রাত দেড়টা বাজে
রাত দেড়টা বাজে।
বেশির ভাগ মানুষের জন্যেই গভীর রাত— আমার জন্যে রজনীর শুরু। ডিজাইনের মূল কাজগুলো আমি এই সময় শুরু করি। আগামীকাল ডুপলেক্স বিল্ডিং-এর ফটোগ্রাফ দিয়ে করা একটা কোলাজ জমা দিতে হবে। বিল্ডিং-এর। ফটোগ্রাফ সাজানো হয়েছে। এদের মাঝখানে ফাক ভরার জন্যে রং দিতে হবে। রং তৈরির কাজটা রাত যত গভীর হয় তত ভালো হয়। দিন হলো কাজের সময়, প্রয়োজনের কাজ যেমন–ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালত। রাত হলে অপ্রয়োজনের কাজের সময়। কবিতা লেখা হবে, ছবি আঁকা হবে। ঔপন্যাসিক চোখ বন্ধ করে তাঁর চরিত্রদের নিয়ে খেলা করবেন। সাধু সন্তরা বসবেন ধ্যানে।
জীবনানন্দ দাশ নিশ্চয়ই চৈত্র মাসের দুপুরে গরমে ঘামতে ঘামতে লিখেন
নি
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি
সারারাত দখিনা বাতাসে।
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাই হরিণীর ডাক শুনি,
কাহারে সে ডাকে।
আমার ধারণা এই লাইনগুলো তিনি লিখেছেন মধ্যরাত পার করে। তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। বরিশালে তাঁর বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ের বাঁশ পাতা বাতাসে কাঁপছে। এবং তিনি কল্পনায় বনের ভেতর ঘাই হরিণীর ডাক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন।
আচ্ছা, ঘাই হরিণী ব্যাপারটা কী? চিত্রা হরিণ, শাম্বা হরিণ আছে। ঘাই হরিণ কোথেকে এসেছে। ঘাই কি নাম, নাকি বিশেষণ?
কাওসার স্যার ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ড বড় বড় করে তাঁর টেলিফোন নাম্বার লিখে বলেছিলেন, ডিজাইন সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় তোমরা যদি পড় তাহলে এই নাম্বারে যে-কোনো সময় আমাকে টেলিফোন করতে পারো। রাত দুটা, তিনটা, চারটা কোনো সমস্যা নেই।
আমি এখন ডিজাইন সংক্রান্ত জটিলতাতেই পড়েছি। মাথার ভেতর থেকে ঘাই শব্দ দূর না করা পর্যন্ত কাজে মন দিতে পারছি না। কাজেই স্যারকে টেলিফোন করার অধিকার আমার আছে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। অধিকার কাজে লাগানো ঠিক হবে না। সব অধিকার কাজে লাগাতে নেই। তারচে মন অন্যদিকে নেবার ব্যবস্থা করা যাক।
আমি হাতে রিমোট কনট্রোল নিয়ে সিডি প্লেয়ার চালু করলাম। ঝড় বৃষ্টির একটা সিডি চালু হয়ে গেল। এই সিডিটা জন্মদিনে ফরিদা আমাকে দিয়েছে। গান বাজনা কিছু নেই শুধুই সাউন্ড এফেক্ট। বাতাসের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, মাঝে মাঝে বজ্ৰপাতও হচ্ছে। স্টুডিওতে তৈরি শব্দ না। মন্টানার এক বনের ভেতরে রেকর্ড করা ঝড়ের শব্দ। সিডির গায়ে সেরকমই লেখা। শুনতে ভালো লাগে।
টেলিফোন বাজছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। একটা চল্লিশ। এত রাতে টেলিফোন করার মতো আমার কেউ নেই। ট্র্যাংক কল হবার সম্ভাবনা। রিসিভার তুলতেই মার আবদারি গলা শুনা গেল— মৃ আজ আমি তোর সঙ্গে ঘুমাব।
আমি বললাম, আচ্ছা।
টেলিফোনের রিং পেয়ে কী ভেবেছিলি?
কিছু ভাবি নি মা।
পাশের কামরা থেকে আমি টেলিফোন করেছি এটা নিশ্চয়ই ভাবিস নি।
না তা ভাবি নি। আমার ঘরে ঘুমুলে চাইলে চলে এসো। তবে আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না। তুমি ঘুমাবে তোমার মতে, আমি বাতি জ্বালিয়ে কাজ করব।
মৃ তোর ঘর থেকে ঝড়ের শব্দ আসছে কেন?
ঝড়ের সিডি বাজছে এই জন্যে ঝড়ের শব্দ।
ঝড়ের সিডি আবার কী?
এসে শুনে যাও কী। এক্সপ্লেইন করতে পারব না।
তুই এত বিরক্ত হচ্ছিস কেন? সবাই দেখি আমার কথা শুনলে বিরক্ত হয়। আমার বাবা-মার ফ্যামিলির সবাই হয়। তোর বাবা হয়। তুই হোস। ব্যাপার কী?
টেলিফোনে এত কথা শুনতে ভালো লাগছে না মা। তুমি আসতে চাইলে চলে এসো।
আমার তো টেলিফোনে কথাবার্তা চালাতে খুবই ভালো লাগছে। খুব যারা ঘনিষ্ঠ তাদের মাঝে মাঝে উচিত টেলিফোনে কথা বলা। টেলিফোনে গলার শব্দ বদলে যায় তো– পরিচিত জনকে তখন মনে হয় অপরিচিত। খুব পরিচিত জনের সঙ্গে যত কথা বলা যায় মোটামুটি পরিচিত জনের সঙ্গে তারচে বেশি কথা বলা যায়। হ্যালো তুই কি টেলিফোন রেখে দিয়েছিল?
না।
মা গলার আওয়াজ নামিয়ে ফিসফিস পর্যায়ে নিয়ে এসে বললেন, তোকে টেলিফোন করার সময় মজার একটা কাণ্ড হয়েছে। তোর বাবা হঠাৎ ঘরে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ ভুরু টুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেছে।
এতে মজার কী হলো?
ওমা মজার না! তোর বাবা ভাবছে— গভীর রাতে হাসিহাসি মুখে কার সঙ্গে কথা? রহস্যটা কী? তোর বাবার মনে একটা কিন্তু তৈরি হয়েছে।
বাবার মনে এত সহজে কিন্তু তৈরি হয় না। বাবা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে কেন?
কয়েক রাত ধরেই তো এই অবস্থা। ঘুমাচ্ছে না, জেগে থাকছে। একটু পরপর বিছানা থেকে উঠে পানি খায়। কিছুক্ষণ বই পড়ার চেষ্টা করে, কিছুক্ষণ লেখার টেবিলে বসে হিসাব নিকাশ করে। বাকি সময়টা বারান্দায় হাঁটাহাটি করে।
কী ব্যাপার, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করো নি?
না। আমি কোনো প্রশ্ন করলেই তো তোর বাবা রেগে যায়। কী দরকার তাকে রাগিয়ে! মৃ তোর সিডি বন্ধ হয়ে গেছে, আবার দে। টেলিফোনে শুনছি তো আওয়াজটা রিয়েল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ঝড় হচ্ছে। একটু আগে যে মট করে শব্দ হলে সেটা কি গাছ ভাঙার শব্দ? টেলিফোনে না শুনে সিডি প্লেয়ারের সামনে বসে যখন শুনব তখন আর রিয়েল মনে হবে না। এটা নিয়ে তোর সঙ্গে বাজি ধরতে পারি।
মা শোনো, টেলিফোন কানের কাছে ধরে ধরে কান ব্যথা করছে। তুমি আসতে চাইলে আস– একটাই শর্ত আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আজ রাতের কাজের এখানেই ইতি। মা আমার ঘরে এসে সুবোধ বালিকার মতো ঘুমিয়ে পড়বেন তা কখনো হবে না। তার প্রধান চেষ্টাই থাকবে আমার সঙ্গে গল্প। করা। সেইসব গল্পেরও কোনো আগা মাথা নেই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গল্পগুলি লাফিয়ে যাবে। ইদানীং গল্পের নতুন এক প্রশাখা যুক্ত হয়েছে। প্যাকেজ নাটক বানায় এমন একজন মা-কে বলেছে তার নাটকে বড় খালার ভূমিকায় অভিনয় করতে। ভদ্রলোক নাটকের স্ক্রীপ্টও মা-কে দিয়েছেন। মার সব গল্প এখন বড় খালার চরিত্রে গিয়ে পড়ছে।
কিছু কিছু মানুষের মনে হয় মনের বয়স বাড়ে না। কিশোরী অবস্থায় মার মন যেমন ছিল— এখননা সে রকমই আছে। শরীর বুড়িয়ে যাচ্ছে। চামড়ায় ভাজ পড়ছে, চোখের নিচ ঝুলে পড়ছে। মাথার চুল পাকতে শুরু করছে। মা নানান রকম ক্রিম ঘষাঘষি শুরু করেছেন। ভিটামিন E ক্রিম। জয়পুরের মাটি দিয়ে মাড ট্ৰিটমেন্ট। চন্দন বাটার প্রলেপ জিনিসগুলো যে একেবারেই কাজ করছে। না তা না। মাঝে মাঝে মার বয়স খুবই কম মনে হয়। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী, কিংবা ইউনিভার্সিটিতে সদ্য ভর্তি হয়েছে এ রকম মনে হয়। তবে ব্যাপারটা খুবই অল্প সময়ের জন্যে ঘটে। আমার ধারণা এটা প্ৰকৃতির একটা খেলা। প্রকৃতি মাঝে মাঝে বয়স্ক মানুষের চেহারা থেকে বয়সের সব চিহ্ন সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে তারুণ্য দিয়ে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। বিভ্রম তৈরির খেলা প্রকৃতির খুবই প্রিয় খেলা।
মার এর মধ্যে চলে আসার কথা। তিনি আসছেন না। হয়তো মত বদলেছেন। টেলিফোন রিসিভার হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি হাতের রং মুছে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার শেষ মাথায় বেতের চেয়ারে পা তুলে বাবা বসে আছেন। তাঁকে আসবাবপত্রের মতো মনে হচ্ছে। কাওসার স্যার ক্লাসে বলেছেন চোখ খোলা রাখবে। যা দেখবে চোখ খোলা রেখে দেখবে। তাহলে বুঝবে ফার্নিচারকে মাঝে মাঝে জীবন্ত মনে হবে। আবার কিছু কিছু মানুষকে ফার্নিচার মনে হবে।
স্যারের অনেক কথাই ঠিক না। তবে একটা কথা একশ ভাগ ঠিক।
মানুষ নিজেকে Conditioned করে নিতে পছন্দ করে। বারান্দার শেষ মাথায় তিনটা বেতের চেয়ার আছে। বাবা বসে আছেন মাঝেরটায়। এই চেয়ার ছাড়া তাঁকে কখনো অন্য চেয়ারে আমি বসতে দেখি নি। আমি এগিয়ে গেলাম। বাবা আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। তিনি মনে হলে আমাকে আসতে দেখে খুশি হয়েছেন। অদ্রিার রোগী যখন রাত জাগে তখন যে-কোনো জাগ্রত মানুষকে দেখে খুশি হয়
আমি হালকা গলায় বললাম, বাবা, তোমার খবর কী?
কোনো খবর নেই।
ঘুম আসছে না।
না।
কেন ঘুম আসছে না?
জানি না কেন আসছে না।
ঘুমের অষুধ খেয়েছ?
পাঁচ মিলিগ্রাম ডরমিকাম খেয়েছি। কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমঝিম ভাব এসেছিল– কেটে গেছে।
কোনো বিশেষ কিছু নিয়ে তুমি কি টেনশন করছ?
না।
ব্যবসা ভালো চলছে?
ভালো চলছে না, তবে টেনশান করার মতো কিছু না।
বসব তোমার পাশে?
বোস।
তাহলে একটা কাজ করো বাবা তুমি মাঝখানের চেয়ারটা ছেড়ে অন্য যে-কোনো চেয়ারে বস। মাঝখানের চেয়ারটা আমাকে ছেড়ে দাও।
বাবা কোনো প্রশ্ন করলেন না। মাঝের চেয়ারটা ছেড়ে দিলেন। আমি বসতে বসতে বললাম, আজহার চাচার আনা কাফনের কাপড়টা কি তোমার মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি করেছে?
না।
আমার নিজের কিন্তু ধারণা করেছে। তোমার ঘুম না হওয়া রোগ শুরু হয়েছে এর পরই। এক কাজ করো কোনো ভিখিরিকে কাপড়টা দিয়ে দাও। কাফনের কাপড় এটা বলে দিতে হবে না বলো যে পায়জামা পাঞ্জাবি বানানোর জন্যে কাপড়। আজহার চাচার আনা এই বিশেষ বস্তুটা তুমি কেন। সিরিয়াসলি নিচ্ছ?
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, আজহার একটা গাধা। আমি কোন দুঃখে তার কথা সিরিয়াসলি নেব। গাধাটা গতকাল দুপুরে আমার অফিসে এসেছিল। কী বলতে এসেছিল জানিস? সে বনানী গোরস্তানে তার এবং তার স্ত্রীর কবরের জন্যে জায়গা কিনেছে। দুই লাখ টাকা লেগেছে। মহাআনন্দে এই খবর দিতে এসেছে। যেন রাজ্য জয় করেছে।
আমি বললাম, তাঁর কাছে এই খবরটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই তিনি এসেছেন। সবাই পৃথিবীটাকে দেখবে তার নিজের মতো করে। সেই দেখা ভুলও হতে পারে আবার শুদ্ধও হতে পারে। তোমার বন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে তোমার রাগ করা সাজে না। উনি গোরস্তানে জায়গা কিনছেন তাতে তুমি কেন রাগবে?
বাবা থমথমে গলায় বললেন, আমি রাগব কারণ গাধাটা আমার জন্যেও জায়গা কিনতে চায়। আমার কাছে এসেছিল এই জন্যে। জায়গার না-কি খুব টানাটানি। এখন না কিনলে পরে আর পাওয়া যাবে না। আজিমপুর গোরস্তানে যে অবস্থা হয়েছে। এখন আর জায়গা বিক্রি হচ্ছে না। ব্যাক ডোর দিয়ে জায়গা কেনাও বন্ধ। কিনলে এখনি কিনতে হবে।
তুমি কী বললে?
আমি বলেছি–কবরের জন্যে জায়গা কেনা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার কবর কোথায় হবে সেটাও ঠিক করা হয় নি। দেশের বাড়িতে হতে পারে। আমি খুব কঠিন গলায় আজহারকে বলেছি আমার কবরের জায়গা নিয়ে সে যেন মাথা না ঘামায়।
উনি মাথা ঘামালে ঘামাক। তুমি মাথা ঘামিও না। তুমি তোমার মতো থাকে।
তাই তো আছি।
না তা নেই। তুমি খুবই আপসেট হয়ে পড়েছ। এখন দয়া করে ডাউনসেট হও।
ডাউনসেটটা কী?
ডাউনসেট হলো আপসেটের উল্টোটা। বারান্দায় বসে না থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে শুয়ে পড়।
আমি বাবার ডান হাতটা ধরে নিজের কোলে রাখলাম। তিনি মনে হলে একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমার কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার পেয়ে তিনি অভ্যস্ত না। আমি আবারো বললাম, বাবা যাও ঘুমুতে যাও।
বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন, বসি আরো কিছুক্ষণ। ঘুমের প্রথম স্পেলটা কেটে গেলে সমস্যা আছে। এখন বিছানায় গেলে কাজের কাজ কিছু হবে না। তুই শুয়ে পড়।
আমার ঘুমুতে দেরি আছে। প্রজেক্ট শেষ করতে হবে। কাল জমা দেবার শেষ দিন।
রাত তিনটায় ঘুমুতে গিয়ে সকাল নটায় ক্লাস ধরতে অসুবিধা হয় না?
না হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। কফি খাবে বাবা? মধ্যরাতের কফির অন্য এক মজা আছে।
এমিতেই ঘুম হচ্ছে না–এর ওপর কফি?
বিষে বিষক্ষয়–হয়তো দেখবে কফি খেয়ে তোমার ঘুম পেয়ে যাবে। আমাদের নতুন একজন টিচার এসেছেন কাওসার নাম উনি সারাদিনে একটা সিগারেট খান। কখন খান জানো? ঠিক ঘুমুতে যাবার আগে। সিগারেট হচ্ছে তার ঘুমের ট্যাবলেট। সিগারেট অর্ধেক শেষ হবার আগেই ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে যায়। এমনও হয়েছে জ্বলন্ত সিগারেট তাঁর মুখে, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। সিগারেটের ছাকা খেয়ে তাঁর ঘুম ভেঙেছে।
তোদের টিচাররা কি ক্লাসে এইসব গল্প করে?
হ্যাঁ করে। আমাদের ক্লাসগুলো অন্যরকম Creativity class. এখানে কোনো নিয়ম নেই। নিয়ম না থাকাটাই আমাদের নিয়ম।
ভালো। যা কফি নিয়ে আয়।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরে যাবার আগে এক তলায় ভাইয়ার ঘরে উঁকি দিলাম। ভাইয়া গভীর ঘুমে। তার ঘরের দরজা খোলা। সে কখনো দরজা বন্ধ করে ঘুমুবে না। দরজা জানালা বন্ধ করলেই তার কাছে না-কি মনে হয় ঘরের বন্ধ দরজা জানালা আর খোলা যাবে না। কোনো কারণে আটকে যাবে। এই মনে করে তার দম বন্ধ হয়ে আসে এবং এক সময় নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়।
ভাইয়া জেগে থাকলে ভালো হতো। তাকে তার বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করতাম। নতুন কোনো এসাইনমেন্ট সে হাতে নিয়েছে কি-না। কত টাকার এসাইনমেন্ট। ছেলেটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে মন্দ হতো না। আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম আবার কোনোদিন রাতে সে যদি ছাদে ঘুমুতে আসে তাহলে তাকে কয়েক লাইন কবিতা শুনিয়ে বলব। এর মানে কী বলুন। তো।
পুলিশ আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বলুন দেখি এই দুটা লাইনের কী অর্থ–
অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়
পৃথিবীরে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
মগ ভর্তি কফি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দেখি বিছানায় এলোমেলো হয়ে মা ঘুমুচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে চিন্তা ভাবনাহীন কিশোরী এক মেয়ে বড় বনের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছে। তার আশা ছিল সে বোনের সঙ্গে স্কুলের কিছু মজার মজার কথা বলবে। আশা পূর্ণ হয় নি। বোন কাজ করছে। ছোট কিশোরী বিছানায় শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছে কখন বড় বোনের কাজ শেষ হবে। কখন বড় বোন বাতি নিভিয়ে বিছানায় আসবে। অপেক্ষা করতে করতে বেদারি ঘুমিয়ে পড়েছে।
কোলাজের কাজ শেষ হলো রাত সাড়ে তিনটায়।
চোখে মুখে পানি দিয়ে বাতি নিভিয়ে আমি মার পাশে জায়গা করে শুয়ে পড়লাম। মা সহজ গলায় বললেন–ঝড়ের ক্যাসেটটা দিয়ে দে। ঝড় বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমাই।
আমি বললাম, তুমি এতক্ষণ জেগেছিলে?
হুঁ, ছিলাম।
এতক্ষণ কি ঘুমের অভিনয় করছিলে?
হুঁ, করছিলাম। অভিনয়টা ভালো হয়েছে না? বড় খালার পাটটা করলে মনে হয় ভালোই পারব, কী বলিস?
নাটকের অভিনয়ের কথা বাদ দাও। নাটক ছাড়া এ রকম অভিনয় কি তুমি প্রায়ই করো?
হুঁ, করি। তোর বাবা কিছু বুঝতে পারে না।
আশ্চৰ্যতো!
আশ্চর্য হবার কী আছে? মেয়ে হয়ে কেউ জন্মাবে আর অভিনয় করবে না, এটা হতেই পারে না।
আমি কোনো অভিনয় করি না মা।
তুই তাহলে মহা বিপদে পড়বি।
বিপদে পড়লে পড়ব। আচ্ছা মা দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি। আমি কবিতার দুটা লাইন বলব তুমি এর কী অর্থ বলবে।
মা বিরক্ত গলায় বললেন, ঘুমাতে! বুড়ো বয়সে বাংলার পরীক্ষা দিতে পারব না।
আহা চেষ্টা করে দেখই না! কবিতার লাইন দুটা হলো–
অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়
পৃথিবীরে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
মা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জীবনানন্দ দাশের কবিতা না? অবসরের গান। এই কবিতার সবচে সুন্দর লাইনটা কী জানিস? সবচে সুন্দর লাইন–
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার
সাধ ভালোবেসে।
মা চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরলেন। আমি অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
মা ঘুমুচ্ছ?
হ্যাঁ ঘুমুচ্ছি।
তুমি আমাকে খুবই অবাক করেছ।
মাঝে মাঝে অবাক হওয়া খারাপ না।
তুমি চোখ বন্ধ করে আছো কেন? এসে গল্প করি। রাত তত বেশি বাকি নাই। এসে গল্প করে রাতটা পার করে দেই।
কী নিয়ে গল্প করবি?
তোমার যা ইচ্ছা। বড় খালার যে রোলটা করতে চাচ্ছ সেটা নিয়েও কথা বলতে পারি। রোলটা কেমন?
একটা মাত্র ডায়ালগ। আমি বসেউলের মোজা বানাচ্ছি, তখন নায়িকা এসে বলবে খালা কার জন্যে মোজা বানাচ্ছ? তার উত্তরে আমি বলব–জানি না। তখন নায়িকা বলবে তুমি মোজা বানাচ্ছ অথচ বলছ কার জন্যে মোজা বানাচ্ছ। জানোনা এটা কোন কথা? তার উত্তরে আমি রহস্যময় হাসি হাস।
রহস্যময় হাসি প্রাকটিস করেছ?
না।
আমি দেখিয়ে দেব কোনো সমস্যা নেই।
মা চিন্তিত গলায় বললেন, রহস্যময় হাসি আমি নিজেও পারব। আসল সমস্যা অন্য খানে উলের মোজা তো বানাতে পারি না। জীবনে কোনোদিন উলের কাঁটাই হাতে নেই নি।
মোজা বানানো শিখে নাও। বয়স্ক মহিলারা সবাই উলের মোজা বানাতে পারে। ওদের কাছে গেলেই পারো।
অভিনয় করছি এটা শুনে তোর বাবা আবার রাগ করবে না তো?
তোমার শখ হয়েছে তুমি অভিনয় করছ। বাবার তো এখানে রাগ করার কিছু নেই। বাবা যখন তার শখ মেটানোর জন্যে কিছু করে তখন তো তুমি রাগ করো না।
মা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। একজন পুরুষের রাগ করার যতটা অধিকার, একজন মেয়ের কিন্তু ততটা অধিকার নেই।
তার মানে?
মনে কর ভোর বাবার হঠাৎ শখ হলো একটা চা বাগান কিনবে। সে কিনে ফেলল। আমাকে কিছুই বলল না। আমি কিন্তু তাতে রাগ করতে পারব না। সে যদি সেই চা বাগানে তার অফিসের কোনো মহিলা কর্মচারীকে নিয়ে যায়, সপ্তাহে দু একদিন কাটিয়ে আসে তাতেও কিন্তু আমি রাগ করতে পারব না। কারণ সে গিয়েছে অফিসের কাজে। তাকে চিঠি লিখতে হবে। দেশের বাইরের যারা চা পাতা কিনবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। অসংখ্য মানুষকে টেলিফোন করতে হবে। টেলিফোন রিসিভ করতে হবে।
বাবা কি চা বাগান কিনেছে না-কি?
উদাহরণ দিচ্ছিরে মা। উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্যে চা বাগানের কথাটা বললাম। তোদর ইউনিভার্সিটির টিচাররা জটিল বিষয় উদাহরণ দিয়ে সহজ করে না? আমিও করেছি।
মা হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে বললেন উদাহরণ দিয়ে বুঝানো নিয়ে খুবই অশ্লীল একটা জোক আছে। অশ্লীল হলেও দারুণ হাসির। তার বিয়ে হোক তারপর বলব।
বিয়ে হোক আর না হেকি তোমার মুখ থেকে অশ্লীল রসিকতা শোনার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।
মা আবার শুয়ে পড়লেন। আমি মায়ের গায়ে হাত রেখে বললাম, ঘাই হরিণী কী তুমি জানো?
মা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জানি। কিন্তু তোকে বলা যাবে না। ঘাই হরিণী ব্যাপারটাও অশ্লীল। মা হয়ে আমি মেয়ের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলব? ভাবিস কি তুই আমাকে? আমি কি জীবনানন্দ দাশ।
মা হঠাৎ বালিশে মুখ গুঁজে হাসতে শুরু করলেন। আমি বললাম, হাসছ কেন?
হাসি আসছে এই জন্যে হাসছি।
কেন হাসি আসছে জানতে পারি?
তুই নাকি একজনের প্রেমে পড়েছিস এই ভেবে হাসি আসছে।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, আমি কারো প্রেমে পড়ি নি। আর যদি পড়েও থাকি এখানে হাসির কী হলো?
কোনো ছেলের প্রেমে পড়িস নি? আমাকে যে বলল তোদের একজন টিচারের সঙ্গে তোর প্রেম হয়েছে। সবাই তাকে গরু স্যার ডাকে। হি হি হি।
হাসি থামাও তো মা। এইসব কে বলেছে?
ঐ দিন ফরিদাদের বাসায় গিয়েছিলাম। সে বলল।
আমি চুপ করে গেলাম। মার অনেক বিচিত্র স্বভাবের একটা হলো আমার সব বান্ধবীর সঙ্গে তার খুব ভালো যোগাযোগ। তিনি নিয়মিত তাদের বাসায় যাবেন। সমবয়সীদের মতো হৈচৈ করবেন এবং ব্যাপারটা আমার কাছ থেকে গোপন রাখবেন।
মা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, মৃন্ময়ী তুই তোর গৰু স্যারকে একদিন বাসায় নিয়ে আসিস তো। আমি লন থেকে কাঁচা ঘাস কেটে রাখব। হি হি হি।
মা পাগলের মতো হাসছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে মা মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না।
মৃন্ময়ী!
বলো।
আমার মনে হচ্ছে তার বিয়ে হবে আজহার সাহেবের ছেলের সঙ্গে। আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে। বিয়েটা যেহেতু ঠিক হয়েই আছে কাজেই গরু স্যারের সঙ্গে প্রেমটা না হলেই ভালো হয়। টিচার মানুষ হাফসোল খাবে। কাজটা ঠিক হবে না।
মা, চুপ করো তো!
এই রসিকতা মা প্রায়ই করে। আজহার চাচার ছেলেটাকে নিয়ে রসিকতা। ছেলেটা জড়ভরতের মতো। মানসিকভাবে হয়তোবা সামান্য অসুস্থ। কোথাও বসে আছে তো বসেই আছে। কোনো দিকে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে।
ছোটবেলায় আমাদের বাসায় আসত। ঘরের কোনো অন্ধকার কোণ খুঁজে বসে থাকত। কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দিত না। শুধু যদি মা বলতেন, এই শোন মৃন্ময়ীকে বিয়ে করবি?
সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে নরম গলায় বলত, করব।
মা হেসে ভেঙে পড়তেন। রাগে আমার গা জ্বলে যেত। এখনো রাগ লাগছে। মানুষের অসুস্থতা নিয়ে রসিকতা করার কোনো মানে হয় না।
মা বললেন, তোর আজহার চাচার এই ছেলে তো খারাপ না। স্বামী হিসেবে আদর্শ হবে। যেখানে বসিয়ে রাখবি বসে থাকবে। তোর দিকে প্রেমপূর্ণ নয়নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। খেতে দিলে খাবে। খেতে না দিলে খাবে না। হি হি হি।
আমি কঠিন গলায় বললাম, মা প্লিজ হাসবে না।
মা বললেন, আজহার সাহেবকে তোর বাবা চিনতে পারে নি। আজহার সাহেব কচ্ছপ রাশি। কচ্ছপ রাশির মানুষ একবার কোনো কিছু কামড়ে ধরলে ধরেই থাকবে। দেখিস সে ঠিকই তোর বাবার কাছে কবরের জায়গা বিক্রি করবে। তোর সঙ্গেও তার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিবে।
আমার সঙ্গে কি তিনি তার ছেলের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?
অবশ্যই চাচ্ছে।
মা আবারও হাসি শুরু করলেন। তিনি কেন হাসছেন কে জানে?