Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মিসির আলির চশমা || Humayun Ahmed » Page 6

মিসির আলির চশমা || Humayun Ahmed

আজ সোমবার।

মিসির আলি সাহেবের চিঠিকন্যা শায়লার আমাদের এখানে ডিনারের নিমন্ত্রণ। তিনি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। টেলিফোনে জানিয়েছেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ চলে আসবেন।

আমি কয়েকটি কারণে কিছুটা উত্তেজনার মধ্যে আছি। প্রথম কারণ, অতিথির জন্যে রান্নার দায়িত্ব পড়েছে আমার। মেনু মিসির আলি ঠিক করে দিয়েছেন

স্টার্টার : জিরাপানি

সাইড ডিস : বেগুন ভর্তা, টমেটো ভর্তা।

মেইন ডিস : ইস্ত্ৰি ইলিশ

ফিনিশিং : মুগের ডাল

ডেজার্ট : দৈ।

মেইন ডিস নিয়ে আমি যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছি। মেইন ডিসের নামই দুশ্চিন্তার জন্যে যথেষ্ট ইস্ত্ৰি ইলিশ। এই রান্না মিসির আলির আবিষ্কার। ইলিশ মাছে সর্ষে বাটা, কাঁচামরিচ এবং লবণ দেয়ার পর লাউপাতা দিয়ে মুড়তে হবে। তারপর গরম ইস্ত্রির নিচে বসিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর মাছ উল্টে আবার ইস্ত্ৰি চাপা। দেয়া। ইস্ত্রি দিয়ে কতক্ষণ চাপা দিয়ে রাখতে হবে, সেই সম্পর্কে মিসির আলি কিছু বলছেন না। আমার ধারণা মেইন ডিস হবে কাঁচামাছ।

মিসির আলিকে এই কথা বলতেই তিনি বললেন, কাঁচামাছ তো খারাপ কিছু না। জাপানিরা সুসি খায়। সুসি বানানো হয় কাঁচামাছ দিয়ে।

সমস্যা হচ্ছে আমরা জাপানি না, কাঁচামাছ খেতে অভ্যস্ত না। কাজেই আমি সকাল থেকে Stop watch দিয়ে ইস্ত্ৰিচাপা দেয়ার সময়টা বের করার চেষ্টা করছি। একটা ইলিশ মাছের লেজ এবং মাথা ছাড়া পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। এখন Experient শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ইলিশ মাছ দিয়ে। যথেষ্টই টেনশন বোধ করছি। আমি একদিনের টেনশনেই অস্থির, বাংলাদেশের মেয়েরা রোজই এই টেনশনের ভেতর দিয়ে যায়— এটা ভেবে খুব অবাক লাগছে।

সন্ধ্যা থেকে ঝুম বৃষ্টি।

সাতটার মধ্যে ঢাকা শহরের সব রাস্তায় পানি। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কাটায় কাটায় সাতটায় শায়লা উপস্থিত হলেন। তখনি। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমার মাথায় হাত। ইলেকট্রিসিটি ছাড়া বিখ্যাত ইস্ত্ৰি ইলিশ তৈরি হবে না।

বসার ঘরের টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মোমবাতির আলোয় শায়লা নামের মহিলাকে অপরূপ দেখাচ্ছে। অধ্যাপিকারা পড়াতে জানেন, সাজতে জানেন না কথাটা ঠিক না। শায়লা অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করতে করতে বললেন, ভুলভাল চিঠি লিখে আপনাকে বিরক্ত করেছি। বাবা আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?

মিসির আলি হাসলেন। শায়লা বললেন, ক্ষমা করে থাকলে মাথায় হাত রাখুন। মিসির আলি মাথায় হাত রাখলেন। সুন্দর সন্ধ্যা শুরু হলো। আমরা তিনজন একসঙ্গে বসেছি। আমাদের সামনে লেবু চা। ঝড়-বৃষ্টির রাতে লেবু চায়ে চুমুক দিতে অসাধারণ লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। হাওয়ায় মোমবাতির শিখা কাঁপছে। এখন মনে হচ্ছে ঝড়-বৃষ্টির রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া এমন খারাপ কিছু না।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তোমার হ্যান্ডব্যাগে কি সব সময় পটাসিয়াম সায়ানাইড রাখ?

শায়লার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল। শায়লার কথা বাদ থাকুক, আমি নিজেই। হকচকিয়ে গেলাম। শায়লা যদি তার হ্যান্ডব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড রেখেও থাকেন মিসির আলির পক্ষে তা জানা কোনোক্রমেই সম্ভব না। উনার আর যাই থাকুক। X-ray চোখ নেই।

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, তোমার ব্যাগে পটাসিয়াম সায়ানাইডের একটা ফাইল আছে কী করে সেটা বুঝলাম তোমাকে বলি। পটাশিয়াম সায়ানাইড নিয়ে তোমার অবসেশান। আছে। শ্বশুরবাড়িতে এই শব্দটা তুমি প্রায়ই উচ্চারণ করো। যে কারণে তোমার শাশুড়িও শব্দটি শিখেছেন এবং তার পুত্রকে সাবধান করেছেন।

কেমিস্ট্রির শিক্ষক হিসেবে পটাশিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করা তোমার পক্ষে কোনো বিষয় না। তারচেয়েও বড় কথা তুমি M. S করেছে New York ইউনিভার্সিটি থেকে। তোমার থিসিস ছিল কোনো একটি Inorganic যৌগে KCN-এর সাহায্যে Carbon যুক্ত করা। Inorganic যৌগের নামটা যেন কী?

শায়লা যন্ত্রের মত বললেন, সিলিনিয়াস হাইড্রাইড।

মিসির আলি বললেন, এই ঘরে ঢোকার পর থেকে লক্ষ করছি, তুমি তোমার হ্যান্ডব্যাগ শরীরের সঙ্গে শুধু যে জড়িয়ে রেখেছ তা-না, শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকেও রাখছ। বাতাসের ঝাপটায় একবার তোমার শাড়ির আঁচল সরেও গেল। তুমি সঙ্গে সঙ্গে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে তোমার ব্যাগটা ঢাকলে। এখন বলো তোমার ব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে না? তুমি যদি বলো নাই তাহলে নাই। আমি তোমার ব্যাগ খুলে দেখব না।

শায়লা বিড়বিড় করে বললেন, পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে। ত্রিশ গ্রামের একটা ফাইল।

চোখ কপালে উঠার ব্যাপারটা বাগধারায় আছে। বাস্তবে এই ঘটনা কখনো ঘটে না। ঘটার সামান্য সম্ভাবনা থাকলে আমার চোখ কপালে উঠে থাকত।

মিসির আলি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে একটা খাম রাখতে দিয়েছিলাম। খামটা আজ ভোলা হবে এবং খামে কী লেখা পড়া হবে।

আমি খাম এনে নিজের জায়গায় বসলাম। মিসির আলি শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি প্রথম চিঠিতে জানতে চেয়েছিলে তোমার পুত্ৰ সাগরের হত্যাকারী কে তা তুমি জানো। আমি জানি কি-না? আমিও জানি। সেটা একটা কাগজে লিখে রাখতে দিয়েছিলাম। তোমার সামনে একদিন খুব এই আশায়। এখন খোলা হবে।

মিসির আলি বললেন, কাগজে কী লেখা পড়ুন।

আমি বললাম, কাগজে লেখা

‘আ মারপ এক
ন্যা’।

মিসির আলি বললেন, অতি সহজ সাংকেতিক ভাষায় লিখেছি। অক্ষরগুলি আগ পিছে করলেই মূলটা বের হবে।

আমি লিখেছি–

‘আমার পত্র
কন্যা।‘

আমি শায়লার দিকে তাকালাম, তার চেহারা ভাবলেশহীন। কী ঘটছে না ঘটছে তা সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

মিসির আলি বললেন, ডায়লা তুমি বিয়ের পর M.S. করতে আমেরিকা যাও, ঠিক না?

শায়লা হা-সূচক মাথা নাড়ল।

জালাল আহমেদের সঙ্গে সেখানেই তোমার পরিচয়?

হ্যাঁ।

সাগর নামের ছেলেটি কি তোমাদের অবৈধ সন্তান?

শায়লা মুখ তুলে তাকালেন এবং কঠিন গলায় বললেন, না। আমি হারুনকে নিয়মমাফিক তালাক দিয়ে জালালকে বিয়ে করি। হারুনের সঙ্গে এমনিতেই আমার বিয়ে বৈধ ছিল না। আপনি এত কিছু জেনেছেন, এই তথ্যও নিশ্চয়ই জানেন সে Impotent.

জানি।

পুরো ইসলামি মতে নিউইয়র্কের এক মসজিদে আমাদের বিয়ে হয়। তারপরই সমস্যা শুরু হয়।

কী সমস্যা?

তার ধারণা হয় আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। যে-কোনো সময় তাকে আমি খুন। করতে পারি। এইসব হাবিজাবি।

ডা. হারুনের যে সমস্যা আছে সেই সমস্যা?

হ্যাঁ।

আমাদের যে বাচ্চাটা হয়–সাগর, সেই বাচ্চাটাকে জালাল সরিয়ে ফেলেছিল। তার ধারণা হয়েছিল বাচ্চাটাকেও আমি মেরে ফেলব। সে সাগরকে তার এক আত্মীয় বাড়িতে সরিয়ে দিয়েছিল যাতে আমি বুঝতে না পারি সে কোথায়। আমি ইচ্ছা করলে পুলিশের সাহায্য নিয়ে বাচ্চা বের করে ফেলতে পারতাম। তা করি নি। নিজেই খুঁজে খুঁজে বের করেছি সে কোথায় আছে। আমি আমার ছেলের খোঁজে জ্যাকসন হাইটের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জানলাম, তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি এক কাপ কফি খাব। কফি কি আছে? মানুষ চলে যায় তার কিছু অভ্যাস রেখে যায়। জালাল নেই কিন্তু তার কফির অভ্যাস আমার মধ্যে রেখে গেছে।

আমি কফি বানিয়ে শায়লার সামনে ধরলাম। শায়লা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বলল, জালাল যে নিউইয়র্কের এক সাবওয়েতে কফি খেতে খেতে মারা গিয়েছিল এই খবর কি আপনি জোগাড় করেছেন?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।

সে হার্ট এটাকে মারা যায় নি। কফিতে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে খেয়েছিল। সে সুইসাইড করেছিল। পটাশিয়াম সায়ানাইড চুরি করেছিল আমার কাছ থেকে। নিউইয়র্ক পুলিশের বুদ্ধির কত নামধাম শুনি, তারা ধরতে পারে নি। তারা ভেবেছে হার্ট এটাক।

তার মৃত্যুর পর আমি দেশে ফিরে আসি। বাস করতে থাকি হারুনের সঙ্গে। এমনভাবে বাস করি যেন মাঝখানের দু’টা বছর হঠাৎ বাদ পড়ে গেছে। হারুন কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে নি। আমিও কিছু বলিনি। আমার শাশুড়ি ব্যাপারটা একেবারেই মেনে নেন নি। তিনি আমাকে হজম করেছেন কারণ আমাকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন। তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে আমি জালালকে খুন করে ফিরে এসেছি তার ছেলেকে খুন করতে। বাবা, আপনার বুদ্ধি আপনার লজিকের সিঁড়ি তৈরি করার ক্ষমতার কোনো তুলনা নেই। আমি ব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড নিয়ে ঘুরি— এটা পর্যন্ত বের করে ফেলেছেন। কিন্তু আমার বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল।

মিসির আলি বললেন, তোমার ছেলে সাগর কোথায় আছে?

সে তার দাদুর সঙ্গে থাকে। ঐ বাড়িতে আমার যাওয়া নিষেধ। তবে হারুন ঐ বাড়িতে যায়। আমার ছেলে তাকে খুব পছন্দ করে। হারুনই তাকে আমার সঙ্গে দেখা করানোর জন্যে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। ছেলেটি তার বাবার চেয়েও অনেক সুন্দর হয়েছে।

ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। আমি ইস্ত্ৰি ইলিশ বানানোয় ব্যস্ত। মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত। সন্ধ্যার পর থেকে অনেক ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে তাল রাখতে সমস্যা হচ্ছে। শায়লা পুরোপুরি সত্যি বলছে এটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না। মিসির আলিকে দেখে কিছু বুঝতে পারছি না।

রাত নটায় দরজার কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খোলার জন্যে উঠে দাঁড়াল শায়লা। লজ্জিত গলায় বলল, আমি হারুনকে রাত নটায় ডিনার খেতে এখানে আসতে বলেছি। ওকে বাদ দিয়ে ডিনার খেতে খুব খারাপ লাগবে।

মিসির বললেন, ভালো করেছ। আমার উচিত ছিল দু’জনকে দাওয়াত দেয়া।

শায়লা বললেন, হারুনকে বলেছি। সাগরকেও যেন নিয়ে আসে। মনে হয় এনেছে।

দরজা খোলা হলো। হারুন সাহেব এক গোছা দোলনচাপা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে যে শিশুটি দাঁড়িয়ে আছে সে দোলনচাপার চেয়েও সুন্দর।

শায়লা বললেন, আমার দুষ্ট বাবাটা কোথায়?

সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরল।

মিসির আলি বললেন, শায়লা! তোমার দুষ্ট বাবুটাকে একটু আমার কাছে আনো। তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *