বাবা কলেজে ইতিহাস পড়ান
বাবা কলেজে ইতিহাস পড়ান, তিনিই আমাকে বলেছিলেন যে, আজমীর শহরটা ঘোড়শ শতাব্দীতে আকবর দখল করে নেন মারওয়াড় অধিপতি মালদেও-এর হাত থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আজমীর ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। আজমীর থেকে এগারো কিলোমিটার পশ্চিমে হল পুষ্কর। এটা হল হিন্দুদের একটা বড় তীর্থস্থান। এখানে একটা হ্রদ আছে যেটাকে ঘিরে প্রতি বছর কার্তিক মাসে একটা মেলা বসে, যাতে লাখের উপর লোক আসে। আমাদের ফিল্মের গল্পে অবিশ্যি আজমীর হয়ে যাচ্ছে কাল্পনিক শহর হিণ্ডোলগড়। আমাদের ফিল্মের নামও হিণ্ডোলগড়। পুষ্কর অবিশ্যি পুষ্করই থাকছে, আর এই পুষ্করের মেলাতেই ইস্কুল মাস্টারের ছেলে মোহনের সঙ্গে রাজকুমার অমৃৎ সিং-এর আলাপ হচ্ছে।
রাত করে আজমীর পৌঁছে আমরা সোজা চলে গেলাম সার্কিট হাউসে। এইখানেই নি সপ্তাহের জন্য আমরা থাকব। বেশ বড় সার্কিট হাউস, দোতলায় উত্তর আর পশ্চিমে চওড়া বারান্দা, সেখানে দাঁড়ালেই উত্তরে প্রকাণ্ড আনা সাগর লেক, আর পশ্চিমে পাহাড় দেখা যায়। রাত্তিরে অবিশ্যি দেখার কিছুই নেই, কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমরা একটা অদ্ভুত জায়গায় অদ্ভুত বাড়িতে এসে পড়েছি। আকাশে তিনভাগের একভাগ চাঁদের ফিকে আলো পাতলা কুয়াশায় ঢাকা লেকের জলে পড়ে দারুণ দেখাচ্ছে। দূরে শহরে কোথায় যেন ঢোলক বাজিয়ে গান হচ্ছে, এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
আমি বারান্দার রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বিশুদা এসে বলল, চ তোর ঘর ঠিক হয়ে গেছে, মমতাদি শোবেন একই ঘরে; তোর কোনও ভয় নেই।
ভয় আমার এমনিতেই ছিল না। এত লোকের সঙ্গে একসঙ্গে থাকব, তাতে আবার ভয় কীসের? আমার কাজ কবে থেকে শুরু? আমি জিজ্ঞেস করলাম বিশুদাকে।
ও বলল, কাল একবার পুষ্কর দেখতে যাওয়া হবে, আর যে বাড়িটা রাজবাড়ি হবে সেই বাড়িটা। কাজ শুরু পরশু থেকে।
কথার মাঝখানে মমতামাসি এসে বললেন, কী অংশু, মার জন্য মন কেমন করছে?
সত্যি বলতে কি, বাড়ির কথা একবারও মনে হয়নি, আর সেটাই বললাম মমতামাসিকে।
এই তো চাই, বললেন মমতামাসি। আমি যদ্দিন আছি তদ্দিন আমিই কিন্তু তোমার মা, বুঝেছ? কোনও অসুবিধা হলে আমাকে বলবে।
রাত্তিরে ঘুমটা ভালই হল।
সকালে উঠে বারান্দায় বেরোতেই প্রথম সত্যি করে লেকটা দেখতে পেলাম। বিরাট লেক, ওপারের সবকিছু ছোট ছোট দেখাচ্ছে। জলে অসংখ্য হাঁস চরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়টা বেশ উঁচু, একেবারে লেকের জল থেকে উঠেছে বলে মনে হয়।
ডিম রুটি আর চমৎকার বড় বড় জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নটার সময় প্রথম দেখতে গেলাম হিরে জহরতের ব্যবসায়ী ধনী স্বরূপলাল লোহিয়ার বাড়ি। দলের বেশিরভাগ লোকই সার্কিট হাউসে রয়ে গেছে, বেরিয়েছি শুধু ছজন–আমি, বিশুদা, সুশীলবাবু, সুশীলবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট মুকুল চৌধুরী, ক্যামেরাম্যান ধীরেশ বোস আর গল্পের লেখক সুকান্ত গুপ্ত। একটা বড় বাস আর তিনটে ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়েছে তিন সপ্তাহের জন্য, তার মধ্যে দুটো ট্যাক্সি আজ খাটছে। মিঃ লোহিয়ার বাড়িটাকে বাড়ি বললে ভুল হবে; বরং দুর্গ বলা উচিত। চারদিকে পরিখা নেই বটে, কিন্তু গাছপালা পুকুর মন্দির সমেত জমি রয়েছে বিশাল। এই কেল্লাই হবে রাজবাড়ি, আর এই বাড়ির ছেলেই হবে অমৃৎ সিং।
সত্যি বলতে কি, এরকম বাড়ি আমি কখনও দেখিনি। হলদে পাথরের তৈরি। কতকালের যে পুরনো তা দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই। মোঘল আমলের হলেও অবাক হব না। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঠিক বলে জানা গেল।
মিঃ লোহিয়ার বয়স ষাটের উপর। ধবধবে সাদা চুল আর চাড়া দেওয়া বিরাট সাদা গোঁফ। আমাদের সবাইকে খুব খাতির করে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বললেন তিনি ফিল্ম বেশি দেখেন না। তবে বাংলা আর বাঙালিদের খুব ভালবাসেন। তাঁর এক মামাতো ভাইয়ের পরিবার নাকি দুশ বছর ধরে কলকাতায় থেকে ব্যবসা করছে। এই মামাতো ভাই মতিলাল চুনৌরিয়ার সঙ্গে আমাদের ছরি প্রোডিউসারের আলাপ ছিল। তিনিই মিঃ লোহিয়াকে চিঠি লিখে আমাদের শুটিং-এর বন্দোবস্তটা করে দিয়েছেন। একটা সুবিধা হচ্ছে যে, এ বাড়ির লোকের তুলনায় ঘরের সংখ্যাটা অনেক বেশি। তার মধ্যে কয়েকটা ঘরে শুটিং হলে বাড়ির লোকের কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়।
মিঃ লোহিয়া আমাদের চা আর লাড্ড খাওয়ালেন, আর তারপর তাঁর কিছু হিরে জহরত বার করে দেখালেন। দেখে আরেকবার চোখটা টেরিয়ে গেল। সবশেষে একটা নীল পাথর দেখালেন তার সাইজ একটা পায়রার ডিমের মতো, সেটার নাম নীলকান্তমণি। এরকম পাথর নাকি খুব কমই পাওয়া যায়। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল সেটার দাম জিজ্ঞেস করার; শেষ পর্যন্ত সুশীলবাবুই সেটা করলেন। তাতে মিঃ লোহিয়া একটু হেসে বললেন, ইট ইজ প্রাইসলেস। তার মানে এর দামের কোনও হিসেব হয় না। মনে মনে ভাবলাম, বাড়ির গেটে কি সাধে বন্দুকধারী দরোয়ান রেখেছেন লোহিয়া সাহেব? এই এক বাড়িতে কোটি কোটি টাকার ধনরত্ন রয়েছে।
মিঃ লোহিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা গেলাম পুষ্কর। পথে একটা গিরিব পড়ে যেটা প্রায় এক মাইল লম্বা। দুদিকে খাড়া পাহাড়, আর তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা। পুষ্কর পৌঁছতে লাগল কুড়ি মিনিট।
সুকান্তবাবুর খুব পড়ার বাতিক; তিনিই রাজস্থান সম্বন্ধে অনেক কিছু পড়ে এসেছেন; তিনিই বললেন যে দেড় হাজার বছর আগেও নাকি পুষ্কর ছিল ভারতবর্ষের একটা প্রধান তীর্থস্থান। হ্রদের পাশের মন্দিরগুলো আওরঙ্গজেব ভেঙে ফেললেন, তার জায়গায় নতুন মন্দির তৈরি করেছে। তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে বিখ্যাত সেটা হল ব্রহ্মার মন্দির। ভারতবর্ষে এটাই নাকি একমাত্র মন্দির যেখানে ব্রহ্মাকে পুজো করা হয়। মন্দিরের বাইরে উপর দিকে ব্রহ্মার বাহন হাঁসের মূর্তি রয়েছে। আমাদের মধ্যে দুজন-সুশীলবাবু আর লেখক সুকান্তবাবু–মন্দিরে ঢুকে পুজো দিয়ে এলেন।
দুদিন পরেই পুস্করের মেলা আরম্ভ। লেকের দক্ষিণে প্রকাণ্ড খোলা মাঠে মেলার তোড়জোড় চলছে। উট, গোরু আর ঘোড়া আসতে শুরু করেছে। এই তিনটি জিনিসের এতবড় হাট নাকি আর কোথাও বসে না। যেদিকে মেলা বসবে, তার উলটো দিকে খানিকটা অংশে গাছপালা আর একটা পুরনো ভাঙা হাভেলির জায়গাটা সুশীলবাবু আর ক্যামেরাম্যান ধীরেশ বোস বেছে নিলেন অমৃৎ আর মোহনের পোশাক বদল আর কিডন্যাপিং-এর দৃশ্যের জন্য। এইখানেই তিনজন দস্যু এসে অমৃৎবেশী মোহনকে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে পালাবে। অবিশ্যি এই দস্যুরা পুরনো আমলের দস্যু নয়। এরা মোহনকে নিয়ে পালাবে একটা মোটর গাড়িতে, উট বা ঘোড়ায় চড়ে নয়।
পুষ্কর থেকে ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল সাড়ে বারোটা। দুপুরে খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল সার্কিট হাউসের একতলার ডাইনিং রুমে। একসঙ্গে পনেরোজন খেতে বসেছে, হিরো ভিলেন সবাই আছে। বেশ একটা গমগমে পিকনিক-পিকনিক ভাব। এই ভাবটা চলবে যত দিন আজমীরে আছি ততদিন। অবিশ্যি কাজ শুরু হলে ক্রমে ক্রমে সার্কিট হাউসের সঙ্গে সম্পর্কটা কমে আসবে, কারণ সারাদিনই প্রায় বাইরে বাইরে থাকতে হবে।
খেতে খেতে সুশীলবাবু তুললেন মিঃ লোহিয়ার হিরে জহরতের কথা। আমরা নীলকান্তমণির মতো একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে এসেছি বলে যারা যায়নি তারা সকলেই আফসোস করল।
দুপুরে খাবার পর আগামীকাল যে দৃশ্যটা শুটিং হবে সেটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এটা জানি যে ছবির শুটিং ঠিক পর পর গল্পের ঘটনা ধরে হয় না। অনেক সময় পরের দিকের দৃশ্য আগে আর গোড়ার দিকের দৃশ্য শেষে তোলা হয়। যেমন, কালকে যে দৃশ্যটা প্রথম ভোলা হবে সেটা হল মেলা থেকে ফেরার পরের দৃশ্য। যদিও প্রথম দিনের কাজ, কিন্তু খুব সহজ নয়। আমি ফাইলটা খুলে কালকের পার্টটা একবার দেখে নিচ্ছি, এমন সময় বিশুদা এসে বলে গেল যে সন্ধেবেলা বারান্দায় রিহার্সাল হবে; আমি রাজা, রানি, রাজার দেওয়ান–সকলকেই থাকতে হবে। মনে মনে বললাম, এই শুরু হল কাজ।
এই কাজ করতে কত কী কাণ্ড হবে সেটা কি আগে থেকে জানতাম?