মিহিকার জন্মদিন
সবাই দাড়িটা কামিয়ে ফেলতে বলছে।
চাকরি করার সময়ে যখন অফিসের কাজে মুম্বাই থেকে সময়ে-অসময়ে পশ্চিমবঙ্গে যাতায়াত শুরু করলুম, তখন দাড়ি ছিল না। চাষি-তাঁতি-জেলেদের হাল ফেরাবার জন্যে কী-কী করা যায়, সে-সব খোঁজখবর নিতে তাদের কাছেকিছু জানতে চাইলে, বাংলাতেই জানতে চাইতুম, জবাব পাওয়া যেত না ঠিক মতন। জ্ঞান যোগাড় করব, তা নয় একেবারে বোকচন্দর হয়ে ফিরতুম।
অফিসে হাই-আমলারা সবাই খাপ্পা। সুব্র্হ্মনিয়াম তামিল হবে তথ্য যোগাড় করছে, তারাপুরকর মারাঠি হয়ে সঠিক প্রতিবেদন বানাচ্ছে, খান্না পাঞ্জাবি হয়ে চাষআবাদের খাঁটি খবর আনছে, আর আমি বাঙালি হয়ে বাঙালিদের কাছ থেকে ঠিকমতন ব্যাপার-স্যাপার জেনে আসতে পারছি না। আমার নিজের বাপ-চোদ্দোপুরুষের সাকিন, অধচ সেখানেই গাড্ডুস মারছি। অন্য রাজ্যগুলোয় যখন যাই, সেখানে তো লোকে দিব্বি আমার হিন্দি-ইংরেজি খিচুড়ি বুঝে যায় আর হাত-পা নেড়ে, অঙ্গভঙ্গী করে, হাফহিন্দি-হাফমাতৃভাষায় যা-যা- বলে, প্যাডে টুকে নিয়ে যখন রিপোর্ট জমা দিই, ঞ্যানেজিং ডায়রেক্টর আগেকার কালের ব্রাহ্মণদের মতন সাধু সাধু বলে শাবাশি দ্যান। অবশ্য, ইংরেজিতে।
পশ্চিমবঙ্গের অ্যাসাইনমেন্ট পেলে তাই এড়িয়ে যাই। যদিও পশ্চিমবাংলায় থাকা-খাওয়া সস্তা বলে টিএ-ডিএ থেকে অনেক টাকা বাঁচিয়ে আনা যায়। কিন্তু কী আর করা। অপদার্থের বদনাম থেকে পদার্থের লোকসান সোয়াটা বেটার।
—-বাঙালিরা বোধয় তোমায় বিলিভ করে না। বলেছিল সুবিমল, মানে সুবিমল বসাক, ও বছর তিরিশেক আছে পশ্চিমবঙ্গে, ঘুলেমিলে গেছে।
—-আরে দিনাজপুরে আর মুর্শিদাবাদের গ্রাম তো দেখেছি বিহারি-অধ্যুষিত। যখন পার্টির কাজ করতুম, ওসব অঞ্চলে অনেক ঘুরেছি। আপনি ওসব জায়গায় ট্যুর নিচ্ছেন না কেন? বিশ্বজিত সেন উপদেশ দিয়েছিল।
বিশ্বজিত কম্যুনিস্ট বলে সুবিধা করতে পেরেছিল। আমার তো কোনো ইষ্ট নেই।
ঠাকুমা ছোটবেলায় বলতেন, ইষ্ট দুরকম হয় রে, যা চাই তা যামন ইষ্ট, তেমনি যা চাই না, তাও ইষ্ট। নইলে ইঁটকে ইষ্টক বলবে কেন, হরিমটরকে ইষ্টমালা বলবে কেন, বল?
আমি তো এটাও জানি না যে কালী, শিবঠাকুর, গুরুঠাকুর, যার নামই লোকে জপুক, মালাটাকে কেন হরিমটর বলে।
আমি দেখেছি মাদুলিকেও বলে ইষ্ট। কলকাতা থেকে যেসব ক্লার্ক আর জুনিয়ার অফিসার ট্রান্সফার হয়ে আসত, তারা মাদুলি আর মার্কস সঙ্গে আনত। তারপর ভাল ইষ্ট-খারাপ ইষ্টর মাঝখানে চটকে যেত।
কলকাতায় অনেককে দেখেছিলুম, টেরি ঈগলটন দিয়ে, ফ্রেডরিক জেমিসন দিয়ে চটকে যাচ্ছে। ফ্রেডরিক জেমিসনটা ওদের সেভাবে চটকাচ্ছে, ঠিক যেমন জব চার্ণকটা ওদের বাপ হয়ে চটকেছিল। টেরি ঈগলটানটাও তো একটা গাধা। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গাধা।
মোল্লার কথা মনে পড়ায় দাড়ির আইডিয়াটা এসেছিল। সুরজিৎ সেন মোল্লা নাসিরুদ্দিন নিয়ে গবেষণা করছে।ঔ ও বলছিল, মোল্লা নাসিরুদ্দিন নামে আদপে কেউ ছিল কি না ডাউটফুল। গল্পগুলো তুর্কির লোকেরা বানিয়েছিল। তুর্কিরা আসলে মোঙ্গোলিয়া থেকে গিয়ে জায়গাটা দখল করেছিল বলে লোকে ভাবে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দাড়িতে শিবাজী বাঁড়ুজ্জের মতন দশবারো গাছা তুলনামূলক চুল ছিল। আসলে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প চারিয়ে লোকে অটোমান সাম্রাজ্যের আগের চুটকি-দাড়ি খলিফাদের আক্রমণ করত। সরাসরি আক্রমণ করলে তো খলিফাদের পার্টি পোঁদে বাঁশ করে দেবে। তাই দাও ধোলাই গল্প দিয়ে।
দশবারো গাছা হলেও মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দাড়ি নিশ্চই ছিল। আর তার ছিল একটা সুপার-ইন্টালিজেন্ট গাধা। সোভিয়েত দেশে ভ্যালেনতিনিভিচ প্লেখানভের পর ঝানভ নামে এক সুপার-ইন্টালিজেন্ট গাধা ছিল যেমন, ঠিক তেমনি, হুবহু, অবিকল ব্রিটেনের অমন গাধা টেরি ঈগলটন আর ইউরোপের অমন গাধা ফ্রেডরিক জেমিসন। বাদামি হোক বা শাদা, গাধারা চিরকাল গাধাদের দলে টানে। একটা গাধা চ্যাভোঁ-চ্যাভোঁ করলে অন্য গাধারাও চ্যাভোঁ-চ্যাভোঁ আরম্ভ করে দেবে।
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের নিশ্চই দাড়ি ছিল। লেনিন আর স্ট্যালিনের যদি অমনধারা দাড়ি থাকত, তাহলে আজকে প্রথিবীর এ-দশা হত না।
গোপাল ভাঁড়েরও দাড়ি ছিল, জানেন তো? ওর হাওড়ার গ্রামে মুড়ি-নারকোল খেতে-খেতে সেদিন অরবিন্দ প্রধান বলল। ওর মতে গোপাল আসলে নাপিত ছিলেন তো, তাই উচ্চবর্ণের লোকেরা ওনার নামে ভাঁড় জুড়ে দিয়েছে; সুকুমার সেন তো অস্তিত্বই নাকচ করে বলেছেন যে আসলে গল্পগুলো রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পাশ্বচর দেহরক্ষী বাগবিদগদ্ধ শংকরতরঙ্গ মহাশয়ের তৈরি। বুঝুন ঠ্যালা অ্যাগবার। যে-গল্পগুলো কৃষ্ণচন্দ্রের এসট্যাবলিশমেন্টকে তুলে আছাড় দিচ্ছে, তাকে বলে কিনা গ্রাম্য আর অশ্লীল। আরে বাবা, সাবঅলটার্ন কাউন্টার-ডিসকোর্স অমন হবে না তো কি শহুরে আর শেকড়হীন ভাড়াটের ন্যাকাচিত্তির ফ্যান্তাফ্যাচাং হবে?
সাবঅলটার্ন বলে অরবিন্দ গর্বে টইটুম্বুর। বলে, আমি হলুম মাহিষ্য, বুঝলেন তো?
তা ঠিক। আমার যখন দাড়ি ছিল না, পশ্চিমবাংলায় অফিসের কাজে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে কি গোলোকধাঁধাতেই না পড়েছি। যেমন অনেকটা এরকম।
—-আপনার নাম তো নিমাজ খাঁ, তাই না? সেনসাস রিপোর্টে দেখছি এ-গাঁয়ে সাতাশটা পরিবার। আর কাউকে দেখছি না গাঁয়ে। ঘরদালান সব ফাঁকা। সবাই কোথায় গেছে বলুন তো? হোসেন মন্ডলের তেল-নুনের দোকান বন্ধ, ওর সামনের মাঠে মসজিদ তালাবন্ধ! চাষআবাদের কিছু খবরাখবর জানতে চাইছিলুম।
—-কোনো কথা বলবনি বাবু। আরবারে এক বাবুকে বলার পর তিলডাঙার বাবুরা খুব মেরেছেল। দ্যাখেন, হাতে-পায়ে কালশিটে পড়ে গেছে। জমিন নাই। দুরে খাটতে যাই। সে-যাওয়াও বন্ধ করে দেছে। রোগজাড়ি হলে হাসপাতালেও যেতে দ্যায় না।
বাবু সম্বোধনে বুঝে গিয়েছিলুম আমার কিছু একটা নেই, যার দরুণ আমি সুব্রহ্মনিয়াম, তারাপুরকর, খান্নার মতন সফল হতে পারছি না। তবু, আরেক গাঁয়ে গিয়ে ভাবলুম এক মহিলার সঙ্গে কথা বলে দেখি, যদি চাষআবাদের তথ্যটথ্য পাই।
—-আপনি তো ফরিদা….
—-না-না-না-না, আমি কোনো কতা কইবোনি বাবু। আমার মেয়ে ঝুরি খাতুনকে ওরা টেনে লিয়ে যেতে চেয়েছেল। আমি বঁটি লিয়ে তেড়ে যেতে ওরা পালায়। পরে এসে মেয়েকে বেদম মারে। সেদিনকেই আমার কোল থেকে এই ছোট্ট ছ্যানাকে কেড়ে লিয়ে যায় বাঁকুড়ার জাংগালে। আমার জায়েরা গিয়ে ছাড়িয়ে আনে। তিন দিন পর ওরা এসে বলে তোর সোয়ামি ঘরে অস্তর লুক্কে রেকেচে। বের করে দে। আমি দিতে পারিনি। শুধু চাষির ঘরের নাঙল, কাস্তে আর হাতুড়ি দিয়ে দি।
—-কাস্তে-হাতুড়ি দিয়ে দিলেন?
—-আর তো কিছু ছিলনে। ওরা বললে বন্দুক আচে।আমরা গরিব। বন্দুক কোতায় পাব? ওরা শুনলেনি। নজরুল ঘুমোচ্ছেল। মাটি থেকে ওকে হ্যাঁচকা মেরে টেনে লিয়ে গেল। এবার আমি জায়েদের সঙ্গে লিয়ে বনের ধারে বাবুদের আপিসে গিয়ে পায়ে পড়ে কেঁদে ছাড়িয়ে লিয়ে এলাম ছ্যানাকে। বাবুরা বলে ওর বাপ ওন্নো দল করে। বংশ রাখা যাবেনি। নুনুখান কেটে লিবে। তাই বাপের বাড়ি পাইলে এসেচি।
এখন এসব কথাবার্তা থেকে কি আমন ধানের ক্রপিং ইনটেনসিটি ক্যালকুলেট করা যায়? বিঘা প্রতি ইনটারনাল রেট অব রিটার্ন হিসাব করা যায়? অপটিমাম কস্ট বের করা যায়? ল্যাসপেয়ার্স ইনডেক্স কষা যায়? কস্ট-আউটপুট রেশিও বের করা যায়? অথচ ভারত সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, আই এম এফ জানতে চাইছে।
ভাল হল যে সর্বজনীন ভাইরাল ফিভারে আমিও আক্রান্ত হলুম। টানা ছুটি। দাড়ি গজিয়ে গেল। হাত বুলিয়ে দাড়ি আদর করি।
এই ফাঁকে, মুখে তো অফুরন্ত হাই, ছেলেমেয়েকে ওদের ছোটবেলায় যে জুনিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়া কিনে দিয়েছিলুম, তার ছবি দেখে টাইমপাস। হাই তুলতে-তুলে দাড়ি খুঁজি। নানারকম জ্ঞানবিজ্ঞানের দাড়ি।
গুরু নানকের দাড়ি ছিল। শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।
থিরুভাল্লুভারের দাড়ি ছিল। তামিল ভাষার সন্ত কবি।
ছত্রপতি শিবাজির দাড়ি ছিল। মারাঠা শক্তির স্হাপক।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির দাড়ি ছিল। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান অব ক্যালকাটার প্রতিষ্ঠাতা।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের দাড়ি ছিল। অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদ্ভাবক।
দাদাভাই নওরোজির দাড়ি ছিল। ব্রটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত প্রথম ভারতীয়।
বিনোবা ভাবের দাড়ি ছিল। ভূদান আন্দোলনের হোতা।
জামশেদজি টাটার দাড়ি ছিল। ভারতবর্ষে ইস্পাতশিল্পের দিগদর্শক।
রবীন্দ্রনাথের দাড়ি ছিল। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজেতা।
যিশুখ্রিস্টের দাড়ি ছিল। ঈশ্বরের পুত্র।
কার্ল মার্কসের দাড়ি ছিল। মার্কসবাদের জনক।
আর্কিমিডিসের দাড়ি ছিল। ঘনত্ব মাপার প্রথম বিজ্ঞানী।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির দাড়ি ছিল। মোনালিসার চিত্রকর।
সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দাড়ি ছিল। আধুনিক মনস্তত্বের পথপ্রদর্শক। হেরোডোটাসের দাড়ি ছিল। মানুষের সবরকম আবেগের নাট্যকার।
টমাস কার্লাইলের দাড়ি ছিল। ফরাসি বিপ্লবের লিপিকার।
কনফুসিয়াসের দাড়ি ছিল। চিনের প্রথম ধার্মিক ভাবুক।
মোজেসের দাড়ি ছিল। ঈশ্বরের দশটা নির্দেশ পেয়ে ইহুদি আইন বানিয়েছিলেন।
ফ্রান্সিস অব আসিসির দাড়ি ছিল। ফ্রানসিসকান ব্রাদারহুডের প্রবর্তক।
সক্রেটিসের দাড়ি ছিল। যুবসমাজকে নষ্ট করার তত্বের অভিভাবক।
প্ল্যাটোর দাড়ি ছিল। যিনি বলেছিলেন যে যা শুভ তা-ই জীবন।
আ্যারিস্টটলের দাড়ি ছিল। আলেকজান্ডারের শিক্ষক।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের দাড়ি ছিল। কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর যুগ্মলেখক আর দাস ক্যাপিটাল বইটার সম্পাদক।
অগুস্তে রোঁদার দাড়ি ছিল। ভাস্কর্যে আলোছায়া ধরে রাখার আবিষ্কর্তা।
জিওভানি পালেস্ত্রিনার দাড়ি ছিল। ইউরোপীয় রেনেসঁসের সংগীতকার।
পিটার চাইকভস্কির দাড়ি ছিল। সিমফনি কবিতা আর ব্যালে সংগীতের বিখ্যাত রুশ কমপোজার।
বইটার রঙিন ছবিগুলো দেখা শেষ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলুম। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে, ফিদেল কাস্ত্রোর তো দাড়ি আছে। ফিদেল কাস্ত্রো, চে গ্বেভারা ওনারা প্রথমে বিপ্লব করে একনায়ক উৎখাত করেছিলেন। বিপ্লব করার সময়ে ওনারা মার্কসবাদী ছিলেন না। বিপ্লব সফল হবার পর উচিত সরকসরি কাঠামো খুঁজতে-খুঁজতে ওনারা সমাজবাদী কাঠামোটাকেই সবচে ভাল মনে করেছিলেন। আগে ওনাদের দাড়ি বড় হয়েছে। পরে বিপ্লব। তারপর মার্কসবাদ।
রানি প্রথম এলিজাবেথ আর পিটার দি গ্রেট দাড়ির ওপর ট্যাক্স বসিয়েছিলেন। তবু লোকে দাড়ি রাখত।
তাই ঠিক করলুম যে দাড়িটা বাড়ছে বাড়ুক, আর কামাব না, শুধু ছাঁটব।
ফল হাতে-নাতে পেলুম।
অফিসে পা দিতেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মীরা বেণুগোপালন বললে, হাই হ্যান্ডসাম, ইউ লুক মারিকাটারি, কিপ ইট, ডোন্ট শেভ, ইউ স্মেল লাইক অ্যাব্রাহাম লিংকন।
নারীরা এরকম পুরুষের গন্ধ নিয়ে চিন্তা করে কেন? জিগ্যেস করেছিলুম সুদক্ষিণাকে। সুদক্ষিণা চট্টোপাধ্যায়। বলতে পারেনি। বোধয় ওর কোনো পুরুষ সঙ্গীর গন্ধহীনতার কথা ভাবছিল।
ট্যুরে পশ্চিমবাংলায় গিয়ে প্রথঞ দিনেই টের পেলুম আমার দাড়িনন্দিত অবস্হাটা, যখন জেলার সরকারি অফিসাররা আমার সঙ্গে ইংরেজি আর হিন্দিতে কথা শুরু করল। আমিও ইংরেজি আর হিন্দি চালিয়ে গেলুম।
এ যে দেখি গাছে-গাছে ক্যানারি পাখি।
মাঠা-ঘাটে জেলে-তাঁতি-চাষিদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলি। চাষআবাদ নিয়ে প্রশ্ন করি। ওরা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা বলে। কিন্তু যা-যা জানতে চাই ঠিক-ঠিক উত্তর পাই। এক্কেবারে বলবনি-বলবনি করে না।
হাঃ হাঃ, কেউ বুঝতে পারে না আমি বাঙালি। যদি জানত যে আমি বাঙালি, তাহলে চেপে যেত। ভাবত আমি এই দল কিংবা ওই দলের। এই নেতার ছায়াতলে কিংবা ওই নেতার পদতলে। এই ঝান্ডার ডান্ডাতাড়িত কিংবা ওই ঝান্ডার ডান্ডা কবলিত। এই দাদফার অ্যালসেশিয়ান কিংবা ওই কমরেডের পমেরানিয়ান।
লোকে মাতৃভাষাকে যে এত ভয় পায়, তা তো দাড়ির জন্যেই বুঝতে পেরেছিলুম। দাড়িটা আমার সঙ্গে পার্মানেন্টলি থেকে গেল।
এখন দাড়িটা কামিয়ে ফেলতে বলছে সবাই। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি বলে নয়। অবসর নিয়েছি বেশ ক’য়ছর আগে। আহমেদাবাদ যাচ্ছি বলে। আহমেদাবাদে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। সবাই বলছে স্টেশানে নামতেই মুসলমান ভেবে কচুকাটা করবে। অজিত ভৌমিক বললে, আপনি তো সিনিয়র সিটিজেন, কনসেশান পাবেন, দাড়ি কামিয়ে বাই এয়ার চলে যান, এয়ারপোর্টটা গোলমাল এরিয়া থেকে দুরে, সাবরমতী নদীর ওপারে।
আমার ভারিভরকম শালি পাপা ওর বোনকে ওসকায়, তোরা করছিস কি, এই দাঙ্গার মাঝে কেউ যায়? দাঙ্গা থামুক, তারপর জামাইবাবুকে দাড়ি কামিয়ে নিয়ে যাবি; তুইও বোকার মতন চুড়িদার পরে যাসনি যেন, তার ওপর তুই সিঁদুর পরা ছেড়ে দিয়েছিস, কতবার বললুম এটা তোর মুম্বাই নয়।
আচ্ছা ঝামেলা।
আমাকে মুসলমান অবাঙালির অভিনয় করে কাজ চালাতে হয়েছিল। এখন আমার স্ত্রীকে হিন্দু বাঙালির অভিনয় করে কাজ চালাতে হবে।
নাঃ, দাড়িটা কামানো যাবে না। অন্তত আহমেদাবাদ থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত। আহমেদাবাদে আমি আর আমার স্ত্রী যাচ্ছি নাতনি মিহিকার প্রথম জন্মদিন উদযাপন করতে। দাঙ্গা হোক বা পাঙ্গা, যেতে আমাদের হবেই। বিয়ের সাত বছর পর মেয়ের বাচ্চা হল। এখন নাতনির জন্মদিনে ওর সঙ্গে গিয়ে একটু খেলব। সেই পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে যখন ছেলে-মেয়ে ছোট ছিল তখন যা খেলেছি। কতকাল হয়ে গেল বাচ্চাদের সঙ্গে খেলিনি। মহা ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছে গুজরাতিগুলো। ওরা তো গাছপাতা খায়। আমরা তো মাছখোর। তাহলে ওরা খুনখারাপিতে নেবে গেল কেন! আজ পর্যন্ত কোনো গুজরাতিকে তো পরমবীর চক্র পেতে শুনিনি। খুনোখুনিকে জনপ্রিয় করে তুলল কী করে! মুখ্যমন্ত্রী বলল আর দলে-দলে লোক সারা গুজরাত জুড়ে মুসলমানদের কচুকাটা করতে লাগল, তা কখনও হয় নাকি, যদি না খুনেরা অনেকদিন থেকে আটঘাট বেঁধে ষড় করে তোড়জোড় করে রাখে? আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তো রোজই বলছেন, ‘এখনই করুন এখনই করুন এখনই করুন’, কিন্তু কেউ কি শুনছে? পঁচিশ বছর ধরে আটঘাট বেঁধে ষড় করেছে যে কুটোটি নাড়বে না । মুখ্যমন্ত্রীর কথা দুকান দিয়ে শুনে পোঁদ দিয়ে বের করে দেয়।
ছোটকাকার সঙ্গে কোতরঙে দেখা করতে গিয়েছিলুম। তা উনিও বললেন, এখুন যাসনে, এখুন বানাসকাঁথা, সুরেন্দ্রনগর, রাজকোট, জামনগর, জুনাগড়, ভাগনগর, কচ্ছ, গান্ধিনগর, বুলসর, চাদ্দিকময় খুনোখুনি চলছে। তোর আবার দাড়ি রেয়েছে। তোর বউও শাঁখা-সিঁদুর পরে না। পরে যাসখন। দ্বারকাটাও ঘুরে আসতে পারবি। আমার হয়ে পুজো দিয়ে দিস। আমি গিসলুম বছর পঞ্চাশেক আগে। সোমনাথ মন্দির, শত্রুঞ্জয় পাহাড়ে জৈনমন্দির, উদওয়াড়ায় পার্সিদের অগ্নিমন্দির, মধেরায় সূর্যমন্দির, কতো জায়গায় গিসলুম। এখুন তো বাতে কাহিল হয়ে বাইরেও বেরোতে পারি না। তোর কাকিমাই সব কচ্চে।
আমি বললুম, কী আর দেখব ঘোড়াড্ডিম, সারা জীবন দেখে-দেখে হাল্লাক হয়ে গেলুম। এখন যাচ্ছি নাতনিকে দেখতে। ওর প্রথম জন্মদিন। কবে পটল তুলব তার ঠিক নেই। ওর সঙ্গে একটু খেলব। বাচ্চার আগডুম-বাগডুম ভাষায় কথা কইব।
যাক, ছোটকাকা অন্তত দাড়িটা কামাতে বললেন না। ঠাকুর্দার দাড়ি ছিল। উনিশ-শতকি রেনেসঁসি দাড়ি। ঠাকুর্দার বাবার দাড়ি ছিল। সুলতানি দাড়ি। আমার দাড়িটা তো গ্রো অ্যাজ ইউ লাইক।
হাওড়া থেকে একটাই ট্রেন, ৮০৩৪ হাওড়া-আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস, রাতে আটটা কুড়িতে ছাড়ে, চুয়াল্লিশ ঘন্টার জার্নি। সকাল পাঁচটাতেই চলে এসেছিলুম, ছটা থেকে মোড়ে-মোড়ে অবরোধ আর বুকনিবাজির ঝুঠঝামেলা এড়াতে; কী একটা গণপ্রতিবাদ আছে যেন। সেকেন্ড এসি প্রায় ফাঁকা। বাঙালি যাত্রী বলতে একটা এনজিও দল। আর তিনজন গোপ্পুড়ে ভুঁড়িদাস গুজরাতি। মহিলা বলতে এনজিও দলে তিনটি উতল-হাওয়া যুবতী। গুজরাতিগুলো যেতে-আসতে আমাদের উদ্দেশ্যে কাঁচাপাকা ভুরু কোঁচকাচ্ছে। আমার স্ত্রী ওর জার্নি-ড্রেস কালোকালো ফুল-আঁকা চুড়িদারই পরেছে। ওর চিরকেলে আশঙ্কা রাতে ঘুমোবার সময় শাড়ি কোথায় উঠে যাবে ঠিক নেই। কলেজে হকি খেলার সময় থেকে ট্রেনে চুড়িদার পরছে। অথচ হকি খেলত হাফপ্যান্ট পরে।
স্টেশানে ছাড়তে এসে শতদল দত্ত বলেছিল, সোজা আহমেদাবাদ না গিয়ে এখান থেকে বম্বে, মানে মুম্বাই, তারপর দুচার দিন মুম্বাইতে কাটিয়ে ওখান থেকে আহমেদাবাদ যেতে পারতেন। সেরকম বুঝলে মুম্বাইতে দাড়িটা কামিয়ে তারপর রওনা দিতেন। আপনার ছেলে মুম্বাইতে আছে, অসুবিধার স্কোপ নেই। অবশ্য এই ট্রেনে যেতে-যেতেই তো হাওয়া বুঝতে পারবেন। রাস্তায় বোধয় গোধরা পড়ে। বেগতিক বুঝলে ট্রেনেই দাড়িটা কামিয়ে নেবেন। বউদিও সিঁদুর-টিদুর পরে নেবেন।
ওকে বলেছিলুম যে শেভিংসেট চাকরি করার টাইমে সান্টাক্রুজে ফেলে দিয়েছিলুম। আর সিঁদুর কারোর বাড়িতে কেউ পরিয়ে না দিলে তোমার বউদি পরে না।
শতদল বলেছিল, লিপ্সটিক আছে তো? তাই দিয়ে সিঁদুর পরে নেবেন।
গুজরাতে ট্রেন ঢুকতে, সুরাত ছাড়ার পর এনজিও দলের এক যুবতী আর এক প্রৌঢ় এলেন আমাদের সঙ্গে গপপো করতে। কোথায় থাকি, কেন যাচ্ছি, কোথায় চাকরি করি ইত্যাদি জানার পর মেয়েটি বলল, আংকল, আমাদের গাড়ি আসবে স্টেশানে, আপনি বলবেন, আমরা সেফলি পৌঁছে দেব, রায়ট অ্যাফেক্টেড এরিয়াগুলোর ম্যাপ আমাদের কাছে আছে।
বুঝলুম ওরা প্যাসেঞ্জার চার্টটায় চোখ বুলিয়ে আমাদের কাছে এসেছে। প্রত্যেক বারই দেখি প্যাসেঞ্জার চার্টে সলিলার নামটা ইংরেজি আর হিন্দিতে শাকিলা টাইপ করে দ্যায়। নামের সঙ্গে চেহারার মিল খুঁজে পেয়েছে।
ধন্যবাদ জানিয়ে বললুম যে আমার জামাই ওর গাড়ি নিয়ে স্টেশানে আসবে। সলিলা যে শাকিলা হয়ে গেছে সে ভুলটা ভাঙিয়ে ওদের লজ্জায় ফেলা অনুচিত মনে হল।
দুপুরে ভারুচে গপপো করতে এলেন তিন গুজরাতির একজন। আমার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের পর আমার মেয়ে-জামাইয়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করলেন। দুটো কার্ড দিলেন, ওনার দুটো দোকানের, একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, অন্যটা বাচ্চাদের পোশাকের । মালিকের নামে স্পষ্ট যে উনি সিন্ধি। দেশভাগে প্রচুর সিন্ধি গুজরাতে চলে এসেছিল। টাকা রোজগার ছাড়া ওরা আর কিছু ভাবার বিশেষ সময় পায় না।ইনি ট্রেনেতেও প্রসপেকটিভ খদ্দে খুঁজছেন।
একটু পরে আবার ফিরে এলেন, আধুলির মাপের ছোট্ট প্লাসটিক ডিবে নিয়ে। খুলে, আমি ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই, গুঁড়োটা দিয়ে আমার কপালে তেলক কেটে দিলেন। বললেন, এটা আনহার্মফুল রেড কালার। আপনার দাড়ির জন্যে গোলমাল ফেস করতে হতে পারে বলে লাগিয়ে দিলুম। দাড়ি-তিলক মানে শিবসেনা। আমার কাছে খদ্দেরের ধর্ম গুরুত্বহীন। দাড়ি থাকলে হিন্দু এরিয়ায় তেলক কেটে বেরোন আর মুসলমান এরিয়ায় মুছে ফেলুন, ব্যাস কৌটোটা রেখে নিন।
উনি যেতে সিটের নিচে রেখে দিলুম বস্তুটা।
চারটে নাগাদ আহমেদাবাদ পৌঁছোলুম। খিদে পেয়ে গিয়েছিল। যা খাবার সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলুম সবই বরোদার আগে ফুরিয়ে গিয়েছিল। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরে বাইরের খাবার খাই না।
স্টেশানে নামতেই মেয়ে-জামাই ছুটে এল। মেয়ে অনুশ্রী বলল, কী করেছ কী, কপালে সিঁদুর লাগিয়ে ধর্মকর্ম শুরু করলে নাকি! ছিঃ।
মনে পড়তে পুঁছে ফেললুম রুমাল দিয়ে। ওদের বললুম ঘটনাটা। কার্ড দুটো নিয়ে জামাই প্রশান্ত বলল, আরে এরা তো মহাচোর, সব জিনিসের বেশি-বেশি দাম নেয়।
সলিলা খৌঁজখবর করতে প্রশান্ত বলল, দাঙ্গার জন্যে মাছমাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের। সব তু মুসলিম এরিয়ায় পাওয়া যায়। ফলের মার্কেটও ওদিকে। মিহিকার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। কলা খেতে শিখেছে। আপেল সেদ্ধ করে দিলে খায়। আমরা একেবারে ফোর্সড গুজরাতি লাইফ লিড করছি। এবলা ঘাসপাতা, ওবলা ঘাসপাতা।
অনুশ্রী বলল, যাক, দাড়িটা কামাওনি। আমার তো চিন্তা হচ্ছিল যে শেষে ভয়ে কামিয়েই ফেললে বুঝি। টেলিফোনে তোমায় বলেছিলুম তো যে মিহিকার চুল ঘাঁটতে খুব ভাল্লাগে। প্রথম জন্মদিনে দাদুর দাড়ি নিয়ে খেলতে না পারলে তো ওর মন খারাপ হয়ে যেত।
(রচনাকাল: আগস্ট ২০০৪। গান্ডীব পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)
এই গল্পটির কারোর কোনো কপিরাইট নেই। যে কেউ পুনর্মুদ্রণ করতে পারেন।