০৬
পাথুরেঘাটার বাড়িটা উৎপলা নিজেই একদিন মাল্যবানের সঙ্গে গাড়িতে চড়ে দেখতে গেল। দেখে পছন্দ হল না তার। অন্য কোনো বাড়িও সুবিধেমতো পাওয়া যাচ্ছিল না। কাজেই ঠিক হল, মেজদার পরিবার এলে মাল্যবান নিজে কিছু কাল মেসে গিয়ে থাকবে।
মাল্যবান তার হাতের অবশিষ্ট ঘড়িটা, ককতগুলো সোনার বোতাম (লুকিয়ে রেখেছিল বাক্সের ভেতর) বিক্রি করে শ-চারেক টাকা উৎপলাকে দিল। সোনার নেকলেসটা তাই আর বিক্রি করতে হল না।
এই সব নানা ব্যাপারে উৎপলার মনটা খুশি হয়েছিল। এক দিন রবিবার সে মাল্যবানকে বললে, মনু অনেক দিন থেকেই বলছে চিড়িয়াখানা দেখতে খুব ইচ্ছে করে তার। আমিও তো শীগগির যাইনি। চলো-না আজ যাই।
তিন জনে ট্রামে উঠল। খিদিরপুরের ব্রিজের কাছে এসে মাল্যবান তার পরিবার নিয়ে ট্রাম থেকে নামল।
বাঃ, আলিপুর বা কোথায়, তুমি পথের মাঝখানে নেমে পড়লে যে—
এই বাজারটুকুর ভেতর দিয়ে যেতে হবে, মিনিট তিনেকের পথ।
খিদিরপুর-বাজারের পথ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে উৎপলা নাক সিটকে বললে, ছি, মুর্গি খাসী বাজারের ভেতর দিয়ে। কলকাতা শহরে কি আর পথ ছিল না!
মনু বললে, রামছাগলের বোঁটকা গন্ধ বেরুচ্ছে, বাবা। ইস, কী পেচ্ছাপের গন্ধ, ছ্যাঃ! ঐ দ্যাখ এক ছাগল কাটছে—
ও-দিকে তাকিয়ো না মনু–
আমাদের যদি একটা ছোটো অস্টিন গাড়িও থাকত, তাহলে এই নালা নর্দমা পচা কাদা আর মূতের গন্ধ কি আমাদের নাগাল পেত, মনু?
আমি বড় হলে বাবা গাড়ি কিনবে। মনু বলল।
একেবারে চিড়িয়াখানর গেটের কাছে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াত, উৎপলা বলল, সেইখানে নামতাম। উৎপলা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, কিন্তু এ নিঃশ্বাসটা চিংড়ি মাছ ঠোকরালে ফানা যেরকম করে নড়ে, তেম্নি হালকা আলতো উদ্দেশ্যহীন। চিড়িয়াখানার ভেতর ঢুকে উৎপলা বললে, এমন ঠাণ্ডা কেন গো, একেবারে হাড়গোড় কেঁপে ওঠে যেন।
শালের ভাঁজ খুলে ভালো করে জড়িয়ে নাও, পলা।
না, এ পাট-করা শালটা হাতেই থাক। শাল গায়ে দেবার মতো শীত দুপুরবেলা কলকাতায় কোথাও পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে বললে, এসব জিনিসের বাজে খরচ করতে হয় না। কেনই বা এনেছিলাম, হারিয়ে যায় যদি!
আমার হাতে দাও।
না, থাক আমার কাছে।
মনুর দিকে ফিরে উৎপলা বললে, বাঁদর দেখবি, মনু—
ঝাকড়া মাথাটা নেচে উঠল, হ্যাঁ, দেখব।
তুই নিজেই তো একটা বাঁদর। তোকে এবার খাঁচায় আটকে রাখতে হবে। মনু, তুই আমার মেয়ে হয়ে জন্মালি রে!
মাল্যবানকে বললে, চলো, বাঁদরের ঘরে যাই।
গেল সকলে মিলে সেখানে।
মনু বললে, দেখেছ মা, কলার জন্য হাত পাতছে; মা, কিনে দাও।
কলা দেবে না হাতি। যা খাচ্ছে, তাই হজম করে নিক।
কেন হজম করতে পারে না? অম্বল হয়?
উৎপলা মাল্যবানকে বললে, এ জানোয়ারগুলোর মুখ তো নড়ছেই—নড়ছেই, পেটে আলসার-টালসার হয় না?
কি জানি!
মনু খুব অনুভাবাক্রান্ত হয়ে বাঁদরের খাঁচাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল; হঠাৎ উৎপলা মেয়েটার চুলের ঝুঁটি ধরে টান মেরে বললে, তোকে এর মধ্যে পুরে দিলে বেশ ভালো হয়।
আর একবার একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বললে, মানুষের পেটে জন্মেছিলি কেন বল তো দেখি।
মাল্যবানের দিকে ফিরে উৎপলা বললে, চলো, বাঘ দেখতে যাই।
কিন্তু দুর্গন্ধে বাঘের খাঁচার থেকে অনেক পিছিয়ে রইল সে। বাঘগুলোর দিকে তাকাতেও গেল না। নাড়ি উল্টে বমি আসছিল উৎপলার। বললে, চিড়িয়াখানর ঢের হয়েছে। চলো, এখন বেরিয়ে যাই।
মনু বললে, বাঘ আমার মোটেই দেখা হল না। বাঘ দেখতেই তো এসেছিলাম চিড়িয়াখানায়।
কিন্তু, তার কথা কেউই গ্রাহ্য করল না।
মাল্যবান স্ত্রীকে বললে, এই তত এলে চিড়িয়াখানায়; এখুনি বেরিয়ে যাবে? চলো, পাখি দেখে আসি।
পাখি আবার একটা দেখে নাকি। ও তো দিনরাত দেখছি।
না, না সে রকম পাখি নয়—
পাখি আমি সব দেখে ফেলেছি। ও আমার দেখবার পিবিত্তি নেই।
কলকাতায় তো দ্যাখ কাক আর চড়াই : সরাল তিতির কাকাতয়া মাকও, কতো রকম হাঁস, বক, ফ্ল্যামিঙ্গো, ধনেশ, শামকল—দেখবে এসো—দেখবে এসো—
যে ধনেশ দ্যাখাচ্ছ তুমি দিনরাত।
আমি?
আরশোলা যেরকম কাঁচপোকা হয়, তেম্নি শামকল হয়ে যচ্ছে তো ধনেশটা— বলে ফির-ফির ফুর-ফুর ফিঃ-ফিঃ ফুঃফুঃ করে হেসে উঠল উৎপলা।
তিনজনে মিলে সিন্ধুঘোটক দেখেতে গেল।
মনু অত্যন্ত কাতর হয়ে বললে, সিংহ দেখা হল না আমার। বার-বার মরিয়া হয়ে বাপ-মাকে সে তার আবেদন জানাতে লাগল, সিংহ দেখব। সিংহ কোথায়? ঐ যে সিঙ্গি ডাকছে।
কিন্তু কেউ তার কথা কানেও তুলতে গেল না।
সিন্দুঘোটকগুলো রয়েছে একটা পুকুরের মধ্যে—ঢের নিচে। চারদিকে দেয়াল। একজন সাহেব ছুঁড়ে-ছুঁড়ে হেরিং মাছ, না, কী দিচ্ছিল তাদের। উৎপলা চেঁচিয়ে বললে, উঃ, কতো মাছ খাচ্ছে।
তা খাবে না—হাতির মতো গতর।
গা কেমন কেমন করে ওঠে যেন।
কেন?
এ যে বালতি-বালতি মাছ খেয়ে ফেলল।
তা খাবে বৈকি।
ডিসপেপসিয়া হবে না?
মাল্যবান ঠোঁট চুমড়ে একটু হেসে বললে, হ্যাঁঃ, ডিসপেপসিয়া!
মনুর মাথা দেয়ালের নিচে পড়ে থাকে; সে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। বার বার নাকি সুরে বাবা-মা-কে ডেকে বলছিল, কৈ, মাছ কোথায়? কী রকম করে মাছ খায়? কুমীরের মত নাকি সিন্ধুঘোটক? কৈ, সিন্ধুঘোটক কোথায়?
কিন্তু, রাজঘোটকে যাতের বিয়ে হয়েছিল, সেই বাপ-মা এই মেয়েটির কোনো কথা খেয়ালের ভেতর আনল না।
উৎপলার, কপালে গালে এমন সব খাঁজ ফুটে উঠল যে, কুৎসিং দেখাতে লাগল তার সুন্দর মুখটাকে বোঝা গেল, তার বয়েস হয়েছে; অবসাদে বললে এই তোমার চিড়িয়াখানা!
কেন, মন্দ কী?
নাঃ, এখানে আর কোনোদিনও আসা হবে না।
আমার তো বেশ লাগে।
দেখবার ভেতর দেখতে চেয়েছিলাম তো বাঘ আর সিংহ। তাও, বাবা, কী ভক-ভক করে গন্ধ আসে—কে এগোতে পারে!
বাঘ কেন, দেখতে হয় পাখি।
তোমার রুচি তো আমার নয়। শামকল পাখির চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখব আমি? তাহলে তো পাখিই সবচেয়ে ভালো মনে হত—সবচেয়ে ভালো লাগত শামকল পাখি—
তাহলে মন্দ হত কি? প্রতীক পৃথিবীর সে-এক আলাদা নিগুঢ়তার ভেতররে যেন দাঁড়িয়ে বললে মাল্যবান বস্তুপৃথিবীর নারীকে।
হল না তো।
আসছে জন্মে হবে।
আসছে জন্মে আবার শামকল! ওরে বাবা! উৎপলা ধড়ফড় করে কেঁপে উঠে বললে, না রে বাবা, তার চেয়ে কোনো জন্ম না পাওয়াও ভালো। জন্ম নিলে ময়ুর হয়ে উড়ে যাব আমি সেই গোরক্ষপুরের দিকে জঙ্গলে–
সেখানে সরবতী দই বিক্রি করছেন বুঝি মহলানবীশ-মশাই। বেশ, বেশ, যেয়ো। চলো, চন্দনা তিতির দেখে আসি–
মনু বললে, তিতির কী বাবা?
মাল্যবান কোনো উত্তর দিল না, উৎপলার দিকে তাকিয়ে বললে, চলো, দাঁড়িয়ে যে, চলো। ডাকপাখি, বাজ, শিকরে বাজ, খানদানী শামকল দেখে আসি সব—দেখে আসি সব।
কিন্তু একেবারেই কোনো তাড়া ছিল না উৎপলার। মাল্যবানের দিকেও তাকাতে গেল না সে। আমার একটু জিরোতে হবে রে বাবা। পা দুটো ধরে গেছে—মাজা ভেঙে গেছে—বাপরে!
তিনজনে একটা গাছের নিচে ঘাসের চাবড়ার ওপর বসল।
বসতেই উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ঘাসের ওপর যে বড় বসলে সবাইকে নিয়ে; ঐ তত বেঞ্চি ছিল।
বেঞ্চির চেয়ে ঘাসে বসতেই ভালো লাগে আমার।
ঘাসে আমার কুটকুট করে, উৎপলা বললে;-বেঞ্চিতে গিয়ে একাই বসলে সে। বসে বললে, কত লোক তো বেঞ্চিতে বসে আছে; বসতে ভালো লাগে বলেই তো। উৎপলা নিজের মনেই তারপর বললে, এত সব লোক চারদিকে; তাদের সঙ্গে বেশ তো খাপ খায় আমার, অথচ ঘরের মানুষদের সঙ্গেই ষাঁড়াষাড়ির কোটাল। ঘাসে গা ছড়ে যায়, আমার শাড়ি নোংরা হয়, মুচি-মোচলমানের চন্নামৃতে গড়াগড়ি খেতে হয়—অথচ ঘেসুড়ে সেজে বসেছেন সব ওঁরা-ঘাস!—ঘাস না হলে হবে না। আঁটি আঁটি ঘাস বাঁধবে না-কি তোমরা বাপ-বেটিতে মিলে কথা বলে যেতে লাগল উৎপলা–
মাল্যবানের থেকে উৎপলা হাত দশেক দুরে একটা বেঞ্চিতে বসেছিল, কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই মাল্যবানের মনে হতে লাগল: এইটুকু ব্যবধান ঘোচাতে হলে—সত্যিই যদি ঘোচাতে পারা যায়-উৎপলার তরফ থেকে আহ্বান আসবে না কোনো দিন। তা ছাড়া, বেঞ্চিতে তো ঘাসের ভেতরে ঘাস নয় : মনু আর আমি ঘাস—ঘাসের ঢেউয়ে; বেঞ্চিটা ঘাসগাছের কাঠেও তৈরি নয়—ধানগাছের কাঠেও নয়; সে রকম কাঠ নেই কোথাও; কেঠো কাঠ আছে; এত ঘাস থাকতে কী ভীষণ কেঠো কাঠের বেঞ্চি চার দিকে সব।
উপলা বললে, চলো, এই বেলা বেরিয়ে পড়ি; প্রকাশবাবুর আজ সন্ধ্যের সময়ে আসার কথা ছিল।
পাখি দেখবে না?
আমি সিংহ না দেখে যাব না। মনু বললে।
আচ্ছা, ঐ যে একটা টেবিলের চারদিকে বসে কয়েকটি লক্কা মেয়ে চা খাচ্ছে, ওরা কারা?
চিনিনা তো, দেখিনি কোনো দিন। মেয়েদের দিকে না তাকিয়েইমাল্যবান বললে।
কেমন এক বিঘৎ পেট বার করে শাড়ি পরেছে; কেমন কানের পাশে জুলপি ঝোলাবার কায়দাটুকু। নিশ্চয়ই আইবুড়ো এরা সব। বাস্তবিক, যার বিয়ে করেনি, তাদেরই রগড়— বলে উৎপলা মুখ ফিরিয়ে চোখ দিয়ে গিলতে লাগল যেন মেয়ে কটিকে।
মাল্যবানের ভালো লাগল না। ওদের দিকে চোখ দিয়ো না, বাপু। ওরা চা আর স্কোন খাচ্ছে। কেন চোখ লাগাচ্ছ পলা।
মাল্যবান কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে ঘাসের শিষের সাদার দিকে তাকিয়ে রইল; কিছুক্ষণ মনুর কোঁকড়া চুল নিয়ে খেলা করল; তারপর উৎপলার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখল, তেম্নি করেই মেয়ে, কটির দিকে গোগ্রাসে চেয়ে আছে সে।
এখানে এসে বোসসা তুমি—এই নরম ঘাসে।
চলো, এখন উঠি।
কোথায় যাবে?
এখানে বসে কী আর লাভ।
তোমার পা ব্যথা করছে, বলছিলে—চা খাবে?
না। ব্যথা কমে গেছে।
চলো-না, ঐ মেয়েদের পাশে আর-একটা টেবিল খালি আছে–
না, তুমি আমাকে আর এক দিকে নিয়ে চলো। মেয়ে কটির দিকে পিছন ফিরে হাঁটতে-হাঁটতে উৎপলা বললে,ভেবেছিলাম, আজ কপালে সিঁদুর-টিপ পরে আসব না—
কেন?
সব সময়ই এ-সবের কী দরকার।
হ্যাঁঃ, রেওয়াজ উঠে গেছে,মাল্যবান বললে, ওসব টিপ-টাপ ফেঁদে কী হবে।
যদি না সিঁদুর ধেবড়ে আসতাম, তাহলে এই মেয়েরা কী মনে করত, বলো তো দেখি–
মাল্যবান একথা সে-কথা ভাবছিল, বললে, মনে করত একটা কিছু। মনে করার বালাই নিয়ে মরি আমি।
তোমাকে হয়তো মনে করত আমার মেসো কিংবা মামাশ্বশুর—
আমাকে যদি ওরা তোমাদের বাড়ির খাজাঞ্চি কিংবা সরকার মনে করতে পারত, তাহলে হয়তো খানিকটা লাভ ছিল—
মাল্যবান হাঁটতে হাঁটতে একটা চোরকাটা ছিড়ে খড়কে বানিয়ে বললে, সেই যে বিলেতে গিয়ে মাখন ভোলা শিখে এসেছে—সব সময়ে সাহেবি পোশাকে থাকে, সাহেবি করে বেড়ায় সেই যে মাখন তোলার সাহেব আমাদের মতীন চৌধুরী গো—তাকে যদি সঙ্গে করে আনতে পারতে, তাহলে তোমাকে ওরা ছো-ছো করে চিলের চোখ দিয়ে দেখে নিত বটে। ওদের ঐ রকমই তো স্বভাব। আমার মত ধনকৃষ্ণের সঙ্গে চিড়িয়াখানা রোঁদ দিতে এসেছ-এ আবার একটা দেখবার কী। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখবে কে!
মতীন চৌধুরী কে?
আহা, বললাম যে বিলেত থেকে মাখন তুলতে শিখে এসেছে।
দুধের থেকে মাখন তুলতে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাখন তোলার সাহেব—
তার সঙ্গে আমি চিড়িয়াখানায় আসতাম—মানে?
এম্নি বলছি—কথার কথা—
তুমি বড্ড বেকুব।
আমি একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছিলাম—
কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে চলছিল না তারা কোন দিকে যাচ্ছিল খেয়াল ছিল না, এম্নি শীতের বিকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল চিড়িয়াখানার চিলতি-চিলতি মাঠ ঘাসের ভেতর-রাস্তায়-বেরাস্তায়।
তোমার মাইনে তো আড়াই শো হল। রিটায়র করবার আগে কতো হবে?
দু শো পঁচাত্তার–তিন শো—
এর বেশি না?
না।
উৎপলা ভাবছিল। চিন্তার মাঝপথে থেমে বললে, আড়াই শো টাকা মাইনেতে কি গলাবন্ধ কোট ছাড়া আর কিছু পরা যায় না?
কেন যাবে না? ধুতি-পাঞ্জাবি পরা যায়। আজকাল অনেকেই তো তা পরছে।
তা নয়, আমি বলছিলাম হ্যাট-টাইয়ের কথা। কেন পর না তুমি? পরলে মানায় না বটে তোমাকে। কেমন যেন খাপছাড়া দ্যাখায়! এরকম হল কেন?
কেন হল? মাল্যবান তার হাতের ঘাসের শিষটা দাঁত দিয়ে কাটতে-কাটতে বললে, চিনি মিষ্টি, আর নুন নোতা কিনা উৎপলা—সেই জন্য হল।
খানিকটা দুর নিঃশব্দে এগোল তারা। মনুর কথায় কেউ কান দেয় না, নালিশ কেউ শোনে না, সেই জন্য সে অনেকক্ষণ থেকেই চুপ মেরে গিয়েছিল।
উৎপলা বললে, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি—কেমন দ্যাখাচ্ছে তোমাকে-চেঁচে এলে না কেন?
হঠাৎ তোমরা সকলে বললে, চিড়িয়াখানা দেখবে—সময় পেলাম কোথায়?
তাই তো! কী দিয়ে চাঁচবে—জিনিস পাবে কোথায়!
দাড়ি যারা সত্যিই চাচে, প্রথম পক্ষের মাগীকে শ্মশানে পোড়াতে পোড়াতে গালে হাত বুলিয়ে নেয়—
তাই নেয় বুঝি।
দাড়িটা কামানো হল কি না দেখে নেয়।
চিড়িয়াখানার থেকে বেরুচ্ছে না কিছু দেখছে না—বসছে না কোথাও—পায়চারি করার মতো আস্তে-আস্তে হাঁটছে—ঘাসের ওপর দিয়েই বেশি। কোথায় চলছে—কেন চলেছে—খেই-খেয়াল না হারালেও শুধোচ্ছে না কেউ কাউকে। মনু কোনো কথা বলছিল না। তার পা টাটাচ্ছিল বুক ধড়ফড় করছিল, জিভ শুকিয়ে আছে অনেকক্ষণ। কিন্তু তার কোনো কথায়ই কেউ সাড়া দেয় না, সায় দেয় না বলে কাউকেই সে কিছু বলতে পারছিল না। মনু খানিকটা পিছে পড়ে গিয়েছিল; তার জন্য দুজনে খানিকক্ষণ থেমে দাঁড়াল। মনু এল।
মাল্যবান ঠিক উৎপলার মনের মতো ঠাটে পা ফেলে হাঁটতে পারছিল না। পা দুটো কিছুতেই আড় ভাঙতে চায় না যেন, উৎপলা যা চায় মাল্যবানের পায়ে—পদক্ষেপে সে সৌন্দর্য, মাত্রা, দৃঢ়তা কিছুতেই ধরা পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে তারা বাঘের ঘরের কাছে এসে পড়ল আবার। খাঁচার ওপর থেকে থপাস-থপাস করে ছুঁড়ে কাচা মাংস দেওয়া হচ্ছিল জানোয়ারগুলোকে
কী রকম করে এরা মাংস খায়, দেখবো এসো।
উৎপলা মাথা নেড়ে বললে, এখন বেরিয়ে যাব।
হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে উৎপলা বললে, আমার দাদা মেজদা ছোড়দা এ-রকম নয়। কখনো ন্যাং ন্যাং করে হাঁটে না তারা।
সামনে তাকিয়ে দেখল দুটো মস্ত হাতি দাঁড়িয়ে রয়েছে-আশে পাশে অনেক ডাল পালা কেটে রাখা হয়েছে, হাতিগুলো ক্রমাগত শুড় দিয়ে সেগুলো টেনে টেনে খাচ্ছে। মনু বললে, দেখলে বাবা, কী রকম শুড় দিয়ে কলা টেনে নিয়ে মুখের মধ্যে ফেলে দ্যায়।
একটি মুসলমান ছেলে কলা দিচ্ছিল—পাঁচ-ছ-টা হাতি, কিন্তু কলা মাত্রর দশ-বারোটা; কিন্তু হাতিগুলোর হায়া আছে, নিয়ম মেনে চলাটা দেখবার মতো; পাশাপাশি কটাতে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কেউ কারু ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে না, যার কপালে যেটুকু প্রসাদ পড়ছে, তাই নিয়েই তৃপ্ত; তারপর ডালপালার দিকে মন।
মাল্যবান বিমুগ্ধ হয়ে দেখছিল; বললে, মানুষের চেয়ে জীবনটাকে এরা বেশি বোঝে। জীবনের কষ্ট ও একঘেয়েমি সহ্য করবার ক্ষমতাও এদের চীনের বা ভারতের জ্ঞানবিষ্ণুদের মতো। বাস্তবিক, হাজার দুহাজার বছর আগে এরা ভারতে চীনে সমাজের বড়-বড় জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখেছে শুনেছে রক্ষা করেছে—ধর্ম কর্মের বিধান দিয়েছে বলে মনে হয়।
শুনে উৎপলা কোনো সান্ত্বনা পেল না। হাতির কুলোর মতো কান ও বুড়ো দিদিমার মতো মুখ দেখে কেমন যেন কৌতুক, অসাধ, নিরেস অস্বস্তি বোধ করছিল সে। বললে, থাক, অনেক হয়েছে; এখন চলো।
হাঁটতে হাঁটতে মাল্যবান বললে, একবার বেরিয়ে গেলে ঢুকতে পারবেনা কিন্তু আর।
আমি ঢুকতে চাইও না আর। এ-জায়গায় কোনো দিনও আর আসা হবে বলে মনে হয় না।
চলো, ছোলা কিনে নিয়ে কাকাতুয়ার ঘরে যাই; দানা খাবে আর পড়বে কা-কা-তু-য়া।
এক-আধটা পাখি বেশ পড়ে। সবগুলোই পারে?
পড়ালেই পারে। চলো।
থাক।
নানা রঙের কাকাতুয়া আছে, বেশ পশমের মতো পালক; ডানার দিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন আগুনের থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ওদের সব—আগুনের ভেতর খেলা করছে সব—আগুনে আগুনে খেলা করে একদিন আকাশে নীলিমায় মিলিয়ে যাবে-চলো—চলো—
উৎপলা দাঁড়িয়ে রইল; আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললে, ঐ তো টেবিলটা, সেই মেয়ে চারটি ওখানেই বসেছিল? ওখানে?
মাল্যবান কিছু বলবার আগে উৎপলা বললে, কোথায় গেল তারা?
চলে গেছে।
চিড়িয়াখানার ভেতরে কোথাও তো তাদের দেখলাম না।
এত তাড়াতাড়ি বেরুল যে?
ঢুকেছিল আমাদের ঢের আগে। দেখাশোনা মজা-মারা হয়ে গেল-বসে থাকবে কেন। বেশ্যের ছেলের অন্নপ্রাশন কি সারাদিন বসে খাবে?
মাল্যবানের অন্নপ্রাশনের কথাটা কোনো কথা নয়; একবার দাঁত দিয়ে চিবিয়ে চোয়াল শক্ত করে কথাটা তারপর ঝেড়ে ফেলে দিল উৎপলা; বললে, দেখলাম, মেয়ে কটির প্যাচে প্যাচে বেশ জিলিপির রস। হাত তুলে ফুর্তি করছে। আগা-পাস্তলা মিঠিয়ে ঝিকিয়ে কী ফুৰ্ত্তির তোেড়—সারাটা সময়; কেঁসে যাচ্ছে না তো—আমার ও-রকম হয় না তো।
বেঁচে যেতে বুঝি ওদের মতো ফুৰ্ত্তি করতে পারলে?
হলে কেমন হত? একটা বীতকাম নিঃশ্বাস ছেড়ে উৎপলা বললে।
ফুৰ্ত্তি মানে আমোদ—
আমোদ বলছ তুমি—
সত্যিকারের আমোদ–
মানে, আনন্দ?
মাল্যবান ঘাসের ওপর পিছ কেটে বললে, ওঃ, ঐ সব মেয়ে! ওরা তো ছেনাল—আনন্দ-আমোদের ইস্টকুটুম আমার সব। ওদের কথা ভাবে মানুষে! ওদের খাঁটিয়ে আবার কথা বলোমাল্যবান দাঁত-মুখখিচিয়ে পিচকাটল ঘাসের ওপর আবার।
তবে কী; ছাগল দিয়ে ধান মাড়িয়ে দশ মুখ করে সেই ছাগলের কথা বলে বুঝি?
চলতে-চলতে মাল্যবান থেমে গেল।কোথায় যেতে চাচ্ছ তুমি?
এবারে চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে যাব। উৎপলা বলল।
আমি তা বলছি না। তুমি রাখালী করে ধান খেতে চাচ্ছ তো ছাগলকে সরিয়ে। দিয়ে। ঐ মেয়েগুলোর মতো পাটে এসে বসতে চাচ্ছ তো—
কে না চায় পেতে বসবার পাট। কিন্তু দেবার ভার তো শামকলের ওপর নয়। মনু, এদিকে আয়। কেউ কারু ওপর বরাত দিতে পারে না। ধনেশ পাখি ঠোঁট কেলিয়ে বসে থাকবে—মাড়োয়ারী কবে তার তেল নিতে আসবে, সেই জন্যে-চন্দনা নিজের পাটে উড়ে যাবে। মনু!
মাল্যবান চিড়িয়াখানার থেকে বেরিয়ে যাবার গেট এড়িয়ে অন্য পথ ধরে চলতে লাগল। উৎপলা বুঝতে পারল না। অনেকক্ষণ হোঁটে বললে, কৈ, এ-গোলক ধাঁধা ফুরোয় না দেখছি।
বেরুতে চাও?
মনু কোথায় গেল—
চলো ঘুরি।
ঘোরো তুমি।
তুমি কী করবে?
একা তো বেরিয়ে যেতে পারবে না। কাছে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে চোখ বুজে বসল উৎপলা।
পা টাটাচ্ছে?
একটা খালি বেঞ্চি—আলগোছে তার এক কিনারে বসে পড়েছে। উৎপলা—একটা হাত তার বুকে—আর একটা কোলের ওপর ভাটার টানে সমুদ্র সরে গেলে ভিজে ঝিনুক, পরগাছার ঠাণ্ডার মতো করুণ হয়ে পড়ে আছে। খানিকক্ষণ এদিক সেদিক উঁচু উঁচু গাছের মাথায় আকাশের মেঘ আলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন কেমন একটা অন্তিমপ্রতিম অর্থ অবধান করে তারি কাছে শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে নিজেকে নির্বিশেষে ছেড়ে দিল উৎপলা; একটু কাৎ হয়ে ডান হাতের ওপর মাথা পাতল; চোখ বুজে এল।
মনুও ঘাসের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে।