ফিরে যাবার পালা
বন্দরের কাল হলো শেষ।
এখন ফিরে যাবার পালা। যেসব স্মৃতি নিয়ে ফিরছি তার বেশিরভাগই সুখ স্মৃতি নয়। তবু জানি প্লেনে ওঠা মাত্র মনে হবে কিছু চমৎকার সময় আমেরিকায় কাটিয়ে গেলাম। পাখি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে যায় কিন্তু ফেলে যায় তার একটি পালক।
দেশে রওনা হবার দু’দিন আগে ভ্রাতৃবধূ ইয়াসমিন বলল, দাদাভাই চলুন আপনাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাই যার স্মৃতি অনেক দিন আপনার মনে থাকবে।
কোন জায়গা বলতো?
ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনয়ান ইন্সটিটিউট।
আগে একবার দেখেছি।
চাঁদের মাটি দেখেছেন?
চাঁদের মাটি তো বাংলাদেশেই দেখেছি। উনিশশ সত্তর সনে আমেরিকান এ্যাম্বেসি চন্দ্ৰশীলা নিয়ে এসেছিল।
‘চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়?
যায়। মিউজিয়ামে সেই ব্যবস্থা আছে। যাবেন?
অবশ্যই যাব। চাঁদের মাটি স্পর্শ করা তো চাদকে স্পর্শ করা। এই সুযোগ পাওয়া যাবে তাই তো কখনো কল্পনা করিনি।
আনন্দে আমার চোখ ঝলমল করতে লাগল। ইয়াসমিন হাসতে হাসতে বলল, আমি জানতাম চন্দ্ৰশীলা হাত দিয়ে ছোয়া যায় শুনে আপনি খুব একসাইটেড ফিল করবেন। এই কারণেই সবার শেষে আপনার জন্যে এই প্রোগ্রাম রেখে দিয়েছি।
সারাদিন গাড়ি চালিয়ে বিকেলে পৌঁছলাম মিউজিয়ামে। অনেক কিছুই দেখার আছে সেখানে রাইট ব্রাদার্সের তৈরি প্রথম বিমান, যে লুনার মডিউল চাঁদে নেমেছিল–সেই লুনার মডিউল আরো কত কি…।
কিছুই দেখলাম না, এগিয়ে গেলাম চন্দ্ৰশিলার দিকে।
উঁচু একটি আসনে চাঁদের মাটি সাজানো। উপরে লেখা এই চন্দ্ৰশিলা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে।
আমি এবং গুলতেকিন একসঙ্গে চাঁদের পাথরে হাত রাখলাম। আমার রোমাঞ্চ বোধ হলো। গভীর আবেগে চোখে পানি এসে গেল। কত না পূর্ণিমার রাত মুগ্ধ চোখে এই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় ও আবেগে অভিভূত হয়েছি। সেই চাঁদ আজ স্পর্শ করলাম। আমার এই মানব জীবন ধন্য।
আমেরিকার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধে মন দ্রবীভূত হলো। আমেরিকানদের অনেক দোষ-ত্রুটি, তবু তো এরা আমাকে এবং আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষকে রোমাঞ্চ ও আবেগে অভিভূত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। ধরা-ছোঁয়ার বাইরের যে চাঁদ তাকে নিয়ে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। এই শতক শেষ হবার আগেই তারা যাত্রা করবে মঙ্গল গ্রহের দিকে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে আবারো অভিভূত করবে। আমেরিকা আমি পছন্দ করি না তবু চন্দ্ৰশিলায় হাত রেখে মনে মনে বললাম–তোমাদের জয় হোক।
ইয়াসমিন ক্যামেরা হাতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কোমল গলায় বলল, দাদাভাই হাসুন, আপনাদের ছবি তুলে রাখি। আপনি চাঁদের মাটিতে হাত দিয়ে এমন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?