আরে ! মুখুজ্যে মশাই যে ! নমস্কার, কী খবর ?
আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত |
তা বেশ | কিন্তু দেখো মুখুজ্যে,
আমার এই ডানদিকটাকে বাঁদিক
আর বাঁদিকটাকে ডানদিক ক’রে
আয়নায় এভাবে ঘুড়িয়ে দেওয়া—
আমি ঠিক পছন্দ করি না |
তার চেয়ে এসো, চেয়ারটা টেনে নিয়ে
জানলায় পা তুলে বসি |
এককাপ চায়ে আর কতটা সময়ই বা যাবে ?
দেশলাই ? আছে |
ফুঃ, এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে |
তোমার কপালে আর করে খাওয়া হল না দেখছি |
বুঝলে মুখুজ্যে, জীবনে কিছুই কিছু নয়
যদি কৃতকার্য না হলে |
২
আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ—
ঢালবে |
কিন্তু ভয়ের কিছু নেই
যুদ্ধ না হওয়ার দিকে |
আমাদের মুঠোয় আকাশ;
চাঁদ হাতে এসে যাবে |
ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির,
অন্ধকারের চেয়ে আলোর দিকেই
পাল্লা ভারী হচ্ছে |
ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালোবাসা |
পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে—
দেখো, আফ্রিকার কোলে
সাত রাজার ধন এক মানিক
স্বাধীনতা |
পাজির পা-ঝাড়াদের আগে যারা কুর্নিশ করত
এখন তারা পিস্তল ভরছে |
শুধু ভাঙা শেকলগুলো এক জায়গায় জুটে
এই দিনকে রাত করবার কড়ারে
ডলারে ফলার পাকাবার
ষড়যন্ত্র আঁটছে |
পুরনো মানচিত্রে আর চলবে না হে,
ভূগোল নতুন ক’রে শিখতে হবে |
আর চেয়ে দেখো,
এক অমোঘ নিয়মের লাগাম-পরা
ঘটনার গতি
পাঁজির পাতায় রাজজ্যোতিষীদের
দৈনিক বেইজ্জত করছে |
ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা |
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয় |
পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে সাজাতে
ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শোনো,
ক্রুশ্চেভের গলায় |
নির্বিবাদে নয়, বিনা গৃহযুদ্ধে
এ মাটিতে
সমাজতন্ত্র দখল নেবে |
হয়তো একটু বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে
কিন্তু যখন হবে
তখন খাতা খুলে দেখে নিও
অক্ষরে অক্ষরে সব মিলে যাচ্ছে |
৩
দেখো মুখুজ্যে, মাঝে মাঝে আমার ভয় করে
যখন অমন সুন্দর বাইরেটা
আমার এই আগোছালো ঘরে হারিয়ে যায় |
যখন দেখি ঠিক আমারই মতন দেখতে
আমার দেশের কোনো ভাই
উলিডুলি ছেঁড়া কাপড়ে
আমাকে কাঁদাতে পারবে না জেনেও
বলে বলে দুঃখের কথাগুলোতে ঘাঁটা পড়ায়–
আমার লজ্জা করে |
পাঞ্চেতের এক সাঁওতাল কুলি দেখতে দেখতে
ওস্তাদ ঝালাইমিস্ত্রি হয়েছিল—
এখন আবার তাকে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে পেটভাতায়
পরের জমিতে আদ্যিকালের লাঙল ঠেলতে হচ্ছে |
এক জায়গায় রুগী ডাক্তার অভাবে মরছে,
অন্য জায়গায় ডাক্তার রুগী অভাবে মরছে |
কেন হয়?
কেন হবে ?
আমি দেখে এসেছি নদীর ঘাড় ধ’রে
আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ—
ভালো কথা |
কলে তৈরি হচ্ছে বড় বড় রেলের ইঞ্জিন—
খুব ভালো
মশা মাছি সাপ বাঘ তাড়িয়ে
ইস্পাতের শহর বসেছে—
আমরা সত্যিই খুশি হচ্ছি |
কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি—
যার হাত আছে তার কাজ নেই,
যার কাজ আছে তার ভাত নেই,
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই |
তবু যদি একটু পালিশ থাকত |
তা নয়,
মুচির দোকানের লাশে-চড়ানো জুতোর মতো
মাথার ওপর ঝুলছে |
গদিতে ওঠবস করাচ্ছে
টাকার থলি |
বন্ধ মুখগুলো খুলে দিতে হবে
হাতে হাতে ঝনঝন করে ফিরুক |
বুঝলে মুখুজ্যে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না
আড় হয়ে লাগতে হবে |
৪
যারা হটাবে
তারা এখনও তৈরি নয় |
মাথায় একরাশ বইয়ের পোকা
কিলবিল করছে :
চোখ খুলে তাকাবার
মন খুলে বলবার
হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবার—
মুখুজ্যে, তোমার সাহস নেই |
আগুনের আঁচ নিভে আসছে
তাকে খুঁচিয়ে গনগনে করে তোলো |
উঁচু থেকে যদি না হয়
নীচে থেকে করো |
সহযোদ্ধার প্রতি যে ভালোবাসা একদিন ছিল
আবার তাকে ফিরিয়ে আনো,
যে চক্রান্ত
ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে
তাকে নখের ডগায় রেখে
পট্ করে একটা শব্দ তোলো ||
দরজা খুলে দাও,
লোকে ভেতরে আসুক |
মুখুজ্যে, তুমি লেখো ||