মুদ্রাদোষ বড় দোষ
প্রথম দুর্ঘটনা
জাহাজে পা দিতেই কেমন একটা অস্বস্তি আমাকে আঁকড়ে ধরল। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালাম। কুলিটা বেডিং আর সুটকেস তুলে নিয়ে চোখে প্রশ্ন তুলে আমার দিকে তাকাল। অর্থাৎ, কত নম্বর কামরা? পকেট থেকে টিকিটটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। তারপর বললাম, ‘ষোলো নম্বর কেবিন।’
লোকটা যান্ত্রিকভাবে বেডিং আর সুটকেস নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ওকে অনুসরণ করলাম।
জাহাজের ওপরের ডেকে খোলা জায়গাটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু মালপত্র পড়ে আছে। মাঝে-মাঝে লোকজন ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ নোঙর তুলবে।
বিকেল পার হয়ে সন্ধে নেমেছে। আকাশের গোলাপি পটভূমিতে ছেঁড়া সাদা মেঘের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের জল হালকা ঢেউ তুলে জাহাজের গায়ে এসে আছড়ে পড়েছে।
ডেকের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। আরও অনেক যাত্রীই সার বেঁধে রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে। কেউ-কেউ হাত নেড়ে প্রিয়জনদের বিদায় জানাচ্ছে। নীচের ডেকে মালপত্রের ফাঁকে-ফাঁকে শুয়ে কয়েকজন নাবিক বিশ্রাম নিচ্ছে। জাহাজের সব ক’টা নৌকোই ধীরে-ধীরে ফিরে আসছে।
একসময় টানা ভোঁ দিয়ে দুলে উঠল ‘জলপরী’ (জাহাজের নাম)। সমুদ্রের নোনা হাওয়ার অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল। জাহাজের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে চলল গোটাকয়েক মাছরাঙা।
হঠাৎ খেয়াল হল, কুলিটা অনেক আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। একটু ব্যস্ত হয়ে সাততাড়াতাড়ি এগোতে যাব, ধাক্কা লাগল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। সাধারণভাবে ‘সরি’ বলে পাশ কাটাতে যাচ্ছি, কানে এল আগন্তুকের পরিষ্কার মিহি গলা, ‘দেশলাই আছে?’
পাশ কাটাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। পকেট হাতড়ে বের করলাম সুদৃশ্য লাইটারটা। সহযাত্রীকে পড়ন্ত বেলায় একবার ভালো করে দেখলাম।
উচ্চতায় ফুট-পাঁচেক হবে কি না সন্দেহ। অত্যন্ত সাধারণ চেহারা। শরীরে মেদের বাড়াবাড়ি। মুখে কৌতুকের হাসি। ঠোঁটের ওপরে চৌকো টুথব্রাশ গোঁফ। দু-কান থেকে ঝাঁটার মতো লোম বেরিয়ে আছে। ছোট্ট ভুরুর নীচে তার চেয়েও ছোট চোখ।
ভদ্রলোকের অদ্ভুত চেহারা দেখে ভীষণ হাসি পেল। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে লাইটার জ্বালিয়ে ওঁর সিগারেটে আগুন ধরালাম। লাইটার পকেটে রাখতে গিয়েই পকেটে রাখা ফটোটায় আঙুল ঠেকল। ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। শিউরে উঠে হাত বাইরে বের করে নিয়ে এলাম।
ভদ্রলোক মৃদু হেসে সিগারেট ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর হেলতে-দুলতে করিডরের দিকে পা বাড়ালেন।
মনে-মনে ভীষণ উত্তেজিত হলেও মুখে সে-ভাবটা এক মুহূর্তের জন্যেও প্রকাশ করিনি। কারণ, প্রফেশনাল কিলাররা মনের ভাব কখনও মুখে প্রকাশ করে না। আর বিশেষ করে সুধীর নায়েকের মতো (অর্থাৎ, এই অধম!) একজন এক্সপার্ট পোড়খাওয়া কিলার।
চারপাশে একবার তাকালাম। না, আমাকে কেউই লক্ষ করছে না। অতি সাবধানে পকেট থেকে সেই ফটোটা বের করলাম। ডেকের মৃদু আলোয় দেখতে অসুবিধে হলেও চিনতে অসুবিধে হল না। না, কোনও ভুলই আমার হয়নি। এই একটু আগেই যাকে সিগারেট ধরিয়ে দিলাম, তিনিই আমার রিভলভারের চাঁদমারি—রণেন বর্মা।
‘অ্যাসাসিন’ নামের এক গুপ্তদলের প্রফেশনাল কিলার অথবা জহ্লাদ হলাম আমি—অর্থাৎ, শ্রীসুধীর নায়েক। এবারের যাত্রায় দলের প্রয়োজনে এবং নির্দেশে আমাকে খুন করতে হবে এই রণেন বর্মাকে। কেন? কী কারণে? রণেন বর্মা কে?—এসব আমার জানার দরকার নেই। শুধু জানি, আদেশ এসেছে, কাজ হাসিল করতে হবে—ব্যস!
কোমরের পটিতে হাত চেপে অনুভব করলাম লুগার ০.৪৫৭-এর ইস্পাত-আশ্বাস। কিন্তু ওই পাঁচফুটিয়া মালটাকে খতম করতে রিভলভারের গুলি খরচ হবে ভেবে মনটা কেমন যেন করে উঠল। অন্যমনস্কভাবেই পা বাড়ালাম করিডরের দিকে।
কয়েক পা এগোনোর পর, করিডরের ঠিক মুখটাতে, হঠাৎ কেন যে মুখ তুলে ওপরদিকে তাকিয়েছিলাম, বলতে পারব না। এবং সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে পাঁচহাত লম্বা এক লাফ দিয়ে ছিটকে পড়েছি কতকগুলো প্যাকিংবাক্সের ওপরে।
ঠিক একইসঙ্গে ঘটে গেল দুটো ব্যাপার।
এক, আমার প্যাকিংবাক্সের ওপরে লাফিয়ে পড়া। দুই, লোহালক্কড়ে বোঝাই বালতিটার ডেকের ওপরে সশব্দে আছড়ে পড়া। একমুহূর্ত আগেই যে-জায়গায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক সেই জায়গায় আছড়ে পড়ল বালতিটা। পুরোনো নাট, বেয়ারিং, বল্টু, রড ইত্যাদি জিনিসগুলো ডেকের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল। বালতি পড়ার ওই প্রচণ্ড শব্দে কয়েকজন নাবিক ছুটে এল।
উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝাড়তে-ঝাড়তে তাদের জানালাম, ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। এবং এ ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনকে না জানাতে বারবার করে অনুরোধ করলাম।
বেশ কিছুটা খোঁজাখুঁজির পর খুঁজে পেলাম আমার দু-দিনের আস্তানা ষোলো নম্বর কেবিন। ওই দুর্ঘটনার ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সত্যিই কি ওটা দুর্ঘটনা? নাকি ঠান্ডা রক্তে খুন করার এক অভিনব পরিকল্পনা? অনেক ভেবেচিন্তেও ব্যাপারটার কোনও সমাধানে আসতে পারলাম না। এখন ওই মূর্খ নাবিকগুলো যদি ক্যাপ্টেনকে ঘটনাটা রিপোর্ট করে, তা হলেই সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকবে না। খাল কেটে কুমির আনব। অর্থাৎ, জাহাজের সব ক’টা লোকের নজর আমার দিকে পড়বে। যেখানে আমি বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ গোপন দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, সেখানে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোটা ‘অ্যাসাসিন’-এর চিফ খুব একটা ভালো চোখে দেখবে না। যদিও জাহাজের প্যাসেঞ্জার লিস্টে আমার নাম সুধীর নায়েক নয়—নোটন আম্বাস্তা। তবু বলা যায় না কখন কী হয়!
কেবিনের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, দরজায় কোনও ছিটকিনি বা শেকল নেই। অর্থাৎ, দরজা থাকা, না থাকা—সমান। বেডিং আর সুটকেসটা কেবিনের এক কোণে রাখা ছিল। এগিয়ে গিয়ে সুটকেসটা নিয়ে এলাম। সেটাকে বন্ধ দরজায় গায়ে ঠেস দিয়ে পকেট থেকে একটা অ্যাডেসিভ টেপের রিল বের করলাম। তারপর ওই অ্যাডেসিভ টেপ দিয়ে সুটকেসটা সেঁটে দিলাম দরজার গায়ে। এতে আর কিছু না হোক, দরজা খোলার সময় অন্তত খানিকটা শব্দ হবে।
এবার কোমরের হোলস্টার থেকে লুগারটা বের করে বেসিনের নীচে অ্যাডেসিভ টেপ দিয়ে আটকে দিলাম। এমনভাবে ওটা লুকিয়ে ফেললাম যে, কারও পক্ষে চট করে আবিষ্কার করা অসম্ভব।
রিভলভারটা সুটকেসে না রাখার একটা কারণ আছে। তা হল, সাধারণত জাহাজের স্টুয়ার্ডরা একটু বেশি কৌতূহলী হয়, এবং সুযোগ-সুবিধে মতো যাত্রীদের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে। সেটা করতে গিয়ে আমার সুটকেস থেকে যদি রিভলভারটা বের করে ফ্যালে, তবে ক্যাপ্টেনের কাছে আমাকে হয়তো জবাবদিহি করতে হবে। আর রিভলভারের ব্যাপারটা একবার জানাজানি হলে জাহাজে থাকাই দায় হয়ে উঠবে।
সব গোছগাছ সেরে কেবিনের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম নিজেকে।
প্রায় ছ’ফুট লম্বা, পেশিবহুল চেহারা। সরু গোঁফ, পাতলা ঠোঁট। নাকটা একটু থ্যাবড়া। গাল বেয়ে লম্বা জুলপি। অনুসন্ধানী চঞ্চল দু-চোখ। সারা মুখে একটা কাঠিন্য।
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওপরের বর্ণনাটা আমার প্রতিবিম্বিত চেহারার বর্ণনা, কিন্তু তার অন্তত পঞ্চাশ পার্সেন্ট ছদ্মবেশ! যেমন ওই গোঁফ, জুলপি, এলিভেটর স্যু, প্লাস্টিসিনের নাক—সবই ছদ্মবেশ। এত ধৈর্য, পরিশ্রমের কারণ একটাই—সতর্কতা।
হঠাৎই অন্যমনস্কভাবে বাঁ-হাত দিয়ে বাঁ-কানের লতিটা চুলকোতে লাগলাম। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম। আবার! কড়া বকুনি দিলাম নিজেকে। আবার সেই মুদ্রাদোষ! বৎস সুধীর নায়েক, এখন হইতেই সাবধান হও। তুমি তো জানো, তোমার ন্যায় এইরূপ কত হতভাগ্য এই সামান্য মুদ্রাদোষের নিমিত্ত শত্রুপক্ষের কবলিত হইয়াছে!
বাঁ-হাতকে বশে ফিরিয়ে আনলাম। মুদ্রাদোষে! হাসলাম, কিন্তু হাসলে কী হবে, এই মুদ্রাদোষের জন্যে আমাদের দলের তিনজন এক্সিকিউশনার এর আগে শত্রুপক্ষের হাতে মারা গেছে। কুণাল যোশী, সোহনলাল শুক্লা এবং সখারাম বক্সী।
কুণালের একটা বদখত মুদ্রাদোষ ছিল, সবসময় টাইয়ের নট ঠিক করে জামার কলারে হাত বোলানো। ব্যস! ওর সম্বন্ধে প্রতিটি গুপ্তদল যে-‘ডোসিয়ার’ রাখত, তাতে লেখা হয়ে গেল, কুণাল যোশী, বয়েস বত্রিশ বছর, চেহারা…এবং একেবারে শেষে—বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত ব্যক্তির এক বিচিত্র মুদ্রাদোষ আছে। তা হল…।
এইভাবে নিজের মৃত্যু-পরোয়ানায় নিজে সই করেছিল কুণাল। এক সুপরিকল্পিত নিখুঁত দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে কুণাল স্বর্গের সিঁড়িতে পা রেখেছিল।
তারপর সোহনলাল শুক্লা। বেচারা সোহনলালের এক অদ্ভুত মুদ্রাদোষ ছিল। সবসমসয়ই দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরত। ও নিজেও সম্ভবত জানতে পারেনি, ওই কালান্তক মুদ্রাদোষের কথা। সুতরাং যেখানে যে ছদ্মবেশেই যাক না কেন, ওকে চিনে নিতে শত্রুপক্ষের কোনও অসুবিধেই হয়নি। তারপর যা ঘটে থাকে, তাই হয়েছে। এক অনির্বচনীয় বিস্ময়কর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল সোহনলাল।
আর সখারাম বক্সী একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল এই বসুন্ধরা থেকে। অপরাধের মধ্যে ওর একটা চোখ—ডানচোখ ছিল পাথরের। তাই ও সবসময় কালো চশমা পরে থাকত আর সেটাকে সর্বক্ষণ হাত দিয়ে অ্যাডজাস্ট করত। তারপর কীভাবে বাকি ঘটনা ঘটেছিল, তা বলতে পারি না। তবে সখারাম এক বিয়োগান্ত নাটকের প্রধান বিয়োগান্ত চরিত্রে পরিণত হয়েছিল।
এতসব ভাবনার পর একটু চিন্তিত হলাম। তা হলে কি ওই বালতির পতনজনিত দুর্ঘটনাটা সুপরিকল্পিত? কেউ কি জেনে ফেলেছে আমার আসল পরিচয়? ভাবতে-ভাবতে নিজের অজান্তেই বাঁ-হাত এগিয়ে গেল কানের দিকে।
সুধীর! মাঝপথেই সতর্ক হয়ে হাতকে ফিরিয়ে আনলাম। আবার সেই ভুল! জাহাজে ওঠার পর থেকে এভাবে ক’বার কান চুলকেছি কে জানে। তবে আমার এই মুদ্রাদোষ কুণাল, সখারাম বা সোহনলালের মতো অতটা বিপজ্জনক নয়। কিন্তু তবুও সাবধান হওয়া প্রয়োজন।
এইরকম ভয়ংকর মুদ্রাদোষসম্পন্ন আর-একজন গুণী ব্যক্তি আছেন। এ লাইনে তাঁকে সবাই গুরুদেব বললেও সাক্ষাৎ পরিচয় প্রায় কারও নেই। তিনি কখন, কোথায়, কী বেশে থাকেন তা না জানলেও তাঁর মুদ্রাদোষ তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দেয়। তাঁর এক অদ্ভুত স্বভাব আছে, সেটা হল—দেশলাইয়ের বাক্সে বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে সমান্তরালভাবে তিনি আঁচড় কাটেন। এই মিস্টার এক্সই (এক্সই বলব, কারণ তাঁর সম্বন্ধে কোনও দলের কাছেই কোনও গোপন ফাইল নেই) নাকি কুণাল, সোহনলাল ও সখারামের বিয়োগান্ত নাটকের পরিচালক। এবং ‘অপারেশান’ নামক গুপ্তসমিতির প্রযোজক। সেই সময়ে (এবং সর্বদাই) ওরা আমাদের এক শত্রুরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করছিল।
যা হোক, এই এক্স-এর পেছনে যদি দল আমাকে পাঠাত, তবে আর দেখতে হত না। ছ’-মাসই কাজ সেরে ফেলতাম। দেখিয়ে দিতাম, ‘সুধীর নায়েক ইজ সুধীর নায়েক!’
আবার আবিষ্কার করলাম, আমার বাঁ-হাত আমার কান চুলকোচ্ছে। শালা! রাগে, বিরক্তিতে নিজের কান নিজেই বেশ করে মুলে দিলাম। আবার সেই মুদ্রাদোষ! তবে আর ছদ্মবেশের দরকার কী? বুকে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হয়, দেখুন আপনারা, এই অধমই সুধীর নায়েক। ‘অ্যাসাসিন’ গুপ্তদলের এক্সিকিউশনার! না, এই নাছোড়বান্দা মুদ্রাদোষ আমাকে ছাড়বে না! শত্রুপক্ষের কোনও লোক এই মুদ্রাদোষ লক্ষ করেই হয়তো চিনে ফেলবে নোটন আম্বাস্তার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সুধীর নায়েককে।
হঠাৎ ঘণ্টি বেজে উঠতেই হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে ন’টা। সম্ভবত ডিনারের জন্যেই এই ঘণ্টির সংকেত। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে কেবিনের আলো নিভিয়ে পা বাড়ালাম খাবার ঘরের দিকে। সেখানে গিয়েই আবার দেখব রণেন বর্মাকে। দেখি, পারলে দু-চারটে কথা বলে একটু বাজিয়ে নেব। মানে, মারার আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি একটু আলাপ করতে চাই।
দ্বিতীয় দুর্ঘটনা
উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ডাইনিং রুমে ঢুকতেই প্রত্যেকটি স্ত্রী-পুরুষ মুখ ফিরিয়ে তাকাল আমার দিকে (সুধীর নায়েক যে হ্যান্ডসাম স্মার্ট যুবক, সে-কথা আপনারা দয়া করে ভুলে যাবেন না, প্লিজ!)। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আমার বাঁ-দিকে এক মোটকা ভদ্রমহিলা আর ডানদিকে একজন অল্পবয়েসি মেয়ে।
মেয়েটির দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসলাম, তারপর তাকালাম খাবার প্লেটের দিকে। খাওয়াটা যদিও আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, তবু ওটা অভিনয়ের অংশ বলে প্লেটের দিকে ঝুঁকে পড়লাম।
হঠাৎ চোখ পড়ল জলের গ্লাসে—সেখানে টলটলে স্বচ্ছ জলের ওপর ভাসছে একটা মুখের প্রতিবিম্ব। চমকে চোখ তুলে তাকালাম। বোকা-বোকা চাউনি নিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন রণেন বর্মা।
চোখাচোখি হতেই বর্মাসাহেব কান এঁটো করে হাসলেন: ‘ভালো আছেন?’
প্রত্যুত্তরে হেসে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, ভালোই আছি (অবশ্য বালতির ব্যাপারটা বাদ দিলে)। তা আপনি কদ্দূর যাচ্ছেন? (এ ছাড়া আর কীই-বা ছাই জিগ্যেস করব?)
‘কোচিন। আপনি?’ প্রশ্নটা করেই রণেন বর্মা অভদ্রের মতো খেতে শুরু করলেন।
‘আমিও।’
এই বেঁটেখাটো লোকটাকে খুন করতে হবে ভেবে দুঃখ হল। কিন্তু উপায় কী? চিফ নিজের মুখেই বলেছেন, এই রণেন বর্মা লোকটি নাকি আমাদের ‘অ্যাসাসিন’ দলের পথে এক বিপজ্জনক কাঁটা। সুতরাং এই কাঁটা তোলার ভার চিফ আমার হাতেই তুলে দিয়েছেন। এবং একটি বিশেষ স্বাভাবিক দুর্ঘটনার সাহায্যে এই রণেন বর্মাকে মাইনাস করতে হবে।
আমি সাধারণত অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সহজ দুর্ঘটনার সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করি। যেমন ট্রেনে হলে, এই রণেন বর্মা ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে (অবশ্য তাঁকে একটা সামান্য ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করতে হত!) মারা যেতেন। এবং এক্ষেত্রে যেহেতু তিনি জাহাজে আছেন, সুতরাং তাঁকে ডেকের রেলিং টপকে সমুদ্রের জলে পড়তেই হবে।
এবার এই উপরোক্ত জলে পড়ার দুর্ঘটনা ঘটানোর তিনটে উপায় আমার হাতে আছে। এক: ভদ্রলোক যখন একা ডেকের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, তখন আচমকা এক কারাটের প্যাঁচে তাঁকে রেলিং টপকাতে সাহায্য করা।
দুই: তাঁর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে, কথা বলতে-বলতে হঠাৎ ধাক্কা দেওয়া।
আর সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তিন নম্বর উপায় হল, মাঝরাতে রণেন বর্মার ঘরে ঢুকে তাঁকে একটা মরফিয়া ইনজেকশান দেওয়া এবং অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে টেনে এনে জলে ফেলে দেওয়া।
এই তিন নম্বর উপায়টা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে হল একটি মাত্র কারণে। তা হল, রণেন বর্মার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা কারও চোখে পড়বে না। আর সেটা যত কম চোখে পড়ে ততই ভালো।
এসব কথা ভাবছি, হঠাৎ পায়ে কীসের ছোঁওয়া পেয়ে আঁতকে লাফিয়ে উঠলাম।
‘কী হল—কী হল?’ বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়লেন মোটকা মহিলাটি।
কী যে হল, সেটা দেখতে টেবলক্লথটা সরিয়ে টেবিলের নীচে উঁকি মারলাম। ডাইনিং হলের অন্যান্য যাত্রী তখন মাঝপথে খাওয়া থামিয়ে উৎসুক হয়ে আমার ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে আছেন। রণেন বর্মাও তার ব্যতিক্রম নন।
টেবিলের নীচ থেকে একটা মোটাসোটা কালো বেড়াল বেরিয়ে এল। ডাকতে লাগল ‘ম্যাঁও-ম্যাঁও’ করে। তাই দেখে ঘরের সবাই তো হো-হো করে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল।
আমতা-আমতা করে কাষ্ঠহাসি হাসতে চেষ্টা করছি, একজন বেয়ারা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। কানে-কানে বলল, ‘স্যার, ক্যাপ্টেনসাহেব আপনাকে একবার ডাকছেন। যদি একমিনিট সময় করে একটু আসেন—।’
খাওয়ার টেবিল ছেড়ে (খাওয়া তখনও শুরুই করতে পারিনি, এমনই দুর্ভাগ্য!) বেয়ারাটির পেছন-পেছন ডাইনিং হল ছেড়ে বেরোলাম। আন্দাজ করলাম, ক্যাপ্টেনসাহেব হয়তো সেই বালতিজনিত দুর্ঘটনার ব্যাপারটা একটু বিশদভাবে জানতে চান। দেখা যাক!
ক্যাপ্টেনের ঘরে পৌঁছে দেখি, তিনি পেছনে হাত রেখে গম্ভীরভাবে পায়চারি করছেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘মিস্টার আম্বাস্তা?
বেয়ারাটি আমাকে ছেড়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে ক্যাপ্টেনের প্রশ্নের জবাব দিলাম, ‘ইয়েস, আই অ্যাম নোটন আম্বাস্তা। হোয়াটস দ্য ম্যাটার?’
‘আসুন—বসুন।’ ইঙ্গিতে একটা চেয়ার নির্দেশ করলেন ক্যাপ্টেন। তারপর নিজেও একটা চেয়ারে বসলেন।
‘মিস্টার আম্বাস্তা, আপনার সেই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা আমি একটু ডিটেইলসে শুনতে চাই।’
‘ওহ, ও কিছু নয়।’ ক্যাপ্টেনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কারণ, ওই দুর্ঘটনাটা নিয়ে যত কম আলোচনা হয়, ততই ভালো।
‘মিস্টার আম্বাস্তা, আপনি ভুলে যাচ্ছেন, ওই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে আমারই জাহাজে। সুতরাং ব্যাপারটা আমার জানা দরকার।’ ক্যাপ্টেনকে বেশ উত্তেজিত মনে হল।
অতএব আর দ্বিরুক্তি না করে ঘটনাটা তাঁকে আনুপূর্বিক জানালাম।
সব শোনার পর তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে বসে রইলেন। অবশেষে একসময় মুখ খুললেন, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন যে, এই জাহাজে আপনার কোনও শত্রু আছে? এমন কেউ, যে আপনাকে খুন করতে চায়?’
হঠাৎ এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটা ভাবতে শুরু করলাম। শত্রু? কিন্তু আমি যে এই জাহাজে করে যাব, সে-কথা তো আমার দল ছাড়া…আচমকা এক কাচের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল আমার হৃৎপিণ্ড। তা হলে কি ‘অ্যাসাসিন’ চাইছে আমাকে সরিয়ে দিতে? কিন্তু ওদের সঙ্গে তো কোনও বিশ্বাসঘাতকতা আমি করিনি!
মনকে বারংবার স্তোক দিয়ে ক্যাপ্টেনকে সবিস্ময়ে এবং সবিনয়ে জানালাম, ‘এ আপনি কী বলছেন, মিস্টার ক্যাপ্টেন? না, না,—কে আমাকে খুন করতে চাইবে? আর কেনই-বা চাইবে? ওটা নেহাতই অ্যাক্সিডেন্ট, ক্যাপ্টেন। হয়তো কোনও বালতি ওপরে রাখা ছিল, জাহাজের দোলানিতে হঠাৎ নীচে পড়ে গেছে।’
কিন্তু এত সব বললে কী হবে, ক্যাপ্টেন ছাড়লেন না। আমাকে নিয়ে অকুস্থল পরিদর্শন করলেন। নানান উপদেশ দিলেন। এমনি করে প্রায় আধঘণ্টা পর তাঁর হাত থেকে মুক্তি পেলাম। খিদেয় তখন পেট চোঁ-চোঁ করছে। তাই আর দেরি না করে খাবার ঘরের দিকে এগোলাম।
খাবার ঘরে পা দিয়েই যে-বিচিত্র দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম, তাতে ঘরটাকে খাবার ঘর না বলে পাগলাগারদ বলাই বোধহয় ঠিক হবে। কারণ, ঘরের প্রায় প্রতিটি যাত্রী এখন সার বেঁধে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখগুলো বোধ হয় ঠিকরে গিয়ে পড়বে টেবিলের ওপরে। যেখানে সাজানো খাবারের প্লেট এবং সেই কালো বেড়ালটা। হ্যাঁ, সেই কালো বেড়ালটা টান-টান হয়ে টেবিলের ওপরে পড়ে আছে। আর, আমার প্লেটের খাবার কিছুটা টেবিলে ছড়ানো।
‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার?’ দরজার কাছে কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বেয়ারাকে প্রশ্ন করলাম, ‘ব্যাপার কী?’
এমন সময় হেলতে-দুলতে এগিয়ে এলেন সেই মোটকা মহিলাটি ‘মিস্টার আম্বাস্তা, মিস্টার আম্বাস্তা…ওঃ, হরিবল!’
‘কী হয়েছে? মনে হচ্ছে, আপনারা যেন ভয় পেয়েছেন?’
মিহি গলায় আমার ডানপাশ থেকে উত্তর ভেসে এল, ‘কালো বেড়ালটা মরে গেছে। আপনার প্লেটে মুখ দিয়েই মরে গেছে!’
ঘাড় ফেরাতেই চোখ পড়ল রণেন বর্মার কাঁচুমাচু মুখের ওপর। তিনি ঘনঘন ঢোক গিলছেন আর চোখ পিটপিট করছেন।
‘আমার আর কী দোষ, বলুন? বেড়ালটা খাওয়ার জন্যে চেয়ারের ওপর উঠল। আমি ভাবলাম, একটু দিই। দিতে যাচ্ছি, অমনি বেড়ালটা প্লেটের ওপর হুমড়ি খেয়ে লাফিয়ে পড়ল। আর খাবার মুখে দিয়েই ছটফট করে মরে গেল।’
ভদ্রমহিলার কথা পুরোপুরি আমার কানে গেল না। চোখে যেন ঝাপসা দেখতে লাগলাম। হাঁটুজোড়া বিদ্রোহ করে অবশ হয়ে এল। মাথার ভেতর আছড়ে পড়ছে সন্দেহের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ।
দুর্ঘটনা?
হয়তো তাই। ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ দিতে হবে যে, তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নয়তো ওই বেড়ালটার জায়গায় পড়ে থাকত এই সুধীর নায়েক।
এদিকে কখন যে ক্যাপ্টেন, জাহাজের ডাক্তার এবং মেট এসে উপস্থিত হয়েছেন, খেয়ালই করিনি। বোধহয় কোনও বেয়ারা গিয়ে তাঁদের খবর দিয়েছে। ডাক্তার তাঁর হাড়জিরজিরে চেহারা নিয়ে আমার প্লেটের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। কিছুক্ষণ শোঁকাশুঁকি করে, আঙুল জিভে ঠেকিয়ে, ক্যাপ্টেনের কানে-কানে কী যেন বললেন, তারপর তাঁরা তিনজনেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় ক্যাপ্টেন আমার পাশে থমকে দাঁড়ালেন ‘মিস্টার আম্বাস্তা, প্লিজ, কাম উইথ আস। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’
চটপট ক্যাপ্টেনকে অনুসরণ করলাম।
ডেকের ওপর এসে পৌঁছতেই ক্যাপ্টেন আমাকে আগের মতোই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুললেন। কোনওরকমে ভাসা-ভাসা ভাবে তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলাম। শেষে তিনি বললেন, ইঁদুর মারার জন্যে জাহাজের স্টোরে আর্সেনিক রাখা হয়। সেখান থেকেই কীভাবে যেন আমার প্লেটে আর্সেনিক পড়ে গেছে। রাঁধুনি এবং বেয়ারাদের অসাবধানতার জন্যে তিনি তাদের নিশ্চয়ই সতর্ক করে দেবেন। বিশেষ করে আমার মতো একজন সম্ভ্রান্ত যাত্রীর পক্ষে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেন জানি না মনে হল, এই ঘটিত দুর্ঘটনাগুলো যেন বড় বেশি স্বাভাবিক। তা হলে কি…কিন্তু চিফ তো আমাকে বিশ্বাসী বলেই মনে করেন। একই প্রশ্নের বৃত্তে ঘুরতে লাগল আমার মন। অশান্ত মন।
তৃতীয় দুর্ঘটনা
খাওয়াদাওয়া সেরে (ক্যাপ্টেনের অনুরোধে এবং নিজের প্রকৃত মনোভাব গোপন রাখার জন্যে বেয়ারার এগিয়ে দেওয়া দ্বিতীয় খাবারের প্লেট সানন্দেই গ্রহণ করেছি)। কেবিনে ফিরে এলাম। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার আগের ব্যবস্থা নিলাম। অর্থাৎ, সুটকেসটাকে অ্যাডেসিভ টেপ দিয়ে দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে আটকে দিলাম। তারপর এগিয়ে গিয়ে বেসিনের তলায় হাত চালালাম। কারণ, দুর্ঘটনা যখন এত ঘনঘন ঘটছে, তখন সাবধান থাকা ভালো।
কিন্তু বেসিনের তলায় হাত ঠেকতেই তড়িৎপৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম। এ কী! অ্যাডেসিভ টেপ ঠিকই লাগানো আছে, কিন্তু আমার লুগারটা বেসিনের গায়ে আর লাগানো নেই! জনৈক পরোপকারী ব্যক্তি আমাকে সামান্য কৃপা করেছেন।
কী করব ভেবে না পেয়ে শোওয়ার ব্যবস্থা করলাম। ক্রমশ আমি যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। আমার নিরাপত্তার প্রাচীর ক্রমেই যেন বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া মাটির ঢিবির মতো গলে যাচ্ছে। মনে সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ঠিক করলাম, আমার যা-ই ঘটে ঘটুক, তবু মরার আগে সুধীর নায়েক তার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট সম্পূর্ণ করে যাবে!
ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কেবিনের পোর্টহোল দিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দে সামুদ্রিক বাতাস বয়ে আসছে। চাঁদের আলো ঘরের মেঝেতে সৃষ্টি করেছে এক রুপোলি বৃত্ত। গায়ের ওপর কম্বল টেনে দিলাম।
সামান্য তন্দ্রা মতো এসেছে, হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার গায়ের কম্বল এবং গেঞ্জির মাঝে একটা স্তর যেন ধীরে-ধীরে নড়ে বেড়াচ্ছে। আমার কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগছে।
খুব হালকা চালে অজানা জিনিসটা এগিয়ে আসতে লাগল আমার বুকের দিকে। কম্বলটা সেই জায়গাটায় সামান্য উঁচু হয়ে নড়তে লাগল।
ভয়ে কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম। বুঝলাম, ভুলক্রমে কম্বলসমেত এক অজানা প্রাণীকে গায়ের ওপর চাপা দিয়ে ফেলছি। কী ওটা? সাপ?
শুয়ে-শুয়ে ঘামতে শুরু করলাম। নিজের স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা একেবারে হারিয়ে ফেললাম। নড়তে সাহস পাচ্ছি না, যদি আচমকা কিছু ঘটে যায়, তা হলে?
হঠাৎ মরিয়া হয়ে এক ঝটকায় লাফিয়ে মেঝেতে নামলাম। কম্বল-টম্বল সব ছিটকে পড়ল মেঝেতে। একছুটে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে অন করে দিলাম আলোর সুইচ।
দেখি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে আমার হাতের পাঞ্জার মাপের এক টারান্টুলা মাকড়সা। একপাটি জুতো দিয়ে পিটিয়ে ওটাকে শেষ করলাম। ওটার লোমশ কালো দেহ মাটির সঙ্গে থেঁতলে গেল।
অন্ধ ক্রোধে আমি উন্মাদ হয়ে উঠলাম। প্রথম বালতি, তারপর আর্সেনিক, রিভলভার চুরি, অবশেষে এই মাকড়সা। ওফ, দিস ইজ টু মাচ।
চটপট জামাটা গায়ে চড়িয়ে চটিটা পায়ে গলালাম। তারপর সুটকেস সরিয়ে দরজা খুলে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাপ্টেনের ঘরে ঢুকেই রাগে ফেটে পড়লাম: ‘নাউ লুক, মিস্টার ক্যাপ্টেন, দিস ইজ টু মাচ!’
ক্যাপ্টেন বসে-বসে ঢুলছিলেন। চকিতে সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘কী—কী হয়েছে, মিস্টার আম্বাস্তা?’
ক্যাপ্টেনকে সংক্ষেপে মাকড়সার ব্যাপারটা জানালাম (রিভলভার প্রসঙ্গের উল্লেখ করব, এমন বোকা আমি নয়)। সব শুনে তিনি দুঃখিতভাবে কয়েকবার মাথা নাড়লেন: ‘ব্যাপারটা কী জানেন? আমাদের স্টোরে প্রচুর পাকা কলা রাখা আছে। আর তারই লোভে সব মাকড়সা এসে ভিড় করে। সেখান থেকেই একটা হয়তো কোনওরকমে…।’
‘ইউ মিন দিস ইজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট?’ টেবিলের ওপরে সশব্দে এক চাপড় কষিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
‘সার্টেইনলি।’ বিস্ময়ে ভুরু উঁচিয়ে তাকালেন তিনি ‘হোয়াই ডোন্ট ইউ থিঙ্ক সো?’
চিৎকার করে একটা বিশ্রী জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সময়মতো নিজেকে সংযত করলাম। ভেবে দেখলাম, টেবিল চাপড়ে বা চিৎকার করে এর কোনও সমাধান হবে না। সুতরাং ঠান্ডা গলায় জবাব দিলাম, ‘ইউ আর রাইট, ক্যাপ্টেন। ব্যাপারটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না।’
ক্যাপ্টেন আমার জন্যে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। ক্যাবিনেট থেকে হুইস্কির বোতল বের করে আমাকে আহ্বান জানালেন।
কিছু সাধারণ গাল-গল্প এবং দু-পেগ হুইস্কি শেষ করে যখন আমি উঠে দাঁড়ালাম, তখন রাত দেড়টা। জড়ানো গলায় ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
বাইরের ডেকে আসতেই এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আমার বুক আনন্দে নেচে উঠল। অন্ধকার ডেকের এককোনায় রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীরণেন বর্মা। মরা চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ডেকের ওপর। আর সেই সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটা। ডেক জনশূন্য, অর্থাৎ নিশ্চিন্ত হয়ে এগোনো যাবে। ক্যাপ্টেন যখন তিন-তিনটে দুর্ঘটনা দেখেছেন, তখন আরও একটা দুর্ঘটনা তাঁকে আমি দেখাতে চাই।
নিঃশব্দ হিংস্র হাসিতে মুখ ভরিয়ে পা টিপে-টিপে রণেন বর্মার দিকে এগোলাম। এরকম সুবর্ণসুযোগ আর হয়তো পাব না।
প্রথমে ধীরে ধীরে…তারপর জোরে…আরও জোরে…শেষে উল্কাগতিতে ছুটে চললাম রণেন বর্মাকে লক্ষ্য করে। চটি খুলে ফেলে দিয়েছি ডেকের ওপর—যাতে কোনওরকম শব্দ না হয়।
তাঁর দশ গজের মধ্যে পৌঁছে আরও হিংস্র হল আমার হাসি। পা দুটো ছুটে চলল আরও জোরে…আরও জোরে…অনুভব করলাম, আমি রণেন বর্মাকে লক্ষ্য করে পাগলের মতো দৌড়চ্ছি…দৌড়চ্ছি…।
চরম দুর্ঘটনা
‘না, না, আপনার কোনও দোষই নেই। কোনও দোষ আপনাকে আমরা দিচ্ছি না।’ কথা বলতে-বলতে একগ্লাস হুইস্কি রণেন বর্মার দিকে এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন ‘নিন, এটা খেয়ে নিন। যা মেন্টাল স্ট্রেন গেছে আপনার।’
‘থ্যা—থ্যাঙ্ক ইউ।’ মিহি গলায় জবাব দিলেন রণেন বর্মা। দু-চার ঢোকেই শেষ করে ফেললেন হুইস্কিটুকু। তারপর চোখ বড়-বড় করে বলতে লাগলেন, ‘আমার ঘুম আসছিল না বলে বাইরে ডেকে এককোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ একটা ঘুমের আমেজ এসেছিল। হঠাৎ দেখি মিস্টার আম্বাস্তা, তাই তো নাম ছিল ভদ্রলোকের, (ক্যাপ্টেন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন) আমার দিকে পাগলের মতো ছুটে আসছেন। হাতদুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে তিনি আমাকে লক্ষ্য করেই যেন দৌড়ে আসছেন। অন্ধকারে তার সাদা দাঁতের সারি ঝকঝক করছে। সারা মুখে কেমন একটা হিংস্র ভাব। আমি—আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আর—আর- একগ্লাস হুইস্কি…ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড—
ক্যাপ্টেন বিনা বাক্যব্যয়ে হুইস্কি আর জল দিয়ে তাঁর গেলাস ভরতি করে দিলেন।
‘ধ—ধন্যবাদ। আমি ভয় পেয়ে একলাফে পাশে সরে গেলাম। আর ভদ্রলোক সোজা ডেকের রেলিঙে ধাক্কা খেয়ে এক ডিগবাজিতে জাহাজের বাইরে চলে গেলেন। ঠিক যেন ভূতে পাওয়া লোকের মতো মিস্টার আম্বাস্তা দৌড়ে আসছিলেন। তিনি বাইরে জলে পড়ে যেতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম। তারপর…।’
‘হ্যাঁ, তারপর তো আমরা সবই জানি।’ গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন, ‘অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ভদ্রলোককে আর উদ্ধার করা গেল না। এ স্যাড বিজনেস। তবে কী জানেন মিস্টার বর্মা, ভদ্রলোকের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে একটা অ্যালার্জি ছিল। এই চরম অ্যাক্সিডেন্টটার আগে আরও তিনবার তিনি অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে আমাদের কাছে রিপোর্ট করেছিলেন। আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য!’
আপনমনেই নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলেন রণেন বর্মা। তারপর দু-পকেট হাতড়ে সম্ভবত দেশলাই খুঁজলেন। শেষে কাঁচুমাচু মুখ করে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকালেন, ‘দে—দেশলাই আছে আপনার কাছে?’
‘হ্যাঁ, এই নিন।’ টেবিলের ওপর খট করে দেশলাইয়ের বাক্সটা ছুড়ে দিলেন ক্যাপ্টেন:’আপনাকে বড্ড আপসেট দেখাচ্ছে, মিস্টার বর্মা। যান, রাত তো অনেক হল—শুয়ে পড়ুন গিয়ে। আপনার দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাহায্যের জন্যে চিৎকার ছাড়া আর কী-ই-বা আপনি করতে পারতেন? আর আপনি ডেকেছিলেন বলেই তবু খোঁজাখুঁজি করা সম্ভব হয়েছে। নয়তো ওটুকুও কি আমরা করতে পারতাম? হয়তো কিছু জানতেই পারতাম না।’ সহানুভূতিতে কোমল হল ক্যাপ্টেনের স্বর।
‘ধ—ধন্যবাদ।’ ফস করে দেশলাই জ্বেলে কাঁপা হাতে সিগারেট ধরালেন রণেন বর্মা। পোড়া কাঠিটা ফেলে দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর দেশলাইয়ের বাক্সে বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে সমান্তরালভাবে আঁচড় কাটতে-কাটতে বললেন, ‘জানেন ক্যাপ্টেন, এই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারগুলো আমাকে ভীষণ আপসেট করে। অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনলেই আমার ভীষণ ভয় করে। বিশ্বাস করুন…সত্যি বলছি…।’