Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃন্ময়ী (২০০১) || Humayun Ahmed » Page 4

মৃন্ময়ী (২০০১) || Humayun Ahmed

বিব্রতকর পরিস্থিতি

আমি যে পরিস্থিতিতে পড়েছি–সংবাদপত্রের ভাষায় তাকে বলা হয় বিব্রতকর পরিস্থিতি। যতটুক বিব্রত বোধ করা উচিত তারচেয়ে বেশি বোধ করছি। চেষ্টা করছি আমাকে দেখে যেন আমার মানসিক অবস্থাটা বোঝা না যায়। এই অভিনয়টা আমি ভালো পারি। তবে সবদিন পারি না। আজ পারছি কিনা বুঝতে পারছি না।

ঘটনাটা এ রকম – ক্লাস শেষ হয়েছে। আমি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি। পেছন থেকে কাওসার স্যার ডাকলেন হ্যালে মিস।

আমি পেছন ফিরলাম। স্যার বললেন, তুমি কোন দিকে যাচ্ছ?

আমি বললাম, দিক বলতে পারব না। বাসা যে দিকে সে দিকে যাচ্ছি।

পথে আমাকে নামিয়ে দিতে পারবে? আমার মোটর সাইকেলের চাকা পাংচার হয়েছে। একটা এক্সট্রা চাকা আছে। চাকা কীভাবে বদলাতে হয় আমি জানি না।

আমি বললাম, আসুন। আপনি কোথায় যাবেন বলুন আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।

আমি কোথাও যাব না। তোমার সঙ্গে গাড়িতে উঠব। হঠাৎ কোথাও নেমে যেতে ইচ্ছা করলে নেমে যাব। আর যদি নেমে যেতে ইচ্ছা না করে তোমার সঙ্গে তোমাদের বাসায় যাব। এক কাপ চা খেয়ে আসব।

স্যারের সঙ্গে কথাবার্তার এই পর্যায়ে হঠাৎ আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকল। যদিও তার কোনোই কারণ নেই। কোনো অপরিচিত ভদ্ৰলোক আমার কাছে লিফট চাইছে না। যিনি লিফট চাইছেন তিনি আমার খুবই পরিচিত। তিনি হয়তো আজ আবার নতুন ধরনের কোনো খেলা খেলার চিন্তা করছেন। আবারো হয়তো সাইকোলজির কোনো পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার এক পর্যায়ে আমি রেগে যাব এবং আমার নিজেকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হবে।

তোমার সঙ্গে যে তোমার বাসা পর্যন্ত যাবই তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। পথে নেমে যেতে ইচ্ছা করলে নেমে যাব।

আমি কথা বাড়ালাম না। চুপ করে রইলাম। উনার যদি নেমে যেতে ইচ্ছা করে উনি নেমে যাবেন। এই কথা বারবার শোনানোর কিছু নেই। তবে একটি তরুণী মেয়ের সঙ্গে তার বাসায় যাবার জন্যে গাড়িতে ওঠা এবং মাঝপথে হঠাৎ নেমে যাওয়া তরুণী মেয়েটির জন্যে অপমানসূচক। মেয়েটি অপমানিত বোধ করবেই। আমি করব না। কারণ যে-কোনো ঘটনা আমি যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। যে সবকিছু যুক্তি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে সে সহজে অপমানিত বোধ। করে না, রাগ করে না। যুক্তিবিদ্যা মানুষকে যন্ত্রের কাছাকাছি নিতে সাহায্য করে। মানুষ বদলাচ্ছে। নতুন শতকের মানুষ যন্ত্রের কাছাকাছি যাবে এটাই স্বাভাবিক।

মৃন্ময়ী।

জ্বি।

আমি যখন বললাম, তুমি কোন দিকে যাচ্ছ–তখন তুমি উত্তর দিলে–দিক জানি না। উত্তরটা কি ঠিক হয়েছে?

হ্যাঁ ঠিক হয়েছে কারণ আমি দিক জানি না।

স্থাপত্য বিদ্যার কোনো ছাত্রী বলবে কি জানি না এটা হতেই পারে না। সূর্য কোন দিকে উঠছে, কোন দিকে অস্ত যাচ্ছে এটা তাকে সব সময় জানতে হবে। শীতের সময় সূর্য যে জায়গা থেকে উঠে গরমের সময় ঠিক সে জায়গা থেকে উঠে না। সামান্য সরে যায়। বলতে পারবে কতটুক সরে যায়?

স্যার, আমরা তো এখন ক্লাসে বসে নেই। ক্লাসের বাইরে আছি। গাড়ির ভেতর বসেও যদি ভাইভা পরীক্ষা দেই তাহলে কীভাবে হবে?

স্যার হেসে ফেললেন। আমি বললাম আপনি সব সময় ক্লাসে বলেন, আমি তোমাদের শিক্ষক না। আমি নিজেও একজন ছাত্র। কিন্তু আপনি কখনো ভুলতে পারেন না যে আপনি একজন শিক্ষক। আমি লক্ষ করেছি ক্লাসের বাইরেও আপনি সারাক্ষণই কোনো না কোনো প্রশ্ন করছেন।

আর করব না।

এখন ঠিক করে বলুনতো আপনি কি সত্যি আমার সঙ্গে চা খেতে যাচ্ছেন, না পথে নেমে যাবেন?

বুঝতে পারছি না।

আচ্ছা মনে করুন আমাদের ক্লাসেরই অন্য কোনো একটা ছেলে কিংবা মেয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে তখনন কি তাকে এসে বলতেন পথে আমাকে। নামিয়ে দিতে পারবে? আমার মোটর সাইকেলের চাকা পাংচার হয়েছে?

না।

না কেন?

গাড়িতে যাওয়া আমার জন্যে জরুরি কিছু না। কার সঙ্গে যাচ্ছি সেটা জরুরি। তোমাকে তো আমি প্রথম দিনই বলেছি তোমাকে আমার পছন্দ। তোমার মতো মেয়েরা আমান্তে হিসেবে খুব ভালো হয়।

আমান্তে কী?

আমান্তে শব্দটা স্প্যানিশ। এর অর্থ হলো সেন্টিমেন্টাল ফ্রেন্ড। তুমি না চাইলেও তোমাকে আমি দেখছি একজন আমান্তে হিসেবে।

আমান্তেকে নিয়ে কি আপনি সাইকোলজির খেলা খেলেন?

মাঝে মাঝে খেলি। তবে সাইকোলজির খেলা না। ম্যাজিকের খেলা।

তার মানে?

প্রথম দিন যা করেছি সেটা হলো খুব সহজ একটা ম্যাজিক দেখিয়েছি। আমি চারটা কাগজে চার রকম লেখা লিখেছি। একটাতে লিখেছি— মৃন্ময়ী মোটর সাইকেলে চড়তে রাজি হবে না। সেই কাগজটা রেখেছি এক জায়গায়। আরেকটাতে লিখেছি—মোটর সাইকেলে চড়তে সে খুশি মনে রাজি হবে। সেটা রেখেছি অন্য জায়গায়। তুমি যাই করতে আমি সেই কাগজটা বের করে তোমাকে দেখিয়ে বলতাম তুমি কী করবে তা আমি আগে থেকেই জানি।

এতে আপনার লাভ কী হয়েছে?

তোমাকে চমকে দিতে পেরেছি—এটাই লাভ।

আপনি কি সবাইকে চমক দিয়ে বেড়ান?

না। সবাইকে চমকাতে ইচ্ছা করে না। কাউকে কাউকে করে। আমান্তেকে করে।

আপনি যে ভঙ্গিতে আমাকে বলেছেন তার থেকে আমার মনে হয়েছে–এ ধরনের কথা আপনি অবলীলায় বলতে পারেন এবং আমার আগে আরো অনেককে আমান্তে বলেছেন। বলেন নি।

হ্যাঁ বলেছি। তুমি বলো নি? মুখে বলার কথা বলছি না। বাঙালি মেয়ে এ ধরনের কথা অবলীলায় বলতে পারে না। আমি মনে মনে বলার কথা বলছি।

না আমি মুখে বা মনে মনে কখনো বলি নি।

বলতে ইচ্ছা করে নি।

না আমার ইচ্ছাও করে নি।

তুমি এমন কঠিন গলায় কথা বলছ কেন? তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে খুবই অপ্ৰিয় কোনো প্রসঙ্গে তুমি কথা বলছ।

প্রসঙ্গটা আমার অপ্রিয়। কোনো একটা ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। আমান্তে টাইপ পরিচয়। রাত বারটার পর নিচু গলায় তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলব। ছুটি ছাটার দিন ফুচকা খেতে যাব এবং কিছুক্ষণ পর পর চমকে চমকে রাস্তার দিকে তাকার কেউ দেখে ফেলল কি-না–এটা আমার খুবই অপছন্দ। স্পেনে কী হয় আমি জানি না। ঐ দেশে কখনো যাই নি তবে আমাদের দেশে প্রেমের ব্যাপারে কিছু সেট রুলস আছে। জানতে চান?

হ্যাঁ জানতে চাই।

প্রেমে পড়লে ছেলে-মেয়ের ফুচকা খেতে হবে।

কারণটা কী?

ফুচকা বিক্রি হয় পার্কে। এবং মেয়েরা খেতে পছন্দ করে। দামে সস্তা বলে ছেলেদের জন্যে খুব সুবিধা হয়।

স্যার হাসতে হাসতে বললেন তোমার কথা শুনে মজা পাচ্ছি। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আমার ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে। কোনো একটা পার্কে আমাকে নিয়ে চলে তো। ফুচকা খাব। আজ আর তোমাদের বাসায় যাব না। ফুচকা খেয়ে বিদায়।

আপনি সত্যি ফুচকা খাবেন?

হ্যাঁ খাব। প্রেমে পড়ার যে সব সেট রুলস এ দেশে আছে তার প্রতিটি আমি মানতে চাই। টেলিফোন কখন করতে হয় বললে রাত বারটার পর?

স্যার ঠাট্টা করবেন না।

আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস। আমরা কি ফুচকার দোকানের দিকে যাচ্ছি।

হ্যাঁ যাচ্ছি।

ফুচকা খেতে খেতে তোমাকে একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলব।

এখনই বলুন।

সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। জনসভায় যে কথা বলা যায়, শোবার। ঘরে সে কথা বলা যায় না। চলন্ত গাড়িতে যে কথা বলা যায় সে কথা বটগাছের নিচে বসে বলা যায় না। কথা হলো পেইন্টিং-এর মতো। জয়নাল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি তুমি তোমার ডাইনিং রুমে টানাতে পারে না। আমি বোধহয় আবার টিচার হয়ে যাচ্ছি।

হ্যাঁ যাচ্ছেন।

সরি–চুপ করলাম। ফুচকা মুখে না দেয়া পর্যন্ত আর কথা বলব না।

আমরা ফুচকা খেতে এসেছি শেরে বাংলা নগরে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সারি সারি ফুচকার দোকান। স্যার মুগ্ধ গলায় বললেন–বাহ! মৃন্ময়ী তাকিয়ে দেখ এক সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ জায়গাটাকে কেমন বদলে দিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের বদলে যদি জারুল গাছ হতো তাহলে কী হতো! গাছ ভর্তি নীল ফুল ব্যাকগ্রাউন্ডে নীল আকাশ। লেকের পানিতেও নীল আকাশের ছায়া… একটা ড্রীম ড্ৰীম ব্যাপার হতো কি-না বল।

হয়তো হতো।

সোনালু বলে একটা গাছ আছে যার ফুল ছোট ছোট ফুলের রং গাঢ় সোনালি। কৃষ্ণচূড়া গাছের বদলে সোনালু গাছ হলে কেমন হয়।

জানি না কেমন হতো।

চিন্তা করে। চিন্তা করে বলে। একটা জিনিস মাথায় রেখে চিন্তা করবে। সোনালি রং বলে কিন্তু কিছু নেই। পৃথিবী সাতটা রং নিয়ে খেলা করে। রামধনুর সতি রং। কারণ আমাদের চোখ এই সাতটা রঙই দেখতে পায়। পৃথিবীতে কিন্তু আরো অনেক রং আছে। আমরা সেইসব রং দেখতে পাই না। কারণ আমাদের চোখ সেইসব রং দেখার জন্যে তৈরি না। সাতটা রং দেখার জন্যে আমাদের চোখ তৈরি হয়েছে বলেই আমরা সাতটা রং দেখছি।

নিন ফুচকা খান। খেতে খেতে ইন্টারেস্টিং কী কথা বলবেন বলুন। না-কি রং বিষয়ক এইগুলিই সেই ইন্টারেস্টিং কথা?

রঙের কথাগুলি তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না?

না তেমন ইন্টারেস্টিং লাগছে না। বুকিস কথা বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি বই পড়ে থিওরি মুখস্থ করে এসে থিওরি কপচাচ্ছেন।

সরি।

সরি হবার কিছু নেই। আপনি কন্ডিশন্ড হয়ে গেছেন। থিওরি কপচাতে কপচাতে থিওরি কপচানো আপনার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। আপনি নিজে সেটা বুঝতে পারছেন না। আপনি কি ইন্টারেস্টিং কথাটা এখন বলবেন?

হ্যাঁ বলব। আমি লক্ষ করেছি— মোটর সাইকেলে করে একটা ছেলে প্রায়ই ইউনিভার্সিটিতে আসে। তোমাকে লক্ষ করে। তারপর চলে যায়। মাঝে মাঝে তোমার গাড়ির পেছনে পেছনে যায়। একদিন সে আমাকেও ফলো করেছে। ছেলেটা কে?

জানি না তো কে!

একটা ছেলে দিনের পর দিন তোমাকে ফলো করছে তারপরেও ব্যাপারটা তোমার চোখে পড়ল না?

না চোখে পড়ে নি।

ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করতে চাও?

অবশ্যই চাই।

সে মোটর সাইকেল নিয়ে এখানেও আমাদের পেছনে পেছনে এসেছে। এই মুহূর্তে সে আছে তোমার প্রায় বিশ গজ পেছনের কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে। তার গায়ে বিসকিট কালারের শার্ট। ছেলেটা সানগ্লাস পরে আছে। তার চুল কোঁকড়ানো।

আশ্চর্য কথা তো!

এই আশ্চর্য কথাটা বলার জন্যেই আজ আমি ইচ্ছা করে তোমার গাড়িতে এসেছি। ফুচকা খাওয়া বা তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আমার মূল উদ্দেশ্য না। এই কথাগুলি বলেছি তোমাকে চমকে দেবার জন্যে।

বুঝতে পারছি। কিছু কিছু মানুষকে আপনি চমকে দিতে পছন্দ করেন।

তুমি কি ছেলেটার সঙ্গে কথা বলবে?

না আমি বলব?

না আমিই বলব।

ফুচকা জিনিসটা তো আমার খেতে খুবই ভালো লাগছে। আমি বরং এক কাজ করি আরো হাফ প্লেট ফুচকা খাই— এই ফাঁকে তুমি কথা বলে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।

রাতের অস্পষ্ট আলোয় দেখা মানুষকে দিনের ঝলমলে রোদে দেখলে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে। রাতে যাকে রহস্যময় মনে হয় দিনে সে-ই সাদামাটা একজন হয়ে যায়। ভাইয়ার যে বন্ধু চোখে সানগ্লাস পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকে বোকা বোকা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে আমাকে দেখে ভয়ও পাচ্ছে। তার ভয় পাওয়া উচিত না। ভয় পাওয়া উচিত আমার। এই ছেলেটা ভয়ঙ্কর মানুষদের একজন। সে এখন নিজেই ভয় পাচ্ছে অথচ এই মানুষটাই যখন ছাদে ভাত খাচ্ছিল তখন মোটেও ভয় পাচ্ছিল না। তাকে বোকা বোকাও লাগছিল না। চেহারাও রাতে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল। ভীত মানুষের চেহারা হয়তো খারাপ হয়ে যায়। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি এখানে কী করছেন?

কিছু করছি না।

আপনি কী প্রায়ই আমাকে ফলো করেন?

সানগ্লাস পরা মানুষটা এই প্রশ্নে মনে হয় খুবই ব্রিত হয়েছে। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে এখন কৃষ্ণচূড়া গাছের সৌন্দর্য দেখায় ব্যস্ত।

কেন এই কাজটা করছেন? আমাকে কিছু বলতে চান?

না।

কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।

কিছু বলতে চাই না।

আমাকে ফলো করবেন না। প্লিজ।

লাল শার্ট পরা ঐ লোকটা কে?

লাল শার্ট পরা ঐ লোক কে তা দিয়ে আপনার কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন আছে?

না।

তাহলে চলে যান।

আচ্ছা।

আচ্ছা বলে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। মোটর সাইকেলে উঠে স্টার্ট দিন। প্লিজ।

মোটর সাইকেল চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁর কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ খানিকটা বিষ বোধ করছি। কেন করছি তাও বুঝতে পারছি না। রাস্তার পাশেই আমার গাড়ি। ড্রাইভার গাড়ির কাচ নামিয়ে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখছে। একটা কাজ করলে কেমন হয়? স্যারকে কিছু না বলে রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠে বসলে হয় না? তিনি খুবই অবাক হবেন। অপমানিত বোধ করারও কথা। তাতে সমস্যা কিছু নেই।

আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাস্তা পার হলাম। স্যার কী করছেন বুঝতে পারছি না। তিনি নিশ্চয়ই ফুচকার প্লেট ফেলে দিয়ে দৌড়ে আমার দিকে আসছেন না। ঘটনাটা হজম করছেন। স্যারের মতো মানুষকে অনেক কিছু হজম করতে হয়।

গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বললাম। স্যার কী করছেন দেখতে ইচ্ছা করছে। সেটা সম্ভব না। ভদ্রলোক এখন কী করবেন? প্রথমেই ছোট্ট একটা বিপদে পড়বেন। ফুচকার দাম দিতে পারবেন না। ফুচকার প্লেট হাতে নিয়েই তিনি বলেছেন মৃন্ময়ী, একটা ভুল করে ফেলেছি। মানিব্যাগ আনি নি। তোমার সঙ্গে টাকা আছে তো?

ফুচকার দাম দেয়ার মতো টাকা সঙ্গে নেই এটা কোনো বুদ্ধিমান মানুষের জন্যে বড় সমস্যা না। এই সমস্যার সমাধান বার করা যাবে। তিনি সুন্দর করেই এই সমস্যার সমাধান করবেন। তারপর কী হবে? তিনি চিন্তিত হয়ে বাসায় ফিরবেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইবেন কিন্তু করতে পারবেন না। আমার টেলিফোন নাম্বার তার কাছে নেই।

ড্রাইভার বলল, বাসায় যাব আপা।

আমি বললাম, না।

কোন দিকে যাব?

আপনার ইচ্ছামতো যে-কোনো জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে থাকুন। আধ ঘণ্টা এই রকম ঘুরবেন, তারপর বাসায় যাবেন।

ড্রাইভারের মুখ শুকিয়ে গেল। আমাদের ড্রাইভার তিনজন। তিন ড্রাইভারের একই অবস্থা হয়। যখনই বলি আপনার ইচ্ছা মতো কিছুক্ষণ গাড়ি নিয়ে চক্কর দিন। তখন তাদের দেখে মনে হয় তারা অথই সাগরে পড়ে গেছে। পরের ইচ্ছায় কাজ করতে এদের সমস্যা নেই। নিজের ইচ্ছায় তারা কিছু করতে পারে না।

নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় কাজ করার ক্ষমতা এদের নষ্ট হয়ে গেছে।

দোতলার টানা বারান্দায় বাবা বসে আছেন। বাবার পাশে আজহার চাচা। বারান্দায় চেয়ারগুলি এমনভাবে পাতা যে মুখোমুখি বসার উপায় নেই। দুজন পাশাপাশি বসে আছেন। কথা বলার সময় আজহার চাচা বাবার দিকে তাকাচ্ছেন–হাত-পা নাড়ছেন। বাবা মূর্তির মতো সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোট নাড়া দেখে আলাপের বিষয়বস্তু বোঝা যাচ্ছে না, তবে আজহার চাচার মুখ ভর্তি হাসি দেখে মনে হয় দারুণ মজার কোনো কথা হচ্ছে। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। যে-কোনো মুহূর্তে তিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবেন। সামনের বেতের গোল টেবিলটা লাথি দিয়ে ফেলে দেবেন। এতে যদি বিরক্তি কাটা যায় তাহলে কাটা যাবে। যদি কাটা না যায় তিনি হয়তোবা দোতলার বারান্দা থেকে লাফ দেবেন।

আমি সরাসরি তাদের কাছে গেলাম। আজহার চাচা আমাকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, অনেক আগেই চলে যেতাম তুই আসবি, তোর সঙ্গে দেখা হবে এই জন্যেই বসে আছি। তার বাবা বলল তোর না-কি ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার টাইমের কোনো ঠিক নেই। কখনো দুপুর তিনটায় ফিরিস, কখনো রাত আটটা?

আমি হাসলাম। হঠাৎ আপনার দেখা পেয়ে খুবই আনন্দ পাচ্ছি জাতীয় হাসি। আমার আসলেই ভালো লাগছে।

চাচা আপনি না-কি কবরের জন্যে জায়গা কিনছেন?

হ্যাঁরে মা, কিনে ফেললাম। ধানমণ্ডিতে যখন এক বিঘার একটা প্লট কিনি তখন খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। কবরের জায়গাটা কেনার পরও সমান আনন্দ পেয়েছি। তোর বাবাকে কিনে দিতে চাচ্ছি সে কিনবে না।

আপনি তো চাচা ডেনজারাস মানুষ।

ডেনজারসি কেনরে মা?

প্ৰথমে কাফনের কাপড় কিনে দিলেন। এখন কবরের জন্যে জায়গা কিনে দিচ্ছেন। কয়েকদিন পর কবরের জায়গাটা বাঁধিয়ে ফেলবেন। তারপর মৌলবি রেখে দেবেন সে প্রতি বৃহস্পতিবারে গিয়ে ওজিফা পাঠ করবে। এদিকে কবরে কোনো ডেডবডিই নেই। বাবা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আজহার চাচা শব্দ করে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসি আর থামতেই চায় না। অনেক কষ্টে হাসি থামান, আবার হো হো করে ওঠেন। তিনি বাবার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললেন তোমার মেয়ের কথাবার্তা শুনেছ? জোকারী ধরনের কথাবার্তা। এ রকম কথা কয়েকটা শুনলে তো হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। বলে কী কবরে কোনো ডেডডি নেই, এদিকে প্রতি বৃহস্পতিবার ওজিফা পাঠ হচ্ছে। হা হা হা।

বাবা বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। চোখের ভাষায় বলার চেষ্টা করলেন তুমি কেন বুঝতে পারছ না আমি এই লোকটার সঙ্গ পছন্দ করছি না? কেন তুমি তারপরেও মানুষটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? তার সঙ্গে রসিকতা করার কোনো দরকার নেই।

আজহার চাচা বললেন, মৃন্ময়ী মা আমার ছেলেটাকে আজ জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। ছোটবেলায় কত এসেছে এখন আর আসতে চায় না। তার কথা তোর মনে আছে তো মা— ডাক নাম শুভ। তোদের বসার ঘরে ও একা একা বসে আছে। ও চা-টা কিছু খাবে কিনা একটু জিজ্ঞেস করিতো। যা লাজুক ছেলে মুখ ফুটে কিছু বলবে না। একে নিয়ে বিরাট বিপদে আছি। তাকে এমন কোনো মেয়ের হাতে তুলে দিতে হবে যে তার নাকে দড়ি দিয়ে কেনি আংগুলে বেধে রাখবে।

আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা হতাশ দৃষ্টি দিয়ে ইশারায় বলার চেষ্টা করলেন খবরদার ঐ দিকে যাবি না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো–হতাশ দৃষ্টিটা আমি কি বুঝেছি! সে কারণেই হয়তো আজহার চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলে কি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেসে শুনেছি কঠিন ধর্ম পালন করে।

আজহার চাচা আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, মৃন্ময়ী মা তো বাইরের কেউ না। তার সঙ্গে কথা বলতে দোষ নাই।

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, একটা ছেলে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলবে তার জন্যে যদি দোষ-গুণ বিচার করতে হয় তাহলে কথা না বলাই উচিত। মৃন্ময়ী তোর যাবার দরকার নেই তোকে দেখে বেচারা হয়তো অস্বস্তিতে পড়বে। কী দরকার? তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই খুব টায়ার্ড। তুই একটা হট শাওয়ার নে— নাশতা খেয়ে রেস্ট নে। তোর পরিশ্রম বেশি হচ্ছে। তোর রেস্ট দরকার।

আমি তাদের সামনে থেকে চলে এলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। বড় কোনো ঝামেলা। বাবা মুখ শুকনা করে বসে আছেন। তিনি খুবই টেনশানে আছেন। আজহার চাচা তার ছেলে শুভকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। এটাই কি টেনশনের কারণ? তিনি কিছুতেই চাচ্ছেন না আমি আজহার চাচার ছেলের সামনে যাই।

বাবা যেখানে বসেছেন আমার ঘর তার থেকে অনেক দূরে। বাবা আজহার চাচার সঙ্গে কী কথা বলছেন কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। তবে একটু পর পর আজহার চাচার হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আজহার চাচা আজ খুব আনন্দে আছেন।

বসার ঘর অন্ধকার। এই ঘরে বড় বড় জানালা আছে। জানালায় ভারী পর্দা টানা থাকে বলে ঘর অন্ধকার হয়ে থাকে। বসার ঘরে কেউ বসলে বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আজ বাতি জ্বালানো হয় নি। আজহার চাচার ছেলে শুভ ঘরের এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে সামান্য ভীত। যেন ডেনটিস্টের কাছে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক পড়বে। আমাকে দেখেই সে অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। যেন আমি ডেনটিস্টের এসিসটেন্ট। তাকে বলতে এসেছি আসুন আপনার ডাক পড়েছে।

আমি বললাম, আপনি আজহার চাচার ছেলে শুভ?

ছেলেটা মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।

ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল।

আপনি কি কিছু খাবেন? চা-কফি কিংবা ঠাণ্ডা কিছু?

ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়ল। আমি ঘরে ঢোকার পর থেকে সে একবারও আমার দিকে তাকায় নি। অথচ এই ছেলেই না-কি ছোটবেলায় আমাকে বিয়ে করার জন্যে ব্যস্ত ছিল।

আপনি একা একা বসে আছেন, আপনার খারাপ লাগছে না?

না।

আমি সামান্য চমকালাম। ছেলেটার গলার স্বর অস্বাভাবিক সুন্দর। বিষাদময়। প্রকৃতি কোনো মানুষকেই পুরোপুরি নিঃস্ব করে পাঠান না। কিছু না কিছু দিয়ে পাঠান। একে হয়তো অপূর্ব কণ্ঠস্বর দিয়ে পাঠিয়েছেন। কিংবা ছেলেটার কণ্ঠস্বর সুন্দর এটা আমার কল্পনাও হতে পারে।

বেচারা একা একা অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছে দেখে আমার মনে হয়তো তার সম্পর্কে এক ধরনের করুণা তৈরি হয়েছে। করুণার কারণেই মনে হচ্ছে ছেলেটার গলার স্বর সুন্দর। শুধু একটি মাত্র শব্দ না শুনে বলা যায় না কারোর গলার স্বর সুন্দর না অসুন্দর। আমি নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, আপনি মেঝের। দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? লজ্জা লাগছে? ছেলেটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। আমার নিজের উপরই রাগ লাগছে–আমি ঠিকমতো প্রশ্ন করতে পারছি না। এমনভাবে প্রশ্ন করছি যে সে কথা না বলেও জবাব দিতে পারছে। আমার প্রশ্নগুলি এমন হওয়া উচিত যেন উত্তর দিতে হলে কথা বলতে হয়।

আপনি কি নিজের বাড়িতেও এরকম চুপচাপ একা বসে থাকেন?

ছেলেটা আবারো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। আবারো ভুল প্রশ্ন করেছি।

বসে বসে সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন?

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়া। আমি তো দেখি ভালোই বিপদে পড়েছি। যে প্রশ্নই করছি সে মাখা নেড়ে নেড়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।

আমি যে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছি আপনার কি খারাপ লাগছে?

ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়ল। আমি হতাশ হয়ে বললাম, কিছু মনে করবেন না। আমি যে প্রশ্নই করছি আপনি মাথা নেড়ে জবাব দিয়ে যাচ্ছেন। আমি আপনার গলার স্বর শুনতে চাচ্ছি। এইবার আমি যে প্রশ্ন করব তার জবাব দয়া করে কথা বলে দেবেন। লম্বা একটা সেনটেন্স বলবেন। একটা লম্বা। সেনটেন্সে জবাব দিলে আমি আর আপনাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করব না। প্রশ্নটা হচ্ছে আমি মার কাছে শুনেছি ছোটবেলায় আপনি না-কি আমাকে বিয়ে করার জন্যে ব্যস্ত ছিলেন। সেই ঘটনা কি আপনার মনে আছে?

ছেলেটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মনে আছে। তখন খুব বোকা ছিলাম। এখনো বোকা।

যে বোকা সে কিন্তু বুঝতে পারে না যে সে বোকা।

আমি বুঝতে পারি।

আপনাকে কি এর আগে কেউ বলেছে যে আপনার গলার স্বর অস্বাভাবিক সুন্দর?

হ্যাঁ বলেছে। একজন মওলানা সাহেব ছিলেন। আমাকে কেরাত শিখাতেন উনি বলেছেন।

আর কেউ বলে নি?

আপনি বলেছেন।

ও হ্যাঁ আমি তো একটু আগেই বললাম। আচ্ছা আমি যাই। আপনি আপনার মতো বসে থাকুন।

রাত এগারোটার দিকে কাওসার স্যার টেলিফোন করলেন। খুব সহজ গলায় বললেন, মৃন্ময়ী ভালো আছ?

আমি বললাম, জি স্যার ভালো আছি। আমার টেলিফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?

জোগাড় করেছি। কীভাবে জোগাড় করেছি সেই ইতিহাস বলে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন দেখছি না। তুমি সত্যি ভালো তো?

জ্বি ভালো।

হঠাৎ করে চলে গেলে! আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।

রাগ করেন নি তো স্যার? আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা উচিত ছিল।

উচিত অনুচিত বিচার করে তো মানুষ সব সময় কাজ করতে পারে না। তোমার সেই মুহূর্তে চলে যেতে ইচ্ছা করেছে। তুমি চলে গিয়েছ। ভালো করেছ।

আপনার কাছে তো টাকা ছিল না। ফুচকাওয়ালাকে কী বলেছেন?

ঐটা কোনো সমস্যা হয় নি। যে ছেলেটি তোমাকে ফলো করে তার নাম কী?

নাম জানি না।

জিজ্ঞেস করো নি?

না জিজ্ঞেস করি নি।

ছেলেটা কে, কী করে?

ঠিক জানি না।

তার সঙ্গে তোমার কী কথা হয়েছে?

স্যার আমার বলতে ইচ্ছা করছে না।

বলতে ইচ্ছা না করলে বলতে হবে না। তুমি কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে বলতে পারো। আমি খুব ভালো কাউন্সেলর।

সব সমস্যার সমাধান আপনার কাছে আছে? সমস্যা থাকলে সমাধান থাকবেই। সমাধান আছে অথচ সমস্যা নেই তা কি হয়?

না, তা হয় না।

তোমাদের ওদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে না-কি? আমি বৃষ্টির শব্দ শুনছি।

বৃষ্টি হচ্ছে না। আমার একটা ঝড় বৃষ্টির সিডি আছে। ঐ সিডিটা শুনছি। আমার মন যখন খুব ভালো থাকে তখন এই সিডি শুনি। আবার মন যখন খুব খারাপ থাকে তখনও এই সিডি শুনি।

এখন তোমার মনের অবস্থা কী? খুব ভালো, না খুব খারাপ?

সেটা আপনাকে বলব না।

সহজভাবে কিছুক্ষণ কথা বলো প্লিজ।

আমি সহজভাবেই কথা বলছি।

তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করছে।

গল্প করুন। কোন বিষয় নিয়ে তোমার গল্প করতে ভালো লাগে? সে বিষয়টা বলে।

যে-কোনো বিষয় নিয়ে গল্প করতে পারেন? পৃথিবীর সব বিষয় আপনি জানেন?

গল্প চালিয়ে যাবার জন্যে গভীর জ্ঞান লাগে না। যারা ভাসা ভাসা জানে তারাই সুন্দর গল্প করতে পারে। জ্ঞানীরা ঝিম ধরে বসে থাকেন, তারা গল্প। করতে পারেন না। আমি জ্ঞানী না। নিজের বিষয় কিছুটা জানি। এর বাইরে প্রায় কিছুই জানি না। জানি না বলেই ভালো গল্প করতে পারি। আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে না আমি ভালো গল্প করি।

হ্যাঁ মনে হচ্ছে।

তুমি কি আমার বিষয়ে কিছু জানতে চাও?

না তো!

জানতে চাইলে বলতে পারি। আমার বাবা মা, ভাই বোন—তারা কোথায় থাকে। তারা পড়াশোনা কোথায় করেছে। জানতে চাও না?

না।

আমার নিজের থেকেই তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে। আমার এমন কিছু বিষয় আছে যা শুনলে তুমি চমকে উঠবে।

মানুষকে আপনি খুব চমকাতে পছন্দ করেন তাই না?

তা করি। তবে আমার নিজের সম্পর্কে জেনে তুমি যে চমকটা খাবে সেটা রিয়েল। বাকিগুলি ফেব্রিকেটেড চমক। কষ্ট করে তৈরি করা। চমকে দেব?

দিন।

আমি রং নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম মনে আছে তো? আমি যখন স্থাপত্য বিষয়ের আন্ডার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট তখন রঙের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ঢুকে। আমাদের একজন টিচার ছিলেন, নাম জন রে জুনিয়র, উনিই ঢুকিয়ে দেন। ক্লাসে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, সাতটা রঙের বাইরেও যে আরো অসংখ্য রং আছে তা বুঝতে পারার কিছু পদ্ধতি আছে। ড্রাগ নেয়া হলো তার একটি। কিছু কিছু ড্রাগ আছে যা রক্তে মিশলে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়, যে সব রং পৃথিবীতে নেই সেইসব রং দেখা যায়। তিনি কিছু কিছু ড্রাগের নামও বললেন–তার একটি হচ্ছে LSD. তুমি LSD-এর নাম শুনেছ?

হ্যাঁ শুনেছি।

স্যারের কথা কতটুকু সত্যি তা পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি LSD নিলাম।

রং দেখতে পেলেন।

হ্যাঁ পেলাম। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার ভুবন রঙে রঙময় হয়ে গেল। রঙের কোনো শেড না— Pure colour. আমি বর্ণনা করতে পারব না, বা এঁকেও দেখাতে পারব না কারণ এই রঙগুলি পৃথিবীতে নেই। মৃন্ময়ী তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ?

হ্যাঁ শুনছি।

অভিজ্ঞতাটা আমার জন্যে এতই অসাধারণ ছিল যে আমার নিজের ভুবন এলোমেলো হয়ে গেল। একের পর এক LSD TRIP নিতে থাকলাম। এক সময় পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করে সুস্থ হতে হলো।

এখন আপনি সুস্থ?

না এখনো ঠিক সুস্থ না। হঠাৎ হঠাৎ মাথার ভেতর রঙগুলি উঠে আসে। আমার চারপাশের পৃথিবী Unreal হয়ে যায়। আমি প্রবল ঘোরের মধ্যে চলে যাই। উদাহরণ দিয়ে বলি– মনে করে আমি কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে আছি। লাল ফুল। পেছনে ঘন নীল আকাশ। হঠাৎ ফুলের লাল রঙটা কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে গেল। আকাশের নীল রঙও বদলে গেল। রঙগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো। ওরা হয়ে গেল জীবন্ত। ওরা নিঃশ্বাস নিচ্ছে, নিঃশ্বাস ফেলছে, ছটফট করছে। কখনো কাঁদছে, কখনো রং হাসছে। বুঝতে পারছ কী বলছি?

মনে হয় পারছি।

এই ব্যাপারগুলি ঘটে যখন খুব পছন্দের কেউ আশেপাশে থাকে। Sentimental friend type কেউ। আমি যখন ফুচকা খাচ্ছিলাম তুমি ছেলেটার সঙ্গে গল্প করতে গেলে। আমি তাকালাম কৃষ্ণচূড়া ফুলের দিকে, তখন ব্যাপারটা ঘটল। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

আপনি কি এখনো LSD নেন?

না। এখন আর নেয়ার দরকার পড়ে না।

আপনার কাছে কি LSD আছে?

হ্যাঁ আছে। কেন, তুমি কি একটা LSD ট্রিপ নিয়ে দেখতে চাও– রং ব্যাপারটা আসলে কী?

আমি বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না।

অভিজ্ঞতার জন্যে একবার নিয়ে দেখতে পারো। তবে না নেয়াই ভালো। রঙের আসল রূপ দেখে ফেললে সাধারণ পৃথিবীর রং আর ভালো লাগবে না। পৃথিবীটাকে খুবই সাধারণ খুবই পাশে মনে হবে। প্রায়ই মনে হবে দূর ছাই এই পৃথিবীতে থেকে কী হবে? যারা LSD নেয় তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এই কারণেই খুব বেশি। অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বললাম, ঘুমাও।

এই বলেই স্যার খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মা ঘরে ঢুকলেন। মার হাতে চায়ের বিরাট মগ। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে তিনি প্রায় এক বালতি গ্রিন টি খান। তার ডায়েটিশিয়ান বান্ধবী তাকে বলেছেন ঘুমুতে যাবার আগে প্রচুর গ্রিন টি খেতে। গ্রিন টিতে আছে এন্টি অক্সিডেন্ট। এবং ন্যাচারাল ভিটামিন ই।

মা হাসিমুখে খাটে বসতে বসতে বললেন, তোর কি শুভর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

আমি কোনো জবাব দিলাম না।

মা বললেন, আমার দেখা হয়েছে। আমি কথা বলেছি। আমাকে দেখে ঝাপ। দিয়ে এসে কদমবুসি করে ফেলল। আমি বললাম, কেমন আছ? সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ভালো। এরপর বেশ কিছু সময় ছিলাম। অনেক কথা বলেছি। সে জবাব দিয়েছে, একবারও আমার দিকে তাকায় নি।

এইসব আমাকে শুনাচ্ছি কেন?

মজার ঘটনা এই জন্যে শুনাচ্ছি। তারপর আমি বললাম, পড়াশোনা কী করেছ? সে বলল বিএ পরীক্ষা দিয়েছি, পাস করতে পারব না। আমি বললাম, এই প্রথমবার দিলে? সে বলল, জ্বি না, আগেও দুইবার দিয়েছি।

মা শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। আমি বললাম, হাসির কিছু হয় নি মা। সে সত্যি কথা বলেছে। লুকায় নি। কেউ সত্যি কথা বললে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা যায় না।

মা চোখ বড় বড় করে বললেন, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? এখনো তো ছেলেটার তোর সঙ্গে বিয়ের দলিল রেজেষ্ট্রি হয় নি। আগে হোক, তারপর রাগ করিস।

আমি বললাম, এইসব কী বলছ তুমি?

মা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তোর সঙ্গে ঠাট্টা করলাম। ঠাট্টাও করতে পারব না।

এই ঠাট্টাটা আমার ভালো লাগছে না।

ঠাট্টা তো করাই হয় ভালো না লাগার জন্যে। ঠাট্টা শুনে তুই যদি মজা পাস তাহলে তো আর এটা ঠাট্টা থাকে না। সেটা হয়ে যায় রসিকতা।

ঠিক আছে মা ঠাট্টা করো।

মা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তুই কিন্তু LSD ট্যাবলেট আমাকেও দিবি। আমি খেয়ে দেখব রঙের ব্যাপারটা কী। আয় আমরা মা মেয়ে দুজন এক সঙ্গে খাই।

আমি মার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মা বললেন, টেলিফোনের প্যারালাল কানেকশন তো। তুই যখন কারো সঙ্গে কথা বলিস তখন মাঝে মাঝে আমি শুনি।

যেন টেলিফোনে লুকিয়ে কথা শোনা কোনো ব্যাপার না। এমন ভঙ্গিতে মা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকে বললেন, তোকে তো আসল কথাই বলা হয় নি। নকল কথা নিয়ে ছোটাছুটি করছি। তোর আজহার চাচা তার ছেলের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এসেছেন। তোর বাবাকে বললেন। খুব খুশি। তার হাসি শুনতে পাচ্ছিলি না। ভোর জন্যে বিশাল এক গিফট প্যাকেট এনেছেন। এখন খুলবি না পরে খুলবি?

আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। মা গ্রিন টির মগে চুমুক দিচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে চা-টা খেয়ে তিনি খুব তৃপ্তি পাচ্ছেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress