Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃন্ময়ী (২০০১) || Humayun Ahmed » Page 7

মৃন্ময়ী (২০০১) || Humayun Ahmed

আকাশে মেঘ করেছে

আকাশে মেঘ করেছে। শহরের মানুষ চারদিকে তাকায়, আকাশের দিকে তাকায়। না। কখন আকাশে মেঘ করে কখন মেঘ কেটে যায় বুঝতেই পারে না। আজ মেঘ করেছে আয়োজন করে। যেন মেঘমালা উঁচু গলায় বলছে হে নগরবাসী! তাকাও আমার দিকে।

নগরবাসী মেঘ দেখছে কি-না আমি জানি না। তবে আমি দেখছি। মনে হচ্ছে আজ ঘন বৰ্ষণ হবে। এই বৰ্ষণ দিয়েই কি আষাঢ়ের শুরু?

আমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। শহরে খুব ডেঙ্গুর উপদ্রপ। জ্বর হলেই সবাই আঁতকে উঠে ভাবে ডেঙ্গু না-কি? আমার সে রকম কিছু হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে ডেঙ্গু হলে ভালোই হয়। কিছু দিন হাসপাতালে কাটিয়ে আসা যায়। সম্পূর্ণ নতুন কোনো পরিবেশ। এই পরিবেশে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না। দম বন্ধ লাগছে।

নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের নানান অবস্থা থাকে শুককীট, মূককীট, পতঙ্গ। একটা অবস্থার সঙ্গে অন্য অবস্থার কোনো মিল নেই। মানুষের জন্যে এ রকম ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। কিছু দিন সে একটা অবস্থায় থাকল, একদিন হঠাৎ বদলে অন্য রকম হয়ে গেল। অন্য একটা জীবন। আগের জীবনের সঙ্গে কোনো মিল থাকল না।

বাড়িতে আমি একা। বাবা সিলেটে, তার চা বাগানে কী যেন সমস্যা হয়েছে। তিনি গেছেন সমস্যা মিটাতে। এক সপ্তাহ সেখানে থাকবেন। মা গেছেন শুটিং-এ। আজ তার মোজা বোনার অংশটা রেকর্ড করা হবে। কাজ কী রকম হচ্ছে একটু পরে পরেই তিনি টেলিফোন করে জানাচ্ছেন বুঝলি মৃ, মেকাপ দিয়েছে। ঠোঁটে দিয়েছে কড়া লাল লিপস্টিক। আমি বললাম, একজন বয়স্ক মহিলা এমন গাঢ় রঙের লিপস্টিক পরবেন? আমার কথায় মেকাপম্যান। এমনভাবে তাকাল যেন আমি ব্লাসফেমি করেছি। তারপর বলল ঠোঁটে লিপস্টিক না দিলে টিভির পর্দায় ঠোট শাদা দেখাবে। আমি চুপ করে রইলাম। ওদের কাজ ওরাই তো ভালো জানবে। স্টিল ক্যামেরাম্যান ছবি তুলেছে। আমি তাকে বলেছি আমার একটা ছবি টেন টুয়েলভ সাইজ করে আমাকে দিতে। অভিনয়ের স্মৃতি থাকুক। কী বলিস?

মার কথা শুনে আমার হিংসা হচ্ছে। তিনি তাঁর জীবনটা সুখেই কাটিয়ে দিচ্ছেন। সব কিছুর মধ্যে থেকেও তিনি কোনো কিছুর মধ্যেই নেই। ভাইয়া হাজতে আছে, তাকে একদিনও দেখতে যান নি। তার প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেন নি। যেন এ রকম কিছুই ঘটে নি। সংসার আগে যেমন চলছিল এখনো

সে রকমই চলছে।

আমি একদিনই ভাইয়াকে দেখতে গিয়েছি। পুলিশ অফিসার আমার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেছেন। আমাকে হাজতে লোহার শিক ধরে ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে হয় নি। একটা আলাদা ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছে। ভাইয়াকে আনা হয়েছে সেখানে। আমাদের জন্যে কেক এবং চা দেওয়া হয়েছে।

ভাইয়া আমাকে দেখে হাসল। আমি বললাম, কেমন আছ?

ভাইয়া তার জবাবেও হাসল। তার গালে খোচা খোঁচা দাড়ি। চুল আঁচড়ানো নেই। তারপরেও তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। ভাইয়ার কারণে যেন ঘরটা আলো হয়ে গেছে। আমি বললাম, তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?

ভাইয়া বলল, না। তবে রাতে খুব মশা কামড়ায়। এখানে মশারির ব্যবস্থা নেই। কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। এতে কাজ হয় না। কয়েলের গন্ধে দল বেঁধে মশা আসে।

আমি বললাম, তুমি তস্তুরী বেগমকে একটা জিনিস রাখতে দিয়েছিলে সেটার কী হবে?

ভাইয়া আবারো হাসল। এই হাসির নিশ্চয়ই কোনো মানে আছে। আমি মানে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এই প্রসঙ্গ নিয়ে সে কথা বলতে চাচ্ছে না।

আমি বললাম, তোমার মাকে কি খবর দেব ভাইয়া? তিনি এসে তোমাকে দেখে যাবেন।

না।

কোঁকড়া চুলের তোমার ঐ বন্ধুটাকে আমার খুব দরকার। ওকে কোথায় পাব বলতে পারো?

না।

ঠিকানা জানোনা?

ওর কোনো ঠিকানা নেই।

নামটা বলে।

নাম দিয়ে কী হবে?

কিছুই হবে না। নাম জানতে ইচ্ছা করছে।

ওর নাম টুলু।

ভাইয়া খুব আগ্রহ করে চায়ে ডুবিয়ে কেক খাচ্ছে। তার ঠোঁটের কোনায় হাসি লেগেই আছে। আমি বললাম, ভাইয়া তুমি আমাকে একটা কথা বলে তো— তুমি কি তোমার বন্ধুদের মতো বড় ধরনের কোনো অপরাধ করেছ?

ভাইয়া চা-য়ে চুমুক দিয়ে বলল, তোর কী মনে হয়?

আমি সহজ গলায় বললাম, আমার এখন তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি করেছ। শুধু যে করেছ তা না, তুমি ওদের লীডার জাতীয় কেউ। আড়ালে বসে সুতা খেলাও।

ভাইয়া আবারো হাসল। আমি বললাম, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি।

ভাইয়া বলল, যে আমাকে যা ভবে আমি সে রকম।

আমি বললাম, এটা তো প্রশ্নের উত্তর হলো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম নেপাল দেশটা কোথায়? তুমি বললে যেখানে নেপালের থাকার কথা সেখানে।

তুই খুব সুন্দর করে কথা বলিস, তোর খুব বুদ্ধি।

তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দেবে না?

এখন দেব না। কোনো একদিন হয় তো দেব। কিংবা জবাব দিতে হবে না। নিজেই জবাব পেয়ে যাবি।

আমি ভাইয়ার দিকে ঝুঁকে এসে বললাম, তুমি কি জানো ছোটবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল?

ভাইয়া সহজ গলায় বলল, জানি। আজহার চাচার ছেলের সঙ্গে। ওটা তো বিয়ে না। বিয়ে বিয়ে খেলা।

সব কিছুই তো খেলা।

তোর মতো বুদ্ধি আমার নেই। ফিলসফির কথা আমি কিছুই বুঝি না। তবে এই বিয়ে নিয়ে তুই মোটেও চিন্তা করবি না। ওটা কোনো ব্যাপার না। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তুই তোর ঐ টিচারটাকে বিয়ে করে ফেল।

টিচারের কথা তুমি জানলে কীভাবে?

ভাইয়া আবারও হাসল। আমি বললাম, ভাইয়া তুমি ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ বসে থাক। কিন্তু তুমি অনেক কিছু জানো। তাই না?

তা জানি। মৃ শোন, ছোটবেলার বিয়েটা নিয়ে তুই মোটেও ভাববি না। বাবা তোকে পাগলের মতে ভালবাসেন। তোর কোনো রকম সমস্যা বাবা হতে দেবেন না। এই বিষয়টা নিয়ে তুই আর ভাববি না।

আমি নিচু গলায় বললাম, ব্যাপারটা ভুলতে পারছি না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনোদিন যদি আজহার চাচার ছেলেটা এসে বলে, মৃন্ময় এসো তোমাকে নিতে এসেছি। তাহলে আমি তার সঙ্গে চলে যাব।

পাগলের মতো কথা বলবি না।

যেটা সত্যি আমি সেটাই বলছি।

অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। এখন বাসায় যা। মাথা ঠিক রাখ। ভালো কথা, টুনু এসে আমার জিনিসটা নিয়ে যাবে।

কবে আসবে?

আসবে কোনো একদিন। আজও আসতে পারে।

ভাইয়া, সেও কি তোমার মতো? প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না।

প্রশ্ন করে দেখিস। সে তোকে খুব পছন্দ করে। তুই না-কি একদিন তাকে খুব যত্ন করে ভাত খাইয়েছিলি।

হ্যাঁ।

ঘটনাটা বলতে বলতে টুনু কেঁদে ফেলেছিল। কেঁদে ফেলে সে নিজের উপর খুবই রেগে গেল। তারপর করল কী ঠাশ ঠাশ করে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলল। হা হা হা।

এর মধ্যে হাসির কিছু নেই ভাইয়া, আসবে না।

আচ্ছা যা হাসব না।

ভাইয়া তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি কোথায় যাব জান?

জানি না তবে অনুমান করতে পারি।

আচ্ছা অনুমান কর তো দেখি।

প্রথম যাবি শালবনের দিকে। কিছুক্ষণ একা একা ঘুরবি। হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। তারপর যাবি আজহার চাচার কাছে। এটা কি হয়েছে?

হ্যাঁ এটাও হয়েছে। আর কোথায় যাব বল। শেষটা বলতে পারলে আমি ধরে নেব তোমার ইএসপি পাওয়ার আছে।

তুই আমার মা-কে দেখতে যাবি। হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। মা-র সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিস কেন?

এম্নি। কোনো কারণ নেই। তুমি বাবার কাছ থেকে কতটুকু পেয়েছ, আর মা-র কাছ থেকে কতটুকু পেয়েছ এটা আমার জানার শখ।

একদিন দেখেই সব বুঝে ফেলবি?

না তা বুঝব না। তবে চেষ্টা করে দেখব।

ভাইয়া হাসিমুখে বসে আছে। পা নাড়ছে। মনে হলো হাজত ঘরে থেকে সে খুব মজা পাচ্ছে।

হাজত থেকে বের হয়েছি। ওসি সাহেব আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছেন। স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ থেকে তিনি যে এটা করছেন তা মনে হচ্ছে না।

ম্যাডাম আপনি আপনার ভাই এর ব্যাপারে মোটেও চিন্তা করবেন না।

আমি চিন্তা করছি না।

তাকে যতটুকু সুবিধা দেয়া যায় আমরা দিচ্ছি।

আমি গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম, কেন দিচ্ছেন?

ওসি সাহেব প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মনে হলে তিনি কেমন যেন। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন। তিনি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, ম্যাডাম আপনার যখনই ভাইকে দেখতে ইচ্ছা করলে আপনি চলে আসবেন। আমি যদি নাও থাকি অসুবিধা হবে না। আমি ইন্সট্রাকশান দিয়ে দেব।

থ্যাংক য়্যু।

আমার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ওসি সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সুন্দর একজন মানুষ। পুলিশের পোশাক ফেলে পায়জামা পাঞ্জাবি পরলেই তাঁকে মনে হবে কোনো এক প্রাইভেট কলেজের বাংলার অধ্যাপক। পুলিশ এবং মিলিটারিদের যেমন পোশাক আছে অন্য সবারই তেমন পোশাক থাকলে। ভালো হতো। পোশাক দেখেই বোঝা যাবে তার পেশা কী। শুধু পুলিশ এবং মিলিটারিদের আমরা চিনব আর অন্যদের চিনতে পারব না, তা কেন হবে? কেরানিদের এক রকম পোশাক হবে, বড় সাহেবদের আরেক রকম, সন্ত্রাসীদের আরেক রকম। আমরা সবাই সবাইকে চিন। কোনো রাখ ঢাক থাকবে না।

আপা কোনদিকে যাব?

আমি ঠিকানা দিয়ে দিলাম। ভাইয়ার মা-র ঠিকানা। দ্রমহিলাকে আমি কী ডাকব? মা ডাকব? নাকি অন্য কিছু?

ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। দুবার সে মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। আমাকে কি খুব দুঃশ্চিন্তাগ্ৰস্ত মনে হচ্ছে? অস্বাভাবিক লাগছে? নিজের মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করছি। ভাইয়ার মা-র কাছে এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে। না। উনার কাছে কেন যেতে চাচ্ছিলাম তাও বুঝতে পারছি না।

অপরিচিত একজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্যে কি যেতে চাচ্ছিলাম? হতে পারে। বিশেষ বিশেষ সময়ে নিতান্ত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। নিতান্ত অপরিচিত জনকে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা গোপন কথা বলে ফেলা। এই ভরসায় বলা যে এর সঙ্গে বাকি জীবনে আর কখনো দেখা হবে না।

বিদেশে এমন ব্যবস্থা আছে। টেলিফোনে কথা বলার সঙ্গী। কাউন্সেলার। কোনো একটা সমস্যা হলো। টেলিফোনে বিশেষ বোতাম টিপলেই মনোেযোগী শ্রোতা পাওয়া যাবে যে উপদেশ দেবে। উপদেশ না চাইলে শুধুই শুনবে। বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা থাকলে আমি টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে হড়বড় করে অনেক কথা বলতাম।

এই যে শুনুন হ্যালো, আজ আমার খুব মন খারাপ।

খুব কি বেশি খারাপ?

হ্যাঁ খুব বেশি খারাপ। এখন আমি গাড়িতে বসে আছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

গাড়ি করে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

একজন মহিলার কাছে যাচ্ছি।

আপনার প্রিয়জনদের কেউ?

না তার সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখা হয় নি। আজ প্রথম দেখা হবে।

আপনার কি ধারণা তার সঙ্গে দেখা হলে আপনার মন খারাপ ভাবটা কমবে?

আমার কোনো ধারণা নেই।

কী নিয়ে আপনার মন খারাপ সেটা কি আপনি বলবেন?

না বলব না।

ড্রাইভার ব্রেক কষে গাড়ি থামাল। আমরা মনে হয় এসে পড়েছি। আমার গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। কী হবে নেমে? আমি বললাম, ড্রাইভার সাহেব শালবনের দিকে চলুন। আমার ঘুম পাচ্ছে। আধো ঘুম, আধো জাগরণে আমি গা এলিয়ে পড়ে আছি।

টুনু নামের ছেলেটা জিনিসটা নিতে এলো সেদিনই। কী সহজ সরল মুখ। লাজুক ভঙ্গি। ভাইয়ার ঘরে বসেছিল, আমাকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়াল। যেন সে স্কুলের ছাত্র। আমি সেই স্কুলের হেড মিসট্রেস।

আমি বললাম, জিনিসটা আপনার?

সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, নতুন কোনো এসাইনমেন্টে যাচ্ছেন? কত টাকার এসাইনমেন্ট?

সে জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, একটা কাজে আপনি কত টাকা নেন জানতে পারি?

সে বলল, আমি যাই।

ভাইয়া তো ঘরে নেই। আপনার যত্ন করারও কেউ নেই। আমি আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারি। না-কি আপনাকে এক্ষুণি যেতে হবে? আপনার কি খুবই তাড়া?

সে আবারো বলল, আমি যাই।

যাই যাই করছেন কেন? কিছুক্ষণ গল্প করুন। না-কি পুলিশ আপনাকে ফলো করছে?

কেউ ফলো করছে না।

একটা কথা শুধু বলে যান, ভাইয়াও কি আপনার মতো একজন?

আমি যাই।

আচ্ছা যান।

আমি মাথা ঠিক রাখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচদিন ধরে ক্লাসে যাচ্ছি না। আমার কী হয়েছে জানতে চেয়ে একের পর এক টেলিফোন আসছে। সেইসব টেলিফোন ধরছে তস্তুরী বেগম। সে সবাইকে বলছে আফা সিলেটে গেছেন। তার বাবার সাথে। কবে আসবে কোনো ঠিক নাই।

তারা সবাই তস্তুরী বেগমের কথা মেনে নিয়েছে। একজন শুধু মানে নি। সে বলেছে— মৃন্ময়ী বাসাতেই আছে। আপনি তাকে দিন। অসম্ভব জরুরি। টেলিফোন আমাকে ধরতে হলো। স্যার টেলিফোন করেছেন। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী হয়েছে?

আমি বললাম, কিছু হয় নি। শরীর খারাপ। জ্বর। মনে হচ্ছে ডেঙ্গু হয়েছে। সব লক্ষণ ডেঙ্গুর মতো।

আমি কি ডেঙ্গু রোগীকে দেখতে আসতে পারি?

এখন পারেন না। আমি একটা ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করছি। যদি সমাধান করে ফেলতে পারি তাহলে আসতে পারেন। খুবই কঠিন ধাধা।

ধাঁধাটা আমাকেও বলে। এসো আমরা দুজনে মিলে সমাধান বের করি।

এই ধাঁধা আমাকেই সমাধান করতে হবে।

মৃন্ময়ী তুমি কেমন আছ বলে তো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি খুব ভালো নেই।

ঠিক ধরেছেন। আমি ভালো নেই।

তুমি চাইলে ভালো থাকার একটা মন্ত্ৰ আমি তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারি।

শিখিয়ে দিন।

সব কিছু সহজভাবে নেবে। যা হবার তাই হচ্ছে। বেশিও হচ্ছে না, কমও হচ্ছে না। নিয়তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

যে নিয়তিবাদী না, তার পক্ষে এমন দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া কি সম্ভব?

নিয়তিবাদী হয়ে যাও।

আপনি কি নিয়তিবাদী?

হ্যাঁ। মৃন্ময়ী শোনো, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। তুমি আমাকে সুযোগ দাও।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, নিয়তিতে যদি লেখা থাকে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন তাহলে সাহায্য করবেন। যদি এ রকম কিছু লেখা না থাকে তাহলে সাহায্য করতে পারবেন না। স্যার আমি রাখি?

আরেকটু কথা বলো।

নিয়তি বলছে এখন আর কথা হবে না।

আমি টেলিফোন রেখে দিলাম।

আমি আকাশ দেখছি। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। বর্ষার নবধারা জলে স্নান করতে পারলে ভালো হতো। মনের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে যেত। সেটা সম্ভব না। আমার জ্বর খুব বেড়েছে। তস্তুরী বেগম খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাথায় পানি ঢালতে চায়। ডাক্তার ডাকতে চায়। আমি পাত্তা দিচ্ছি না। জ্বর গায়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করছি।

একটু আগে বাবা সিলেট থেকে টেলিফোন করেছিলেন। উদ্বিগ্ন গলায় বলেছেন–মৃ আজকের খবরের কাগজ দেখেছিস।

আমি সহজ গলায় বললাম, দেখেছি।

বাবা বললেন, আমি প্লেনের সেকেন্ড ফ্লাইট ধরে ঢাকায় চলে আসছি। কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবি না।

আচ্ছা।

খবরটা পড়ে তুই কি বেশি রকম আপসেট হয়েছিস? তোর গলা এরকম শুনাচ্ছে কেন?

বাবা আমার জ্বর। জ্বরের কারণে গলা এরকম হয়ে গেছে।

আমি দুপুরের মধ্যে চলে আসব। তুই মোটেও আপসেট হবি না।

আমি আপসেট না বাবা। আমি নিয়তীবাদী হয়ে গেছি। নিয়তিবাদী মানুষ আপসেট হয় না। বাবা এই ঘটনাটি তুমি ঘটিয়েছ? এন্ড গেমে জয়লাভ হয়েছে।

বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, কী আজেবাজে কথা বলছিস? এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠিয়ে দে। তোর মা কোথায়?

মার নাটকের শুটিং চলছে বাবা। তিনি শুটিং-এ গেছেন।

খবরের কাগজ কি তোর মা দেখেছে?

দেখেছেন হয়তো। মা নিয়মিত কাগজ পড়েন।

তারপরেও শুটিং-এ চলে গেল!

খবরের কাগজের খবরটা তোমার জন্যে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মার জন্যে হয়ত ততটা নাবাবা টেলিফোন রেখে দেই? কথা বলতে পারছি না। ব্যথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।

তস্তুরী বেগম হঠাৎ ঘরে ঢুকে উত্তেজিত গলায় বলল, আফা আজহার চাচা মারা গেছেন খবর জানেন?

খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আজহার চাচার একটা ছবি ছাপা হয়েছে। ছবির ক্যাপশান–সন্ত্রাসীর গুলিতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মৃত্যু। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ বর্ণনাও আছে। দিনে দুপুরে একটা সুন্দর চেহারার ছেলে কী কাজের কথা বলে তার অফিস ঘরে ঢুকেছে। সবার সামনে পর পর তিনবার গুলি করেছে। ছেলেটার চেহারা সুন্দর। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। পুলিশ সন্দেহ করছে হত্যাকাণ্ডের নায়কের নাম টুলু। সে পেশাদার খুনি।

ছবিতে আজহার চাচা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। একটা ছেলে তাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কী পবিত্র দৃশ্য।

তস্তুরী বেগম বলল, আজহার চাচাজীর ছেলে আসছে আফা। আফনের সাথে দেখা করতে চায়। তারে কি চইল্যা যাইতে বলব? সে খুবই কানতেছে।

তাকে ড্রয়িংরুমে বসাও। তাকে বলে আমি আসছি।

আসছি বলেও আমি শুয়ে আছি। তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। আকাশ জোড়া মেঘ! কী সুন্দর মেঘমালা। কখন বৃষ্টি নামবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress