পরদিন ভোর ছটায় উঠতে হল
পরদিন ভোর ছটায় উঠতে হল। শুধু আমাকে নয়, যাদের শুটিং-এ দরকার হবে তাদের সকলকেই ভোর ছটায় চা এনে দিয়ে উঠিয়ে দিল পঞ্চানন বেয়ারা। ব্রেকফাস্ট পরে হবে–এটা ছিল যাকে বলে বেড-টি। আমার এ জিনিসে অভ্যাস নেই, কিন্তু এখানে আর সকলের সঙ্গে চা খেতে মোটেই খারাপ লাগল না। আজমীরে অক্টোবর মাসে সকালে একটা শীত শীত ভাব থাকে, তাই মমতামাসি আমাকে জোর করে একটা পুলোভার পরিয়ে দিলেন। রোদ বাড়লে সেটা খুলে ফেললেই হবে।
গতকাল রিহার্সাল ভালই হয়েছে। আমার যেটুকু ভয়-ভয় ভাব ছিল সেটা অন্যদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে একদম কেটে গেছে। রাজবাড়িতে কিছু ছোট পার্ট করার জন্য আজমীর থেকেই তিনজন বাঙালিকে নেওয়া হয়েছে; তারা এখানের বহুদিনের বাসিন্দা। বিশুদাই খোঁজ করে তাদের জোগাড় করে এনেছে। বিশুদাকে সারাক্ষণ চরকিবাজির মতো ঘুরতে হয়। ওর কাজটাকে বলে প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজ। এই একজন লোক যার এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেই।
আজ সকালে নটা থেকে কাজ আরম্ভ হবার কথা। একটার সময় লাঞ্চের জন্য একঘণ্টা ছুটি, তারপর আবার দুটো থেকে কাজ। আমার কাজটা বিকেলের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। সন্ধ্যার পরেও কাজ আছে, তাতে তিন গুণ্ডাকে দরকার হবে আর আমাকে লাগবে মাত্র একটা শটের জন্য। মগনলাল। গুণ্ডা তার দুই শাকরেদকে নিয়ে রাজবাড়ির পাঁচিলের বাইরে হানা দিতে এসেছে। তারা মতলব করছে। রাজকুমার অমৃৎকে নিয়ে পালাবে, তারই সুযোগ খুঁজছে। রাজবাড়ির বাইরে থেকে দোতলার একটা ঘরে তারা অমৃৎকে দেখতে পায়। অমৃৎ এ-ঘর সে-ঘর খেলা করে বেড়াচ্ছে, আর ছগনলাল তাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছে। এই হল দৃশ্য।
আজ আমাদের সব গাড়িগুলোকেই দরকার হল। বাসের মাথায় প্রথমে চাপানো হল ক্যামেরা চলার জন্য রেলগাড়ির মতো লাইন। টুকরো-টুকরো আট দশ ফুটের লাইন পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে বড় লাইন হয়ে যায়। তার উপর দিয়ে চলে চাকাওয়ালা গাড়ি, যাকে বলে ট্রলি, আর সেই ট্রলির উপর বসে ক্যামেরা। এই ট্রলিও উঠেছে বাসের মাথায়। আর উঠেছে স্টুডিওর বড় বড় আলো। দিনের বেলাও ঘরের ভিতর কাজ করতে বাইরে থেকে আসা আলোর সঙ্গে বাড়তি ইলেকট্রিক আলো যোগ করতে হয়।
আজ সকালে আমি ছাড়া অ্যাটিং–এর জন্য দরকার হবে রাজা, রানি, দেওয়ান আর আরও জনা তিনেক লোক, যাদের কোনও কথা বলতে হবে না। এদের বলা হয় একা, আর এদের সবাইকে আজমীরেই পাওয়া গেছে। এখানে একটা হিন্দি নাটকের দল আছে, তারা গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল সার্কিট হাউসে। তারা বলে গেছে তোক দিয়ে সাহায্য করবে।
সাড়ে সাতটার সময় আমাদের গাড়ি আর বাস রওনা দিয়ে দিল। মিঃ লোহিয়ার বাড়ি যেতে দশ মিনিট লাগে, কাজেই সময় আছে অনেক। কিন্তু তোড়জোড়ে যে অনেক সময় বেরিয়ে যায় সেটা আমি একদিন স্টুডিওতে টেস্ট দিয়েই বুঝেছি। যিনি রাজা সাজবেন, সেই পুলকেশ ব্যানার্জি প্রায় পনেরো বছর হল ফিল্মে অ্যাকটিং করছেন। সেইসঙ্গে থিয়েটারও করেন। তিনি গাড়িতে আমার পাশেই বসেছিলেন, যাবার পথে বললেন, এসো মাস্টার অংশুমান, আমাদের পার্টগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আমারও আপত্তি নেই, তাই গাড়ি চলতে চলতেই কয়েকটা রিহার্সাল দিয়ে দিলাম।
রাজবাড়িতে পৌঁছে আগে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেওয়া হল। মিঃ লোহিয়া পুরো একতলাটা ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য। তা ছাড়া শুটিং-এর জন্য দোতলার তিনটে ঘর ছাড়া আছে। সেসব ঘরে চেয়ার টেবিল কার্পেট ছবি ঝাড়-লণ্ঠন সবই রয়েছে, আর সেগুলোই ছবিতে ব্যবহার করা হবে। ঘরে রাখার জন্য কলকাতা থেকে প্রায় কিছুই আনতে হয়নি।
যতক্ষণ একতলায় খাওয়া হচ্ছে, ততক্ষণে কাজের জিনিসপত্র দোতলায় যে ঘরে শুটিং হবে সেখানে চলে গেল। পুলকেশবাবু আর মমতামাসি খাওয়া শেষ করেই একতলার বারান্দায় মেক-আপ করার। জন্য বসে গেলেন। আমাকে রঙ মাখতে হবে না, শুধু চুলটাকে একটু অন্যরকমভাবে আঁচড়ে নিতে হবে। খানিকটা সময় আছে, তাই ভাবছি কী করব, এমন সময় একটা আওয়াজ শুনে আমার চোখ চলে গেল বাড়ির সামনের মাঠের দিকে। একটা মোটরসাইকেল মাঠের উপর ফটফটিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তাতে চড়ে আছে বিশুদা।
দুপাক ঘুরেই বিশুদা সাইকেলটাকে আমার সামনেই এনে দাঁড় করিয়ে বলল, আয়, পেছনে বোস। দু চক্কর ঘুরিয়ে আনি তোকে।
আমি জানি যে গল্পে ইনস্পেক্টর সূর্যকান্তর সঙ্গে আমাকে মোটরবাইকের পিছনে চড়তে হবে, তাই ক্যারিয়ারে উঠে বসলাম, আর বিশুদা প্রচণ্ড শব্দ করে বাইক ছেড়ে দিল। আমার হাত দুটো বিশুদার কোমরে জড়ানো, কানের পাশ দিয়ে শনশন্ করে হাওয়া যাচ্ছে, এ এক দারুণ মজা। বিশুদা যে এত ভাল মোটরবাইক চালায় সেটা জানতামই না। সে মোটরগাড়ি চালায় অবিশ্যি অনেকদিন থেকেই।
তিন পাক ঘুরে বাইকটাকে আবার বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করাল বিশুদা। এও একটা রিহার্সাল বইকী! আমার মন বলছে স্টান্টম্যান যদি তেমন ওস্তাদ হয়, তা হলে তার পিছনে চড়তে আমার কোনও ভয় লাগবে না। গল্পে এক জায়গায় আছে ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত মোহনকে ডাকাতদের হাত থেকে উদ্ধার করে মোটরসাইকেলে ছুটে চলেছে, আর ডাকাতরা তাদের তাড়া করেছে অ্যাম্বাসাডরে। তাদের এড়াবার জন্য সূর্যকান্ত রাস্তা ছেড়ে এবড়ো-খেবড়ো মাঠে নেমে পড়েছে। মোহন আঁকড়ে ধরে আছে। সূর্যকান্তর কোমর আর বাইক বেদম স্পিডে লাফাতে লাফাতে ছুটে চলেছে মাঠের উপর দিয়ে। আর তারপর? এটাই আসল, এখানেই হাততালি পড়বে সিনেমা হলে–মাঠ থেকে বাইক কাঁচা রাস্তায় নেমেছে, ডাকাতদের গাড়ি আবার তাদের পিছু নিয়েছে, এবার রাস্তা হঠাৎ চড়াই ওঠে। ওঠবার আগে মোটরসাইকেলের স্পিড ভীষণ বাড়িয়ে দেয় সূর্যকান্ত। তার কারণ আর কিছুই না–সামনে একটা দশ হাত চওড়া নালা, তাতে জল বইছে তেড়ে, সেই নালা এক লাফে পেরিয়ে উলটো দিকের উতরাইতে পড়তে হবে। গল্পে অবিশ্যি আছে সূর্যকান্ত স্বচ্ছন্দে নালা টপকে পেরিয়ে গেল, কিন্তু শুটিং-এ বম্বের স্টান্টম্যান সেটা পারবে কি? আর সেটা করার সময় কি আমাকেই থাকতে হবে মোটর সাইকেলের ক্যারিয়ারে স্টান্টম্যানের কোমর জড়িয়ে ধরে?
এ বিষয় এখন কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভাল। যা হবার সে তো পরে জানতেই পারব। কাজটা ভাল হবার জন্য যদি আমাকেই থাকতে হয় তা হলে তাই করব।
সাইকেল থেকে নেমে বিশুদা বলল, সূর্যকান্তর জন্য এই বাইকটা ভাড়া করা হল। আশা করি ক্যাপ্টেনের পছন্দ হবে।
ক্যাপ্টেন? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ক্যাপ্টেন আবার কে?
ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ, বলল বিশুদা, স্টান্টম্যান। আজ রাত্তিরে আসছে বম্বে থেকে।
কৃষ্ণণ! বম্বে থেকে এলেও লোকটা যে মাদ্রাজি সেটা নাম শুনেই বুঝতে পারলাম।