Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃন্ময়ী (২০০১) || Humayun Ahmed » Page 2

মৃন্ময়ী (২০০১) || Humayun Ahmed

প্রথম ক্লাস

প্রথম ক্লাস সকাল সাড়ে নটায়। এই ক্লাসটায় আমি রোজ লেট করি। এবং রোজই ভাবি আজ থেকে ক্লাস শুরু হবার দশ মিনিট আগেই ইউনিভার্সিটিতে চলে যাব। ফজলু মিয়ার ক্যান্টিনে কফি খাব। ফজলু মিয়ার কফি এমন অসাধারণ কিছু না। তবে খুব তাড়াহুড়া করে খেলে অসাধারণ লাগে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে এক্ষণি ক্লাসে ঢুকতে হবে, অথচ হাতে মগভর্তি কফি তখন কফিটা লাগে অসাধারণ।

আমি গাড়িতে উঠতে যাব–দোতলার বারান্দা থেকে মা হাত ইশারায় ডাকলেন। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গি। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোনো দুর্ঘটনা বাসায় ঘটে গেছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম, আবার দোতলায় উঠলাম। মা বললেন, যাচ্ছিস কোথায়?

এ ধরনের প্রশ্নের কোনো মানে হয়? মা জানে না আমি কোথায় যাচ্ছি? সকাল নটায় তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বের হবার উদ্দেশ্য তো একটাই।

ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি মা।

আজ না গেলে হয় না?

তেমন ভয়ঙ্কর কোনো কিছু ঘটে গেলে না গেলে হয়। ভয়ঙ্কর কিছু কি ঘটেছে?

আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি?

সেই এক জায়গাটা কোথায়? তাড়াতাড়ি করে বল তো মা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

মা ঝলমল করে উঠলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন, মৌচাক মার্কেট। সিল্ক শাড়ির একটা এগজিবিশন হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।

তুমি দাওয়াতের কার্ড পেয়েছ?

আমি কার্ড পাব কেন? আমি কি মহিলা এমপি? জাস্ট দেখতে যাব। পছন্দের কোনো শাড়ি পেলে কিনব। তুই পছন্দ করে দিবি। অনেক শাড়ি এক সঙ্গে দেখলে আমার মাথা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়! যে রঙটা সেখানে সবচে ভালো মনে হয়, বাসায় এনে দেখি সেটাই সবচে খারাপ।

তুমি শাড়ি কিনবে এইজন্য আমি ক্লাস মিস দেব?

একদিন দিবি। একদিনে তো তুই এমন কিছু পণ্ডিত হয়ে যাবি না। শাড়ি এগজিবিশনে প্রথম দিনেই যেতে হয়। ভালো ভালো শাড়ি প্রথম দিনেই শেষ হয়ে যায়।

আমি যাব না মা।

এরকম করিস কেন? তুই তো জানিস আমি একা একা কোথাও যেতে পারি না। আমার একা যাওয়া ঠিকও না।

ভাইয়াকে নিয়ে যাও। ও ঘরে বসে আছে।

ছেলেমানুষ সে, শাড়ির কী বুঝবে?

না বুঝলে না বুঝবে – মা আমি গেলাম। আজও আমার দেরি হয়ে গেল— ফজলু মিয়ার কফি খাওয়া হলো না।

মা উৎসাহী গলায় বললেন, ফজলু মিয়ার কফি ব্যাপারটা কীরে? তোর মুখে আগেও কয়েকবার শুনেছি।

আমি জবাব না দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামছি। মা-ও নামছেন। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি টেনশনে পড়েছেন। ফজলু মিয়ার কফির রহস্য ভেদ না হওয়া পর্যন্ত টেনশন কমবে না। আমি নিশ্চিত গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার মোবাইল বেজে উঠবে। মা জিজ্ঞেস করবেন ফজলু মিয়ার কফি ব্যাপারটা কী-রে? ফ্লাঙ্কে করে আমার জন্যে নিয়ে আসিস তো।

মোবাইল টেলিফোনের ঝামেলা ক্লাসের মধ্যেও চলতে থাকবে। মা যদি শেষ পর্যন্ত শাড়ির এ এগজিবিশনে যান তাহলে সেখান থেকে সাজেশান চেয়ে। টেলিফোন আসবে, হালকা গোলাপি রঙটা তোর কাছে ভালো লাগে না হালকা আকাশি? গাঢ় রঙের কোন শাড়ি কিনব? মোটা মানুষদের নাকি গাঢ় রঙ মানায়। তাদের চিকন দেখা যায়। সত্যি না-কি?

যথারীতি আজও ক্লাসে দেরি হলো। নতুন একজন টিচার এসেছেন। রোল কল শুরু হয়েছে। তিনি ডাকলেন, রোল ফিফটিন। আমি ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, ইয়েস স্যার। পুরো ক্লাস এক সঙ্গে হেসে উঠল। আমাদের এই ক্লাসের হাসি রোগ আছে। অতি তুচ্ছ কারণে সবাই আমরা এক সঙ্গে হাসি। নতুন টিচার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তোমার নাম কী?

মৃন্ময়ী।

নামটা রেজিস্টার খাতায় আছে, তারপরেও আলাদা করে নাম জিজ্ঞেস করায় আনন্দ আছে। তাই না?

জ্বি স্যার।

ভদ্রলোক বললেন, আমাকে স্যার ডাকবে না। স্যার ডাক আমার খুবই অপছন্দের। ডিজাইন ক্লাসে আমরা সবাই ছাত্র। ঠিক আছে?

জ্বি, ঠিক আছে।

যাও বোস। তুমি বসার পর ক্লাশ শুরু হবে।

আমি ফরিদার দিকে এগুচ্ছি। ফরিদার পাশের চেয়ারটা আমার। সব সময় সেখানেই বসি। কিছু একটা সমস্যা মনে হয় হয়েছে। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একজন ছাত্রী সামান্য দেরি করে ক্লাসে এসেছে। সে তার জন্যে নির্দিষ্ট করা চেয়ারটায় বসতে যাচ্ছে এটা এমন কোনো দৃশ্য না যে দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকতে হবে। এটা তো আলফ্রেড হিচককের ছবির সেট না। আর্কিটেকচার বিভাগের ফোর্থ সেমিস্টারের ডিজাইন ক্লাস। নতুন টিচার যে তাকিয়ে আছেন সেটা উনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি। মেয়েদের মাথার পেছনে ছটা অদৃশ্য চোখ থাকে। কোনো পুরুষ যদি পেছন থেকে তার দিকে তাকায় তাহলে সে অদৃশ্য চোখ দিয়ে দেখতে পায়।

মৃন্ময়ী।

জ্বি।

তুমি কি সব সময় এই চেয়ারটায় বস?

জ্বি।

আজ প্রথমদিন, কাজেই আমি কিছু বলছি না। সবাই আজ তাদের পছন্দের জায়গায় বসবে। কাল থেকে এই নিয়ম থাকবে না। একই চেয়ারে কেউ দ্বিতীয় দিন বসবে না। মানুষ Conditional হতে পছন্দ করে। খাবার টেবিলে দেখবে প্রত্যেকের জন্যে জায়গা ঠিক করা। এই চেয়ারটা মার। এই চেয়ারটা বড় মেয়ের। খেতে বসলে ঐ চেয়ার ছাড়া কেউ বসবে না। মানুষ খুবই স্বাধীন প্রাণী কিন্তু অদ্ভুত কারণে সে ভালোবাসে শিকল পরে থাকতে। আমরা যারা ডিজাইন ক্লাসের ছাত্র তাদেরকে শিকল ভাঙতে হবে সবার আগে। মৃন্ময়ী কী বলছি বুঝতে পারছ?

পারছি স্যার।

আগে একবার বলেছি। আবারো বলি আমাকে স্যার ডাকবে না।

ফরিদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার না ডাকলে আপনাকে কী ডাকব?

নাম ধরে ডাকবে। আমার নাম কাওসার। বোৰ্ড লিখে দিচ্ছি।

ভদ্রলোক বোর্ডের কাছে গিয়ে বড় করে লিখলেন

COW-SIR

আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। নামের বিচিত্র বানান দিয়ে তিনি কি সবাইকে অভিভূত করতে চাইছেন? নাম নিয়ে এই রসিকতা তৈরি করতে তাঁর নিশ্চয়ই বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। এই রসিকতায় নিশ্চয়ই অতীতে অনেকে মজা পেয়েছে। আমি পাচ্ছি না। আমার বিরক্তি লাগছে। আচ্ছা আমি কি আমার নাম নিয়ে এমন কিছু করতে পারি? Mrinmoye-কে লেখা যেতে পারে

MR IN MOYE

তাতে লাভ কি কিছু হয়? নামের আগে MR চলে আসে এইটুকু লাভ।

ভদ্রলোকের বয়স কত হবে? পঁয়ত্রিশ কিংবা তারচেয়ে কম। পাঁচমিশালী রঙে ভর্তি শার্ট পরে আছেন। ডান হাতে লাল রঙের ব্যান্ড জাতীয় কিছু। পাংকু বলতে পারলে ভালো হতো। তা বলা যাবে না। ভদ্রলোকের Ph.D ডিগ্রি আছে। আমাদেরকে জানানো হয়েছে–অসম্ভব মেধাবী একজন টিচার জয়েন করছেন। তিনি ডিজাইন ক্লাস নেবেন। বড়লোকের ফেলটুস ছেলে হাতে লাল ব্যান্ড পরলে পাংকু হয়ে যায়, কিন্তু Ph.D ওয়ালা অসম্ভব মেধাবী কেউ কি তা হন? সহজ সাধারণ কিছু পরে থাকলে তাকে অনেক সুন্দর লাগত। আমার ধারণা ভদ্ৰলোক যদি কালো প্যান্টের ওপর হালকা হলুদ পাঞ্জাবি পরতেন তাঁকে অনেক বেশি মানাত।

ফরিদা ফিসফিস করে বলল, এই লোক না-কি দারুণ বিলিয়ন্ট। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে রেকর্ড নাম্বার পেয়ে পাস করেছে। কিন্তু নিজের নাম নিয়ে কী ছাগলামি করছে দেখেছি। আমাদের স্কুলের ছাত্র ভাবছে। কি-না কে জানে। যখন ধরা খাবে তখন টের পাবে।

ভদ্রলোক ফরিদার দিকে তাকিয়ে বলবেন তুমি মনে হয় আমাকে নিয়ে মাছ মাছ করছ।

ফরিদা মুখ শুকনা করে বলল, মাছ মাছ করছি মানে কী স্যার?

মাছ মাছ মানে Fish Fish. তুমি আমাকে নিয়ে ফিসফিস করছ। যাই হোক ভালো করে লক্ষ কর

আমার নামের মধ্যেই Sir আছে। নামের শুরুতে একটি নিরীহ প্রাণী আছে। আমি নিজেও ঐ প্রাণীটির মতোই নিরীহ। আমি যতদূর জানি আজ তোমাদের একটা প্রজেক্ট জমা দেবার কথা। টেবিল ল্যাম্প। তোমরা প্রজেক্ট এনেছ?

ফরিদা বলল, আমি ছাড়া সবাই এনেছে।

তুমি আনো নি কেন?

আমি কখনোই সময় মতো কোনো প্রজেক্ট জমা দিতে পারি না।

কোনো সমস্যা নেই। তোমার যখন প্রজেক্ট জমা দিতে ইচ্ছা করবে জমা দেবে। এতে নাম্বার কাটা যাবে না। আমার ক্লাসে নাম্বার কাটা যাবার কোনো সিস্টেম নেই। আর আমার ক্লাসে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের জবাব দেবার কিছু নেই।

প্রজেক্ট জমা নেওয়া শুরু করার আগে কিছুক্ষণ গল্প করলে কেমন হয়?

ফরিদা বলল, ভালো হয় স্যার।

কাওসার বলল, একটু আগেই বলেছি আমাকে স্যার ডাকা যাবে না। আমি প্রশ্নটা আবার করছি—প্রজেক্ট জমা নেওয়া শুরু করার আগে কিছুক্ষণ গল্প করলে কেমন হয়?

ফরিদা বলল, ভালো হয় ভাইয়া।

আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আমার মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোক নিজেকে ইন্টারেস্টিং করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। এক্ষুণি হয়তো পকেট থেকে কয়েন বের করে কয়েন ভ্যানিসের একটা ম্যাজিক দেখাবেন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জোক বলে সবাইকে হাসাবেন। কিছু জোক থাকবে মোটামুটি অশ্লীল। এবং তিনি যে মহাজ্ঞানী এই ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে কঠিন কঠিন সব তত্ত্ব কথা বলবেন। সদ্য আমেরিকা ফেরত শিক্ষকরা আমেরিকান শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক ফাজলামি শিখে আসে। সেই জিনিস যে বাংলাদেশে চলে না তা বুঝতে পারে না। কিছুদিন আমেরিকান ফাজলামি করে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত এই জ্বলোক দুতিন মাসের মধ্যেই বদলাবেন এবং সময়মতো প্রজেক্ট জমা না দেয়ার জন্যে নাম্বার কাটা শুরু করবেন।

আচ্ছা বলো, সুন্দর ব্যাপারটা কী? কিছু কিছু বস্তু দেখে আমরা বলি সুন্দর। কেন বলি? এই ছেলে নারিকেলের মালা দিয়ে একটা টেবিল ল্যাম্প বানিয়েছে। আমরা বললাম— সুন্দর হয়েছে। কেন বললাম!

কেউ জবাব দিল না। ভদ্রলোক বললেন, সুন্দর অসুন্দরের প্রভেদটা আমরা কীভাবে করি?

এবারও সবাই চুপ করে রইল। ভদ্রলোক তিনটা ফুলস্কেপ কাগজ দিয়ে দলা পাকিয়ে তিনটা বলের মতো বানালেন। তিনটা তিন ধরনের বল। তারপর বললেন, টেবিলের ওপর তিনটা বল দেখতে পাচ্ছ। তিনটা বলের মধ্যে একটা অনেক সুন্দর লাগছে। বলো দেখি কোনটা?

বেশ কয়েকজন ছাত্র এক সঙ্গে বলল, মাঝেরটা।

দ্ৰলোক বললেন, এখন দেখ কী করি বলগুলোর ওপর আমি আলো ফেলব। আলো এমনভাবে ফেলা হবে যে মাঝের বলটা আর সুন্দর লাগবে না।

আমি অবাক হয়েই দেখলাম ভদ্রলোকের কথা ভুল না। মাঝখানের বলটা এখন আর সুন্দর লাগছে না, বরং প্রথম বলটা সুন্দর লাগছে।

ভদ্রলোক মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বললেন, এখন বলো দেখি সুন্দর কী? Define beauty. মৃন্ময়ী তুমি বলো সুন্দর কী?

আমি চুপ করে আছি। সুন্দর অসুন্দরের কচকচানিতে যেতে চাচ্ছি না। তাছাড়া আমার মোবাইল বাজতে শুরু করেছে। মা টেলিফোন করেছেন। হয়তো শাড়ি বিষয়ক কিছু বলবেন। সিল্ক এগজিবিশনে মা যাবেন না তা হবে না। আমি মোবাইল অফ করে দিলাম।

মৃন্ময়ী চুপ করে আছ কেন? বলো সুন্দর কী? উঠে দাঁড়াতে হবে না। বসে বসে বলো। মোবাইলে মনে হয় কেউ একজন তোমাকে ফোন করেছে। নাম্বারটা দেখে রাখ। আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে কল ব্যাক করো।

আমি বললাম, যা দেখতে ভালো লাগে তাই সুন্দর।

তুমি বলতে চাচ্ছ যা দেখে চোখ আরাম পায় তাই সুন্দর?

জ্বি।

তার মানে হলো চোখ সব সময় আরাম পায় না। সব সময় একটা কষ্টের মধ্যে থাকে। মাঝে মাঝে সে আরাম পায়। যা দেখে সে আরাম পায় তাকে বুলি সুন্দর। এই তো?

আমি বুঝতে পারছি না একটু কনফিউজড বোধ করছি।

কনফিউজড বোধ করলে লজ্জা পাবার কিছু নেই। সৌন্দর্যের ব্যাখ্যার ব্যাপারে অনেক বিখ্যাত মানুষই কনফিউজড বোধ করেছেন। নোবেল পুরস্কার পাবার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়েছিলেন আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। আইনস্টাইন হঠাৎ করে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা কী? রবীন্দ্রনাথকে থমকে যেতে হয়েছিল। যাই হোক, মৃন্ময়ী সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিতে পারছে না।

ভদ্ৰলোক হাসি হাসি মুখে একেকজনের দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর দৃষ্টি হঠাৎ থমকে গেল। তিনি বললেন— Young man আসগার না তোমার নাম?

আসগার খুবই হকচকিয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়েস স্যার।

তোমার নাম যে আসগার এটা কী করে জানলাম বলো তো?

বলতে পারছি না স্যার।

আমি রোল কল করার সময় সবার নাম দেখে নিয়েছি। সতেরোটা নাম মনে রাখা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না। নাম মনে রাখারও পদ্ধতি আছে। তোমরা চাইলে তোমাদের শিখিয়ে দেব। এখন তুমি বলো সৌন্দর্য কী?

জানি না স্যার।

মনে কররা তুমি গুলশান এলাকায় হেঁটে যাচ্ছ। চারপাশে দালান। তুমি কোনোটাকে বলছ সুন্দর, কোনোটাকে বলছ অসুন্দর। কেন বলছ? বিচার বিবেচনাটা কীভাবে করছ?

আসগার বলল, আমি কোনো বিবেচনা করি না স্যার। আমি হেঁটে চলে যাই। হাঁটার সময় মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটি।

ক্লাসের সবাই হেসে উঠল। সবচে বেশি হাসলেন কাওসার সাহেব। হাসি থামিয়ে বললেন, ভালো আর্কিটেক্ট হবার সম্ভাবনা তোমার সবচে বেশি। যারা সারাক্ষণ সুন্দর সুন্দর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তারা আসল কাজ পারে না। যেমন ধরো আমি। আমি যে কটা ডিজাইন করেছি তার সবকটাই অতি নিম্নমানের। যাই হোক, এস মূল বক্তব্যে ফিরে যাই– সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার নিজের ব্যাখ্যাটা বলি। খাতা খুলবে না—আমি যা বলব শুধু শুনে যাবে, খাতায় নোট করবে না।

আমার নিজের ধারণা–জীবন্ত কিছু মানেই সুন্দর। জড় বস্তুকে তখনি সুন্দর মনে হবে যখন মনে হবে এর ভেতর প্রাণ আছে। প্রাণটা স্পষ্ট না, অস্পষ্ট। তবে আছে। যখন মনে হবে আছে তখনি সেটা আমাদের কাছে সুন্দর লাগে। এক গাদা রট আয়রন তুমি ফেলে রাখলে এর প্রাণ নেই কাজেই অসুন্দর। ওয়েল্ডিং মেশিন এনে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে তুমি একটা খাট তৈরি করলে। খাটের মধ্যে প্রাণ তৈরি হলো। খাটটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ যখন খাটে ঘুমুতে আসে তখন সে আনন্দিত হয়। কাজেই খাটে সৌন্দর্য তৈরি হলো। এই প্রাণ যে যত বেশি তৈরি করতে পারবে সে তত বড় শিল্পী। আমার বক্তৃতা কি কঠিন মনে হচ্ছে।

না।

এখন একটু কঠিন কথা বলি– সুন্দরের সঙ্গে সব সময় দুঃখবোধ মেশানো থাকে। মহান সৌন্দর্যের সঙ্গে বেদনাবোধ মেশানো থাকতেই হবে। এডগার এলেন পোর এই কয়েকটা লাইন ব্যাপারটা সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে। খাতা খোল, এই কয়েকটা লাইন খাতায় লিখে নাও। তার মতে সৌন্দর্য হচ্ছে

A feeling of sadness and longing
That is not akin to pain,
And resembles sorrow only
As the most resembles the rain.

তোমাদের প্রজেক্টগুলো জমা নিয়ে আমি এখন তোমাদের ছুটি দিয়ে দেব। তোমাদের একটা হোম এসাইনমেন্ট আছে—সৌন্দর্য কী? এই নিয়ে এক পৃষ্ঠার একটা লেখা লিখবে। কোন মনীষী সৌন্দর্য সম্পর্কে কী বলেছেন এইসব কচকচানি না। তুমি কী ভাবছ সেটা লিখবে। ঠিক আছে?

জ্বি ঠিক আছে।

এখন আমি তোমাদের কাছে একটা পরীক্ষা দেব। এক এক করে তোমাদের সতেরো জনের নামই আমি বলব। আমি যখন বলেছিলাম তোমাদের সবার নাম আমি জানি তখন তোমরা সেটা বিশ্বাস করে নি। প্রথমেই যদি আমার কথার ওপর বিশ্বাস না থাকে পরে আরো থাকবে না। টিচার হিসেবে আমি যা বিশ্বাস করাতে চাই তা বিশ্বাস করাতে পারব না।

ফরিদা বলল, স্যার আপনার পরীক্ষা দিতে হবে না। আপনি ফেল করবেন, তখন আমাদের সবার খারাপ লাগবে।

আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আমাদের নাম্বার বলতে শুরু করলেন। কোনো ভুল হলো না। সবাইকে খানিকটা চমকে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী রোল ফিফটিন ক্লাসের শেষে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

আমি হঠাৎ একটা ধাক্কার মতো খেলাম। তবে সঙ্গে সঙ্গে মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। এই ভদ্রলোকের আলাদা করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কারণটা স্পষ্ট না। তিনি কী বলতে চান সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা থাকলেও নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত রাখা যেত। আকাশ জোড়া মেঘ থাকলে ছাতা হাতে পথে নামতে হয়। সুন্দরবনে মধুর খোজে বাওয়ালীরা যখন ঢেকে তাদের সঙ্গে একজন থাকে গাদা বন্দুক নিয়ে। প্ৰস্তুতি থাকেই। শুধু আমার কোনো প্রস্তুতি থাকবে না।

আমি লক্ষ করলাম ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা মুখে চাপা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ক্লাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আসগার আমার ডেস্কের কাছে এসে বলল, আমাদের নতুন স্যারের জন্যে একটা নাম পাওয়া গেছে। তোমার এপ্রোভেল পাওয়া গেলেই নামটা চালু করা যায়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার এপ্রোবেলের প্রশ্ন আসছে কেন?

তোমাকে উনি এপ্রোভ করেছেন বলেই তোমার এপ্রোভেলের প্রশ্ন আসছে। উনি নিজের নাম তো Cow-sir লেখেন, ঐটাই বাংলা করে গরু স্যার। উনার আপত্তি করার কিছু থাকল না। কি এপ্রোভ করছ তো?

আমি কিছু বললাম না, তবে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম কাওসার নামের এই ভদ্ৰলোক অতি দ্রুত গরু স্যার হিসেবে পরিচিত হবেন। এমন একটা নামের ভার বহন করার মতো শক্তি ভদ্রলোকের কি আছে? থাকার কথা না। বেশির ভাগ মানুষের মনের জোর তেমন থাকে না। ভদ্রলোকের অবস্থা ছেড়ে দে ছাত্ৰ সমাজ কেঁদে বাঁচি হবার কথা।

স্যার আসব?

ভদ্রলোক তাঁর ঘরে কম্পিউটারের কানেকশন জাতীয় কী করছিল। এখন চোখে চশমা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে? ভাবটা এরকম যেন আমাকে চিনতেই পারছেন না। আমি বললাম, স্যার আমি মৃন্ময়ী।

কিছু বলবে?

আপনি বলেছিলেন ক্লাসের শেষে যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি। আমি দেখা করতে এসেছি।

ও আচ্ছা আচ্ছা। সরি ভুলে গিয়েছিলাম। এসো। চেয়ারটায় বোস।

আমি চেয়ারে বসলাম। আমার মেজাজ খারাপ লাগছে। ভদ্রলোক বেশ ভালো করেই জানেন তিনি আমাকে আসতে বলেছেন। তারপরেও ভান করলেন তাঁর মনে নেই। এই ভানটা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

মৃন্ময়ী তোমার কি বাড়িতে ফেরার খুব তাড়া আছে? তাড়া থাকলে আজ চলে যাও। অন্য আরেকদিন কথা বলব আমি পোর্ট লাইনের কানেকশনটা দিতে পারছি না। কানেকশন না দিতে পারা পর্যন্ত অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারছি না।

আপনি কানেকশন দিন আমি অপেক্ষা করছি। কী জন্যে ডেকেছেন এটা না জানা পর্যন্ত আমার নিজের মধ্যেও এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করবে।

অস্বস্তি কাজ করবে কেন?

আজ আপনার সঙ্গে আমাদের প্রথম ক্লাস হলো। ক্লাসের মাঝখানে বেশ আয়োজন করেই আপনি আমাকে বললেন, আমি যেন আপনার সঙ্গে দেখা করি। অস্বস্তির কারণটা এইখানেই।

তোমাদের এখানে কি এই নিয়ম যে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রকে দেখা করতে বলতে পারবে না?

অবশ্যই বলতে পারবে। তবে তার জন্যে কারণ থাকতে হবে।

গল্প করার জন্যে আমি কাউকে ডাকতে পারি না? ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কি একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করা যায় না? সব সময় দূরত্ব থাকতে হবে? আমি। নিয়ম ভাঙতে চাই।

নিয়ম ভাঙতে হলে শক্তি লাগে। সেই শক্তি কি আপনার আছে?

আমার ধারণা আছে।

থাকলে তো ভালোই।

ক্লাসে আমার বক্তৃতা তোমার কেমন লাগল?

ভালো। তবে আপনার প্রধান চেষ্টা ছিল আপনি যে অন্যদের চেয়ে আলাদা এটা প্রমাণ করা। কেউ যদি আলাদা হয় এমিতেই তা ধরা পড়ে। আয়োজন করে আমি আলাদা এটা প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আপনার এই জিনিসটা আমার খারাপ লেগেছে।

তোমার নিজের কি মনে হয় না আমি অন্যদের মতো না? আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা?

আমি শান্ত গলায় বললাম, আমাদের ক্লাসে সতেরো জন স্টুডেন্ট। এই সতেরো জনের ভেতর থেকে আপনি আমাকে সিঙ্গেল আউট করে প্রশ্নগুলো করছেন কেন?

কারণ তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। প্রথম দেখাতেই পছন্দের একটা কথা সমাজে প্রচলিত। ঐ ব্যাপারটাই ঘটেছে। তোমাকে আলাদা একটি মেয়ে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি হয়তো অন্য আর দশজনের মতোই কিন্তু তুমি না। আমার ধারণা হয়েছে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে আমার ভালো লাগবে। এইজন্যেই তোমাকে খবর দিয়েছি। আমি যদি সমাজের আর দশজনের মতো হস্তাম আমি আমার পছন্দের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতাম। অল্প অল্প করে তোমার সঙ্গে পরিচয় হতো। একদিন হয়তো ডিজাইনের একটা বই তোমাকে পড়তে দিলাম। বই ফেরত দেবার সময় এক কাপ কফি খাওয়ালাম। টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে দিলাম যাতে ক্লাসের কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে টেলিফোন করতে পারো। তারপর একদিন তোমার টেলিফোন নাম্বার নিলাম। নানান ধাপ পার হয়ে আসা। আমি সবগুলি ধাপ এক সঙ্গে পার হতে চাই। তুমি আমার কথায় হার্ট হচ্ছ না তো?

না হার্ট হচ্ছি না। আমি যখন আপনার ঘরে ঢুকলাম তখন কিন্তু আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি বা না-চেনার ভান করেছেন।

তুমি একটা ব্যাপার লক্ষ করে নি। আমি শর্ট সাইটেড মানুষ। আমার চোখে চশমা ছিল। কাছের জিনিস দেখার জন্য আমি যখন চশমা পরি তখন দূরের জিনিস দেখতে পাই না। তোমাকে আমি আসলেই চিনতে পারি নি। তুমি কি কফি খাবে? আমি খুব ভালো কফি বানাতে পারি।

না, কফি খাব না।

আইসক্রিম খাবে? আমি শুনেছি ঢাকা শহরে খুব ভালো ভালো আইসক্রিমের দোকান হয়েছে।

না আইসক্রিমও খাব না। আমাকে বাসায় যেতে হবে।

আমি তোমাকে নামিয়ে দেই। বাসাটাও চিনে আসি। কখননা যদি যেতে বলে চট করে চলে যেতে পারব। তোমাকে কষ্ট করে ঠিকানা বলতে হবে না। আমি যদি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই তাতে কি তোমার আপত্তি আছে?

না, আপত্তি নেই।

থ্যাংক য়্যু।

আমি বিরক্ত বোধ করছি। বিরক্তি চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের একজন শিক্ষক যদি আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে চান তাতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষটা নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চেষ্টাটা যে হাস্যকর তাও ভদ্ৰলোক বুঝতে পারছে না। মানুষটা কি বোক? যে এক লাফে অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে চায় তার প্রথমেই জানতে চাওয়া উচিত যাকে নিয়ে সে সিঁড়ি ভাঙতে চাচ্ছে সে কি তা চায়?

আমি বললাম, স্যার আপনার কি দেরি হবে?

স্যার হাসিমুখে বললেন, না দেরি হবে না। পোর্ট কানেকশন আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক্সপার্ট কাউকে আনতে হবে। ভালো কথা— মোটর সাইকেলে চড়া কি তোমার অভ্যাস আছে?

মোটর সাইকেল?

গাড়ি আমার খুবই অপছন্দ। মোটর সাইকেল আমার অতি পছন্দের বাহন। মোটর সাইকেলে You can feel the speed. মোটর সাইকেলে কখনো চড়েছ?

না।

চড়তে আপত্তি আছে?

না আপত্তি নেই।

বাঙালি মেয়েদের সম্পর্কে আমার যে কনসেপ্ট ছিল তার অনেকখানিই তুমি ভেঙে দিয়েছ। মোটর সাইকেলে তুমি আমার পেছনে যাচ্ছ এই দৃশ্য দেখে তোমার বন্ধুরা তোমাকে ক্ষেপাবে না তো?

না ক্ষ্যাপাবে না।

দ্যাটস ভেরী গুভ। যেহেতু এই প্রথমবার তুমি মোটর সাইকেলে চড়বে দেখবে তোমার খুবই ভালো লাগবে। বাতাসে চুল উড়বে, শাড়ির আঁচল উড়বে। তোমার একটা ফিলিং হবে তুমি আকাশে উড়ছ। Flying Dutchman. চিন্তা করতেই ভালো লাগছে না?

আমি জবাব দিলাম না। ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার মোটেই ভালো লাগছে। না। নিজের ওপর রাগ লাগছে। আমি তো এরকম ছিলাম না। যা মনে এসেছি বলেছি। আজ কেন এরকম হলো? মোটর সাইকেলে চড়তে আমার খুবই আপত্তি আছে। অথচ বললাম, আপত্তি নেই। কেন বললাম? আমিও কি এই ভদ্রলোকের মতোই নিজেকে আলাদা ভাবছি? না তা ভাবছি না। আমি জানি আমি কী। আমি চাচ্ছি যেন এই জ্বলোক মনে করেন আমি আলাদা। আমি বিশেষ কেউ।

স্যার বললেন, মৃন্ময়ী তুমি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছ। ব্যাপারটা কী বলো তো?

কোনো ব্যাপার না স্যার।

আমার কী ধারণা জানো? আমার ধারণা তুমি ঝোঁকের মাথায় মোটর সাইকেলে চড়তে রাজি হয়েছিল। এখন ঝোক কেটে গেছে। এখন আর রাজি নও। আমার ধারণা কি ঠিক?

হ্যাঁ ঠিক।

স্যার হাসি মুখে বললেন, আমার আসলে সাইকোলজি পড়া উচিত ছিল। দেখ কত সহজে তোমার মনের অবস্থাটা ধরে ফেললাম। তোমার অস্বস্তি বোধ করার কোনোই কারণ নেই। আমি একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে চা খেয়ে আসব। চা পাওনা রইল। ঠিক আছে?

জ্বি ঠিক আছে। স্যার আমি যাই?

আচ্ছা যাও। তোমাকে আলাদা করে ডেকে এনে ব্ৰিত করেছিতুমি কিছু মনে করো না।

আমি কিছু মনে করি নি।

আমার ওপর রাগ লাগছে না তো?

লাগছে না।

একটা ব্যাপার জানতে পারলে তুমি অবশ্যি রাগ করবে। ব্যাপারটা না জানানোই ভালো। কিন্তু আমি লোভ সামলাতে পারছি না। বলেই ফেলি।

স্যার তার সামনের টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া একটা কাগজ বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি প্রথমে আমার পেছনে মোটর সাইকেলে চড়তে রাজি হবে। তারপর মত বদলাবে। এই ব্যাপারটা আগেই জানতাম। কাগজে লিখে রেখেছি। পড়ে দেখ।

আমি কাগজ হাতে নিলাম। সেখানে পরিষ্কার লেখা— মৃন্ময়ীকে (রোল ফিফটিন) যখন বলা হবে আমার সঙ্গে মোটর সাইকেলে চড়তে সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হবে। পরে বলবে না।

আমি কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে স্যারের ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

আমার প্রচণ্ড রাগ লাগছে। নিজেকে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

কেউ যখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে সময়ের সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। চারা গাছ যেমন জল হাওয়ায় বিশাল মহীরুহ হয়। ক্ষুদ্রতার ব্যাপারটাও সে রকম। যত সময় যাচ্ছে নিজেকে ততই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।

বাসায় ফিরে মনে হলো আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি খুবই সাধারণ একজন। আলাদা কেউ না। সারাজীবন নিজেকে আলাদা ভেবেছি। এই ভাবার পেছনে কোনো কারণ নেই। নিজেকে অন্যরকম ভাবার একটা খেলা খেলেছি। আমি খুব শক্ত ধরনের মেয়ে। কে কী বলল বা কে আমাকে নিয়ে কী ভাবল তা নিয়ে আমি কখনো ভাবি না তা ঠিক না। আমি ভাবি। না ভাবলে স্যারের পেছনে মোটর সাইকেলে চড়তে পারতাম। কোনোই সমস্যা হতো না।

তস্তুরী বেগম আমাকে চা দিতে এসে বলল, আফা আপনের কী হইছে?

আমি বললাম, কিছু হয় নি তো। কেন আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমার জীবনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে?

তস্তুরী বেগম ফিক করে হেসে ফেলে বলল, না গো আফা। আপনেরে বড়ই সৌন্দর্য লাগতেছে।

থ্যাংক য়্যু।

তস্তুরী মাথা নিচু করে হাসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, হাসছ কেন?

তস্তুরী বেগম নরম গলায় বলল, আমরার গেরাম দেশে একটা কথা আছে। কন্যার যে দিন বিবাহ ঠিক হয় হেই দিন আল্লাহপাক তার রূপ বাড়ায়ে দেন। তিন দান বাড়ে।

বিয়ার কন্যা সুন্দরী
তিন দিয়া গুণন করি।

তার মানে তোমার ধারণা আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? রূপ তিন গুণ বেড়েছে?

হ আফা।

বিয়ে ঠিক হয় নি তস্তুরী, মন খুব খারাপ হয়ে আছে।

আমার অস্থিরতা কমছে না। একটা সময় ছিল— অস্থির লাগলে ছাদে যেতাম। অস্থিরতা কমতো। এখন তা হয় না। ছাদে গেলে উল্টোটা হয়। অস্থিরতা বেড়ে যায়। মনে হয় ছাদ থেকে একটা লাফ দিলে কেমন হয়? নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির হাতেনাতে প্রমাণ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায়। জীবনের শেষ সময়ে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। পৃথিবী তার মহা শক্তি দিয়ে আমাকে আকর্ষণ করবে, আমিও আমার যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে পৃথিবীকে আকর্ষণ করব।

রাতে খাবার টেবিলে বাবা বললেন, তোর কী হয়েছে রে?

আমি বললাম, কিছু হয় নি তো।

তোকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।

অন্যরকমটা কী?

দেখে মনে হচ্ছে মুখের শেপে কোনো কিছু হয়েছে। চুল কাটার পর ছেলেদের চেহারা যেমন হঠাৎ খানিকটা বদলে যায় সেরকম। চুলে কি কিছু করেছিস?

না, চুলে কিছু করি নি। আমার খুব বেশি মন খারাপ। মন খারাপ হলে হয়তো মানুষের চেহারা বদলায়।

মন খারাপের কারণ কী?

তেমন কোনো কারণ নেই।

আমাকে বলা যাবে না?

বলার মতো কিছু হয় নি।

আমাকে বলতে না চাইলে তোর মাকে বল। Open up. মন খারাপের ব্যাপারটা হলো একটা খারাপ গ্যাসের মতো। দরজা জানালা বন্ধ ঘরে এই গ্যাসটা আটকে থাকে। কাউকে মন খারাপের কথা বললে বন্ধ ঘরের জানালা খুলে যায়। তখন গ্যাসটা বের হতে পারে। জানালা খুলে দে।

বাবাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। জ্ঞানের কথা বলতে পারার আনন্দ। শিক্ষক হবার এই সমস্যা–জ্ঞানের কথা বলতে ইচ্ছা করে। উদাহরণ দিয়ে কোনো জ্ঞানের কথা বলতে পারলে ভালো লাগে। বাবা তার চেহারায় ভালো লাগা ভাব নিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী ইদানীং টগর কী করছে না-করছে সে সম্পর্কে কিছু জানি।

আমি বললাম, না।

কম্পিউটারের কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, সেটা তো যতদূর জানি সে করছে। না।

ভাইয়ার চোখে সমস্যা। সে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না।

চোখে সমস্যা এইসব ভুয়া কথা। কোনো কিছু করার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। সে ধরেই নিয়েছে বাবার মৃত্যুর পর বিরাট বিষয়সম্পত্তির মালিক হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে যাবে। তার চিন্তাটা ঠিক না। যে অপদার্থ তাকে আমি কিছু দিয়ে যাব না। তাকে পথে পথে ঘুরতে হবে। এই কথাটা তাকে বুঝিয়ে বলিস তো।

তুমি বুঝিয়ে বলো। তুমি শিক্ষক মানুষ। উদাহরণ দিয়ে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে পারো। আমি পারি না। এই তো একটু আগে গ্যাস নিয়ে কথা বললে। জানালা খুললে গ্যাস বের হয়ে যাবে – এইসব উদাহরণ তো আমি জানি না।

বাবা আহত চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে তিনি মন খারাপ করেছেন। যে মানুষটার মন খারাপ সে তার মন খারাপটা ছড়িয়ে দিতে চায় অন্যদের ভেতর। যার মন উফুল্ল সে চায় তার ফুল্ল ভাব ছড়িয়ে দিতে। আমি ঠিক এই কাজটাই করছি। জেনে শুনে করছি তা না। নিজের অজান্তেই করছি। যে মস্তিস্ক আমাদের পরিচালনা করছে সে করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। মানুষ স্বাধীন না, সে তার মস্তিষ্কের অধীনে বাস করে।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ভাইয়ার ঘরে ঊকি দিলাম। জানালা দিয়ে উকি। এটা আমার নিয়মিত রুটিনে পড়ে না। কাজটা কেন করলাম? ঘুমোনার আগে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্যে। তা তো না। ভাইয়া গল্প করতে পারে না। কিছু বললে ঠোট চেপে হাসে। মাঝে মধ্যে মাথা দোলায়। তাহলে কি আমার অবচেতন মন এই ঘরে কিছু খুঁজছে? ভাইয়ার বন্ধুকে আমি খুঁজছি?

ভাইয়ার ঘরের দরজা ভেজানো। ভেতরটা যথারীতি অন্ধকার। ঘরের ভেতর ভাইয়া ছাড়া দ্বিতীয় কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। ভাইয়া বড় বড় করে শ্বাস ফেলছে এটা শোনা যাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে। ভাইয়া হয়তো ঘুমুচ্ছে।

মৃ! জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিস কেন?

আমি ভাইয়ার কথা শুনে জানালা থেকে সরে এসে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, তোমার ঘরে কেউ লুকিয়ে আছে কি-না দেখতে এসেছি।

বাবা পাঠিয়েছেন?

কেউ পাঠায় নি, আমি নিজেই এসেছি।

অন্ধকার ঘরে দেখবি কী? বাতি জ্বালিয়ে দেখ। খাটের নিচে উঁকি দে।

তোমার ঐ বন্ধু আর আসে নি?

কোন বন্ধু?

নাম তো আমি জানি না। মাথায় কোঁকড়া চুল। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির ছাদে ঘুমায়। যাকে পুলিশ খুঁজছে।

ও আচ্ছা!

তার নাম কী?

ভাইয়া হাসল। নাম বলতে তার বোধহয় কোনো সমস্যা আছে।

আমি তো ভাইয়া পুলিশের কোনো ইনফরমার না। নাম বলতে তোমার সমস্যা কী?

কোনো সমস্যা নেই। বোস, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর ডান দিকেই চেয়ায় দেখতে পাচ্ছিস নাকি বাতি জ্বালতে হবে?

দেখতে পাচ্ছি। ভাইয়া, তোমার ঐ কোঁকড়া চুলের বন্ধু ও কি খুবই ভয়ঙ্কর?

হ্যাঁ ভয়ঙ্কর।

ও করে কী?

এমনিতে কিছু করে না। দিন রাত মন খারাপ করে থাকে। কেউ মজার কোনো কথা বললে খুব মজা পায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ করে ফেলে। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। এসএসসি-তে ঢাকা বোর্ডে ফিফথ প্লেস পেয়েছিল। কলেজে ওঠার পর আর পড়াশোনা হয় নি।

এটা তো তার কোনো পরিচয় হলো না ভাইয়া। আমি জানতে চাচ্ছি ও করে কী? কেন ভয়ঙ্কর?

ও ভাড়া খাটে।

ভাড়া খাটে মানে?

যে কেউ তাকে ভাড়া করতে পারে। মনে কর, কেউ খারাপ কিছু কাজ করতে চায়, নিজে করতে পারছে না ওকে ভাড়া করে নিয়ে গেল।

খারাপ কাজটা কী রকম?

মানুষ খুন?

হ্যাঁ।

টাকা দিলেই সে মানুষ খুন করবে।

হ্যাঁ করবে।

মানুষ খুন করতে সে কত টাকা নেয়?

জানি না। আমি জিজ্ঞেস করি নি।

তোমার এত প্রিয় বন্ধু, রাতে তোমার সঙ্গে থাকতে আসে আর তুমি কিছু জিজ্ঞেস করো নি?

ভাইয়া হাসল। মজার কোনো কথা শুনলে মানুষ যেভাবে হাসে ঠিক সেরকম হাসি। আমি বললাম, ভাইয়া আমি যদি তোমার ঐ বন্ধুকে বলি– এই নিন টাকা, আমি অমুক লোকটাকে খুন করতে চাই। সে করবে?

করার তো কথা।

এরকম বন্ধু তোমার কজন আছে?

ভাইয়া আবারও হাসল। যেন আবারও আমি মজার কোনো কথা বলেছি।

ওদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে তোমার ওদের মতো হতে ইচ্ছে করে না?

না। ওরা আমার মতো হয় না। আমিও ওদের মতো হই না। যা, ঘুমুতে যা।

কেউ কি আসবে তোমার কাছে?

ভাইয়া চুপ করে রইল। আমি বললাম, তুমি কিন্তু এখনো ঐ ছেলের নাম বলো নি।

ভাইয়া আবারও বলল, যা ঘুমুতে যা।

আমি ঘুমুতে গেলাম এবং আশ্চর্যের কথা খুবই সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম কাওসার স্যার মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন। আমি মোটর সাইকেলের পেছনে বসে আছি। হাওয়ায় আমার মাথার চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। মোটর সাইকেল প্রায় উড়ে যাচ্ছে। আমার মোটেই ভয় লাগছে না। তার পরেও কপট ভয়ের অভিনয় করে বলছি এই তুমি কি একটু আস্তে চালাতে পারে না? স্যার বললেন, না, পারি না।

আমি বললাম, ছিটকে পড়ে যাব তো।

স্যার বললেন, পড়বে না। আমার কোমর জড়িয়ে ধরে শক্ত হয়ে বসে থাক। আমি কিন্তু স্পিড আরো বাড়াচ্ছি। রেডি। গেট সেট গো। এমন স্পিড দেব যে মোটর সাইকেল নিয়ে আকাশে উড়ে যাব।

স্যারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মোটর সাইকেল সত্যি সত্যি আকাশে উঠে গেল। ওপর থেকে নিচের ঢাকা শহর দেখা যাচ্ছে। আমার সামান্য ভয় ভয় লাগছে। তবে ভয়ের চেয়ে আনন্দ হচ্ছে অনেক বেশি।

ভয়ঙ্কর ভয়ের স্বপ্নে মানুষের ঘুম ভাঙে, আবার অস্বাভাবিক আনন্দের স্বপ্নেও মানুষের ঘুম ভাঙে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে ভাবলাম কেন এরকম স্বপ্ন দেখলাম? আমি কি একপলকের দেখাতেই একটা মানুষের প্রেমে পড়ে গেছি? প্রেম এত সস্তা?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress