মৃন্ময়ী (Mrinmoyee) – 03
মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে/ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে/ উতরোল বড় সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে/তবুও কাউকে আমি পারি নি বোঝাতে/ সেই ইচ্ছা সংঘ নয়, শক্তি নয়, কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়, আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।
মুকুল বলল, কি বিস্ময় ছত্রে ছত্রে।.
আমি বললাম, কার কবিতা?
মুকুল গাছের নিচে শুয়ে পড়ল। বলল, বল না কার হতে পারে।
কবিতা আমি ঠিক চর্চা করি না। অভাবী পিতার পুত্র বই পত্র কোথা পাব। তবু দু-একবার কবিতা লেখার হাতে খড়ি হয়েছে রায়বাহাদুরের নাতনি মিমির পীড়াপীড়িতে। মনেও রাখতে পারি না। মনের মধ্যে এত অপমানের জ্বালা বয়ে বেড়ালে বিলুরই বা দোষ কি! মুকুল পারে, তার খাতায় সুন্দর হস্তাক্ষরে সে কবিতা লিখে আমাকে শোনায়। মানুষের তরে এক মানুষের গভীর হৃদয় —এমন শব্দমালা আমার মধ্যে কেমন ঝড় তোলে। শহরের ইঁট কাঠ, ঘরবাড়ি, বালিকার নরম জানু এবং লতাপাতা আঁকা ফ্রকে যেন রয়ে যায় গভীর এক সুষমা। মুকুল সহসা উঠে বসল ফের, কিছু ভাল লাগে না। আমার কিছু ভাল লাগে না। কি যেন করতে হবে। কে যেন বলে, এই বসে আছ কেন, কিছু কর। তখন কবিতা পড়ি। যা কিছু এখন চারপাশে সবই যেন আমার হয়ে কথা বলছে, মুকুল, বসে আছ কেন? যাও, দেখ হৃদয়ের গভীরে সে তোমার অপেক্ষায় বসে। বলেই শেষে হতাশ গলায় বলল, চৈতালীর সঙ্গে আজও দেখা হল না।
—কী গভীর উন্মাদনা ছত্রে ছত্রে। আমি যদি এমন কবিতা লিখতে পারতাম। কথাটা বলে মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক। বড় ব্যর্থ প্রেমিকের মুখ।
তবু মুকুল আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য বলল, পারবে না কেন। কত সুন্দর তোমার সেই লাইনটা শহর ঘুমিয়ে আছে—আমি জানি একজন ঘুমায় নাই। শুয়ে আছে জানালায় মুখ রেখে। চাঁদের ওপিঠে কলঙ্ক কালি, সে দেখে একফালি রোদে।
মুকুল আবার আবৃত্তি করল, তবু অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা-সিন্ধুর রাত্রের জল আনে-আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে; কেমন অনন্যোপায় হওয়ার আহ্বানে / আমরা আকুল হ’য়ে উঠে / মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে/ জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায / যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।
বিকেলের ঝড়ো হাওয়ায় আমরা বসে আছি। আমাদের চোখ বিস্ফারিত, কোথায় যেন যাওয়ার কথা আছে আমাদের। বিকেল হলেই সাইকেলে আমরা চলে যাই নিমতলা পার হয়ে। বাদশাহী সড়কের পাশে নিচু জমির ছায়ায় বসে প্রকাণ্ড এক ঝিলের ওপারে চাষীদের বীজ রোপণ দেখি। আমি বসে থাকি। মুকুল একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করে যায়। সব দুঃখ অপমান আমাদের কে যেন নিমেষে হরণ করে নেয়।
তারপরই সহসা মুকুল বলল, কি ব্যাপার বল তো, কদিন থেকে মুখ ভার দেখছি তোমার?
আমিও এবার শুয়ে পড়লাম। ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। হাত, পা ছড়ানো। দাঁতে ঘাস কাটছি। মাথার উপর নিরন্তর আকাশ। আর মনের মধ্যে অপমানের ঝড়। আত্মরক্ষার উপায় যেন খুঁজে পাচ্ছি না। মুকুলের সঙ্গে ঘুরলে আমার কেমন মনটা হাল্কা লাগে। কি ভাবে সে যেন জামার গোপন কষ্ট সব টের পায়। কলেজের শেষ দিকে সে আমার সঙ্গে একদিন যেচে আলাপ করতে এল। বলেছে, কলেজ ম্যাগাজিনে তোমার কবিতাটা দারুণ হয়েছে। ওকে বলতে পারি না—ওটা আমাকে ভয় দেখিয়ে লেখানো হয়েছে। ওটা না লিখলে কালীবাড়ির পুরোহিত করে আমাকে সবাই ছাড়ত। বলতে পারা যায় রায়বাহাদুরের নাতনি মিমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করে লিখিয়েছে। এতে আমার কোন হাত ছিল না। কিছুই জবাব না পেয়ে, সে কেমন দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিল, তোমার হবে।
আমি বলেছিলাম, হবে মানে?
—তোমার চোখ বলে হবে।
—হওয়ার কথা কি চোখে লেখা থাকে।
—লেখা থাকে। সেই থেকে আমার কি হয়েছিল, বাড়ি এসে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে বসেছিলাম। চোখে এমন কি আছে যা দেখে মুকুল বলতে পারে, হবে। আমি ঠিক বুঝি না। একদিন তারপর মুকুল আমাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে বলল, কথা আছে।
একটা দেবদারু গাছের নিচে সে আমি বসলাম। সে কেমন সংকোচের সঙ্গে বলল, দুটো কবিতা লিখেছি শুনবে!
আমি বললাম, তোমার ইচ্ছে হয় কবিতা লিখতে।
মুকুল হা হা করে হেসে দিয়েছিল। বলেছিল, যত অপমান সব মিছে, যদি পারি দিনান্তে কোনো অস্তগামী সূর্যের রঙ ফোটাতে।
কবিতা লিখলে সব অপমান মুছে যায়? আমার প্রশ্ন।
বারে, যায় না? যত দূর সেই অগাধ স্বার্থপরতা/ যত দূরেই যাক, একদিন থাকে না তার কোলাহল / সে হয় অবনত মৃত্যু তীক্ষ্ণ সুধা / ফুল যদি ফোটে, ফুটে থাকে সেই আমার ঈশ্বর / শেষ বিকেলে সে যদি হেঁটে যায়—আমার প্রতিমা/ প্রতিমার মতো দু হাতে তার থাকে করবদ্ধ অঞ্জলি / আমার সব অপমান মিছে / সে আছে বলেই বেঁচে থাকি/ বাঁচি জীবন বড় দুরন্ত বালকের হাতছানি।
কী সুন্দর কবিতা। উচ্ছ্বাসে সেদিন ফেটে পড়েছিলাম।
তারপর থেকেই কী যে হল জানি না, মুকুল এক সকালে আমাদের বাড়ি চলে এল। থাকল খেল। গাছের ছায়ায় ঘুরে বেড়াল। মাকে মাসিমা, বাবাকে মেসোমশাই এবং যেন কতদিন থেকে বাবার এমন বাড়িঘরে সে আসবে বলে প্রতীক্ষায় ছিল। কলেজের যখন যা নোট আমার জন্য করে রাখত। আমাদের অভাবের সংসারে বই কেনা বাড়তি খরচা সে সেটা টের পেয়ে যখনকার যে বই দরকার দিয়ে গেছে। বাড়িতে নিয়ে গেছে। তার দাদাকে বলেছে, জান, বিলু কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা লিখেছে। কি আশ্চর্য মায়াবী কবিতা। এটা এমন একটা কাজ যেন আমি ছাড়া আর কেউ পারে না। বৌদিকে ডেকে বলেছে, তুমি দেখতে চেয়েছিলে—এই আমাদের বিলু।
মুকুল বোধহয় একটু বেশি বেশি করেই আমার সম্পর্কে তার বৌদিকে বলে রেখেছিল। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়ল না। পি ডবলু ডির কোয়ার্টার। দাদা তার সরকারী অফিসে কাজ করে। বাংলো ধরনের বাড়ি। সামনে ফুলের বাগান। পাশে মাঠ। মাঠ পার হলে, স্টেশনে যাবার রাস্তা। চৈত্রের দুপুরে মাতাল হাওয়ায় আমরা তোলপাড় হতে থাকলে, বৌদি হাজির। কাপে চা। কখনও ডিমের ওমলেট। টোস্ট। যখনকার যা।
মুকুলের ঘরে বসে আড্ডা মারি। কত অর্থহীন কথা হয়। এরই মধ্যে একদিন বলেছিল মুকুল, জান একটা ভাল কবিতা লিখতে পারলে অনেক ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এ সব আমি ঠিক বুঝি না। ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে না। কেমন ফাঁপরে পড়ে যাই। কবিতা লেখার ব্যাপারে বলি, ও হবে না আমার। তোমাকে নিয়ে আমার ঘুরতে শুধু ভাল লাগে।
মুকুল বলেছিল, তবু লেখ কিছু।
টিউশনি করতে গিয়ে রোজ যে অপমানিত হচ্ছি আজ মুকুলকে সব খুলে বললাম।
মুকুল শুনে বলল, এই অপমানের জবাব একটাই। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। নানা রকম স্বপ্নের জলছবি বোনা হতে থাকে। চুপি চুপি মুকুল একদিন বলল, একটা কবিতা কলকাতার কাগজে পাঠিয়েছি। ওটা যদি ছাপা হয় কী না হবে! তুমি একটা লেখ। তোমারটাও পাঠিয়ে দেব।
—কি হবে পাঠালে।
—বা, কত লোক জানবে! কত লোকে আমাদের নাম জানবে!
জীবনের এ দিকটা আমি আদৌ ভেবে দেখিনি। বললাম, আচ্ছা তুমি বল, মেয়ে দুটোর সব টাসক দাদু দিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত একটা কথা বলতে পারলাম না ওদের সঙ্গে। রাগ হয় না!
—দেখতে কেমন!
—দেখার কথা বলছি না। এটা কত বড় অপমান বল।
মুকুল বলল, ওরা কি ভাবে, তুমি ওদের খেয়ে ফেলবে!
—ঠিক জানি না। আসলে দাদুটা নষ্টের গোড়া। বাড়িতে এমন হাল ফ্যাশন, আর উঠতি মেয়ে দুটোর বেলায় এত রক্ষণশীল।
মুকুল বলল, এক কাজ করবে?
—কি!
—একটা মাসিক পত্রিকা বের করব। তুমি সম্পাদক হবে। তুমি কাগজের সম্পাদক হলে ওরা আর হেলাফেলা করবে না।
—যা, হয় না। ওসব আমি বুঝি না।
—কাগজটা করতে বেশি খরচ পড়বে না। যারা লিখবে তারা পয়সা যোগাবে। বেশি তো লাগবে না। আমার বৌদি জান, কলেজে পড়ার সময় কবিতা লিখত। বৌদিকে পার্টনার করব। তোমাকে কিছু দিতে হবে না। রাম নিখিল ওদের কাছে প্রস্তাবটা রাখি চল। আর তোমার রায়বাহাদুরের নাতনি যদি রাজি হয় তবে ত কথাই নেই।
কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। বলি, ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। ওর দাদু আমাকে কালীবাড়ির পূজারী বানাবার তালে ছিল। সেটা না হওয়ায় তাদের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। পরী আমার সঙ্গে শেষ দিকে কথাও বলত না।
আমি পরী বলি, মুকুল ডাকে রসময়ী। আসলে কলেজে রায়বাহাদুরের নাতনি নিজের নামটা হারিয়ে ফেলেছিল। জনে জনে আলাদা নামে ডাকত। আমি শেষ পর্যন্ত পরী নামটাই জুতসই মনে করেছি। যদিও ওর আসল নাম পরী নয়, মিমি, মৃন্ময়ী এবং দীপান্বিতা।
বললাম, পরীকে সঙ্গে পেলে ভাল হয়। তবে কি জান ওর কাছে আর যেতে ইচ্ছে হয় না। তাছাড়া পত্রিকা বের করে হবেটা কি!
মুকুল বলল, হবে, সব হবে। একটা নামও ঠিক করেছি। বলব কি না ভাবছি।
—নাম ঠিক করেছ, বলবে না মানে!
—না, এই আর কি। চৈতালী নামটা কেমন।
চৈতালীকে মুকুল ভালবাসে। চৈতালী ভালবাসে কি না, সেটা আমাদের জানার বিষয় নয়। আমরা এখন সুন্দর মেয়ে দেখলে ভালবাসতে পারলেই খুশি। মুকুলও খুব খুশি। সে চৈতালীকে ভালবাসে। এত গুণ যে নারীর, তাকে না ভালবেসে থাকা যায় না। একবার নাকি চৈতালী তাকে চোখ তুলে দেখেছে। এই দেখা থেকেই তার ভালবাসার জন্ম। এবং কবিতার জন্ম।
একই পাড়ার না হলেও বেশি দূরে নয় চৈতালীদের বাড়ি। ওর দিদি স্কুল শিক্ষয়িত্রী। এক দিদি গার্লস কলেজের ফিজিক্সের অধ্যাপিকা। এক দিদি ল্যালা ক্ষ্যাপা। মুখ দিয়ে লালা ঝরে সব সময় আমরা বিকেল হলে, একবার কি দুবার বাড়িটার পাশ দিয়ে সাইকেলে রাউণ্ড মারি। মুকুল অন্তত সারাদিনে একবার চৈতালীকে না দেখতে পেলে কেমন মনমরা থাকে। কিছুদিন থেকে এই দেখার কাজটিতে মুকুল আমাকে সঙ্গে নিতে পছন্দ করে। আমরা অধিকাংশ দিন চৈতালীকে দেখতে পাই না। লম্বা বারান্দায় ল্যালা ক্ষ্যাপা দিদিটা দাঁড়িয়ে কেবল দুলতে থাকে। গায়ে লম্বা সেমিজ পা পর্যন্ত একজন সুন্দর তরুণীকে দেখতে এসে এমন কুৎসিত দৃশ্য দেখলে কার না ক্ষেপে যাবার কথা।
মুকুল ক্ষেপে গিয়ে বলে, চৈতালী আমাকে ভালবাসে না। ভালবাসলে দিদিটাকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখে!
কখনও দেখা হয়ে গেলে মুকুল কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ঐ আসছে। দাঁড়াও না।
মুকুল তখন কেমন দাঁড়াতেও ভয় পায়।
বলি, কোন কথা হল। ওর দিদি ত তোমার বৌদির বন্ধু। কি করে কথা হবে বল। সকালে রেয়াজ। টাউন হলের ফাংশানে কি মাইরি গাইল। সেই গানটা আজকাল মুকুল সব সময় গায়। মুকুলের সুর তাল লয় চমৎকার। সে গুনগুন করে গায় যখন, তখন বোঝাই যায় না, তার ভালবাসায় দুঃখ আছে। তারপরই তার হাহাকার হাসি, চল, যত সব মন খারাপের ব্যাপার। আমার বয়ে গেছে। কথা তো আমার ভালবাসার। আমি যখন ভালবেসেছি তখন আর কথা কি। চৈতালী ভালবাসল না বাসল বয়ে গেল!
আমি বললাম, এ হয় না।
—হবে না কেন! তুমিও ভালবাস কাউকে। বুকে হাত দিয়ে বল। উপেন রায়ের ছোট মেয়েটাকে দেখে বলেছিলে না, কি লাভলি দেখতে! চোখে যেন সেই বিদিশার নিশা!
মুকুল টের পায়, এ বয়সে শুধু ভালবাসলেই পরমায়ু বাড়ে। আর এইটুকুই কখনও কোনো মাসিক কাগজ বের করা, কিংবা কবিতা লেখাতে পরিপূর্ণতা পায়। বললাম, চৈতালী নামটা সত্যি ভারি সুন্দর। এ নামে কাগজ বের হলে শহরে হৈ হৈ পড়ে যাবে।
দুজনে সাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে যাই তখন। মুকুল কেমন আনমনা গেয়ে ওঠে, দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।
সাইকেল চলে। আমরা পাশাপাশি দু-জন। পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্প পার হয়ে পঞ্চানন তলার দিকে যাই। আমাদের চুল ওড়ে। লাল সড়কে ধুলো ওড়ে। মুকুলের গলা ভারি হয়ে আসে—চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াই, সদা মনে হয় যদি দেখা পাই….। ভাঁকুড়ির মোড়ে এসে আমাদের গতি স্তব্ধ হয়। সে নামে। আমিও নামি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে এক প্রিয় নারীর সন্ধান চলে। মুকুল তখনও গায়, এত ভালবাসি, এত যারে চাই, মনে হয় না ত সে যে কাছে নাই!
মুকুলের সেই বড় বড় চোখে কবিতার মতো তখন স্বপ্ন ঝুলে থাকে। ডাকি, মুকুল।
—হুঁ।
—কাগজটা যে করেই হোক বের করতে হবে।
সে আমার দিকে তাকায়। তারপর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে, কাগজটাকে আমরা বাঁচাবই। কাগজ বের করা ছাড়া তাকে অবাক করে দেবার মতো আমাদের আর কোন সম্বল নেই।
তা ঠিক। কারণ আমাদের দুজনের পরীক্ষার নম্বর ভাল না। আমরা দুজনে থার্ড ডিভিসন সব কাজে। চৈতালী কিংবা অন্য তরুণীরা সব ফার্স্ট ডিভিসন, সব বিষয়ে। পড়ায়, গানে, রূপে। আমাদের হাতে এটাই যেন ক্ষুরধার অস্ত্র হয়ে ওঠে, একটা কাগজ বের করতে পারলে, মিলের ম্যানেজার সাহেব থেকে আরম্ভ করে চৈতালীর অহংকার কাচের বাসনের মতো টোকা মেরে ভেঙে দিতে পারব। মিমিরও। বললাম, কাগজ বিক্রির কি হবে?
—কেন আমরা নিজেরা করব। তমলুকে তরুণ আছে। ওকে লিখব। সে যেন বিশ ত্ৰিশ কপি বিক্রি করে দেয়। আমরা রোজ স্টেশনে দাঁড়িয়ে বলব, চৈতালী নিন। কবিতা গান নাটক সব এতে পাবেন। দাম করব চার আনা। সুন্দর মলাট নিখিল মলাটে ছবি আঁকবে। মফঃস্বল শহরে এটা কত বড় খবর হবে বুঝতে পারছ না।
আমার সব অপমান নিমেষে কেমন উবে গেল। আত্মপ্রকাশের এই সুযোগ হেলায় ছাড়া যায় না। ভিতরে যে মিমি থেকে আরম্ভ করে ম্যানেজারের অপমানের জ্বালা আগুন হয়ে বিশ্ব সংসার অর্থহীন করে তুলেছিল মুহূর্তে আমাদের কাছে তা নতুন এক গৌরবময় অধ্যায় খুলে ধরল।
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাবা জেগে থাকেন। সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ শোনার জন্য তিনি উৎকর্ণ হয়ে বসে থাকেন। আমি ফিরলে মনে হয় বাবার ঘরবাড়ির আবার ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গেছে। সাইকেল ঘরে তোলার সময় শুনতে পাই বাবার গলায় অভিযোগ, এত রাত করে ফিরিস না। রাস্তাঘাট ভাল না। সেদিন টিকটিকি পাড়ার কাছে ছিনতাই হয়েছে। পঞ্চাননতলা জায়গাটা ভাল না। তোর মা সেই কখন থেকে জেগে আছে।
বাড়ি ফিরলে টের পাই কেউ ঘুমায়নি। মার গলা শুনতে পাই, তোদের এত কি যে বাইরে কাজ থাকে। রাত হয় না। এত রাতে ফিরলে চিন্তা হয় না। মাকে বাবাকে বোঝাই কি করে আমার ভেতরে অহরহ এক জ্বালা আমাকে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে মারছে। আমি তো আর তাঁদের আগের বিলু নেই। আমারও যে কিছু ভাল লাগে না, সব আছে অথচ কি যেন নেই, এর থেকে উদ্ধার পেতে চাই।
সকালে উঠে দেখি, মায়া একখানা পূজায় পাওয়া কোরা লালপেড়ে শাড়ি পরেছে। মায়াকে শাড়ি পরলে বেশ বড় বড় লাগে দেখতে। মায়া ফ্রক পরুক বাবার পছন্দ না। মা’র সঙ্গে এই নিয়ে বাবার কথা কাটাকাটি গেছে কদিন। বাবা মানতে রাজি না। শাড়ি পরলে বাবার ধারণা, মেয়েদের মধ্যে যে নারীত্ব আছে তা এক ধরনের মহিমা পায়। উজ্জ্বল, সপ্রতিভ এবং বড় হয়ে ওঠার মধ্যে মেয়েদের মধ্যে যে নারী-মহিমা আছে তা প্রকাশ পায়। বাবা এ জন্য শুভদিন দেখে রেখেছেন। আজ বোধ হয় সেই শুভদিন। মায়ার বয়স ত বারোও পার হয়নি। এ বয়সে মেয়েরা শাড়ি পরলে মায়ার বয়সটা ধরা পড়ে যায় ভেবেই বোধ হয়, শাড়ি পরার ব্যাপারে মা’র মত পাওয়া যায় নি। তবু মা আজকাল বুঝেছে, বাড়ির একজন অভিভাবক না থাকলে সংসারে শৃংখলা থাকে না। বাবার কথাই শেষ কথা।
মায়া শাড়ি ভাল করে পরতে পারে না। মা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। কেমন জবু থবু দেখাচ্ছিল। সকালে স্নান করে শাড়ি পরায় ভিজা চুল জড়ান। ওর নাক তীক্ষ্ণ। শ্যামলা রঙ। বড় বড় চোখ, এক মাথা ঘন চুল। বিনুনি খোলা। ভিজা চুল ছড়ানো পিঠে। শাড়ি পরে বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছিল। কেমন সব সময় আড়ালে থাকছে। আজ থেকে মায়া ঠাকুর ঘরের পূজার আয়োজনের ভার পেয়েছে। বাবা সকালে স্নান করে এসে মায়াকে বলল, মাকে প্রণাম করেছ?
কেমন আনত মুখে মায়া দাঁড়িয়ে আছে। তার ভিতর যে তরলমতি এক বালিকা ছিল, শাড়ি পরায় তা নিমেষে উবে গেছে। ভারিক্কী এবং গম্ভীর লাগছিল দেখতে। শাড়ি পরলে মেয়েরা কি বুঝতে পারে—তারা এবারে মা হয়ে যাবে। মায়ার আচরণে কেমন তা ফুটে বের হচ্ছে। বাবা বললেন, প্রথম শাড়ি পরলে গুরুজনদের প্রণাম করতে হয়। মাকে, দাদাকে ….।
মায়া মাকে প্রণাম করল, বাবাকে করল। তারপর আমার পায়ের কাছে টুপ করে গড় হল। আমরা কুলীন এবং পুরোহিত বংশ বলে প্রণামটা সেই কবে থেকে পেয়ে আসছি। এতে আমাদের কোন লজ্জা সংকোচ থাকে না। প্রাপ্য বলে ধরে নিই। মায়া উঠে দাঁড়ালে “দেখলাম, কপালে সুন্দর লাল টিপ পরেছে। বড় পবিত্র এবং মায়াবী মুখ তার। যেন বলছে, দাদারে, আমরা সবাই কেমন বড় হয়ে যাচ্ছি দেখ। বাবা খুব প্রশান্ত গলায় আজ কথাবার্তা বলছেন।
মায়া শাড়ি পরে আছে বলে বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করছে না। গোপাল করের মা এসেছিল, শুভ দিন দেখতে। তার মেয়ে স্বামীর কাছে যাবে—একটা দিনক্ষণ দেখে না দিলে হয় না। বাবা থামে হেলান দিয়ে পঞ্জিকা দেখছেন। গোপাল করের মা মার সঙ্গে কথা বলছিল। বড় সহজ সরল কথা। কি কি রান্না হবে তার ফিরিস্তি দিচ্ছিল মাকে। মাও কি আজ রান্না করবে গোপাল করের মাকে বলে যাচ্ছিল। সংসারে রান্না যে সন্তান সন্ততির খাওয়ার তৃপ্তি সৃষ্টি করে—দু এক রকমের বেশি পদ করে খাওয়াতে পারলে যে ভেতরে এক অনাবিল সুখের সন্ধান পাওয়া যায়, এই দুই নারীর -কথাবার্তা না শুনলে তা বোঝা যায় না। স্নেহ, মায়া মমতা সব এতে যেন উজাড় করে দিতে পারে মা।
একটা থালায় কিছু কচি পাটের ডগা। একটা থালায় দুধ কচু কাটা। কিছু গন্ধ পাঁদালের পাতা, থানকুনি পাতা, কাঁচকলা আর বেগুন কাটা পেতলের গামলায়। মটর ডাল যত্ন করে ধোওয়া। কচি আম কাটা একটা পাথরবাটিতে। দেখলেই বোঝা যায় পাট পাতার বড়া, গরম মুচমুচে পাতে দেবে মা। শুকতোনি হবে। কচুর ডগা দিয়ে মটর ডাল। কাচকি মাছ সরষে বাটা দিয়ে, আর কি লাগে! এই রান্নার জন্য হয়ত রাতে মা শুয়ে শুয়ে কত ভেবেছে—কাল কি হবে! বাড়িতেই প্রায় সব পাওয়া যায়। কেবল সকাল বেলায় মা’র কাজ ঘুরে ঘুরে এ সব সংগ্রহ করা।
সকাল হলে মা’র সঙ্গে মায়াও ঘুরে বেড়ায়। শাক পাতা, কাঁচকলা, থোড় কিংবা মোচা সংগ্রহ। রোজ একই রকম খেতে দিলে সন্তান সন্ততি নিয়ে আর বাড়ি ঘরে থাকা কেন। আজ একরকম, কাল আর একরকম। মা তার জীবনের সার্থকতা এরই মধ্যে আবিষ্কার করে বড় বেশি তৃপ্তি পায়।
খেতে বসলে, আমরা চারজন। মায়ার কাজ নুন জল দেওয়া। মা পাতে দেবে আর লক্ষ্য রাখবে আমরা কতটা পরিতৃপ্ত হচ্ছি মা’র হাতের রান্না খেয়ে। কোন কারণে যদি নুন ঝাল একটু এদিক ওদিক হয়ে যায় মা’র কি আপসোস। যেন দিনটিই তার মাটি হয়ে গেল। – আর একটু দিই। এই খেয়ে পেট ভরেনি। সেকি গো! আর দুটো পাট পাতার বড়া দেব? কাঁচা লংকাটা মেখে নাও না। সরবেটা জান ভাল না। ঠিক ঝাঁজ হয় না। খেতে বসলে মা’র এ সবই অভিযোগ থাকে শুধু। একজন মা যে কত দরকারি, সংসারে খেতে বসলে আমরা সবাই এটা বেশি যেন টের পাই।
খেতে খেতে মনে হয় জীবনে এমন মাধুর্য না থাকলে আমরা এত ঘরবাড়ির প্রতি আকর্ষণ বোধ করতাম না। কোথাও দু-একদিনের জন্য গেলে কিংবা থাকলে সেটা আরও বেশি করে মনে হয়। কালীবাড়ি থাকতে, ছুটি ছাটায় কিছুতেই লক্ষ্মী কিংবা বৌদি আটকে রাখতে পারত না।
এখন গ্রীষ্মের দুপুর। কত রকমের পাখির কলরব বাড়িটাতে। গাছপালায় ঘেরা এই বাড়িঘর দেখে কে বলবে, আমরা প্রবাসে আছি। আমরা ছিন্নমূল। দেশবাড়ির স্মৃতি আমাদের কাছে যেন অন্যজন্মের কথা। খাওয়া হলে, মাদুর নিয়ে গাছতলায় গড়াগড়ি দেওয়ার হুটোপুটি পড়ে যায়। পুনুটা এসে আমার পিঠে এক পা তুলে শুয়ে থাকবে। পিলুটা বলবে, সর না দাদা, আমি একটু শুই। শুয়ে থেকেও স্বস্তি থাকে না। কখন টুপ করে হাওয়ায় আম পড়বে অপেক্ষায় থাকি। সারাদিনই চলে এমন। মা’র কান বড় সজাগ। পেছনের জমিটাতে বোম্বাই, রাণীপসন্দ আমগাছ থেকে টুপ করে আম পড়ে। মা ঠিক শুনতে পায়—যা মায়া দেখ, আম পড়েছে। সে কোঁচড়ে করে নিয়ে আসে। এত আম জামের খবর পেয়ে কোথাকার সব কাচ্চা বাচ্চা ঘুরে বেড়ায় বাড়িটার আনাচে কানাচে। পাখি, কাঠবেড়ালি, হনু, যেন প্রাণী জগতের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়—বড় ফলবতী সব বৃক্ষ। বাবা কাউকে তেড়ে যান না। শুধু হনুর উৎপাত বাড়লে কোটা নিয়ে পিলু এ-গাছ ও-গাছের নিচে ছুটে বেড়ায়। আর মা’র কাজ বাড়ে। সব আম সাজিয়ে রাখা তক্তপোষের নিচে। কোটা কোন্ গাছের, কেমন খেতে, সব মা’র মুখস্থ। বাবা বিকেল হলেই বারান্দায় বসবেন আমের ঝুড়ি নিয়ে। পাশে এক বালতি জল। আম কেটে সবার হাতে দেওয়া বাবার এক যেন আলাদা আনন্দ।
মাদুরে আমি শুয়ে, পিলু গাছে উঠে আম পাড়ছে। মায়া মা, আম ঝুড়িতে তুলে রাখছে—বাবা লিচু গাছের উপর জাল বিছিয়ে দিচ্ছেন যাতে হনুতে কচি লিচু নষ্ট না করে যায়। দুটো গাছেই ঝাঁপিয়ে লিচু এসেছে। আম শেষ হলে লিচু, লিচু শেষ হলে জাম, তারপর জামরুল। শেষে তাল। তালের কচি শাঁস বিকেলের প্রচণ্ড গরমে কে না খেতে ভালবাসে! ফলে এ কটা মাস আমাদের বাড়িটা কেমন আরও বেশি সকলের নজর কাড়ে। কেউ আসে দুটো আম নিতে টক খাবে বলে, কেউ আসে, পাকা আমের আশায়। বাবা দিয়ে থুয়ে খুশি থাকেন। মা কিন্তু এটা পছন্দ করে না। এমন কি একবার বাবার বেশি বাড়াবাড়ি দেখে মা আম মুখেই দিল না। আজকাল এর জন্য বাবা মাকে বলেই দেন। কখনও মা না থাকলে গোপনে দিয়ে বলবে, যা পালা। পাইকার আসে যদি গাছ বিক্রি হয়। বাবার এক কথা, সবাই খাবে বলে হয়েছে। এ তো বিক্রির জন্য লাগানো হয়নি বাপু।
আর এ-সময়েই পিলুর মগডাল থেকে চিৎকার, দাদা, মুকুলদা আসছে। সঙ্গে আরও কারা যেন। মায়া কথাটা শুনেই দৌড়ে ঘরে পালাল। ও শাড়ি পরেছে নতুন। ওদের সামনে বের হতে তার লজ্জা। মা বলল, মুকুলের জামাইবাবু কি একটা চাকরি দেবে বলেছিল, তার কিছু বলল।
মাকে বোঝাই কি করে চাকরি পাওয়া বড় কঠিন। জানা-শোনা না থাকলে হয় না। তবে এখন আমি একটা চাকরি নিতে পারি। মুকুলের জামাইবাবু বলেছেন স্পেশাল ক্যাডার শিক্ষক নেবার একটা পরিকল্পনা সরকারের আছে। প্ল্যান এপ্রুভ হয়ে গেলে তিনি আমার জন্য চেষ্টা করবেন।
নিখিল রাম প্রণব সুধীন মুকুলের সঙ্গে আসতে পারে। মুকুল আমাদের ঘরবাড়ি এবং গাছপালার এমন এক অলৌকিক গল্প করেছে, যেন ওরা না এসে থাকতে পারে না। বিশেষ করে তার মেসোমশাইটির। সে তো জানে না, পুত্রের বন্ধুরা সব অবস্থাপন্ন ঘরের—তারা এলে ঘরবাড়ির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এক হাতে করা, পুত্র সুস্থিতি লাভ করেছে এটাই বাবার বড় সান্ত্বনা। পরিচয় মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। আপদে কাজ দেয়। এই যে চাকরির কথা হচ্ছে, মুকুল তার জামাইবাবুকে ধরেছে, বিলুকে একটা চাকরি করে দিতেই হবে, এত, পরিচয়ের সূত্র থেকে। এই সূত্র থেকেই ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা। এটা না থাকলে স্ত্রী পুত্র ঘরবাড়ি নিয়ে বেঁচে থাকার মাহাত্ম্য কোথায়।
রাস্তা থেকেই চিৎকার, বিলু আমরা এসে গেছি। চার পাঁচটা সাইকেল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। এক পা মাটিতে, আর এক পা সাইকেলে। গাছের ছায়ায় আমি হেঁটে যাচ্ছি। কি রোদ! ওরা রাস্তায় রোদে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, ভিতরে এস।
—দেখ কারা এসেছে। বলে মুকুল হা হা করে হাসল।
আমি জানি মুকুল বড় সহজে সব কিছু তুচ্ছ করতে পারে। এত রোদে এসেও হাসিটুকু তার বড় সজীব।
নিখিল বলল, ব্যাটা তুমি এমন একটা আশ্রমের মতো বাড়িতে থাক ঘুণাক্ষরে তো বলনি।
আমি কি বলব। ওরা সাইকেলগুলি গাছে হেলান দিয়ে মাদুরে এসে বসল। বাবা বারান্দায় তামাক সাজছেন। আসলে তিনি তামাক সাজছেন না, পুত্র এবং তার বন্ধু-বান্ধবদের কথা শুনছেন! কেমন পাট ভাঙ্গা প্যান্ট জামা সব পরনে। বিলুটার এদের তুলনায় কিছুই নেই, কিছুটা তার মনকষ্ট হতে পারে। উঠোনের এক কোণ থেকে গাছতলার সবটাই দেখা যায়।
রাম মুকুল এসেই মাদুরে শুয়ে পড়ল। বাবার আতিথেয়তা একটু বেশি। শক্ত তেল চিটচিটে গোটা দুই বালিস না আবার হাজির করেন বাবা। একবার উঠে গিয়ে বাবাকে সতর্কও করে দিয়ে এলাম। আর বাবার অদ্ভুত স্বভাব। বন্ধুরা কেউ এলেই, বাবাও সেখানে গুটি গুটি হাজির হবেন। তারপর চলবে, তোমার বাবার নাম কি? দেশ কোথায় ছিল? কি করেন তিনি? তোমরা ক ভাই বোন? বিশদ জানাজানির পর বাবা বলবেন, বাসা বাড়িতে থাক, না নিজের বাড়ি? একদিন মা বাবাকে নিয়ে বেড়িয়ে যাবে।
মুকুল মাঝে মাঝে আসে বলে, বাবার স্বভাব চরিত্র তার জানা। মাঝে মাঝে বাবার অহেতুক কৌতূহলে আমি ক্ষুণ্ণ হলে মুকুল বলবে, মেসোমশাই তো ঠিকই বলেছেন, তুমি রাগ কর কেন বুঝি না।
মুকুলের হাতে একটা কবিতার বই। সুদীনবাবুর হাতে রাজনারায়ণ বসুর একাল সেকাল। কোথাও গেলে হাতে কবিতা কিংবা গল্প প্রবন্ধের বই এখন আমাদের থাকা চাই। কারণ আমরা আলাদা গোত্রের এটা যেন চারপাশের মানুষকে বোঝানো দরকার। শুধু খাওয়া পরাটাই সব নয়, বাড়ি ঘরই সব নয়, জীবনে আরো কিছু দরকার।
নিখিল বলল, একেবারে বামুন ঠাকুর সেজে বসে আছিস। তোকে আমাদের কাগজের সম্পাদক মানাবে না।
মুকুল বলল, বিলুর বিদ্যাসাগর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গলায় পৈতা, পরনে কোরা ধুতি আর একটা চাদর গায়ে দিলেই একেবারে বিংশ শতাব্দীর বিদ্যাসাগর। বিলুকে আমি আমাদের পত্রিকার জন্য নাটক লিখতে বলেছি।
প্রথমত আমাকে বিদ্যাসাগর বলে ঠাট্টা করায় একটু চটে গেছিলাম। এটা ঠিক, বাড়িতে প্যান্ট সার্ট কেউ আমরা পরি না। পাজামা গেঞ্জি কিংবা পাঞ্জাবি পরা যায়। ওদের বাড়ি গেলেই দেখি, ওরা কেউ খালি গায়ে কখনও থাকে না। পাজামা গেঞ্জি না হয় পাঞ্জাবি পরে আছে। এমন কি ঘরেও তারা চটি পরে থাকে। আমাদের স্বভাব অন্যরকম। কলোনির মানুষ হলে যা হয়। পুজোর কিংবা শ্রাদ্ধে দানের কাপড় দিয়ে আমাদের সব। এমন কি সেই কোরা কাপড় কেটে সার্টও বাবা তৈরি করে দেন আমাকে, পিলুকে। মার শেমিজ। বাড়িতে আমি খালি গায়ে থাকি। খালি পাঁয়ে হাঁটি। সোডায় কাচা কোরা কাপড় পরে থাকি। একবার একটা কোরা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরলে বাবার কি ক্ষোভ! তোমরা বামুনের সন্তান, না চণ্ডালের সন্তান। বামুনের বাড়িতে ও সব চলবে না।
রাম নিখিল সুধীন সবার বাড়ি মুকুল আমাকে নিয়ে গেছে। বাইরে একটা সবার বসার ঘর থাকে। কারো ঘরে দেখেছি বাঁকুড়ার পোড়া মাটির ঘোড়া। বাবার কাছে এ সবের কোন তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না। নীল রঙের ক্যালেণ্ডার। টেবিলে বাতিদান—কত সুন্দর কারুকাজ করা লেসের কাজ পর্দায়। জীবনে এগুলি মোহ তৈরি করে বুঝি। বাবাও আমার এ সব দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, কিন্তু তাঁর কাছে বাড়ির এ সব অর্থহীন, বরং জায়গা থাকলে একটা গাছ লাগাবার পরামর্শ দিয়ে আসেন। এমন কি বাড়িতে এসেও তাঁর আক্ষেপ—কত বড় বাড়ি কি সব সুন্দর সাজানো ঘর ধনবৌ-সব মাটি বুঝলে না—বাড়িটাতে একটা ফলের গাছ নেই। পূজা আর্চার জন্য একটা ফুলের গাছ নেই। মানুষ এভাবে ধর্মহীন হয়ে বাঁচে কি করে! সুতরাং এরা আমাদের বাড়ি এলে একটা অন্য গ্রহে হাজির হয়েছে মনেই করতে পারে।
মুকুল বলল, তা হলে তুমি নাটকের ভার নিচ্ছ!
আমি বললাম, ক্ষেপেছ! নাটক কি করে লিখতে হয় আমি জানি না। কবিতা থেকে নাটকে! হয় না।
সুধীন বলল, সিরাজদৌল্লার নাটক তোমাকে পড়তে দেব। বুঝতে পারবে যথার্থ নাটক কাকে বলে!
নাটক আমার একখানাই পড়া আছে। আমাদের সিলেবাসে নাটকটি ছিল। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ নাম নাট্যকারের। তার টীকা এবং ব্যাখ্যা আমাকে এতো জ্বালাতন করেছে, নাটকের নাম শুনলেই ত্রাসের সঞ্চার হয়। বিদ্যাবিনোদ মশাই আমাদের মতো পড়ুয়াদের যে অথৈ জলে ফেলে গেছেন, নতুন নাটক লিখে আবার আমি আগামী দিনের পড়য়াদের কাছে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে রাজি না। বললাম, হবে না।
–হবে। তুমি পারবে।
—আমি পারি না জান। কেন যে জোরজার কর বুঝি না। এমন করলে তোমাদের সঙ্গে আর নেই। কেন যে পত্রিকা বের করার ইচ্ছাটা মাথায় এসেছিল।
বেশ কঠিন শোনাল বোধ হয় কথাগুলি। ওরা চুপচাপ থাকল। বলল, কবিতা লেখার অনেক লোক পাওয়া যাচ্ছে। সুধীনবাবু বাংলা চলচ্চিত্রের উপর প্রবন্ধ লিখবে বলেছে। ছোটগল্পও দুটো একটা পাওয়া যাবে। প্রণবের বাবা বলেছে, প্রণবকে দিয়ে একটা ছোট গল্প লিখিয়ে দেবেন। সমালোচনা বিভাগে থাকবে। এটার ভার নেবে নিখিল। তুমি তা’লে…….।
আমি তা’লে কিছু না। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। খাটা-খাটনি আমাকে দিয়ে হবে। কিন্তু লেখা হবে না।
রাম বলল, ওকে বরং কবিতাই লিখতে দাও। ও যখন ওটা পারে ওকে দিয়ে তাই লেখানো উচিত।
তাতেও রাজি না দেখে সুধীনবাবু একটু ক্ষেপেই গেল। কলেজ ম্যাগাজিনে ত বেশ লিখেছিলে!
ওটা চাপে পড়ে লিখতে হয়েছে। ও কথা বাদ দিন।
অমন সুন্দর কবিতা কেউ চাপে পড়ে লেখে বিশ্বাস হয় না।
ওরা কিছুক্ষণ যেন দম নিল—পরে কি ভাবে আমাকে চাপ সৃষ্টি করা যায় ভাবছে। আমি হুট করে ওদের অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে গেলাম। বললাম, প্রণব না বলে প্রণবের বাবা কেন বলল! প্রণবই তো বলতে পারে সে গল্প লিখবে।
প্রণবের বাবাকে আমরা জানি—বড় অমায়িক মানুষ, তিনি চান তাঁর পুত্র বড় লেখক হোক। মাঝে মাঝেই বলেন, প্রণব যাও, উপরে উঠে যাও, লেখগে। লিখতে লিখতে হাত খোলে।
প্রণব আমাদের আড্ডায় দু-একবার গল্প শুনিয়েছে। বাক্য বন্ধন শিথিল, প্রেম এবং আবেগ ছাড়া কিছু থাকে না! ওকে দিয়ে হবে না এটা আমাদের জানা। কিন্তু কাগজের একটা বড় খরচের বহর প্রণবের বাবা দিতে নাকি রাজি হয়েছেন। শর্ত একটাই তাঁর পুত্রের গল্প ছাপাতে হবে। সব বাবারাই দেখছি এক ধাতুতে গড়া। আমার বাবা অবশ্য শুনলে কিছুটা শংকাই বোধ করবেন। কারণ তাঁর কাছে লেখক কবি নাট্যকারের কোন দাম নেই সংসারে। উচ্ছন্নে না গেলে কেউ নাটক কবিতা গল্প লেখে না। এতে বাড়ি ঘরের অমঙ্গল হয়।
বাবা দেখছি তখন পিলুকে খোঁজাখুঁজি করছেন। একবার যাবার সময় শুধু বলে গেলেন, তোমরা ভাল আছ তো? বাবা বোঝেন আমাদের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি আমি অপছন্দ করি। বিরক্ত বোধ করি। বাবা আজকাল আমার ভাল লাগা মন্দ লাগার বিষয়টার উপর গুরুত্ব দিতে শিখেছেন। পিলু যে আমগাছে চুপচাপ বসে আমাদের কথা শুনছে বাবার খেয়াল নেই। আমিই বললাম, এই পিলু, বাবা তোকে ডাকছে না!
সে তড় তড় করে গাছ থেকে নেমে পড়ে বলল, ডাকছ কেন?
বাছুর ধরবি। দুধ দোওয়াতে হবে।
বুঝতে পারছি, বাবা তাঁর পুত্রের উপস্থিত বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়নের যোগাড় করছেন।
রাম বলল, গাছে কত আম! আমের কি মিষ্টি গন্ধ!
নিখিল ওদিকে গেল না। সে জানে আমি একজনকে বড় বেশি এড়িয়ে চলি, সে তারই কথা তুলে ফেলল।
সে বলল, শেষ পর্যন্ত দেখছি পরীকেই লাগাতে হবে।
—তার মানে?
মানে পরী বলছিল, আসবে।
—কোথায়?
—তোমার কাছে।
—কেন?
পরী তো কাগজে টাকা দিচ্ছে। পরী কবিতা লিখবে। তুমি কাগজে আছ শুনেই সে রাজি হয়ে গেল। পরী এলে আমাদের আর ভাবনা থাকবে না।
আমার কেমন ভয় ধরে গেল। পরী এ বাড়িতে এলে বিলুর ঠিকুজী কুষ্ঠী জানতে বাকি থাকবে না। যেন পরী এলে সে অপমানিত হবে আবার। বললাম, পরীকে আসতে বারণ কর। ওর আসা আমার বাবা পছন্দ নাও করতে পারেন। বাবার দোহাই দিয়ে পরীর এখানে উদয় হওয়া থেকে নিজের আত্মরক্ষার এটাই যেন আমার একমাত্র উপায় জানা। আমি বারণ করেছি শুনলে সে এখানে রোজ এসে হাজির হতে পারে। পরী বার বার শুনিয়েছে, সে যে-সে মেয়ে নয়। সে রায়বাহাদুরের নাতনি। সে সুহাসদার সঙ্গে মিছিল করে, মিটিং করে। সাইকেল চালিয়ে যতদূর খুশি চলে যেতে পারে। সকাল বিকালে তাকে পার্টি অফিসে পাওয়া যায়। সে মেয়ে এখানে এলে বাধা দেবে কে!
পরীকে কতদিন দেখেছি মিছিলের আগে ঝাণ্ডা হাতে। কতদিন দেখেছি, মিটিং-এ সে মাইকে নাম ঘোষণা করছে। পরী কী যে হবে, সে নিজেও বুঝতে পারে না। পার্টি অফিসে গেলে দেখা যায়, সে বসে বসে পোষ্টার লিখছে। রাস্তায় দেখা যায় সে মিছিলের আগে আছে। নাটকে দেখা যায়, সে নায়িকার পাঠ করছে। আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় দেখা যায়, চাঁদ যেন ঝলসান রুটি। একটা মেয়ে একা এত করতে পারে, সে আমার বাবার দোহাই কতটা মানবে বুঝতে পারছি না। বড় লোকের নাতনি, তা আদুরে হবে বেশি কি! গাড়ি চালিয়ে একদিন কালীবাড়ি হাজির। আবার গাড়ি চালিয়ে কলেজে হাজির! অথচ প্রথম দিকে, কী ধীর পায়ে কলেজের সিঁড়ি ভাঙত। গাড়ি থেকে নেমে সোজা হেঁটে যেত—কারো দিকে তাকাত না। সুহাসদা কলেজ ইউনিয়নের পাণ্ডা। তার পাল্লায় পড়ে পরী একেবারে অন্য ধাতু হয়ে গেল। পরের দিকে গাড়িতে আসত না। এতে বোধহয় গণসংযোগের ব্যাঘাত ঘটে। সে আসত সাইকেলে। সুতরাং যদি পরী মনে করে আসবে, তবে তা কেউ রোধ করতে পারবে না। বাবার দোহাই দিলেও না।
আমি বাধ্য হয়ে মনমরা হয়ে গেলাম। মুকুলের সঙ্গে পত্রিকা বের করা নিয়ে জড়িয়ে না পড়লেই হত। আসলে সেই ভায়া দাদু টিউশনিটাই আমার ঘিলুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।
লক্ষ্মীর আত্মহত্যার কারণ এই পরী। পরীকে এ কথা বলা যায় না। বললে সে খারাপ ভাববে। সেদিন জ্যোৎস্না রাতে পরীকে নিয়ে রেল লাইন ধরে হেঁটে না গেলে লক্ষ্মী আত্মহত্যা করত না। একটি অন্ত্যজ কিশোরী বালবিধবা হয়ে দেবস্থানে যে মানুষটাকে সে নিজের মনে করে সারাদিন চোপা করত সেই মানুষটা এমন বেইমানি করবে সে কল্পনাও করতে পারে নি। তাই সেই মুখ এখনও আমাকে তাড়া করে। পায়ে আলতা, হাতে শাঁখা এবং কপালে সিঁদুর পরে সে শুয়ে আছে যেন। কে বলবে মেয়েটা বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। লক্ষ্মী আমার উপর অভিমান বশে চলে গেল। নিরন্তর সেই জ্বালা মাঝে মাঝে আমাকে এখনও উদাস করে তোলে। সেই থেকে আমি পরীকে এড়িয়ে চলছি। পরী এলে আবার কোন্ আপদ এসে বাড়িটায় ভর করবে কে জানে!
পরী এলে বুঝতে পারছি এক অপমান থেকে আর এক অপমানের দরজায় আমি ঢুকে যাব। সে অপমান কি নতুন সংকট সৃষ্টি করবে কে জানে। একদিন মুকুলকে সোজাসুজি বললাম, পরীকে আমার পিছু লেলিয়ে দেবে না। ওকে আমি চিনি।
আমরা বিকাল হলে সাইকেলে সারা শহর চক্কর মারি। কখনও পুলিস মাঠে গাছের ছায়ায় বসে থাকি। শহরটা যেন আমাদের কাছে কত সব সুন্দর খবর বয়ে আনে। সূর্য অস্ত যাবার আগে সারা লালদীঘি কেমন আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। কোনো তরুণী কিংবা যুবতী আসে হেঁটে। আমরা বড় দূর থেকে দেখি—পৃথিবীর কোন গ্রহ নক্ষত্রে এরা বড় হয় এমন প্রশ্ন জাগে মনে। পরীকে দেখলেও হত। কিন্তু পরীর প্রতি আমার আকর্ষণ অন্য রকমের। পরী আগেও ভয় দেখিয়েছে, বিলু একদিন তোমার বাড়ি যাব। তখন লক্ষ্মী বেঁচে। লক্ষ্মীই পরীকে বলেছিল, মাষ্টার তোমাকে তার বাড়ি নিয়ে যাবে, তা’হলেই হয়েছে। কালীবাড়িতে তখন ছাত্র পড়াই। থাকি, খাই, কলেজ করি।
নিখিল বলল, পরী—কি করেছে?
—বললাম, কি করেছে বলা যাবে না। পীড়াপীড়ি করবে না। ওকে কবিতা দিতে গিয়ে যত ফ্যাসাদ। পরীর জন্যই তো লক্ষ্মীটা বিষ খেল।
—বলছ কি!
—কাউকে কিন্তু বোল না।
—তুমি যে কিনা। এত বড় খবরটা চেপে গেছ।
—তখন তো তোমার সঙ্গে আমার ভাল আলাপ হয় নি। জানতো পরীর মাথা খারাপ আছে। ওকে বাড়িতে মিমি বলে ডাকে। ওকে বেশি আস্কারা দিও না।
আমরা ঘাসের উপর শুয়ে আছি। এ দিকটা নির্জন। দূরে এগ্রিকালচারের মাঠ, পরে সাহেবদের কবরখানা। পাশে বিশাল ঝিল। রিকশার প্যাঁক প্যাঁক শব্দ। আর দূরের রেল-লাইন পার হয়ে গাছের ছায়ায় অনেকটা দূরে আমার বাড়ি। পরীর কথা ভাবলে, আমার কেন জানি বাড়িতে ফেরার ইচ্ছে থাকে না। তবে আর যাই মানাক, আমাদের বাড়িতে মিমিকে মানায় না। আমি বললাম, ওর বোধহয় সুন্দর ছেলে দেখলেই ভাল লাগে। বড় লোকের মেয়েদের কত শখ থাকে। আমি ওর শখের জিনিস। বরং মজা বলতে পার। আমাকে নিয়ে ও মজা করতে ভালবাসে। ওর মধ্যে আমি আর নেই।
পরী তো বলছে, তোমাকে সম্পাদক করতে।
—পরীকে বলবে, আমি রাজি না। ওকে দয়া করে আমাদের বাড়িও নিয়ে যাবে না। পরী আমার বাড়ি চেনে না।
—আমরা কে ওকে নিয়ে যাবার? সে ইচ্ছা করলে সব জায়গায় যেতে পারে। একা নাকি কানপুর যাচ্ছে, বাবার কাছে। সেখানে মাস খানেক থাকবে।
—বাঁচা গেল।
মুকুল তড়াক করে উঠে বসল, বাঁচা গেল মানে! তুমি কি বিলু, মেয়েটা তোমার জন্যই টাকা দিচ্ছে। তোমার কথা উঠতেই বলল, যা লাগে দেব। দাদুকে বলব। দাদু বিলুকে চেনে। ওকে সম্পাদক করতে হবে।
আসলে মুকুলকে কি করে বোঝাই, সেই ভায়া দাদু টিউশনিটাই যত নষ্টের মূলে। ম্যানেজার সাহেবের দুই মেয়ে অবশ্য এখন মাঝে মাঝে সামনের টেবিলে বসে পড়া দেখিয়ে নেয়। একেবারে পর্দার অন্তরালে আর থাকে না। বাবার গৌরবে মেয়েরাও গর্বিত। বাবার হয়ে তাদের গর্ব করার শেষ নেই—বাবা টেনিস খেলে, বাবা আবৃত্তি করে। বাবা নাটক করে। সব ছবি একদিন আমাকে দেখিয়েছিল। বাবার শেষ কৃতিত্বের ছবি বাবার একখানা কবিতা। কবিতাটি সাহেবের স্ত্রী সুচীশিল্পে ধরে রেখেছেন। এবং তাদের ভিতরের ঘরের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। তাহলে ম্যানেজার সাব কবিতা লেখেন। আর সে কাগজের সম্পাদক, এখানে একটা যেন তার বড় অমোঘ জায়গা আছে। বিজ্ঞাপনের জন্য সাহেবকে অনুরোধ জানান হবে। এবং তার জন্য মিমিকে পাঠালে কাজে আসবে—শহরের বনেদী পরিবার, এক ডাকে সবাই তার দাদুর নাম জানে, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, আলাদা ইজ্জত। এবং আমি জানি, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ঠিক একটি কবিতা ধরিয়ে দেবে। এই আশা আমাকে কুহকে ফেলে দিচ্ছে। সুতরাং বুঝতে পারছি, এই কুহকই আমাকে সম্পাদক না করে ছাড়ছে না। আমি বললে, মিমি দয়া করে ফোনে জানিয়ে দেবে, আর একটা কবিতা পাঠাবেন। বিলুর পছন্দ না। বিলু মানে আমাদের কাগজের সম্পাদক।