Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মিসির আলি আপনি কোথায় || Humayun Ahmed » Page 7

মিসির আলি আপনি কোথায় || Humayun Ahmed

তরিকুল ইসলামের ঘুম ভাঙ্গে ফজরের ওয়াক্তে। তিনি হিমশীতল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নামাজ আদায় করেন। এরপর তার আর অনেকক্ষণ কিছুই করার থাকে না। বাড়ির সবাই ঘুমে। তাদের ঘুম এত সহজে ভাঙে না। তরিকুল ইসলাম ঝাড়ু হাতে নেন। উঠান ঝাড় দেয়া শুরু করেন। এতে দুটা কাজ হয়- উঠান হয় ঝকঝকে পরিষ্কার এবং তাঁর শীত কমে। কিছু এক্সসারসাইজও হয়। এই বয়সেও এক্সসারসাইজ করে শরীর ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।

একটা বিষয় চিন্তা করে তরিকুল ইসলাম বেশ মজা পান। বিষয়টা হচ্ছে বাড়ির কেউই উঠান বাট দেয়ার ব্যাপারটা জানে না। তারা ধরেই নিয়েছে ঘুম থেকে উঠে দেখবে চারদিক ঝকঝকি করছে। কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই।

তরিকুল ইসলাম উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন। অর্ধেকের মতো ঝাঁট দেয়া হয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে এসে কে যেন তার হাত ঝাণ্টে ধরল এবং ঝাড়ু দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। তিনি চমকে পেছনে ফিরে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। জামাই ফারুক এসেছে। তরিকুল ইসলাম বললেন, বাবা! কেমন আছ?

ফারুক কদমবুসি করতে করতে বলল, আপনি ঝাঁট দিচ্ছেন কেন? বাড়িতে মানুষ নাই?

তরিকুল ইসলাম বললেন, ঝাড়ু দেয়া মানে একই সঙ্গে হাতের, পায়ের এবং কোমড়ের এক্সসারসাইজ। এই জন্যে ঝাড়ু দেই।

ফারুক বলল, এক্সসারসাইজের জন্যে ঝাড়ু দিতে হবে না। আপনি ফ্রি হ্যান্ড এক্সসারসাইজ করবেন। বাবা এখন বলুন আমার স্যারের অবস্থা কি? উনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন শুনে কি যে ভয় পেয়েছিলাম।

তোমার স্যার ভালো আছেন। ডাক্তার দেখে গেছে বলেছে কোনো ভয় নাই। উনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে মসজিদে একটা মিলাদও দিয়েছি। কবিরাজ রোহিনী বাবু এসেছিলেন তিনি চীবন প্রাস বানিয়ে দিয়েছেন। সকাল বিকাল এক চামচ করে খেলে ঘোড়ার মতো তেজি শরীর হবে।

স্যার কি ঘুমাচ্ছেন?

সবাই ঘুমাচ্ছে। কখন যে উঠবে আল্লাহ পাক জানে। দাঁড়াও ডেকে তুলি।

কে চা বানাবে?

আমি বানাব। আপনার জন্যে ইলিশ মিষ্টি নিয়ে এসেছি।

ইলিশ মিষ্টিটা কি?

সন্দেশ। ইলিশের পেটির মতো করে বানানো।

তরিকুল ইসলাম আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বের কর একটা খেয়ে দেখি। ভালো মিষ্টি দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে। নাটোরের কাচাগোল্লা এখন স্মৃতি ছাড়া কিছুই না। মেট্রিক পরীক্ষার আগের দিন নাটোরের কাঁচাগোল্লা খেয়েছিলাম। সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। হাতে লেগে আছে মিষ্টির গন্ধ। তোমরা এই জমানার ছেলে।পুলে আসল মিষ্টির স্বাদ কিছুই জানলে না। আফসোস, বিরাট আফসোস।

উঠানে বেতের মোড়ায় স্বশুর জামাই চা খাচ্ছেন। তিরিকুল ইসলাম আনন্দে অভিভূত। জামাইকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তাঁরকুল ইসলাম বললেন, দুপুরে মাছ কি খেতে চাও বল।

ফারুক বলল, বিলের ফ্রেস ছোট মাছ খাব।

পাঁচমিশালী গুড়ামাছ জোগার করব। কোনো সমস্যা নাই।

কালি বোয়াল কি পাওয়া যায় বাবা?

এইতো বিপদে ফেললে এইসব জিনিস কি আর দেশে আছে? দেখি চেষ্টা করে।

খলিসা মাছ?

আরেক ঝামেলায় ফেলেছ। খলিসাতো প্ৰায় extinct মাছ। এখুনি বের হচ্ছি। সকাল সকাল না গেলে পাওয়া যাবে না।

ফারুক বলল, বাবা আপনার জন্যে একটা চাদর এনেছিলাম। বের করে দেই? চাদরটা গায়ে দেন। দেব?

দাও।

তরিকুল ইসলাম গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে বললেন, আরেক কাপ চা বানাওঁ। চা খেয়ে বের হই। আরেকটা কথা বাবা তোমাকে বলি মন দিয়ে শোন। আমি শিক্ষক মানুষ তো সব মানুষকে আমার কাছে মনে হয়। পরীক্ষার খাতা। সবাইকে নম্বর দেই! তুমি আমার কাছে নম্বর পেয়েছ একশতে একানব্বই। সন্টার মার্কের চেয়েও বেশি। আর আমার জার্মান প্রবাসী গাধা পুত্র পেয়েছে চব্বিশ। গ্রেস মার্ক দিয়েও তাকে পাস করানোর বুদ্ধি নেই।

ফারুক বলল, আয়না। আয়না কত পেয়েছে?

তরিকুল ইসলাম চিন্তিত গলায় বললেন, ওর খাতাটা আমি বুঝি না। নাম্বারাও এই জন্যে দিতে পারি না।

আয়না দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি উঠোনের দিকে। শ্বশুর জামাই চা খেতে খেতে গল্প করছে দেখতে ভালো লাগছিল। এখন ফারুক একা। মাথা নিচু করে উঠোনে হাঁটছে। একবারও দোতলার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই আয়নার হাসি মুখ দেখতো।

আয়না দোতলা থেকে নামল। তার কেন জানি হঠাৎ ইচ্ছা করছে ফারুককে চমকে দিতে। নিঃশব্দে তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাউ’ করে চিৎকার দিলে কেমন হয়? আয়না খানিকটা অবাক হচ্ছে। এ রকম ইচ্ছাতো তার আগে কখনো হয় নি।

হাউ চিৎকার শুনে ফারুক চমকে তাকালো। আয়না গম্ভীর গলায় বলল, কেমন আছ?

ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?

আমিও ভালো আছি। তোমার শিক্ষকও ভালো আছেন। তবে তাঁর মাথা খানিকটা এলোমেলো।

ফারুক বলল, আমার স্যার এমন একজন মানুষ যার মাথা কখনো এলেমেলো হয় না।

তাই বুঝি?

ফারুক বলল, হ্যাঁ তাই—
যদিও আমার গুরু শুড়ি বাড়ি যায়
তবুও আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

আয়না বলল, শুড়ি বাড়ি যায় মানে?

ফারুক বলল, কথার কথা বললাম, আমার গুরু কোথাও যান না।

আয়না বলল, দোতলা থেকে দেখলাম তুমি বাবার জন্যে চা বানিয়ে এনেছি। আমার জন্যে চা বানিয়ে আন।

এখুনি আনছি। ইলিশ সন্দেশ এনেছি। খাবে?

তুমি বললে খাব। সকালে আমি মিষ্টি খাই না। খেতে বলো না।

আচ্ছা বলব না।

আমি চা খাব আর তুমি আমার সামনে বসে বলবে কেন তুমি মিসির আলি নামের মানুষটাকে এত পছন্দ কর?

ফারুক বলল, আচ্ছা যাও বলব।

আয়না বলল, আমিও পছন্দ করি তবে আমার পছন্দের কারণ আর তোমার পছন্দের কারণ এক না।

তোমার পছন্দের কারণ কি?

আয়না। হাসতে হাসতে বলল, বলব না।

ফারুক চা বানিয়ে এনেছে। আয়না আগ্রহ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ফারুক বলল, মিসির আলি স্যারকে এত পছন্দ করি কেন বলছি। মন দিয়ে শোন।

মন দিয়ে শুনছি।

তাঁর চিন্তা করার ধারা বা বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাস বাদ থাকুক মানুষ মিসির আলির একটা গল্প শোনা। মন দিয়ে শোন।

বাr বার মন দিয়ে শোনা বলছ কেন? আমি যা শুনি মন দিয়ে শুনি।

একদিন ক্লাসে তিনি বললেন, আমি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে তার চিন্তা করার ক্ষমতার ভেতর একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করছি। তোমরা হচ্ছে আমার প্রথম সাবজেক্ট। তোমরা সবাই তোমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করবে এবং বোর্ডে লেখা পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর দেবে।

১. রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে যাও না বাতি জুলিয়ে ঘুমুতে যাও?

২. উচ্চতা ভীতি কি আছে?

৩. দিঘির পানির কাছে গেলে কি পানিতে নামতে ইচ্ছা করে?

আগুন ভয় পাও?
৫. অপরিচিত কোনো ফুল হাতে পেলে গন্ধ শুঁকে দেখ?

আমরা সবাই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা লিখলাম এবং আগ্ৰহ নিয়ে প্রশ্নগুলির জবাব দিলাম। কাজটা স্যার কেন করলেন জন? আমাদের মধ্যে হতদরিদ্র যারা তাদের খুঁজে বের করার জন্যে।

আয়না বলল, মজার তো।

ফারুক বলল, স্যার তিনজন হতদরিদ্র খুঁজে বের করলেন যাদের ইউনিভার্সিটির খরচ তিনি দিতেন। আমি ছিলাম তিন জনের একজন।

বাহ্‌।

আরেকটা গল্প বলব?

वन।

স্যারের একবার প্লুরিসি হলো। খুবই খারাপ অবস্থা। তিনি এমন একটা ক্লিনিক বের করলেন যার খোজ কেউ জানে না। তিনি সেখানে ভর্তি হলেন। কেন জান?

কেন?

যাতে ছাত্ররা তাঁকে খুজে না পায়। তাকে সেবার জন্যে ব্যস্ত না হয়। তিনি কারোর সেবা নেন না। মিসির আলি স্যার এমনই একজন পূণ্যবান ব্যাক্তি যার কাছাকাছি বসে থাকলেও পূণ্য হয়।

আয়না বলল, তোমার চোখে পানি এসে গেছে। পানি মোছ।

ফারুক চোখ মুছল।

মিসির আলির সঙ্গে ফারুকের দেখা হল সকালে নাশতার টেবিলে। ফারুক বলল, স্যার আমাকে চিনেছেন?

মিসির আলি বললেন, তোমার নাম দেখে তোমাকে চিনতে পারি নি। এখন চিনেছি। খুব ভালো মত চিনেছি। তুমি অনার্স এবং এমএ দুটোতেই ফাস্টক্লাস ফাস্ট হয়েছিলে। ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হবার কথা ছিল। কি সব পলিটিক্সের কারণে হয়নি।

ফারুক বলল, আমার বিষয় আর কিছু কি মনে আছে স্যার?

মনে আছে। আমার একবার প্লুরিসি হয়েছিল। মারতে বসেছিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম। এমন এক ক্লিনিকে যার খোজ কেউ জানে না। তুমি কি ভাবে কি ভাবে সেখানে উপস্থিত হলে। কেমন আছ ফারুক?

স্যার ভালো আছি। আপনি সুস্থ আছেন এবং ভালো আছেন দেখে ভালো লাগছে।

মিসির আলি বললেন, তুমি যে ডেকেছি সেই সমাধান আমি করতে পারিনি। পারব সে রকম মনে হচ্ছে না।

ফারুক বলল, সব সমস্যার সমধান থাকে না। স্যার। যেসব সমস্যার সমাধানই নেই আপনি তার কি সমাধান করবেন? এইসব নিয়ে আমরা রাতে কথা বলব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *