মুরারিবাবুর টেবিলঘড়ি
ক্রি র র র রং……
মুরারিবাবু তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলেন বিছানা থেকে। তারপর আলো জ্বেলে দিলেন। ভোর চারটেয় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন টেবিলঘড়িতে। ঠিক ছটায় হাওড়া স্টেশনে ট্রেন। প্ল্যাটফর্ম নম্বরও মুখস্থ করে রেখেছেন। রাস্তার মোড়ে ট্যাক্সি পেতে অসুবিধে হবে না। সাড়ে পাঁচটায় বেরুলেই চলবে।
রাঁধুনি-কাম-ভৃত্য জটিলকে এবার ঘুম থেকে ওঠাতে হবে। অন্তত এককাপ চা না খেলে ঘুমের আড়ষ্টতা কাটবে না। তবে জটিলের ঘুমটা পাতলা। সমস্যা হবে ভাগ্নে বীরুকে নিয়ে। সে একটি কুম্ভকর্ণ। হাতের এই দেড়ঘণ্টা সময়ের আধঘণ্টা তাকে ঘুম থেকে ওঠানোর কাজে বরাদ্দ করে রেখেছেন মুরারিমোহন। জিনিসপত্র রাতে শুতে যাওয়ার আগে গোছানো হয়েছে। কাজেই ব্যস্ততার দরকার ছিল না।
কিন্তু মুরারিবাবুর স্বভাব হচ্ছে এই। সব ব্যাপারেই হিসেব করে চলেন, যাতে পরে পস্তাতে না হয়। তাই একটু ব্যস্তবাগীশ হয়ে পড়েন।
অ্যালার্ম থামতে-থামতে তার বাথরুমে ঢোকা হয়ে গেছে। প্রাতঃকৃত্য সেরে সোজা চলে গেলেন কিচেনের সামনেকার খোলা বারান্দায়। খাঁটিয়া পেতে জটিলেশ্বর ঘুমোচ্ছে। ঘড়র-ঘড়র নাক ডাকছে। মুরারিবাবু ডাকলেন,–জটে! জটিল রে। ওঠ, ওঠ।
জটিলের নাক ডাকা থামল। মুরারিবাবু ফের সস্নেহে ডাকলে সে চোখ বুজে থেকেই জড়ানো গলায় বলল,–দেরি আছে।
মুরারিবাবু বললেন,–দেরি নেই। চারটের অ্যালার্ম বেজে গেছে। উঠে পড় বাবা!
জটিল একইভাবে চোখ বুজে এবং পাশ ফিরে বলল,–দেরি আছে।
মুরারিবাবু রেগে গেলেন। তার গায়ে হাত রেখে একটু ঠেলে বললেন, কী দেরি আছে বলছিস! ওঠ, ওঠ। চায়ের জল চাপা। আমি বীরুকে ওঠাই।
জটিল শুধু বলল, ঠিক আছে।
তখন আশ্বস্ত হয়ে মুরারিবাবু পাশের ঘরে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। বীরু বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছ। এইবার আধঘণ্টা সময় তার পিছনে জোঁকের মতো লাগতে হবে। আজ তো না লেগেও উপায় নেই। যার ঘুম আটটার আগে ভাঙে না, তাকে ভোর চারটেয় ওঠানো সহজ নয়।
মুরারিবাবু ভাগ্নেকে প্রথমে গুতোগুতি, পরে ঠেলাঠেলি, শেষে তার কানে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করলেন। তাতেও বীরুর কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। তখন মুরারিবাবু তার লম্বা চুল টানাটানি করতে থাকলেন। এবার বীরু বলল, কী করিস মাইরি! ভাল্লাগে না!
মুরারিবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, আমি রে, আমি। ওঠ বাবা। ট্রেন ফেল হয়ে যাবো। উঠে পড়।
বীরুর আর সাড়া নেই।
তখন মুরারিবাবু বিরক্ত হয়ে ওর দুকাঁধ ধরে টেনে ওঠালেন এবং বিছানায় বসিয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ আছে বীরুর। সে বসে এদিক-ওদিক টলতে থাকল। তারপর গড়িয়ে পড়ল ফের।
মুরারি ভাগ্নেকে আবার অমনি করে ওঠালেন। আবার বসে থেকে চোখ বুজে টলতে টলতে বীরু বিছানায় গড়াল।
আর সহ্য করতে পারলেন না মুরারিবাবু। মেঘের মতো গর্জে ডাকতে শুরু করলেন, বীরু, অ্যাই বীরে! অ্যাই হতচ্ছাড়া। অ্যাই পাজি! ওরে কুম্ভকর্ণ! ওরে ভূত!
কিন্তু কাঁহাতক ডাকা যায়! আর কী বলেই বা ডাকা যায়? ডাকাডাকির সঙ্গে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুতি, সুড়সুড়ি, কাতুকুতু সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন। আধঘণ্টা সময় বরাদ্দ করা আছে। কাজেই মুরারিবাবু নিজের কর্মসূচিই রূপায়িত করছেন বলা যায়।
কতক্ষণ পরে শ্রীমান বীরুর সাড়া পাওয়া গেল। চোখ খুলে পাতা পিটপিট করে বলল,-কী হয়েছে?
–ওঠ। উঠে পড়। কখন চারটে বেজে গেছে। তোর দেখছি সবদিনই সমান ঘুম!
দিন না রাত? –বলে বীরু উঠে বসল। বিরক্তমুখে বলল ফের, আমি কি দিনে ঘুমোই?
মুরারিবাবু হাসতে-হাসতে কিচেনের অবস্থা দেখতে গেলেন। গিয়েই অবাক হলেন। জটিল তেমনি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।
খাপ্পা হয়ে মুরারিবাবু তার কান ধরে গর্জালেন, জটে! তুলে ফেলে দেব রাস্তায়। হতচ্ছাড়াকে চায়ের জল চাপাতে বললাম। আর কিনাফের নাক ডাকাতে
শুরু করেছে? আই বাঁদর! ওঠ!
জটিল আগের মতো জড়ানোগলায় বলল,–দেরি আছে।
তখন মুরারিবাবুর রাগ চড়ে গেল মাথায়। ওর খাঁটিয়াটা খটাখট নাড়া দিয়ে এবং চ্যাঁচিমেচি করে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেললেন। ওপরতলায় এবং পাশের ফ্ল্যাটে নড়াচড়া ও কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
একটু পরে ওপরতলার ব্যালকনিতে ঝুঁকে প্রতিবেশী হারাধনবাবু ডাকলেন, মুরারিয়া! ও মুরারি! হল কী? এত চ্যাঁচামেচি কীসের?
কলিং বেল বাজল। অগত্যা মুরারিবাবু গিয়ে দরজা খুললেন। দেখলেন ওপরতলার হারাধনবাবু, পাশের দুটো ফ্ল্যাটের গোবিন্দবাবু মানিকবাবু আর মানিকবাবুর স্ত্রী ঘুমভাঙাচোখে হাজির হয়েছেন। দরজা খুলতেই একসঙ্গে বলে উঠলেন, কী হয়েছে? এত হইচই হচ্ছে কেন?
এক কথায় মুরারিবাবু বললেন, রাঁচি যাব।
–রাঁচি। –হ্যারাধনবাবু খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলেন। হাসবারই কথা।
রাঁচিতে পাগলাগারদ আছে। কাজেই রাঁচি যাওয়া মানেই পাগল হয়ে যাওয়া।
গোবিন্দবাবু বললেন,-রাতদুপুরে রাঁচি যাবে মানে? মাথার গোলমাল হল নাকি? সর্বনাশ! অ্যাদ্দিন বলেনি কেন? আমার পিসেমশায়ের ছেলের ছোট খুড় শ্বশুরের জামাই তার ভাগ্নের কাকা বড় ডাক্তার!
মুরারিবাবু বিরক্ত হয়েছেন প্রতিবেশীদের এমন অবাঞ্ছিত কৌতূহলে। বললেন, বড়দার মেয়ের বিয়ে। বুঝলে? তাই ছটার ট্রেনে রাঁচি যাব।
তাই বলো! হারাধন হাসতে-হাসতে বললেন, কিন্তু তার জন্যে এই রাতদুপরে এমন ভূমিকম্প সৃষ্টি করছ কেন ভায়া? সবে শুয়ে ঘুমোব-ঘুমোব করছি, আর তোমার এই ডাকাতপড়া হুলুস্থুল!
–কোনও মানে হয়? গোবিন্দবাবু বললেন। আমরা ভাবলুম, আবার একটা ভুতুড়ে আলমারি এনেছ বুঝি! রাতদুপুরে আবার গণ্ডগোল বাধিয়েছ। হয়তো আবার দেখব, ভিরমি খেয়ে পড়ে আছে। তাই দৌড়ে এলাম।
হ্যাঁ–একবার চীনে পাড়ার দোকান থেকে একটা আলমারি কিনে এনে সে এক হাঙ্গামা হয়েছিল বটে। কিন্তু এঁরা রাতদুপুর-রাতদুপুর করছেন, এতেই মুরারিবাবুর রাগ হয়েছে। বললেন,-রাতদুপুর মানে কী? প্রায় এক ঘণ্টা আগে চারটে বেজে গেছে। এখন প্রায় পাঁচটা বেজে এল!
পাঁচটা! হারাধনবাবু খুব সময়সচেতন মানুষ। সবসময় হাতে ঘড়িটি বাঁধা থাকে। বিদেশি সওদাগরি আপিসের কেরানি। সায়েবদের সংসর্গে থেকে ঘড়ির কাটা ধরে চলেন সব কিছুতে। হাতের ঘড়িটি দেখে নিয়ে বললেন, তোমার মাথা খারাপ? মোটে বারোটা পঁয়ত্রিশ বাজছে।
মুরারিবাবু বললেন–অসম্ভব! আমার টেবিলঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল কাঁটায়-কাঁটায় চারটেয়। অ্যালার্ম শুনেই তো ঘুম ভেঙেছে। তারপর ঘণ্টাটাক ওদের ডাকাডাকি করছি।
ইতিমধ্যে অন্যান্য ফ্ল্যাটের কর্তগিন্নিরাও এসে ভিড় জমিয়েছেন। ব্যাপার জেনে কেউ-কেউ বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গজপতিবাবু একটু হেসে বললেন,–মুরারি, টেবিলঘড়ি কিনেছ বুঝি? হুঁ, বুঝেছি।
মুরারিবাবু বললেন, কী বুঝেছ শুনি?
ভায়া, টেবিলঘড়ির কথা আর বোলো না। বিশেষ করে অ্যালার্ম ঘড়িগুলো বড় গোলমেলে জিনিস, গজপতি বললেন,–অ্যালার্ম দেবে নটায়, বাজবে এগারোটায়। আজ অবধি একটাও অ্যালার্ম ঘড়ি দেখলাম না, যে সঠিক সময়ে বাজে।
সুরসিক হারাধনবাবু বললেন, বরং নিজে রাঁচি না গিয়ে তোমার ঘড়িটাকেই পাঠিয়ে দাও।
প্রতিবেশীরা হো-হো হি-হি খাক-খ্যাক করে হাসতে থাকলেন।
এই শুনে মুরারিবাবুর এত রাগ হল যে সবার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর সটান নিজের ঘরে চলে এলেন।
এসে টেবিলঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অবাক। যখন অ্যালার্ম বেজেছিল, তখন ঘড়ির দিকে তাকাননি। কে-ই বা তাকায়?
ঘড়িতে বাজছে–সত্যি বাজছে বারোটা ছত্রিশ!
অথচ অ্যালার্মের কাঁটা দেওয়া আছে চারটেয়। তাহলে ঘড়ির অ্যালার্মে গণ্ডগোল আছে। মুরারিবাবু হতাশ হয়ে বসে পড়লেন। এই ঘড়িটা গতকাল বিকেলে কিনে এনেছেন পার্ক স্ট্রিটের একটা দোকান থেকে। বেশ বড় দোকান। হালফ্যাশানি জিনিস মুরারিবাবুর চক্ষুশূল। আজকাল সবকিছুতেই তো ভেজাল। তাই যে যুগে ভেজাল কেউ দিত না এবং ভেজাল দেওয়া পাপ মনে করত, সেই যুগের তৈরি জিনিস কিনতে মুরারিবাবুর আগ্রহ বেশি।
এই টেবিলঘড়িটা একশো বছর আগের তৈরি বিলিতি জিনিস। শো-কেসে সাজানো ছিল। দোকানদার কিছুতেই বেচবে না। জেদ করে অনেক চড়া দামে কিনে এনেছেন মুরারিবাবু। রাঁচি যাওয়ার জন্য ভোরে ওঠার দরকার ছিল।
কিন্তু বিলিতি অ্যালার্ম ঘড়ি যে এমন অদ্ভুত কাণ্ড করবে ভাবতেও পারেননি।
অবশ্য মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম বলে শাস্ত্রবাক্য আছে। মুনিদেরই ভুল হয়। তো, এ একটা ঘড়ি। অতএব মুরারিবাবু অ্যালার্মের কাটা চারটেতে রেখেই অ্যালার্মের চাবি ঘুরিয়ে ভালোমতো দম দিলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন।
পাশের ঘরে বীরু আবার বালিশের দিকে ঠ্যাং করে শুয়ে পড়েছে কখন। অকাতরে ঘুমোচ্ছে। দেরি ছিল মুরারিবাবুর।
সেই ভোরে অ্যালার্ম কিন্তু আর বাজেইনি। মুরারিবাবুর রাঁচি যাওয়া হয়নি ছটার ট্রেনে। গিয়েছিলেন পরের ট্রেনে বিকেলবেলা।
ফিরে এলেন দিন তিনেক পরে। হাওড়া পৌঁছতে রাত নটা বেজে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরতে দশটা হল। ট্রেন জার্নিতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন এগারোটা নাগাদ। সবে ঘুমের আমেজ এসেছে, আচমকা অ্যালার্ম বেজে উঠল। অ্যালার্মের দম তো দেওয়া ছিল না।
ঘড়িতে তখন ঠিক এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ।
বিরক্ত হলেন মুরারিবাবু। কিন্তু কী আর করবেন তখন? ঘড়ির দোকানে দেখাতে হবে। সকাল হোক।
পরদিন ঘড়ি মেরামতের দোকানে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে আনলেন। কিন্তু কোনও ত্রুটি ধরা পড়ল না। যন্তর ঠিক আছে। এতটুকু গণ্ডগোল নেই। বরং ঘড়িটার খুব তারিফই শুনে এলেন মিস্ত্রি ভদ্রলোকের কাছে।
অথচ সেদিনও অ্যালার্মের দম না দেওয়া সত্ত্বেও আবার ঠিক রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে অ্যালার্ম বাজল।
এবার একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন মুরারিবাবু। ঠিক ঘুম আসার সময় এ কী জ্বালাতন!
পরের রাতেও ঠিক একই ব্যাপার হল এবং তার পরের রাতেও সময় ওই এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট।
নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে। মুরারিবাবু ভেবে কূল পেলেন না কিছু। সেই পার্ক স্ট্রিটের দোকানে গিয়ে মালিককে ব্যাপারটা খুলে বললেন। মালিক ভদ্রলোক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। সব শুনে বললেন,–এক কাজ করুন স্যার। অ্যালার্মটা নষ্ট করে দিন। ইচ্ছে করলে আমাদের এখানেও দিতে পারেন। আমরা অ্যালার্ম যন্ত্রটা খুলে দেব। তাহলেই আর ঝামেলা হবে না।
তাই করা হল। মহানন্দে ঘড়ি নিয়ে এলেন মুরারিবাবু। নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লেন আজ। প্রথম ঘুমটা ভেঙে গেলে ফের ঘুম আসতে চায় না। এবার আর ব্যাঘাত ঘটবে না।
কিন্তু ও হরি, এ কী কাণ্ড! সবে চোখ বুজে এসেছে, অমনি ক্রিররররং–
লাফিয়ে উঠে বসলেন মুরারিবাবু। অ্যালার্ম কাটা নেই, অ্যালার্ম যন্ত্র অর্থাৎ ভেতরের ঘণ্টা নেই–বড় কাটা ছোট কাটার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, অথচ ঠিক অ্যালার্ম বাজছে সেই এগারোটা পঁয়ত্রিশে।
খুব ভয়ের চোখে ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মুরারিবাবু। আবার কি তাহলে সেই চীনে আলমারির মতো কোনও ভুতুড়ে ঘড়ি কিনে ফেলেছেন?
যাকগে, কিনেছেন তো আর কী করবেন? ঘড়িটাকে রেখে এলেন কিচেনের পাশে স্টোররুমে।
পরদিন রাতে জটিল এল দৌড়ে, বাবু, বাবু! অ্যালারাম বাজছে কেন?
মুরারিবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন, বাজুক না, তোর কী? তুই ঘুমো নাক ডাকিয়ে।
ব্যাজার মুখে জটিল বলল,–প্রথমে ঘুমটা চটে গেলে আর কি সহজে ঘুম আসবে বাবু?
তারপর রোজ রাতে এগারোটা পঁয়ত্রিশে অ্যালার্ম বাজে ভঁড়ার ঘরে এবং বেচারা জটিলের টাটকা ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসতেই চায় না। কয়েক রাত এইভাবে ঘুম ভালো না হওয়ার ফলে জটিলের চোখ গর্তে বসে গেল।
আর তার দুর্ভোগ ভুগতে হল মুরারিমোহনকেই। সে রাঁধতে-রাঁধতে দিনের বেলা ঘুমোয়। ডাল তরকারি ভাত পুড়ে যায়।
বাইরে কোনও জিনিস আনতে গিয়ে বড্ড দেরি করে। ব্যাপার কী? না– ফুটপাতে বা রোয়াকে ঘুমোচ্ছিল।
এরপর মুরারিবাবুর রাগ হলনা, বেচারি জটিলের ওপর নয়, ঘড়িটার ওপর। রাগের মাথায় ঘড়িটাকে এক আছাড় মারলেন।
এক আছাড়েও রাগ মিটল না। পরপর তিন আছাড় মারলেন। তারপর কানের কাছে রেখে শুনলেন, বন্ধ হয়ে গেছে ঘড়ি। টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ভাঙা ঘড়িটা জুতোর খালি বাক্সে ভরে পুরোনো জিনিসপত্রের সঙ্গে আলমারির মাথায় রেখে দিলেন।
সেদিন রাতে খুব তৃপ্তির সঙ্গে শুয়ে পড়লেন মুরারিবাবু। হাতঘড়িতে বাজছে তখন সাড়ে দশটা।
চোখের পাতা বুজে এসেছে, কী যেন স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছেন–সেই সময় আচমকা ক্রিররররং!…
লাফিয়ে উঠে বসলেন মুরারিবাবু। হা, আলমারির মাথায় রাখা পুরোনো জিনিসপত্রের ভেতর থেকেই আসছে আওয়াজ।
কিন্তু এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তক্ষুনি জুতোর প্যাকেট বের করে ঘড়িটা কানের কাছে রাখলেন। কোনও আওয়াজ নেই।
আওয়াজ নেই। অথচ কাটা চলছে। ঘড়িতে বাজছে এগারোটা পঁয়ত্রিশ! ভুতুড়ে ঘড়ি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মুরারিবাবুর হাত কাঁপতে থাকল। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ঘড়িটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে আবার শক্তভাবে বাঁধাছাদা করে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে।
রাস্তাঘাট তখন জনশূন্য। ল্যাম্পপোস্টের আলো হলদে হয়ে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি যাতায়াত করছে। মুরারিবাবু পাশের বিরাট ডাস্টবিনে ঘড়িটা ফেলবেন ভেবে পা বাড়িয়েছেন, আচমকা তার গায়ে জোরালো আলো পড়ল। অমনি দাঁড়িয়ে গেলেন।
গাড়িটা পুলিশের। দ্রুত কাছে এসে পড়ল। তারপর ঘঁাচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে একজন পুলিশ অফিসার নেমে বললেন,-কে আপনি?
মুরারিবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আমি মুমু-মুরারিমোহন চাকলাদার।
–কোথায় থাকেন?
–ওই যে হলদে বাড়িটা দেখছেন স্যার, ওর দোতলায় স্যার।
–হুম! আপনার হাতে ওটা কী?
–ঘ-ঘ-ঘড়ি স্যার!
ঘড়ি! রাতদুপুরে ঘড়ি নিয়ে এখানে কী করছেন? কই, দেখি!–বলে পুলিশ অফিসার খপ করে ওঁর হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিলেন। তারপর দড়ির বাঁধন খুলতে খুলতে বললেন,–এমন করে বেঁধে প্যাকেটে ভরেছেন কেন? আঁ? কী ব্যাপার?
মুরারিবাবু বললেন, স্যার! এটা একটা ভুতুড়ে ঘড়ি! তাই ফেলে দিচ্ছিলাম ডাস্টবিনে।
ভুতুড়ে ঘড়ি! পুলিশ অফিসার বাঁকা হেসে বললেন,–হুঁ– কী বলছেন? ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছিলেন! ভালো। গিরিধারী!
একজন কনস্টেবল লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। তার পেল্লায় চেহারা দেখে মুরারিবাবুর প্রাণ প্রায় খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। সে এসে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াল।
পুলিশ অফিসার বললেন,–পাকড়ো! কার ঘড়ি চুরি করে পালাচ্ছে ব্যাটা!
গিরিধারী তার বিশাল থাবা মুরারিবাবুর রোগা হাড্ডিসার কাঁধে ফেলতেই তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন।
আসলে মুশকিল করেছে তার চেহারা আর পোশাক। বীরু তো সাধে বলে, না,–ও মামা, একটু ফিটফাট সেজেশুনে ভদ্রলোকের মতো থাকলে কী ক্ষতি হয়। আপনার?
মুরারিবাবু সাদাসিধে থাকেন।
চেহারাও সুবিধের নয়। তার ওপর মাথায় বিদঘুঁটে টাক। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, রাতদুপুরে নির্জন পথে এমন করে প্যাকেটে ঘড়ি লুকিয়ে এদিক-ওদিক তাকানো!
থানায় যেতেই হল। তারপর রাতের মতো হাজতেও থাকতে হল। সেখানে বিছানা, না পাখা। মশার কামড়ে শরীর লাল হল। এক দঙ্গল চোর-ডাকাত ছিনতাইকারীর সঙ্গে লকআপে কাটাতে মুরারিমোহন চাকলাদার রাতারাতি বুড়িয়ে গেলেন।
বীরু হারাধনবাবু, গোবিন্দবাবুদের থানায় নিয়ে গিয়ে সেবারকার মতো উদ্ধার করেছিল আমাকে। মুরারিবাবু নাক কান মলে বললেন,–আর অ্যালার্ম ঘড়ি কিনবই না। তাতে যতবার ট্রেন ফেল হয় তোক।
আর সেই ঘড়িটা? থানায় মহাফেজখানায় থেকে গেল অন্যসব আটক করা জিনিসপত্রের সঙ্গে। বলা বাহুল্য, মুরারিবাবু আর ওটা দাবি করেননি।
কদিন পরে হঠাৎ কলিং বেল বাজল সকালবেলা। দরজা খুলে আঁতকে উঠলেন মুরারিবাবু। সেই থানার ওসি, ভদ্রলোক এসে হাজির। ভয়েভয়ে মুরারিবাবু বললেন, কী কী কী স্যা-স্যার?
ও.সি. ভদ্রলোক একগাল হেসে করজোড়ে নমস্কার করে বললেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে মুরারিবাবু। বিরক্ত করলাম বলে অনুগ্রহ করে রাগ করবেন না।
মুরারিবাবু তখন বিগলিত হয়ে ভেতরে এনে বসালেন। ও.সি. ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম ক্ষেত্রমোহন সেনাপতি। আমি পুলিশ হয়ে আসিনি আপনার এখানে। একটা বিশেষ কথা আছে। আপনি আমাকে ক্ষেত্রবাবু বলেই ডাকবেন।
বলুন ক্ষেত্রবাবু! বলে মুরারিবাবু জটিলকে ডাক দিলেন। চায়ের জোগাড় করতে বললেন ইশারায়।
ক্ষেত্র দারোগা বললেন, কথা আপনার সেই ঘড়ি সম্পর্কে।
মুরারিবাবু মনে-মনে হেসে বললেন, হুঁ, বুঝেছি। খুব জ্বালাচ্ছে বুঝি!
জ্বালাচ্ছে মানে?–ক্ষেত্র দারোগা বললেন,-মহাফেজখানা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাসায়। আপনি দাবি করেননি–আর কেউই দাবি করেননি। কাজেই কী করা যায়? নিয়ে গেলাম। সারাতে দেব ভেবে রেখে দিলাম। কিন্তু ও হরি, রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে
মুরারিবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন,–অ্যালার্ম বাজছে তো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, বাজছে। রোজ রাতে বেজে উঠছে। সারাতে দেব কী, ব্যাপারটা যে ভুতুড়ে!
–তা কী করবেন ভাবছেন?
দয়া করে আপনার জিনিস আপনি নিয়ে আমায় নিষ্কৃতি দিন।বলে ক্ষেত্র দারোগা একটা কাগজে জড়ানো ঘড়িটা রেখে দিলেন মুরারিবাবুর কোলে। তারপর তক্ষুনি উঠে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।
বেরিয়ে যাওয়া নয়, যেন কেটে পড়া। চা খেতেও আর বসলেন না। ঘড়িটা হাতে নিয়ে মুরারিবাবু স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।
কিন্তু একটা বিহিত তো করতে হবে। সেবার চীনে আলমারিটা দোকানে ফেরত দিয়ে বেঁচেছিলেন। এবারও তাই করা যাক।
অতএব তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লেন। ট্যাক্সি চেপে সোজা পার্ক স্ট্রিটের সেই দোকানে। দোকান খুলতে দেরি ছিল। তাই ফুটপাতে অপেক্ষা করতে থাকলেন।
কতক্ষণ পরে এক বুড়ো ভদ্রলোক, চেহারায় সায়েব বলে মনে হল, এসে প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে দোকান খুললেন। ইনি যে মালিক ভদ্রলোক নন, তা ঠিক। হয়তো কোনও পার্টনারই হবেন।
দোকান খুলে তিনি ঢুকলে মুরারিবাবুও পেছন-পেছন ঢুকলেন। ঘরের ভেতরটা তখন আবছা অন্ধকার। মুরারিবাবু ইংরিজিতে বললেন, হ্যালো মিস্টার…মিস্টার…
ঘুরে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। চোখ দুটো কী নীল! খাঁটি সায়েব বলেই মনে হচ্ছে। ঠোঁটের কোণায় হাসি। বললেন, আই অ্যাম মিঃ হেনরি কোলব্রুক! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ব্যাবু?
মুরারিবাবুর ইংরিজি তেমন আসে না। ভেবেচিন্তে বললেন,–আই ওয়ান্ট টু রিটার্ন দিস অ্যালার্ম ক্লক স্যার!
–হোয়াই ব্যাবু?
–ভেরি ব্যাড ব্লক স্যার! রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে বাজে স্যার–মানে, …মুরারিবাবু টের পেলেন মাতৃভাষা বেরিয়ে পড়েছে। তখন টাক চুলকে বললেন,–এ হন্টেড ক্লক স্যার!
অদ্ভুত হেসে বুড়ো সায়েব হাত বাড়ালেন, দ্যাট ওয়াজ মাই অ্যালার্ম ক্লক ব্যাবু। থ্যাংক ইউ। কিন্তু এ কী! তার হাতটা কোটের হাতা দিয়ে যতটুকু– ছে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে হাড়ের হাত। তার মানে কঙ্কালের!
মুরারিবাবুর হাত থেকে ঘড়িটা পড়ে গেল। তক্ষুনি গোঁ-গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।…
জ্ঞান হল যখন, চোখ খুলে মুরারিমোহন অতি কষ্টে বললেন, আমি কোথায়?
বীরুর গলা পাওয়া গেল, মামা! আপনি হাসপাতালে।
মুরারিবাবু উঠে বসলেন। হ্যাঁ, হাসপাতালই বটে। বললেন, কী হয়েছিল রে?
বীরু বলল, আর কী হবে? পার্ক স্ট্রিটে একটা ঘড়ির দোকানের সামনে ফুটপাতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন আপনি। লোকেরা আপনাকে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এখানে পাঠিয়ে দেয়। আপনার পকেটে একটা চিঠি ছিল বড়মামার। আপনার নাম ঠিকানা পেয়ে এঁরা খবর দিয়েছিলেন।
মুরারিবাবু ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন,–সেই ঘড়িটার কী হল বল তো বাবা?
–ঘড়ি? ঘড়ির কথা তো কেউ বলল না মামা!
–না বলুক। চুলোয় যাক। এতদিনে আপদ গেছে। কিন্তু সেই হেনরি কোলক কে?
মুরারিবাবু পরে সেই দোকানে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন। কোলব্রুক সায়েব একশো বছর আগে রাত এগোরোটা পঁয়ত্রিশে আত্মহত্যা করে মারা যান। এই দোকানের মালিক ছিলেন তিনি। দুরারোগ্য অসুখে ভুগে প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। খুব যন্ত্রণা হতো। সারাক্ষণ ছটফট করতেন। তার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।
হ্যাঁ, আত্মহত্যার আগে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন এগারোটা পঁয়ত্রিশের ঘরে। বোঝা যায়, হেনরি কোলব্রুক নাটকীয়ভাবে মরতে চেয়েছিলেন।
দোকানদার ভদ্রলোক আরও জানিয়েছিলেন,–ঘড়িটা আমরা এবার সার্কুলার রোডে কবরখানায় ওঁর কবরের কোণা খুঁড়ে পুঁতে দিয়ে এসেছি। আপনার পাশেই কাগজের প্যাকেটে ঘড়িটা পড়েছিল। আর ঘরে ঢোকাইনি। কারণ, আপনাকে নিয়ে এই চোদ্দজন হল–প্রত্যেকে ওটার পাল্লায় পড়ে ভুগেছেন। এবার স্যার, কালীঘাটে গিয়ে পুজো-টুজো দিন।