সানফ্রান্সিসকো থাকার কাল শেষ হয়েছে
সানফ্রান্সিসকো থাকার কাল শেষ হয়েছে, এখন যাচ্ছি নিউ অরলিন্স। গুলতেকিন আমার সঙ্গে যেতে পারছে না তার টিকিট পাইনি। সে চলে যাবে নিউ জার্সি। আমার জন্যে সেখানেই অপেক্ষা করবে। আমি নিউ অরলিন্সে এক সপ্তাহ কাটিয়ে চলে যাব তার কাছে।
আমি তাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এলাম। খুবই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে–শেষ বিদায় দিতে এসেছি। আর দেখা হবে না। তার স্যুটকেস চেক ইন করে দিয়েছি–সে ঢুকবে সিকিউরিটি এলাকায়। খুব মন খারাপ করা মুহূর্ত। এই মুহর্তে হঠাৎ আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে সে বলল, আমার এদেশের একটা জিনিস খুব ভালো লাগে। বিদায় মুহূর্তে এদের স্বামী-স্ত্রীরা কি সুন্দর শালীন ভঙ্গিতে চুমু খায়। তোমার কি এই দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না?
আমি বললাম, হ্যাঁ ভালো লাগে।
আমার সব সময় মনের মধ্যে গোপন বাসনা ছিল
গুলতেকিন তার কথা শেষ করল না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিকিউরিটি এলাকায় ঢুকে গেল। আমি মন খারাপ করে নিউ অরলিন্স রওনা হলাম। মন খারাপ হলেই আমার শরীর খারাপ করে। প্লেনে ওঠার পর পর মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো। এক সময় দেখি নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে।
নিউ অরলিন্সের ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের চমৎকার একটি হোটেলের তিনতলায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম। একবারও ইচ্ছা করল না শহরটা কেমন ঘুরে দেখি। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার ব্যাপারটা কি? কি বিশেষত্ব এই জায়গায় যে আমেরিকান সমস্ত প্রধান লেখকরাই তাদের জীবনের একটা বড় অংশ এখানে কাটিয়েছেন? কি আছে এখানে? হোটেলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের আনন্দ ও উল্লাস ধ্বনি শুনি। পথে পথে হৈচৈ হচ্ছে। জ্যাজ সঙ্গীত হচ্ছে। নাচ হচ্ছে। প্রতিটি কাফে সারারাত খোলা। বার খোলা। মনে হয় এই পৃথিবীতে কোনো দুঃখ নেই।
আমি ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের মতো মজাদার জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি এই খবর রটে গেল। আমার সঙ্গী লেখকরা সব সময় খোঁজখবর নিতে আসছেন। পঁয়তাল্লিশ জন লেখকদের সবাই এখানে এসেছেন। তারা এক ধরনের দায়িত্ববোধ করছেন বাংলাদেশী ঔপন্যাসিকের কি হলো খোঁজ নেয়া। খুবই বিরক্তিকর অবস্থা। অবশ্য তাদের কাছ থেকে কিছু মজার মজার খবরও পাচ্ছি। যেমন ভারতীয় মহিলা কবি গগন গিল ডলার বাঁচানোর জন্যে আলজেরীয় নাট্যকারের সঙ্গে একটা রুম শেয়ার করছেন। একজন অল্পবয়স্কা ভারতীয় মহিলা এ রকম করবেন তা সহজভাবে গ্রহণ করতে একটু বোধহয় কষ্ট হয়। দেখলাম লেখকদের কেউই ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারে নি।
পশ্চিম দেশীয় কোনো তরুণী শয্যাসঙ্গী হিসেবে অল্প পরিচিত কোনো পুরুষকে গ্রহণ করতে হয়তো আপত্তি করবে না। কিন্তু রাতে ঘুমুবার জন্যে একটি আলাদা ঘর চাইবে, প্রাইভেসি চাইবে। যাক এসব ক্ষুদ্রতা, অনা কথা বলি–নিউ অরলিন্সের হোটেল বরবনে রাত্রিবাস আমার একেবারে বৃথা গেল না–মে ফ্লাওয়ার এখানেই লেখা শুরু করলাম। শারীরিক অসুস্থতা ভুলে থাকার এই একটি চমৎকার উপায় লেখালেখিতে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলা। তাই করলাম। দরজা বন্ধ করে সারাদিন লেখার পর দেখি শরীরের ঘোর কেটে গেছে। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে।
রুম সার্ভিসকে কফি এবং খবরের কাগজ দিতে বলেছি। সে নিউইয়র্ক টাইমস দিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখি নিউইয়র্ক টাইমস-এর শেষ পাতায় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হয়েছে। জনতার প্রবল দাবির মুখে প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে তার পালক পুত্র এবং পালক কন্যাসহ গৃহবন্দি আছেন।
বাংলাদেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানতাম না। এই খবরে বিস্ময়ের সীমা রইল না। এত বড় একটা খবর অথচ আমেরিকান পত্রিকায় এত ছোট করে ছাপা হয়েছে দেখেও খারাপ লাগল। ছাত্ররা এত ক্ষমতাবান একজন ডিক্টেটরকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে ফেলেছে। এই ঘটনা চীনের থিয়েনমেন স্কয়ারের চেয়ে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় অথচ কত হেলাফেলার সঙ্গেই না খবরটা এরা ছাপাল। এরশাদের যে একজন পালক কন্যাও ছিল তা জানতাম না–নিউইয়র্ক টাইমসের কল্যাণে জানলাম। পালক পুত্রটির ছবি লক্ষ বার দেখেছি। পলিক কন্যাকে কোনোদিন দেখিনি। এরশাদ নিশ্চয় বলে নি মেয়েটির ছবি ছাপা হোক। তাকে সবাই দেখুক।
কেন জানি ঐ পালক কন্যাটি খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কেমন দেখতে ঐ মেয়েটি? কি তার নাম?