যা ক্ৰোধী! তিনি সমস্ত অপরাধ তারই বলে সাব্যস্ত করবেন, তিরস্কার করবেন তাকে সবাইকার সামনে। পিতাও তালে তাল দেবেন।
নিশিপাল এবং তার দলের বৃক্ষচ্ছেদকরা বনের ডালপালা কেটে সমস্ত গ্রামে জোগান দেয়, তাদের অন্নের অভাব হবে না। কটিবস্ত্রটুকুও জুটেই যায়। নন্দদের মুখাপেক্ষী না হলেও তাদের চলবে। তাই-ই শূদ্রের এত সাহস! কিন্তু নন্দ বা তার ভাইয়েরা চাষের কাজ করতে পারলেও, বড় বড় গাছ কাটতে পারবে না। এর জন্য ভাইয়েদের কাছ থেকেও তার ভর্ৎসনা জুটবে মনে হচ্ছে। কারণ পিতামহ নিশ্চয় বলবেন, ‘আমার পিতা তো তোমাদের বয়সে বন কেটেই এই ক্ষেত্র পেয়েছিলেন। দুই পুরুষেই তোমরা এত বলহীন হয়ে পড়োনি যে প্রয়োজন হলে গাছ কাটতে পারবে না।’
এই সময়ে জম্বুকের মাতা ভীষণ কান্নাকাটি করছিলেন। তিনি জম্বুক-পিতা এবং অন্যান্য পরিজনদের বলছিলেন গ্রাম চতুষ্পথের কাছে জম্বুকের দেহাবশেষের ওপর একটি স্তূপ স্থাপন করতে হবে। জম্বুক জীবিত থাকতে কেউ তাকে কোনদিন কোনও সমাদর দেখায়নি। বরং তাকে নিয়ে কৌতুক করেছে, তাকে অবহেলা করেছে। কী রমণী, কী পুরুষ, কী বালক-বালিকা কেউ তাকে কোনদিন সম্মান করেনি। আজ সে সেই অবহেলার ফলস্বরূপ মৃত। একমাত্র একটি স্তূপ স্থাপন করতে পারলেই তার আত্মার শান্তি হবে।
জম্বুককের বড় ভাই বলল, ‘মা আমাদের পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে আমাদের জন্ম মৃত্যু সব হয়। এ জন্মের ভোগভোগান্তি সবই তো পাপের ফল। জম্বুককে অধিক দিন জীবিত থেকে আরও কষ্ট সহ্য করতে হয়নি এ এক পক্ষে তার সৌভাগ্য!’
জম্বুক-মাতা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘কম্মফল! কম্মফল! কম্মফল-টলের কথা আমি জানি না। আমি জানি অসময়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রসব হওয়ার ফলে জম্বুককের মাথায় আঘাত লাগে। তাই সে ওরূপ অল্পবুদ্ধি। তার এখানে দোষ কী? দোষ তো ধাইয়ের, দোষ তো আমার, দোষ তো তোমারও পুত্ত, পুন্নগব্ভা মাতাকে তুমি উদ্যান থেকে অম্ব আনতে পাঠাওনি?’
‘আমি কেন পাঠাবো? তুমি নিজেই তো গাছ থেকে সদ্য পাড়া অম্ব নিয়ে আসবে বলে উদ্যানে গেলে।’
‘তুমি তো আমাকে নিষেধ করতে পারতে, তোমার বধূকে পাঠাতে পারতে! তা তো করনি। মাতার আর কী হবে? এতগুলি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, ওঁর আর কোনও যত্নের প্রয়োজন নেই। এই-ই তো তোমাদের মনোভাব! সন্তান-জন্ম যে কী বত্থু তা তো আর জানো না! হত তোমাদের কুক্ষিতে একটি করেও অন্তত বচ্চ, তো বুঝতে।’
এইভাবে জম্বুক-মাতা কান্নাকাটি, দোষারোপ করতে করতে মৃতপ্রায় হয়ে গেলেন। পুত্ররা কত বোঝালো, স্তূপ একমাত্র মহামুনি, আচার্য এঁদের দেহাবশেষের ওপরেই হয়। তিনি শুনলেন না। অবশেষে তিনি আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেন দেখে, জম্বুক-পিতা গ্রামের চৌমাথায় সত্যিই একটি সুশোভন স্তূপ প্রস্তুত করালেন। গ্রামে কোনও আচার্য ব্রাহ্মণের বাস নেই। তাঁরা থাকলে হয়ত আপত্তি তুললেন। কিন্তু তাঁরা থাকেন উল্টো দিকের গ্রামে। এদিকে তাঁদের এমনিতে আসার কোনও সম্ভাবনাও নেই। বিশেষত চৌমাথায় আরও দুটি স্তূপ রয়েছে। প্রাচীন হয়ে গেছে, ভেঙে ভেঙে গেছে, কিন্তু আছে। এই উপলক্ষে জম্বুক-পিতা সেগুলিকেও সারিয়ে দিলেন। চুনমের প্রলেপ দেওয়া সাধারণ দুটি স্তূপ। কিন্তু জম্বুকের ভূপটিতে সযত্নে কারুকার্য করা। প্রতিদিন তাতে মাল্য দিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে আসেন জম্বুক-মাতা। বলেন সে তো অল্পবুদ্ধি ছিল না। ছিল ক্ষণজন্মা। প্রচ্ছন্ন মহাপুরুষ। সংসারে প্রবেশ করার ভয়ে অল্পবুদ্ধি সেজে থাকত। তিনি নিভৃতে জম্বুকের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় অনেক পেয়েছেন। কেন, গ্রামবাসীরা কি সেই তেমিয় নামে রাজপুত্রের কথা জানে না যিনি রাজকার্য করে কর্মচক্রের জড়িত হবার ভয়ে মূক-পঙ্গু সেজে থাকতেন! জম্বুকও সেই প্রকার।
পক্ষকাল পরে সাকেত থেকে ধনঞ্জয়পুত্রী বিশাখার বিবাহ উপলক্ষে গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ করতে এলেন একজন ব্রাহ্মণ ও একজন লেখক, এঁরা দুজনেই শ্ৰেষ্ঠীর কাছে কর্ম করেন। চৌমাথায় নূতন স্তূপটি দেখে তাঁরা গ্রামবাসীরা জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কার স্তূপ? কেউ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন, মনে হচ্ছে?
গ্রামবাসীরা সসম্ভ্রমে বলল, ‘মহামুনি জম্বুকের। তিনি প্রতিচ্ছন্ন হয়ে সংসারে যাবতীয় কর্তব্য পালন করতেন অল্পবুদ্ধি সেজে। কিন্তু রাত্রিকালে শক্কদেবের সঙ্গে অন্তরীক্ষে বিচরণ করতেন। একটি বৃশ্চিক দংশন করায় তিনি নিদ্রার মধ্যে পা ছুঁড়েছিলেন, তাইতে বৃশ্চিকটির মৃত্যু হয়। বৃশ্চিক তাঁকে এই বলে অভিশাপ দেয়, “আমার গমনপথে বাধাস্বরূপক হয়ে শুয়েছিলি, তাই আমি তোকে দংশন করেছিলাম, তুই পদাঘাতে আমাকে বধ করলি, এই পাপে ওই পায়ে বিষের তীর বিঁধেই তোর মৃত্যু হবে।” জম্বুক মুনি এই অভিশাপ সত্বর সফল করে দুঃখময় মানবজন্ম থেকে মুক্তি পাবার অভিলাষে গভীর বনে গিয়ে বৃক্ষ ছেদন করতেন, এই বৃক্ষতলের রক্ষক বনচররা তাঁকে বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে বধ করে।’
শুনে ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর দূত সেই ব্রাহ্মণ ও লেখক স্তূপটিকে প্রদক্ষিণ করে ভূমিতে শুয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করল। ভক্তিভরে সুগন্ধ মাল্য দিল, দীপ জ্বেলে দিল। তারপর জিজ্ঞাসা করল শ্বেতবর্ণের ওই স্তূপ দুটি কাদের?
গ্রামজনেরা বলল, ‘প্রথমটি সেই বৃশ্চিকের, এবং দ্বিতীয়টি সেই বৃক্ষদেবতার। এঁরা উভয়েই শাপভ্রষ্ট দেবতা ছিলেন।’ তখন এই স্তূপ দুটিকেও যথাবিধি বন্দনা করে শ্রেষ্ঠীর দূতেরা গ্রামে ঢুকে সবাইকে আহ্বান করে শ্রেষ্ঠীর নিমন্ত্রণ জ্ঞাপন করল। তারপর বলল, ‘এ গ্রাম তো পুণ্য গ্রাম, আমরা এসে ধন্য হলাম।’ তারা গ্রামান্তরে চলে গেল। নলকার গ্রাম, লোনকার গ্রাম, কম্মার গ্রাম…এখনও অনেক রয়েছে।
গ্রামণী সেই রাত্রেই সব পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ডেকে সভা করলেন, শ্ৰেষ্ঠীর কন্যার বিয়েতে তো এমনি যাওয়া যায় না। উপহার নিয়ে যেতে হবে। গ্রামস্থ সবাইকেই সাধ্যানুযায়ী কিছু কিছু দিতে হবে। এখন স্থির করা যাক উপহারটি কী হবে! অবশেষে অনেক বাদ-প্রতিবাদের পর স্থির হল একটি সোনার তীরধনুক দেওয়া হবে। তীরটি হবে আধ হাত পরিমাণ। ধনুকটি তদনুযায়ী। এই তীর জম্বুকমুনির মুক্তির স্মৃতির সঙ্গে জড়িত থাকায় পুরস্কারটি যথাযথ হবে বলেই মনে করলেন সকলে। সোনার বৃশ্চিক কিংবা স্ফটিকের স্তূপ দেবার কথাও হয়েছিল। কিন্তু বিবাহে স্তূপ তা যত বড় মুনিরই হোক না কেন, সমীচীন মনে হল না, আর বৃশ্চিকটির ব্যাপারে খুব দক্ষ স্বর্ণকার চাই। অত কুশলী শিল্পী এত শীঘ্র জোগাড় করা যাবে না বলেই সকলে সিদ্ধান্ত করলেন। জম্বুক-পিতা সবচেয়ে বেশি অর্থ ছন্দক (চাঁদা) স্বরূপ দিলেন, নন্দর পিতামহ দিলেন সাধ্যের অতিরিক্ত। বৃক্ষচ্ছেদকদের পল্লী থেকেও নিশিপালের তত্ত্বাবধানে দশটি তাম্র কাহন এলো।
সাকেতের উপকণ্ঠে এই জম্বুক-গ্রামের উপহারটি কনে বিশাখার বড় মনোমত হয়েছিল। অন্য নিরানব্বুইটি গ্রাম থেকে যে নিরানব্বইটি উপহার আসে, শ্বশুরগৃহে যাত্রার সময় সে সমস্তই সে গ্রামবাসীদের উদার হাতে বিলিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সোনার এই তীরধনুকটি দেয়নি। এ যেন তার কৈশোর, তার অভিনব শিক্ষার প্রতীক, এ যেন তার কৌমার, তার স্বাধীনতা, তার আত্মমর্যাদাও। তাই তার শয়নকক্ষের নাগদন্ত থেকে ঝুলত জম্বুক-গ্রামের উপহার স্বর্ণময় তীরধনুক। যাতে সব সময়ে স্মরণে থাকে, সে কে, সে কী চায়! কী ভাবে তার জীবন আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু সে তো কিছুকাল পরের কথা। আগে বিশাখার বিবাহটাই তা হোক! সে তো এক রাজসূয় ব্যাপার!