Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মূল কাহিনি || Tarapada Roy

মূল কাহিনি || Tarapada Roy

মূল কাহিনি

আপাতত যথেষ্ট হয়েছে। পাঠক-পাঠিকাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক গল্পের সুযোগে নিষিদ্ধ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি জ্ঞানদান করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

এবার আমরা মূল গল্পে প্রবেশ করি। প্রথমেই ভ্রম সংশোধন। বাংলা মদের দোকানের নাম যে থাকে না তা নয়। বাংলা মদের নামহীন দোকান সব, যেগুলোকে তার গ্রাহক-অনুগ্রাহকেরা ভালবেসে ঠেক বলে থাকে, কখনও কখনও গ্রাহকদের দ্বারস্থ গৌরবার্থে নামান্বিত হয়। যেমন খালাসিটোলা, বারদুয়ারি, হাবিলদার বাড়ি, মায়ের ইচ্ছা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সব ঠেকে দু-চারজন যে বিক্ষিপ্তভাবে যায় না তা নয় কিন্তু অধিকাংশই দলবদ্ধভাবে যায়। বন্ধুবান্ধবের একেকটা দলে চার-পাঁচ জন থেকে পনেরো-বিশজন পর্যন্ত থাকে।

.

পূর্ব কলকাতার হাবিলদার বাড়ি একটি সুপ্রাচীন বিখ্যাত ঠেক। কেন এই মদের দোকানটির নাম হাবিলদার বাড়ি সেটা কেউ জানে না। শোনা যায়, কোনওকালে কোনও হাবিলদার সাহেব বেনামে এই মদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কালক্রমে কৃতজ্ঞ গ্রাহকবৃন্দ বেনামকে স্বনামে এনে দাঁড় করিয়েছে।

এই হাবিলদার বাড়ি ঠেকের নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে কয়েকটা দল আছে, তার একটি হল বুড়ো শিবতলা নাচগানের একটি সমিতি। অবশ্য যারা সন্ধ্যাবেলা এই দলের সঙ্গে বসে এই ঠেকে নেশা করেন তারা সবাই এই ধার্মিক সংঘের লোক নয়। সমিতিটির পোশাকি নাম নামব্রত সঙ্ঘ।

মদের দোকানটির উত্তর সীমান্তে ডানদিক ঘেঁষে মুখোমুখি দুটো লম্বা বেঞ্চে সঙেঘর রাজত্ব। মধ্যে কোনও টেবিল নেই। বেঞ্চের নীচে বোতল, জল ইত্যাদি এবং সুরাপাত্র সামনের বেঞ্চের লোকটির পাশেই রাখা নিয়ম। এ তো আর বিলিতি মদের বার নয়, সাহেবি ক্লাবও নয়। তবে অসুবিধা হয় শনিবার সন্ধ্যাবেলা, রবিবার দুপুরে। ভিড় উপচিয়ে পড়ে। হাবিলদার বাড়ি মাতালের ভিড়ে গিজগিজ করে। হই হট্টগোলে গমগম করে, মদ-চাট-ঘামের গন্ধে থই থই করে।

এই ঠেকে বুড়ো শিবতলা নামচক্র সঙেঘর নিয়মিত সদস্যের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জন। কিন্তু শনি-রবিবারে পনেরো বিশজনে পৌঁছে যায়। হই হই কাণ্ড হয়।

নামচক্র সঙঘ এই নাম শুনে যদি কারও মনে ধারণা হয় যে সমিতিটি সাম্প্রদায়িক তা হলে তিনি ভুল করবেন। সাম্প্রদায়িক কেন, সঙ্ঘটি ধার্মিকও বোধহয় নয়।

সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ হল মিস্টার ডেভিড পাল, সাতপুরুষ কিংবা ততোধিক পুরুষ ধরে তালতলাবাসী এবং অ্যাংলো। তবে ডেভিডের জীবনের আরও একটা দিক আছে। ডেভিড তার সংক্ষেপিত নাম। তার আসল নাম দেবীদয়াল, দেবীদয়াল থেকে ডেভিড হয়েছে।

দেবীদয়াল নামটা তার ঠাকুমা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন ঘোর বোষ্টমি। কাটোয়ার ছোট লাইনে রেলগাড়ির গার্ডসাহেব ছিলেন ডেভিডের পিতামহ। ওখান থেকেই ডেভিডের ঠাকুমাকে তিনি বিয়ে করে নিয়ে আসেন। খ্রিস্টান সংসারেও মহিলা তার বোষ্টমি সত্ত্বা রক্ষা করেছিলেন। কপালে চন্দনের রসকলি এঁকে স্বামীর সঙ্গে গির্জায় যেতেন, পালা পার্বণে, রবিবার। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ করে খাঁটিয়ায় তুলে মৃত্যুর পরে তাকে কবর দেয়া হয়েছিল।

ডেভিড বেশ লম্বা, গায়ের রং ফরসা। ইংরেজি বলতে কইতে পারে। নিউ মার্কেটে একটা বড় সুতোর দোকানে কাজ করে, হেড সেলসম্যান। শীতের দিনে কোট-প্যান্ট, টাই পরে, বড়দিনে ইস্টারে সপরিবারে গির্জায় যায়। তবে তার প্রধান দুর্বলতা সে পেয়েছে তার ঠাকুরমার কাছ থেকে, সে একজন কীর্তনিয়া, নামগান সঙ্ঘের মূল স্তম্ভ।

কিন্তু এই মূল স্তম্ভটি মাঝেমধ্যেই হেলেদুলে যায়। তার কারণ ওই কারণবারি বা মদ।

ডেভিড একেক সময় মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, হাবিলদার বাড়িতে তাকে আর দেখা যায় না, বেশ কয়েক দিন, এমনকী কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বেপাত্তা হয়ে যায়। নামগান সঙেঘর সহশিল্পীরা তার আর খোঁজ পায় না।

অবশ্য এ জন্যে ডেভিডকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। মদ্যপানে তার উৎসাহের কোনও অভাব কখনওই হয় না। সে ইচ্ছে করে হাবিলদার বাড়িতে আসে না তা নয়, তার আসা হয় না। তার আসার উপায় থাকে না তার ধর্মপত্নী জারিনার জন্যে।

জারিনার কথা কম করে বা বেশি করে, বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা যাবে না। তার কোনও প্রয়োজন নেই। খুব বেশি বলার দরকারও নেই।

আশেপাশের বাড়ি ঘরে, পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে জারিনাকে সবাই অল্পবিস্তর দেখেছেন, তাকে সবাই হাড়ে হাড়ে চেনেন।

জারিনার প্রতাপে জগৎ সংসার তটস্থ, স্বামী বেচারা ডেভিড তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। এমনকী হাবিলদার বাড়ি নামক প্রবল পরাক্রান্ত দিশি মদের ঠেকের দুঃসাহসী মদ্যপদের পা ঠকঠক করে কাপে জারিনার নাম শুনলে।

বলা বাহুল্য, মিঃ ডেভিড পালকে উদ্ধারকল্পে মিসেস জারিনা পাল বহুবারই হানা দিয়েছে হাবিলদার বাড়ির নৈশ ঠেকে এবং সেই সব রাতে সেখানে একই সঙ্গে রামরাবণের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র এবং দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে। কিংবা পূর্বাপর বিবেচনা করে বলা যেতে পারে দনুজদলিনীর মহিষাসুর বধ পালা মঞ্চস্থ হয়েছে।

মদের ওপর, জারিনা বিবির একটা জাতক্রোধ আছে, (অজাতক্রোধও বলা যায়), কারণ তাঁর বাবা জুয়েল মণ্ডল খিদিরপুরে ওভারসিজ বেকারিজ অ্যান্ড প্রভিসন্স কারখানার সহকারী প্রধান পাউরুটি তৈরির কারিগর ছিলেন। জনিসাহেব নামে তার এক মদ্যপ সহকারী বন্ধুর সঙ্গে এক শীতার্ত বড়দিনের প্রভাতে বহু রুটি এবং বহুতর কেক তৈরি করতে করতে জুয়েলকারিগর উক্ত বন্ধুর প্ররোচনায় কেক ও রুটি তৈরির ইস্ট বা শর্করার গাদ দুই গামলা পান করেন। তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়নি, ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল। পুরোটা পেয় ছিল না, চর্ব না হলেও অনেকাংশ চোষ্য এবং লেহ্য ছিল, চুষে এবং চেটে খেতে হয়েছে।

পরিণাম ভাল হয়নি। জুয়েল মণ্ডল ওই সপ্তাহেই নববর্ষের দিন সকালে দেহত্যাগ করেন। জারিনা তখন মাতৃগর্ভে। জারিনা জন্ম ইস্তক রিষড়ায় তার মাতুলালয়ে মানুষ হয়েছে এবং আজন্ম মদ্যপ পিতার কীর্তিকলাপের খোঁটা শুনে এসেছে। সুতরাং স্বামীর ওপরে সে পরবর্তীকালে প্রতিশোধ নেবে, বিশেষত মদ্যপানের ব্যাপারে, এটা স্বতঃসিদ্ধ।

তবে জারিনা বিবির লাজ-লজ্জা, সমবোধ আছে। নিতান্ত অপারগ না হলে বিবি হাবিলদার বাড়িতে হানা দিত না।

ডেভিডের নামচক্র সঙেঘর সাঙাতেরা, অনাদি, অনন্ত, অনিল, অক্ষয়–এরা সবাই জানে আসল দোষী ডেভিড ওরফে দেবীদয়াল ওরফে অমর।

এখানে বলে রাখা ভাল নামচক্রের সকলেরই নতুন নাম। শুধু নামগানের সময় নয় হাবিলদার বাড়ির ঠেকেও সেই নামই চালু। ডেভিড যেমন অমর, গদা মিস্ত্রি হল অনাদি, ছিমন্ত হল অনন্ত এবং শেষমেশ বাদলচন্দ্র হল অক্ষয়।

নামচক্রে বাদলচন্দ্রই সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ, তার পূর্ব ইতিহাসও খুব সেকুলার। এগারো-বারো বছর বয়েসে ভারত-বাংলাদেশ একাকার হয়ে যাওয়া এক বন্যায় সে পদ্মা পেরিয়ে রাজশাহি থেকে। মুর্শিদাবাদে ভেসে গিয়েছিল। সেটা সেই পাতাল রেলের কলকাতার ময়দান খোঁড়ার যুগ। আজিমগঞ্জের পাশে ভাগীরথী পারের গ্রামের রহমতুল্লা ছিলেন পাতাল রেলের লেবার কনট্রাক্টর। বন্যায় ভাসমান এই কিশোরকে তিনি উদ্ধার করেন, এবং তাকে পাতাল রেলের গর্ত খোঁড়ার কাজে কলকাতায় নিয়ে আসেন।

এ গল্পে বাদলচন্দ্রের কাহিনির স্থান নেই। আমরা এখন ডেভিড এবং জারিনা বিবির কেচ্ছায় ফিরে যাচ্ছি। এবার নয়, যথাসময়ে বাদলচন্দ্র ওরফে অক্ষয়ের সঙ্গে দেখা হবে।

ডেভিড ঠিক সংসারী টাইপের লোক নয়। তার হয়তো বিয়ে করাই উচিত হয়নি। সে অবশ্য বলে যে, আমি তো বিয়ে করিনি। জারিনা আমাকে বিয়ে করেছে।

ডেভিডের প্রধান দোষ ছিল সে মাইনে পাওয়ার পর তিন-চারদিন বেপাত্তা হয়ে যেত। তারপর সব টাকা উড়িয়ে বাড়ি ফিরত। কোনও সংসারই এ জিনিস বরদাস্ত করতে পারে না।

জারিনা বিবির কল্যাণে ডেভিডের এই দোষটি কিঞ্চিৎ সংশোধিত হয়েছে। হাবিলদার বাড়ির ঠেকে অতর্কিতে আবির্ভূতা হয়ে জারিনা ডেভিডের টুটি চেপে বাড়ি নিয়ে যেত, সেই সঙ্গে ইয়ার বন্ধুদের যার কাছে যা মালকড়ি আছে সেটাও হস্তগত করত।

সে সময় ঝামেলার ভয়ে ডেভিড মাসের প্রথম দিকে নামচক্রের আড্ডায় আসত না। জারিনা বিবিও এসে তাকে খুঁজে পেত না। জারিনা তখন বুদ্ধি করে ডেভিডের কর্মস্থলে মাসমাইনের দিনে সকাল সকাল গিয়ে উপস্থিত হত। এ ছাড়াও জারিনা দোকানের প্রবীণ মালিককে অনুরোধ করে যেন সে না এলে কিংবা কখনও আগের দিন মাইনে দেওয়া হলে সেটা যেন ডেভিডকে না দেয়া হয়। প্রাজ্ঞ দোকানদার সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।

অবশ্য এই ঘটনার ফলে ডেভিডের যথেষ্ট সম্মানহানি হয়েছিল। দোকানের এবং আশেপাশের দোকানের অন্য কর্মচারিদের কাছে মুখ দেখানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। মনের দুঃখে সে মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়।

মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া খুব সোজা কাজ নয়। সব মাতালই কখনও না কখনও মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, আবার ধরে। আবার ছাড়ে, আবার ধরে। আরও জোর দিয়ে ধরে।

একই নিয়মে কয়েকদিন মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পরে হঠাৎ করে ডেভিড আবার নামচক্রে চলে আসে। অধিকতর উদ্যমের সঙ্গে মদ্যপান, হইচই শুরু করে। হাবিলদার বাড়ির ঠেক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও সে বাড়ি যেতে চায় না। আরও খাবে, আরও আরও খাবে।

এইরকম সময়ে বন্ধুরা অনেকেই তাকে বুঝে কিংবা না বুঝে তাল দেয় কিন্তু তারা সবাই ডেভিডের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারে না। রাস্তায় বেরিয়ে করতালি সহযোগে নামগানের সঙ্গে ডেভিড যখন হেলিয়া-দুলিয়া নাচে, তারা তাল রাখতে গিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

রাত বাড়ে। দায় বাড়ে নামব্রত সঙেঘর ঠান্ডামাথা সদস্যদের। তারা এভাবে ডেভিডকে রাস্তায় ফেলে যেতে পারে না।

.

এককালে কলকাতার ট্রাফিক পুলিশে মাতাল স্কোয়াড ছিল। এক অ্যাংলো সার্জেন্ট সাহেব লাল মোটর সাইকেলে রাত সাড়ে দশটার পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। কোথায় কোন মাতাল বাড়ি ফেরেনি, তাকে বাড়ি পাঠানোই তার ডিউটি। সেই সার্জেন্ট সাহেব কলকাতার পানশালার একটি অনবদ্য গল্পে অমর হয়ে আছেন।

(গল্পটা অন্যেরাও লিখেছেন বা বলেছেন। আমার কাণ্ডজ্ঞানেও সম্ভবত রয়েছে। তবু কাহিনির খাতিরে আরেকবার উল্লেখ করা যেতে পারে।)

মোদো কলকাতার মধ্য নিশা। চৌরাস্তার মোড়ে দুই মাতাল পরস্পরকে জাপটিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বহুদূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সার্জেন্ট সাহেব তার সেই লাল মোটর সাইকেল যুগ্মমদ্যপের পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, বাবুরা বাড়ি যাও। Go Home–এর পরে বিবিরা পেটাবে।

সবাই চলে গেছেন। শুধু ওই দুজন দাঁড়িয়ে রইলেন, চুরচুর অবস্থায় দুজনায় দুজনকে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাস্তায় মধ্যখানে সম্পূর্ণ নিশ্চল। সার্জেন্ট সাহেব তার মোটর সাইকেল নিয়ে তাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জোর করতে লাগলেন বাড়ি যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তাদের তো বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই, তাদের বক্তব্য, United we stand, divided we fall অর্থাৎ একত্রে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকলেই তারা আছেন, ছাড়াছাড়ি হলেই পড়ে যাবেন। বাড়ি যাওয়ার উপায় কী?

মিস্টার ডেভিড ওরফে শ্রীযুক্ত দেবীদয়াল ওরফে অমরের সমস্যা অনেক জটিল। অধিক মদ্যপান করলে ডেভিডের কদাচিৎ পদস্খলন হয়, সে তখন উদ্বাহু নৃত্য করে।

আর সে বাড়ি যাবেই বা কেন? সেখানে জারিনা বিবির উদ্যত ঝাটা অপেক্ষা করছে।

বেচাল অবস্থায় রাত দুপুরে পাড়ার কুকুরদের বিচলিত না করে নিজের বলয়েও নিঃশব্দ প্রবেশ খুব সহজ নয়। সুতরাং যত রাতই তোক জারিনা জেগে উঠবেই এবং তারপর ওরকম অভ্যর্থনা, ঝটা পেটা এবং অনাহার ডেভিডের মোটেই পছন্দ নয়। সুতরাং সে নানা কারণেই বাড়ি ফিরতে চায় না।

নামব্রত সঙ্ঘের বন্ধুরা উদ্যোগ নিয়ে আগে দুয়েকবার ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গেছে। কিন্তু তার পরিণতি সুখের হয়নি। অনাদি, অনন্তরা সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও বহন করে চলেছে।

একবার বাদলচন্দ্র জারিনার কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ডেভিডকে ঘরের মধ্যে ঢুকে একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। জারিনা ঘরের মধ্যে অন্ধকারে, নিঃশব্দে ওঁত পেতে ছিল। সে মাতাল ও অসতর্ক বাদলচন্দ্রের কোমরে আচমকা একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। চোর-চোর বলে চেঁচাতে থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘনবসতি ঘিঞ্জি ও হাফবস্তি অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে পিল পিল করে লোক লাঠি-বল্লম-ভোজালি-চাবুক-হাতদা-বঁটি-দা ইত্যাদি নিয়ে রে রে করে বেরিয়ে আসে। পূর্বপুরুষদের বহু পুণ্যে সে যাত্রা বাদলচন্দ্র মত্ত অবস্থাতেও আত্মপরিচয় দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। বলা বাহুল্য, নামব্রত সঙেঘর সহযোগী বন্ধুবান্ধবেরা যারা সেদিন তার সঙ্গে ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়েছিল, দুর্যোগের আভাস পাওয়া মাত্রেই তারা দৌড়ে পালিয়েছিল।

এখনও শীতে বর্ষায় বাদলচন্দ্রের কোমরের গাঁটটা টনটন করে।

অবশ্য এর পরেও উপায়ান্তর না থাকায়, বন্ধুরা কখনও কখনও মধ্যরাতে কিংবা তারও পরে ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছাতে গেছে। কোনওবারই অভিজ্ঞতা মনোরম হয়নি। জারিনার কেমন যেন বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায় ডেভিডের পদস্খলনের জন্যে এরাই দায়ি। হিংস্র ভাষায় এবং হিংস্রতর ভঙ্গিতে সে এই বন্ধুবৎসল এবং পরোপকারী বন্ধুদের তাড়া করে যেত। একবার ডাকাত ডাকাত করে চেঁচিয়ে একরাত্রি তালতলা থানায় এদের হাজতবাসের ব্যবস্থাও করেছিল।

সে যা হোক, এখন নামব্রত সঙ্ঘের সম্মুখে বিশাল সমস্যা। প্রত্যেকবার জন্মাষ্টমীর সময় তারা ঢোল-করতাল কঁসি সহযোগে নামগান করে পথ প্রদক্ষিণ করে। বলতে গেলে এটাই নামগান সঙেঘর বাৎসরিক প্রধান উৎসব।

এই উৎসব ডেভিডকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। সবচেয়ে বড় খোলটা নিপুণ হাতে ডেভিড বাজায়। তার গানের গলাও খুবই সুরেলা। তা ছাড়া দীর্ঘকায়, সুদর্শন, গৌরবর্ণ ডেভিড ওরফে দেবীদয়ালই নায়কেরই মতো ওই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেয়। তখন তার চন্দনচর্চিত ললাট, গলায় উঁইফুলের মালা, সাদা অঙ্গবস্ত্র ইত্যাদি দেখে কে বলবে যে এই লোকটিই জুতোর দোকানের টাইপরা সেলসম্যান।

তা সেই ডেভিডেরই দেখা নেই এবং এবার বিরতি খুব দীর্ঘ দিনের। দেড়-দুই মাস তো হবেই। হাবিলদার বাড়ির ঠেকে এত দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ডেভিড কখনও হয়নি। কখনও কখনও বড়জোর তিন সপ্তাহ হয়েছে। কিন্তু এবার বিশেষ করে এই জন্মাষ্টমীর আগে ডেভিডের এত দীর্ঘকাল দেখা নেই, ভাবা যায় না।

শেষ যেদিন ডেভিড এসেছিল, সেদিন অবশ্য বেশ গোলমাল হয়েছিল। ডেভিডকে বাড়িতে পৌঁছাতে যেতে হয়েছিল, সেটাও রাত দেড়টা নাগাদ প্রায় চ্যাংদোলা করে। সেদিনও অভ্যর্থনা মোটেই সুখের হয়নি। ঘরে ঢোকা মাত্র ডেভিডকে এক ঝাপটায় মেঝেতে চিত করে ফেলে জারিনা বিবি জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে পরপর চিনেমাটির পেয়ালা ছোড়ে। অব্যর্থ লক্ষ তার, প্রথম দুটি অনন্ত এবং অমরের কপালে লাগে, অবস্থা বুঝে বাকি দুজন দৌড় দেয়। কিন্তু রক্ষা পায় না। অনাদির ঘাড়ে এবং অসীমের পিঠে লাগে। সবাই অল্পবিস্তর আহত হয়, অমরের কপাল কেটে যায়, নীলরতনে গিয়ে দুটো সেলাই দিতে হয়েছিল।

.

নামব্রত সঙ্ঘের ঠেকে বসে সবাই খুবই চিন্তান্বিত। ক্যালেন্ডার দেখে হিসেব কষে বেরোল আজ পঞ্চাশদিন ডেভিডের দেখা নেই৷

এদিকে বার্ষিক উৎসবের সময় সমাগত। আর দেরি করা যায় না।

মদ্যপানে মানুষের মনে এক ধরনের অলীক সাহস সঞ্চয় হয়। রাত দশটার সময় হাবিলদার বাড়ির দোকান বন্ধ হলে রাস্তায় বেরিয়ে কিছুক্ষণ জটলা করে সবাই সঙঘবদ্ধ হয়ে ঠিক করল, ওই দজ্জাল জারিনা বিবিকে ভয় পেলে চলবে না, আমাদের বউয়েরাই বা ওর চেয়ে কম কীসে, ডেভিডের বাড়িতে আজ যেতেই হবে, ডেভিডকে ছাড়া তো আর নগর সংকীর্তন হবে না।

কিন্তু ডেভিড কোথায়? এক মাস আগে ডেভিড মারা গেছে।

ওই-রকম লম্বা-চওড়া, যুবক মানুষ। সকালবেলা বাজারে গিয়ে বাজার থেকে ফিরে থলে নামিয়ে বউয়ের কাছে এক গেলাস জল চাইল। জল আর খাওয়া হয়নি। সামনে বিছানার ওপরে লুটিয়ে পড়ে। আধঘণ্টা পরে হাসপাতাল বলে হার্ট ফেল।

এ খবর তো আর অনাদি-অনন্তদের কাছে পৌঁছয়নি। মাতালদের আড্ডায় এরকম হয়। একেক জন একেক প্রান্ত থেকে আসে। তার মধ্যে কেউ একদিন হঠাৎ বরবাদ হয়ে গেলে সে খবর আড্ডায় অন্যদের কাছে এসে পৌঁছায় না।

আজ বলতে গেলে একটু সকাল সকালই এসেছে এরা। রাত এগারোটা। পাড়ার অনেক বাড়িতেই আলো জ্বলছে। লোকজন দাওয়ায়, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় চারমূর্তি গলির মধ্যে প্রবেশ করল।

এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সামনের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে নৈশাহার শেষে রাস্তার কুকুরদের রুটি দিচ্ছিলেন। তিনি এদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কাকে চান?

অনাদি বলল, আমরা ডেভিডের বন্ধু।

অনন্ত বলল, আমরা ওই সামনের বাড়ির ডেভিডের কাছে এসেছি।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, আপনারা কীরকম বন্ধু? জানেন না একমাস হল ডেভিড মারা গেছে।

এই সংবাদে হতভম্ব হয়ে অনাদি-অনন্তেরা পিছু হটছিল। তাদের মনের মধ্যে দুটো জিনিস কাজ করছিল। একটা হল বন্ধুর মৃত্যুর জন্য শোক এবং অন্যটা হল জারিনা বিবির আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার থেকে নিষ্কৃতি জনিত স্বস্তি।

কিন্তু ইতিমধ্যে নিজের ঘরের জানলা দিয়ে এদের দেখে স্বয়ং জারিনা বিবি রাস্তায় নেমে এসেছে। এরা জারিনাকে দেখে দৌড় দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো এদের পর্যবেক্ষণে রেখেছিল এবং দৌড় দিলেই তাড়া করবে বুঝতে পেরে, দ্রুত পা চালিয়ে পালাতে গেল।

এদের ভাবগতিক দেখে জারিনা দ্রুতপদে এগিয়ে এল, যাবেন না। আপনারা যাবেন না। আপনাদের কাছে আসার দরকার আছে।

কিছুই বুঝতে না পেরে অনাদি-অনন্তরা দাঁড়িয়ে গেল। তবে খুব ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। জারিনা বিবির চোখেমুখে চেহারায় রাগের ভাগ দেখা যাচ্ছে না।

জারিনা এদের ডেকে নিয়ে তার ঘরে বসাল। একপাশে একটা বড় খাট, তার ওপরে একপাশে দুই পিতৃহীন নাবালক ঘুমোচ্ছে। এপাশটায় জারিনা শোয়। সেখানে দুজনে বসল। আর দুজন দুটো চেয়ারে বসল, চেয়ার দুটো এবং খাটের মাঝখানে একটা ছোট গোল টেবিল।

জারিনা বলল, আপনারা একটু বসুন। আমি কতদিন ধরে আপনাদের কথা ভাবছি। এই বলে সে টেবিলের দেরাজ থেকে একটা চাবি বার করে ঘরের একপাশের সাবেকি দিনের বড় কাঠের আলমারিটা খুলল।

অনাদি ফিসফিস করে অনন্তকে বলল, পিস্তল-টিস্তল বার করছে বোধহয়। অন্য দুজনও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

কিন্তু পিস্তল-টিস্তল নয়। জারিনার হাতে একটা বোতল, এক বোতল দুনম্বর বাংলা মদ। মৃত্যুর দিন বাজার করার পথে কিনে এনেছিল ডেভিড। যখন ঠেকে যেত না, বাজার থেকে আসার সময় একেক দিন এইরকম কিনে আনত।

বোতলটা অটুট রয়ে গেছে। জারিনা এসে বোতলটা টেবিলের ওপর রাখল। তারপর পাশের রান্নাঘরে গিয়ে গোটা দুয়েক গেলাস আর তিনটে কাপ নিয়ে এল।

চারজনের জন্যে পাঁচটা পাত্র। অনাদি ধরে নিল জারিনাও খাবে। বোতলের ছিপিটা খুলতে খুলতে অনাদি মনে মনে বলল, সাবাস জারিনা।

বোতলটা খোলা হয়ে যেতেই জারিনা সেটা নিজের হাতে নিয়ে চারটে পাত্রে সমান করে ভাগ করে দিল। আর পঞ্চম পাত্রে খুব কম ঢালল।

ভদ্রতা করে অনন্ত বলল, আপনি নিজে এত কম নিলেন?

জারিনা বলল, এটা আমার নয় ডেভিডের।

চার পাত্র নিঃশেষ করে চার বন্ধু উঠে পড়ল। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ডেভিডের পাত্রের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে জারিনা তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখে জল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress