মা : 08
সময় এগিয়ে চলে, অভাব কিছুটা কমলেও একটা অদ্ভুত আতঙ্কে যেন জরাগ্রস্ত হতে থাকে ওরা দুজনেই। পাঁচ মাসের সাধে ফল মিষ্টি, শাড়ি নিয়ে মেরির মা এলে শাশুড়ি বলে বাচ্চা হতে অনেক খরচ কোথায় পাবে বেটা জানি না, খেটে খেটে নিজের শরীরের কি দশা হয়েছে দেখেছো,এই কথার উত্তরে মেরির মায়ের চুপ হয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না, মেরির যেন মিষ্টির স্বাদ তিতো ঠেকে! দ্যুলোক সেদিন রাতে মেরিকে বলে অভাবের ঘরের বৌ তুই , নিজের যত্ন লিবি,যেমনি হোক সে যেন সুস্থ হয়ে জন্মায় না হলে যে নিজেদের ক্ষমা করতে পারবোনা। মেরির চোখে যেন এক অচেনা ভালো মানুষ ধরা দেয়,যে উদের জন্য দিনরাত খেটে উপায় করে, কোনোরকম নেশা করে না। দিনের শেষে স্বস্তির ঘুম আসে, পরদিন ঘুম থেকে উঠে সামনের গাছে ফুল দেখে মনে হয় বোধহয় সুখ বলতে এটুকুই…. হাসপাতাল ঘর সংসারে সময় এগিয়ে চলে মেরির… নয়মাসে হঠাৎ একদিন কলতলায় কাপড় কাচতে গিয়ে সাবানের ফেনায় পিছলে পড়ে যায় মেরি,পাশের বাড়ির বুড়ি মাসি ছুটে আসে, দ্যুলোককে কোনোরকমে খবর দেয় ফোন করে মেরি, দ্যুলোক যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বুড়ি মাসি বলে জল ভেঙেছে পড়ে গিয়ে, তুমি নার্সিংহোমে নিয়ে যাও বাবা, জবা আজ হাসপাতালে গিয়েছিলো ডাক্তারবাবু আজ আসেননি, দেরি হয়ে গেলে যদি বিপদ বাড়ে তখন আফশোসের শেষ থাকবে না দ্যুলোক মাথা চেপে ধরে বলে কিন্তু খরচ? মাসিমা: সাস্থ সাথি কার্ডে কিছু খরচ কমবে, আমার জমানো কিছু আছে নিয়ে যাও পরে আস্তে আস্তে দিয়ে দিও। দ্যুলোক আমি কিছু টাকা এনেছি বড়ো বাবুর থেকে।মাসি: তবু নিয়ে রাখো, এখন একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকো। অ্যাম্বুলেন্স করে নার্সিংহোমে পৌঁছে দ্যুলোক ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে কার্ড দেখিয়ে বলে বৌ এর জল ভেঙেছে পড়ে গিয়ে, বাধ্য হয়ে এখানে এনেছি,গরীব মানুষ দাদা একটু দেখবেন। ক্যাশিয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে আমাদের খরচ চালাতে হয়, প্যাথলজি পরীক্ষা, ডাক্তারের ফিস আছে, চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে,আচ্ছা তোমারটা আমি কথা বলবো এখন কিছু টাকা জমা করো,ভর্তির ফরম এ সই না টিপছাপ দেবে? দ্যুলোক: সই করতে পারি। হাজার পাঁচেক টাকা জমা করে, সই করে… তারপর বৌ এর কাছে গিয়ে বলে চিন্তা করিস না, এখানের ডাক্তারবাবুর খুব পশার, এখন চুপ করে শুয়ে থাক।পর পর ইঞ্জেকশন, স্যালাইন দেওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ে মেরি, দুপুরে ভাত দেওয়ার সময় নার্স প্রেসার দেখে বলে খুব চিন্তা করছো, প্রেসার এতো বেশি! তুমি চিন্তা করে বাচ্ছার ক্ষতি করছো, ঠাকুরকে ডাকো,এই ডাক্তারবাবু খুব ভালো। বিকালে কয়েকটি টেস্ট হয়েছে, ভিজিটিং এর সময় মেরির মা বলে চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে, দ্যুলোক খুব চেষ্টা করছে, তোদের ভালো হোক ঠাকুরের কাছে এই প্রার্থনা করি সব সময়, শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখের জল মোছে। মাঝরাতে মেরির ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে, একটু দূরে ওটির আলো জ্বলছে, তাহলে নতুন কোনো রুগি হয়তো নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে যার ওটি চলছে। আস্তে আস্তে আবার ঘুমিয়ে পড়ে মেরি। সকালবেলা ডিউটি নার্সেরা যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে চলেছে চাপা স্বরে, চোখে মুখে যেন চিন্তাগ্রস্ত। মেরির কাছে আয়া পরিষ্কার করতে এলে মেরি জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে জানো? ওদিকে কারা যেন কাঁদছে শুনতে পাচ্ছি…আশেপাশে যেন সবাইকে যেন কেমন লাগছে!আয়া আশেপাশের দিকে তাকাতে তাকাতে বলে একটা লোক মরেছে গো ভোর রাতে,তাই নিয়ে জটলা, এখন এখানে কাজ করতে হয় সমঝে বুঝে, তুমি আর কাউকে কিছু বলতে যেও না, তোমার বোধহয় কাল সিজার হবে শুনলাম যেন, এখন নিজের খেয়াল রাখো বাপু,অন্যের হাঁড়ির খবরে তোমার লাভ কি? মেরি চুপ করে বসে থাকে ঠেস দিয়ে, কাল সিজার হবে?ভয়ে যেন চোখ মুখ বসে যায়। একটু পরে দ্যুলোক ওষুধ দিতে আসে, মেরি জিগ্গেস করে কাল সিজার হবে? সেতো অনেক খরচ, কোথায় পাবে? দ্যুলোক: হুম, সবাই মিলে কিছু কিছু দিছে, অসুবিধা নেই, তোদের যেন সুস্থ করে ঘরে ফিরতে পারি,তুই চিন্তা করিস না, এখানের লোক ভালো, ডাক্তারবাবুকে বলে কিছু টাকা কম হয়েছে। মেরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে চিন্তা কম করে, তবে প্রেসার কমবে। মাঝরাতে ঘুমের মাঝে মনে হয় কারা যেন ওর মুখ চেপে ধরেছে ঘুম ভেঙে যায়, একটু পাশ ফিরে শুয়ে আবার যেন ফিসফিস করে কথা শুনতে পায়।ধরা পড়লে বিপদ, এভাবে ওটি থেকে সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি সরিয়ে পাঠানো সম্ভব!আমরা যে কোন দিকে যাই, চিন্তা হয় ফেঁসে না যাই।মেরির মনে হয় নার্সিংহোমে কিছু একটা গন্ডগোল চলছে, হয়তো ওষুধ কিছু সরিয়ে রাখে ওরা, কিন্তু শরীরটা দূর্বল, আবার ঘুমিয়ে পড়ে।