Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাস্টার অংশুমান || Satyajit Ray » Page 10

মাস্টার অংশুমান || Satyajit Ray

এই ঘটনার পরে অ্যাকটিং-এর সময় আমার বেশ কয়েকবার কথা গুলিয়ে গিয়ে এন. জি হল। এন. জি. মানে নো গুড। তার মানে শটটা আবার নিতে হবে। শট যদি ঠিক থাকে তা হলে সেটা হয় ও. কে.। একটা শট শেষ হওয়া মাত্র ডিরেক্টর বলে দেন সেটা ও. কে. না এন. জি.। সুশীলবাবু আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন, অংশু, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?কথাটা খুব নরম করে বললেও আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। কারণ আর কিছুই না; নীলকান্তমণির ব্যাপারটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না বলেই যত গণ্ডগোল। বিশেষ করে জগু ওস্তাদের কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছিল, আর মন বলছিল জগু ওস্তাদ নির্দোষ। ও যা বলেছে সেটাই আসলে ঠিক, কেষ্টদা নিশ্চয়ই উলটোপালটা শুনেছে।

দুদিন লাগল মন থেকে নীলকান্তমণির চিন্তাটা তাড়িয়ে দিয়ে অ্যাকটিং করতে। তারপর অবিশ্যি আর এন. জি. হয়নি।

ইনস্পেক্টর মাহেশ্বরী কিন্তু তদন্তের ব্যাপারে বেশ নাজেহাল হচ্ছেন। সে-চাকর শহর ছেড়ে পালিয়েছে বটেই, কিন্তু সে যে কোথায় গা-ঢাকা দিয়েছে সেটা পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও বার করতে পারছেন না।

তেইশ তারিখ সকালে আমার শুটিং ছিল মোহনের বাড়িতে। ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত গুণ্ডাদের হাত থেকে মোহনকে উদ্ধার করে তার বাবার কাছে এনে দিচ্ছে, বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরছে।

এই শুটিং মিঃ মাহেশ্বরী তাঁর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে দেখতে এলেন। বিশুদার প্রশ্নের উত্তরে উনি বললেন যে চোর এখনও ধরা পড়েনি। তবে বিক্রম যে লোক সুবিধের ছিল না তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। বাজারে যাবার নাম করে মদের দোকানে গিয়ে মদ খেত। যেদিন চুরিটা হয় সেদিনও সে মদের দোকানে গিয়েছিল।

পরদিন–চব্বিশ তারিখ–ভীষণ জরুরি দিন। আজকে মোটরবাইকে চড়ে কেষ্টদা আমাকে নিয়ে নালা টপকাবে। এই দৃশ্য তোলার জন্য দুটো বাড়তি ক্যামেরা লোকসমেত বম্বে থেকে এসেছে। সার্কিট হাউসে ঘর খালি করা হয়েছে, তাই তারা সেখানেই এসে উঠেছে, বাইকে নালা পেরনোর ব্যাপারটা একবারের বেশি করা রিস্কি বলে দৃশ্যটা তিনটে ক্যামেরা দিয়ে তিন জায়গা থেকে একই সঙ্গে ভোলা হবে। একটা চড়াই দিয়ে এগোনোর সময়, একটা নালা টপকে পেরোনোর সময়, আর একটা উলটোদিকে উৎরাইয়ের মুখে ল্যান্ড করার সময়।

অবিশ্যি এই সিনের আগে সকালে অন্য কাজ আছে। তাতে তিন গুণ্ডা আর পুলিশের দল লাগবে। পুলিশ ছগনলালের দলকে গ্রেপ্তার করার দৃশ্য। ইনস্পেক্টর মাহেশ্বরী স্থানীয় পুলিশের লোক দিয়েছেন, তারাই শুটিং-এ পুলিশের কাজ করবে। আমার মনে আর এখন কোনও সন্দেহ নেই যে কেষ্টদা ভুল শুনেছিল। জগু ওস্তাদ আসলে নির্দোষ। তাকে ভজাতে চেষ্টা করেছিল বিক্রম, কিন্তু সে রাজি হয়নি। ভাগ্যিস! মিছামিছি জগু ওস্তাদের উপর দোষ চাপালে একটা বিশ্রী ব্যাপার হত!

একটা গোলমেলে ব্যাপার এই যে, আজ সকাল থেকে মেঘলা করেছে। অবিশ্যি হাওয়া আছে বলে মেঘ মাঝে মাঝে সরে গিয়ে রোদ বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিকেলে নালা টপকানোর শট-এর জন্য রোদেরই দরকার, কারণ মোটরবাইক সংক্রান্ত আর সব শটে রোদ রয়েছে। আমি বুঝি গেছি যে এখানেও সেই কনটিনিউইটির ব্যাপার। একই দৃশ্যে দশটা রোদে তোলা শট-এর সঙ্গে একটা মেঘলায় তোলা শট জুড়লে ভীষণ চোখে লাগে। তাই সকাল থেকেই মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি যেন বিকেলে মেঘ সরে গিয়ে রোদ বেরোয়।

দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা গাড়িতে আমি, কেষ্টদা, আর মেক-আপের দুজন লোক, আর অন্য গাড়িতে নতুন দুটো ক্যামেরা, তাদের ক্যামেরাম্যান আর সহকারী নালার শুটিং-এর জন্য বেরিয়ে পড়লাম। অন্যেরা সকাল-সকাল বেরিয়ে গেছে গুণ্ডাদের দৃশ্য তুলতে। তারা সেখান থেকে সোজা চলে যাবে নালার জায়গায়।

পথে হঠাৎ দেখলাম আমাদের তিন নম্বর গাড়িতে জগু ওস্তাদ আর আরও দু তিন জন লোক শুটিং সেরে সার্কিট হাউসে ফিরছে। তার মানে ছগনলালের কাজ শেষ।

সেদিনেরই মতো কুড়ি মিনিট লাগল নালার জায়গাটায় পৌঁছতে। মোটরবাইক আগেই এসে গেছে। বাসের মাথায়। কেষ্টদা আর দেরি না করে বাইকে চড়ে পড়ল। যারা আগে এসেছে তারা সবাই এখন পুরি-তরকারি লাঞ্চ করছে। কেষ্টদা বলল, আমি একবার নালাটা টপকে পেরিয়ে দেখে নিচ্ছি। স্পিডের আন্দাজটা ঠিক করে নিতে হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে দরকার হবে?

কেষ্টদা মাথা নাড়ল–তুমি চড়বে একেবারে শট-এর সময়।

পথের ডান পাশে কিছু দূরে একটা তেঁতুল গাছ, তারই নীচে দলের সকলে খেতে বসেছে। কেষ্টদা চেঁচিয়ে জানিয়ে দিল যে, সে একটা রিহার্সাল করে নিচ্ছে। আজই ওর শেষ কাজ, সেটা হলেই ও বম্বে ফিরে যাবে, হয়তো আর কোনওদিনও দেখা হবে না। এটা মনে হলেই আমার খুব খারাপ লাগছিল।

কেষ্টদা বাইকটাকে দাঁড় করিয়েছে নালা ঘেঁষে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার উপর।

নালার দিকে কেউ নেই তো? হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করল কেষ্টদা।

বিশুদা পরিবেশন করছিল, চেঁচিয়ে বলল, না, সবাই এখানে।

আমি রিহার্সালটা দেখব বলে দৌড়ে নালার ধারে চলে গেলাম। তারপর গলা ছেড়ে হাঁক দিলাম, এসো, কেষ্টদা!

আবার সেই কানফাটা শব্দ, সেই আচমকা ঝোঁপের পিছন থেকে বেরোনো, সেই দমবন্ধ করা লাফ, আর সেই ম্যাজিকের মতো–

কিন্তু এ কী? ওপারে গিয়ে বাইকটা একী হল? সেটা যে মুখ থুবড়ে পড়েছে উতরাইটা পেরিয়েই, আর কেষ্টদা যে বাইক থেকে ছিটকে গিয়ে পড়েছে ঝোঁপের মধ্যে।

বিশুদা!

চিৎকার ছেড়ে জুতো মোজা পরেই নালা পেরিয়ে উলটো দিকে গিয়ে উঠলাম।

মোটরবাইকটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, তার একটা চাকা এখনও বনবন করে ঘুরছে, আর কেষ্টদা রাস্তা থেকে উঠে গা থেকে ধুলো ঝাড়ছে।

আমি স্টান্টম্যান বলেই আজ বেঁচে গেলাম, অংশুবাবু! অন্য কেউ হলে…

ব্যথা পেয়েছ নিশ্চয়ই?

আমার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছিল।

ঝোঁপটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। নইলে মাথায় চোট পেতাম নির্ঘাত।

কিন্তু কী করে–?

ব্যাপারটা আর কিছুই না; রাস্তাটাকে খুঁড়ে গর্ত করে তারপর আলগা মাটি দিয়ে বুজিয়ে কিছু পাথর আর খোলামকুচি ওপরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেখেই বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। তাই বাইকটা এসে পড়তেই মাটির ভিতর ঢুকে গেছে।

বিশুদার সঙ্গে প্রায় সকলেই আমার ডাকে ছুটে এসেছে। কাণ্ড দেখে সকলের চক্ষুস্থির।

কিন্তু এরকম করল কে? প্রশ্ন করলেন সুশীলবাবু, আপনার উপর কারুর আক্রোশ আছে নাকি যে আপনাকে এভাবে টাইট দেবে?

কেষ্টদার ঘাড় আর গাল ছড়ে গিয়েছিল; আমাদের সঙ্গে ফাস্ট এড বক্স ছিল, তার থেকে ওষুধ নিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হল।

সুশীলবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোনও ধারণা আছে এ-কাজ কে করে থাকতে পারে?

কেষ্টদা বলল, তা আছে, তবে কেন সে ধারণা হয়েছে সেটা বললে অনেক কিছু বলতে হয়। আমি শুধু বলছি যে আপনাদের জগু ওস্তাদ বলে যে অভিনেতাটি আছেন, তাঁর কলকাতা যাওয়া আপনারা বন্ধ করুন।

বিশুদা দেখলাম কথাটা ভালভাবে নিল না। বলল, আপনি শুধু ওরকম বললে তো চলবে না। কেন এমন একটা ব্যাপার করতে বলছেন সেটা আমাদের জানতে হবে। আপনি কারণটা বলুন। কথা নেই। বার্তা নেই আমাদের দলের একজনের ঘাড়ে দোষ চাপালে তো চলবে না। আপনার কি তার সঙ্গে কোনওরকম ঠোকাঠুকি লেগেছিল?

কেষ্টদাকে অগত্যা সব কথাই বলতে হল। আমি এখন জানি যে, কেষ্টদার কথাই ঠিক, কিন্তু বিশুদা তার কথায় আমলই দিল না।

দেখুন, কাপ্তেন মশাই, বলল বিশুদা, জগু ওস্তাদ যে সন্ধেবেলা নেশা করে সেটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তার নামে চুরির অপবাদ কেউ কোনওদিন দেয়নি। অনেকদিন হল সে ফিল্মের লাইনে কাজ করছে, আর কাজটা সে ভালভাবেই করে এটা কেউ অস্বীকার করবে না। আপনি বোম্বাই থেকে এসে বাংলার একজন অভিনেতা সম্পর্কে এমন একটা গুরুতর অভিযোগ করবেন সেটা তো আমরা বরদাস্ত করতে পারব না। আপনি মদের দোকানে তার মুখ থেকে কী কথা শুনেছেন সেটা তো আমি মানতে রাজি নই। আপনি নিজে যে নেশা করেন না তার কী প্রমাণ?

কেষ্টদা বলল, আমি এককালে মাঝে মাঝে নেশা করতুম সেটা অস্বীকার করব না, কিন্তু একবার একটা স্টান্টে গড়বড় হয়ে যাবার পর থেকে গত পাঁচ বছরে আমি মদ ছুঁইনি। আমি যা শুনেছি তা ঠিকই শুনেছি, তাতে কোনও ভুল নেই। আজকের ঘটনাটাই প্রমাণ করছে যে আমি ভুল শুনিনি। সেটা আপনারা বিশ্বাস করেন কি না করেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। আজকের এই অ্যাক্সিডেন্টের পর আমি একবারে শিওর যে জগু ওস্তাদের কাছেই রয়েছে ওই পাথর, আর আমি তার কথা শুনে ফেলেছিলাম বলেই সে রাস্তা খুঁড়ে রেখে আমাকে খতম করার চেষ্টা করেছিল।

সুশীলবাবুকে ভীষণ চিন্তিত বলে মনে হচ্ছিল; এবার উনিই কথা বললেন—

যাই হোক, এখন আসল কথা হচ্ছে যে, এই রাস্তা দিয়ে আর বাইক চালানো যাবে কি না। শটটা তো আমাদের নিতে হবে। আর এখানেই নিতে হবে, কারণ আমরা জানি যে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা এইভাবে এই নালার উপর এসে পড়েনি।

শট নিতে কোনও বাধা নেই, বলল কেষ্টদা, ওই গর্তটাকে শক্ত মাটি আর পাথর দিয়ে ভাল করে বুজিয়ে দিলেই শট নেওয়া যাবে। ওটা প্রায় ফাঁপা ছিল বলে বাইক ওর মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।

আধঘণ্টার মধ্যে সবাই মিলে কাজ করে গর্তটাকে আবার বুজিয়ে দেওয়া হল। ঘড়িতে বলছে আড়াইটা। তা হলে এখন কি শট নেওয়া যায়?

না, যায় না, কারণ আকাশ মেঘে ভরে গেছে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। এমন কী বৃষ্টি নামলেও কিছু আশ্চর্য হবার নেই।

আমি জানি যে রোদ না উঠলে শট নেওয়া যাবে না। আমি কেষ্টদাকে একা পেয়ে তার পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, জগু ওস্তাদ কিন্তু পৌনে ছটায় সার্কিট হাউস থেকে বেরোবে। সাড়ে ছটায় ওর ট্রেন।

কেষ্টদা আমার কথার কোনও উত্তর দিল না। আমি ওর পিঠে হাত রাখলাম ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। বিশুদা ওর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে সত্যিই অন্যায় করেছে।

এবার কেষ্টদা কথা বলল, তার গলা ভারী আর গম্ভীর।

আমাকে কিছু বলতে এসো না। আমি বুঝেছি মানুষের উপকার করতে যাওয়া হচ্ছে বোকামো। বম্বে হলে লোকে আমার কথা মানত।

আমার ভয় হল যে কেষ্টদা হয়তো রেগে গিয়ে আর শটটাই দেবে না। আমি তাই বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেষ্টদা, তুমি বাকি কাজটা করবে তো?

দেখা যাক, বলে কেষ্টদা চুপ করে গেল।

বৃষ্টি এল না, কিন্তু মেঘ জমে রইল। হাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে, তাই মেঘ আর সরতেই চায় না। আমার চোখ বারবার আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে। শুধু আমি কেন, দলের সকলেই ওই একটা শট-এর অপেক্ষায় খালি খালি উপর দিকে চাইছে। সূর্যটা যে কোথায় আছে সেটা অবিশ্যি বোঝা যায়; এমনকী এক-একসময় মেঘ পাতলা হয়ে চারিদিকের আলো বেড়ে ওঠে, কিন্তু রোদ ওঠার নাম নেই। ক্যামেরাম্যানরা তাদের কাজের জন্য একটা কালো কাঁচ ব্যবহার করে, সেটা একটা ফিতে দিয়ে গলায় ঝোলানো থাকে। ধীরেশ বোস বারবার সেই কাঁচের ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে দেখছেন।

সাড়ে চারটে।

হঠাৎ দেখি কেষ্টদা বাইকটা নিয়ে হাতে করে ধরেই সেটা নালার ওপারে করে নিল, কারণ শটে ওদিক থেকেই আসবে বাইকটা। আমি মনে খানিকটা ভরসা পেলাম। মনে হচ্ছে কেষ্টদার রাগ কিছুটা পড়েছে। রাগ করবার যে যথেষ্ট কারণ ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই জানি যে শয়তানির গোড়ায় রয়েছেন জগু ওস্তাদ। নীলকান্তমণি চুরি করে বিক্রম জগু ওস্তাদকেই দিয়েছে। কেষ্টদা যে ফন্দিটা ধরে ফেলেছে সেটা জগু ওস্তাদ কোনওরকমে জেনে ফেলেছে, আর তাই বদলা নেবার জন্য গতকাল তোকজন নিয়ে এসে রাস্তাটা খুঁড়ে আলগা মাটি দিয়ে ভরিয়ে রেখে গেছে। অথচ বিশুদা কেষ্টদার কথাটা বিশ্বাস করল না। শুধু বিশুদা কেন, কেউই করল না। স্টান্টম্যান বলে কি তার কথাও বিশ্বাস করতে নেই?

ইতিমধ্যে আমি অমৃতের পোশাক পরে নিয়েছি, আর দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে কেষ্টদাও গোঁফ লাগিয়েই ইনস্পেক্টরের পোশাক পরে নিল। কেষ্টদা রেডি হবার সঙ্গে সঙ্গেই দলের চার-পাঁচজন একসঙ্গে বলে উঠল–রোদ বেরিয়েছে!

আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, সত্যিই মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যসমেত অনেকখানি নীল আকাশ বেরিয়ে গেছে। অন্তত পাঁচ মিনিট থাকবে নিশ্চয়ই।

ক্যামেরাজ রেডি?

এই হুঙ্কারটা ছাড়লেন স্বয়ং ডিরেক্টর সুশীল মিত্তির।

তিনটে ক্যামেরা তিন জায়গায় রাস্তার–দুপাশে আর নালার ধারে–বসিয়ে রাখা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এবারে তিনজন ক্যামেরাম্যান রেডি হয়ে গেলেন।

চলো মাস্টার অংশু! গম্ভীরভাবে বলল কেষ্টদা।

আমি আর কেষ্টদা মোটরবাইকে উঠে পড়লাম। ক্যামেরা স্টার্ট দিলে চেঁচিয়ে বোলো, হাঁক দিলেন সুশীলবাবু, তারপর বাইক স্টার্ট হবে।

এবারে কেষ্টদা বাইকটাকে আরও বেশ অনেকখানি দূরে নিয়ে গেল। আগেরবার কিন্তু এতদুর থেকে রওনা হয়নি। এবার কি তা হলে আরও স্পিডে বাইক আসবে? আমার সেটা কেষ্টদাকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এখন আর ওসবের সময় নেই।

সবাই রেডি? সুশীলবাবু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিন ক্যামেরাম্যান আর কেষ্টদা বলে উঠল–রেডি!

আমি ক্যারিয়ারে বসে আমার হাত দুটো কেষ্টদার কোমরের দুদিক দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়েছি।

আজ স্পিড বাড়াব, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেই বলল কেষ্টদা, শক্ত করে ধরে থাকবে। কোনও ভয় নেই।

স্টার্ট ক্যামেরা!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিন ক্যামেরাম্যান একসঙ্গে বলে উঠল–রানিং!

আর চার-পাঁচ সেকেন্ড পরেই শোনা গেল।

স্টার্ট বাইক!

গোঁ করে গর্জন করে একটা ধাক্কা দিয়ে বাইক ছুটতে শুরু করল। আজ আর আমি চোখ বুজলাম। আজ চেয়ে থাকব, সব দেখব। আগের দিনের দেড়া স্পিডে তীরবেগে চড়াই দিয়ে উঠে গেল বাইক।

এবারে সমস্ত পৃথিবীটা হঠাৎ যেন নীচে নেমে গেল।

বাইক শূন্যে উঠেছে। প্রচণ্ড হাওয়া।

শুন্য দিয়ে এগিয়ে আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।

পৃথিবী আবার উপরে উঠে এল।

এবার বুঝলাম স্পিড বাড়ানোর কারণ। গর্তটা ছাড়িয়ে শক্ত জমিতে নামবে কেষ্টদা। আমাকে পিছনে নিয়ে কোনও রিস্কের মধ্যে সে যাবে না।

একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনির সঙ্গে বাইক আবার মাটিতে এসে নামল। আমি শুনলাম বহুদূর থেকে চিৎকার ভেসে এল—

ও. কে.!

আর তারপরে আরও দুটো ও. কে.!

তার মানে তিনটে ক্যামেরাতেই শট ঠিকভাবে উঠেছে।

কিন্তু বাইক থামছে না কেন?

কেষ্টদা কোথায় চলেছে?

প্রশ্নটা মনের মধ্যে আসতেই আমি উত্তরটা পেয়ে গেলাম।

বিশুদা যাই বলুক, কেষ্টদা তার নিজের বিশ্বাসে কাজ করে চলেছে।

নালার জায়গাটা সার্কিট হাউস থেকে চোদ্দ কিলোমিটার। প্রচণ্ড স্পিডে দশ মিনিটে আজমীরে পৌঁছে একটা চৌমাথায় আসতেই একটা ট্রাফিক পুলিশের ঠিক পাশে এসে বাইকটা থামাল কেষ্টদা। তারপর পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করল থানাটা কোথায়।

পুলিশ বুঝিয়ে দিতেই বাইক ছুটল আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে। কত স্পিডে যাচ্ছে বাইক? আশি? নব্বই? আমি জানি না। শুধু জানি এত স্পিডে আমি কোনওদিন কোনও গাড়ি চড়িনি। হাওয়ার শব্দে কান প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে, গায়ের লোম খাড়া।

এই যে পুলিশ স্টেশন।

তিন মিনিটের মধ্যে ইনস্পেক্টর মাহেশ্বরীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক চিনলেন। কেষ্টদার গায়ে ইনস্পেক্টরের পোশাক দেখে ভদ্রলোক হেসেই ফেললেন।

কী চাই আপনাদের?

লোহিয়াজির পাথর, বলল কেষ্টদা, আমি জানি কোথায় আছে। একটা জিপে চলে আসুন আমার সঙ্গে। যদি দেখেন ভুল বলছি তা হলে আমাকে হাজতে পুরবেন।

হয়তো কেষ্টদার কথা বলার ভঙ্গির জন্যই মাহেশ্বরী রাজি হয়ে গেলেন।

ঠিক হ্যায়, আমি আসছি আপনার সঙ্গে।

সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে নেবেন।

ও. কে.।

বাইকে উঠেই কেষ্টদার কব্জিটা ধরে ঘুরিয়ে একবার ঘড়িটা দেখে নিলাম। ছটা বাজতে দশ। জগু ওস্তাদ স্টেশনে রওনা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

বাইরে অন্ধকার। শহরের বাতি জ্বলে গেছে।

রাস্তার ট্র্যাফিককে আশ্চর্যভাবে বাঁচিয়ে কেষ্টদা বিদ্যুদ্বেগে ছুটে চলেছে স্টেশনের উদ্দেশে। পিছনে পুলিশের জিপ। বাইকের সঙ্গে তাল রেখে সেও চলেছে ছুটে। ঘন ঘন হর্ন দিয়ে তোক সরানো হচ্ছে রাস্তার মাঝখান থেকে।

স্টেশন এসে গেছে। কটা বাজল? থানা ছাড়বার পর পাঁচ মিনিটও হয়নি।

স্টেশনের বাইরে বাইক আর জিপ পর পর থামল।

ওই যে জগু ওস্তাদ! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।

ঠিক কথা। সেও সবেমাত্র স্টেশনে পৌঁছেছে। কুলির মাথায় মাল চাপাচ্ছে অটো-রিকশা থেকে নেমে।

দ্যাট ইজ দ্য ম্যান! জগু ওস্তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মাহেশ্বরীকে বলল কেষ্টদা।

মাহেশ্বরী জগু ওস্তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন, তাঁর হাতে রিভলভার।

জগন্নাথ দে ওরফে জগু ওস্তাদ শেষ মুহূর্তে পালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। দুদিক থেকে দুই পুলিশ এসে তাকে ধরে ফেলেছিল। তার কাছেই যে মিঃ লোহিয়ার নীলকান্তমণিটা পাওয়া গেল সেটা বোধ হয় আর না বললেও চলবে। পাথর ফেরত পেয়ে মিঃ লোহিয়া এত খুশি হলেন যে, কেষ্টদাকে দু হাজার টাকা পুরস্কার দিয়ে ফেললেন। এটা যে হবে সেটা আমি জানতাম। কেষ্টদা স্টান্টম্যান ঠিকই, কিন্তু এটাও ঠিক যে এই পাথর উদ্ধার করার মতো স্টান্ট সে কোনওদিন করেনি।

সবচেয়ে আফসোস হয়েছিল বিশুদার। আপনাকে সেদিন ভুল করে কত কথা বলে ফেলেছিলাম; আশা করি আপনি অপরাধ নেবেন না।

অপরাধ আমি নিশ্চয়ই নেব না, বলল কেষ্টদা, কারণ এ ছবিতে কাজ করে, বিশেষ করে মাস্টার অংশুর সঙ্গে কাজ করে, আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি।

আমি একটা কথা বলতে চাই আপনাকে, বলল বিশুদা।

কী, বলুন!

আপনাদের তো টাইটেলে কখনও নাম যায় না–আমি কথা দিচ্ছি এবার আমাদের ছবিতে আপনার নাম বড় করে আলাদা করে যাবে।

তা হলে আমার অনেকদিনের একটা সাধ পূর্ণ হবে, বলল কেষ্টদা।

এসব কথা হচ্ছিল স্টেশনে। আমরা কাল সকালে সামান্য কয়েকটা কাজ সেরে সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা দেব; আজ কেষ্টদা বম্বে চলে যাচ্ছে, আমরা তাকে বিদায় দিতে এসেছি। কেষ্টদা এবার আমার দিকে ফিরল। তারপর তার ডান হাতটা বাড়িয়ে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, আমি তো দশ বছর হল স্টান্ট করছি, কাজটা আমার কাছে নাওয়া-খাওয়ার মতোই সহজ হয়ে গেছে; কিন্তু তুমি বারো বছর বয়সে তোমার প্রথম ছবিতেই যে সাহস দেখালে, সে স্টান্টের কোনও জবাব নেই।

কিন্তু আবার কবে দেখা হবে কেষ্টদা?

যেদিন এই ছবি রিলিজ করবে সেইদিন। মিঃ লোহিয়ার দেওয়া টাকা দিয়ে আমি নিজে টিকিট কেটে চলে আসব। নইলে বাংলা ছবি তো আর এমনিতে বোম্বাই পৌঁছবে না।

ট্রেনে হুইসল দিয়ে দিয়েছিল। একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে কেষ্টদা পাদানিতে উঠে পড়ল।

আসি, মাস্টার অংশু। ঠিকানাটা রেখে দিয়েছ তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

চিঠি লিখো।

ট্রেন ছেড়ে দিল।

নিশ্চয়ই লিখব কেষ্টদা। নিশ্চয়ই লিখব।

যতক্ষণ দেখা গেল কেষ্টদাকে ততক্ষণ সে পাদানিতে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে রড ধরে ঝুলে বাইরে বেরিয়ে অন্য হাত নাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 10 of 10 ): « পূর্ববর্তী1 ... 89 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress