মাইক্রোবাসে করে আমার ডেডবডি
সন্ধ্যা ছয়টা।
মাইক্রোবাসে করে আমার ডেডবডি গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। ড্রাইভারের পাশে বসেছে কাদের। এক দিনে সে বুড়ো হয়ে গেছে। সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না, বাঁকা হয়ে হাঁটছে। কথাও পরিষ্কার বলতে পারছে না। সব কথাই জড়ানো। ধরা পড়ার পর পুলিশ তাকে ভালোমতো ডলা দিয়েছে। নিচের ঠোট কেটে ফুলে উঠেছে। এই ফোলা মনে হয় আরও বাড়বে। সে কেন পালিয়ে গিয়েছিল, এই ব্যাখ্যা রুবিনাকে দিতে গিয়েছিল। রুবিনা বলল, তোমার কথা পরে শুনব। তোমার স্যারের ডেডবডি নিয়ে রওনা হয়ে যাও।
কী নিয়ে রওনা হব, ম্যাডাম?
তোমার স্যারের ডেডবডি।
কাদের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘জি ম্যাডাম।‘ এমনিতেই সে আতঙ্কে ছিল, এখন সেই আতঙ্ক দশ গুণ বাড়ল। চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো।
কাজের মেয়ে সালমা ফিরে এসেছে। যেন কিছুই হয়নি, এই ভাব নিয়ে সে রান্না বসাচ্ছে। একবার এসে বলে গেল, মরা বাড়িতে মাছ খাওয়া নিষেধ। ইলিশ মাছের বদলে ডিমের সালুন করি?
রুবিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যা ইচ্ছা করো।
ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল আমার স্টাডিরুমে। সেখানে সে কী করছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই ঘরটা দেখতে পাচ্ছি না। রুবিনাকে দেখতে পাচ্ছি, সে সন্ধ্যাবেলার শাওয়ার নিচ্ছে। পলিনকে দেখছি, সে কম্পিউটারে গেম খেলছে। গেমের নাম ‘ডায়মন্ড রাশ’। পলিনের সঙ্গে এই খেলা আমিও অনেকবার খেলেছি। অ্যাংকরের গোপন গুহায় ঢুকে হীরা সংগ্রহ করতে হয়। নানা ঝামেলা আছে। মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ে, সাপ এসে ছোবল দেয়। আমি সব ঝামেলা এড়াতে পারি না। পলিন পারে।
আমি এখন শীতার্ত। শরীর থাকলে বলতাম, শীতে শরীর কাঁপছে। শরীর নেই, তার পরও শীতের অনুভূতি। ভয় হচ্ছে, এই শীত কি আরও বাড়বে? যদি আরও বাড়ে, তখন কী হবে? তার চেয়ে বড় চিন্তা, আমার ডেডবডি কবর হয়ে যাওয়ার পর আমার কী হবে? আমার অস্তিত্ব থাকবে, নাকি থাকবে না? কবরে নামানোর দৃশ্য কি আমি দেখতে পাব? এই দৃশ্যটা আমার দেখার শখ আছে।
ইন্সপেক্টর খলিল টেলিফোনে জানিয়েছিল, বড় মামা মারা গেছেন। আমার জন্য এটা ছিল অতি আনন্দের সংবাদ। বড় মামার নিশ্চয়ই আমার অবস্থা হয়েছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।
এখনো সেটা সম্ভব হয়নি। যে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে বড় মামার সঙ্গে আমাকে দেখা করায়নি। সে কি আমাকে নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা করছে? পরিকল্পনাটা কী?
পুরো স্মৃতিশক্তি আমাকে দেওয়া হয়নি। আমাকে বিষ খাওয়ানোর বিষয় আমার মনে নেই। জুঁই নামের যে মেয়েটি রাত তিনটায় রুবিনাকে টেলিফোন করেছিল, তার কথা মনে নেই। পলিনের বাবা কে, তা-ও মনে নেই।
এমনকি হতে পারে যে আমাকে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হচ্ছে? অপ্রয়োজনীয় তথ্য কম্পিউটারের ভাইরাসের মতো। অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রাম। দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে। আদার রিয়েলিটি বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা—সবই হলো ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতো, কম্পিউটারের খেলার মতো ভারচুয়াল গেম। আমরা একজন মাস্টার প্রোগ্রামের তৈরি বিনোদন খেলা।
রুবিনা মেয়েকে নিয়ে চা খেতে বসেছে। রুবিনা যথারীতি এক পট চা নিয়ে বসেছে। পিরিচে কাটা আপেল, মাখন লাগানো টোস্ট বিস্কুট। ছোট্ট গ্লাসে বেদানার রস। রুবিনা চোখমুখ কুঁচকে বেদানার রস খেল। পলিন বলল, বেদানার রস তুমি পছন্দ করো না?
করি তো?
তা হলে খাওয়ার সময় মুখ কুঁচকাও কেন?
রুবিনা বলল, কষ্টা, এই জন্য পছন্দ করি না।
তা হলে খাও কেন?
প্রচুর ভিটামিন-ই আছে, এই জন্য খাই। অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টি আছে।
বেদানার রস খেলে তোমার বয়স বাড়বে না?
ধীরে বাড়বে।
তুমি কি অনেক দিন বেঁচে থাকতে চাও?
সবাই চায়।
আমি চাই না।
অল্প বয়সে মরে যেতে চাও?
হুঁ। ওই লোক বাবার স্টাডিরুমে এতক্ষণ ধরে কী করছে?
রুবিনা চমকে উঠে বলল, বাবা বলছ কেন? তুমি তো ওকে কখনো বাবা ডাকতে না।
মনে মনে ডাকতাম। এখন উনি মারা গেছেন, তাই মনে মনে না ডেকে ঠিকমতো ডাকছি।
তুমি তাকে পছন্দ কর?
হুঁ। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন? ওই লোকটা বাবার স্টাডিরুমে ঢুকে কী করছে?
তার কাগজপত্র, ডায়েরি—এই সব ঘাঁটাঘাঁটি করছে।
কেন?
সে ডিবি পুলিশের লোক। তার ধারণা, তুমি এখন যাকে বাবা ডাকছ, তাকে খুন করা হয়েছে। এই বিষয়ে তদন্ত করছে।
কে খুন করেছে?
এখনো সে বের করতে পারেনি।
বের করতে পারবে?
জানি না পারবে কি না।
শার্লক হোমস থাকলে পারত। শার্লক হোমসের অনেক বুদ্ধি। তুমিও পারবে, তোমার অনেক বুদ্ধি। মা, তুমি কি জান, কে খুন করেছে?
না।
ওই লোক কি জানে?
সে-ও জানে না। তবে তার ধারণা, আমি খুন করেছি।
মা, তুমি কি করেছ?
না, আমি খুন করিনি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করেছ?
পলিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, করেছি। কারণ, তুমি কখনো মিথ্যা বল না।
রুবিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যাকে এখন বাবা ডাকছ, এই মানুষটা পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভালো মানুষ। বিবাহিত জীবনে কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে রাগ করেনি।
বাবা যে ভালো মানুষ, এটা আমি জানি। কম্পিউটার গেমের সাপগুলোও জানে। তারা সহজে বাবাকে ছোবল দিতে চায় না।
আমি এখন আর রুবিনা ও পলিনকে দেখতে পাচ্ছি না। রুবিনা ও পলিন এই মুহূর্তে যে কথাটি বলল, তা আমাকে জানানোর জন্যই হয়তো এই দুজনকে এতক্ষণ দেখছিলাম। আমাকে জানানো শেষ হয়েছে বলে এদের দেখছি না। আমি দেখছি খলিলকে। সে বইয়ের তাকের পেছন থেকে ছোট্ট একটা শিশি উদ্ধার করেছে। শিশির গায়ে লেখা, ‘উইপোকার বিষ’। শিশির অর্ধেকটা খালি। খলিল খুব সাবধানে পলিথিনের ব্যাগে শিশি ভরে পকেটে রাখল। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। যে বিষ খাইয়ে হত্যা করবে, সে বিষের শিশি ফেলে যাবে না। তবে অসম্ভব বুদ্ধিমতী রুবিনা এই কাজটি করতে পারে।
খলিল ভাবছে, এই মহিলার সঙ্গে কথাবার্তায় আরও সাবধান হতে হবে। ছোটখাটো ফাঁদ পেতে একে ধরা যাবে না। তার জন্য লাগবে বড় ফাঁদ। এনায়েতের ব্যাপারটা এই মেয়ে যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে, তা বিস্ময়কর।
খলিল এখন আমার ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছে। এখানে সে কিছুই পাবে না। আমি ডায়েরিতে ব্যক্তিগত কিছুই লেখি না। কোয়ান্টাম জগতের রহস্যময়তা নিয়ে লেখি। অঙ্কের কিছু প্যারাডক্স লেখা হয়েছে। প্যারাডক্সগুলো পলিনের জন্য লেখা। সে অত্যন্ত পছন্দ করে। এই মুহূর্তে খলিল আগ্রহ নিয়ে অঙ্কের একটা প্যারাডক্স দেখছে। আমি লিখেছি:
৩৬ ইঞ্চি=১ গজ
উভয় পক্ষকে ৪ দিয়ে ভাগ দিলাম
৯ ইঞ্চি = ১/৪ গজ
উভয় পক্ষে বর্গমূল করা হলো
৯ = ১/৪
তাহলে দাঁড়ায়
৩ = ১/২
অর্থাৎ ৬ ইঞ্চি = ১ গজ
একটু আগে দেখানো হয়েছে, ৩৬ ইঞ্চি সমান এক গজ। এখন অঙ্কে প্রমাণ করা হলো ৬ ইঞ্চি সমান এক গজ। কী করে সম্ভব?
খলিল মাথা চুলকাচ্ছে। কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। প্যারাডক্স মাথায় ঢুকে গেছে। অতি সামান্য প্যারাডক্সে সে অস্থির, আর আমি ঢুকে গেছি প্যারাডক্সের মহাসমুদ্রে।
খলিল ও রুবিনা বসার ঘরে। রুবিনা ব্যস্ত নখে নেলপলিশ দেওয়া নিয়ে। অ্যাশট্রের এক কোনায় তার ধরানো সিগারেট পুড়ছে। সিগারেটের ভেতর গাঁজা ভরা আছে। বিকট গন্ধ আসছে। রুবিনার হাতে নেলপলিশের ব্রাশ। আমি দুজনকে দেখছি। রুবিনা কী ভাবছে, বুঝতে পারছি না। খলিলের চিন্তা ধরতে পারছি। রুবিনার চিন্তা-কল্পনা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় কি আসবে যে আমি দেখতে পাব; কিন্তু কে কী বলছে, তা শুনতে পাব না? মৃতের জগৎ পরাবাস্তব জগৎ। বাস্তবতা ব্যাপারটাই অবশ্য অত্যন্ত ধোঁয়াটে।
ক্লাসে বাস্তবতা নিয়ে আমি একবার একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল বাস্তবতার বিষয়টি মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করে। রেটিনা থেকে ইনফরমেশন মস্তিষ্কে যায়। মস্তিষ্ক তা প্রসেস করে আমাদের যা দেখায়, তা-ই আমাদের কাছে রিয়েলিটি। প্রসেসিং প্রক্রিয়ায় সামান্য ত্রুটি হলে রিয়েলিটি অন্য রকম হবে। আমরা যা দেখছি, তা-ই বাস্তব মনে করার কিছু নেই। আমাদের মস্তিষ্ক যা ভাবতে বাধ্য করছে, তা-ই বাস্তব।
ক্লাসের একটি মেয়ে প্রশ্ন কলল, স্যার, আমি যে ক্লাসে বসে আছি, এটা কি বাস্তব?
আমি বললাম, তোমার নাম কী?
সে বলল, বকুল।
আমি বললাম, আমাদের মস্তিষ্ক এমন ট্রিক করতে পারে যে ফুলের নামে যাদের নাম, তাদের দেখামাত্র সেই ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করতে থাকবে। মস্তিষ্ক এই রিয়েলিটি তৈরি করছে, যা মূল রিয়েলিটির বাইরে।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাসের একজন ছাত্র মুখ শুকনা করে বলল, স্যার, ওর গা থেকে গোবরের গন্ধ আসছে। সে কি তাহলে গোবর?
সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করল। সবার আগে হাসল বকুল। আমার হাসি এল না। ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রীর হাসির শব্দে মাথা গমগম করতে লাগল।
এখন আবার হাসির শব্দ শুনছি। ত্রিশ-চল্লিশজন ছাত্রছাত্রীর হাসির শব্দ নয়। হাজার হাজার মানুষের চাপা হাসি। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আমি কি অন্য কোনো বাস্তবতায় ঢুকতে যাচ্ছি? হাসির শব্দ ছাপিয়ে রুবিনার গলা শুনলাম, স্টাডিরুমে কিছু পেয়েছেন?
ইনসেকটিসাইডের একটা বোতল পেয়েছি। বোতলে কী আছে, তা জানার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠাব।
খাতাপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু পাননি?
না। আমি আপনার মেয়ে পলিনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
আজ বাদ থাক। আরেক দিন করুন। তার বাবার ডেডবডি সারা দিন বারান্দায় পড়ে ছিল। সে সংগত কারণেই আপসেট।
খলিল বলল, আমি যত দূর জানি, ইফতেখার সাহেব তার বাবা নন।
বাবা না হলেও পলিন তাকে বাবা ডাকা শুরু করেছে। আগে ডাকত না। আজ থেকে ডাকছে। পলিনকে প্রশ্ন না করে আপনি আমাকে প্রশ্ন করুন। যত ইচ্ছা করুন। আমি মিথ্যা কথা বলি না।
যারা মিথ্যা বলে না, তারা খুবই বিপজ্জনক।
কোন অর্থে?
তারা যখন একটা-দুটো মিথ্যা বলে, তখন সেই মিথ্যাকে সত্য ধরা হয়। এক হাজার ভেড়ার পালে একটা নেকড়ে ঢুকে পড়ার মতো। এক হাজার সত্যির মধ্যে একটা মিথ্যা। ভয়ংকর মিথ্যা।
রুবিনা হাসল। খলিলের উপমা তার পছন্দ হয়েছে। খলিল বলল, আপনার সঙ্গে রবিউল সাহেবের যে বন্ধুত্ব, তা আপনার স্বামী কীভাবে দেখতেন?
কোনোভাবেই দেখত না। সে জানত, রবির সঙ্গে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। রবি অতি কর্মঠ একজন। সর্বকর্মে পারদর্শী। তাকে দিয়ে আমি নানা কাজ করিয়ে নিতাম। বিনিময়ে সামান্য অভিনয়।
‘বিনিময়ে সামান্য অভিনয়’ ব্যাপারটা বুঝলাম না।
ভাব করা যে, আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি। হয়তো বা গোপনে ভালোবাসি। বিবাহিত হওয়ায় বাধা পড়ে গেছি। নয় তো তার সঙ্গে ভেগে যেতাম।
অভিনয় করে আপনি কাজ আদায় করে নেন?
অভিনয় ছাড়াও আমি কাজ আদায় করতে পারি, অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারি। যেমন, আপনাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিলাম। আপনি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করলেন, একজন পুলিশ দিলেন। কোনো সমস্যা ছাড়াই আমার স্বামীর ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়ে গেল।
আপনার স্বামী যে রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সে রাতের ঘটনা বলুন। কোনো কিছু বাদ দেবেন না বা কোনো কিছু যুক্ত করবেন না।
ক্ষুদ্র ডিটেইলসও কি বলব?
হ্যাঁ, বলবেন।
রাত ১০টার পর থেকে বলা শুরু করি। তার আগে থেকে বলার কিছু নেই।
করুন। নেলপলিশ দেওয়া শেষ করে বলুন। আমি চাই, কথা বলার সময় আপনি আমার চোখের ওপর চোখ রাখবেন। কেউ অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বললে আমার অস্বস্তি লাগে।
রুবিনা নেলপলিশ দেওয়া শেষ করল। দুই হাত মেলে দেখল, তারপর কথা বলা শুরু করল।
রাত ১০টার মধ্যে আমাদের রাতের খাবার হয়ে যায়। আমরা যে যার মতো আমাদের কর্মকাণ্ড শুরু করি।
ব্যাখ্যা করে বলুন। যে যার মতো কর্মকাণ্ড মানে কী?
রুবিনা সিগারেট ধরিয়ে কথা বলছে, আমি খলিলের চেয়েও অনেক আগ্রহ নিয়ে শুনছি। রুবিনা এখন যা বলছে, তার স্মৃতি আমার নেই। সবই নতুন শুনছি।
রুবিনা বলছে, আমাদের যে যার কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে বলছেন, করছি। আমার মেয়ে পলিন অটিস্টিক। সে অনেক রাত পর্যন্ত জাগে। কম্পিউটারে গেম খেলে। ফেসবুক খুলে বসে থাকে। তার ফেসবুকের বন্ধুর সংখ্যা পাঁচ হাজার আঠারো। এদের প্রত্যেকের নাম সে জানে।
আমার স্বামী স্টাডিরুমের দরজা ভিড়িয়ে বসে থাকেন। বই পড়েন, লেখালেখি করেন। প্রতি রাতে আধঘণ্টা মেডিটেশন করেন। আমি কখনো সেই ঘরে যাই না।
আমি থাকি শোবার ঘরে। বেশির ভাগে রাতে ভূতের ছবি দেখি। ছবি দেখার মাঝখানে একবার এসে বেদানার রস খাই। আমি দুই গ্লাস করে বেদানার রস খাই। সকালে এক গ্লাস, রাতে এক গ্লাস। বেদানার রস খেয়ে পলিনের ঘরে উঁকি দেই। আমাকে দেখে পলিন বলে, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি, প্লিজ। আমি বলি, আই লাভ ইউ।
পলিনের ঘর থেকে নিজের ঘরে আসি। ছবি দেখা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি।
সেই রাতে আমি পার্পল স্কাই নামের একটা ভূতের ছবি দেখছিলাম। ছবির মাঝখানে বেদানার জুস খেতে গিয়ে দেখি টেবিলে জুসের গ্লাস নেই। কাজের মেয়েটা নতুন, সে জুস বানিয়ে তাতে দুই টুকরা বরফ দিয়ে খাবার টেবিলে রাখতে ভুলে গেছে। আমি গেলাম পলিনের ঘরে। পলিন বলল, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। আমি বলি, আই লাভ ইউ।
নিজের ঘরে এসে ছবি শেষ করে ঘুমুতে গেলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, জানি না। ঘুম ভাঙল পলিনের ঝাঁকুনিতে। খোলা দরজা দিয়ে সে ঢুকেছে। আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে।
আমি ধড়মড় করে জেগে উঠে বললাম, কী হয়েছে মা?
পলিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাসায় ভূত এসেছে।
ভূতটা কী করছে?
আমাকে ডিস্টার্ব করছে।
কীভাবে ডিসটার্ব করছে?
গোঁ গোঁ, ঘত ঘত করে শব্দ করছে। দরজায় বাড়ি দিচ্ছে।
চল দেখি।
পলিন বলল, আমি যাব না। তুমি দেখে এসো। ভূতটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আসবে।
আমি পলিনের ঘরে গেলাম। সেখান থেকে গেলাম স্টাডিরুমে। ভূতরহস্য ভেদ হলো। আমার স্বামী মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। গোঁ গোঁ শব্দ মনে হয় সেই এতক্ষণ করছিল। তার ঘরে ভাঙা গ্লাসের টুকরা। টুকরায় বেদানার রস লেগে আছে।
অ্যাম্বুলেন্সের জন্য টেলিফোন করলাম। রবিকে টেলিফোন করলাম। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
খলিল বলল, ডাক্তাররা কি ফুড পয়জনিংয়ের চিকিৎসা করেছে? স্টমাক ওয়াশ করেছে?
না। তারা মাইন্ড স্ট্রোক ধরে নিয়েছে। সেভাবে চিকিৎসা করেছে। আমি যে সত্যি কথা বলছি, এ রকম কি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ। তবে কাজের মেয়েটা নতুন এসেছে, কথাটা তো মিথ্যা। আমি যত দূর জানি, সালমা নামের মেয়েটা আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর জয়েন করেছে। আপনার এই অংশটা কি মিথ্যা নয়?
হ্যাঁ, মিথ্যা।
এই মিথ্যাটা কেন বলেছেন?
জানি না কেন বললাম।
খলিল বলল, আমি জানি। আপনি খুব গুছিয়ে গল্প বলতে গেছেন। গুছিয়ে গল্প বলতে গেলে অপ্রয়োজনীয় জিনিস চলে আসে। আপনারও এসেছে।
হতে পারে।
আপনার মেয়ে পলিন তার বাবাকে খুব পছন্দ করে, আপনি বলেছেন। ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিক।
সে তার বাবার সঙ্গে রাত জেগে কম্পিউটার গেম খেলে।
হ্যাঁ।
তার ঘরের পাশেই তার বাবার স্টাডিরুম। সে ভূতের ভয় পেয়ে তার বাবার ঘরে না গিয়ে আপনাকে কেন জাগাল?
জানি না।
আমার ধারণা, আপনার মেয়ে আপনার কাছে আসেনি। আপনি হরর মুভি দেখেন। ভূতের শব্দ আপনারই শোনার কথা। তা ছাড়া অটিস্টিক শিশুরা ভূত ভয় পায় না, মানুষ ভয় পায়।
রুবিনা কিছু বলল না। সে সামান্য ভয় পাচ্ছে। ঘন ঘন সিগারেটে টান দিতে দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে। খলিল বলল, কাজের মেয়ের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। ওই রাতে আপনার বাসায় কাজের মেয়ে ছিল না, তাই না?
হ্যাঁ।
কাদের কি বেদানার রস বানায়?
না।
তাহলে আমি কি ধরে নিতে পারি, বেদানার রস আপনি বানিয়েছিলেন?
ধরে নিতে পারেন।
আচ্ছা, এ রকম কি হতে পারে, ওই রাতে আপনার বেদানার রস খেতেই ইচ্ছে করছিল না, আপনি স্বামীর কাছে গ্লাস নিয়ে গেলেন। বেদানার রসটা নষ্ট না করে তাকে খেয়ে ফেলতে বললেন।
রুবিনা কঠিন গলায় বলল, আপনি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, ওই রাতে আমি বেদানার রস বানিয়ে তাতে বিষ মিশিয়ে আমার স্বামীকে খাইয়েছি?
আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। আমি অনুমানের কথা বলছি। একটা বিশ্বাসযোগ্য সিনারিও দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। এর বেশি কিছু নয়।
রুবিনা বলল, আজকের মতো জেরা করাটা কি বন্ধ করা যায়?
জেরা করছি না তো। জেরা করবে উকিল। আপনি কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন, উকিল একের পর এক প্রশ্ন করবে। অনেক নোংরা প্রশ্ন করবে। ক্রিমিনাল লইয়াররা রূপবতীদের নোংরা প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। উকিলদের নোংরা প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচার একটা উপায় হচ্ছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া।
রুবিনা বলল, তারপর হাসিমুখে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া।
খলিল বলল, মেয়েদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে আদালত নমনীয় থাকে। আপনি প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে আপনার স্বামী আপনাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। ঘরে রূপবতী স্ত্রী রেখে সে বেশ্যায় গমন করত। কাজের মেয়েদের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। এসব দেখেশুনে আপনার মাথা ঠিক ছিল না। ভেবে দেখবেন। ম্যাডাম, আমি উঠি। আগামীকাল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেবেন। ছোট্ট একটা দুঃসংবাদ আছে। দুঃসংবাদটা কি দেব?
দিন। আপনার সুসংবাদগুলোও দুঃসংবাদের মতো।
খলিল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, খুব বড় দুঃসংবাদ অবশ্য নয়। আপনার স্বামীর ডেডবড়ি নিয়ে যে মাইক্রোবাসটি যাচ্ছিল, সেটি খাদে পড়ে গেছে। কাদেরের ঠ্যাং ভেঙে গেছে। সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
রুবিনা শব্দ করে হেসে ফেলল। আমার নিজেরও হাসি আসছে। রুবিনা হেসে ফেলার কারণ খলিল ধরতে পারছে না। তাকে খানিকটা কনফিউজড় মনে হচ্ছে। কাদের যে কয়বার মাইক্রোবাস বা বাসে করে ঢাকার বাইরে গেছে, সে কবারই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এবং প্রতিবারই তার পা ভেঙেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, নাকি বোধের অগম্য অন্য কিছু?
রুবিনা গা দুলিয়ে হাসছে। এই হাসির একটা নাম আছে, শুধু ঠোটে হাসা না, সর্বাঙ্গে হাসা। শরীর হাসা।
খলিল বলল, আপনার মেয়ে পলিন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। সে কি আপনার আগের হাজব্যান্ডের সন্তান?
রুবিনা বলল, আমি একবারই বিয়ে করেছি। আমার আগের হাজব্যান্ড বলে কিছু নেই।
তাহলে পলিন কে?
পলিন আমার ছোট বোনের মেয়ে। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। পলিনের জন্ম তার জন্য বিরাট সমস্যা হয়েছিল। পলিনকে তার কাছ থেকে নিয়ে আমি আমার বোনকে মুক্তি দেই। পলিন জানে, আমি তার মা।
আপনার ছোট বোনের বিষয়ে বলুন।
সে আমেরিকায় থাকে। বিয়ে করেছে। সুখে আছে। এই হত্যা মামলায় সে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। কাজেই তার বিষয়ে কিছু বলব না।
আপনি পালিয়ে মা সেজেছেন। আপনার স্বামী কেন বাবা সাজলেন না। আমি চাইনি।
আমার স্বামী একজন পবিত্র মানুষ। অপবিত্র কোনো কিছুর সঙ্গে সে যুক্ত হোক, তা চাইনি।
অপবিত্র কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে আপনার আপত্তি নেই, না?
গাড়ি খাদে পড়েছে শুনলে মনে হয় গিরিখাদ। প্রথম যখন শুনলাম আমার ডেডবডি বহন করা মাইক্রোবাস খাদে পড়েছে, তখন ভেবেছিলাম, ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। এখন আমি অকুস্থলে আছি। তেমন কিছু ঘটেনি। রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়ে গিয়েছিল। ধাক্কাধাক্কি করে গাড়ি তোলা হয়েছে। ড্রাইভার স্টার্ট নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইঞ্জিন কিছুটা ঘররর শব্দ করে থেমে যাচ্ছে।
কাদেরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে শুনেছিলাম, এটাও সত্যি নয়। সে কিছুক্ষণ পর পর পা চেপে ধরে গোঙানির আওয়াজ করছে। তার চেহারা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। অক্সিজেনের ঘাটতি হলে মানুষ নীল বর্ণ ধারণ করে। কাদেরের অবশ্যই অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার।
অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শালবনের ভেতরের রাস্তায়। আশপাশে কোনো লোকজন নেই, তবে পুলিশের একটা জিপ এসেছে। মাইক্রোবাস দড়ি দিয়ে জিপের সঙ্গে বাঁধা হচ্ছে। দড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।
মাইক্রোবাস যখন চলে যাবে, তখন আমিও কি তাদের সঙ্গে যাব? নাকি আমি একা পড়ে থাকব শালবনে? কী ঘটবে, কিছুই জানি না। আমার শীতভাব প্রবল ভাবছে। হিমশীতল হাওয়া একটা বিশেষ দিক থেকে আসছে। সেই দিক উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম, কে জানে!
পুলিশের জিপ মাইক্রোবাস নিয়ে চলে গেছে। মাইক্রোবাসের ভেতর আমার ডেডবডি। আমি (বা আমার চেতনা) একা পড়ে আছি। এর কোনো মানে হয়? কতক্ষণ থাকব এখানে?
মৃত্যুর পরের জগতে সময় থাকার কথা নয়। কাজেই কতক্ষণ একা পড়ে থাকব, এই চিন্তাও অর্থহীন। হয়তো অনন্তকাল পড়ে থাকব। সূর্য একসময় বামন নক্ষত্র হয়ে পৃথিবী গিলে খাবে, আমি এখানেই পড়ে থাকব।
যেদিক থেকে হিমশীতল হাওয়া আসছে, সেদিকে আকাশে একধরনের আভা দেখছি। এর মানে কী? হঠাৎ সেই আভার দিকে একধরনের টান অনুভব করলাম। খুব হালকাভাবে কিছু একটা আমাকে টানছে। আমার অনন্ত যাত্রা কি সেই দিকে? কোথায় যাব?
আমি হতাশ গলায় বললাম, এখানে কেউ কি আছেন, যিনি আমাকে সাহায্য করবেন? কথা শেষ হওয়ার আগেই বনের ভেতর থেকে শিয়াল ডাকতে লাগল। শিয়াল প্রহরে প্রহরে ডাকে। এখন কোন প্রহর?
কেউ একজন শিয়ালের ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে ছড়া বলছে—
শিয়াল ডাকে হুক্কাহুয়া
তুহিনদের কাজের বুয়া
তাই পেয়েছে ভয়
তার যত সাহস ছিল
সব হয়েছে ক্ষয়।
জয় শিয়ালের জয়।
ছড়া পাঠ করছে খলিল। আমার অবস্থান এখন খলিলদের বাসায়। খলিলের সামনে পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে। এর নাম নিশ্চয়ই তুহিন। খলিল তার সদ্য লেখা ছড়া মেয়েকে পড়ে শোনাচ্ছে। তুহিনের ছড়া শোনার আগ্রহ নেই। সে রাক্ষসের ছবি আঁকছে।
খলিলের স্ত্রী রান্নাঘরে। সে রান্নার তদারকি করছে। আজ তাদের বাসায় পোলাও, খাসির রেজালা এবং রোস্ট রান্না হচ্ছে। খলিলের স্ত্রীর কিশোরী-কিশোরী চেহারা। নতুন শাড়ি পরায় তাকে সুন্দর লাগছে। আজ তাদের বিয়ের ছয় বছর পূর্তি।
মেয়েটি রান্নাঘর থেকে বলল, তুহিনের বাবা, আজ তুমি কাউকে খেতে বলনি? তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ আসবে না?
খলিল বলল, কিছু কিছু অনুষ্ঠান শুধু স্বামী-স্ত্রীর জন্য। বাইরের কেউ সেখানে থাকবে না।
আমি একগাদা খাবার রান্না করেছি। সব বারই তো তুমি অন্যদের বলতে।
আর বলব না। শুধু তুমি আর আমি।
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, তুমি আসলে ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির কথা ভুলে গেছ। ঠিক বলেছি না?
হুঁ।
ইচ্ছা করলে এখনো বলতে পারো। মাত্র আটটা দশ বাজে।
এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। পাশে এসে বসো।
রান্না দেখাচ্ছি তো।
রান্না কাজের বুয়া যা পারে, দেখবে।
তরুণী সামনে এসে বসল। তুহিন ছবি আঁকা বন্ধ করে মুখ তুলে বলল, বাবা, তোমরা কিন্তু হাত ধরাধরি করবে না। তাহলে আমি রাগ হব।
স্বামী-স্ত্রী দুজনই হাসছে। তুহিন মা-বাবার হাত ধরাধরি ছাড়াই রাগ হয়েছে। সে রাক্ষসের ছবি নিয়ে চলে গেল। খলিল বলল, এশা! বিবাহবার্ষিকী কী জন্য ভুলে গেছি শোনো।
এশা বলল, বাদ দাও তো। বিবাহবার্ষিকী ভুলে যাওয়া তোমার জন্য নতুন কিছু না। প্রথম দুই বছর ছাড়া সব বারই ভুলে গেছ। শেষ মুহূর্তে আমি মনে করিয়ে দিয়েছি।
এবার মনে করিয়ে দিলে না কেন?
সন্ধ্যা ছয়টার সময় অনেকবার টেলিফোন করেছি।
তখন মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। আমি ভয়ংকর এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
ভয়ংকর কেন?
সে তার স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরেছে। তার পরেও কোনো বিকার নেই। তার স্বামীর ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে সে সাজগোজ করছিল।
এশা বলল, বানিয়ে কথা বলবে না তো।
বানিয়ে বলছি না। আমার সামনে বসে নখে নেলপলিশ দিচ্ছিল। আমি হতভম্ব।
এশা বলল, হয়তো তোমাকে হতভম্ব করার জন্যই কাজটা করেছে। মেয়েটা যে খুন করেছে, তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ। সব সন্দেহ রুবিনার ওপর।
রুবিনা নাম?
হুঁ। তার গাঁজা খাওয়ার অভ্যাসও আছে। হোয়াট এ ক্যারেক্টর?
এশা বলল, সাধারণত দেখা যায়, সব সন্দেহ যার ওপর, সে খুন করেনি। যাকে কেউ সন্দেহ করছে না, সে খুন করেছে।
খলিল বলল, গল্প-উপন্যাসে এ রকম দেখা যায়। এ রকম না হলে ডিটেকটিভ গল্প দাঁড়ায় না। বাস্তবে সব সন্দেহ যার ওপর, সে-ই খুনি। রুবিনা কী করেছে শুনতে চাও?
না। বিবাহবার্ষিকীতে খুনখারাবির গল্প কেন শুনব?
খলিল বলল, তাও ঠিক। আচ্ছা যাও, বাদ।
এশা বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তোমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে। বললা, শুনি।
খলিল বলল, রুবিনা উইপোকা মারার বিষয় কিনে এনেছে। উইপোকার বিষয় হলো কঠিন বিষ। বেদানার জুসভর্তি গ্লাসে অর্ধেক বোতল ঢেলেছে। তার স্বামীকে খাইয়েছে।
এশা বলল, রুবিনা দেখতে কেমন?
খলিল বলল, খুনি হলো খুনি। দেখতে রাজকন্যার মতো হলেও খুনি, দাঁত-উঁচা তাড়কা রাক্ষসীর মতো হলেও খুনি।
তার মানে, তোমার এই খুনি খুবই রূপবতী?
হ্যাঁ, রূপবতী। রূপবতীদের নানান ফ্যাকড়া থাকে। স্বামীর বন্ধুদের সঙ্গে প্রেম তাদের একটি। মোটিভ এটাই হবে।
আলোচনার এ পর্যায়ে আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, এশা। তোমার স্বামীর কথা বিশ্বাস করবে না। উইপোকার বিষের বিষয়টা আমার মনে পড়েছে। বিষ আমি আনিয়েছি। বড় মামার ফার্মেসির একটি ছেলেকে দিয়ে কিনিয়েছি। বিষ কিনিয়েছি আর একটা স্প্রে কিনিয়েছি। আমার বইয়ে উইপোকা ধরেছে। উইপোকা মারার জন্য। উইপোকার ওষুধ যেখানে পাওয়া গেছে, স্প্রেটাও সেখানে ছিল।
আমি কথা শেষ করলাম। কথা শেষ করা না-করায় কিছু যায়-আসে না। এশা মেয়েটির সঙ্গে বা জীবিত কারও সঙ্গেই আমার যোগাযোগের ক্ষমতা নেই।
এশা আমাকে চমকে দিয়ে তার স্বামীকে বলল, উইপোকার ওষুধ কেনা হয়েছে বইপত্রে দেওয়ার জন্য।
খলিল বলল, তুমি জানলে কোত্থেকে? তোমাকে কে বলেছে?
এশা বলল, আমাকে কে আবার বলবে? এ রকম মনে হচ্ছে বলে বলছি। ওষুধ যেখানে ছিল, সেখানে স্প্রে ছিল না? থাকার তো কথা।
খলিল চিন্তিত মুখে বলল, হ্যাঁ, ছিল। এখন মনে পড়েছে। তুমি কীভাবে বলছ?
এশা হাসতে হাসতে বলল, আমি প্রায়ই মন থেকে এমন সব কথা বলি, তা সত্যি হয়। তুমি তো এটা জানো।
খলিল হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, এশা! প্লিজ তোমার স্বামীকে বলল, রুবিনা তার স্বামীকে খুন করেনি। কেউ খুন করেনি। এটা ছিল সাধারণ মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক বা অন্য কিছু। বলো এশা, বলো।
এশা বলল, রান্না হতে দেরি হবে। তুমি কি এক কাপ চা খাবে?
না।
খাও, এক কাপ চা। দুজন বারান্দায় বসে চা খাই, চলো। এক কাপ চা বানাব। তুমি একবার চুমুক দেবে। আমি একবার।
আচ্ছা যাও, চা বানাও।
আমি বললাম, চা পরে বানাবে এশা। আগে রুবিনা নির্দোষ, এটা বলো। দেরি করছ কেন?
এশা বলল, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, রুবিনা মেয়েটা নির্দোষ। তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
ভিসেরা রিপোর্টে অরগ্যানো ফসফরাস পাওয়া গেছে।
রিপোর্ট ভুল হয়েছে। আবার পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করো।
দেখা যাক।
দেখা যাক না। ব্যবস্থা করতেই হবে। একটা নির্দোষ মেয়ে ফাঁসিতে ঝুলবে নাকি?
খলিল বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক।
এশা বলল, না, থাকবে না। রুবিনা মেয়েটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর কষ্টে আছে। তুমি তার কষ্ট দূর করো।
কীভাবে?
টেলিফোন করে বলল যে তুমি নিশ্চিত, তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
আমি নিশ্চিত না।
এশা বলল, তুমিও এখন নিশ্চিত। মুখে বলছ, নিশ্চিত না।
আমি বললাম, এশা, তুমি তোমার স্বামীকে বলল, রুবিনার মতো ভালো মেয়ে খুব কম জন্মেছে। তার চেয়ে বড় কথা, সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। সে যদি তার স্বামীকে খুন করত, তাহলে এমনভাবে করত যে তোমার স্বামীর সাধ্যও হতো না খুনের রহস্য উদ্ধারের। এই কথাটা তাকে বলে তারপর চা বানাতে যাও।
এশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, রুবিনা মেয়েটা অতি বুদ্ধিমতী। সে খুন করলে এমনভাবে করত যে তুমি ধরতে পারতে না।
রুবিনা অতি বুদ্ধিমতী, তোমাকে কে বলেছে?
কেউ বলেনি। আমার মন বলছে।
কথা সত্যি। শি ইজ ভেরি স্মার্ট।
খলিল তার স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে। তাদের সামনে এক কাপ চা। সেই কাপে একবার খলিল চুমুক দিচ্ছে, একবার এশা চুমুক দিচ্ছে।
তুহিন রাক্ষসের ছবি নিয়ে বারান্দায় ঢুকল। গাল ফুলিয়ে বলল, তোমরা হাত ধরাধরি করে বসে আছ কেন? হাত ছাড়ো। আমি খুব রাগ করেছি।
খলিল হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এশা বলল, কোথায় যাচ্ছ?
খলিল বলল, রুবিনা ম্যাডামকে একটা টেলিফোন করব।
রুবিনা তার মেয়ের ঘরে বসে আছে। পলিন হীরক সংগ্রহের খেলা খেলছে। একটা ভয়ংকর জায়গা পার হতে পারছে না। দুটা সাপ ছোবল দিয়ে মেরে ফেলছে। পলিন বলল, বাবা থাকলে এই সাপের জায়গাটা পার করে দিত। বাবা পারে, আমি পারি না।
রুবিনা বলল, সে এখন নেই। সাপখোপের জায়গা তোমাকে একাই পার হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গান আছে, একলা চলো, একলা চলো রে। রবীন্দ্রনাথকে চেনো না?
চিনি। সাদা দাড়ি আছে।
রুবিনার টেলিফোন বাজছে। সে টেলিফোন ধরল।
ম্যাডাম, আমি খলিল।
রুবিনা বলল, জানি। আপনার নাম উঠেছে।
আপনাকে টেলিফোন করলাম একটা কথা জানানোর জন্য। আপনি সন্দেহের তালিকায় নেই।
কে আছে, পলিন?
কেউ নেই। আপনার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল থেকে দেওয়া ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেটে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কথা লেখা। ভিসেরা রিপোর্ট মনে হয় ঠিক নয়। ভিসেরা পরীক্ষা নতুন করে করার ব্যবস্থা করছি।
রুবিনা বলল, আমি এখন খেতে যাব। আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
সামান্য বাকি আছে। আজ আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। এই উপলক্ষে আমার স্ত্রী প্রচুর খাবারদাবার রান্না করেছে। মৃত বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের খাবার পাঠানোর প্রাচীন রীতি আছে। আমি কিছু খাবার পাঠাতে পারি?
রুবিনা বলল, পারেন। হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।
হঠাৎ একটা ধাক্কা অনুভব করলাম। সব অস্পষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। যে পরিকল্পনায় আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছে, সে পরিকল্পনার সমাপ্তি হয়েছে।
বুঝতে পারছি, আমাকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাব? জানি না। মানুষ কোত্থেকে এসেছে, তা-ই সে জানে না। কোথায় যাবে, সেটা জানবে কীভাবে?
ইশ, আমার যদি শরীর থাকত, আমি রুবিনার হাতে হাত রাখতে পারতাম। পলিনের কপালে একটা চুমু খেতাম। মেয়েটা সাপের জায়গা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে, তাকে সাপের জায়গাটা পার করে দিতাম।
ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে। ঘণ্টা বেজেই থেমে যাচ্ছে না, অনেকক্ষণ ধরে রিনরিন করছে। ভয়াবহ শৈত্য আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে।
পলিনের আনন্দিত গলা শুনলাম। যে বলল, মা দেখো, আমি সাপের জায়গাটা পার হয়ে গেছি।
রুবিনা কী যেন বলল, তার কথা শুনতে পেলাম না। আমার শব্দ শোনার শক্তি কি নিয়ে নেওয়া হয়েছে? তাহলে ঘণ্টাধ্বনি শুনছি কীভাবে?
চারদিক কেমন জানি গুটিয়ে সিলিন্ডারের মতো হয়ে যাচ্ছে। সিলিন্ডারের শেষ প্রান্তে আলোর বন্যা। সেই আলোর ভয়াবহ চৌম্বক শক্তি। আমি ছুটে যাচ্ছি। আমি পেছন ফিরে বললাম, পৃথিবীর মানুষেরা! তোমরা ভালো থেকো। সুখে থেকো! আমি ছুটে যাচ্ছি আলোর দিকে। আমি জানি, আমাকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। অসীম কখনো শেষ হয় না। তাহলে যাত্রা শেষ হবে কীভাবে?
কে বলে দেবে আমাকে?
.
পরিশিষ্ট
চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর
জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তরা।।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর