নগরের কেন্দ্ৰস্থলে
নগরের কেন্দ্ৰস্থলে প্রায় পাদক্ৰোশ ভূমির উপর মগধের প্রাচীন রাজপুরী। এই পাদক্রোশ ভূমি উচ্চ পাষাণ-প্রাচীর বেষ্টিত। পূর্বদিকে প্রশস্ত রাজপথের উপর কারুকার্যােশাভিত উচ্চ পাষাণ-তোরণ। এই তোরণ উত্তীর্ণ হইয়া প্রথমেই বহুস্তম্ভযুক্ত বিচিত্র দ্বিতল মন্ত্ৰগৃহ। তাহার পশ্চাতে মহলের পর মহল, প্রাসাদের পর প্রাসাদ,-কোনটি কোষাগার, কোনটি অলংকারগৃহ, কোনটি দেবগৃহ, কোনটি চিত্ৰভবন। মধ্যে কুঞ্জবেষ্টিত কমল-সরোবর—তাহাতে সারস মরাল প্রভৃতি পক্ষী ও বহুবর্ণের মৎস্য ক্রীড়া করিতেছে।
সকলের পশ্চাতে শীর্ণ অথচ জলপূৰ্ণ পরিখার গণ্ডিনিবদ্ধ মগধেশ্বরের অন্তঃপুর। সেতু পার হইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে হয়। সেতুমুখে কাঞ্চুকী সেনা অহােরাত্ৰ পাহারা দিতেছে। ভিতরে সুন্দর কারুশিল্পমণ্ডিত উচ্চশীর্ষ সৌধ সকল পরস্পর সংলগ্ন হইয়া যেন ইন্দ্ৰভুবন রচনা করিয়াছে। এখানে সকল গৃহই ত্রিতল, প্রথম তল শ্বেত-প্রস্তরে রচিত, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তল দারুনিমিত।
এই পুরী চন্দ্রগুপ্তের নির্মিত নহে, মৌর্যকালীন প্রাচীন রাজভবন। রাজ্যজয়ের সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র গুপ্ত ইহা অধিকার করিয়াছিলেন। অধিকার করিয়াই রাজপুরীর যাহা সারবস্তু সেই মোহনগৃহ সন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু বহু চেষ্টাতেও তাহা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। মোহনগৃহ রাজভবনের একটি গোপন কক্ষ, দেখিতে অন্যান্য সাধারণ কক্ষের মতোই, কিন্তু ইহার প্রাচীর ও হর্ম্যতলে নানা গুপ্তদ্বার থাকিত। সেই গুপ্তদ্বার দিয়া ভু-নিম্নস্থ সুড়ঙ্গপথে পুরীর বাহিরে যাওয়া যাইত; এমন কি ঘোর বিপদ-আপদের সময় দুর্গের বাহিরে পলায়ন করাও চলিত। এই মোহনগৃহ প্রত্যেক রাজপুরীর একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল; স্বয়ং রাজা এবং পট্টমহিষী ভিন্ন ইহার সন্ধান আর কাহারও জানা থাকিত না। মৃত্যুকালে রাজা পুত্রকে বলিয়া যাইতেন।
এই রাজপ্রাসাদে পূর্ববর্ণিত ঘটনার পরদিন প্ৰভাতে আমি কিছু গোপন অভিসন্ধি লইয়া উপস্থিত হইলাম। সম্মুখেই মন্ত্ৰগৃহ,–বহুজনাকীর্ণ। সচিব, সভাসদ, সেনানী, শ্রেষ্ঠী, বয়স্য, বিদূষক—সকলেই উপস্থিত; সকলের মুখেই দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠার চিহ্ন। চারিদিক হইতে তাহাদের মৃদুজল্পিত গুঞ্জনধ্বনি উঠিতেছে। সভার কেন্দ্ৰস্থলে রত্নসিংহাসনে বসিয়া কেবল মহারাজ চন্দ্ৰগুপ্ত নির্লিপ্ত নির্বিকার। আমি সভায় প্রবেশ করিতে চন্দ্ৰগুপ্ত একবার চক্ষু তুলিয়া আমার দিকে চাহিল—মোহাচ্ছন্ন স্বপ্নাবিষ্ট ভাব-যেন কিছুতেই আসে যায় না। আমি সম্ভ্রম দেখাইয়া অবনত মস্তকে প্ৰণাম করিলম, চন্দ্ৰগুপ্ত ঈষৎ বিরক্তিসূচক ভ্রূকুটি করিয়া মুখ ফিরাইয়া লাইল। আমার হাসি আসিল, মনে মনে বলিলাম, ‘চন্দ্ৰগুপ্ত! যদি জানিতে!…”
রাজ-সম্মুখ হইতে অপসৃত হইয়া ইতস্তত ঘুরিতে ঘুরিতে এক স্তম্ভের আড়ালে সন্নিধাতার সহিত দেখা হইল। সর্বদা রাজ-সন্নিধানে থাকিয়া তাঁহার পরিচযা করা সন্নিধাতার কার্য। নানা কারণে এই সন্নিধাতার সহিত আমার কিছু প্রণয় ছিল; অনেকবার রাজপ্রাসাদের অনেক গূঢ় সংবাদ তাহার নিকট হইতে পাইয়াছি। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলম, “বল্লভ, খবর কি?”
বল্লভ বলিল, “নূতন খবর কিছুই নাই। মহারাজ আজ পত্রচ্ছেদ্যকালে বলিতেছিলেন যে, মোহনগৃহের সন্ধান জানা থাকিলে এ পাপ রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেন।”
আমি বলিলাম, ‘সংসারে এত বৈরাগ্য কেন?”
বল্লভ চোখ টিপিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “সংসারের সকল বস্তুতে নয়!—সে যাক, তোমায় বহুদিন দেখি নাই, সভায় আস না কেন?”
আমি বলিলাম, ‘দিনরাত গৌতম-দ্বারে পাহারা—সময় পাই না।—বিরোধবিমর্ণ কোথায় বলিতে পার? সভায় তো তাঁহাকে দেখিতেছি না।”
বল্লভ বলিল, “মহাবলাধিকৃত উপরে আছেন, সান্ধিবিগ্রহিকের সঙ্গে কি পরামর্শ হইতেছে।” “আমারও কিছু পরামর্শ আছে”—বলিয়া সোপান অতিবাহিত করিয়া আমি উপরে গেলাম। বিরোধবমর্ণ তখন গুপ্তসদস্যগৃহে বসিয়া সান্ধিবিগ্রহিকের সহিত চুপিচুপি কথা কহিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া উভয়ে জিজ্ঞাসু নেত্ৰে আমার দিকে চাহিলেন। আমি কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া বলিলাম, “এরূপভাবে কতদিন চলিবে? দুর্গে খাদ্য নাই, পানীয় নাই; এক দীনারের কমে আঢ়ক পরিমাণ মাধবী পাওয়া যায় না। ঘরে ঘরে লোক না খাইয়া মরিতে আরম্ভ করিয়াছে। যুদ্ধে মরিত কোনও কথা ছিল না; কিন্তু শক্রকে বিতাড়িত করিবার কোনও চেষ্টাই নাই। কেবলমাত্ৰ দুৰ্গদ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিয়া থাকিলে কি ফল দর্শিবে? নাগরিকগণ নানা কথা বলিতেছে—দুৰ্গরক্ষীরাও সন্তুষ্ট নয়।”
আমি বলিলাম, “কাল সন্ধ্যায় চণ্ডপালের মদিরা গৃহে গিয়াছিলাম। সেখানে শুনিলাম, অনেকেই বলাবলি করিতেছে—চন্দ্রবর্মার দিগ্বিজয়ী সেনার বিরুদ্ধে শূন্য উদর লইয়া দুর্গরক্ষার চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। দুর্গ একদিন তাহারা অধিকার করিবেই। সুতরাং বাধা না দিয়া নির্বিবাদে আসিতে দেওয়াই সুবুদ্ধি—তাহাতে তাহাদের নিকট সদব্যবহার প্রত্যাশা করা যাইতে পারে।”
সান্ধিবিগ্রহিক ও মহাবলাধিকৃত দৃষ্টি-বিনিময় করিলেন। বিরোধবর্মা কহিলেন–“চন্দ্রবমর্ণ পাটলিপুত্র অধিকার করিতে পরিবে না, তাহার দিগ্বিজয়যাত্রা এইখানেই শেষ হইবে।”
আমি বলিলাম, “কিন্তু-”
বাধা দিয়া বিরোধবর্মা বলিলেন, “ইহার মধ্যে কিন্তু নাই। জানিয়া রাখ, আজ হইতে দশ দিনের মধ্যে দিগ্বিজয়ী চন্দ্ৰবিমী লাঙ্গুল উচ্চে তুলিয়া মগধ হইতে পলায়ন করিবে। ইচ্ছা হয়, তুমি তার পশ্চাদ্ধাবন করিও।”
ভিতরে কিছু কথা আছে বুঝিলাম। কি কথা জানিবার জন্য পুনশ্চ বলিলাম, “কেমন করিয়া এই অঘটন সম্ভব হইবে জানি না। দশ দিনের মধ্যে নগর শ্মশানে পরিণত হইবে। তখন চন্দ্রবর্মা রহিল কি পলাইল, কে দেখিতে যাইবে?”
কোথা হইতে খাদ্য আসিবে! কিন্তু প্রশ্ন করা সুবিবেচনা হইবে না বুঝিয়া বলিলাম, “কিন্তু খাদ্য পাইলেই কি চন্দ্রবর্মাকে বিতাড়িত করা যাইবে?”
বিরোধবর্মা কহিলেন, “খাদ্যের আয়োজন হইয়াছে, কল্য হইতে সকলে প্রচুর খাদ্য পাইবে।”
আমি বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলাম। ইচ্ছা হইল জিজ্ঞাসা করি, কিভাবে কোথা হইতে খাদ্য আসিবে! কিন্তু প্রশ্ন করা সুবিবেচনা হইবে না বুঝিয়া বলিলাম, “কিন্তু খাদ্য পাইলেই কি চন্দ্রবর্মাকে বিতাড়িত করা যাইবে?”
বিরোধবর্মা বলিলেন, “বলিয়াছি, দশ দিনের মধ্যে চন্দ্রবর্মাকে তাড়াইব।”
“কিন্তু এই দশ দিন প্রজাদের কি বলিয়া বুঝাইয়া রাখিবেন? প্রজা ও রক্ষিসৈন্য মিলিয়া যদি মাৎসন্যায় করে?”
“মাৎস্যন্যায়!”–বিরোধব্যমা গর্জিয়া উঠিলেন, ‘চক্রায়ুধ, যে যোদ্ধা শক্রকে দুর্গ-সমর্পণের কথা চিন্তা করিবে তাঁহাকে শূলে দিব, যে প্রজা মাৎস্যন্যায়ের কথা উচ্চারণ করিবে তাহাকে হাত-পা বাঁধিয়া পরিখার কুম্ভীরের মুখে ফেলিয়া দিব। মাৎস্যন্যায়!—এখনো আমি বাঁচিয়া আছি।” ঈষৎ শান্ত হইয়া বলিলেন, “তুমি যাও, যে জিজ্ঞাসা করিবে, তাহাকে বলিও অন্তরীক্ষপথে বাত আসিয়াছে’, চন্দ্ৰবর্মার উচ্ছেদ হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই।”
অন্তরীক্ষ-পথে! আমি উঠিলাম। উভয়কে প্ৰণাম করিয়া বাহির হইতেছি, সান্ধিবিগ্রহিক আমাকে ফিরিয়া ডাকিলেন। ধীরে ধীরে কহিলেন, “চক্রায়ুধ! যাহা শুনিলে, তাহা হইতে যদি কিছু অনুমান করিয়া থাক, তাহা নিজ অন্তরে রাখিও। মন্ত্রভেদে রাজ্যের সর্বনাশ হয়।”
“যথা আজ্ঞা”—বলিয়া মনে মনে হাসিয়া আমি বিদায় লইলাম।
সেই রাত্ৰিতে মধ্যযাম ঘোষিত হইবার পর সোমদত্তা আবার আসিল। গতরাত্রির সংকেতস্থানে
আমি পূর্ব হইতেই উপস্থিত ছিলাম, প্ৰদীপ হস্তে ধরিয়া ভুবনমোহিনীর ন্যায় আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি দুই বাহু প্রসারিত করিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলাম। সোমদত্তা ভুবনমোহন হাসি হাসিয়া আমার আলিঙ্গনে আত্ম-সমৰ্পণ করিল।
এক রাত্রির মধ্যে কি পরিবর্তন! নারীর মন এমনই বটে—কাল যে ধর্মের জন্য যুদ্ধ করিতেছিল, আজি সে নাগরের প্রেমে পাগল! আমি এমন অনেক দেখিয়াছি, তাই বিস্মিত হইলাম না। স্ত্রীজাতি যখন দেখে কুল গিয়াছে, তখন প্ৰাণপণে নাগরকে ধরিয়া থাকে; দু’কুল হারাইয়া ইতো নষ্ট স্ততোত্ৰষ্ট হইতে চাহে না।
আমি বলিলাম, “সোমদত্তা, চন্দ্ৰগুপ্ত ভিন্ন অন্য পুরুষ পৃথিবীতে আছে কি?”
সোমদত্তা দুই মৃণালভূজে আমার কণ্ঠবেষ্টন করিয়া মুখের অত্যন্ত নিকটে মুখ আনিয়া মৃদু সলজ স্বরে কহিল, “আগে জানিতাম না, এখন বুঝিয়াছি, তুমি ভিন্ন জগতে অন্য পুরুষ নাই।”
সোমদত্তার কথা, তাহার সম্পর্শ, তাহার দেহসৌরভ আমার সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া হর্ষের প্লাবন আনিয়া দিল। অনির্বচনীয় সুখের মাদকতা মস্তিষ্ককে যেন অবশ করিয়া ফেলিল। সৃষ্টির আরম্ভ হইতে এমনই বুঝি নারী পুরুষকে বশ করিয়া রাখিয়াছে!
আমি বলিলাম, “সোমদত্তা, প্ৰিয়তমে, তোমাকে আমি সমগ্রভাবে, অনন্যভাবেই চাই। রাত্ৰিতে চোরের মতো লুকাইয়া এই ক্ষণিকের মিলন—ইহাতে আমার হৃদয় পূর্ণ হইতেছে না।”
সোমদত্তা আমার স্বন্ধে মস্তক রাখিয়া দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, “তাহা কি করিয়া হইবে, প্ৰাণাধিক? আমি যে রাজপুরীর পুরন্ধ্রী—চন্দ্রগুপ্তের বনিতা।”
বহুক্ষণ দুইজনে নীরব রহিলাম। সোমদত্তার মতো নারীকে যে পায় নাই, সে জানে না, তাহার জন্য পুরুষের মনে কি তীব্ৰ—কি দুবার আকাঙক্ষা জাগিতে পারে। আমিও যতদিন তাহাকে দূর হইতে কামনা করিয়াছিলাম, ততদিন তাহার এই দুৰ্নিবার শক্তি অনুভব করি নাই। সোমদত্তাকে লাভ করিবার বাসনা অপেক্ষা তাহাকে একান্তে নিজস্ব করিয়া ভোগ করিবার আকাঙক্ষা শতগুণ প্রবল! তাহার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ আছে, যাহা তাহার অলৌকিক যৌবনশ্ৰীীরও অতীত, যাহা ভোগে অবসাদ আসে না, ঘৃতাহুতির ন্যায় কামনার অগ্নিকে আরও
পারে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, সৃষ্টি রসাতলে পাঠাইতে তিলমাত্র দ্বিধা করে না।
“শত্রুর নিকট কাল কি সংকেত পাঠাইতেছিলে?”
সোমদত্তা আমার স্কন্ধ হইতে মস্তক তুলিল। আমার মুখের উপর দুই চক্ষু পাতিয়া যেন অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত অন্বেষণ করিয়া লইল। সেখানে কি দেখিল জানি না, বলিল, “দুর্গের দুই একটা কথা জানাইতেছিলাম।”
“তাহা না বলিলেও বুঝিয়েছি। কি কথা?”
“নগরে খাদ্য নাই, এই সংবাদ দিতেছিলাম।”
আমি বলিলাম, “ভুল সংবাদ দিয়াছ—কাল প্ৰভাত হইতে নগরে আর অন্নাভাব থাকিবে না।” সোমদত্ত চমকিত হইয়া বলিল, “সে কি! কোথা হইতে খাদ্য আসিবে?”
আমি বলিলাম, “তাহা জানি না! বোধ হয় কোনও সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হইয়াছে। সেই পথে বাহির হইতে খাদ্যাদি। আসিবে।”
“সুড়ঙ্গ? কোথায় সুড়ঙ্গ?”
“তাহা কি করিয়া জানিব? এ আমার অনুমান মাত্র। কিন্তু নিশ্চিত বলিতেছি, নগরে আর দুর্ভিক্ষ থাকিবে না, সে আয়োজন হইয়াছে। শুধু তাই নয়, শীঘ্রই চন্দ্ৰবর্মাৰ্থ বাহির হইতে আক্রান্ত হইবেন-বোধ হয়। বৈশালী হইতে সৈন্য আসিতেছে।”
“সত্য বলিতেছ? আমাকে প্রতারণা করিতেছ না?”
“সত্য বলিতেছি, আজ বিরোধবর্মার মুখে এ কথা শুনিয়াছি।”
সোমদত্ত ললাটে করাঘাত করিল; বলিল, “হায়! কাল এ কথা শুনি নাই কেন? শুনিলে প্ৰাণ দিতাম, তবু…”
সোমদত্ত বিদ্যুদগ্নিপূর্ণ দুই চক্ষু আমার দিকে ফিরাইল। দীর্ঘকাল মৌন থাকিয়া শেষে বলিল, “যাহা হইবার হইয়াছে, ললাট-লিখন কে খণ্ডাইবে? বেশ্যা-কন্যার বুঝি ইহাই প্রাক্তন!”
আমি বাহু দ্বারা তাহার কাটিবেষ্টন করিয়া সোহাগে গদগদ স্বরে বলিলাম, “সোমদত্তা, প্রেয়সী, কেন বৃথা খেদ করিতেছি? তুমি আমার। চক্রায়ুধ ঈশানবম তোমার জন্য অগ্নিতে প্রবেশ কুকুর, জলে ঝাঁপ দিবে। চন্দ্রগুপ্তের কাল পূর্ণ হইয়াছে, তোমার জন্য আমি তার সর্বনাশ করিব।”
“তুমিও চন্দ্রগুপ্তের সর্বনাশ করিবে?”
“করিব। তুমি পারি, আর আমি পারি না? চন্দ্ৰগুপ্ত আমার কে?”
“সখা!”
“সখা নয়। আমি তার প্রমোদের সহচর, স্তাবক সভাসদ, বিট-বিদূষক মাত্র। চন্দ্ৰগুপ্ত একদিন আমার মুখের গ্রাস কড়িয়া লইয়াছিল, আমিও লইয়াছি। যার অঙ্ক’লক্ষ্মীকে কড়িয়া লইয়াছি, তার সঙ্গে আবার সখ্য কিসের? এখন আমরা দুজনে মিলিয়া তার উচ্ছেদ করিব।”
কিছুক্ষণ নিবাক থাকিয়া সোমদত্তা প্রশ্ন করিল, “কি করিতে চাও?”
“শুন বলিতেছি। প্ৰভাতে বিরোধবর্মার মুখে যাহা শুনিয়াছি তাহা হইতে অনুমান হয় যে, আজ হইতে দশ দিনের মধ্যে লিচ্ছবিদেশ হইতে পাটলিপুত্রের সাহায্যার্থে সৈন্য আসিবে-পারাবত-মুখে এই সংবাদ আসিয়াছে। চন্দ্রবমর্ণ যদি পাটলিপুত্র অধিকার করিতে চান, তবে তৎপূর্বেই করিতে হইবে, লিচ্ছবিরা আসিয়া পড়িলে আর তাহা সুসাধ্য হইবে না। তখন নিজের প্রাণ লইয়া টানাটানি পড়িয়া যাইবে। এদিকে নগরের খাদ্যাভাবও ঘুচিয়াছে, সুতরাং বাহুবলে এই দশ দিনের মধ্যে দুর্গ জয় করা অসম্ভব। এরূপ ক্ষেত্রে উপায় কি?”
“কি উপায়?”
“বিশ্বাসঘাতকতা।”
“কে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে?”
“আমি করিব। কিন্তু পরিবর্তে চন্দ্ৰাবামা আমাকে কি দিবেন?”
“যাহা পাইয়াছ তাহাতে তৃপ্তি নাই?”
“না। কাল বলিয়ছিলাম বটে, রাজ্য সিংহাসন চাহি না, কিন্তু তাহা ভুল। রাজ্য না পাইলে তোমাকে পাইয়াও আমার অতৃপ্তি থাকিয়া যাইবে। তুমি রাজ-ঐশ্বর্যের স্বাদ পাইয়াছ—অল্পে কি তোমার মন উঠিবে?”
“তা বটে, অল্পে আমার ক্ষুধা মিটিবে না!…কৃতঘ্নতার মূল্য কি চাও?”
“আমি সব স্থির করিয়াছি। তুমি দীপসংকেতে চন্দ্রবর্মাকে সমস্ত সংবাদ দাও,—জানাও যে বিশ্বাসঘাতকতা ভিন্ন দুর্গ অধিকার হইবে না। তাঁহাকে এ কথাও বল যে, একজন দ্বারপাল সেনানী দুৰ্গদ্বার খুলিয়া দিতে প্ৰস্তুত আছে, কিন্তু পুরস্কারস্বরূপ তাহাকে মগধের সিংহাসন দিতে হইবে।”
সোমদত্তা প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর হাসিয়া উঠিল। দীপের কম্পমান আলোকে সে হাসি অদ্ভুত দেখাইল। বলিল, “বেশ, বেশ! আমিও তো ইহাই চাহিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম পিতাকে তুষ্ট করিয়া এক জনের জন্য মগধের সিংহাসন ভিক্ষা মাগিয়া লইব, এক স্পর্ধিতা দুবিনীতা নারীর দৰ্পচূৰ্ণ করিব। কিন্তু এই ভালো। তোমার ও আমার ষড়যন্ত্রে পিতা দুর্গ অধিকার করিবেন, তারপর তুমি সিংহাসনে বসিবে, আর আমি—আমি তোমার পট্টমহিষী হইব। এই ভালো!”—বলিয়া সোমদত্তা আবার হাসিল।
আমি বলিলাম, ‘চন্দ্ৰগুপ্তকে হত্যা করিতে হইবে। তাহকে বাঁচিতে দিয়া কোনও লাভ নাই। পরে গণ্ডগোল বাধিতে পারে। একটা সুবিধা আছে, চন্দ্ৰগুপ্ত পলাইতে পরিবে না, সে মোহনগৃহের সন্ধান জানে না।”
চন্দ্রগুপ্তের প্রতি সোমদত্তার মনে কোনও মমতা আছে কি না দেখিবার জন্য এই কথা বলিয়াছিলাম। দেখিলাম, তাহার মুখে করুণার ভাব ফুটিয়া উঠিল না, বরঞ্চ মুখ ও অধরোষ্ঠ আরও কঠিনভাব ধারণ করিল। সে স্থির নিষ্করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া রহিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মোহনগৃহ কি?”
মোহনগৃহ কি, বুঝাইয়া দিলে সোমদত্তার মুখে কিছু উৎফুল্লতা দেখা দিল। সে আমার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া বলিল, “প্রিয়তম, চন্দ্ৰগুপ্ত ও কুমারদেবী পুত্ৰ লইয়া পলাইবে, এই কথা ভাবিয়া আমার মনে সুখ ছিল না; এখন নিশ্চিন্ত হইলাম। ভাবিও না, তোমাতে আমাতে নিরাপদে রাজ্যসুখ ভোগ করিব।”
“আর চন্দ্ৰগুপ্ত?”
“সে ভার আমার। আমি তার ব্যবস্থা করিব।”
ঊষার সূচনা করিয়া শীতল বায়ু আমাদের অঙ্গ স্পর্শ করিয়া গেল। পূর্বগগনে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়প্ৰাপ্ত শশিকলা রোগপাণ্ডুর মুখ তুলিয়া চাহিল। আমি বলিলাম, ‘আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই, রাত্ৰি শেষ হইয়া আসিতেছে, এই বেলা সংকেত পাঠাও।”
সোমদত্তা প্ৰদীপ লইয়া প্রাকারের প্রান্তে গিয়া দাঁড়াইল। প্রসারিত-হস্তে কিছুক্ষণ প্ৰদীপ ধরিয়া থাকিয়া মুখে নিশাচর পক্ষীর মতো একপ্রকার শব্দ করিল। উৎকৰ্ণ হইয়া শুনিলাম, পরিখার পরপর হইতে অস্পষ্ট উত্তর আসিল। তখন সোমদত্তা প্ৰদীপ ধীরে ধীরে সঞ্চালিত করিতে লাগিল। তাপসীর মতো আত্মসমাহিত মুখ, নিশ্চল তন্ময় চক্ষু, সোমদত্তা দীপরশ্মির সাহায্যে সমস্ত সংবাদ বাহিরে প্রেরণ করিল।
সংবাদ শেষ হইলে বাহিরের অন্ধকার হইতে আবার শব্দ আসিল—এবার পাপিয়ার উচ্চতান–শব্দ স্তরে স্তরে উঠিয়া ঊর্ধ্বে বায়ুমণ্ডলে বিলীন হইয়া গেল।
সোমদত্তা প্ৰদীপ নামাইয়া বলিল, “কল্য উত্তর পাইবে।”